শ্রাবণ মাস।
ভোমরা নদী ফুলে-ফোঁপে উঠেছে। শহরবাড়ির সামনের বিস্তৃত মাঠ জলমগ্ন। পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে মনে হয় শহরবাড়ির উঠানে পানি চলে আসবে। পাঁচ-ছয় বছর পর পর এরকম হয়, শহরবাড়ির উঠানে পানি চলে আসে। পানিতে জোয়ার-ভাটার টান পর্যন্ত হয়।
মঞ্জু অত্যন্ত আনন্দিত। তাঁর প্রধান কাজ গামবুট পরে পানিতে হাঁটাহাঁটি। সে নিজে নেত্রকোনা শহর থেকে গামবুট কিনে এনেছে। রাতে সে শহরবাড়িতে ঘুমায় না। পানশি নৌকায় ঘুমায়। পানশি নৌকা উত্তরের ঘাটে বাধা থাকে। নৌকার ছাঁইয়ের ভেতর ডাবল তোষকের বিছানা। তোষকের উপর সুনামগঞ্জের শীতলপাটি। কোলবালিশ। এলাহি ব্যবস্থা। মঞ্জুর রান্নবান্না নৌকার ভেতরই হয়। রান্না করে নিরঞ্জন। বন্দুও উঠে এসেছে নৌকায়। তার কােজ নৌকার গলুইয়ে ছিপ ফেলে বসে থাকা। এই কাজটা সে গভীর আগ্রহ এবং আনন্দের সঙ্গে করে। তাকে দেখে মনে হয়, এতদিনে সে মনের মতো একটা কাজ পেয়েছে। ফাৎনার দিকে তাকিয়ে মঞ্জু নামের মানুষটার সঙ্গে গল্প করতে তার বড় ভালো লাগে। সব গল্পই সে সাধারণভাবে শুরু করে, শেষ করে ভূত-প্রেতে। মঞ্জুকে কিছুদিন হলো সে মামা ডাকা শুরু করেছে।
মামা, পানি কেমন বাড়তাছে দেখছেন?
হুঁ।
শহরবাড়ির ভিতরে যদি পানি না। ঢুকে, আমি আমার দুই কান কাঁইট্টা কুত্তরে খাওয়াইয়া দিব। এইটা আমার ওয়াদা। আপনেরে সাক্ষি মাইন্যা কথাটা বললাম। ইয়াদ রাইখেন।
ইয়াদ রাখব।
আপনের ঘটনাটা কী বলেন দেখি, নিজ দেশ গ্রামে আর ফিরবেন না?
ফিরব না কেন? অবশ্যই ফিরব। এদের একের পর এক ঝামেলা যাচ্ছে, এখন যাই কীভাবে? পরীবানুর সন্তান হোক তারপরে বিদায়।
আপনারে একটা কথা বলি মামা?
বলো।
আপনে যদি চইল্যা যান। আপনার সাথে আমিও যাব।
তুমি চলে গেলে এখানে চলবে কীভাবে?
না চললে নাই। আমি এই বাড়ির কিনা গোলাম না। আমার যেখানে ইচ্ছা আমি যাব। আমারে কিন্তু সাথে নিতে হবে।
আচ্ছা দেখা যাবে।
দেখা যাওয়া যাওয়ির কিছু নাই মামা। আমি যাবই।
মঞ্জু দেশের বাড়ি চলে গেলে তাঁর সঙ্গে বদু ছাড়াও আরো একজন যাবার আগ্রহ প্ৰকাশ করেছে। তার নাম জাইতরী। তবে সে মঞ্জুকে বড়পীর সাহেবের নামে কসম কাটিয়েছে কথাটা কাউকে বলা যাবে না। কথাটা গোপন রাখতে হবে।
আজ মঞ্জুর ব্যস্ততার সীমা নেই। সে মূল বাড়ির সামনে দুপুর থেকেই হাঁটাহাঁটি করছে। পরীবানুর প্রসব বেদনা উঠেছে আজ ভোরবেলায়। যে-কোনো সময় সন্তান হতে পারে। উল্লাপাড়া থেকে বিখ্যাত ধাই রুসামের মাকে আনা হয়েছে। সে ঘোষণা করেছে, কন্যার পেটে সন্তান দুইটা। অঘটন ঘটতে পারে। জোড়া মোরগ যেন ছদগা দেওয়া হয়। ছদগার মোরগ হতে হবে। ধবধবে সাদা। সাদা মোরাগের সন্ধানে লোক গেছে।
লীলা সতীশ ডাক্তাকে খবর দিয়ে আনিয়েছে। পুরুষ ডাক্তারের এখানে কিছুই করার নেই। আঁতুড়ঘরে কোনো পুরুষ মানুষই ঢুকতে পারে না। তারপরেও লীলা তাকে কেন আনিয়ে রেখেছে সে-ই জানে। সতীশ ডাক্তার বাংলাঘরে বসে পান-তামাক খাচ্ছেন।
সিদ্দিকুর রহমান আশেপাশে নেই। তিনি লোকমান-সুলেমানকে নিয়ে জঙ্গলে গেছেন। সেখানে পানি উঠেছে। বেশির ভাগ জায়গাই ড়ুবে গেছে। পানির উপর মাথা ভাসিয়েছে কচুগাছ। কচুগাছে ফুল ফুটেছে। সেই ফুলের গন্ধ নেশা ধরা। ফুলগুলি দেখতেও সুন্দর, ধবধবে সাদা। তিনি হাত ইশারায় লোকমানকে ডাকলেন। লোকমান-সুলেমান দুই ভাই-ই ছুটে এলো।
লোকমান!
জি চাচাজি।
একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ? জংলি ফুলের গন্ধ আর বাগানের ফুলের গন্ধ আলাদা। সব জংলি, ফুলের গন্ধে নেশা নেশা ভাব হয়।
লোকমান কিছু বলল না। সিদ্দিকুর রহমান আগ্রহ নিয়ে বললেন, আমি আরেকটা জিনিস লক্ষ করেছি, জংলি ফুলের রঙ হয় সাদা।
এই বিষয়ে লোকমানের কিছু বলার ছিল। সে লাল-হলুদ অনেক রঙের ফুলাই জঙ্গলে ফুটতে দেখেছে। এই জঙ্গলেই কয়েকটা জবা গাছ আছে। হাতের থাবার মতো বড় টকটকে লাল রঙের ফুল ফোটে। এই বিষয় নিয়ে চাচাজির সঙ্গে বাহাস করা তার পক্ষে সম্ভব না।
লোকমান!
জি চাচাজি।
জঙ্গলে পানি ঢুকেছে। হাঁটাচলা করা মুশকিল। আমার বসার ব্যবস্থা করো। একটা চৌকি এনে কোথাও পাতো। চৌকিতে বসে থাকব।
জি আচ্ছা।
জি আচ্ছ না। এখনই নিয়ে আসো। দুই ভাই চলে যাও।
আপনি একা থাকবেন?
একা থাকব কী জন্যে? আমার চারদিকে গাছপালা। এরাও আমার সঙ্গে আছে। তোমরা দাড়ায়ে থেকে না, চলে যাও।
লোকমান কিছু বলছে না, মাথা চুলকাচ্ছে। সুলেমান সাহস করে বলল, চাচাজি, আপনের ঘরে যাওয়া দরকার।
কেন?
মাসুদ ভাইজানের স্ত্রীর সন্তান হবে। ধাই বলেছে অবস্থা ভালো না।
আমি সেখানে গিয়ে কি কিছু করতে পারব? পারব না। মেয়েদের সন্তান প্রসবের বিষয়ে পুরুষদের কিছু করার নাই। তাছাড়া আমার বড় মেয়ে আছে। যা ব্যবস্থা নেবার সে নিবে। নিবে না সুলেমান?
জি নিবেন।
তোমরা চলে যাও। বড় দেখে চৌকি আনবা। চৌকির পায়ার নিচে ইট দিয়া চৌকি উঁচু করবা।
লোকমান-সুলেমান চলে গেছে। আকাশে মেঘ করেছে। ফোটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। সিদ্দিকুর রহমান চাপা গলায় বললেন, এই তোমরা আছ কেমন?
প্রশ্নটা গাছপালার উদ্দেশে। প্রশ্নটা করেই তার মনে হলো, চারপাশের বৃক্ষরাজি তাঁর প্রশ্ন বুঝতে পারছে। তারা প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করছে। উত্তর দেবার কৌশল জানা নেই বলে উত্তর দিতে পারছে না।
সিদ্দিকুর রহমান চোখ বন্ধ করে আবারো বললেন— তোমরা কেমন আছ?
মাগরেবের আজানের পর পর দাই রুসামের মা লীলাবতীর হাত ধরে বলল, মা গো, সন্তান প্রসব হবে না। একটা সন্তান উল্টা হইয়া নিচে নামছে আরেকটা নামতে পারতেছে না। আমার করনের কিছু নাই। আমারে বিদায় দেও।
লীলা হতভম্ব হয়ে বলল, কিছুই করার নাই?
রুসমের মা বলল, কিছুই করার নাই। বিষয়টা এখন ডাক্তার কবিরাজের হাতে নাই–আল্লাহপাকের হাতে। সদর হাসপাতালে নিয়া দেখতে পারো। শুনেছি সেইখানে পেট কাইট্টা বাচ্চা বাইর করে।
লীলা বলল, সদর হাসপাতাল তো অনেক দূরে, নেত্রকোনা। এত দূর নেয়ার সময় কি আছে?
নেত্রকোনা যাইতে সারা রাইত নাও বাইতে হবে। অত সময় নাই।
সিদ্দিকুর রহমানের জন্যে জঙ্গলের মাঝামাঝি জায়গায় খাট পাতা হয়েছে। তিনি মাগরেবের নামাজ শেষ করে খাটে পাতা জায়নামাজে বসেছেন, তখন খবরটা শুনলেন। সিদ্দিকুর রহমান শান্ত গলায় বললেন, আমার মেয়ে কি কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে?
লোকমান বলল, উনি নৌকা নিয়া এক্ষণ রওনা দিবেন বলে বলেছেন।
তোমরা দুই ভাই সঙ্গে যাও। ঝড়ের অগ্ৰে যেন নাও যায়।
আপনে বাড়িতে চলেন।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি এইখানেই থাকব। আমার কথা মাথা থাইক্যা দূর করো— তোমাদের যা করতে বলছি করো।
প্ৰবল বর্ষণ শুরু হয়েছে। নৌকা পড়েছে হাওরে। বিখ্যাত শনির হাওর। সামান্য বাতাস দিলেই বিশাল ঢেউ উঠছে। নৌকা টালমাটাল করছে। মঞ্জু, নৌকার গলুইয়ে বসে ভিজছে। ছাঁইয়ের ভেতর থেকে একেকবার কাতরানির শব্দ আসছে আর মঞ্জুর শরীর কেঁপে উঠছে। পরীবানু নামের মেয়েটির সঙ্গে তার কোনোদিন কোনো কথাও হয় নাই–অথচ মেয়েটার কষ্টে তার বুক ভেঙে যাচ্ছে। সে কিছুক্ষণ পরপর আল্লাহর কাছে দোয়া করছে, হে আল্লাহপাক, একজনের জীবনের বিনিময়ে অন্য একজনের জীবন তুমি দিতে পারো। সম্রাট বাবর তার পুত্র হুমায়ুনের জন্যে নিজের জীবন দিয়েছিলেন। আমি পরীবানু মেয়েটার কেউ না। আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও দুঃখী মেয়েটার জীবন তুমি রক্ষা করো আল্লাহপাক।
নৌকা নিয়ে সামনে এগুনো যাচ্ছে না। প্ৰবল বাতাস সামনের দিক থেকে আসছে। বৃষ্টি কমে এসেছে, কিন্তু বাতাসের প্রবল বেগ।
ছাইয়ের দুই মুখ শাড়ির পর্দা দিয়ে ঢাকা। বৃষ্টিতে শাড়ি ভিজে ভারী হয়ে আছে। তারপরেও বাতাসে দুলছে। ছই থেকে একটা হারিকেন ঝুলানো হয়েছে। বাতাসে হারিকেন দুলছে। পরীবানুর গা চাদর দিয়ে ঢাকা। তার ফর্সা রক্তশূন্য মুখ চাঁদরের ভেতর থেকে বের হয়ে আছে। লীলাবতী বসেছে পরীর মাথার কাছে। সে পরীর হাত ধরে আছে। সেই হাত থারথার করে কাঁপছে। পরীবানু। বলল, বুবু, আমার মৃত্যু ঘনাইছে ঠিক না?
লীলা কিছু বলল না। সে একমনে দোয়া ইউনুস পড়ছে— লাইলাহা ইল্লা আনতা সোবাহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজজুয়ালেমিনা। সে দোয়া ঠিকমতো পড়তেও পারছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে, কোথাও কোনো গণ্ডগোল হচ্ছে।
বুবু। ও বুবু।
দুইটা সন্তানই কি মারা যাবে? কেউ বাঁচবে না?
শেষরাতে রমিলা খুব হৈচৈ করতে লাগলেন। তিনি তার হাতের টর্চ দিয়ে জানালার শিকে বাড়ি দিচ্ছেন। গোঙানির মতো শব্দ করছেন। সিদ্দিকুর রহমান রমিলার ঘরের জানালার কাছে এসে দাড়ালেন। রমিলা বললেন, আমারে গরম পানি দিতে বলেন, নতুন সাবান দিতে বলেন, নয়া শাড়ি দিতে বলেন। আমি সিনান করব। আল্লাহপাকের দরবারে শুকরানা নামাজ পাঠাব। আপনার পুত্ৰ মাসুদের দুইটা সন্তান হয়েছে। দুইটাই পুত্ৰ সন্তান। তারা ভালো আছে। সন্তানদের মাতাও ভালো আছেন। বলেন, আলহামদুলিল্লাহ।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আলহামদুলিল্লাহ।
তিনি একবারও জিজ্ঞেস করলেন না, রমিলা, এই সংবাদ কোথায় পেয়েছে? কীভাবে পেয়েছে?
মঞ্জু বিরাট দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছে। দুটা পুত্ৰ সন্তান হয়েছে। এখন আযান কি একবার দেয়া হবে, না দুইবার? কেউ তাকে কিছু বলতেও পারছে না। তারা এখনো নৌকায়। হাসপাতালে পৌঁছাতে দেরি আছে। পরীবানুর সন্তান নৌকাতেই হয়েছে এবং ভালোমতোই হয়েছে। তার জ্ঞান আছে। সে জড়ানো গলায় কিছু কথাও বলছে। দুটি বাচ্চাকেই মায়ের বুকে শুইয়ে দেয়া হয়েছে। বাচ্চা দুটির গলায় বিপুল শক্তি। তারা ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছে।
মঞ্জুর পাশে সতীশ ডাক্তার বসে আছেন। শেষ মুহুর্তে সন্তান প্রসবের কাজ তিনিই করিয়েছেন। মঞ্জু বলল, ডাক্তার সাহেব, আযান একবার দিব না। দুইবার? কিছু একটা বলেন।
সতীশ ডাক্তার বললেন, আপনাদের ধর্মের বিষয়ে তো আমি কিছু জানি না।
আপনার বিবেচনায় কী বলে?
আমার বিবেচনা বলে দুইবার। সন্তান যখন দুইটা।
মঞ্জু বলল, আমি এই দুই ছেলের নাম রাখলাম। প্ৰথমজনের নাম ঝড়। দ্বিতীয় জনের নাম তুফান। দুই ভাই একত্রে ঝড়-তুফান। হা হা হা।
বদু নৌকার হাল ধরেছিল, সে আনন্দিত গলায় বলল, নাম অতি চমৎকার হয়েছে।
মঞ্জু, আযান দিচ্ছে।
পরীবানু লীলার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল, বুবু, আমার নাম দুইটা খুব পছন্দ হইছে— ঝড়-তুফান। বুবু, দুইজনের মধ্যে কে বেশি সুন্দর? ঝড় না তুফান?
লীলা জবাব দিতে পারছে না। সে কেঁদেই যাচ্ছে। তার কান্না থামবে এরকম মনে হচ্ছে না।