১৭. সেনা পরিষদ এবং সেনা বাহিনীর স্বৈরশাসনের বিরোধিতা

সপ্তদশ অধ্যায় – সেনা পরিষদ এবং সেনা বাহিনীর স্বৈরশাসনের বিরোধিতা

  • সেনা পরিষদ গঠিত হল।
  • জনগণের প্রত্যাশাকে জলাঞ্জলি দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করার সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
  • কুখ্যাত আত্রাই অপারেশন।
  • এ্যন্টিস্মাগলিং অপারেশনকালে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সরকারি দলের আসল চরিত্র অনুধাবন করতে পারেন।
  • সেনা বাহিনীর সফলতায় চোরাচালনের মাত্রা যখন কমে আসছিল তখন দলীয় চাপের মুখে শেখ মুজিব সেনা বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যাবার নির্দেশ দিলেন।
  • জনগণ এবং সেনা বাহিনী ঐ আদেশে হতাশ হয়ে পড়ে।
  • কর্নেল জিয়াউদ্দিন তার সাড়া জাগানো নিবন্ধ ছাপালেন।
  • শেখ মুজিবের ক্ষমা প্রস্তাব প্রত্যাখান করে চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে সর্বহারা পার্টিতে তিনি যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন।
  • কর্নেল তাহেরকে সেনা বাহিনী থেকে অব্যাহতি দিয়ে ড্রেজার অর্গানাইজেসনে নিয়োগ করা হল।
  • গণবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেন কর্নেল তাহের।
  • স্বৈরাচার যখন খোলা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির সব পথ বন্ধ করে দেয় তখনই রাজনীতিতে বেজে উঠে অস্ত্রের ঝনঝনানি।
  • ১৯৭৩ এর এপ্রিল মাসে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং দুঃস্কৃতিকারী দমন অভিযানের জন্য সামরিক বাহিনীকে আবার তলব করতে বাধ্য হয় মুজিব সরকার।
  • অপারেশনে ধরা পড়ল সরকারি দলের অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা ও রুই- কাতলা।
  • ক্রোধে ফেটে পড়লেন প্রধানমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দল।
  • প্রধানমন্ত্রীর হুকুম তামিল করে আটককৃত দুঃস্কৃতিকারীদের প্রায় সবাইকেই ছেড়ে দিতে হল স্বয়ং জেনারেল শফিউল্লাকেই।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত সব অফিসারদের ইতিমধ্যে সেনা বাহিনীতে পুনর্বাসন করা হয়। শেখ মুজিবর রহমানের বিশেষ আস্থাভাজন এ সমস্ত অফিসারদের একটি অংশ শেখ সাহেবের চোখ ও কান হিসাবে সেনা বাহিনীর উপর নজর রাখছিল। প্রভাবশালী এই মহলটির করুণা পেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ এগিয়ে নেবার জন্য তাদের দালালি করতে তখন অনেকেই নীতি বিসর্জন দিয়ে তাদের এজেন্ট হয়ে যান। এদের মাধ্যমে সেনা বাহিনীর সব খবরা-খবর শেখ মুজিবের কান অব্দি পৌঁছে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হল।

সেই সময় এদের চোখে ধুলো দিয়ে আমরা কিছু তরুণ অফিসার উদ্যোগ নেই ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং মত বিনিময়ের মাধ্যমে সচেতন দেশপ্রেমিক ও সমমনা ব্যক্তিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি অঘোষিত সংগঠন গড়ে তোলার। প্রতিষ্ঠিত হয় সেনা পরিষদ। সেনা পরিষদ সরকারের প্রতিটি নীতিও পদক্ষেপ সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ থাকত। প্রতিটি পদক্ষেপ এবং ইস্যুর চুলচেরা বিশ্লেষন করে জাতীয় পরিসরে এবং সামরিক বাহিনীর উপর এসমস্ত নীতি পদক্ষেপের প্রভাব এবং প্রতিক্রিয়া কি হবে অথবা হতে পারে সে বিষয়ে অধিনস্ত সৈনিকদের বুঝিয়ে বলা হত সেনা পরিষদের তরফ থেকে। সৈনিকদের সচেতনতার মান বাড়িয়ে তোলার জন্যই এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম আমরা। সরকারি নীতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে দৃষ্টি রাখা ছাড়া দেশ ও জাতির ভবিষ্যত নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করত সেনা পরিষদ। কি হচ্ছে, কি হওয়া উচিত, কি উচিত নয় বিভিন্ন জাতীয় সমস্যা এবং সম্ভাব্য সমাধান প্রভৃতি বিষয়ে নিয়মিত আলোচনা করা হত সেনা পরিষদের ষ্টাডি সার্কেলগুলোতে। সবকিছুই করা হত অতি সর্তকতার সাথে, গোপনে। বেসামরিক আমলা, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি মহলের দেশপ্রেমিক সচেতন সদস্যদের সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিভিন্ন সূত্রে যোগাযোগ রক্ষা করে মত বিনিময় করতেন সেনা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সদস্যরা। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিভিন্ন স্তরের অনেকের সাথেও যোগাযোগ ছিল সেনা পরিষদের। আন্তরিকভাবে নিয়মিতভাবে খবরা-খবর আদান-প্রদান এবং খোলামেলা মত বিনিময়ের ফলে ক্ষেত্র বিশেষে অনেকের সাথে সেনা পরিষদের সদস্যদের সম্পর্ক নিবিড় হয়ে উঠে। সেনা বাহিনীর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও সেনা পরিষদের সদস্যরা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হন। অনেকের সাথে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বও গড়ে উঠে। আলোচনাকালে অনেকেই মত পোষণ করেন- জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে জনগণকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে বাচাবার সংগ্রামে সেনা বাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশকে অগ্রণী হয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার দায়িত্ব নিতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই।

তাদের এ ধরণের বক্তব্যের জবাবে সেনা পরিষদের তরফ থেকে বলা হত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জনগণের মুক্তি সংগ্রামকে এগিয়ে নেবার জন্য কিছু করণীয় থাকলে সে দায়িত্ব যেকোন ত্যাগের বিনিময়ে পালন করতে প্রস্তুত রয়েছে সেনা পরিষদ তবে সেনা পরিষদের যে কোন ভূমিকাই হবে সহায়ক শক্তি হিসেবে সংগ্রামকে এগিয়ে নেবার লক্ষ্যে: নিজেদের ক্ষমতা দখলের জন্য নয়। তৃতীয় বিশ্বে রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা কিংবা সামাজিক অস্থিরতার সুযোগে সেনা বাহিনীর ক্ষমতা দখল এবং রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ার ফলে কোন দেশেই গণতান্ত্রিক সুষম সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি; প্রতিষ্ঠিত হয়নি মানবিক অধিকার। একমাত্র সুষ্ঠ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্ভব সার্বিক আর্থ-সামাজিক মুক্তি অর্জন আর এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্বের দায়িত্ব অবশ্যই নিতে হবে পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের। এটাই ছিল সেনা পরিষদের দৃঢ় বিশ্বাস।

১৯৭২ সালের শেষের দিকে হঠাৎ করে কর্নেল তাহেরকে কমান্ড থেকে সরিয়ে ঢাকায় হেডকোয়াটার্স এ বদলি করা হয়। কর্নেল তাহেরকে কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়ার প্রধান কারণ ছিল তার নিখাদ দেশপ্রেম এবং গণমুখী চিন্তা-চেতনা। আমাদের উপরও নজর রাখা হচ্ছিল; সেই বিষয়টিও পরিষ্কার হয়ে গেল কর্নেল তাহেরের বদলির মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধে কর্নেল তাহের তার একটি পা হারান। বদলির কারণ হিসেবে খোঁড়া যুক্তি দেয়া হল তিনি পঙ্গু তাই ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে তাকে রাখা যায় না; তার জন্য ষ্টাফ পদই উপযুক্ত। মেজর জলিল ইতিমধ্যে বেকসুর খালাস পাবার পর সেনা বাহিনীর চাকুরী থেকে পদত্যাগ করে জাসদ গঠন করেছেন। দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। আওয়ামী লীগ সরকারের গণবিরোধী রূপ ক্রমশঃ প্রকাশ হয়ে পড়ছে তাদের বিভিন্ন নীতি ও কার্যক্রমে। অপশাসন ও শোষণের সীমাহীন নিষ্পেষনে জনগণের প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির ফলে জীবনের নিরাপত্তার অভাব সমাজকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। অর্থনৈতিক অব্যবস্থা ও অবাধ লুটপাট এবং চোরাচালানের ফলে বেঁচে থাকা হয়ে উঠছে দুঃর্বিষহ। সবকিছু মিলিয়ে দেশ এক চরম নৈরাজ্যে পরিণত হয়েছে আওয়ামী সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা এবং ব্যর্থতায়। সরকারি শোষণের বিরুদ্ধে মাওলানা ভাসানী ভারত থেকে ফিরেই সরকার বিরোধী আন্দোলনে অবতীর্ণ হন। তার নেতৃত্বে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোও সরকার বিরোধী আন্দোলনে তৎপর হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বিরোধী দলগুলো বলে যে, দেশ স্বাধীন হয়নি। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ভারতের প্রতি বিদ্বেষ জনগণের মনে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয়ী বাংলাদেশীদের আশা-আকাংখায় ভাটা পড়তে শুরু করে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভারতের স্বার্থেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল; দালাল আইন প্রত্যাহার এবং হাজার হাজার রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটির সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন শেখ মুজিবের মহানুভবতা বলে প্রচার করা হলেও আসলে দেশপ্রেমিকদের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ শক্তি হিসাবে এদের দাঁড় করানোর জন্যই এ ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছিল। পরবর্তিকালে ধর্ম ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন এবং সরকারি গুরুত্বপুর্ণ পদে তাদের বহাল করার জন্য শেখ মুজিবর রহমানই দায়ী। দেশদ্রোহিতায় অভিযুক্ত, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও বুদ্ধিজীবি নিধনের সাথে জড়িত অপরাধীদের দেশের প্রচলিত আইনে বিচার না করে তাদের ক্ষমা করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছিলেন শেখ মুজিবর রহমান; জনগণের প্রত্যাশা জলাঞ্জলী দিয়ে।

দেশের সার্বিক অবস্থার দ্রুত অবনতির সাথে সাথে যেখানেই বিরোধী দলগুলো সরকার বিরোধী আন্দোলনে জনগণকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছিলেন সেখানেই চরম হিংস্রতায় হায়নার মত আওয়ামী সরকার তাদের উপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে তাদের সমূলে উৎপাটন করার চেষ্টা চালায়। ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি জনাব ওহিদুর রহমান ও টিপু বিশ্বাসের নেতৃত্বে বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীরা আত্রাই, পাবনা, রাজবাড়ি জেলার কিছু কিছু জায়গায় বেশ তৎপর হয়ে উঠে। শেখ মুজিব তাদের দমন করার জন্য তার বিশেষ প্রিয়ভাজন কর্নেল শাফায়াত জামিলকে (তৎকালীন রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার) হুকুম দিলেন তাদের নির্মূল করার জন্য। নেতার ব্যক্তিগত অনুকম্পা লাভের জন্য কর্নেল শাফায়াত জামিল অন্ধের মত আত্রাই অপারেশনে ঝাপিয়ে পড়লেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পরামর্শে ঐ সমস্ত এলাকা থেকে সমর্থ ছেলে মেয়েদের ধরে এনে কোন রকম তদন্ত এবং বিচার ছাড়াই তাদের মেরে ফেলার এক জঘণ্য খেলায় মেতে উঠলেন তিনি। তার এই অন্যায় তৎপরতার বিরোধিতা করে তারই ব্রিগেড মেজর ক্যাপ্টেন নূর চৌধুরী। শাফায়াত জামিলকে ষ্টাফ অফিসার হিসাবে নূর বোঝাতে চেষ্টা করেছিল যে, শেখ সাহেবের প্রতি তার অন্ধ আনুগত্য থাকলেও এভাবে ব্যক্তি স্বার্থে নিষ্ঠুরের মত ছেলে মেয়েদের মেরে ফেলা অন্যায় এবং অযৌক্তিক। এ ধরণের পাশবিকতার জন্য নিজের বিবেকের কাছেই তিনি একদিন দায়ী হয়ে পড়বেন। অযুক্তিক এই হত্যাযজ্ঞের ভাগীদার হওয়া ক্যাপ্টেন নূরের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ক্যাপ্টেন নূরের এ পরামর্শ সেদিন কর্নেল শাফায়াত জামিল গ্রহণ করেননি। ফলে ক্যাপ্টেন নূর বাধ্য হয়ে নিজের উদ্যোগেই হেডকোয়াটার্সে পোষ্টিং নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। আত্রাই অপারেশনের সাফল্যের জন্য শেখ মুজিব পুরষ্কার স্বরূপ কর্নেল শাফায়াতকে পরে ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করেন। সামরিক বাহিনীর অফিসার ও সদস্যদের বদলি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজেদের অনুগত রাখার নীতি গ্রহণ করে মুজিব সরকার। এমনকি কৃতি ও জনপ্রিয় অনেক সামরিক অফিসারকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান এবং বিদেশের দূতাবাসে নিয়োগ করার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছিল আওয়ামী সরকার। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের আগে অবৈধ চোরাচালানের ফলে রিলিফ বিতরণের ক্ষেত্রে চরম অরাজকতার সৃষ্টি হয়। বাধ্য হয়ে সরকার চোরাচালান দমন করার জন্য সেনা বাহিনীকে নিয়োগ করে। সেনা বাহিনীর তরুণ মুক্তিযোদ্ধা অফিসার এবং সদস্যরা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে চোরাচালান বন্ধ করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাদের আন্তরিকতা অল্পসময়ের মধ্যেই জনগণের মনে আশার সঞ্চার করে। এই অপারেশনের নাম ছিল ‘অ্যান্টি স্মাগলিং অপারেশন’। আমরা সমমনা সবাই সিদ্ধান্ত নেই যদিও তখনো আমরা সুগঠিত নই তবুও যেকোন ত্যাগের বিনিময়েই আমাদের দায়িত্ব পালন করে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটাব। এ সুযোগের পূর্ণ সদ্বব্যবহার করতে হবে আমাদের। এই অপারেশন করার সময়ই তরুণ অফিসার এবং সৈনিকগণ ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ও টাউট বাটপারদের অসৎ চরিত্র এবং সম্পদ গড়ে তোলার লোভ-লালসার অভিলাষ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করতে সমর্থ হন। রাজনৈতিক নেতাও টাউটদের সঙ্গে তারা মুখোমুখি দ্বন্দ্বে আসার সুযোগ পান। আমরা অপারেশন কমান্ডার হিসাবে প্রতিজ্ঞা করি পেটের ক্ষুধার তাড়নায় যে ট্রাক ড্রাইভার কিংবা পোর্টার বোঝা বয়ে চোরাচালানের সামগ্রী বর্ডারের ওপারে নিয়ে যাচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের ধরেই ক্ষান্ত হব না, আমাদের প্রচেষ্টা হবে চোরাচালানের মূল ব্যক্তিদের জনসম্মুখে প্রকাশ করা। ক্ষমতাবলয়ের ঐ সমস্ত অসাধু রুই-কাতলাদের উম্মোচন করা: যারা পর্দার অন্তরালে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জাতীয় সম্পদের চোরাচালানের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে জনগণের লাশের উপরে। অল্প সময়েই জানা গেল সব সীমান্তে চোরাচালানের মূলে রয়েছে ভারতের একটি প্রভাবশালী মারোয়াড়ী গোষ্ঠি এবং সরকারি দলের ক্ষমতাশালী মন্ত্রী ও নেতারা। শেখ মুজিবের কনিষ্ঠ ভ্রাতা শেখ আবু নাসের, স্বরাষ্টমন্ত্রী মনসুর আলী তদীয় পুত্র নাসিম, বন ও মৎস্য মন্ত্রী সেরনিয়াবাত তদীয় পুত্র হাসনাত। গাজী গোলাম মোস্তফা সরাসরিভাবে ঐ মারোয়াড়ী চক্রের সাথে জড়িত বলেও তথ্য পাওয়া যায় বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রে এবং সরেজমিনে তদন্তের ফলে। সব ঝুঁকি কাঁধে নিয়ে আমরা তাদের চরিত্র এবং দুঃষ্কর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরতে থাকি জনগণের কাছে। অফিসার এবং সৈনিকরা পরিষ্কার বুঝতে পারেন দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল এবং নেতারাই হচ্ছে দেশের দুর্গতির মূল উৎস। তাদেরই যোগসাজসে লুটেরারা দেশ ও জাতিকে দেউলিয়া করে তুলছে। সেনা পরিষদের প্রচারণা এবং সরকার সম্পর্কে সংগঠনের মূল্যায়নের সত্যতা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে যাচাই করার সুযোগ পান সেনা সদস্যরা। তারা বুঝতে পারেন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই চাকুরী ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেনা পরিষদের নেতৃত্ব এবং সদস্যরা তাদের সচেতনতা বাড়াবার জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়েই সবকিছু করছিলেন। এর ফলে সেনা পরিষদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাও বেড়ে গিয়েছিল। এভাবেই সেনা বাহিনীতে সেনা পরিষদের ভাবমুর্তি এবং জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। অ্যান্টি স্মাগলিং অপারেশন সম্পর্কে একটা ঘটনার কথা পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি। এ থেকেই তৎকালীন সরকারের চরিত্র সম্পর্কে তারা ধারণা করতে পারবেন। দিনাজপুরের অপারেশন কমান্ডার একদিন ঢাকায় কন্ট্রোল রুমে খবর পাঠাল, চারজন মারোয়াড়ী স্মাগলার আর্মির ভয়ে ঢাকায় গিয়ে জনাব মনসুর আলীর ছেলে নাসিমের সাহচর্যে তার বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে আত্মগোপন করে আছে : ঢাকায় সিদ্ধান্ত নেয়া হল, জনাব মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাও করে মারোয়াড়ীদের গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু আর্মি হেডকোয়াটার্সের হস্তক্ষেপে ঢাকার এরিয়া কমান্ডার জনাব মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাও করার সিদ্ধান্ত বাদ দিতে বাধ্য হন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চাপের মুখেই আর্মি হেডকোয়াটার্স থেকে এ ধরণের হস্তক্ষেপ হয়েছিল। ঐ ঘটনার পর সরকার আর্মির তৎপরতা সম্পর্কে উদ্বিঘ্ন হয়ে উঠে। অপারেশনের ফলে একদিকে সেনা বাহিনীর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে সরকার ও তার দলের মুখোশ উম্মোচিত হয়ে পড়ায় ক্ষমতাসীনরা বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এই অবস্থায় কি করা উচিত সেটা ভেবে উভয় সংকটে পড়ল সরকার ও সরকারি দল। এই অবস্থাতেও দাতাগোষ্ঠির চাপে সরকার বাধ্য হয়ে সামরিক বাহিনীকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিল খাদ্যসামগ্রী দেশের সকল অঞ্চলে সময়মত পৌঁছে দেবার। সেনা বাহিনী শুরু করল ‘অপারেশন ফুড: এই অপারেশনেও অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করে সেনা বাহিনী তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগের মাধ্যমে। এই অপারেশন আর্মির হাতে দেয়ায় ভীষণ অসন্তোষ দেখা দেয় সরকারি দলের মাঝে। কারণ তাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছিল প্রতিক্ষেত্রে। সব পর্যায়ে দলীয় স্বার্থের পরিপন্থী এই সমস্ত অপারেশন বন্ধের জন্য প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করা হল প্রধানমন্ত্রীর উপর। তিনি দলীয় স্বার্থের খাতিরে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে অবিলম্বে সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যাবার নির্দেশ দেন। এতে জনগণের মনে দারুণ ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। সেনা বাহিনী বাধ্য হয়ে ব্যারাকে ফিরে আসে। সরকার প্রধানের এ ধরণের পক্ষপাতিত্যের ফলে সেনা বাহিনীর সদস্যরা হতাশ হয়ে পড়েন। এই পরিস্থিতিতে কর্নেল জিয়াউদ্দিন (ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার) অভিমত প্রকাশ করেন, “বর্তমান সরকারের অধিনে সামরিক বাহিনীতে থেকে জনগণের স্বার্থে কাজ করা সম্ভব নয়। সরাসরিভাবে সরকারের বিরোধিতা করাও সম্ভব নয়। তাই সরকারি অপশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের মাঝ থেকেই গড়ে তুলতে হবে দুর্বার প্রতিরোধ সংগ্রাম।” তার অভিব্যক্তিতে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পেলাম। তিনি সক্রিয় রাজনীতির কথা ভাবছেন। তার অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে সেনা পরিষদের মনোভাব ছিল তার বক্তব্য অবশ্যই যুক্তিসম্পন্ন। সরকার বিরোধী আন্দোলনকে বিজয়ের চুড়ান্ত পর্যায়ে এগিয়ে নেয়া সম্ভব জনগণের রাজনৈতিক আন্দোলনে গতিশীলতা সৃষ্টি করেই। মূলতঃ এ দায়িত্ব পালনের ভার দেশপ্রেমিক এবং জাতীয়তাবাদী দল ও নেতৃত্বের উপর। তবে আমরাও সেনা বাহিনীর ভেতরে অবস্থান করেও জনগণের আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারব যদি নিজেদের সংগঠিত করতে পারি।

১৯৭২ সালের গ্রীষ্মকালে সাপ্তাহিক হলিডে-তে কর্নেল জিয়াউদ্দিন তার সাড়া জাগানো নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এ নিবন্ধের মাধ্যমে তিনি সরাসরি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতি ক্ষমতাসীনদের বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনেন। তিনি তার নিবন্ধে লেখেন, “Independence has become an agony for the people of this country. Stand on the street and you see purposeless. spiritless. lifeless faces going through the mechanics of life. Generally, after a liberation war, the new spirit carries through and the country builds itself out of nothing. In Bangladesh, the story is simply other way round. The whole of Bangladesh is either begging or singing sad songs or shouting without awareness. The hungry and poor are totally lost. The country is on the verge of falling into the abyss.”

নির্ভিক এই মুক্তিযোদ্ধা এই নিবন্ধে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পচিশ বছরের গোপন চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি সর্বপ্রথম তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের উল্লেখ করে তিনি বলেন, “We fought without him and won. If need be we will fight again without him.”

শেখ মুজিবর রহমান সে সময় লন্ডনে গলব্লাডার অপারেশনের পর সুইজ্যারল্যান্ডের এক স্বাস্থ্যনিবাসে অবস্থান করছিলেন। কর্নেল জিয়াউদ্দিনের লেখা দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে জানতে পেরে তড়িঘড়ি করে তিনি দেশে ফিরে এলেন। কর্নেল জিয়াউদ্দিনের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক কষ্টের এবং ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা নিয়ে যে কোন ষড়যন্ত্রের বিরোধিতা করতে আবার প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে দ্বিধাবোধ করবেন না তারা। তার এই লেখা থেকে দেশবাসী প্রথম পরিষ্কারভাবে জানতে পারেন, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। প্রমাদ গুনলেন আর্মি চীফ শফিউল্লাহ। তিনি জিয়াউদ্দিনকে হাতে-পায়ে ধরে অনেক মিনতি করেছিলেন যেন শেখ সাহেব ফিরে এলে ছাপানো নিবন্ধের জন্য তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। কারণ শফিউল্লাহ বুঝতে পেরেছিলেন কর্নেল জিয়াউদ্দিনের লেখা রাজনৈতিক মহলে বিশেষ করে তরুণ ও ছাত্রসমাজ এবং সেনা বাহিনীতে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সেনা বাহিনীতে কোন প্রকার বিষ্ফোরন যাতে না ঘটে তার জন্যই মিনতি জানিয়েছিলেন তিনি। শেখ মুজিব দেশে ফিরে বিষ্ফোরম্মুখ অবস্থার গুরুত্ব উপলব্দি করতে পেরে জেনারেল শফিউল্লাহকে জিজ্ঞেস করেন কি করে অবস্থার সামাল দেয়া যায়? শফিউল্লাহ শেখ সাহেবকে জানালেন, নিবন্ধ ছাপানোর পর কর্নেল জিয়াউদ্দিনের ভাবমুর্তি তরুণ অফিসার এবং জোয়ানদের মধ্যে আরো বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় কর্নেল জিয়াউদ্দিনের প্রতি কোন কঠিন ব্যবস্থা নেয়া হলে আর্মির মধ্যে আকস্মিক বিষ্ফোরন ঘটে যেতে পারে। শেখ মুজিব তার মোড়লী বুদ্ধি দিয়ে ঠিক করলেন কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে ডেকে কিছু বকাবকি করে তাকে দিয়ে কৌশলে মাফ চাইয়ে নেবেন। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে বলা হল জেনারেল সফিউল্লাহকে। গণভবনে জিয়াউদ্দিনকে নিয়ে এলেন শফিউল্লাহ। প্রধানমন্ত্রীর ঘরে ঢুকে স্যালুট করে দাড়াতেই গর্জে উঠলেন শেখ মুজিব, “তুমি কোন সাহসে এ ধরণের নিবন্ধ ছাপালে? জানো, তোমার অপরাধ রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমান? সামরিক বাহিনীতে চাকুরীরত অবস্থায় এ ধরণের লেখা ছাপানো বেআইনী। আমি তোমাকে এ ধরণের গুরুতর অপরাধের জন্য কঠিন শাস্তি দিতে পারি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তোমার বিশেষ অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে এবারের মত তোমাকে আমি মাফ করব যদি তুমি শফিউল্লাহকে লিখিতভাবে দাও যে, তুমি অন্যায় করেছ।” একনাগাড়ে বলে গেলেন শেখ মুজিব। সবকিছুই চুপ করে শুনলেন কর্নেল জিয়াউদ্দিন। তিনি জবাব দিলেন, “শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী। আপনার দয়া-দাক্ষিণ্য আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। কারণ আমি কোন অন্যায় করিনি আমি যা লিখেছি সেটা আমার বিশ্বাস। অতএব, ক্ষমা চাওয়ার কিংবা ক্ষমা পাওয়ার কোন অবকাশ নেই এখানে। আপনি ঠিকই বলেছেন যে, চাকুরীতে থাকাকালীন অবস্থায় এ ধরণের লেখা ছাপানো অন্যায়। তাই আমি আমার কমিশনে ইস্তফা দিয়েই আমার নিবন্ধ ছেপেছি।” এভাবেই সেদিন শার্দূল সন্তান কর্নেল জিয়াউদ্দিন শেখ মুজিবকে স্তম্ভিত করে দিয়ে গণভবন থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তার বেরিয়ে আসার পর শফিউল্লাহকে শেখ মুজিব অনুরোধ করেছিলেন জিয়াউদ্দিনকে বোঝাবার জন্য। হেডকোয়াটার্সে ফিরে এসে জেনারেল শফিউল্লাহ, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ প্রমুখ অনেকেই কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। জিয়াউদ্দিন তাদের চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন তার শাণিত জবাব দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, নিজের আত্মার সাথে বেঈমানী করতে পারবেন না সামান্য চাকুরীর লোভে। তাছাড়া তাদের মত মেরুদন্ডহীন কমান্ডারদের অধিনে একই সংগঠনে তাদের অধিনস্ত হয়ে চাকুরী করে তিনি তার আত্মসম্মান খোয়াতে রাজি নন। এভাবেই সেনা বাহিনীতে ইস্তফা দিয়ে তিনি পরে সর্বহারা পার্টিতে যোগদান করেন। এ ঘটনার কিছুদিন পর অন্যায়ভাবে কর্নেল তাহেরকে সেনা বাহিনী থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাকে ড্রেজার অর্গানাইজেশনের পরিচালক পদে নিয়োগ করা হয়। এই নতুন পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর কর্নেল তাহের জাসদের সশস্ত্র গোপন সংগঠন ‘গণবাহিনী’ গড়ে তোলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেনা বাহিনী থেকে তাকে বের করে দেবার পরও আমাদের যোগসূত্র ছিন্ন হয়নি কখনো। আমরা আমাদের স্ব স্ব অবস্থানে থেকে একই লক্ষ্যে কাজ করে যেতে থাকি। লক্ষ্য একটাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন। গণতান্ত্রিক সুষম সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধশালী এবং মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে সাহায্য করা। আমাদের মাঝে আদর্শগত বন্ধন এত সুদৃঢ় ছিল যে, আমরা বিশ্বাস করতাম জাতীয় মুক্তির বৃহৎ স্বার্থে যেকোন ক্রান্তিলগ্নে আমরা সবাই এক হয়ে লড়তে পারব নির্দ্বিধায়।

১৯৭৩ সালে জাতীয় নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী হল আওয়ামী লীগ। কিন্তু দেশের অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না। সার্বিক অবস্থার অবনতির গতি দ্রুততর হল মাত্র। মরিয়া হয়ে উঠলেন সরকার; রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার প্রচেষ্টায়। সরকারি দলের লক্ষ্যহীনতা ও নৈরাজ্যিক কার্যকলাপের মুখে বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলি, বিশেষ করে বিরোধী দলগুলি এবং সামগ্রিকভাবে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি নিক্ষিপ্ত হল এক সংকটময় পরিস্থতির মধ্যে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি শাসিত যে কোন দেশেই কোন বিশেষ একটি দল দেশের শাসনতন্ত্রকে দলীয় সম্পদ মনে করে না। সেখানে শাসনতন্ত্রের প্রতি অনুগত দুই বা ততোধিক রাজনৈতিক দল থাকে। ক্ষমতার হাত বদল হয় সে সমস্ত দলগুলোর মধ্যেই। জাতীয় স্বার্থের মৌলিক বিষয়ের প্রশ্নে তারা একে অপরের সহযোগিতা করে থাকে। এই সহযোগিতার ভিত্তিতেই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে যেখানে সরকার নিজের স্বার্থের সাথে রাষ্ট্রের স্বার্থকে এক করে দেখেছে সেখানে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ মোটেই সম্ভব নয়। বিরোধী দলগুলো অনৈক্য এবং অন্যান্য কারণে আওয়ামী লীগের বিকল্প শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারছে না। তাদের উপর নিষ্পেষন চালিয়ে আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে সেখানে বিরোধী দলগুলো ভবিষ্যতে কখনো পর্যাপ্ত শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে কিনা সে বিষয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এই প্রক্রিয়া আওয়ামী লীগকেও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেবে না। যেভাবে সরকারি দল আইনের শাসনের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির সব নীতি বিসর্জন দিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে উঠে-পড়ে লেগেছে তাতে অদূর ভবিষ্যতেই দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে স্বৈরাচার। স্বৈরাচার যখন খোলা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশের সব দরজা বন্ধ করে দেয় তখনই স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দানা বেঁধে উঠে রাজনৈতিক গোপন তৎপরতা। রাজনীতিতে বেজে উঠে অস্ত্রের ঝনঝনানি। রাজনৈতিক বিরোধিতা রূপ নেয় সশস্ত্র সংগ্রামের।

১৯৭৩ সালের ১১ই নভেম্বর বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলনে শেখ মুজিবের ভাষণই এর বড় প্রমাণ। তিনি ঐ ভাষণে বলেন, “যারা রাতের বেলায় গোপনে রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, সাধারণ মানুষকে হত্যা করে তাদের সঙ্গে ডাকাতদের কোন পার্থক্য নেই। কেউ যদি নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করতে পারে তাহলে আমাদেরও তাদের গুলি করে হত্যা করার অধিকার আছে।” (বঙ্গবার্তা ১২ই নভেম্বর ১৯৭৩) ইতিহাসের লিখন যে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান অস্ত্রের জোরে বিরোধীদের শায়েস্তা করার চেষ্টা করেছেন তার পতনও ঘটেছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অস্ত্রের মুখেই।

ঐ একই দিন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মাওলানা ভাসানী রাজশাহীর এক জনসভায় বলেন, “সরকার যেভাবে বিরোধী দলীয় কর্মী হত্যা করা শুরু করেছে তার ফলে এ দেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ বন্ধ হতে চলেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে কোন সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ করা যাবে না। দমন নীতি এবং মানুষকে হত্যা করে দেশ শাসন করা যায় না। আইয়ূব খান-ইয়াহিয়া খানের পতন হয়েছে অতীতে; এ ধরণের দমন নীতি চলতে থাকলে এ সরকারের পতনও অবশ্যম্ভাবী। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নাও। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি এবং বিরোধী দল ছাড়া কোন গণতান্ত্রিক সরকার বেচে থাকতে পারে না।” (১২ই নভেম্বর ১৯৭৩) রাজনৈতিক কর্মী নিধনের ব্যাপারে জাসদের বক্তব্য ছিল একই রকম। সরকার এবং বিরোধী পক্ষের বক্তব্য থেকে যে জিনিষটা স্পষ্ট হয় তাহল আজকের বাংলাদেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পরিবেশ আছে সেটা কেউই স্বীকার করছেন না। উভয় পক্ষই একমত যে, দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে।

বাংলাদেশের শান্তি-শৃংখলা ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকে রক্ষা ও পরিচালনার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর বক্ত্যবের দু’টি বিষয় এখানে বিশেষভাবে প্রাণিধানযোগ্য। প্রথমত: তিনি বিরোধী দলীয় কর্মীদের ‘ডাকাত’ বলে অভিহিত করছেন। দ্বিতীয়ত: সে সমস্ত ডাকাতদের গুলি করে হত্যা করার অধিকারও তার রয়েছে বলে দাবি করছেন। বিরোধী কর্মীদের চোর, ডাকাত, দেশদ্রোহী, ক্রিমিনাল আখ্যা দেয়ার রেওয়াজ সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু হয়েছিল। ১৯৫০ সালে নূরুল আমীন বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দকে ‘ডাকাত দলের সরদার’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। রাজশাহীর ‘ছাপড়া-ওয়ার্ডে’ নাচল বিদ্রোহের রাজবন্দীদের গুলি করে মারা এবং ইলা মিত্রকে পুলিশ কর্তৃক ধর্ষণকেও সরকার তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে দাবি করেছিলেন। ১৯৭০ সালে যখন রাজবন্দীদের মুক্তির জোর দাবি উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তানে তখন স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া খানও পূর্ব পাকিস্তানের সব রাজনীতিবিদদের ‘ক্রিমিনাল’ আখ্যায়িত করেছিলেন এবং তাদের মুক্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করেছিল নূরুল আমীন এবং ইয়াহিয়া খানের দোসররাই ছিল প্রকৃত ক্রিমিনাল। বিরোধী পক্ষকে চোর,ডাকাত ইত্যাদি বলে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টার ফল কি দাড়ায় সেটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অজানা থাকার কথা নয়। পাকিস্তানের রাজনীতিতে এ বিষয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও রয়েছে প্রচুর। কিন্তু দীর্ঘদিনের সেই শিক্ষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব শেখ মুজিবর রহমানের দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে চোর-ডাকাত আখ্যা দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ যে সুগম করছেন না সেটা বলাই বাহুল্য। বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতি বিরাজমান সে অবস্থায় সরকার এবং বিরোধী দলসমূহ যে দাবি করছে তাতে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অবক্ষয় অবধারিত।

১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে দেশের এক নাজুক পরিস্থিতিতে দিশেহারা মুজিব সরকার নেহায়েত অনোন্যপায় হয়ে আবার সেনা বাহিনীকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং দুষ্কৃতিকারী দমন করে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধনের জন্য তলব করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কুমিল্লা সেনা নিবাসের ব্রিগেড কমান্ডার তখন কর্নেল নাজমুল হুদা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত ছিলেন কর্নেল হুদা। সেই সুবাদে কিংবা অন্য যেকোন কারণেই হোক শেখ মুজিবের প্রতি অন্ধ ভক্তি ছিল তার। তবে এ বিষয়ে সুশিক্ষিত কর্নেল হুদার মনে দ্বন্দ্বও ছিল যথেষ্ট। একই সাথে যুদ্ধ করেছি আমরা। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আমাকে ভীষণ আপন করে নিয়েছিলেন। আমাদের সম্পর্ক এত নিবিড় হয়ে উঠেছিল যে আমরা রাজনীতি নিয়ে অবাধে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা করতাম। আমার স্পষ্টবাদিতায় অনেক সময় তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়তেন। অনেক সময় বড় ভাইয়ের মত উপদেশ দিতেন বেফাঁস কথাবার্তা বলে আমি যাতে নিজেকে বিপদে না ফেলি। তার আন্তরিকতায় আমি তাকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করতাম। অপারেশন অর্ডার আসার পর আমি হুদা ভাইকে একদিন বলেছিলাম ‘৭২ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। তিনি নিজেও সে বিষয়ে ওয়াকিফহাল ছিলেন ঠিক করা হল চীফ অফ স্টাফকে অনুরোধ জানানো হবে যাতে তিনি সশরীরে কুমিল্লায় এসে অপারেশন সম্পর্কে সবকিছুই বিস্তারিত খুলে বলেন। এতে করে আমরাও জানার সুযোগ পাবো এবার সরকারের উদ্দেশ্য কি? প্রধনমন্ত্রী কি এবার সত্যিই তার ‘চাটার দল’ ছেড়ে জনগণের কল্যাণ চান? এর জন্যই কি তিনি আমাদের সাহায্য চাইছেন? সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেনারেল শফিউল্লাহকে কর্নেল হুদা কুমিল্লায় আসার অনুরোধ জানালেন। এলেন জেনারেল শফিউল্লাহ। কনফারেন্সে তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, “ ৭২ সালের মত সেনা বাহিনীকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে নাতো এবারও?” তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “This time ‘Banga Bandhu means business. If even his dead father is found to be implicated in any crime then his body could be exhumed for trial. No exception this time whatsoever. This is what he told me personally and I have no reason to disbelieve him.” খুবই ভালো কথা। শেখ মুজিব এবার সত্যিই চিনতে পেরেছেন তার সরকার ও দলকে। তিনি তাদের অন্যায়ের প্রতিকার চান। এদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃত অর্থে জননেতা হবার জন্য দেশপ্রেমিক সেনা বাহিনীর সাহায্য চাইছেন তিনি। তার এই প্রচেষ্টায় অবশ্যই আমরা ‘আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে তাকে সাহায্য করব সব ঝুঁকি হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে; সে কথাই দেয়া হয়েছিল জেনারেল শফিউল্লাকে। অপারেশনকে যেকোন মূল্যে সফল করে তুলবো আমরা। খুশি মনেই ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। কুমিল্লা ব্রিগেডকে দায়িত্ব দেয়া হল কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং সিলেটে অপারেশন পরিচালনার : আমাকে কর্নেল হুদা (হুদা ভাই) কুমিল্লা অপারেশনের দায়িত্ব দিলেন। সিলেট এবং নোয়াখালীর দায়িত্ব দেয়া হল মেজর হায়দার এবং মেজর রশিদকে। Combing Operation শুরু হল। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রিপোর্ট থেকে জানা গেল সব সেক্টরে আওয়ামী লীগ এবং দলের অঙ্গ সংগঠনগুলোর কাছেই রয়েছে বেশিরভাগ অবৈধ অস্ত্ৰ। প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়াতেই নিরাপদে রয়েছে ঐসব অস্ত্র এবং অস্ত্রধারীরা তাতে কি? এবার মুজিব তার মরা বাপকেও ছাড়তে রাজি নন। আমরা যার যার এলাকায় সব প্রস্তুতি শেষে অপারেশন শুরু করলাম। সব জায়গায়ই খবর পাওয়া যাচ্ছিল এলাকার যত দাগী লোক, অবৈধ অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী, খুনী, লুটেরাদের মাথা হল আওয়ামী লীগের নেতারা কিংবা নেতাদের পোষ্য মাস্তানরা। সব জায়গাতেই আবার আমাদের সরকারি দলের নেতারাও তাদের তৈরি সন্ত্রাসীদের নামের তালিকা দিয়েছিলেন। কিন্তু তদন্তের ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তাদের দেওয়া তালিকাভুক্ত লোকেরা প্রায়ই এলাকায় সৎ এবং নীতিবান বলে পরিচিত। অবশ্য তাদের মধ্যে অনেকেই সরকার বিরোধী রাজনীতির সাথে জড়িত কিংবা সমর্থক ছিলেন। আমাদের দায়িত্ব হল দুঃস্কৃতিকারীদের ধরা সে যেই হোক না কেন। দল বিশেষের প্রতি আমাদের কোন পক্ষপাতিত্ব নেই। আমাদের কাজ হচ্ছে নিরপেক্ষ থেকে আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাওয়া। ধর-পাকড় করা হল অপরাধীদের স্থানীয় বেসামরিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো এবং প্রশাসনের সহায়তায়। যারা ধরা পড়েছিল তাদের বেশিরভাগই হোমরা-চোমরা চাঁই এবং নেতা-নেত্রীরা। সংসদ সদস্যা মমতাজ বেগম থেকে কুমিল্লার জহিরুল কাইউম কেউই বাদ পড়লেন না। সিলেট, নোয়াখালী, খুলনা, বরিশাল এবং দেশের অন্যান্য জায়গাতে আর্মির হাতে ধরা পড়ল শেখ নাছের, হাসনাত প্রমুখ অনেক নামী-দামী নেতারা। সব জায়গায় একই উপাখ্যান। এলাকার দুষ্কৃতিকারীদের বেশিরভাগই সরকার ও সরকারি দলের লোকজন। এই অপারেশনের সময় সেনা বাহিনীর সদস্যরা সরাসরিভাবে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-পাতি নেতাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। আমি অপারেশনের ফলে সারাদেশে চমক সৃষ্টি হল। লোকজন ভাবল শেখ মুজিব আর্মির সাহায্যে ‘চাটার-দল’ এর সন্ত্রাস ও দুর্নীতির হাত থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচাবার চেষ্টা করছেন। ফলে সবখানেই জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন আমি অপারেশনে সাহায্য করতে। কয়েকদিনের দেশব্যাপী অভিযানের ফলে সন্ত্রাস কমে গেল অস্বাভাবিকভাবে। জনগণের মনে আশা ফিরে এল। দুঃশাসনের ফলে নির্জীব হয়ে পড়া জাতির মধ্যে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হল। ধরা পড়া সবার বিরুদ্ধেই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হল। কারো ব্যাপারেই কোন ব্যতিক্রম করা হল না। যদিও বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল থেকে এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকেও অনেকের ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হচ্ছিল অনবরত। কিন্তু আমরা আমাদের নীতিতে সবাই অটল। কারো ব্যাপারে কোন বাহু-বিচার করা হবে না। আইন সবার জন্যই সমান। হঠাৎ সেনা সদর থেকে কয়েকজন আটক অপরাধীকে ছেড়ে দেবার জন্য নির্দেশ পাঠালেন জেনারেল শফিউল্লাহ। কর্নেল হুদা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন কাউকে ছেড়ে দেওয়া তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। কারণ শুধুমাত্র আইনই এখন তাদের ভাগ্য নির্ধারন করতে পারে। আইনকে নিজের হাতে নেবার কোন অধিকার তার নেই। ব্রিগেড কমান্ডারের এই জবাব জেনারেল শফিউল্লাহ প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন। কর্নেল হুদার কাছে ফোন এল প্রধানমন্ত্রীর। কর্নেল হুদা বিনীতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করলেন প্রধানমন্ত্রী যেন তার রাজনৈতিক সচিব জনাব তোফায়েলকে পাঠিয়ে দেন চীফের সাথে সরেজমিনে অবস্থার তদন্ত করার জন্য। তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় যে আর্মি কারো প্রতি কোন অবিচার কিংবা অন্যায় আচরণ করেছে সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর যেকোন শাস্তিই তিনি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত আছেন Area Commander হিসাবে। প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন যখন আসে তখন দৈবক্রমে আমিও Control Room এ উপস্থিত ছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর ফোন তাই আমি রুম থেকে বের হয়ে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু কর্নেল হুদার নির্দেশেই রুমে থেকে যেতে হয়েছিল আমাকে। কর্নেল হুদার চারিত্রিক দৃঢ়তা সেদিন আমাকে মুগ্ধ করেছিল। নেতার প্রতি তার অন্ধ আনুগত্য এবং শেখ মুজিবের অতি বিশ্বাসভাজনদের একজন হয়েও কর্নেল হুদা (গুডু ভাই) এ ধরণের জবাব প্রধানমন্ত্রীকে দেবেন সেটা সত্যিই আমি ভাবতে পারিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন অতিসত্ত্বর তিনি লোক পাঠাচ্ছেন তদন্তের জন্য। সেদিনই হেলিকপ্টারে করে এসে পৌঁছালেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। জনাব তোফায়েলকে কিছুতেই তিনি সঙ্গে আনতে রাজি করাতে পারেননি। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ জনাব তোফায়েল কুমিল্লায় এলে সবকিছু বিস্তারিত জানার পর মাথা হেট করে ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন গত্যান্তর থাকত না তার। জেনারেল জিয়ার আগমণের পর কুমিল্লাসহ অন্য সব জেলার শীর্ষ নেতাদের যারা তখনও বাইরে ছিলেন তাদের সবাইকে সেনা নিবাসে আমন্ত্রণ জানানো হল এক মধ্যাহ্ন ভোজে। ভোজপর্ব শেষে একে একে সব ধৃত ব্যক্তিদের কেন এবং কোন চার্জে ধরা হয়েছে; প্রমাণাদিসহ তার বিশদ বিবরণ দিলেন Operation Commander-রা। কেউ কোনকিছুর প্রতিবাদ করতে পারলেন না। জেনারেল জিয়া কর্নেল হুদা এবং আমাকে সঙ্গে করে একই হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় সেনা সদরে ফিরে এলেন। সেখান থেকে জেনারেল শফিউল্লাহকে সঙ্গে করে আমরা গেলাম ৩২নং ধানমন্ডিতে শেখ সাহেবের সাথে দেখা করতে। সেখানে পৌঁছে দেখি প্রধানমন্ত্রী এবং জনাব তোফায়েল আহমদ আমাদের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন। ঘরে ঢুকতেই কর্নেল হুদা এবং আমাকে দেখা মাত্র শেখ মুজিব গর্জে উঠলেন,

—কি পাইছস তোরা? আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশে আর কোন দুষ্কৃতিকারী নাই? জাসদ, সর্বহারা পার্টির লোকজন তোদের চোখে পড়ে না? অবাক হয়ে গেলাম কি বলছেন প্রধানমন্ত্রী। কর্নেল হুদা জবাব দিলেন.

—স্যার আমরা আপনার নির্দেশে অপারেশন করছি প্রকৃত দুস্কৃতিকারীদের ধরার জন্য। আমরা নির্দলীয়। আমাদের কাছে সবাই সমান। বিভিন্ন এজেন্সীর দেয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে এবং আমাদের নিজস্ব এজেন্সী দিয়ে ঐ সমস্ত রিপোর্ট ভেরিফাই করার পরই আমরা এ্যাকশন নিয়েছি। ধৃত ব্যক্তিদের বেশিরভাগই যদি আওয়ামী লীগার হয় তাতে আমাদের দোষ কোথায়? কথা বাড়তে না দিয়ে জনাব তোফায়েল কয়েকজনের নাম করে তাদের অবিলম্বে ছেড়ে দিতে বললেন। তাকে সমর্থন করে আমাকে উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বললেন,

—যা হবার তা হইছে। এখন এদের ছাড়ার বন্দোবস্ত কর। জবাবে আমি বললাম,

—ধরার বা ছাড়ার মালিক আমরা নই স্যার। চীফের মাধ্যমে আপনার নির্দেশই কার্যকরী করেছি আমরা। ধরার হুকুম দিয়েছিলেন আপনি: ছাড়ার মালিকও আপনি তবে এ বিষয়ে আইন কি বলে সেটা আমার জানা নেই। ছেড়ে দেয়াটা যদি আইনসম্মত মনে করেন তবে হুকুম জারি করে আইন সংস্থাকে বলেন তাদের ছেড়ে দিতে। আমরা তাদের ছাড়বো কিভাবে? তারাতো এখন আমাদের অধিন নয়। সবাই এখন রয়েছে আইনের অধিনে। আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে। আমার জবাব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জেনারেল শফিউল্লাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলে উঠলেন,

—বাজান। কিছু একটা কর নাইলে দেশে আওয়ামী লীগ একদম শ্যেষ হইয়া যাইবো। জেনারেল শফিউল্লাহ প্রধানমন্ত্রীর ‘বাজান’ সম্বোধনে বিগলিত হয়ে দাড়িয়ে পড়ে প্রায় হাতজোড় করে বললেন,

—স্যার। আপনি অস্থির হবেন না। আমি অবশ্যই একটা কিছু করব। আপনি আমার উপর ভরসা রাখতে পারেন। কথাগুলো শেষ করে বসতেও ভুলে গিয়েছিলেন সেনা প্রধান। প্রধানমন্ত্রীর ইশারায় আবার নিজের আসনে বসলেন জেনারেল শফিউল্লাহ। আমরা সবাই নিশ্চুপ বসে থেকে তার মোসাহেবীপনার কৌতুক উপভোগ করছিলাম কিছুটা বিব্রত হয়ে। After all he is our Chief? ইতিমধ্যে জনাব তোফায়েল শেখ সাহেবের কানে কানে নীচুস্বরে কিছু বললেন। তার কান পড়ায় হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী বলে উঠলেন,

—কুমিল্লার ক্যাপ্টেন হাই, ক্যাপ্টেন হুদা, ‘লেফটেন্যান্ট তৈয়ব, সিলেটের লেফটেন্যান্ট জহির এর বিরুদ্ধে এ্যাকশন নিতে হইবো। তারা বন্দীদের উপর অকথ্য অত্যাচার করছে। হুদা ভাইকে উদ্দেশ্য করেই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন শেখ মুজিব।

—স্যার ওরা সব জুনিয়র Subordinate officer. ওরা যা করেছে সেটা আমার হুকুমেই করেছে। অত্যাচারের অভিযোগ সত্যি নয়। এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তার পরেও যদি ওদের শাস্তি দিতে চান তবে সেটা সবার আগে আমারই প্রাপ: : আমাকে ডিঙ্গিয়ে জুনিয়র অফিসারদের শাস্তি দিলে সেটা আমার জন্য অপমানকর হবে সেক্ষেত্রে কমান্ডার হিসাবে অধিনস্থ সব অফিসার এবং সৈনিকদের কাছে আমি আর ফিরে যেতে পারব না। কর্নেল হুদার জবাবে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ত্রস্তে উঠে দাড়ালেন তিনি এবং বললেন,

—ঠিক আছে : আইজ তোরা যা. ডালিম তুই রাইতে খাইয়া যাইস। আমাকে রেখে বাকি সবাই চলে গেলেন। শেখ সাহেব ও আমি বাড়ির অন্দর মহলে ঢুকলাম। রাত তখন প্রায় ১১টা। যথাযথ নিয়মে বারান্দায় খাওয়া পরিবেশন করা হল। খেতে খেতে শেখ সাহেব বললেন,

—তুই থাকতে কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের এই দশা অইলো ক্যান?

—চাচা বিশ্বাস করেন: আমরা কোন দল দেখে অপারেশন করিনি। চীফ কুমিল্লায় এসে আমাদের বলেছিলেন এবার নাকি আপনি আপনার মরা বাপকেও ছাড়বেন না। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করেছি। আপনি একবার কুমিল্লায় গিয়ে দেখেন লোকজন কি খুশী। সবাই মনে করছে এবার আপনি সত্যিই চাটার দল এবং টাউট বাটপারদের শায়েস্তা করতে চাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে নেতা হিসাবে জনগণের মনোভাবকেই তো আপনার প্রাধান্য দেয়া উচিত। আমিতো মনে করি আমাদের এই অপারেশনের পর আপনার জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে গেছে। এখন যেকোন কারণেই আপনি যদি এদের ছেড়ে দেন তবে কি আপনার লাভ হবে? আমারতো মনে হয় ক্ষতিই হবে আপনার। আপনার পরামর্শদাতারা যে যাই বলুক না কেন আমার মনে হয় বিনা বিচারে কাউকেই ছাড়া আপনার উচিত হবে না। এতে ব্যক্তিগতভাবে আপনিই ক্ষতিগ্রস্থ হবেন সবচেয়ে বেশি।

—কিন্তু পার্টি ছাড়া আমি চলমু কেমনে? প্রশ্ন করলেন শেখ সাহেব।

—পার্টি আপনার অবশ্যই প্রয়োজন। মনে করেন না কেন এটা একটা শুদ্ধি অভিযান খারাপদের বাদ দিয়ে সৎ এবং ভালো মানুষদের নিয়েওতো পার্টি চালানো যায়। কিছু মনে করবেন না চাচা: চোর, বদমাইশ, সন্ত্রাসী, লুটেরা, টাউট-বাটপারদের নেতা হিসাবে পরিচিত হওয়াটাকি আপনার শোভা পায়? যারাই ধরা পড়ছে তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগার। তার মানে বর্তমানে আপনার দলে ভালো লোকের চেয়ে খারাপ লোকজনই বেশি। এদের বাদ দেন। দেখেন লোকজন কিভাবে আপনাকে সমর্থন জানায়। চুপ করে শুনছিলেন আমার কথা। মুখটা ছিল থমথমে। খাওয়ার পর পাইপ টানার অভ্যাস তার, পাইপটা টেবিলের উপর পরে থাকলেও আজ তিনি সেটা ধরাননি। চিন্তিত অবস্থায় হঠাৎ করে বলে উঠলেন,

—বাঙ্গালী জনগণরে খুব ভালো কইরা চিনি আমি।

বুঝলাম না তিনি এই উক্তিতে কি বোঝাতে চাইলেন। কিছুক্ষণ পর শোবার ঘরে উঠে চলে গেলেন শেখ সাহেব। ওখানে তার কোন আত্মীয় অপেক্ষা করছিলেন। আমিও উঠতে যাচ্ছিলাম হঠাৎ কামাল এসে উপস্থিত।

—বস দিলেনতো আওয়ামী লীগ শেষ কইরা। কাজটা ভালো করেন নাই। উত্তর দিলাম,

—সব criminals and badelements যদি আওয়ামী লীগার হয় তার জন্য আমরা দায়ী না। সারা দিনের ধকলে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম তাই কথা না বাড়িয়ে চলে এসেছিলাম ৩২নম্বর থেকে। বাসায় ফিরে দেখি আব্বা আমার ফেরার অপেক্ষায় তখনও জেগে বসে আছেন। বুঝতে পারলাম কুমিল্লা থেকে নিম্মী ফোন করে আমার ঢাকায় আসার খবর বাসায় জানিয়েছে।

আব্বা জিজ্ঞেস করলেন কি হল? সবকিছুই খুলে বললাম তাকে। সব শুনে তিনি বললেন, “তোরা কি ভেবেছিলি? শেখ মুজিব সত্যিই অপরাধীদের ধরার জন্য তোদের মাঠে নামিয়েছে? আমি ওকে ভালো করে চিনি। যখন এসএম হলে জিএস ছিলাম তখন একসাথে মুসলীম লীগের রাজনীতিও করেছি। ওর নীতি বলে কিছু নেই। সারাজীবন ক্লিকবাজী আর লাঠিবাজীর মাধ্যমে নিজের সুবিধা আদায় করে নিয়েছে সে। চরম সুবিধাবাদী চরিত্রের ধুরন্দর শেখ মুজিব। তোদের মাঠে নামিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করতে চেয়েছিল শেখ মুজিব। একদিকে বর্তমানের তীব্র সরকার বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিশেষ করে জাসদ, সর্বহারা পার্টির সদস্যদের খতম করা অন্যদিকে সেনা বাহিনী এবং জনগণের দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী অংশের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে সেনা বাহিনীকে তার দলের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করার জন্যই সে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু তার চালকে বানচাল করে দিয়েছিস তোরা। দেখ এখন সে কি করে। তাদের নিয়েই আমার চিন্তা।। hope you and your other colleauges don’t get victimised, কথাগুলো শুনে জবাবে আমার কিছু বলার ছিল না। তার বক্তব্যের সত্যতা ভবিষ্যতেই প্রমাণ হতে পারে। আব্বা বুঝতে পেরেছিলেন আমি ভীষণ ক্লান্ত। তাই কথা না বাড়িয়ে বললেন, “কুমিল্লাতে একটা ফোন করে শুয়ে পড়। Don’t over estimate Mujib, he is just an average man.” আব্বার কথায় কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। পরদিন সকালে জেনারেল শফিউল্লাহ সেনা সদরে আমাকে ডেকে পাঠালেন। সেখানে গিয়ে দেখি কর্নেল হুদাকেও ডেকে পাঠানো হয়েছে। হুদা ভাই আমাকে বললেন, “Chief will go with us to Comilla to release all those people.” ভীষণভাবে দমে গিয়েছিলাম এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে। হুদা ভাই ও ভীষণ Upset. ক্যাপ্টেন নূর জেনারেল জিয়ার ADC তার কামরায় গিয়ে বললাম, বসের সাথে দেখা করতে চাই। নূরের মাধ্যমে খবরটা পেয়েই তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। ঘরে ঢুকে দেখলাম তিনিও গম্ভীর। আমাকে বসতে ইঙ্গিত করে বললেন, “Well I know every thing. Don’t loose heart. Allah is there. You have done your duty sincerely so forget about the rest and be at ease.” চীফের সাথে একই হেলিকপ্টারে ফিরে এলাম কুমিল্লায়। চীফ নিজে গিয়ে বন্দীদের মুক্তি দিলেন। আমাদের সামনেই ফুলের মালা গলায় পরিয়ে সমবেত আওয়ামী লীগাররা সদর্পে মিছিল করে চলে গেল শেখ মুজিবের জয়ধ্বনি করতে করতে। বিব্রতকর অবস্থায় intolerable humiliation সহ্য করে নিতে হয়েছিল আমাদের সকলকে। ঢাকায় ফেরার আগে জেনারেল শফিউল্লাহ আমাদের সারমন দিলেন, “Prime minister’s desire is an order.” এ ঘটনার ফলে সারাদেশে deployed আর্মির morale একদম ভেঙ্গে পড়েছিল। গুজব ছড়িয়ে পড়ল শেখ মুজিব শীঘ্রই আর্মি অপারেশন বন্ধ করে দিচ্ছেন। এরপর আমরা নামে মাত্র অপারেশনে Deployed ছিলাম। আরোপিত দায়িত্ব পালনে কোন উৎসাহ ছিল না কারোই। কোনরকমে সময় কাটাচ্ছিলাম আমরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *