সতেরো
সন্ধে নাগাদ সরিৎশেখরকে খানিকটা সুস্থ দেখাচ্ছিল। সারাদিন জল আর বিস্কুট ছাড়া কিছু খাননি। অনিমেষ জোর করে একটা সন্দেশ খাইয়ে দিলে বৃদ্ধের গলার স্বর একটু স্বাভাবিক হল। সরিৎশেখর বললেন, একটু বাথরুমে যাবেন।
সারাটা দিন শুয়েই কাটিয়েছেন তিনি, ওঠার কোনও কারণও ছিল না। ওরকম জ্বরো রোগী যে হেঁটে চলে বেড়াবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ততক্ষণে অনিমেষের খেয়াল হল যে দাদু একবারও বাথরুমে যাননি। এবং কথাটা শোনামাত্র সে বিচলিত হয়ে পড়ল। ওদের এই হস্টেলের বাথরুম-পায়খানা খুব সভ্য ধরনের নয়। এতগুলো মানুষের প্রয়োজন মেটাতে হয়তো কিছু সুবন্দোবস্ত করা যেত কিন্তু তার সুরক্ষা সম্ভব নয়। প্রতি তলায় একটা করে ঘেরা জায়গা আছে ক্ষুদ্র প্রয়োজনের জন্যে কিন্তু বৃহৎ ব্যাপারের ব্যবস্থা নীচে। জায়গাটা যেমন অন্ধকার তেমন স্যাঁতসেঁতে। আগের হস্টেলটা এসব ব্যাপারে অনেক ভদ্র ছিল। কিন্তু এই বাড়িটা এত প্রাচীন এবং কিছুটা রহস্যময় ভঙ্গিতে গঠিত যে এর উন্নতি করা অসম্ভব। জলপাইগুড়ি থাকতে যে মানসিক গঠন ও অভ্যাস অনিমেষের ছিল কলকাতার হস্টেলে থাকতে এসে তা কিছুটা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। ওটা এমন বয়স যা সবকিছু মানিয়ে নিতে পারে। এখন এগুলোর গুরুত্ব সারাদিনের জীবনে এত কম যে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও দরকার বোধ করেনি অনিমেষ। মনে পড়ে, প্রথম দিন এক ঘরে অপরিচিত ছেলের সঙ্গে থাকতে হবে জেনে চোখে জল এসে গিয়েছিল। সারাটা ছেলেবেলা সে কারও সঙ্গে ভাগ করেনি, কিন্তু পরবর্তীকালে তো তাও অভ্যেস হয়ে গেল।
কিন্তু সরিৎশেখর কী করে এইরকম ব্যবস্থা মেনে নেবেন? সারাটা জীবন যে মানুষ সাহেবদের সঙ্গে কাটিয়ে মানসিকভাবে কতগুলো রুচি মেনে চলেন, তাঁর পক্ষে এই ধরনের বাথরুম ব্যবহার করা অসম্ভব। হয়তো ভেতরে ঢুকেই বেরিয়ে আসবেন। কী করা যায় বুঝতে পারছিল না অনিমেষ।
সরিৎশেখর বললেন, ‘তুমি কি আমার কথা শুনতে পাওনি?’
অনিমেষ ব্যস্ত হয়ে উঠল। তারপর দাদুকে সযত্নে ধরে ধরে সামনের ছাদে নিয়ে গেল। কোনার দিকে দুটো দিক দেওয়াল ঘেরা জায়গাটায় পৌঁছে বলল, ‘এখানেই সেরে নিন।’ ভেতরে দুটো সিমেন্ট লাগানো ইট ছাড়া কিছু নেই।
অনিমেষ যা আশঙ্কা করছিল তাই হল, সরিৎশেখর বেরিয়ে এসে বললেন, ‘এখানে জলের কল নেই?’
‘না। মানে, এটা খুব প্রয়োজনের জন্যে। রোজ জমাদার এসে ধুয়ে দিয়ে যায়।’ অনিমেষ দাদুর দিকে তাকাল।
‘কিন্তু জল না-হলে হাত ধোব কী করে?’ সরিৎশেখর অবাক।
অনিমেষ এক ছুটে নিজের ঘরে ঢুকে কুঁজো থেকে গেলাসে জল গড়িয়ে সেটা আবার সরিৎশেখরের কাছে নিয়ে এল। ব্যাপারটা দেখে সরিৎশেখর হতভম্ব হয়ে গেলেন, ‘তুমি খাওয়ার জলে শৌচ করো নাকি আজকাল? ছি ছি!’
অনিমেষ বলল, ‘আপাতত এই জলে কাজ মিটিয়ে নিন, আমি ভাল করে ধুয়ে রাখব।’
ঘরে ঢুকে সরিৎশেখর বললেন, ‘শিক্ষা মানুষকে এমন নোংরা করে ভাবতে পারি না। তোমাকে এতদিন আমি কী শেখালাম!’
অনিমেষ বলল, ‘এখানে আমি একা কী করব? যেমন পরিবেশ তেমনভাবেই চলতে হচ্ছে।’
‘তোমরা হস্টেলের মালিককে বলো না কেন?’
‘কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামায় না দাদু।’
‘বাঃ, চমৎকার। সভ্য সমাজের মিনিমাম প্রয়োজন সম্পর্কেও তোমরা এত উদাসীন? মাঝরাতে পেট খারাপ হয় না কারও?’ সরিৎশেখর কড়া চোখে নাতিকে দেখলেন।
‘আপনি এরকম পরিবেশে তো কখনও থাকেননি তাই চোখে লাগছে। কলকাতা শহরের লোক এসবে অভ্যস্ত।’ জবাবদিহি করার ভঙ্গিতে বলল অনিমেষ। কিন্তু বলার সময়েই সে বুঝতে পারছিল দাদু তার এসব কথায় কোনও আমল দেবেন না। বাথরুমে এই, পায়খানায় ঢুকতে গেলে দাদু যে কী কাণ্ড করবেন ভাবতেই শক্ত হয়ে গেল। আসলে এসব খামতি নিজের চোখে ঠেকেনি কিংবা ঠেকলেও পাত্তা পায়নি।
সরিৎশেখর বললেন, ‘এই ঘরে তুমি থাকো?’
অবাক হল অনিমেষ। এ কীরকম কথা? অন্যের ঘরে কি সে দাদুকে থাকতে বলবে? তবু স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সে ঘাড় নাড়ল।
‘এভাবে তোমার থাকতে ইচ্ছে করে?’
অনিমেষ ঘরটার দিকে তাকাল। রোজ দেখে অভ্যস্ত চোখে ঘরটা একই আছে। সে বলল, ‘এই ঘরটাই সবচেয়ে নিরিবিলি।’
‘আমি সে-কথা বলছি না। বিছানার চাদরটা ক’মাস কাচোনি? বালিশের ওয়াড়টার চেহারা দেখেছ? ওখানে মুখ রাখতে তোমার প্রবৃত্তি হয়? বইপত্তর স্তূপ করে ছড়ানো, এখানে ওখানে জামা ঝুলছে, দেওয়ালে ঝুল। একটা মানুষের রুচি তার শোওয়ার জায়গায় ফুটে ওঠে। তাই না?’ সরিৎশেখর নিজের ঝোলাটা এগিয়ে দিলেন, ‘এতে একটা চাদর আছে, তাই পেতে দাও।’
অনিমেষ খুব অসহায় বোধ করছিল।
সে যতটা সম্ভব গোছগাছ করেছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও দাদু এগুলো আবিষ্কার করলেন। বিছানার চাদর তার দুটো, আর একটা সেট বালিশের ওয়াড় ধোব ধোব করে ধোওয়া হয়নি। অনিমেষের চোখে এগুলো তেমন নোংরা নয়। এ হস্টেলেরই অনেক ছেলে আছে খুব সাজগোজ করে থাকে। এমনকী ফুলদানি এবং ধূপ জ্বালার শখও আছে অনেকের। ওরকম মেয়েলি স্বভাব অনিমেষ রপ্ত করতে পারেনি।
মোটামুটি একটা ব্যবস্থা করে দাদুকে শুইয়ে দিয়ে অনিমেষ বলল, ‘আপনি একটু বিশ্রাম নিন, আমি ঘুরে আসছি।’
সরিৎশেখর বললেন, ‘আজ তো তোমাকে ক্লাস করতে দিলাম না, সন্ধেবেলায় পড়তে বসবে না?’
কথাটা শুনে অনিমেষের মজা লাগল। কলকাতায় আসার পর তাকে কেউ পড়তে বসার কথা বলেনি। অথচ ওই একটা কথায় দাদু সমস্ত ছেলেবেলাটাকে সামনে এনে দিলেন। এই মানুষই সন্ধেবেলায় চিৎকার করে না-পড়লে এমন শাসন করতেন যে অনিমেষ তটস্থ থাকত। দাদুকে সে এখন কী করে বোঝাবে যে পড়াশুনো ব্যাপারটা সময় মেপে করার অভ্যেসটা আর নেই। প্রয়োজনমতো সেটা করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে।
অনিমেষ মুখে কিছু বলল না। হাত বাড়িয়ে সরিৎশেখরের কপাল স্পর্শ করে বলল, ‘নাইন্টি নাইনের বেশি হবে না। এখন চুপ করে শুয়ে থাকুন। অনেক কথা বলেছেন। আমি ডাক্তারকে রিপোর্ট দিয়ে আসি।’
সরিৎশেখর বললেন, ‘বড্ড কড়া ওষুধ এনেছ, মাথা ঝিমঝিম করছে।’
অনিমেষ বলল, ‘ডাক্তারকে বলব।’
ঘরের দরজা ভেজিয়ে সে ভাবল তমালকে একবার খোঁজ করবে কি না। বুড়ো মানুষটাকে একদম একা রেখা যেতে মন চাইছে না। তারপর মত পালটাল। এই সন্ধে-ছোঁয়া সময়টা কোনও জোয়ান ছেলে হস্টেলে পড়ে থাকে না। আর থাকলেও তাকে এক অসুস্থ বৃদ্ধের সঙ্গে জোর করে বসিয়ে রেখে যাওয়া অন্যায় হবে। তমাল নিজে আজ সকালে যা করেছে তাই অনেক।
নীচের গেটে সুপারিনটেনডেন্টের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এই প্রবীণ অধ্যাপকটির ওপরে যদিও হস্টেলের দায়িত্ব কিন্তু কোনও ব্যাপারে নাক গলান না। এমনকী খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও ছেলেদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। প্রতি মাসে একজন করে ম্যানেজার ঠিক করে দেন, সেই চালায়। দাদু ওর ঘরে আছেন এই খবরটা নিজে থেকে ভদ্রলোককে দেওয়া উচিত, যদিও এরকম চালু আইনটা কেউ বড় একটা মানে না। অনিমেষকে দাঁড়াতে দেখে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিছু বলবে? ও হ্যাঁ, তোমার ঘরে একজন অসুস্থ বৃদ্ধ এসেছেন শুনলাম। তিনি কে হন তোমার?’
‘আমার ঠাকুরদা।’
‘কেমন আছেন এখন?’
‘ভাল।’
‘ওঁর তো এখানে থাকতে অসুবিধে হবে। তোমার কলকাতা শহরে আর কোনও আত্মীয় নেই?’
‘না। উনি একটু সুস্থ হলেই চলে যাবেন। আপনার আপত্তি নেই তো?’
‘ঠিক আছে।’ ভদ্রলোক চলে যেতে অনিমেষের খেয়াল হল সারাদিনে দাদুকে জিজ্ঞাসাই করা হয়নি কী কারণে তিনি মাথা ন্যাড়া করে একা একা কলকাতায় এলেন? আশ্চর্য! সে যে কেন একটুও প্র্যাকটিক্যাল হতে পারল না আজও!
ডাক্তার চেম্বারেই ছিলেন। ভদ্রলোকের পসার খুব জমজমাট। কলকাতা শহরের মানুষের রোগ বোধহয় লেগেই থাকে। এবং এতে ডাক্তাররা খুশিই হন। অপেক্ষারত মানুষগুলোকে দেখতে দেখতে অনিমেষের মনে হল, আচ্ছা, যদি আজ এঁদের সবাই সুস্থ থাকতেন তা হলে ডাক্তারের মন কেমন থাকত? অর্থের জন্যে মানুষের মন সবসময় নিম্নগামী হয়।
সকালে যে লোকটা তাকে আটকেছিল সে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল। বেশ খাতিরে গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করবেন?’
এইসব ন্যাকামো অনিমেষের সহ্য হচ্ছে না আজকাল। সে এখানে বেড়াতে আসেনি জেনেও এ ধরনের প্রশ্নের কোনও মানে আছে? বাজারের থলে হাতে দেখেও কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, কী বাজারে যাচ্ছেন, তখন ন্যাকামো ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে। অনিমেষ মুখে কিছু না-বলে ঘাড় নাড়ল।
‘পাঁচ মিনিট দাঁড়ান। ডাক্তারবাবু একজনকে চেক করছেন, মেয়েছেলে তো! বসুন না, ওখানে বসুন।’ লোকটা ব্যস্ততা দেখাল।
‘ঠিক আছে।’ অনিমেষ ওকে এড়াতে সামনের টেবিল থেকে ম্যাগাজিন তুলে চোখ রাখল। আজ সকালে এই লোকটা তাকে পাত্তা দিতে চায়নি আর এখন খাতির করছে কেন? ঘরে এখন কমসেকম বারোজন লোক, সিরিয়ালি এলে ঘণ্টা দুই অপেক্ষা করতে হতে পারে, অথচ লোকটা বলল পাঁচ মিনিট দাঁড়ান! তার মানে নিয়ম ভাঙবে লোকটা। তখন যদি সবাই প্রতিবাদ করে—। অনিমেষ ঠিক করল কেউ কিছু বললে সে ভেতরে ঢুকবে না। ঘণ্টা দুই পরে ঘুরে আসবে।
কিন্তু ভদ্রমহিলা চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসতেই লোকটা যখন হাত নেড়ে তাকে ভেতরে যেতে বলল তখন কেউ আপত্তি করল না। এতকাল শুনে এসেছে অসুস্থতা মানুষকে অধৈর্য করে, কিন্তু এঁরা বেশ চুপচাপ।
পরিশ্রম করে ডাক্তার একটু আরাম করছিলেন সিগারেট ধরিয়ে, অনিমেষকে দেখে ভ্রূ কোঁচকালেন, ‘ও তুমি! কতক্ষণ এসেছ?’
‘এইমাত্র।’ অনিমেষ বসল না। কারণ বসার মতো সময় নেওয়ার কোনও মানে হয় না।
ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘উনি কেমন আছেন?’
‘এখন একটু ভাল। জ্বর কম কিন্তু খুব দুর্বল বোধ করছেন। ওষুধগুলো খুব কড়া বলছিলেন।’ অনিমেষ বলল।
‘পেচ্ছাপ হয়েছে?’
‘একবার, বিকেলে।’
‘শোনো ওঁর বয়স হয়েছে। আজ যদি জ্বর চলে যায় তো ভাল কিন্তু আবার যদি আসে তা হলে তুমি ম্যানেজ করতে পারবে না। ভিটামিন ডেফিশিয়েন্সি তো আছেই, মনে হয় ক’দিন কিছু খাননি। আবার যদি জ্বর আসে ব্লাড আর ইউরিন পরীক্ষা করিয়ে নেবে। প্রেসক্রিপশনটা দাও।’ হাত বাড়ালেন ডাক্তার।
অনিমেষ পকেট থেকে কাগজটা বের করে এগিয়ে দিতে তাতে খসখস করে কয়েকটা শব্দ লিখে ফেরত দিলেন, ‘দুটো ওষুধ চেঞ্জ করে দিলাম। আজ রাত্রে হরলিক্স আর সন্দেশ দেবে; দুধ সহ্য নাও হতে পারে। কাল যদি জ্বর না-থাকে এই ফুডগুলো দেবে। ঠিক আছে।’ মাথা নেড়ে ওকে বিদায় করতে চাইলেন ডাক্তার।
অনিমেষ ওষুধগুলোয় চোখ বুলিয়ে নিতে গিয়ে ভাবছিল, যেগুলো সকালে কেনা আছে সেগুলো কী করবে জিজ্ঞাসা করা উচিত কিনা! কিন্তু কথা না-বাড়িয়ে সে দরজার দিকে ফিরতেই শুনল, ‘হস্টেলে কোনও বৃদ্ধ রোগীর দেখাশোনা হয় না। ওঁকে অন্য কোথাও শিফট করো। আর আমার চেম্বারে একটা ফোন আছে। এভাবে হুটহাট চলে আসার চেয়ে টেলিফোনে কথা বললে ভাল হয়।’
কথাটা চুপচাপ শুনল অনিমেষ। অন্যায় কিছু বলেননি ডাক্তার। অন্য সময় সে কী করত বলা যায় না, এখন মাথায় অন্য চিন্তা ঢুকেছে। আজ সকালে ওষুধপত্র কিনতে বেশ কিছু খরচ হয়ে গেছে। বাবা যে টাকা পাঠান তাতে সব খরচ মিটিয়ে সামান্যই নিজের জন্যে থাকে। এখানে আসার পর কোনও বড় রকমের অসুখ-বিসুখ করেনি তার, বাড়তি খরচের প্রশ্ন ওঠেনি। অনেকে বাড়ি থেকে পাঠানো টাকার কিছু কিছু প্রতি মাসে জমিয়ে রাখে। অনিমেষের ক্ষেত্রে সে-কথা ওঠে না।
চেম্বার থেকে বেরিয়ে সামনের ওষুধের দোকানে গিয়ে প্রেসক্রিপশনটা দেখাতে আরও কিছু টাকা চলে গেল। তার কাছে বড়জোর কুড়িটা টাকা পড়ে আছে। মাসের একেবারে শেষ হলে দুটো টাকাও থাকত না। অনিমেষ ভাবছিল, দাদু নিশ্চয় বেশিদিন থাকবেন না। কিন্তু বাকি মাসটা কীভাবে চালাবে! বাবার কাছে নতুন করে টাকা চেয়ে চিঠি দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।
ব্যাপারটা নিয়ে আর-একটু চিন্তা করতে গিয়ে অনিমেষ একটা ব্যাপার আবিষ্কার করে থতমত হয়ে গেল। পৃথিবীতে তার যদি সবচেয়ে আপন বলে কেউ থাকে তা হলে সরিৎশেখর। ছোটবেলায় এই মানুষটিকে ঘিরে সে কত রকমের স্বপ্ন দেখত। বাবা, ছোটমা কিংবা পিসিমা হেমলতাও সেই স্বপ্নের ধারেকাছে আসতে পারেননি কখনও। আর আজ অসুস্থ সরিৎশেখর মাত্র একটা দিন তার কাছে এসে ওঠায় সে দিশেহারা হয়ে পড়ছে। অনিমেষ নিজেকে শাসন করল। দাদু এত জায়গা থাকতে তার কাছে এসে উঠেছেন এটাই ভাগ্যের কথা। তাঁর জন্যে যদি খরচ হয় তো হোক। নিজের কাছে না-থাকলে হস্টেলের ছেলেদের কাছে ধার করলে চলবে। আর কেউ না-থাক পরমহংস আছে। টিউশনির টাকা জমিয়ে রাখে ও। চাইলে নিশ্চয়ই দেবে। কিন্তু এ ঘটনা থেকে একটা সত্য খুব জোরালো হল অনিমেষের কাছে। না, আর ঢিলেমি নয়, এবার কিছু টাকা রোজগার করতেই হবে। টিউশনির কপাল সবার থাকে না। তা ছাড়া অন্য লোকের বাড়ির মর্জি মতন পড়ানো তার পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
হাতিবাগানের মোড়ে দাঁড়িয়ে এইসব কথা ভাবছিল অনিমেষ। এখন, এই সন্ধেবেলায় বেশ ভিড় হয়। মেয়েরাই কেনাকাটা করতে অথবা দোকান দেখতে বেরিয়ে পড়েছে। অনিমেষের এসব দিকে খেয়াল ছিল না। কিছু একটা গম্ভীরভাবে চিন্তা করতে গেলেই এরকম হয়। আশেপাশের সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে যায়। ওই অবস্থায় মনে হল কেউ যেন তাকে ডাকছে। তারপর আচমকা কারও হাতের ঝাঁকুনিতে ও সজাগ হল। চমকে যাওয়া ভাবটা সামলে পেছনে ফিরে ও সত্যি অবাক হল।
‘তুমি কি তোমার মধ্যে ছিলে? কী ভাবছিলে এত?’
‘একী সারপ্রাইজ সুবাসদা। কোত্থেকে এলে?’
‘বেলগাছিয়ায় গিয়েছিলাম। ট্রাম থেকে তোমাকে দেখতে পেয়ে নেমে এলাম। তখন থেকে নাম ধরে চেঁচাচ্ছি কোনও সাড়া নেই। অসুখ টসুখ আছে নাকি?’
অনিমেষ লজ্জা পেল, ‘না না। আসলে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম এই আর কী। আঃ, অনেকদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হল। কিন্তু তুমি যে কলকাতায় আছ তাই জানতাম না। বিমানদা বা সুদীপ— কেউ তো বলেনি।’
‘বলেনি, হয়তো বলতে ইচ্ছে হয়নি কিংবা ভুলে গেছে।’ সুবাস যেন হাসল।
কথাটা কেমন বেসুরো লাগল কানে, অনিমেষ বলল, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’
‘সব কথা না-বোঝাই ভাল। অনেক সময় বুঝতে না-চাইলে উপকার হয়। তার চেয়ে চলো আমরা একটু চা খাই। সেই বিকেল থেকে ঘুরছি, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ওই তো একটা চায়ের দোকান, চলো।’ সুবাস অনিমেষের হাত ধরে রাস্তা পার হবার জন্য এগোল।
সুবাসদার কথাবার্তা একটু অন্যরকম। অনিমেষের মনে হচ্ছিল কিছু একটা হয়েছে। সুবাসদাকে ওর ভাল লাগে। বলতে গেলে কলকাতায় পা দিয়েই সুবাসদার সঙ্গে তার যোগাযোগ। বোধহয় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তাকে সেদিন বাঁচিয়েছিল সুবাসদা। লোকটা খুব চাপা এবং কারও ব্যাপারে নাক গলাতে ভালবাসে না।
কিন্তু এখন চায়ের দোকানে বসলে হস্টেলে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। যদিও এর পরে দাদুকে ওষুধ দিতে হবে রাত দশটা নাগাদ তবু অতক্ষণ একা একা থাকতে ওঁর অসুবিধে হতে পারে। কাউকে বলেও আসা হয়নি। দেরি করে হস্টেলে ফিরলে দাদু অসন্তুষ্ট হবেন। ভাববেন এইরকম সময়ে ফেরা ওর নিয়মিত অভ্যেস।
রাস্তা পার হতে হতে অনিমেষ মনে মনে হেসে ফেলল। স্কুলে পড়ার সময় দাদুর ভয়ে সন্ধের আলো জ্বলবার আগেই খেলার মাঠ থেকে দৌড় শুরু করত বাড়িতে ফেরার জন্যে। আলো জ্বলে গেলে বুক ধড়াস ধড়াস করত শাস্তি পাওয়ার ভয়ে। সেই ব্যাপারটাই যেন এতদিন বাদে কলকাতায় তার কাছে ফিরে এসেছে। কিন্তু সুবাসদাকে ছেড়ে যেতেও ইচ্ছে করছে না। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারত সে ডাক্তারের দেখা পেয়েছে স্বাভাবিকভাবে দু’ঘণ্টা অপেক্ষার পর। তা হলে তো সেই দেরি হতই যার জন্যে কিছু করার ছিল না তার। মনে মনে একটু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করল অনিমেষ। অন্তত ঘণ্টাখানেক দেরি করে ফিরলেও ম্যানেজ করা যায়।
রেস্টুরেন্টে বেশ ভিড়। একটু দাঁড়িয়ে থেকে দুটো বসার জায়গা জোগাড় করল ওরা। একই টেবিলে অন্য লোক রয়েছে। তারা যে কথা বলছে তা স্বাভাবিকভাবে এমন চেঁচিয়ে বলার নয় তবু অনর্গল বলে যাচ্ছে। এরকম ব্যাপার প্রায়ই লক্ষ করেছে অনিমেষ। ট্রামে বাসে মানুষেরা এমন স্বচ্ছন্দে পারিবারিক গল্প করে যে মনে হয় সেখানে তারা ছাড়া আর কেউই নেই। ট্রাম-বাসের ঠাস ঠাস ভিড় যেন নির্জন গাছের মতো।
দুটো চা বলে সুবাসদা নিচু গলায় বলল, ‘এখন কী করছ?’
কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না অনিমেষ। ছাত্র হিসেবে তার এখন পড়াশুনা করার কথা। তবু এই প্রশ্নটা নিশ্চয়ই অকারণ নয়। ইঙ্গিতটা অনুমান করলেও এড়িয়ে গেল অনিমেষ। মুখে কিছু না-বলে হাসল।
সিগারেট ধরিয়ে সুবাসদা বলল, ‘তোমাদের ইউনিয়নের কাজকর্ম কেমন চলছে?’
‘ভালই। আসলে ছাত্রদের দাবিদাওয়া নিয়ে মাঝে মাঝে ভি সি-র কাছে যাওয়া আর স্লোগান দেওয়া ছাড়া ইউনিয়নের কাজকর্ম আর কী আছে বলুন?’
দিয়ে-যাওয়া-চায়ে চুমুক দিল অনিমেষ। দিয়ে মনে পড়ল আজ বিকেলে তার চা খাওয়ার কথা খেয়ালই ছিল না।
‘তুমি পার্টির অফিসে যাচ্ছ না?’
‘দু’-তিন দিন গিয়েছিলাম; ওখানে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে ভাল লাগে না, আমি বোধহয় গায়ে পড়ে আলাপ করতে পারি না— তাই।’
‘কয়েকদিন আগে পুলিশের গুলিতে দু’জন কমরেড খুন হয়। তোমরা এর প্রতিবাদে ছাত্র ধর্মঘট করেছিলে, কেমন হয়েছিল?’
‘সাকসেসফুল। আসলে এসব ছুতো পেলে ছাত্ররা ক্লাসে ঢোকার দায় থেকে বাঁচে, তা সে যে-ই ডাকুক না কেন!’ অনিমেষ বলল।
‘কিন্তু ধর্মঘটটা করলে কেন?’
অনিমেষ হকচকিয়ে গেল, ‘মানে?’
‘কত লোক তো প্রতিদিন খুন হচ্ছে সেজন্যে তো তোমরা ধর্মঘট করছ না! এই সেদিন প্রাক্তন বিপ্লবী খুন হলেন, তোমরা কোনও প্রতিবাদ করোনি, এখন করলে কেন?’
অনিমেষ সুবাসদার মুখের দিকে তাকিয়ে অর্থটা ধরতে চেষ্টা করল কিন্তু বিফল হল। সে বলল, ‘এ তো সোজা কথা। যে দু’জন মারা গেছে তারা পার্টির লোক আর আমাদের ছাত্র সংগঠন সেই পার্টির মতবাদে বিশ্বাস করে তাই প্রতিবাদ জানানো দরকার ছিল।’
‘বেশ বেশ, আমি এই কথাটাই শুনতে চাইছিলাম। ছাত্ররা এখন আর দেশের বৃহত্তম শক্তি হিসেবে কেন গণ্য হবে না সে সন্দেহ কেউ করবে না। দেখা যাচ্ছে প্রতিটি ছাত্র সংস্থা বিশেষ রাজনৈতিক দলের কর্মপন্থা অনুসরণ করে। অন্যভাবে বলতে গেলে ছাত্র সংস্থাগুলো রাজনৈতিক দলের একটা শাখা। তাই তো?’
‘একথা সবাই জানে সুবাসদা। তুমি কী বলতে চাইছ?’
‘পার্টি যদি ভুল করে এবং সেই ভুলটা ছাত্রদের ওপর চাপিয়ে দেয় তা হলে তুমি কি সেটা সমর্থন করবে?’ অনিমেষের মুখের দিকে তাকাল সুবাস সেন।
অনিমেষ ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, ‘তা কেন? পার্টি যদি ভুল করে তা হলে সেটা দেখিয়ে দিয়ে সংশোধন করা উচিত।’
‘কিন্তু নেতারা যদি জেনেশুনে ভুল করেন, তা হলে?’
‘তা কেন করবে?’
‘করবে এবং করছে। এটাও এক ধরনের রাজনীতি।’
‘কী করে সম্ভব সুবাসদা! প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলের নির্দিষ্ট আদর্শ আছে। না-হলে একটার সঙ্গে আর-একটার কোনও পার্থক্য থাকবে না। নেতারা যদি সেই আদর্শ মানতে না-চান তা হলে তার প্রতিবাদ দল থেকেই উঠবে। যারা কর্মী তারা চুপ করে থাকবে কেন?’
‘চুপ করে থাকবে স্বার্থের জন্যে।’
‘না, এ-কথা আমি মানি না।’
‘আমি মানি।’
‘কারণ?’
‘কারণ এই প্রতিবাদ করার জন্যে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমরা যে ক’জন বেরিয়ে যেতে বাধ্য হলাম তারা ছাড়া আর কেউ একটা কথা বলেনি। এমনকী আমাদের ওপর যে আচরণ করা হল তার সমালোচনা করার সাহস কেউ করেনি।’
অনিমেষ হতবাক হয়ে গেল। সুবাসদাকে দল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে? সেই সুবাসদাকে? যে এতগুলো বছর দলের জন্যে প্রাণপাত করে গেল, নিজের ভবিষ্যতের দিকে না-তাকিয়ে বীরভূমের গ্রামে দলের হয়ে কাজ করে বেড়াল, তাকে? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল অনিমেষের। কোনওরকমে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কবে হয়েছে এই ব্যাপারটা?’
সুবাসদা হাসল, ‘মাসখানেক। তুমি জানতে না দেখে অবাক হচ্ছি।’
‘না আমি জানি না। বিমানদারা জানে?’
‘অবশ্যই। ওরাই তো সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল আমাকে তাড়ানোর ব্যাপারে। দেখো, বিধান রায় মারা যাওয়ার পর থেকেই আমাদের নেতারা যেন গন্ধ পাচ্ছেন একদিন মন্ত্রিত্বটা দলের হাতে আসবে। তারপর থেকে সবার চালচলন মতামত দ্রুত পালটে যাচ্ছে। এটাই হল সবচেয়ে দুঃখের কথা। এখন কেউ কাউকে চটাতে চায় না। চোখ বুজে অন্যায় এড়িয়ে যাচ্ছে সবাই।’
‘তোমাদের কী কারণে এক্সপেল করা হল?’
‘পার্টির বর্তমান কার্যধারার সমালোচনা করেছিলাম। মুখে যা বলা হয়েছিল কাজে তা হচ্ছে না। দীর্ঘদিন গ্রামে থেকে ওখানকার মানুষগুলোর কাছে ক্রমশ প্রতারক হয়ে যাচ্ছি। কমিউনিজমের প্রথম কথাই হল মানুষের সমানভাবে বাঁচার অধিকার আদায় করতে হবে। অথচ দলের মধ্যে ছোটখাটো হিটলারের ছড়াছড়ি। নিঃস্ব মানুষের পার্টি কখনও জোতদারের ওপর নির্ভর করে চলতে পারে না। গত কুড়ি বছরে পার্টির নেতারা কতগুলো ফাঁকা বুলি আওড়ে যাচ্ছে যেগুলোর বাস্তব রূপায়ণের কোনও চেষ্টা এ-দেশে হয়নি। এ-দেশের কমিউনিজম তাই একটা হাওয়ার বেলুনের মতো, ধরা-ছোঁয়া যায় না। আমরা বলেছিলাম নতুন রক্ত চাই নেতৃত্বে। যে মানুষগুলো এতগুলো বছরে দলকে সুনির্দিষ্ট পথে চালাতে পারল না তাদের সরে যেতে হবে। এর ফল একটাই হল এবং আমরা জানতাম, আমাদেরই সরে যেতে হয়েছে।’
অনিমেষ বলল, ‘কিন্তু এরকম করলে দল ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়বে। যত ভাঙন হবে তত শত্রুপক্ষ উৎসাহিত হবে।’
‘শত্রুপক্ষ? আমরাই তো আমাদের বড় শত্রু।’
‘কিন্তু—।’
‘শোনো, কমিউনিস্ট পার্টির দুটো ভাগ হল কেন? চিনা সমস্যা? মোটেই না। তুমি কি জানো, হোম মিনিস্টার যখন রেডিয়োতে ঘোষণা করেছিল যে কমিউনিস্ট পার্টির একটা শাখা এই দেশে সশস্ত্র বিপ্লব আনতে চায় চিনের স্বার্থে তখন আমাদের প্রধান নেতা কী বলেছিলেন তাকে? সেই সকালে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন আমরা কমিউনিস্টরা আইনসম্মত গণতান্ত্রিক কার্যধারায় বিশ্বাস করি। কোনওরকম সশস্ত্র বিপ্লবের ধারেকাছে আমরা নেই। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তা হলে দল ভাগ হল কেন? কমিউনিস্ট পার্টির ডান-বাম যদি একই পথে চলে তা হলে আলাদা হাঁড়ি করতে হল কেন? সেটা নেতৃত্বের গোলমাল না আদর্শের সংঘাত তা এখন আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না।’
সুবাসদা কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল। রেস্টুরেন্টের অনেকেই এদিকে এখন তাকাচ্ছে। এমনকী সামনের লোক দুটোও। সেটা বুঝতে পেরে সুবাসদা উঠে দাঁড়াল। দাম মিটিয়ে বাইরে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি তো এখনও মানিকতলায় আছ, তাই না?’
অনিমেষ বলল, ‘না। আমি এই গ্রে স্ট্রিট-হরি ঘোষ স্ট্রিটের মোড়ের হস্টেলে এসেছি। আসবে?’
‘আজ থাক। তোমাকে আমার দরকার। ব্যাপারটা ভাবো। এসব কথা এখনই কাউকে বলার দরকার নেই। আমি শিগগিরই দেখা করব।’
‘কী করছ সুবাসদা?’ অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।
‘আমাদের এখন কী করা উচিত তাই ভাবছি অনিমেষ।’