১৭. সাতচল্লিশ নম্বর পুরানা পল্টন

সাহিত্য তো হচ্ছে কিন্তু জীবিকার কি হবে? আর্ট হয়তো প্রেমের চেয়েও বড়, কিন্তু সবার চেয়ে বড় হচ্ছে ক্ষুধা। এই সাহিত্যে কি উল্পের সংস্থান হবে?

আমি আর্টকে প্রিয়ার চেয়েও ভালবাসি—এই কথাটি আজ কদিন ধরে আমার মনে আঘাত দিচ্ছে। আমাকে লেখা প্রেমেনের আরেকটা চিঠি: মনে হচ্ছে আমি সুবিধার খাতিরে প্রিয়াকে ছোট করতে পারি, কিন্তু আর্ট নিয়ে খেলা করতে পারি না। আমার প্রিয়ার চেয়েও আর্ট বড়। আমি যাকে তাকে বিয়ে করতে পারি কিন্তু আর্টকে শুধু নামের বা অর্থের প্রলোভনে হীন করতে পারি না—অন্তত এখন তাই মনে। হচ্ছে। সেই আদিম যুগে উলঙ্গ অসভ্য মানুষ সৃষ্টি করবার যে প্রবল অন্ধ প্রেরণায় নারীকে লাভ করবার জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে সেই প্রেরণাই আজ রূপান্তরিত হয়ে আর্টিষ্টের মনকে দোলা দিচ্ছে। এই দোলার ভেতর আমি দেখতে পাচ্ছি গ্রহতারার দুর্বার অগ্নিনৃত্যবেগ, সূর্যের বিপুল বহ্নিজালা, বিধাতার অনাদি অনন্ত কামনা সৃষ্টি, সৃষ্টি—আজ আর্টিষ্টের সৃষ্টি শুধু নারীর ভেতর দিয়ে সৃষ্টির চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে বলেই প্রিয়ার চেয়ে আর্ট বড়। সৃষ্টির ক্ষুধা সমস্ত নিখিলের অণুপরমাণুতে, প্রতি প্রাণীর কোষে কোষে। সেই সৃষ্টির লীলা মানুষ অনেক রকমে করে এসে আজ এক নতুন অপরূপ পথ। পেয়েছে। এ পথ শুধু মানুষের—বিধাতার মনের কথাটি বোধ হয় মানুষ এই পথ দিয়ে সব চেয়ে ভালো করে বলতে পারবে; সৃজনকামনার চরম ও পরম পরিতৃপ্তি সে এই পথেই আশা করে। অন্তত এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে এই আর্ট সেই আদিম অনাদি সৃষ্টি-ক্ষুধার রূপান্তরিত বিকাশ।

এতক্ষণ এত কথা বলে হয়ত কথাটাকে জটিল করে ফেললুম, হয়ত কথাটার একদিক বেশি স্পষ্ট করতে গিয়ে আর একদিক সম্বন্ধে তুল ধারণা করবার সুযোগ দিলুম।

নারীর মধ্যে প্রিয়াকে চাই এবং প্রিয়ার মধ্যে প্রেমকে চাই। যার কাছে ভালবাসার প্রতিদান পাব তারি মাঝে এ পর্যন্ত যত নারীকে। ভালবেসেছি ও পেয়েছি ও হারিয়েছি বা ভালবেসেছি ও পাইনি সকলে নতুন করে বাঁচবে—এই আমার মত। জানি এ মত অনেকের কাছে বিতৃষ্ণাময় লাগবে, এমত অনেকের কাছে হৃদয়হীনতার পরিচায়কও লাগবে হয়ত। কিন্তু হৃদয়হীন হতে রাজী নই বলেই এই আপাতহৃদয়হীন মত আমি নিজে পোষণ করি। প্রেম খুঁজতে গিয়ে প্রিয়ার নারীত্ব আমাকে আঘাত দিয়েছে বলে আমি নারীর মধ্যে প্রেম পাবার আশা ত্যাগ করব না। নিজের কথাই বলছি তোর কথা বলতে গিয়ে।

আমার এখন দৃঢ় ধারণা হযেছে ছেলেবেলা থেকে একটা রূপকথা শুনে আসছি—সে রূপকথা যেমন অসত্য তেমনি সুন্দর। রূপকথাটাকে আমরা কিন্তু তাই রূপকথা ভাবি না, ভাবি সেটা সত্য। মানুষের প্রেম সত্যি করে একবার মাত্র জাগে এই কথাটাই রূপকথা। প্রেম অমর এটা সত্য হতে পারে কিন্তু অমর প্রেম লাভ করবার আগে প্রেমের অনেক আশ্বাস ও আভাস আসে যাকে আমরা তাই বলে ভুল করি।

এক গরীব চাষা অনেক তপস্যা করে এক দেশের এক রাজকন্যাকে পাবার বর পেয়েছিল। কিন্তু রাজকন্যা আসবার সময় প্রথম যে দাসী এল খবর দিতে, সে তাকেই ধরে রেখে দিলে। সে যখন জানলে সে রাজকন্যা নয়, তখন সে ভগবানকে ডেকে বললে, তোমার বর ফিরিয়ে নাও, আমার দাসীই ভাল। তারপর যখন সত্যিকারের রাজকন্যা এল তখন কী অবস্থাটা হল বুঝতেই পারিস।

আমাদের রাজকন্যাকে, দুঃখের বিষয়, সনাক্ত করবার কোনো উপায় নেই। কোনদিন সে আসবে কিনা তাই জানিনা, আর এসেও কখন অসাবধানতায় ফসকে যায় এই ভয়ে আমরা সারা। তাই আমরা প্রথম অগ্রদূতীকেই ধরে বলি অনেক সময়, বর ফিরিয়ে নাও ভগবান। ভগবানকে আমরা যতটা সজাগ ও সদয় মনে করি, তিনি বোধহয় ততটা নন কারণ তিনি মাঝে-মাঝে বলেন তথাস্তু। আর আমাদের সত্যিকারের রাজকন্যা হয়ত একদিন আসে, যদিও মাঝে মাঝে অগ্রদূতীর ছদ্মবেশ খুলে আসল রাজকন্যা বেরিয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে কিন্তু তিনি বর ফিরিয়ে নেন না, এবং অনেক সমব সদয় হয়েই। তোর জীবনে ভগবান এবার তথাস্তু বলেন না কেন কে জানে। যে প্রেমের নীড় মানুষ অটুট করে রচনা করে তার মাঝে থাকে সমস্ত অগ্রদূতীর প্রেমের ছায়া।

কল্লোলের এমন অবস্থা নয় যে লেখকদের পয়সা দিতে পারে। শুধু শৈলজা আর নৃপেনকেই পাঁচ-দশ টাকা করে দেওয়া হত, ওদের অনটনটা কষ্টকর ছিল বলে। আর সবাই লবডঙ্কা। আমরা শুধু মাটি পাট করছি। হাঁড়ি গড়তে হবে, ঢিল-বালি সব বের করে দিচ্ছি। সাধু গাঁজা তৈরি করছে, তার সাজতে-সাজতেই আনন্দ। আমাদেরও প্রায় তেমনি। লেখবার বিস্তৃত ক্ষেত্র পেয়েছি এতেই আমাদের স্ফূর্তি। ঢালছি আর সাজছি, দম যখন জমবে তখন দেখা যাবে। চকমকির পাথর যদি কারু থাকে তবে ঘা মারলে আগুন বেরুবেই।

তবু একেক দিন দীনেশদা হঠাৎ গলা জড়িয়ে ধরে পাশে বসে পড়তেন। শূন্য বুক-পকেটে একটি টাকা টুপ করে কখন খসে পড়ত। এ টাকাটা দানও নয়, উপার্জনও নয়, শুধু স্বপ্নে কুড়িয়ে-পাওয়া একটি অভাবিত মেহম্পর্শের মত—এমনি অনুভব করতাম। নিশ্চিন্ত হতাম, আরো দিন চারেক আড্ডা চালাবার জন্যে ট্রাম চলবে।

কিন্তু প্রেমেন শৈলজার অর্থের প্রয়োজন তখন অত্যন্ত। তাই তারা ঠিক করলে আলাদা একটা কাগজ বের করবে। সেই কাগজে ব্যবস্থা করবে অশনাচ্ছাদনের। সঙ্গে সুমন্ত্র মুরলীধর বসু। তন্ত্রধারক বরদা এজেন্সির শিশির নিয়োগী।

বেরুল কালি-কলম—তেরশ তেত্রিশের বৈশাখে। দুটো বিশেষত্ব প্রথমেই চোখে পড়ল। এক, সাধাসিধে ঝকঝকে নাম; দুই, একই কাগজের তিনজন সম্পাদক-শৈলজা প্রেমেন আর মুরলীদা। আর প্রথম সংখ্যায় সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা মোহিতলালের নাগার্জন।

তুরিতে উঠিয়া গেনু মন্ত্রবলে স্মরণের আলোক-তোরণে,
—প্রবেশি অকম্পিত নিঃশঙ্ক চরণে।
অমর মিথুন যত মূরছিল মহাভয়ে–শ্লথ হল প্রিয়া আলিঙ্গন।
কহিলাম, ওগো দেব, ওগো দেবীগণ,
আমি সিদ্ধ নাগার্জুন, জীবনের বীণাযন্ত্রে সকল মূর্চ্ছনা
হানিয়াছি, এবে তাই আসিয়াছি করিতে অর্চ্চনা
তোমাদের রতিরাগ; দাও মোরে দাও ত্বরা করি
কামদুঘা সুরভির দুগ্ধধারা এই মোর করপাত্র ভরি!
—মানব-অধর-সীধু যে রসনা করিয়াছে পান
অমৃত পায়স তার মনে হল ক্ষার-কটু প্রলেহ সমান।
জগৎ-ঈশ্বরে ডাকি কহিলাম, ওগো ভগবান!
কি করিব হেথা আমি? তুমি থাক তোমার ভবনে,
আমি যাই; যদি কভু বসিতাম তব সিংহাসনে,
সকল ঐশ্বৰ্য্য মোর লীলাইয়া নিতাম খেলায়ে–
বাঁকায়ে বিদুৎ-ধনু, নভোনাভি পূর্ব্বমুখে হেলায়ে হেলায়ে
গড়িতাম ইচ্ছাসুখে নব-নব লোক লোকান্তর।
তবু আমি চাহি না সে, তব রাজ্যে থাক তুমি চির একেশ্বর।
মোর ক্ষুধা মিটিয়াছে; শশী-সূৰ্য্য তোমার কন্দুক?
আমারও খেলনা আছে—প্রেয়সীর সুচারু চুচুক!
স্তোত্র-স্তুতি ভাগ্য তব, তবু কহ শুধাই তোমারে–
কভু কি বেসেছ ভালো মুদিতাক্ষী যশোধারা,
মদিরাক্ষী বসন্তসেনারে?

এ-কবিতায় অবশ্য কোনোই দোষ পায়নি শনিবারের চিঠি কারণ মোহিতলাল যে নিজেই ঐ দলের মণ্ডল ছিলেন। শুনেছি কৃত্তিবাস ওঝা নাকি ওঁরই ছদ্মনাম! শনিবারের চিঠিতে সরস-সতী নাম দিয়ে সরস্বতী-বন্দনাটি বিচিত্র।

সারাটা জাতের শিরদাঁড়াটায় ধরেছে ঘুণ–
মার জঠরেও কাম-যাতনায় জ্বলিছে ভ্রূণ।
শুকদেব যথা করেছিল বেদ-অধ্যয়ন–
গর্তে বসেই শেষ করে তারা বাৎস্যায়ন!

বুলি না ফুটিতে চুরি করে চায়—মোহন ঠাম!
ভাষা না শিখিতে লেখে কামায়ন–কামের সাম।
জ্ঞান হলে পরে মায়েরে দেখে যে বারাঙ্গনা!
তার পরে চায় সারা দেশময় অসতীপণা।

এদেরি পূজোয় ধরা দিয়েছ যে সরস্বতী,
চিনি নে তোমায়, কোন বলে তুমি আছিলে, সতী?
দেখি তুমি শুধু নাচিয়া বেঁড়াও হাঁস-পা-তালে,–
অঙ্গে ধবল, কুষ্ঠও বুঝি ওষ্ঠে-গালে!

কালি-কলম বেরুবার পর বাইরে থেকে দেখতে গেলে, কল্লোলের সংহতিতে যেন চিড় খেল। প্রথমটা লেগেছিল তাই প্রায় প্রিয়বিচ্ছেদের মত। একটু ভুল-বোঝার ভেলকিও যে না ছিল তা নয়। কেউ কেউ এমন মনে করেছিল যে কল্লোলের রীতিমত লাভ হচ্ছে, দীনেশদা ইচ্ছে করেই মুনফার ভাগ-বাটোয়ারা করছেন না। এ সন্দেহে যে বিন্দুমাত্র ভিত্তি নেই, তার কারণ কালি-কলম নিজেও ব্যবসার ক্ষেত্রে ফেল মারল। এক বছর পরেই প্রেমেন সটকান দিলে, দু বছর পরে শৈলজা। মুরলীদা আরো বছর তিনেক এক পায়ে দাঁড়িয়ে চালিয়েছিলেন বটে কিন্তু মুরলীধ্বনিও মীণতর হতে-হতে বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে বরদা থাকলেও ভাগ্যে বরদাত্রী জোটে না সব সময়।

সুতরাং প্রমাণ হয়ে গেল, সত্যিকার সিরিয়স পত্রিকা চালিয়ে তা থেকে জীবিকানির্বাহ করা সাধ্যাতীত। বেশির ভাগ পাঠকের চোখ ঢাউসগুলোর দিকে, নয়তো খিস্তি-খেউড়ের দিকে। কল্লোল তো শেষের দিকে সুর বেশ খাদে নামিয়ে আনবার চেষ্টা করেছিল, জনরঞ্জনের প্রলোভনে। কিন্তু তাতে ফল হয় না! অবশিষ্ট ভক্তরাও রুষ্ট হয় আর নিষ্কলঙ্ক ধর্ম থেকে বিচ্যুতি ঘটে। কল্লোল তাই কল্লোলের মতই মরেছে। ও যে পাতকো হয়ে বেঁচে থাকেনি ওটাই ওর কীতি।

টাকা থাকলেই বড়লোক হওয়া যায় বটে, কিন্তু বড় মানুষ হওয়া যায় না। বড় মানুষের বাড়ির একটা লক্ষণ হচ্ছে এই যে, সব ঘরেই আলো থাকে। কল্লোল সেই বড় মানুষের বাড়ি। তার সব ঘর আলো করা।

তবু সেদিন কল্লোল ভেঙে কালি-কলমের সৃষ্টিতে নৃপেনের বিক্ষোভের বোধহয় অন্ত ছিল না। সে ধরল গিয়ে শৈলজাকে, মুখোমুখি প্রচণ্ড ঝগড়া করলে তার সঙ্গে। এমন কি তাকে বিশ্বাসহন্তা পর্যন্ত বললে। শৈলজা বিন্দুমাত্র চঞ্চল হল না। তার স্বাভাবিক সস্মিত গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললে, ব্যস্ত নেই, তোকেও আসতে হবে।

বস্তুত কল্লোল-কালিকলমের মানে কোনো দলাদলি বা বিরোধ-বিপক্ষতা ছিল না। যে কল্লোলে লেখে সে কালি-কলমেও লেখে আর যে কালি-কলমের লেখক সে কল্লোলেরও লেখক। যেমন জগদীশ গুপ্ত, নজরুল, প্রবোধ, জীবনানন্দ, হেম বাগচি। প্রেমেন ফের কল্লোলে গল্প লিখল, আমিও কালি-কলমে কবিতা লিখলাম। কোথাও ভেদ-বিচ্ছেদ রইল না, পাশাপাশি চলবার পথ মসৃণ হয়ে গেল। বরং বাড়ল আর একটা আড্ডার জায়গা। কল্লোল আর কালি-কলম একই মুক্ত বিহঙ্গের দুই দীপ্ত পাখা।

কিন্তু নৃপেন প্রতিজ্ঞাভ্রষ্ট হয় নি। কালি-কলমে লেখা তে। দেয়ইনি, বোধহয় কোনদিন যায়ওনি তার আপিসে-আড্ডায়।

মনটা বুদ্ধদেবের দিকে ঝুঁকে পড়ল। এবং তেরোশ তেত্রিশের এক চৈত্রের রাতে ঢাকা রওনা হলাম।

ক্ষিতীন সাহা বুদ্ধদেবের বন্ধু, কলকাতায় মেসে থেকে পড়ে, বাড়ি ঢাকায়। হঠাৎ তার কঠিন অসুখ হয়ে পড়ল, ঢাকায় বাপ-মার কাছে যাবার দরকার। পথে একজন সঙ্গী চাই। আমি বললাম, আমি যাব।

তার আগে পূজোর ছুটিতে বুদ্ধদেব চিঠি লিখেছিল: আপনি ও নেপেনদা এ ছুটিতে কিন্তু একবার ঢাকায় আসবেনই। আপনাদের দুজনকে আমি প্রগতি-সমিতির পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ পাঠাচ্ছি। যদিও পাথেয় পাঠাতে আমরা বর্তমান অবস্থায় অক্ষম, তবে এখানে এলে আতিথেয়তার ত্রুটি হবে না। আপনার পকেট আশু রৌপ্য-গর্ভ হয়ে উঠুক।..এ নিমন্ত্রণ আমাদের সবাকার,-আমার একার নয়। আমাদের। সম্মিলিত সম্ভাষণ ও আমার ব্যক্তিগত অনুরাগ জ্ঞাপন করি।

ক্ষিতীনকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে সাতচল্লিশ নম্বর পুরানা পল্টনে এসে পৌঁছুলাম।  বুদ্ধদেবের বাড়ি। বুদ্ধদেব তো আকাশ থেকে পড়ল! না, কি, উঠে এল আকাশে! এ কী অবাক

কাণ্ড!

আমাকে দেখে একজন বিস্মিত হবে আর তার বিস্ময়টুকু আমি উপভোগ করব এও একটা বিস্ময়!

আরে, কী ভয়ানক কথা, আপনি?

হ্যাঁ, আর ঢাকা থাকা গেল না—চলে এলাম।

খুশিতে উছলে উঠল বুদ্ধদেব। উঠলেন কোথায়?

আর কোথায়!

দাঁড়ান, টুনুকে খবর পাঠাই, পরিমলকে ডাকি।

সাধারণ একখানা টিনের ঘর, বেঁড়া দিয়ে ভাগ করা। প্রান্তের ঘরটা বুদ্ধদেবের। সেই ঘরেই অধিষ্ঠিত হলাম। পাশালো একটা তক্তপোষ আর ন্যাড়া-ন্যাড়া কাঠের দু-একটা টেবিল-চেয়ার সমস্ত ঘরের সম্পদ, আর বইভরা কাঠের একটা আলমারি। দক্ষিণে ফাঁকা মাঠ, উধাও-ধাওয়া অফুরন্ত হওয়া। একদিকে যেমন উদ্দাম উন্মুক্তি, অন্যদিকে তেমনি কঠোরব্রত কৃচ্ছতা। একদিকে যেমন খামখেয়ালের এলোমেলোমি, অন্যদিকে তেমনি আবার কর্মোদযাপনের সংকল্পস্থৈর্য। আড্ডা হল্লা, তেমনি আবার পরীক্ষার পড়া-তেমনি আবার সাহিত্যের শুশ্রূষা। সমস্ত কিছু মিলে একটা বর্ধন-বিস্তারের উদ্যতি।

প্রায় দিন পনেরো ছিলাম সে-যাত্রায়। প্রচুর সিগারেট,–সামনের মুদিদোকানে এক সিগারেটের বাবদই একা বুদ্ধদেবের তখন ষাট-সত্তর টাকা দেনা—আর অঢেল চা—সব সময়ে বাড়িতে নয়, চায়ের দোকানে, যে কোনো সময়ে যে কোনো চায়ের দোকানে। আর সকালে-সন্ধ্যায় টহল, পায়ে হেঁটে কখনো বা ঢাকার নামকরা পংখীরাজ ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে। সঙ্গে টুনু বা অজিত দত্ত, পরিমল রায় আর অমলেন্দু বসু। আর গল্প আর কবিতা, ছড়া আর উচ্চ হাসির তারকার। শুধু পরিমলের হাসিটাই একটু শ্লেষাশ্লিষ্ট। সেই সঙ্গে কথায়-কথায় তার ছড়ার চমক স্ফূর্তিকে আরো ধারালো করে তুলত। গেলে পাঞ্জাবে, জেলে জান যাবে কিংবা দেশ হয়েছে স্বাধীন, তিন পেয়ালা চা দিন,—সেই সব ছড়ার দু-একটা এখনো মনে আছে। ক্রমে-ক্রমে দলে সামিল হল এসে যুবনাশ্ব বা মণীশ ঘটক, তার ভাই সুধীশ ঘটক, আর অনিল ভট্টাচার্য, ছবির জগতের আলফাবিটা—আর সর্বোপরি ভৃণ্ড। নবরত্বের সভা গুলজার হয়ে উঠল। মনে হল যেন বোহিমিয়ায় এসে বাস নিয়েছি।

বলা বাহুল্য নিভৃততম ছিল বুদ্ধদেব। মুক্ত উঠোনে পিঁড়িতে বসে একসঙ্গে স্নান, পাশাপাশি আসনে বসে নিত্য ভুরিভোজ নিত্যকালের জিনিস হয়ে রয়েছে। সমস্ত অনিয়ম ক্ষমা করে বুদ্ধদেবের মার (অতি শৈশবে মাতৃবিয়োগ হবার পর দিদিমাকেই বুদ্ধদেব মা বলত) যে একটি অনিমেষ স্নেহ ছিল চারপাশে, তারই নীরব স্পর্শ আমাদের নৈকট্যকে আরো যেন নিবিড় করে তুলল। একটা বিরাট মশারির তলায় দুজনে শুতাম একই তক্তপোষে। কোনো কোনো দিন গল্প করে কাব্যালোচনা করে সারারাত না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিতাম। কোন কোনো রাতে অজিত এসে জুটত, সঙ্গে অনিল কিংবা ভৃগু। তাস খেলেই রাত ভোর করে দেওয়া হত। বুদ্ধদেব তাস খেলত না, সমস্ত হল্লা-হাসি উপেক্ষা করে পড়ে-পড়ে ঘুমুত এক পাশে।

সে সব দিনে মশারি টাঙানো হত না। লণ্ঠনের আলোতে বসে সুদীর্ঘ রাত্রি তাসখেলা—এক পয়সা যেখানে স্টেক নেই—কিংবা দুই বা ততোধিক বন্ধু মিলে শুদ্ধ কাব্যালোচনা করে রাত পোহান—সেটা যে কি প্রাণনায় সেদিন সম্ভব হত আজকের হিসেবে তা অনির্ণেয়। যে-যেদিন মশারি ফেলা হত সে-সেদিনও তাকে বাগ মানিয়ে রাখা সাধ্য ছিল না। শেষরাত্রির দিকেই বাতাস উঠত-সে কি উত্তাল উদ্দাম বাতাস—আর আমাদের মশারি উড়িয়ে নিয়ে যেত। সবুজ ভোরের আলোয় চোখ চেয়ে মনে হত দুইজনে যেন কোন পাল-তোলা ময়ূরপঙ্খীতে চড়ে কোন নির্জন নদীতে পাড়ি দিয়েছি।

এক দুপুর বেলা অজিত, বুদ্ধদেব আর আমি—আমরা তিনজনে মিলে মুখে-মুখে একটা কবিতা তৈরি করলাম। কবিতাটা ঢাকাকে নিয়ে, নাম ঢাকা-ঢিক্কি বা ঢাকা-ঢক্কা। কবিতার অনুপ্রাস নিয়ে শনিবারের চিঠির বিদ্রুপের প্রত্যুত্তর। অনুপ্রাস কতদূর যেতে পারে তারই একটা চূড়ান্ত উদাহরণ :

ফাগুনের গুণে ‘সেগুনবাগানে’ আগুন বেগুন পোড়ে,
ঠুনকো ঠাটের ‘ঠাঠারিবাজারে’ ঠাঠা ঠেকিয়াছে ঠিক;
ঢাকার ঢেঁকিতে ঢাকের ঢেঁকুর ঢিটিক্কারেতে ঢোঁড়ে,
সং ‘বংশালে’ বংশের শালে বংশে সেঁধেছে শিক।

ভুয়া ‘উয়ারির’ কুয়ার ধুঁয়ায় চুঁয়ায় গুয়ার শুয়া,
বাছা ‘এছাকের’ কাছার কাছেতে কাছিমের কাছি আছে,
‘চকের’ চাকু-চাক্কায় চিকা চকচকি চাখে চুয়া
সাচিবন্দরে মন্দোবীরা বন্দী বান্ধিয়াছে।

পাষণ্ড ঐ ‘মৈনুণ্ডির’ মুণ্ডে গণ্ডগোল,
‘সূত্রাপুরের’ সূত্রধরের পুত্রেরা কাৎরায়,
‘লালবাগে’ লাল ললনার লীলা ললিত-লতিকা-লোল
‘জিন্দাবাহার’ বৃন্দাবনেরে নিন্দিছে সন্ধ্যায়।

‘বক্সীবাজারে’ বাক্সে নক্সা মকশো একশোবার,
রমা রমণীরা ‘রমনায়’ রমে রম্য রম্ভাসম;
‘একরামপুরে’ বিক্রি মাকড়ি লাকড়ি শুক্রবার,
গন্ধে অন্ধ ‘নারিন্দ্যা’ যেন হিন্দু ইন্দুপম।

চর্ম্মে ঘৰ্ম্ম ‘আৰ্ম্মেনিটোলা’ কর্ম্মে বর্ম্মাদেশ,
টাকে-টিকটিকি-টিকি ‘টিকাটুলি’ টিকার টিকিট কাটে,
‘তাঁতিবাজারের’ তোৎল তোতার তিত-তরে পিত্যেশ,
‘গ্যাণ্ডারিয়ার’ ভণ্ড গুণ্ডা চণ্ড চণ্ডূ চাটে।

ঢাকায় দুজন পৃষ্ঠপোষক পাওয়া গেল। এক পরিমলকুমার ঘোষ, প্রোফেসর; দুই ফণীভূষণ চক্রবর্তী, বর্তমানে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি। জ্ঞানী গুণীদের মধ্যে থেকে কেউ-কেউ আছেন আমাদের স্বপক্ষে, সেইটেই তখন প্রকাণ্ড উপার্জন।

একদিন দুপুরে আকাশ-কালোকরা প্রচণ্ড বৃষ্টি নামল। স্নান করে উঠে ঠিক খাবার সময়টায়। দাঁড়াও, আগে বৃষ্টি দেখি, পরে খাওয়া যাবে। কিন্তু সাধ্য নেই সর্বভঞ্জন সেই প্রভঞ্জনের সামনে জানলা খোলা যায়। ঘরে লণ্ঠন জ্বেলে দুজনে-বুদ্ধদেব আর আমি–ভাত খেলাম। অদ্ভুত অবিস্মরণীয় পরিবেশে। হাওয়া যখন পড়ল তখন জানলা খুলে চেয়ে দেখি, সর্বনাশ। অন্ধের নড়ি, আমার একমাত্র ফাউণ্টেন পেনটি টেবিল থেকে পড়ে ভেঙে গিয়েছে।

এর পর আর ঢাকায় থাকার কোনো মানে হয় না।

বুদ্ধদেবের কটা চিঠির টুকরো :

আপনি যদি ওর সঙ্গে চিঠি লেখালেখি শুরু করেন তা হলে খুব ভেবে-চিন্তে সুন্দর করে লিখবেন কিন্তু। কারণ এইসব চিঠি যে ভবিষ্যতে বাঙলা দেশের কোনো অভিজাত পত্রিকা-বিশেষ গৌরবের সহিত ছাপবে না এমন কথা জোর করে বলা যায় না। কিন্তু মেয়েটি আপনার হাতের লেখা পড়তে পারবে কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। আমি অন্ততঃ আপনাকে এইটুকু অনুরোধ করতে বাধ্য হচ্ছি যে আমাকে চিঠি লেখবার সময় কলমে যেন বেশি করে কালি ভরে নেন এবং অক্ষরগুলোকে ইচ্ছে করে অত ক্ষুদে-ক্ষুদে না করেন। কারণ আমরা ডাক পাই গোধূলিলগ্নে। তখন ঘরেও আলো জ্বলে না, আকাশের আলোও ম্লান হয়ে আসে। কাজেই আপনার চিঠি পড়তে রীতিমত কষ্ট হয়।

 

অচিন্ত্যবাবু, আষাঢ় মাস থেকে আমরা প্রগতি ছেপে বার করচি। মস্ত দুঃসাহসের কাজ, না? হঠাৎ সব ঠিক হয়ে গেল। এখন আর ফেরা যায় না। একবার ভালো করেই চেষ্টা করে দেখি না কি হয়। প্রেমেনবাবুকে এ খবর দেবেন।

 

‘আষাঢ়’ মানে তেরোশ তেত্রিশের আষাঢ় আর ‘ছেপে’ মানে এর আগে ‘প্রগতি’ হাতে-লেখা মাসিক পত্রিকা ছিল।

 

আপনি দুঃখ ও নৈরাশ্যের ভেতর দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন ভেবে আমার সত্যি-সত্যি মন খারাপ লাগে। কি হয়েছে? কেন? এ সব প্রশ্ন করা সত্যি অসঙ্গত—অন্তত চিঠিতে। কিন্তু আপনার দুঃখের কারণ কি তা জানতে সত্যি ইচ্ছে করে—অলস কৌতূহলবশত নয় কেবল—আপনাকে বন্ধু বলে হৃদয়ে গ্রহণ করেছি, তাই। আপনার প্রতি সুখদুঃখের সঙ্গে আমি নিজেকেও ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট বিবেচনা করি। আপনি কি ঢাকায় আসবেন? আসুন না। আমার যতদূর বিশ্বাস ঢাকা আপনার ভালো লাগবে-পল্টনের এই খোল। মাঠের মধ্যেই একটা মস্ত শান্তি আছে। আপনি এলে আমাদের যে অনেকটা ভালো লাগবে তা তো জানেনই।

 

প্রগতি আগামী বছর চলবে কিনা এখনো ঠিক করিনি। সাধ তো আকাশের মত প্রকাণ্ড, কিন্তু পুঁজিতে যে কুলোয় না। এ পর্যন্ত এর পেছনে নিজেদের যত টাকা ঢালতে হয়েছে তার হিসেব করলে মন খারাপ হয়ে যায়। এ ভাবে পুনোপুরি লোকসান দিয়ে আর এক বছর চালানো সম্ভব নয়। এখনো অবিশ্যি একেবারে হাল ছেড়ে দিইনি। গ্রীষ্মের ছুটি হওয়ামাত্র একবার বিজ্ঞাপন-সংগ্রহের চেষ্টায় কলকাতায় যাব। যদি কিছু পাওয়া যায় তাহলে প্রগতি চলবে। যথাসাধ্য চেষ্টার ফলেও যদি কিছু না হয়, তাহলে আর কি করা? আপনি আর প্রেমেনবাবু মিলে একটা নতুন উপন্যাস যদি লেখেন তা হলে তা দ্বিতীয় বর্ষের আষাঢ় থেকে আরম্ভ করা যায়।

আপনি কবে কলকাতা থেকে বেরোবেন? ঢাকায় কি আসবেন না একবার? শীত প্রায় কেটে গিয়েছে—আর কয়েকদিন পরেই পল্টনের বিস্তৃত মাঠ অতিক্রম করে হু-হু করে জোয়ারের জলের মত দক্ষিণা বাতাস এসে আমার ঘরে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়বে—যে বাতাস গত বছর আপনাকে মুগ্ধ করেছিল, যে বাতাস আপনার কলম ভেঙেছিল। এবারো কি একবার আসবেন না? যখন ইচ্ছে। You are ever welcome here.

 

প্রগতিকে টিকিয়ে রাখা সত্যিই বোধ হয় যাবে না। তবু একেবারে আশা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে না—কুসংস্কারগ্রস্ত মনের মত miracleএ বিশ্বাস করবার দিকে ঝুঁকে পড়ছি। প্রগতি উঠে গেলে আমার জীবনে যে vacuum আসবে তা আর কিছু দিয়েই পূর্ণ করবার মত নয়—সেই হিসেবেই সব চেয়ে খারাপ লাগছে। কালিকলম কি আর এক বছর চলবে?

এবারকার কল্লোলে শৈলজার ছবি দিয়েছে দেখে ভারি আনন্দ পেলাম। আধুনিকদের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ তাদের যথাযোগ্য সম্মান করার সময় বোধহয় এসেছে। তাহলে কিন্তু এবার মোহিতলালের ছবিও দিতে হয়। কারণ আজকের দিনে কথা-সাহিত্যের ক্ষেত্রে যেমন শৈলজানন্দ, কাব্যসাহিত্যের ক্ষেত্রে তেমনি মোহিতলাল–নয় কি?

 

নজরুল ইসলাম এখানে দিন-কতক কাটিয়ে গেলেন। এবার তার সঙ্গে ভালোমত আলাপ হল। একদিন আমাদের এখানে এসেছিলেন; গানে, গল্পে, হাসিতে একেবারে জমজমাট করে রেখেছিলেন। এত ভালো লাগলো! আর ওঁর গান সত্যি অদ্ভুত! একবার শুনলে সহজে ভোলা যায় না। আমাদের দুটো নতুন গজল দিয়ে গেছেন, স্বরলিপি সুদ্ধ ছাপবো….নাট্যমন্দির এখানে এসেছে। তিনরাত অভিনয় হবে। আমি আজ যেতে পারলাম না-একদিনও যেতে পারবো না হয়তো। অর্থাভাব। যাক—একবার তো দেখেইছি। এর পর আবার স্টার আসছে। ঢাকাকে একেবারে লুটে নেবে।

প্রগতি সত্যি-সত্যি আর চললো না। কোনোমতে জ্যৈষ্ঠটা বের করে দিতে পারলেই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। তবু—যদি কখনো অর্থাগম হয়, আবার কি না বার করবো?…আপনার মাকে আমার প্রণাম জানাবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *