১৭. শ্রাবণের মেঘাচ্ছন্ন রাত্রি

প্রদ্যোত ডাক্তার বারান্দায় বসে ছিল। শ্রাবণের মেঘাচ্ছন্ন রাত্রি, অসহ্য গুমটের মধ্যে ঘরে ঘুম আসা এক অসাধ্য ব্যাপার; তার ওপর মশারি। মশা এখানে খুব বেশি ছিল। লোকে বলত বিনা মশারিতে শুয়ে থাকলে মশারা সমবেতভাবে তুলে নিয়ে চলে যেতে পারে। আজকাল মশা কমেছে। ডি. ডি. টি. ক্যাম্পেন শুরু হয়েছে গত বছর থেকে। তবুও প্রদ্যোত বিনা মশারিতে শোয় না। একটি মশাও কামড়াতে পারে এবং সেইটিই অ্যানোফলিস হতে পারে এবং তার। বাহিত বিষটুকুতে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার বীজাণু থাকতে পারে। বাইরে মশারি খাঁটিয়ে শুলে হয়, কিন্তু তাতে মঞ্জ অর্থাৎ ডাক্তারের স্ত্রী ভয় পায়। শহরের মেয়ে, তার ওপর এ অঞ্চল সম্পর্কে ছেলেবেলায় অনেক চোরডাকাত ভূতপ্রেত সাপবিছের গল্প শুনেছে সে। মঞ্জুর মায়ের মাতামহের। বাড়ি ছিল এই দেশে। মায়ের মাতামহ অবশ্য বেঁচে নেই এবং মামাও কোনো কালে ছিল না, অর্থাৎ মঞ্জুর মা ছিল মা-বাপের এক সন্তান; থাকবার মধ্যে মঞ্জুর বৃদ্ধা মাতামহী বেঁচে আছে। কানে কালা, চোখেও খুব কম দেখে। সে-ই গল্প করত। ভূতপ্রেত মঞ্জু বুদ্ধি দিয়ে অবিশ্বাস করে, তর্কও করে, কিন্তু অন্ধকারে কোনো শব্দ উঠলেই চমকে ওঠে। সেই কারণে বন্ধ ঘরে শুতে যাবার আগে যতক্ষণ পারে প্রদ্যোত ডাক্তার বসে থাকে। মধ্যে মধ্যে ফ্লিট স্পে করে দেয়। চারিপাশে বারান্দার নিচে সিঁড়িতে কার্বলিক-অ্যাসিড-ভিজানো খড় ছিটানো থাকে। আর থাকে ডি. ডি. টি. পাউডার এবং ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো। সাপ পোকা বিছে আসতে পারে না।

সকালবেলা থেকেই প্রদ্যোতের মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। রতনবাবুর ছেলে বিপিনবাবুর। কেসে এখানকার হরেন ডাক্তার তাকে কল দিয়েছিল; আকস্মিকভাবে হিকার উপসর্গ এসে জুটেছে। কল দিয়েছিল কাল সকালে। একটা নিষ্ঠুর যন্ত্রণাদায়ক অবস্থা। মনে হয় হয়ত যে-কোনো মুহূর্তে নিষ্ঠুর পরিণতি এসে উপস্থিত হবে। হরেনের সঙ্গে পরামর্শ করে যা করবার করেছে তারা, কিন্তু কোনো ফল হয় নি। আজ সকালে কিশোরবাবু প্রস্তাব করলেন–জীবন মশায়কে ডাকা হোক। প্রস্তাবটা বোধহয় রতনবাবুর, কিশোরকে দিয়ে প্রস্তাবটা তিনিই করিয়েছেন। প্রদ্যোত ডাক্তার কী বলবে? মনে উত্তরটা আপনিই এসে দাঁড়িয়েছিল-বেশ তো দেখান। আমি কিন্তু আর আসব না। কিন্তু কথাটা বের হবার আগেই কিশোরবাবু বলেছিল–আপনি কিন্তু বলতে পাবেন না—আর আসব না। আমার অনুরোধ। আমি শুনেছি আপনি তার উপর অসন্তুষ্ট। কিন্তু তিনি অসন্তোষের লোক নন।

ডাক্তার বলেছিলেন—এর মধ্যে সন্তোষ-অসন্তোষের কথা কী আছে কিশোরবাবু? আপনাদের রোগী, ইচ্ছে হলে ভূতের ওঝাও ডাকতে পারেন।

–আপনি একটু বেশি বলছেন প্রদ্যোতবাবু। বলছেন না? নিজের মর্যাদাটাকে বড় করে বিচার করবেন না। সত্যকে বড় করে খতিয়ে বলুন প্রদ্যোতবাবু। কিশোরবাবু মানুষটি বিচিত্র। তার মধ্যে কোথায় যেন অলঙ্নীয় কিছু আছে। তাকে লঙ্ন করা যায় না। সমগ্র দেশের লোকের প্রীতির পাত্র। আজীবন দেশের সেবাই করে আসছেন। এখানে প্রদ্যোত ডাক্তার এসে অবধি কত ছোটখাটো উপকারে ওঁর কাছে উপকৃত তার আর হিসেব নেই। এখানকার লোকগুলি সহজ নয়। মঞ্জু আধুনিকা, সে বাইসিক্ল চড়ে একা যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়, এর জন্য কুৎসা রটিয়েই ক্ষান্ত হয় নি—উপরে দরখাস্ত করেছিল। প্রদ্যোতের বন্ধু এই জেলারই সদরে ল্যাবরেটরিতে প্র্যাকটিস করে, সে মধ্যে মধ্যে আসে এখানে তার সঙ্গে জড়িয়ে কুৎসিত অভিযোগ এবং হাসপাতালের ওষুধ চুরির অপরাধও ছিল তার সঙ্গে। কয়েকটা কেসে প্রদ্যোত বন্ধুর ল্যাবরেটরিতে রোগীর রক্ত ইত্যাদি পরীক্ষা করিয়েছিল বলে তা নিয়েও অনেক কথা ছিল সে দরখাস্তে। মুখে মুখে এ নিয়ে কথার তো অন্ত ছিল না; বিচিত্র প্রশ্ন সব। ও বাবা, এ যে দুই বঁধুতে মিলে বেশ ফাঁদ পেতেছে! রক্ত পরীক্ষা থুতু পরীক্ষা প্রস্রাব পরীক্ষা-দাও টাকা এখন। চোর চোরাটি আধা ভাগ। এতকাল এসব ছিল না–তা রোগ ভাল হত না?

কিশোরবাবুই এ সমস্ত অপবাদ এবং প্রশ্ন থেকে রক্ষা করেছেন। অযাচিতভাবে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন।

এখানে থাকলে দুটি বেলা কিশোরবাবু তাদের খবর নেন। কিশোরবাবুর প্রশ্নে এই কারণেই ডাক্তারকে ভেবে দেখতে হয়েছিল। কিশোরবাবু বলেছিলেন—ভাল করে ভেবে দেখুন ভাই। এখানে প্রশ্ন হল মূল্যবান একটি জীবনের। আর মশায়কে তো আমরা আপনাদের উপরওয়ালা করে ডাকছি না; ডাকছি সাহায্য করবার জন্যে। ওঁকে ডাকছি-উনি নাড়িটা দেখবেন আর হিকাটা থামিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন। তাতে আপনাদের যেসব শর্ত আছে তা বলে দিন তাঁকে। কই হরেন চারুবাবু এঁরা তো আপত্তি করছেন না।

হরেন ডাক্তার চারুবাবু মত দিয়ে গেছেন। চারুবাবু বলে গেছেন—খুব ভাল কথা। ওঁর অনেক মুষ্টিযোগ আছে। অব্যৰ্থ ফল হয়। শুধু আফিংঘটিত কিছু যেন না দেন।

এরপর অগত্যা প্রদ্যোতকে মত দিয়ে আসতে হয়েছে। বলতে সে পারে নিওঁদের মত ওঁদের, আমার মত আমার। আমি আর আসব না। কিন্তু এ নিয়ে একটা অস্বস্তি তার মনে সেই সকাল থেকেই ঘুরছে। উৎকণ্ঠিত হয়ে আছেন জীবন মশায় নামক এই দেশজ ভিষণাচার্যের ভেষজের ফলের জন্য। একটা বিষয়ে সন্তুষ্ট হয়েছে সে। ওই নিদানবিশারদ এক্ষেত্রে নিদান হকে নি। তাদের ভুল ধরে নি। চারুবাবুদের সঙ্গে তার আলোচনার কথা বোধহয় বৃদ্ধ শুনেছে। তবুও অস্বস্তি রয়েছে। ওই ওষুধের ফলের জন্য অস্বস্তি। তার সঙ্গে আরও যেন কিছু আছে। এর ওপর একটি রোগী আজ অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে তার হাতে মারা গিয়েছে।

কী যে হল?

সব থেকে যেটা তাকে পীড়িত করছে সেটা হল তার ভ্রান্তি। সকালবেলা সে দেখে বলে এসেছিল—রোগী বেশ ভাল আছে। জ্বর ছেড়ে গেছে। কাল পথ্য দেব। একটু যেন ড্রাউজি ভাব ছিল—আচ্ছনের মত পড়ে ছিল রোগী, কিন্তু ডাক্তার সেটাকে দুর্বলতা মনে করেছিল। ছেলেমানুষ শিশু রোগী। রোগীর বুড়ি ঠাকুমা বলেছিল-ভাল কী করে বলছ বাবা তুমি? বালা রুগীজ্বর ছেড়েছে, ভাল আছে তো মাথা তুলছে কই, খেতে চাচ্ছে কই?

ডাক্তার তাকে বলে এসেছিল তুলবে মাথা। একটু দুর্বল হয়ে আছে। ওটা কাটলেই তুলবে। আর আমাদের কথায় বিশ্বাস করুন। না করলে তো চিকিৎসা করতে পারব না।

বিকালবেলা ছেলেটা হঠাৎ কোলান্স করলে। ডাক্তার ছুটে গিয়েছিল। ইনজেকশনও দিয়েছিল বার তিনেক, কিন্তু সন্ধের সময় মারা গেছে ছেলেটা।

ডাক্তার ভাবছিল। কোথায় ভুল হল তার? আগাগোড়া? ডায়াগনোসিসে?

হ্যাঁ, তাই। ম্যালেরিয়া বলে ধরেছিল সে। কিন্তু ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। ভুল হয়ে গিয়েছে। সেইখানে। কুইনিন ইনজেকশনও সে দিয়েছিল।

ফলটা হয়েও স্থায়ী হল না। ইনট্রাভেনাস দেওয়া উচিত ছিল।

ডাক্তার অকস্মাৎ চকিত হয়ে ইজিচেয়ারের উপরেই সোজা হয়ে বসল। কুইনিন অ্যাম্পুলটা? সেটার ভিতর ঠিক কুইনিন ছিল তো? বিনয়ের দোকান থেকে কেনা অ্যাম্পুল। একালের এই ঔষুধ ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস নেই। না—নেই। এরা সব পারে। কলকাতায় জাল ওষুধ তৈরি করার একটা গোপন কিন্তু বিপুল-আয়তন আয়োজনের কথা অজানা নয়। এবং তাদের সঙ্গে ওষুধের দোকানদারদের যোগাযোগের কথাও অপ্ৰকাশ নেই। বিনয়চন্দ্র পাকা ঝানু ব্যবসাদার। মিষ্টি মুখের তুলনা নেই। সাধুতার সততার এমন সুকৌশল প্রচার করতে পারে লোকটি যে মনে সমের উদয় হয়। কিন্তু প্রদ্যোত নিজে ডাক্তার তার কাছে বিনয়ের লাভের প্রবৃত্তির কথাও তো অজ্ঞাত নয়। চার পয়সা যে দাগে ওষুধের খরচ তার দাম চার আনা। এ নিয়ে কথা তার সঙ্গে হয়েছে। কিন্তু বিনয় সবিনয়ে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে—ওর কমে দিলে লোকসান অবশ্যম্ভাবী। বছরের পর বছর বিনয় জমি কিনছে, সঞ্চয় বাড়াচ্ছে। এবার নাকি নতুন একটা বাড়ি করবে। বিনয় সব পারে। প্রদ্যোতের কান দুটো উত্তপ্ত হয়ে উঠল, মনের মধ্যে একটা অসহায় ক্ষোভ জেগে উঠল। ইজিচেয়ার থেকে উঠে নিজের কলবাক্সটা টেনে বের করে বসল। ছোট ছোট কাগজের বাক্সে নানান ইনজেকশন। কুইনিনের বাক্সটা বের করে তার ভিতর থেকে একটা অ্যাম্পুল বের করে সে ভেঙে ফেললে। জিভে চেখে দেখলে। সারা মুখটা তেতো হয়ে গেল।

ডাক্তার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আবার বাইরে এসে বসল। ডাকলে—মঞ্জু মঞ্জু! ডাক্তারের স্ত্রী মঞ্জ, মঞ্জুলা।

মঞ্জ রান্নাঘরে রয়েছে। রান্নার লোকটা কিছুই জানে না। এটা যাকে বলে খাঁটি গাইয়ার দেশ। শাক শুকতো চচ্চড়ি, ঘোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি হোড়, এ ছাড়া কিছু জানে না। আর জানে খেড়ো নামক একটি বস্তু-কাঁচা তরমুজের তরকারি, আর কড়াইয়ের দাল আর টক। অম্বলকে বলে টক। এবং কাঁচা মাছে অম্বল বাঁধে। বড় বড় মাছের মাথা অম্বলে দিয়ে খায়। ভাল রান্না মানে তেলমসলার শ্রাদ্ধ। ডিসপেপসিয়া রোগটি জন্মানোর জন্যে উৎকৃষ্ট সার দিয়ে জমি প্রস্তুত করা। ডাক্তারের রুচি আধুনিক সুপ, সিদ্ধ, সালাদ। এখানকার ওই গ্রাম্য লোকটি আজও পর্যন্ত নামগুলো আয়ত্ত করতে পারে নি। অগত্যা মঞ্জু দাঁড়িয়ে থেকে দেখিয়ে দেয়। তা। ছাড়া একটি কোর্স সে নিজে হাতে রান্না করে নেয়। ওটা মঞ্জুর শখ।

—মঞ্জু! আবার ডাকলে প্ৰদ্যোত।

–আসছি। এবার সাড়া দিলে মঞ্জু।

দীর্ঘাঙ্গী তরুণীটির শ্ৰীটুকু বড় মধুর এবং কোমল, এর ওপরে ওর বর্ণটার মধ্যে একটা দীপ্তি আছে যা সচরাচর নয়, সাধারণ নয়। চোখ জুড়িয়ে যায়, মোহ জাগে মঞ্জুকে দেখে। প্রাণচঞ্চলা আধুনিকা মেয়ে মঞ্জু। গান গাইতে পারে, আই. এ পর্যন্ত পড়েছে; বাইসিক্ল চড়তে শিখিয়েছে ডাক্তার, বন্দুক ছুঁড়তে শিখিয়েছে।

—কী বলছ? আমার রান্না পুড়ে যাবে।

–কী রাঁধছ?

–টক। হাসতে লাগল মঞ্জু। কাঁচা মাছের টক। আমার ভারি ভাল লাগে। আগে বুড়ি দিদিমা বলত—আমরা আসতাম। কিন্তু সত্যি চমৎকার সরষে ফোড়ন দিয়ে আর কাঁচা তেল ছড়িয়ে।

—বোসো তুমি এখানে। একা ভাল লাগছে না। গানটান গাও। মনটা বড় খারাপ হয়ে আছে। ওদের ছেলেটা এমন হঠাৎ মরে গেল–।

—রাঁধুনীটা বলছিল।

–কী বলছিল? ডাক্তার আবার তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল।

–বলছিল—সঁচজনে বলছে পাঁচ রকম।

–তবু ভাল, পাঁচজনে পঞ্চাশ রকম বলে নি। হাসলে প্রদ্যোত।

–তুমি কি সকালে বলে এসেছিলে কাল পথ্য দেবে?

–হ্যাঁ, কেন?

—ওই কথাটাই বেশি বলছে লোকে। তাতে চারুবাবু বলেছেন শুনলামওরে বাবা, মৃত্যুর কথা কি কেউ বলতে পারে? ওর ওপরে ডাক্তারের হাত নেই।

ডাক্তার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে, মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। নিচ্ছিদ্র মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। পৃথিবীর উপরে একটা ছায়া ফেলেছে এই রাত্রিকালেও।

চকিত একটু বিদ্যুতাভাস খেলে গেল সীমাহীন মেঘাচ্ছন্ন আকাশে। মৃদুগম্ভীর গর্জনে মেঘ ডেকে উঠল দূরে অনেক দূরে। ডাক্তার মৃদুস্বরে বললে–শ্রাবণরাত্রির একটা গান গাও।

—আসছি আমি। ওকে বলে আসি-অম্বলটা ওই নামাবে।

–যাক পুড়ে যাক। না নামায় তো কাল ওটাকে দূর করে দিয়ো।

মঞ্জু মৃদু গুনগুনানি সুরে ধরলে–

এসো শ্যামল সুন্দর।
আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা।
বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে।

ডাক্তার চোখ বুজলে। সত্যি বৃষ্টি হলে দেশটা জুড়োয়। প্রাণটা বাঁচে। গান শেষ করে মঞ্জু উঠল, বললে—আমি আসছি। ততক্ষণ রেডিও খুলে দিয়ে যাই। রবীন্দ্রসঙ্গীত আছে। মন তার এখনও পড়ে আছে রান্নাশালে। ছ্যাঁক করে সম্বরা দিতে তার ভারি ভাল লাগে। ডাক্তার চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। তা হলে চারুবাবু তার বিরুদ্ধ সমালোচনা করেন নি; প্রৌঢ় মোটের ওপর লোক ভাল।

রেডিওতে যন্ত্রসঙ্গীত বাজছে। গীটার। সুরটা কাঁপছে, কাঁদছে।।

চারুবাবু কিন্তু ডিফিটেড সোলজার। হার মেনেছেন ভদ্রলোক। যাকে সাধু বাংলায় বলে আত্মসমর্পণ করেছেন। সারেন্ডার করেছেন। মৃত্যুর কথা কেউ বলতে পারে না। ওর ওপর ডাক্তারের হাত নাই।

আছে। হাত আছে। এখানে যদি একটা ক্লিনিক থাকত। গোড়াতেই যদি ব্লাড কালচার করে নেওয়া যেত। এবং ওষুধ যদি খাঁটি হত। কে বলতে পারে বাচত না ছেলেটা?

রেডিওতে গান বেজে উঠল—মরণ রে তুহু মম শ্যামসমান। ডাক্তার ভ্রূ কুঞ্চিত করে উঠে গিয়ে রেডিওটা বন্ধ করে দিলে।

কম্পাউন্ডের ফটকটায় হর্নের শব্দ উঠল। সাইকেল রিকশার হর্ন। কে এল? কেন? কল? ডাক্তার উঠে দাঁড়াল। ঘরের মধ্যে থেকে ছোট স্টোভল্যাম্পটা বের করে নিয়ে এল। দুটো রিকশা। একটি রিকশায় একটি তরুণী, অজ্ঞান অবস্থা বলে মনে হচ্ছে। এ গাঁয়ের দাইটা তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। সর্বাঙ্গ কাপড় দিয়ে ঢাকা। মাথাটা দাইয়ের কাঁধের উপর ঢলে পড়েছে। অব্যক্ত যন্ত্রণায় মধ্যে মধ্যে নীল হয়ে যাচ্ছে, বিকৃত হচ্ছে। কাপড়খানার নিচের দিকে রক্তের দাগ। ডেলিভারি কেস। বোধ করি প্রথম সন্তান আসছে। ডাক্তারের আলোটা হাতে নেমে পড়ল। ডাকলে হরিহরবাবু! মিস দাস!

কম্পাউন্ডার আর মিডওয়াইফ। কিন্তু ও কে? পিছনের রিকশায়?

স্থূলকায় বৃদ্ধ? জীবনমশায়?

জীবনমশায় শশীকে পৌঁছুতে গিয়েছিলেন। শশীর প্রতিবেশী গণেশ ভটচাজের প্রথম সন্তানসম্ভবা কন্যা তখন সূতিকাগারে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। জীবন মশায়কে পেয়ে তারা তাকে ছাড়ে নি। জীবনমশায় এক্ষেত্রে কী করবেন? তবু তারা মানে নি। বলেছিল-হাতটা দেখুন।

–হাত দেখে কী করব? আগে তো প্রসব করানো দরকার। যারা প্রসব করাতে পারে। তাদের ডাক। নয়তো হাসপাতালে নিয়ে যাও।

তাই নিয়ে এসেছে। কিন্তু জীবন মশায়কে ছাড়ে নি।

—আপনি থাকুন মশায়! কণ্ঠস্বরে মেয়ের বাপের সে কী আকুতি!

মশায় উপেক্ষা করতে পারেন নি।

 

শার্টের আস্তিন গুটিয়ে যথানিয়মে হাত ধুয়ে, বীজাণুনাশক লোশন মেখে ডাক্তার তৈরি হয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।

–আপনি প্রসবের জন্য কোনো ওষুধ দিয়েছেন?

—গুড। আপনি কি অপেক্ষা করবেন?

–হ্যাঁ। একটু থাকি। হাসলেন মশায়।

–আচ্ছা। বসুন ওই চেয়ারটায়। নাড়ি দেখে কিছু বলেছেন নাকি?

–নাড়ি দেখেছি। কিন্তু—

ঘরের মধ্যে অবরুদ্ধ যন্ত্রণায় জান্তব গোঙানির মত গোঙানি উঠল।

—ডাক্তারবাবু! মিস দাসের কণ্ঠস্বর।

প্রদ্যোত ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। জীবনমশায় শ্রাবণের মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েই রইলেন। একটা অস্বস্তি বোধ করছেন তিনি। কেন তিনি এলেন? ওদের ইচ্ছে প্রসবের পর তিনি একবার নাড়ি দেখেন। কিন্তু প্রসব হতে গিয়েই যদি

—বসুন মশায়। বললে হরিহর কম্পাউন্ডার। হরিহর গরম জল, তুলো, পরিষ্কার ন্যাকড়া ইত্যাদি নিয়ে যাচ্ছে পাশের ঘরে।

–বেশ আছি হে। হাসলেন মশায়। মেয়েটির বয়স হয়েছে। প্রায় তিরিশ। চিন্তা হচ্ছে তাঁর।

চমকে উঠলেন মশায়। মেয়েটি আবার যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে—আরও কিছু। হ্যাঁ ঠিক। নবজাতকের প্রথম কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। জয় পরমাপ্রকৃতি! জয় গোবিন্দ।

—হরিহরবাবু, গরম জল। তুলো। প্রদ্যোত ডাক্তারের ধীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। আশ্চর্য ধীর এবং শান্ত এবং গম্ভীর।

***

তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। মেয়েটির বাবা বললে–ডাক্তারবাবু!

—সেফ ডেলিভারি হয়েছে। খোকা হয়েছে।

–নীহারের জ্ঞান হয়েছে?

–না।

–হয় নি?

–না। আজ বাড়ি যান। যা করবার আমি করব। এখানে থেকে গোলমাল করলে কোনো উপকার হবে না। যান, বাড়ি যান। আপনিও বসে আছেন? মাফ করবেন, এখন নাড়িটাড়ি। দেখতে দেব না আমি। কিছু মনে করবেন না যেন। আমার জ্ঞানমত নাড়ি ভালই আছে, এই পর্যন্ত বলতে পারি।

ডাক্তার চলে গেলেন নিজের বাসায়।

—মঞ্জু!

–চা ছাঁকছি।

—মেনি থ্যাংকস, মেনি মেনি থ্যাংকস, জলদি আন–চা খেয়ে গিয়ে দরকার হলে আবার ইনজেকশন দেব।

–কেস কি?

–নট গুড, আবার খারাপও নয় খুব। বাট শি মাস্ট লিভ, বাঁচাতে হবে।

চায়ে চুমুক দিয়ে বললে—প্রথমটা আমার কিন্তু ভারি রাগ হয়ে গেছল। দ্যাট ও ম্যান, ফেমাস মহাশয় অব্‌ দি প্লেস–সে সঙ্গে এসেছিল।

—কোনো খারাপ কথা বল নি তো?

–না। তবে এখন ওরা চাইছিল—মশায় একবার নাড়ি দেখে। আমি বলে দিয়েছি, না–তা আমি দেব না।

—ওঁকে চা খেতে ডাকলে না কেন?

—ডাকা উচিত ছিল, না?

–নিশ্চয় ছিল।

চায়ের কাপ নামিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে প্রদ্যোত আবার হাসপাতালের দিকে চলল। আর একটা ইনজেকশন দিতে হবে। মশায় চলে গেছেন। একটু অন্যায় হয়ে গেল। টং টং শব্দে ঘড়ি বাজছে। রাত্রি বারটা। রোগীর ঘর থেকে মৃদু যন্ত্রণার শব্দ শোনা যাচ্ছে। যন্ত্রণা কমে এসেছে। শি মাস্ট লিভ; বাঁচাতে হবে মেয়েটাকে। হরিহর বেরিয়ে এল।

–কেমন আছে এখন?

–ভালই মনে হচ্ছে।

–ভালই থাকবে। ইনজেকশন বের করুন।

ডাক্তার সিরিঞ্জটা উঁচু করে আলোর সামনে ধরলেন। আবার যেন ফটকটা খুলল? কে এল আবার?

এগিয়ে গেল হরিহর। রনবাবুর লোক।

–কী, হিক্কা খুব বেড়েছে?

–আজ্ঞে না। সেই শহর থেকে রেপোর্ট এসেছে, তাই বুড়োবাবু বললেন– ডাক্তারবাবু যদি জেগে থাকেন তো দিয়ে আয়।

বিপিনবাবুর ইউরিন রিপোর্ট।

—হিক্কা কেমন আছে?

–তেমনিই আছে। একটুকু কম বলে লাগছে।

একটা ক্লিনিক যদি এখানে থাকে! এক্স-রেইলেকট্রিসিটি না হলে উপায় নাই। ময়ূরাক্ষী স্কিম হতে আরও কয়েক বছর লাগবে। তার আগে সে আর হবে না। কিন্তু একটা ক্লিনিক। কত লোক যে বাঁচে! আজ কি এই মেয়েটাই বাচত? হাসপাতাল যন্ত্রপাতি—এসব না থাকলে এ মেয়েটাও আজ মরত।

জীবনমশায় হাত দেখে ঘাড় নেড়ে বলত-কী করবে? এ কার হাত? তোমার, না–আমার?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *