১৭. শুবরু, শুবরু

কে যেন ডাকল, শুবরু, শুবরু।

আমি চোখ বন্ধ করে গাড়ির পেছনের সীটে বসে আছি। বৃষ্টির শব্দ শোনার চেষ্টা করছি। গাড়ির কাচ উঠানো। তারপরেও বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এর মধ্যে হঠাৎ কানো এল শুবরু শুবরু! কেউ যেন এই নামে ডেকে গাড়ির পেছনে পেছনে ছুটে আসছে।

আমি নিজের অজান্তেই কে বলে চোখ মেললাম। গাড়ির ড্রাইভার গাড়িতে হঠাৎ ব্রেক করে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, কিছু না তুমি চালাও। সে আবার একসিলেটার চাপ দিল। সে এখনো স্বস্তিবোধ করছে না। তার চোখ ব্যাক ভিউ মিররের দিকে। আমাকে মনে হয়। সেই আয়নায় খানিকটা দেখা যাচ্ছে। এই ড্রাইভারকে নতুন রাখা হয়েছে। যে-কোনো কারণেই সে আমাের ভয়ে সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকে। যতবারই আমি তাকে ডাকি সে চমকে ওঠে। অফিসের বারান্দায় বসে সে চা খাচ্ছিল। আমি তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ তার দিকে তাকলাম— দেখি, তার চোখ ভয়ে ও আতংকে কাঁপছে।

আমাকে সে কেন ভয় পায়? আমরা যে জিনিস বুঝতে পারি না তাকেই ভয় পাই! সে আমাকে বুঝতে পারছে না বলেই ভয় পাচ্ছে। এই মুহুর্তে সে কী ভাবছে? সে ভাবছে ছোট সাহেব চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন, হঠাৎ কেন জেগে উঠে বললেন- কে? আমি তাকে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলে সে কি আশ্বস্ত হবে? আমি কি তাকে বলব, রশীদ শোন, দুটা জিনিস মানুষকে তাড়া করে। একটার নাম স্বপ্ন। সে সামনে থেকে তাকে ডাকে। মানুষ তার দিকে ছুটে যায়। আরেকটার নাম স্মৃতি। সে ভয়ংকর কোনো জন্তুর মত পেছন থেকে তাড়া করে। একজন বুড়ো মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। তিনি প্রচুর জর্দা খেতেন। ফুলের সৌরভের মত, জর্দার সৌরভ তাঁকে ঘিরে থাকতো। ঐ ভদ্রলোক আমাকে ডাকতেন শুবরু নামে। তিনি চলে গেছেন, নামটা ফেলে রেখে গেছেন। ঐ নামটা মাঝে মাঝেই আমাকে তাড়া করে। একটু আগেও করছিল বলে ভয়ে পেয়ে আমি বলেছিলাম— কে?

ঐ বুড়ো ভদ্রলোকের ছেলেমেয়ে বা তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আমার খুব কথা বলার শখ। তাদের কাছে আমি জানতে চাইব।— বুড়ো ভদ্রলোক শুবরু নামের বাচ্চা একটা ছেলেকে এতটা ভাল কেন বেসেছিলেন। কার্যকরণহীন ভালবাসা বলে এ জগতে কিছু নেই। সব কিছুর পেছনে কারণ আছে। প্রথমে cause তারপর affect, ভালবাসাটা যদি affect হয় তার পেছনের cause টা কী?

আমি ঐ বুড়ো মানুষের পরিবারের সদস্যদের কাছে জানতে চাইব— আপনারা কি আমাকে উনার সম্পর্কে বলবেন? আমি ভাসা ভাসা ভাবে শুনেছি। মৃত্যুর আগেও তিনি শুবরুকে ডেকেছেন। কেন ডেকেছেন? তিনি শুবরু সম্পর্কে কি বলতেন? আচ্ছা শুবরুকে কোলে নিয়ে তার কি কোনো ছবি আছে? একটা ছবি তিনি আমাকে নিয়ে স্টুডিওতে গিয়ে তুলেছেন। এবং আমাকে লজ্জিত গলায় বলেছেন— ছবি তোলার কথা বড় সাহেবরে বলব না। উনি রাগ হতে পারেন।

আমি বলেছিলাম, রাগ হবেন কেন? ছবি তোলা কি খারাপ?

না খারাপ না। ব্যাপারটা হল কী শুবরু, মানুষ আল্লাহপাকের আজব সৃষ্টি। সে খারাপ কাজে রাগ হয়, ভাল কাজের জন্যেও রাগ হয়। আবার ধর ভাল না, খারাপ না এমন কাজের জন্যেও রাগ। মানুষ বড়ই আজব জানোয়ার।

মানুষ আজব জানোয়ার কেন?

আল্লাহপাক মানুষকে আজব করে বানিয়েছেন এই জন্যে।

আল্লাহপাক মানুষকে আজব করে কেন বানিয়েছেন?

এইটাইতো বাবা বুঝি না। প্রায়ই চিন্তা করি— কুল পাই না। তিনিতো কত কিছুই সৃষ্টি করলেন। মানুষকে আজব করলেন কেন? তিনি নিজে খুবই আজব এই জন্যে?

উনি কি খুবই আজব?

উনি কী, কেমন কিছুই জানি না বাবা।

আপনি জানেন না কেন?

আমার তখন প্রশ্নকাল চলছে। শুধুই প্রশ্ন করি। এবং তিনি ক্লান্তিহীন ভাবে আমার প্রশ্নের জবাব দিয়ে যান। আমার প্রশ্ন এবং তার উত্তরগুলি লিখে রাখলে অদ্ভুত কিছু ব্যাপার জানা যেত। একজন অত্যন্ত সাধারণ মানুষের পৃথিবী সম্পর্কে ধ্যান ধারণা?

বুড়ো মানুষের পরিবারের কাউকেউ আমি খুঁজে পাই নি। বুড়ো মানুষটার মত সবাই হারিয়ে গেছে। আমার সকল চেষ্টাই বিফলে গেছে। আমি হাল ছেড়ে দেই নি। সবশেষে চায়না ভাইকে বললাম, এদের কাউকে খুঁজে বের করতে পারবে?

চায়না ভাই আমাকে চমকে দিয়ে বলল— অবশ্যই। আপনি হুকুম দেন। আমি বাইর করি। একমাসের ভিতরে যদি বাইর করতে না পারি চায়না ভাই নাম বদলাইয়া আমি নিজের নাম রাখব চায়না ভইন।

কীভাবে বের করবে?

মানুষ খুঁজে বের করা কোনো ব্যাপার না ছোট সাহেব। মানুষ যেখানে যায় গন্ধ রেখে যায়। মানুষরে বাইর করুন যায়। গন্ধে গন্ধে।

এক মাসের মধ্যে পারবে?

অবশ্যই। আইজ আশ্বিন মাসের তিন তারিখ। কার্তিকের তিন তারিখের মধ্যে আপনি খবর পাইবেন। ইনশাল্লাহ।

আচ্ছা ঠিক আছে।

আপনে নিশ্চিন্ত থাকেন ছোটসাহেব। আজরাইল মানুষরে খুঁইজ্যা বাইর করে না? আমিতো আজরাইলের মতই।

খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার বুড়ো মানুষটা যেভাবে আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন- চায়না ভাই নামের এই ভয়ংকর মানুষটাও একই ভাবে আমার দিকে আকৃষ্ট হয়েছে। রোজ একবার আমাকে না দেখলে তার না-কি ভাল লাগে না।

আচ্ছা মানুষের শরীরে কি বিশেষ কোনো গন্ধ আছে? কিংবা কোনো ম্যাগনেটিক ফিল্ড? একেকজনের জন্যে একেক রকম। যার সঙ্গে সেই ম্যাগনেটিক ফিল্ডের রেসোনেন্স হচ্ছে সে-ই ভয়ংকর ভাবে আলোড়িত হচ্ছে। সে-ই আটকা পড়ে যাচ্ছে।

রশীদ!

রশীদ স্টিয়ারিং হুইল হাতে নিয়েই চমকে উঠল। গাড়ির ব্রেকেও পা দিয়ে দিয়েছে। সে ভীত গলায় বলল, জ্বি স্যার।

ক্যাসেটটা দাও তো, ক্যাসেট চলুক।

রশীদ। আমার হাত থেকে ক্যাসেট নিল! ক্যাসেট বাজতে শুরু করলে সে আরেকটা ছোটখাট চমক খাবে। ক্যাসেটে কোনো গান বাজনা নেই। এই ক্যাসেটে আছে মীরার হাসি।

ক্যাসেট বাজছে। আমি মীরার হাসি শুনছি। ড্রাইভার চোখ-মুখ শক্ত করে হাসি শুনছে।

রশীদ!

জ্বি স্যার।

হাসি কেমন লাগছে?

জ্বি স্যার ভাল।

কী রকম ভাল?

খুব ভাল স্যার।

আচ্ছা ঠিক আছে। এখন এই হাসিটা শোন। দাও, এই ক্যাসেট দাও।

এখন বাজছে বিনুর হাসি। সে মীরার মত এক নাগাড়ে হাসে নি। লজ্জা পেয়ে থেমে থেমে হেসেছে।

রশীদ!

জ্বি স্যার।

এই হাসিটা কেমন?

ভাল স্যার।

এই হাসিটা বেশি ভাল না। আগের টা?

দুটাই ভাল। আচ্ছা ঠিক আছে, এখন দাও এই ক্যাসেট। তিন নম্বর হাসি।

রশীদ ভীত মুখে তিন নম্বর ক্যাসেট চালু করল। এবার হাসছে আসমানী। আসমানীর হাসির সঙ্গে মীরার হাসির মিল আছে। বেশ ভাল মিল; আমি চোখ বন্ধ করে মিল এবং অমিলগুলি ধরার চেষ্টা করছি। ধরতে পারছি না।

ড্রাইভার রশীদ কি আমাকে পাগল ভাবছে? মনে মনে নিশ্চয়ই ভাবছে। রশীদ একা না, অনেকেই তাই ভাবছে। ঐ দিন মীরার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। বিয়ের পর সে কতটা বদলেছে সেটা দেখার জন্যে যাওয়া। কোথায় যেন পড়েছিলাম— বিয়ে হবার আগ পর্যন্ত মেয়েদের চোখে ভরসা হারা দৃষ্টি থাকে। বিয়ের পর পর সেই দৃষ্টি বদলে যায়। দৃষ্টিতে ভরসা ফিরে আসে। মীরার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখলাম না। কিন্তু সে আমাকে দেখেই চমকে উঠে বলল, তোর চোখে পাগল পাগল ভাব এসে গেছে।

পাগল পাগল ভাবটা কী রকম?

পাগলদের চোখের মণি কোনো খানে স্থির হয় না। তোরও হচ্ছে না।

আমি তোমার ঘর সংসার দেখছি বলে আমার চোখের মণি নড়াচড়া করছে।

তুই কিছুই দেখছিস না। আমাকে ভুলানো এত সহজ না। শুভ্ৰ তুই কি খুব কষ্টে আছিস?

না।

তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই কষ্টে আছিস।

আমার প্রতি তোমার প্রবল মমতা আছে বলে তুমি এ রকম ভাবছ। প্রবল মমতার কারণে মনে হয় মমতার মানুষটা বুঝি কষ্টে আছে। সব মাকে দেখবে। যদি সে তার সন্তানকে কয়েক দিন অদর্শনের পর দেখে তাহলে বলে- আহরে রোগা হয়ে গেছে। এটা হল Mother complex.

তুই কথাও বেশি বলছিস। কথা বেশি বলাও পাগলামির লক্ষণ।

তোমার ধারণা আমি পাগল?

এখনো না, তবে তুই ঐ পথ ধরেছিস। কিছুদিনের মধ্যেই তুই ট্রাফিক কনট্রোল শুরু করবি।

আমি হাসলাম। মীরা কঠিন গলায় বলল, হাসবি না। আমি ঠাট্ট তামশা করছি না। রাতে তোর ঘুম ভাল হয়?

খুব ভাল ঘুম হয়।

তোমার ঘুমের খবর বল। আখলাক সাহেব তোমাকে রাতে ঘুমুতে দেন?

সে দেয়, আমিই তাকে জাগিয়ে রাখি। বকবক করি। রাত তিনটার সময় বলি- বৃষ্টি হচ্ছে ছাদে, চলতো ভিজব। বেচারা মহাবিপদে পড়েছে।

তুমিতো মনে হয়। উনার প্রেমে হাবুড়ুবু খাচ্ছ।

তা খাচ্ছি। এই প্রেমটা শুরু হয়েছে বিয়ের পর। এই প্রেমের সঙ্গে শরীরের একটা ব্যাপার আছে। তাই বলে সেই প্রেমকে তুচ্ছ বা ছোট করার কিছু নেই। শুভ্র তুই আমার কথা শোন— বিয়ে করে ফেল।

কাকে বিয়ে করব?

যে কাউকে— রহিমা, ফাতেমা, উর্মি, টুর্মি any one. আমার ধারণা তুই যাকেই বিয়ে করিস না কেন তার জন্যে তোর ফিলিংস একই থাকবে। ফাতেমাকে তুই যতটা ভালবাসবি, উর্মিকেও তুই ততটাই ভালবাসবি। একটু বেশিও না, একটু কমও না। চা খাবি?

না।

মদ খাবি? এটা হল মদের বাড়ি- পৃথিবীর হেন মদ নেই যা এই বাড়িতে নেই।

না, মদ খাব না।

কিছু একটা খা। সরবত খাবি? প্লেইন এন্ড সিম্পল লেবুর সরবত?

আচ্ছা দাও।

মীরা লেবুর সরবত বানাতে বানাতে বলল, তোর কি অন্ধ মেশকাত সাহেবকে মনে আছে।

হুঁ।

উনি সেদিন এসেছিলেন। আমি দাওয়াত করে এনেছিলাম। হাত দেখাতে ইচ্ছা করছিল। উনি হাত দেখলেন। মানে চোখে দেখলেন না, উনি যেভাবে দেখেন সেভাবে দেখলেন। তারপর কী বললেন জানিস?

কী বললেন?

উনি খুবই অদ্ভুত কথা বললেন, উনি বললেন— বিয়ের প্রথম বছরেই আমার একটি কন্যা সন্তান হবে। সে তার নিজের প্রতিভায় দেশের সকল মানুষের হৃদয় হরণ করবে। মেশকাত সাহেবের কথা শুনেই আমার গা শিরশির করতে শুরু করল। কারণ কী জানিস? উনার হাত দেখার আগেই আমি কনসিভ করেছি। এখনো ডাক্তারি পরীক্ষায় কনফার্ম করা হয় নি— But i Knew, আমার যে মেয়ে হবে সেটাও আমি জানি।

খুব আনন্দ লাগছে?

হ্যাঁ খুবই আনন্দ লাগছে। আমার মাথায় এখন কিছু নেই; শুধুই আমার মেয়ে। আখলাক বিছানায় যাওয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়ে। আমি জেগে থাকি এবং মেয়ের সঙ্গে কথা বলি।

মেয়ের সঙ্গে কথা বল?

হ্যাঁ। সিরিয়াস ধরনের কথা। তোকে নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক কথা হয়। অনেক আঙ্গুমেন্ট হয়। তর্কে আমি ওর কাছে সব সময় হেরে যাই। আমি ওর নাম দিয়েছি তর্ক-সমাজ্ঞী। তোকে নিয়ে যখন তর্ক হয় তখন সে সব সময় তোর পক্ষ নেয়।

মীরা কথা বলছে- আমি অস্বাক হয়ে দেখলাম মেয়ের কথা বলতে বলতে তার চোখ ভিজে উঠছে।

ভালবাসা ব্যাপারটা কী? যে মানুষটি পৃথিবীতেই এখনো আসে নি তার প্রতি এমন গভীর গাঢ় ভালবাসা কীভাবে তৈরি হয়? এই ভালবাসা কেমন ভালবাসা?

মীরার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় সে বলল, তুই একটা কাজ করিাসতো— মেশকাত সাহেবের সঙ্গে দেখা করিস। দেখি উনি কী বলেন। বিশেষ কিছু জানতে চাইলে উনাকে স্পেসিফিক্যালি জিজ্ঞেস করবি।

আমি বললাম, আধুনিক পদাৰ্থ বিদ্যা কি এইসব বিশ্বাস করে?

তোর ধারণা করে না?

না।

আমার ধারণা করে। সাবে এটমিক লেভেলে চিন্তা কর শুভ্ৰ— মানুষ সেই লেভেলে কি দিয়ে তৈরি? আপকোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক, চার্ম। জিনিসগুলি আসলে কী? নাথিং।

জিনিসগুলি আসলে কী তার সঙ্গে মেশকাত সাহেবের বলার কোনো সম্পর্ক নেই।

তোর সঙ্গে তর্ক করতে চাচ্ছি না— শুভ্ৰ তোকে আমার ধারণার কথাগুলি বলি– we really do not exist, এই যে তুই আমার সঙ্গে বসে আছিস, আমি তোর সঙ্গে গল্প করছি— এগুলি কিন্তু ঘটছে না। আমরা হচ্ছি কোনো একজনের কল্পনা। সেই কোনো একজনটাই হয়ত God. The one and the only.

আমি তাকিয়ে আছি। মীরা হাত নাড়তে নাড়তে গল্প করছে। তাকে দেখতে ভাল লাগছে। আমি মীরার গল্পে বাধা দিয়ে বললাম, আমার ধারণা তুমি এইসব উদ্ভট থিয়োরি রাত জেগে জেগে আখলাক সাহেবকে শোনাও। এবং উনি খুব মন দিয়ে বাধ্য ছাত্রের মত শুনেন।

মীরা হাসতে হাসতে বলল, তা শুনে এবং যা বলি বিশ্বাস করে। আখলাকের এই অংশটি আমার খুব পছন্দ। তোকে বিয়ে করলে পছন্দের এই অংশটি থেকে আমি বঞ্চিত হতাম। ভাগ্যিস তোকে বিয়ে করি নি।

আমাকে বিয়ের প্রশ্ন আসছে কেন?

কথার কথা বললাম। তোকে কিংবা তোর মত কাউকে। অবশ্যি তোর কথা একেবারেই যে ভাবি নি তা না।

মীরা হাসছে। এই হাসি এবং ক্যাসেটের হাসি এক না। অনেক আলাদা। মানুষের হাসি নিয়ে কেউ গবেষণা করে নি। করা উচিত ছিল। চিস্তা চেতনার পরিবর্তনের সঙ্গে হাসির শব্দ বদলে যায়। শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি বদলায়। কিছু ফ্রিকোয়েন্সি বাদ পড়ে কিছু নতুন ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত হয়; কেন এইসব নিয়ে কেউ ভাবছে না? রহস্যময় মানুষ কেন রহস্যের কুঠুরি থেকে বের হয়ে আসতে পারছে। না? মেশকাত সাহেবের মত মানুষরা আসলে কী করেন?–অর্জন উঁচিয়ে রহস্যময় সেই জগতের প্রতি ইঙ্গিত করেন? বুঝেই করেন না বুঝেই করেন?

 

মেশকাত সাহেব আমাকে চিনতে পারলেন। চোখের মত শক্তিমান ইন্দ্রীয় থেকে বঞ্চিত মানুষদের অন্য ইন্দ্রীয়গুলি তীক্ষ্ম হয় এটা জানা কথা। তাই বলে এত তীক্ষ্ণ!

মেশকাত সাহেব লুঙ্গি পরে আছেন, খালি গী। গায়ের ওপর পাতলা চাঁদর জড়ানো। মানুষটা ধবধবে ফর্সা। আখলাক সাহেবের বাড়িতে তাঁর গায়ের এমন রঙ চোখে পড়ে নি। মেশকাত সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সহজ গলায় বললেন, আপনি শুভ্ৰ? আখলাক সাহেবের বাড়িতে আপনার সঙ্গে কথা হয়েছিল।

জ্বি।

পার্টি শুরু হবার আগেই আপনি মীরার সঙ্গে চলে গেলেন। মীরা ফিরে এল, আপনি ফিরলেন না।

জ্বি। এতসব আপনার মনে আছে?

অবশ্যই মনে আছে। মনে রাখাই আমার কাজ। অন্য কোনো কাজতো হাতে নেই। আমার মত অবস্থা যদি আপনার হোত আপনিও সব কিছু মনে রাখতেন।

ব্রেইলী পদ্ধতি ব্যবহার করে পড়াশোনা করার কথা কখনো ভেবেছেন?

ভেবেছি। সেই সুযোগ কোথায়?

আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।

শুভ্ৰ, আমি কারো সাহায্য নেই না।

যে কারোর সাহায্য নেয় না, সে তো কাউকে সাহায্যও করে না।

আপনি কি আমার কাছে কোনো সাহায্যের জন্যে এসেছেন?

না। জানতে এসেছি।

আমার কাছে কী জানতে চান?

অতীন্দ্রীয় ক্ষমতা বলে কিছু কি আছে? ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য ক্ষমতার বাইরে কোনো ক্ষমতা।

মূল ক্ষমতার সবটাইতো ইন্দ্রীয়ের ধরা ছোয়ার বাইরে। সামান্য যে ইলেকট্রন একেও তো আপনি হাত দিয়ে ছুঁতে পারছেন না, অনুভব করতে পারছেন না, গন্ধ নিতে পারছেন না, দেখতে পারছেন না।

আমি না পারলেও আমার তৈরি যন্ত্রপাতি পারছে। পারছে বলেই আমরা বলতে পারছি ইলেক্ট্রন কী, তার ধর্ম কী?

তাও পারছেন না। পারছেন না বলেই একবার বলছেন ইলেক্ট্রন বস্তু, আরেকবার বলছেন তরঙ্গ।

ইলেকট্রন হচ্ছে একই সঙ্গে বস্তু এবং একই সঙ্গে তরঙ্গ।

খুব হাস্যকর কথা বলছেন না? আপনি নিজের মনকে জিজ্ঞেস করুন—কথাটা হাস্যকর না?

আমি চুপ করে রইলাম। মেশকাত সাহেব বললেন, মীরার কাছে শুনেছি আপনি ছাত্র হিসেবে অসাধারণ, মানুষ হিসেবে অসাধারণ। দুই অসাধারণ যার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তার হাতটা আমি একটু ছুঁয়ে দেখি।

দেখুন বলে আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, শুনেছি আপনি মানুষের হাত ছুঁয়ে অনেককিছু বলতে পারেন। আমার ব্যাপারে বলুন তো শুনি।

মেশকাত সাহেব হালকা গলায় বললেন, ভুল শুনেছেন। আমি হাত ধরে কিছুই বলতে পারি না। তবে হাত ধরাটাকে তুচ্ছ করবেন না। যেই মুহুর্তে আমি আপনার হাত ধরলাম। সেই মুহূর্তে কী হয় জানেন— আপনার শরীরের কিছু ইলেকট্রন কিছু সাব এটোমিক পার্টিকেল আমার শরীরে চলে আসে। আমার কিছু চলে যায় আপনার মধ্যে। হাত ধরা মানে তার কিছু অংশ নিজের ভেতর নিয়ে নেয়া।

আমি এরকম করে ভাবি নি।

খুব বড় মাপের মানুষদের আমরা স্পর্শ করতে চাই- কারণ, আমরা তার শরীরের কিছু অংশ নিজের ভেতর নিয়ে নিতে চাই। ঠিক যে কারণে ভয়ঙ্কর মানুষদের স্পর্শ করতে নেই।

মেশকাত সাহেব্ব আমাকে চা খাওয়ালেন। নিজেই বানিয়ে খাওয়ালেন। একবারের জন্যেও মনে হল না মানুষটা চোখে দেখতে পান না। তিনি বাস করেন। আলোহীন জগতে।

শুভ্র।

জ্বি।

একটা হাইপোথেটিক্যাল ব্যাপার কল্পনা করুন। আমি হাত দিয়ে আপনাকে ছয়ে দিলাম। সেই কারণে আপনার শরীর থেকে কিছু ইলেকট্রন চলে এল আমার শরীরে। এমনওতো হতে পারে তাদের কাছে আপনার ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য থাকতে পারে। সেই তথ্য হয়তো সবাই ধরতে পারে না। কেউ কেউ পারে।

আমি চায়ে চুমক দিতে দিতে বললাম, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন— ইলেকট্রনের ভাষা পড়ার ক্ষমতা আপনার আছে?

মেশকাত সাহেব শান্ত গলায় বললেন, আমি কিছুই বলতে চাচ্ছি না। আমি একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করলাম। এর বেশি কিছু না। বিজ্ঞান রহস্যময়তা অপছন্দ করে অথচ সবচে রহস্যময় ব্যাপারগুলি কিন্তু ঘটাচ্ছে বিজ্ঞান। আমাদেরকে পরম রহস্যের দিকে এই বিজ্ঞানই কিন্তু ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। বলুন নিয়ে যাচ্ছে না?

হ্যাঁ, নিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের সাধারণ মানুষের কাছে সময় আছে- অতীত আছে, বর্তমান আছে, অনাগত ভবিষ্যত আছে। সেখানে আপনাদের বিজ্ঞান যদি বলে বসে। অতীতবর্তমান-ভবিষ্যত বলে কিছু নেই তখন ধাক্কার মতো লাগে না?

হ্যাঁ, লাগে। আপনি কি বিজ্ঞান নিয়ে প্রচুর পড়াশুনা করেন?

মোটেই পড়াশুনা করি না। অন্যরা বলে, আমি শুনি। যা ভাল লাগে মনে করে রাখি। মানুষকে চমকে দেবার জন্যে আহরিত এই জ্ঞান ব্যবহার করি। সত্যি করে বলুন তো শুভ্ৰ- আপনি চমকান নি?

হ্যাঁ, চমকেছি।

অন্যকে চমকে দিয়ে মজা দেখার প্রবণতা মানুষের মধ্যে খুব বেশি আছে। আর সবচে বেশি আছে প্রকৃতির মধ্যে। প্রকৃতি সবসময়ই মানুষকে চমকাচ্ছে। প্রকৃতির কাণ্ডকারখানা দেখে আমার মনে হয়— মানুষকে চমকে দিয়ে সে খুব মজা পায়। কাজেই, শুভ্ৰ শুনুন–যদি কখনো ভয়ঙ্কর ভাবে চমকে ওঠার মত কোনো ঘটনা আপনার জীবনে ঘটে আপনি বিচলিত হবেন না। সহজ থাকবেন। শান্ত থাকবেন। এবং ভেবে নিবেন— এটা কিছুই না। প্রকৃতির মজা মজা খেলার অংশ।

এটাই কি আমার বিষয়ে আপনার ভবিষ্যত বাণী?

মেশকাত সাহেব হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, এটা আমার একটা খেলাও হতে পারে। চমক চমক খেলা। গম্ভীর ভঙ্গিতে কিছু কথা বলে চমকে দেয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *