ষষ্ঠ খণ্ড
সাংবাদিক জীবন
অধ্যায় সতের – সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি
১. এক ঢিলে দুই পাখি
সাংবাদিক হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার ছেলেবেলা ছিল না। যেটা ছিল, সেটা সাহিত্যিক হওয়ার সাধ। আসলে সাহিত্যিক-সাংবাদিক যে দুইটা আলাদা বস্তু, সে জ্ঞানই তখন আমার ছিল না। সাহিত্যিক যারা তারাই খবরের কাগজও চালান, এটাই ছিল আমার ধারণা। সাহিত্যিক হওয়ার চেষ্টা ত আমি করিতেছিই। খ্যাতনামা লেখকদের বই-পুস্তক পড়িতেছি। নিজে কবিতা, প্রবন্ধ ও গল্প লিখিতেছি। আর খবরের কাগজ শুধু পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। খবরের কাগজ বাহির করার জ্ঞান ছাপার কৌশল দেখা পর্যন্ত। স্কুল-জীবনে ময়মনসিংহ শহর হইতে প্রকাশিত একমাত্র সাপ্তাহিক চারু-মিহির ছাপা হইতে দেখিয়াছি। বিস্মিত হইয়াছি। কিন্তু আকৃষ্ট হই নাই। কারণ লেখা সম্পাদনের কাজটা কারা করেন, কোথায় করেন, তা দেখার সৌভাগ্য হয় নাই। সাংবাদিক হওয়ার সাধ জন্মানোর জন্য ঐটুকু অভিজ্ঞতা যথেষ্ট নয়। তার উপর, ঐ সময় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিবিধ প্রবন্ধে’, নবীন লেখকদের প্রতি উপদেশ’ পড়িয়াছিলাম। তাতে তিনি নবীন লেখকদের উপদেশ দিয়াছেন : ‘যদি প্রকৃত সাহিত্যিক হইতে চাও, তবে সাময়িক পত্রিকায় লিখিও না। সাহিত্যিক হওয়ার বাসনাটা প্রবল থাকায় বঙ্কিমচন্দ্রের উপদেশটা মানিয়া চলার একটা অস্পষ্ট সংকল্প আমার নিশ্চয়ই হইয়াছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের ঐ উপদেশাবলিতে আরো একটা উপদেশ ছিল এই : যা লিখিবে তাই ছাপাইবার জন্য ব্যস্ত হইও না। তার এ উপদেশটা মানিতে পারি নাই। আল এসলাম নামক মাসিকে প্রবন্ধ ও সওগাত-এ গল্প লিখিতে শুরু করি। বঙ্গ দর্শন-এর সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র নিশ্চয়ই মাসিক কাগজকে সাময়িক পত্রিকা বলেন নাই। তিনি সাপ্তাহিক দৈনিক খবরের কাগজই মিন করিয়াছেন। কাজেই বঙ্কিমচন্দ্রের উপদেশ অমান্য করার দরকার হইল না।
কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষ করিয়াই বুঝিলাম, রোযগারের জন্য চাকরি করিতেই হইবে। রোযগারের জন্য চাকরি ও সাহিত্য সেবার মত এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায় শুধু খবরের কাগজেই। খবরের কাগজের কেন্দ্র কলিকাতা। কাজেই একদিন এই উদ্দেশ্যে কলিকাতা গেলাম।
.
২. ‘ছোলতান’
আমার সাংবাদিক জীবন শুরু হয় ১৯২৩ সালে। আবুল কালাম শামসুদ্দীন। তখন মুসলিম জগত নামক সাপ্তাহিকের সম্পাদক। খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ সাহেবের ছোট ভাই মখদুমী লাইব্রেরির পরিচালক মো. মোবারক আলী সাহেব। (পরে খান বাহাদুর) এই কাগজের মালিক। আমি একটা কিছু চাকরি জোগাড়ের মতলবেই কলিকাতা গিয়াছিলাম। সাংবাদিকতার দাবি সবার আগে। চা-নাশতা হইতে খাওয়া-থাকা সবই শামসুদ্দীনের ঘাড়ে। কাজেই তার সম্পাদকতায় যথাসাধ্য সাহায্য করা কর্তব্য মনে করিলাম। এই কর্তব্যই শেষ পর্যন্ত সুযোগে পরিণত হইল। আস্তে আস্তে ছোট-ছোট সম্পাদকীয় মন্তব্য হইতে বড় প্রবন্ধ লিখিতে শুরু করিলাম। এরই মধ্যে ছহি বড় তৈয়ব নামা নামে পুঁথির ভাষায় একটি রাজনৈতিক প্যারডি স্যাটারার ও সভ্যতায় দ্বৈতশাসন’ নামক একটি দীর্ঘ দার্শনিক রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখি। তাতে মুসলিম সাংবাদিকদের নজরে পড়ি। কতকটা এই কারণে, কতকটা আবুল কালামের চেষ্টায় আমি ত্রিশ টাকা বেতনে মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সাহেবের ছোলতান-এ সহ সম্পাদকের চাকুরি পাই।
ছোলতান-এ আমি প্রায় দেড় বছর কাজ করি। মাওলানা ইসলামাবাদী সাহেবের স্নেহ ও প্রশংসা অর্জন করি। তিনি আমার বেতন ত্রিশ টাকা হইতে চল্লিশ টাকা করিয়া দেন এবং বলেন সাধ্য থাকিলে আরো বেশি দিতেন। ছোলতান-এ কিছু দিন কাজ করিয়াই জানিতে পারি, মৌ. ইসমাইল হোসেন সিরাজী সাহেবও ছোলতান-এর একজন মালিক। তাঁর সাথেও পরিচয় হয়। তিনি আমার লেখার উদ্দীপনা ও ভাষার তেজস্বিতার বহুৎ প্রশংসা করেন। মওলানা সাহেব কিন্তু আমার লেখার তেজস্বিতার চেয়ে যুক্তিবত্তা ও বিষয়বস্তুর প্রশংসা করেন বেশি। যা হোক দুই মুনিবের মন রাখার চেষ্টায় আমার ভালই হইল। আমার লেখায় ওজস্বিতা ও যুক্তিপূর্ণতা সমানভাবে উন্নতি লাভ করিল। আমি মওলানা সাহেবের স্নেহ ও আস্থাভাজন হইয়া বেশ সুখেই দেড় বছর ছোলতান-এ কাটাইলাম। ১৯২৪ সালের জুন-জুলাই মাসে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নেতৃত্ব ও মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের সভাপতিত্বে সিরাজগঞ্জে প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মিলনী হয়। এই কনফারেন্স উপলক্ষে আমি মওলানা আকরম খাঁ সাহেবেরও আস্থা অর্জন করি। তিনি ছোলতান-এ আমার লেখায় আগেই সন্তুষ্ট ছিলেন। কাজেই সিরাজগঞ্জ কনফারেন্সের পর পরই তিনি মওলানা ইসলামাবাদী সাহেবের নিকট চাহিয়া নিয়া আমাকে তার সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে চাকুরি দেন। চল্লিশ টাকার জায়গায় পঞ্চাশ টাকা বেতন পাইতেছি দেখিয়া মওলানা ইসলামাবাদী সাহেব সম্মতি দেন।
.
৩. ‘মোহাম্মদী’
মোহাম্মদীতেও আমি দেড় বছরের বেশি কাজ করি। এই সময় জনাব ফজলুল হক সেলবর্সী ও জনাব মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীও মোহাম্মদীতে কাজ করিতেন। আমি উনাদের জুনিয়র হইলাম। কাজেই সব সিনিয়রের মতই এই দুই বন্ধুও আমাকে দিয়া প্রায় সব কাজ করাইয়া নিতেন। তারা যথাসম্ভব কম লিখিতেন। এতে আমি অসন্তুষ্ট বা দুঃখিত হইতাম না। বরঞ্চ এটাকে আমি তাদের অনুগ্রহ মনে করিতাম। সারা দিন ভূতের মত খাঁটিতাম। সাপ্তাহিক কাগজে প্রতি সপ্তাহে দুইটা করিয়া সম্পাদকীয়তে মাসে আটটা হইত। কোনও কোনও মাসে পাঁচ-ছয়টাই আমি লিখিতাম। সেলবর্দী সাহেবের লেখা ছিল হৃদয়স্পর্শী উচ্ছ্বাস; তিনি যুক্তিতর্কের ধারে-কাছেই যাইতেন না। পক্ষান্তরে ওয়াজেদ আলী সাহেবের লেখা ছিল যুক্তিপূর্ণ। তিনি উচ্ছ্বাসের ধারে-কাছে যাইতেন না। আমি দুইটাতেই দক্ষ ছিলাম। রক্তচক্ষু’, ‘বজ্রমুষ্টি ইত্যাদি বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী উদ্দীপক হেডিং দিয়া আমি একাধারে ওজস্বিতা ও যুক্তিপূর্ণ বহু সম্পাদকীয় লিখিয়া সাংবাদিক মহলে নাম ও মওলানা আকবর খাঁ সাহেবের প্রশংসা অর্জন করিলাম। স্বয়ং মওলানা আকরম খাঁ সাহেবই বলিতেন আমার লেখার মধ্যে সেলবর্সী সাহেবের উচ্ছ্বাস ও ওয়াজেদ আলী সাহেবের যৌক্তিকতা দুইটারই সমন্বয় হইয়াছে। বস্তুত ‘রক্তচক্ষু’, বজ্রমুষ্টি’, ‘সিংহ নিনাদ’ ইত্যাদির মত উদ্দীপনাময়ী অনেক লেখা
‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির’ রিডিং রুমে একজন আবৃত্তির ভঙ্গিতে পড়িতেন, আর সকলে শুনিতেন। একই প্রবন্ধ এমনিভাবে একাধিকবার পড়া হইত। এটা ত গেল সম্পাদকীয় লেখার দিক। একটা সংবাদপত্র, তা সাপ্তাহিকই হউক, আর দৈনিকই হউক, সম্পাদনায় সম্পাদকীয় লেখা ছাড়াও আরো অনেক দিক আছে। দেশি-বিদেশি সংবাদ ছাপা, সেসব সংবাদের হেডিং দেওয়া, পাঠকদের চিঠিপত্র ছাপা, মফস্বলের অভাব-অভিযোগ ও সভা-সমিতির রিপোের্ট ছাপা, সর্বোপরি কাগজটির সার্বিক ও সামগ্রিক গেট আপ ও মেক-আপের সৌষ্ঠব বৃদ্ধির জন্য প্রকাশিত সংবাদসমূহের স্থান নির্ণয়-নির্দেশ করা এবং ঠিকমত এসব কাজ হইতেছে কিনা, শেষ পর্যন্ত তা নিরীক্ষণ ও তসদিক করার জন্য কম্পোযিটার ও মেশিনম্যানদের সঙ্গে সঙ্গে থাকা এবং সবশেষে এ সবের মোটামুটি প্রুফ দেখিয়া দেওয়া খুবই দায়িত্বপূর্ণ ও শ্রমসাধ্য কাজ। বড়-বড় কাগজে এবং দৈনিক কাগজ মাত্রই এ সব কাজ করিবার জন্য বিভাগীয় সাব-এডিটর আগেও ছিলেন। এখন ত আরো বেশি। কিন্তু একটি সাপ্তাহিকের জন্য তৎকালে এত সব ব্যবস্থা ছিল না। সাধ্যও ছিল না। দরকারও ছিল না। কাজেই সাপ্তাহিক মোহাম্মদীর বেলা এ সবই আমাদেরই করিতে হইত। আমাদের মানে তৎকালে আমরা ঐ তিনজন। ওঁরা দুইজনই আমার সিনিয়র। তাঁদের ছিল যেমন সিনিয়রের বোঝা জুনিয়রের কাঁধে ঢালিয়া দেবার অধিকার ও অভিপ্রায়, আমারও ছিল তেমনি ‘বড় বোঝা’ বহিবার জন্য কাঁধ পাতিয়া দিবার আগ্রহ। জ্ঞানী সিনিয়ররা যেমন অজ্ঞ জুনিয়রদেরে ‘ছেলে-ভুলানো’ তারিফ করিয়া কাজ আদায় করিয়া থাকেন, আমার বেলা তা ঘটে নাই, তা বলিতে পারি না। তবে আমি তা বুঝি নাই। বুঝিবার দরকারও হয় নাই, তা বলিতে পারি না। কারণ আমার পরবর্তী সাংবাদিক জীবনে জুনিয়র-স্তরের এই খাটুনি খুবই কাজে লাগিয়াছিল।
যা হোক সিনিয়রদের স্নেহ ও আস্থার ফলে সম্পাদনার উপরোল্লিখিত সব দায়িত্ব ও কর্তব্যই আমার ঘাড়ে বর্তাইত। আমিও ঘাড় পাতিয়া সানন্দেই সব গ্রহণ করিতাম। তারা স্বেচ্ছায় যা দিতেন তার বেশি চাহিয়া নিতাম।
এ সব কাজের মধ্যে সকলের আগে সংবাদে ‘কপি’ তৈয়ার করা। এটা দৃশ্যত ছিল খুবই সহজ কাজ। প্রতিদিন সকালেই বাংলা দৈনিক কাগজগুলি পাইতাম। সে সব কাগজ হইতে বাছাই-করা সংবাদগুলি কেঁচি-কাটা করিলেই সাপ্তাহিকের কপি হইয়া যাইত। কিন্তু শুনিতে এটা যেমন সহজ মনে হয়, আসলে কাজটা তত সহজ নয়। দৈনিকে প্রকাশিত সব খবর সাপ্তাহিক কাগজে দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাতে সর্ব সংবাদই যে সাপ্তাহিকে দেওয়া হইত না, তা-ও নয়। বাছাই-করা সংবাদগুলিই ছোট করিতে হইত। বড়-বড় লেখাকে ছোট করিবার জন্য স্কুল-কলেজে সামারি লিখিবার যে শিক্ষা লাভ করিয়াছিলাম, তা এখানে কাজে লাগিত না। সামারি করিলে আবার নিজের হাতে নিজের ভাষায় লিখিতে হয়। তাই সাংবাদিকরা বড় বড় লেখাকে ছোট করিবার নূতন কায়দা আবিষ্কার করিয়াছেন। গোটা রিপোর্টটা পড়িয়া তার দরকারি অংশগুলি কেঁচি-কাটা করিয়া সেই কাটা অংশগুলি অন্য সাদা কাগজে পেস্ট করিয়া দেওয়া হইত। এই উদ্দেশ্যে সাদা কাগজের পাশে ছোট ও দীঘে লম্বা করিয়া প্যাড বানান হইত। এই প্যাডে কাটা টুকরাগুলি আঠা দিয়া আঁটিয়া দেওয়া হইত। এতেও দক্ষতা লাগিত। কারণ এমন কাটা বিভিন্ন টুকরার মধ্যে সংগতি ও ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য কেঁচি-কাটা অংশগুলির ফাঁকে-ফাঁকে কিছু-কিছু কথা ভরিয়া দিতে হইত। এটা হাতের লেখাতেই করা হইত। তা ছাড়া, আরো একটা খুব বড় অথচ ছোট কাজও করিতে হইত। কলিকাতার সবগুলি বাংলা দৈনিক কাগজই ছিল হিন্দুদের সম্পাদিত ও পরিচালিত। কাজেই তাদের বাংলা ভাষাকেও আমাদের কিছুটা মুসলমানি করিয়া লইতে হইত। এই ধরুন, জলকে ‘পানি’, ‘ঈশ্বরকে’ ‘আল্লাহ’, ভগবানকে ‘খোদা’, ‘পিসা’কে ‘ফুফা, ‘খোঁড়া’কে ‘চাচা’ করিতে হইত। এটা করিতে হইত এই জন্য যে হিন্দু লেখক-সাংবাদিকরা শুধু হিন্দু ব্যক্তিদের মুখ দিয়াই নয় মুসলমান ব্যক্তিদের মুখেও ঐ সব শব্দ ঢুকাইয়া দিতেন। এমনকি মুসলমান মৃত ব্যক্তিকেও ‘কাফন-দাফন’ না করাইয়া ‘অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করাইতেন। ঈদের জামাতে মওলানা সাহেবদের দিয়া এমামতি’ না করাইয়া ‘পৌরাহিত্য’ করাইতেন। বাংলা সাহিত্যের উন্নয়ন যুগের এটা ছিল সেই মুদ্দত যখন বাংলা সাহিত্যের হিন্দু মহারথীদের লেখা নাটক-নভেলে ও মঞ্চে পাঠান-মোগল বাদশা বেগম ও শাহযাদা-শাহযাদীরা পরস্পকে ‘পিসা-পিসি’, ‘খোঁড়া’-’খোড়ী’ সম্বোধন করিতেন। কাজেই মুসলমান পাঠকদের জন্য সাপ্তাহিক চালাইতে গিয়া ঐ সব ভাষিক সংশোধন আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক ছিল। এ সব কাজকে সাব-এডিটিং বলা হইত।
সম্পাদকের নামে লিখিত চিঠি-পত্রও সংশোধন করা দরকার হইত। এই সব চিঠি-পত্র সাধারণত দুই প্রকারের হইত। এক শ্রেণীর চিঠি-পত্র স্থানীয় অভাব-অভিযোগ, রাস্তাঘাট নির্মাণ, পোল মেরামত, স্কুল-মাদ্রাসা স্থাপন, পানির ব্যবস্থার অভাব এই সব অভাব-অভিযোগের প্রতিকার দাবিই সাধারণত এই শ্রেণীর চিঠি-পত্রের বিষয়বস্তু ছিল। কাজেই এক-আধটু ভাষা সংশোধন ছাড়া এসব পত্রে আর কিছু করা দরকার হইত না।
অপর শ্রেণীর চিঠিপত্র ছিল বাদ-প্রতিবাদের মত তর্কিত বিষয়। কোনও প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ। কোনও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিশেষ কাজের অবিচার ও পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি। এ ধরনের চিঠিপত্র খুব সাবধানে ‘সম্পাদন মানে সংশোধন করিতে হইত। এ ধরনের পত্রে সাধারণ সত্য-মিথ্যার আশঙ্কা ছাড়াও মানহানি’ এমনকি রাষ্ট্রদ্রোহিতার’ রিস্ক থাকিতে পারিত। কাজেই এ ধরনের পত্রের সম্পাদনায় অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন আবশ্যক হইত।
সব লেখকদেরই, বিশেষত সাংবাদিকদের, প্রুফ রিডিং জানা অত্যাবশ্যক, এমনকি অপরিহার্য। অবশ্য সব সংবাদপত্রে, সব ছাপাখানাতেও, প্রুফরিডার নামে এক শ্রেণীর বিশেষজ্ঞ থাকেন। প্রুফ রিডিংয়ের কাজ এঁরাই করিয়া থাকেন। কিন্তু সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক (এ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর), সহ-সম্পাদক (সাব-এডিটর) সবারই প্রুফ রিডিং জানা দরকার। এঁদের মধ্যে অনেকে আমাদের সময়েও ছিলেন, আজকালও আছেন, যাঁরা প্রুফ রিডিংয়ে তেমন মনোযোগ দেন না। ওটা তাদের ডিউটি নয় বলিয়া। কিন্তু আমার মতিগতি ছিল অন্য রকম। প্রুফ দেখা আমার একটা বাতিক ছিল বলা চলে। মোহাম্মদীতে এ বিষয়ে আমার মডেল ও শিক্ষাদাতা ছিলেন ওয়াজেদ আলী সাহেব। তারও প্রুফ দেখার নেশা ছিল। ছিলেনও তিনি প্রুফ দেখার উস্তাদ। অবশ্য মোহাম্মদীতে আসার আগেই, ছোলতান-এ কাজ করার সময় হইতেই প্রুফ দেখার কাজে আমি বেশ খানিকটা অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছিলাম। ছোলতান-এর ম্যানেজারই বলুন, মওলানা মনিরুজ্জামান। ইসলামাবাদী সাহেবের সর্বক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি বা প্রাইভেট সেক্রেটারিই বলুন, আর ছোলতান-এর প্রধান সাব-এডিটরই বলুন, মৌ. আলী আহমদ ওলী ইসলামাবাদী সাহেব ছিলেন মিষ্টভাষী সদালাপী, সর্ববিষয়ে অভিজ্ঞ একজন করিতকর্মা লোক। উপরে সাপ্তাহিক কাগজের সহ-সম্পাদকের যেসব। দায়িত্বের কথা বলা হইয়াছে, তার সবগুলি সম্পর্কে অল্পবিস্তর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ করি আমি জনাব আলী আহমদ ওলী সাহেবের নিকট হইতেই। তাঁর সাহচর্যে ছোলতান-এর দেড় বছর স্থায়ী চাকুরিজীবনে সাপ্তাহিক সম্পাদনার অনেক কাজই শিখিয়াছিলাম।
কিন্তু এ সব শিক্ষাই আরো পাকা হইয়াছিল মোহাম্মদীর চাকুরিজীবনে। কাগজও বড় ছিল, প্রচারও বেশি ছিল। কাজেই দায়িত্ব অনেক বড় ছিল। শিক্ষকও পাইয়াছিলাম ওয়াজেদ আলী সাহেবের মত অভিজ্ঞ ও প্রতিভাবান লেখককে। অন্যান্য দিকের মত প্রুফ রিডিংয়েও তিনি আমাকে অনেক শিক্ষাদান করিয়াছিলেন। প্রুফ দেখা শুধু টেকনিক্যাল জ্ঞান লাভ নয়, এটা যে একটা বিশেষ আর্ট, জ্ঞানের চেয়ে দক্ষতা ও নিপুণতা যে এ কাজে অধিক আবশ্যক, এ জ্ঞান আমাকে দান করেন ওয়াজেদ আলী সাহেবই। পরবর্তীকালে দি মুসলমান-এ যোগ দিয়া আমার রাজনৈতিক ও সাংবাদিক গুরু শ্রদ্ধেয় মৌলবী মুজিবর রহমান সাহেবের নিকট বিশেষ করিয়া প্রুফ রিডিংয়ে বিশেষ তালিম পাইয়াছিলাম। সে কথা পরে যথাস্থানে লিখিব। মোহাম্মদীতে দেড় বছর কাল খুব সুখে ও উৎসাহেই কাজ করিবার পর ১৯২৬ সালের প্রথমেই বিনামেঘে বজ্রপাতের মত আমার চাকুরি গেল। আমি ইচ্ছা করিয়া এই চাকুরি ছাড়ি নাই। আমাকে ছাড়াইয়া দেওয়া হয়। ঘটনাটাও এমন বিশেষ কিছু নয়। ১৯২৫ সালের শেষ দিকে মওলানা আবদুল্লাহিল কাফী সত্যাগ্রহী নামে একটি সাপ্তাহিক বাহির করেন। মওলানা আবদুল্লাহিল বাকী ও মওলানা আবদুল্লাহিল কাফী দুই ভাই-এর সাথে আমি মোহাম্মদী আফিসেই পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হই। একই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতের লোক বলিয়া এই দুই ভাই-এর সাথে মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের খুবই মাখামাখি ছিল। কাজেই মওলানা কাফী সাহেব সত্যাগ্রহী বাহির করিলে আমি তাঁর আফিসে ঘন ঘন যাতায়াত করিতাম এবং দরকার হইলে লেখাটেখা দিয়া সাহায্যও করিতাম। মওলানা আকরম খাঁ সাহেব এই খবর পাইয়া মনে-মনে রুষ্ট হইলেন। কিন্তু আমাকে কিছু বলিলেন না। মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের অনেক গুণ থাকা সত্ত্বেও এবং তিনি বহু ব্যাপারে খুবই উদার চিন্তানায়ক হওয়া সত্ত্বেও একটা ছোটখাটো দুর্বলতা তাঁর ছিল। মুরুব্বির নিন্দা করিতে নাই। কিন্তু না বলিয়া উপায়ও নাই। কোনও মুসলমান নূতন বাংলা কাগজ বাহির করিলেই তিনি অসন্তুষ্ট হইতেন, এটা তাঁর বরাবরের দুর্বলতা। হয়ত তার সংগত কারণও ছিল। তিনি খুব সম্ভব মনে করিতেন, নূতন কাগজ বাহির হওয়ায় তাঁর কাগজের অনিষ্ট হইবে। এটা ভাবা নিতান্ত অস্বাভাবিক ছিল না। তৎকালে মুসলমানের পক্ষে সংবাদপত্র বাহির করা এবং চালান খুবই কঠিন ছিল। গ্রাহক-পাঠক সংখ্যাও খুব মুষ্টিমেয় ছিল। বোধ হয় সেইজন্যই মওলানা আকরম খাঁ মনে করিতেন, এই নূতন কাগজটা শেষ পর্যন্ত টিকিবে না; মাঝখান হইতে তাঁর নিজের কষ্টের চালু করা মোহাম্মদীর গ্রাহক কমাইয়া এবং তাতে আর্থিক ক্ষতি করিয়া যাইবে। কাজেই নূতন কাগজ বাহির করাই অন্যায় এবং প্রকারান্তরে মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের কাগজের দুশমনি। এই মনোভাব হইতেই মওলানা আকরম খাঁ সাহেব সত্যাগ্রহী বাহির করার দরুন কাফী সাহেবের উপরও নাখোশ ছিলেন। আমি তাঁরই বেতনভোগী কর্মচারী হইয়া তাঁর দুশমনের সাহায্য করিতেছি, এটাকে হয়ত তিনি ঘোরতর অন্যায় মনে করিলেন। কিন্তু আমাকে তিনি হুঁশিয়ার করিলেন না। কথাবার্তায় বা আভাসে-ইঙ্গিতে বাধাও দিলেন না। দিলে আমি কিছুতেই ও-কাজ করিতাম না। কারণ মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের বা মোহাম্মদীর অনিষ্ট করার ইচ্ছাও আমার ছিল না; পঞ্চাশ টাকা বেতনের চাকুরি ছাড়িবার সংগতিও আমার ছিল না। বরঞ্চ এই পঞ্চাশ টাকা বেতনের চাকুরির উপর ভরসা করিয়া মাত্র অল্পদিন আগে বাপ-মার বহুদিনের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত বিবাহ করিতে রাজি হইয়াছি এবং বিয়ার দিন তারিখও ঠিক হইয়া গিয়াছে।
এমন সময় মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের বড় ছেলে এবং মোহাম্মদীর ম্যানেজার মৌ, খায়রুল আলম সাহেব আমাকে হঠাৎ একদিন জানাইলেন, পরদিন হইতেই আমার চাকুরি নাই। কেন নাই, কী আমার অপরাধ, কিছু বলিলেন না। আমি আসমান হইতে পড়িলাম। চোখে অন্ধকার দেখিলাম। আমি অতি বিনীতভাবে কারণ জানিতে চাইলাম। যা বলা হইল, তার সারমর্ম এই যে, মোহাম্মদীতে আর আমার মন নাই। যেখানে মন আছে সেই সত্যাগ্রহীতেই আমার যাওয়া উচিৎ। ততক্ষণে বুঝিলাম আমার অপরাধ কী? এও বুঝিলাম যে হাজার অন্ধকার দেখিয়াও কোনও লাভ নাই।
.
৪. ‘দি মুসলমান’
মওলানা কাফী সাহেব শুনিয়া মর্মাহত হইলেন। তিনি সব বুঝিলেন। আমাকে বলিলেনও। কিন্তু পঞ্চাশ টাকা মাহিয়ানা দিয়া আমাকে রাখিবার তাঁর সংগতি নাই বলিয়া আফসোসও করিলেন; তবে এও বলিলেন, কিছু একটা করিতেই হইবে। কিছু-একটা তিনি নিশ্চয়ই করিয়াছিলেন। কারণ দুই-একদিন পরেই মৌলবী মুজিবর রহমান সাহেব আমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন এবং পঁয়ষট্টি টাকা বেতনের দি মুসলমান-এ চাকুরি দিতে চাহিলেন, কথা-বার্তায় বুঝিলাম মওলানা কাফী সাহেব সব কথাই তাঁকে বলিয়াছেন। এমনকি, আমি যে বিবাহের তারিখ পিছাইয়া দিতে বাপজীর কাছে পত্র লিখিতে যাইতেছি, সে কথাটা পর্যন্ত কাফী সাহেব মৌলবী সাহেবকে বলিয়া দিয়াছেন। কারণ মৌলবী সাহেব বলিলেন : ‘এক মাসের বেতন অগ্রিম লইয়া তুমি বাড়ি যাও। বিবাহের পরেই তুমি চাকরিতে যোগ দাও। বলা বাহুল্য, আমি কৃতজ্ঞতায় গলিয়া পড়িলাম। মনে হইল, গায়ের চামড়া দিয়া মৌলবী সাহেবের পায়ের জুতা বানাইয়া দিলেও এ ঋণ শোধ হইবে না। বিয়ার পরে যথাসময়ে দি মুসলমান যোগ দিলাম। অতি সুখে শান্তিতে মানে-মর্যাদায় একাদিক্রমে চার বছরকাল মৌলবী সাহেবের বিশ্বস্ত ও স্নেহসিক্ত সহকারী হিসাবে সাংবাদিকতা করিলাম। তিনি প্রথম প্রথম সাব-এডিটরের সাধারণ কাজ করান ছাড়াও এডিটরিয়েল নোট লেখাইতেন এবং শুদ্ধ করিয়া দিতেন। পরে আমাকে দিয়া বড়-বড় বিষয়ে এডিটরিয়েলও লেখাইতেন। ক্রমে আমি তাঁর এত বিশ্বাস অর্জন করিয়াছিলাম যে তিনি নিজে না দেখিয়াও অনেক সময় আমার লেখা প্রেসে পাঠাইয়া দিতেন। এমন কাজ অন্য কারো বেলা তিনি করিতেন না। অধ্যাপক জে এল ব্যানার্জি মৌলবী সাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি একাদিক্রমে অনেকদিন মৌলবী সাহেবের মেহমানরূপে দি মুসলমান আফিসের দুতালায় বাস করিতেন। এই সময়ে তিনি দি মুসলমান-এর সম্পাদকীয় রূপে বহু লেখা লিখিতেন। এ ছাড়া বাবু রসময় ধারা নামে একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক নিয়মিতভাবে দি মুসলমান-এ লিখিতেন। এই দুইজন বিশিষ্ট পণ্ডিত লোকের লেখাও কোনও দিন মৌলবী সাহেব নিজে না পড়িয়া এবং কিছু সংশোধন না করিয়া প্রেসে দিতেন না। সেটা অবশ্য ইংরাজি ভাষা সংশোধন নয় মতবাদ সংশোধন। তিনি আমাকে বলিতেন : এঁরা ভাষা ও বিষয়বস্তুতে পণ্ডিত বটে, কিন্তু মুসলমানের মুখে যেমন করিয়া ফুটা উচিৎ ঠিক তেমনটি এঁরা সব ক্ষেত্রে পারেন না। আরেকটা কথা মৌলবী সাহেব বলিতেন এবং আমাদিগকে সব সময়ে স্মরণ করাইয়া দিতেন : কারো সমালোচনা এমনকি নিন্দা করিতে গিয়া শিষ্টাচার ও ভদ্রতার খেলাফ করিও না। তিনি এইরূপ দৃষ্টান্ত দিতেন :
তুমি জান একজন মিথ্যা কথা বলিয়াছেন। তার কথা লিখিতে গিয়া কখনও লিখিও না তিনি মিথ্যাবাদী, তিনি মিথ্যা কথা বলিয়াছেন। তার বদলে লিখিবে, তিনি সত্যবাদী নন’ বা ‘তিনি সত্য কথা বলেন নাই। কোনও শ্ৰেণী, সম্প্রদায় বা জাতির কোনও সাধারণ দোষের কথা লিখিতে গিয়া কখনও লিখিবে না ‘অমুক শ্রেণী সম্প্রদায় বা জাতির এই দোষ’ তার বদলে লিখিবে ‘ঐ শ্ৰেণী সম্প্রদায় বা জাতির কতকাংশের এই দোষ। এই ধরনের হাজারও নীতি-বাক্য ও মূল্যবান উপদেশ তিনি আমাদিগকে শুনাইয়াছেন। আমরা অনেকেই শিখিয়াছি। পরবর্তী সাংবাদিক জীবনে ঐগুলি আমার পথের দিশারিরূপে কাজ করিয়াছে।
.
৫. ‘খাদেম’
মৌলবী সাহেব আমার ইংরাজি লেখার খুব তারিফ করিলেও তিনি বলিতেন : ‘কিন্তু তোমাকে দিয়া আমি যদি শুধু ইংরাজি লেখাই, তবে তোমার উপর এবং বাংলা সাহিত্যের উপর আমি অবিচার করিব। কতকটা শুধু তোমারই জন্য আমাকে একটা বাংলা কাগজ বাহির করিতে হইবে।’ শেষ পর্যন্ত তিনি করিলেনও তাই। তিনি খাদেম নামে বাংলা সাপ্তাহিক বাহির করিয়া তাঁর সম্পাদনা-পরিচালনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার উপর ছাড়িয়া দিলেন।
খাদেম সম্পাদনার সময় একটি ব্যাপারে আমার বিরাট জয়লাভ ঘটে। ব্যাপারটা এই : স্বামী সত্যদেব নামে এলাহাবাদের এক আর্য সমাজী ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁকে অভ্যর্থনা দেওয়া লইয়া মুসলমানদের মধ্যে বিরাট হৈ চৈ শুরু হয়। কলিকাতায় তাঁকে অভ্যর্থনা ও টাকার তোড়া দেওয়ার বিপুল আয়োজন। সব মুসলমান সংবাদপত্র এ কাজের সমর্থন করেন। শুধু খাদেম এ আমি একা এ কাজের প্রতিবাদ করি। আমার বক্তব্য এই যে কোনো অমুসলমান ইসলাম কবুল করিলেই তাকে অভ্যর্থনা দেওয়ার যে ঘটা হয়, এটা ইসলাম ও মুসলমান সমাজের জন্যই অপমানকর। এতে প্রমাণিত হয় যে ঐ ভদ্রলোক ইসলাম ও মুসলমান সমাজের শক্তি ও মর্যাদা বাড়াইয়াছেন। এই লেখার দরুন খাদেম-এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হইল, আমার বিরুদ্ধে মৌলবী সাহেবের কাছে নালিশ করা হইল। মৌলবী সাহেব আমার মতের সমর্থন করিয়াও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাইতে আমাকে উপদেশ দিলেন। আমি চুপ করিলাম। স্বামী সত্যদেব মওলানা মহীউদ্দিনরূপে কলিকাতা আসিলেন তাকে রাজকীয় অভ্যর্থনা দেওয়া হইল। যতদূর মনে আছে চার লাখ টাকার একটা তোড়া দেওয়া হইল। দেখাদেখি ঢাকা, চাটগা এবং রেঙ্গুনে তাঁকে অনুরূপ অভ্যর্থনা ও টাকার তোড়া দেওয়া হইল। এই ধুমধামে আমার পক্ষে রাস্তাঘাটে বাহির হওয়া বিপদসংকুল হইয়া উঠিল। কাগজে ও সভা-সমিতিতে আমার নামে ছি ছি হইতে থাকিল। মওলানা মহীউদ্দিনকে বাংলা-বর্মা ভ্রমণ শেষ করিয়া ফিরিবার পথেও বিরাট বিদায় অভিনন্দন দেওয়া হইল।
এরপর আমার জয়ের পালা। মওলানা মহীউদ্দিন মুসলমানদের পাঁচ লাখের মত টাকা হস্তগত করিয়া এলাহাবাদে ফিরিয়াই আর্য ধর্মে পুনঃ দীক্ষিত হইলেন এবং স্বামী সত্যদেব হইয়া গেলেন। শুধু তা-ই নয়। তিনি আমার অভিজ্ঞতা এই গোছের নাম দিয়া একটি বই লিখিলেন। তাতে তিনি বলিলেন, ইসলাম ও মুসলমান সমাজ সম্পর্কে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লাভের জন্যই তিনি ইসলাম গ্রহণ করিয়াছিলেন। কয়েক মাস মুসলমান থাকিয়া তিনি নিঃসন্দেহে বুঝিতে পারিয়াছেন যে ইসলামের মত অসভ্য ধর্ম ও মুসলমান সমাজের মত বর্বর ও ব্যভিচারী জাতি দুনিয়ায় আর নাই। অভ্যর্থনাওয়ালাদের মুখে চুনকালি পড়িল। আমার সমর্থকদের দন্ত বিকশিত হইল। কিন্তু বিজয়ানন্দের উল্লাসের বদলে নিজের হতভাগ্য নির্বোধ সমাজের জন্য আমার চোখে পানি আসিল।
.
৬. প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তি
ইতিমধ্যে আমি উকালতি পাশ করিয়াছিলাম। যদিও মৌলবী সাহেব আমার বেতন বাড়াইয়া পঁয়ষট্টি হইতে পঁচাশি করিয়া দিয়াছিলেন, তবু ঐ টাকাও যথেষ্ট নয় মনে করিয়া আমি ময়মনসিংহে উকালতি করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করি। মৌলবী সাহেবের ন্যায় পিতৃতুল্য স্নেহময় মুরুব্বি এবং সাংবাদিক জীবন ছাড়িয়া আসিতে আমার খুবই কষ্ট হয়। তবু এটা করিলাম। কারণ ইতিমধ্যে একটি ছেলে হইয়াছে। বাড়ির অবস্থাও অধিকতর খারাপ হইয়াছে। বাপজী আরো দেনাগ্রস্ত হইয়াছেন। কাজেই বেশি টাকা রোযগারের আশায় সাংবাদিক জীবন ছাড়িলাম।
মৌলবী সাহেব আমার স্বার্থপরতায় নিশ্চয়ই মনে-মনে দুঃখিত হইয়াছিলেন। কারণ এই সময় তিনি দি মুসলমানকে দৈনিক করিবার চিন্তা করিতেছিলেন। এ কাজে তিনি আমার উপর অনেকখানি নির্ভরও করিতেছিলেন। তবু আমাকে বাধা দিলেন না। বরঞ্চ আইনের বই-পুস্তক কিনায় আমাকে সাহায্য করিলেন। আমার মত নগণ্য সাব-এডিটারকে নিজ ব্যয়ে এক ফেয়ারওয়েল পার্টি দিলেন। এই পার্টিতে স্যার আবদুর রহিম, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মৌ, আবদুল করিম, মৌ. আবুল কাসেম, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, নবাব মশাররফ হোসেন, মওলানা আকরম খাঁ, ডা. আবদুল্লা সোহরাওয়ার্দী, মৌ. এ কে ফজলুল হক, হাজী আবদুর রশিদ, মি. সৈয়দ নাসিম আলী, খান বাহাদুর আজিজুল হক, অধ্যাপক জে এল ব্যানার্জি, খান বাহাদুর আসাদুজ্জামান প্রভৃতি অনেক গণ্যমান্য লোক উপস্থিত ছিলেন। সকলের সামনে তিনি আমার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিলেন। উপসংহারে বলিলেন : উকালতিতে আবুল মনসুর নাম করুক, আল্লাহর দরগায় এই দোওয়া করিয়াও তাঁকে এই আশ্বাস দিতেছি যে, দি মুসলমান এর দরজা সর্বদাই তার জন্য ভোলা রহিল। যখনই সে মনে করিবে উকালতি তার ভাল লাগে না, তখনই দি মুসলমান-এ আসিতে পারিবে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস মুসলিম সাংবাদিকতায় আবুল মনসুর যথেষ্ট দান করিতে পারিত। মৌলবী সাহেবের মতের উপর আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল। কাজেই তাঁর প্রশংসায় আমি গর্বিত হইলাম। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত বদলাইলাম না। ভাগ্যিস, তিনি আমাকে মত বদলাইবার হুকুম করেন নাই। তিনি যদি একবার বলিয়া ফেলিতেন : ‘তোমার যাওয়া হইবে না’ তবে আমার পক্ষে তাঁর আদেশ অমান্য করা সম্ভব হইত না। তিনি তা জানিতেন বলিয়াই তেমন কথা বলেন নাই। এইভাবে আমার সাংবাদিক জীবনের প্রথম পর্যায় শেষ হইল ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে।