১৭. শরৎ চট্টোপাধ্যায়কে শরৎ চট্টোপাধ্যায় বলে ভুল

শরৎ চট্টোপাধ্যায়কে শরৎ চট্টোপাধ্যায় বলে ভুল করেছিল, এমন লোকও বাংলা দেশে আছে! কথাটাই যেন আমাদের কাছে কি রকম গোলমেলে বলে মনে হল। বিশুদার কথা তো, উদ্ভট কিছু একটা গল্পের আভাস দিয়ে আমাদের উৎকণ্ঠায় রাখা ওঁর চিরকালের স্বভাব। পরের শনিবার দপ্তরে বেলা পাঁচটার মধ্যে সবাই হাজির, বিশুদার দেখা নেই।

সব্যসাচী লেখক সুযোগ পেয়ে বললেন—বিশুবাবুর যখন আসতে দেরিই হচ্ছে তখন আসুন সময় কাটাবার জন্যে আমরা পরচর্চা শুরু করে দিই।

বৈঠকের বন্ধুদের ধারণা পরনিন্দা বা পরচর্চা হচ্ছে খই ভাজার উৎকৃষ্ট সাবসটিট্যুট। সময় কাটাতে হলে কর পরচর্চা—এটাই হল বৈঠকীবন্ধুদের স্লোগান। আর পরচর্চা হবে তাকে নিয়েই, যে বৈঠকে অকারণে অনুপস্থিত। পরচর্চার এমনই গুণ যে মারণ উচাটন বাণ-মারার মতই এ ফলপ্রসু। যে অনুপস্থিত থাকে তার মানসিক অবস্থাটা অনুমান করুন। সব সময় তার মনের মধ্যে এক যন্ত্রণা, তাকে নিয়ে কি শ্রাদ্ধটাই না করা হচ্ছে। যেখানেই সে থাকুক, হন্তদন্ত হয়ে পড়ি-কি-মরি অবস্থায় ছটফট করতে করতে তাকে ছুটে আসতেই হয়।

সব্যসাচী সাহিত্যিকের উৎসাহ পেয়ে তরুণ কবি শুরু করলেন-বিশুদা কবে একদিন রসচক্রের আসরের এক কোণায় বসবার সুযোগ পেয়েছিলেন সেই সুবাদে শরৎ চাটুজ্যেকে নিয়ে যতরাজ্যের গল্প আমাদের কাছে বলবেন।

গাল্পিক সাহিত্যিক বললেন–ওঁর ভাবখানা এমন যে, আমাদের সে-আসরে বসবার সুযোগ না-পাওয়াটা যেন মস্ত দুর্ভাগ্য।

সব্যসাচী লেখক মুখটা যতখানি সম্ভব বিকৃত করে বললেন—কে জানে ওঁর কথার কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে।

আমি বললুম-আপনারা যাই বলুন-না-কেন শরৎবাবুর সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য আমাদের মধ্যে একমাত্র বিশুদারই হয়েছে। উনি ভাল করেই জানেন শরৎবাবু সম্বন্ধে আমাদের কৌতূহলের অন্ত নেই। সুতরাং বিশুদা সে-সুযোগ ছাড়বেন কেন।

সব্যসাচী লেখক বললেন–তাই বলে উনি বেমালুম সব গাঁজাখুরী গল্প বলে যাবেন আর আমাদের তা সুবোধ বালকের মত শুনে যেতে হবে?

তরুণ কবি বললেন–বলতে দিন, পার্সেন্টেজ বাদ দিলেই হল।

–কে কার পার্সেন্টেজ বাদ দেয়। বিশুদার কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম।

তাকিয়ে দেখি দরজার কাছে বিশুদা গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে-ঘরে ঢুকছেন না।

আসুন, আসুন বিশুদা—আসুন-সবাই সমস্বরে সাদর অভ্যর্থনা জানালাম।

বিশুদা গম্ভীর গলায় বললেন–বলি, হচ্ছে কতক্ষণ।

—কি হচ্ছে?

–কি আবার, আমার ছেরাদ্দ। সব্যসাচী লেখক বললেন–সবে শুরু করেছিলাম, হতে আর দিলেন কোথায়।

খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন–আপনারা এমন জায়গায় অফিস করেছেন যে, আসতে গেলে রাস্তায় হাজার বাধা। ট্রামে করে বড়বাজারের মোড়ে এসেই দেখি হারিসন রোডের উপর ললাকে লোকারণ্য। ট্রাম থেকে নেমে ভিড় ঠেলে এগিয়ে দেখি রাস্তার উপরেই দুটো পুরুষ্ট, ঘাড় সিং-এ সিং লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটার রং কালো আরেকটার সাদা। একবার কালোটা সাদাটাকে ঠেলে চার-পাঁচ গজ পিছনে হটিয়ে দিয়ে সিং-এ সিং লাগানন অবস্থায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, আরেকবার সাদাটা কালোটাকে। ভিড়ের মধ্যে আমার পাশেই মশাই দুই মায়োয়াড়ী দুই ঘাড়ের উপর লাগাই শুরু করে দিলে।

কে একজন প্রশ্ন করল-লাগাই আবার কি?

বিশুদা বললে—জুয়া মশাই জুয়া। প্রথম মারোয়াড়ী যেই বললে—ধলা দশ, দ্বিতীয় ব্যক্তি সঙ্গে সঙ্গে বললে-কালো দশ। তারপর শুরু হয়ে গেল

–ধলা বিশ।

–কালো বিশ।

–ধলা ত্রিশ।

–কালো ত্রিশ। এদিকে দুই ষাঁড়ের কিন্তু ওই এক অবস্থা। ন যযৌ ন তস্থৌ।

লাগাই যখন একশ টাকায় উঠেছে তখন হঠাৎ আমার খেয়াল হল—এই রে, বৈঠকে তো আমার বারোটা না বাজিয়ে ছাড়বে না। যাঁড়ের লড়াইয়ের ফলাফল ফেলেই ছুটে আসতে হল।

চায়ের দোকানের ছোকরাটা এসে কয়েক কাপ চা টেবিলে রেখে গেল। বিশুদার দিকে একটা কাপ এগিয়ে দিয়ে বললাম-চটপট চা-টা খেয়ে নিন। শরৎবাবুকে নিয়ে সেই ঘটনাটা শুনবার জন্যে আমরা সবাই অপেক্ষা করে আছি।

দাঁড়ান মশাই। অত তাগাদা দিলে কি গল্প বেয়োয়? যে-রকম উত্তেজনা থেকে এসেছি তাতে স্নায়ুগুলোকে একটু জিরোতে দিতে হবে তো।

আমরা আর প্রতিবাদ করলাম না। কারোর দিকে না তাকিয়ে ধ্যানস্থ হয়ে আস্তে আস্তে চায়ের কাপে শেষ চুমুক মেরেই দুটো আঙুল ঈষৎ ফাঁক করে বাড়িয়ে দিলেন। অর্থাৎ ফাঁকের ভিতরে যে-কেউ একজন সিগারেট ওঁজে দিক। দেওয়া হল। বাঁ হাতটা এবার টেবিলের উপর মেলে ধরলেন অর্থাৎ দেশলাই চাই। দেওয়া হল। সিগারেট ধরিয়ে দেশলাইটা টেবিলের উপর ধরাস করে ফেলে দিলেন। যার দেশলাই সে নিজে কুড়িয়ে নিক। জলন্ত সিগারেটটা তর্জনী আর মধ্যমার গোড়ায় গুঁজে হাতটা মুঠো করে ফেললেন। বৃদ্ধাঙ্গুলী ও তর্জনীর মাঝে যে ফোকর সৃষ্টি হল সেইখানে মুখ দিয়ে একটা টান দিলেন যেন গাঁজার কল্কেতে দম দেওয়া হল। এক টানেই ছাইটা অর্ধেক নেমে এসেছে। ধোয়া নাক-মুখ দিয়ে আর আমরা বোয়োতে দেখলাম না।

সব্যসাচী লেখক আর থাকতে না পেরে বলে ফেলল—পকেটে দেশলাইসিগারেট নেই কিন্তু নেশাটি ঠিক আছে।

গাল্পিক সাহিত্যিক আধ্যাত্মিকতার গন্ধ পেলেই চাগিয়ে ওঠেন। তিনি বললেন–মূলকে ধরে রাখাই তো সাধনার সারকথা। ঈশ্বরকে যে পেয়েছে সে তাতেই বুদ হয়ে থাকে। তার কাছে তখন আর সব কিছুই অবান্তর।

এতক্ষণে বিশুদা চোখ খুললেন। ডাইনে-বাঁয়ে দুই সাহিত্যিকের দিকে চোখটা একবার ঘুরিয়ে নিয়ে মুখটা উপরের দিকে তুলে পেটের মধ্যে এক রাজ্যের জমিয়ে-রাখা ধোঁয়া ঘরের চালা লক্ষ্য করে ছাড়লেন, যেন ভিসুভিয়াসের পেট থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। অনুমান করলাম, পর্বতে বহ্নিমান ধূমাৎ। বিশুদা রেগেছেন, ফেটে পড়লেন বলে। গল্পের মাথায় ডাণ্ডা পড়ার আগেই বিশুদাকে ঠাণ্ডা করবার জন্যে বললাম-বিশুদা, ওঁদের কথায় কান দেবেন না। আপনি যে-ঘটনাটা বলবেন বলেছিলেন সেটা শুরু করুন।

বিশুদা বললেন–আমার অবর্তমানে যা হচ্ছিল, হচ্ছিল। সাক্ষাতে আর কেন। তবে হ্যাঁ। যে-ঘটনাটা আপনাদের বলতে যাচ্ছি সেটা আমার নিজের চোখে দেখা, এক বিন্দু বানানো নয়।

১৯৩৬ সাল, শরৎবাবুর মৃত্যুর দুই বছর আগের ঘটনা। আমার বাবার খুব অসুখ। এদিকে ব্লাড প্রেশার, ওদিকে ডায়াবেটিস। তার উপর কদিন ধরে পেটের গোলমালে খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন। একদিন দুপুরে বাড়াবাড়ি, ডায়রিয়ার লক্ষণ। তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডেকে আনলাম। ভাল করে পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু একটা মিক্সচারের প্রেসক্রিপশন লিখে আমার হাতে দিয়ে বললেন—ওষুধটা তাড়াতাড়ি আনিয়ে দু-ঘণ্টা পরপর এক দাগ করে খাইয়ে যান।

তখন বৈশাখ মাস, প্রচণ্ড গরম। রাস্তার পিচ গলে চটচটে হয়ে আছে। কালীঘাট অঞ্চলের সব কটা ডিসপেনসারি ঘুরলাম, সবাই বললে এ-ওষুধ ওদের কাছে নেই। এদিকে রোদে মাথার চাঁদি ফাটার উপম, আমারও নোখ চেপে গেল ওষুধ না নিয়ে বাড়ি ফিরব না। বসা রোডের মোড়র কাছে একটা ওষুধের দোকানে প্রেসক্রিপশনটা দেখিয়ে কম্পাউন্ডারকে বললাম কি ব্যাপার বলুন তো, কালীঘাটে সব দোকান ঘুরেছি, সবাই বললে এ-ওষুধ নেই। আপনিও কি তাই বলবেন?

–তা না বলা ছাড়া আর উপায় কি। এই যে হিউলেট মিক্সচার লিখে দিয়েছেন—ওটা তো বিলিতী ওযুধ, আজকাল পাওয়াই যায় না। ওটার বদলে একটা দেশী ওষুধ বেরিয়েছে—বিসমার্ক পেপসিন কম্পাউণ্ড। বলেন তো ওটা দিতে পারি। তবে প্রেসক্রিপশনে ওটা লিখিয়ে আনতে হবে।

আমি বললুম-তা হবে না মশাই। যা লেখা আছে তাই নিয়ে যেতে হবে। এই দুপুর রোদ্দ রে ঘুরে ঘুরে হয়রান। আবার ডাক্তারের বাড়ি ছুটব?

কম্পাউণ্ডার একটু রেগেই বললেন—তাহলে সাহেব পাড়ায় ছুটুন। পেলে সেখানেই পাবেন, এখানে নয়।

-কেন, আপনারাও বিলিতী বর্জন করেছেন বুঝি। কিম্বা দেশী কোম্পানীর মাল কাটাবার জন্যে মোটা কমিশন খাচ্ছেন।

কম্পাউণ্ডার মশাই এবার খেঁকিয়ে উঠলেন—যান যান, আপনার সঙ্গে তর্ক করলে আমার চলবে না, হাতে অনেক কাজ।

—আপনার সঙ্গেও আমার তর্ক করবার প্রবৃত্তি নেই।

এই কথা বলেই তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে আবার আমি রাস্তায় নেমে পড়লাম। রাসবিহারী অ্যাভিনিউ দিয়ে হেঁটে চলেছি, দুপাশে ওষুধের দোকান দেখলে ঢুকি আবার বেরিয়ে আসি।

হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়েছি দেশপ্রিয় পার্কের কাছে। পার্কের পুব। দিকে একটা জনবিরল রাস্তা। সেই রাস্তার উপরে কিছু দূরেই একটা সাইনবোের্ড ঝুলছে—পার্ক ফার্মেসি। ভাবলাম, বড় রাস্তার দোকান তো অনেক দেখলাম। এবার অলি-গলির দোকানগুলিতে ঢু মারা যাক। গলির দোকানে খদ্দেরের ভিড় সাধারণত কমই হয়। সেখানে বিলিতী ওষুধের পুরনো স্টক পড়ে থাকা অসম্ভব নয়। রোদে পুড়ে তেতে গলদঘর্ম অবস্থায় দোকানের সামনের লাল ফুলে-ভরা কৃষ্ণচূড়া গাছটার ছায়ায় এসে দাঁড়ালাম একটু জিরিয়ে নেবার জন্যে।

ছোট্ট দোকান। কাঠের কাউণ্টারের ওপাশে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক গভীর মনোনিবেশের সঙ্গে একটা বই পড়ছেন। পিছনে সার সার তিনটি আলমারিতে নানা লেবেলের পেটেন্ট ওষুধ সাজানো, ঘরের দেয়ালে দরজার পাল্লায় দেশী ও বিলিতী ওষুধের প্রচার-চিত্র ঝুলছে। দোকানে আর কেউ নেই।

ফুটপাথ থেকে দোকানের ভিতরে প্রবেশ করে একেবারে প্রৌঢ় ভদ্রলোকের সামনে এসে দাঁড়ালাম। হৃক্ষেপ নেই। এক মনে এবং একাগ্র মনে বই পড়ে চলেছেন। কৌতূহল হল। কী এমন বই যে খদ্দেরের দিকে মুখ তুলে তাকাবার ফুরসত নেই। গলাটা একটু বাড়িয়ে প্রথমে বইটা দেখে নিলাম। বিপ্রদাস। শরৎ চাটুজ্যের সাম্প্রতিক প্রকাশিত উপন্যাস। আমার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য গলা খাঁকারি দিলাম, কা কস্য। ভদ্রলোক এক ঝটকায় পাতাটা উল্টে বাঁদিকের পাতার উপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। বই-এর পাতা থেকে ওঁর চোখ ফেরানো অসম্ভব জেনেই প্রেসক্রিপশনটা এগিয়ে ধরে বললাম—ও মশাই, শুনছেন?

কে কার কথা শোনে। সন্দেহ জাগল ভদ্রলোক নিশ্চয় কানে কালা। আরেক ধাপ গলা চড়িয়ে বললাম—ও মশাই, বলি শুনতে পাচ্ছেন?

বই-এর পাতা থেকে চোখ না তুলে শুধু বললেন–অত চেঁচাচ্ছেন কেন। কি চাই বললেই তো হয়।

যা-চ্চলে। যা ভেবেছিলুম তা নয়। কি রকম দোকানদারি বাবা। খদ্দেরকেই ধমকানি! আমার মেজাজ তখন আসমানে চড়বার কথা। কিন্তু বই-পাগলা লোক, তার উপর শরৎ চাটুজ্যের। সুতরাং যতটা সম্ভব গলাটা মোলায়েম করে বললাম-একটা ওষুধ নিতে এসেছি। পাওয়া যাবে?

বইয়ের পাতায় চোখ নিবদ্ধ রেখেই বাঁ-হাত দিয়ে ফস করে কাগজটা আমার হাত থেকে নিয়ে বাঁদিকের কাউণ্টারের উপর প্রসারিত করে হাঁক দিলেন-প্রাণকেষ্ট।

বাঁদিকের কোণটায় একটা কাঠের পার্টিশন দেওয়া খুপরি। এক পাশে একটা কালো পর্দা ঝুলছে। পর্দার উপরের দিকে একটা পেস্ট-বোর্ড পেরেক দিয়ে মারা, তাতে ইংরিজী হরপে লাল কালিতে লেখা—নো অ্যাডমিশন।

কালো পর্দাটা একটু ফাঁক করে প্রথমে একটা মুণ্ডু দেখা দিল। মুণ্ডু দেখেই অনুমান করলাম চেহারা দেশলাইয়ের কাঠি। বয়েস চল্লিশ পার হয়েছে, চোখে পুরু কঁচের চশমা। প্রাণকেষ্ট পর্দা ঠেলে বেরিয়ে এলেন। নোগা লিকলিকে শরীরটা ধনুকের মত বেঁকে গেছে। গায়ের গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে এমন ভাবে লেপটে আছে যে পাঁজরার হাড় গোনা যায়। প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিয়ে দেখে বললেন—পাওয়া যাবে, তবে তৈরি করতে একটু সময় নেবে।

পাওয়া যাবে কথাটা শুনলাম এক ঘণ্টা ঘোরাঘুরির পরে। পরম তৃপ্তিতে মন ভরে গেল। হোক না দেরি। পেয়েছি এটাই অনেকখানি। জিজ্ঞাসা করলাম—কত দেরি হবে?

-এই আধ ঘণ্টা কি পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ইচ্ছে করলে ঘুরেও আসতে পারেন।

এই রোদে আর গরমে কোথায় ঘুরব। দোকানের একটা টুল টেনে নিয়ে পার্কের দিকে মুখ করে বসে পড়ে বললাম—আমি এখানেই অপেক্ষা করি, আপনি ওষুধটা তৈরি করুন।

পর্দানশীন প্রাণকেষ্ট আবার পর্দার আড্ডালে অন্তর্ধান করলেন।

তাহলে বই-পাগলা ভদ্রলোক হচ্ছেন দোকানের মালিক, প্রাণকেষ্ট হচ্ছে তার কম্পাউণ্ডার। বেলা তখন হবে প্রায় দুটো। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড রোদ, বাইরে তাকানো যায় না। রাস্তায় লোক চলাচল নেই বললেই চলে। জনশূন্য পার্কের সোনাঝুরি গাছটার ছায়ায় একটি ভিখারিনী ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, কোলের কাছে দুটি কঙ্কালসার উলঙ্গ শিশু বসে বসে ধুকছে। দুপুরের স্তব্ধতা ভেদ করে মাঝে মাঝে দু-একটা ট্রাম সশব্দে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। আশপাশের বাড়ির আলসের ছায়ায় বসে কয়েকটা কাক মুখ হাঁ করে হাঁপাচ্ছে।

দোকানের মালিকের দিকে এবার তাকালাম। আবার বইয়ের পাতা উল্টোলেন। কালো পর্দাটার দিকে তাকালাম। প্রাণকেষ্ট কি আবার ঘুমিয়ে পড়ল? কাউণ্টারের গায়ে পিঠটা হেলান দিয়ে ক্লান্ত পা-দুটো টান করে ছড়িয়ে দিয়ে বসে রইলাম। ওষুধ যখন তৈরি হয় হোক, আমি ততক্ষণ জিরিয়ে নিই।

 

হঠাৎ চমকে উঠে খাড়া হয়ে বসলাম। এই কাঠফাটা নোন্দরে নিতান্ত পাগল আর আমার মত বিপদগ্রস্ত লোক ছাড়া কে রাস্তায় বেরোয়। কাকে দেখছি দোকানের সামনে! পয়ং শরৎবাবু এসে উপস্থিত। গায়ে হাফ-হাত পাঞ্জাবি, হাতে লাঠি। শুভ্র কাশের মত মাথার চুল অবিন্যস্ত। দোকানের সামনে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে একবার সাইন বোর্ডটা দেখে নিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন।

দোকানের মালিকের দিকে তাকিয়ে আমি বিমূঢ় হয়ে গেলাম। যার লেখা বই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে পড়ছেন সেই লেখক সশরীরে তার সামনে উপস্থিত তারই দোকানের খদ্দের হয়ে অথচ ভদ্রলোকের সেদিকে কোনও নজরই নেই। যেমন পড়ছিলেন তেমনিই পড়ে চলেছেন।

শরৎবাবু একটু ইতস্তত করে ভদ্রলোকের সামনে একটা কাগজ এগিয়ে ধরে বললেন–এই ওষুধটা আমাকে দিন।

বই থেকে মুখ না তুলে ভদ্রলোক হাঁক দিলেন-প্রাণকেষ্ট, দেখ তো কি চায়।

কালো পর্দার ভিতর থেকে প্রাণকেষ্টর পুনরাবির্ভাব হল। শরৎবাবুর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে একটা আলমারির ডালা সরিয়ে যা বার করল, তাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে ইউকোড়োল। অনুমান করলাম কোনও বিলিতী কোম্পানীর ওষুধ।

প্রাণকেষ্ট কাউণ্টারের উপর কাগজ আর ওষুধটা রেখে বললে-মেমম করে দিন। আর কোনও বাক্য ব্যয় না করে প্রাণকেষ্ট আবার কালো পর্দার ভিতরে ঢুকে পড়ল। শরৎবাবু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রাণকেষ্টর আসা ও যাওয়া নিরীক্ষণ করলেন।

ভদ্রলোক বইটার পাতার উপর একটা কাচের পেপার-ওয়েট চাপা দিয়ে ড্রয়ার খুলে একটা ক্যাশমেমম বার করলেন। মুখে অত্যন্ত বিরক্তির ছাপ। খসখস করে ওষুধের নাম আর দাম লিখে কাগজটা ছিড়তে ছিড়তে বললেন—দু টাকা।

শরবাবু পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বার করে কাউণ্টারের উপর রাখলেন। নোটটা ড্রয়ারের ভিতর রেখে তিনটা খুচরো টাকা বার করে শরৎবাবুর হাতে দেবার সময় ভদ্রলোকের কী যে করুণা হল হঠাৎ মুখ তুলে তাকালেন। টাকাটা শরৎবাবুর হাতে দেবেন বলে হাতটা সবে বাড়িয়েছিলেন, মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। চোখেমুখে ভদ্রলোকের বিস্ময় বিমূঢ় ভাব। দু-এক সেকেণ্ডের মধ্যেই সামলে নিলেন। মেমো আর টাকা শরৎবাবুর হাতে দিতেই তিনি তা হাফ-হাতা পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দোকান থেকে বেরোবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, এমন সময় দোকানের মালিক মুখে বদান্যতার হাসি এনে বললেন–একটা কথা বলব স্যার?

বলুন কি বলবেন। শরৎবাবু ভদ্রলোকের দিকে মুখ ফেরালেন।

–কিছু মনে করবেন না তো?

—কিছুমাত্র না। আজীবন প্রশ্নের উত্তর দিয়েই আসছি। প্রশ্নের কি আর শেষ আছে? বলুন কি বলতে চান।

ভদ্রলোক সংকোচের সঙ্গে বললেন–দেখুন, আপনাকে ঠিক শরৎ চাটুজ্যের মৃত দেখতে।

কথাটা শুনেই শরৎবাবু একটু থমকে গেলেন। পরমুহূর্তেই চোখে মুখে এমন একটা ভান করলেন যেন প্রশ্নটা তাঁর কাছে দুর্বোধ্য। বললেন–কোন শরৎ চাটুজ্যে?

–নবেলিস্ট শরৎ চাটুজ্যে, যিনি শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন, গৃহদাহ, দেবদাস, বিপ্রদাস লিখেছেন।

গম্ভীর গলায় শরৎবাবু বললেন–ও, অনেকে তাই বলে বটে।

শরৎবাবু আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না। শেষপ্রশ্ন উপন্যাস লিখলে কি হবে। মানুষের প্রশ্নের তো আর শেষ নেই। আবার কি জিজ্ঞাসা করে বসে সেই ভয়ে একটু তাড়াতাড়ি দোকান থেকে ফুটপাথে নেমে মনোহর পুকুর রোডের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।

আমার মাথায় তখন দুষ্টবুদ্ধি চেপে গেল। ভাবলুম একটু রগড় করা যাক। শরৎবাবু যখন বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে গিয়েছেন তখন আস্তে আস্তে পুস্তক-পাঠ-নিমগ্ন ভদ্রলোকের কানের কাছে ঝুকে গলাটা একটু খাটো করেই বললাম-ও মশাই, চিনতে পারলেন না? উনিই তো শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

ঘুমের মধ্যে হঠাৎ ছুঁচ ফুটিয়ে দিলে মানুষ যেমন চমকে ওঠে তেমনি কথাটা কানে যাওয়া মাত্র আচমকা চেয়ার থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললেন–অ্যাঁ, উনিই শরৎচন্দ্র? নবেলিস্ট শরৎ চাটুজ্যে? তা এতক্ষণ বলেন নি কেন? তাছাড়া আমার দোকানে উনি কেন আসবেন।

কাউণ্টারের সুইং-ডোরটা এক ঝটকায় খুলে বিদুৎগতিতে ফুটপাথে ছুটে নেমে গেলেন। যাবার সময় হাতের ধাক্কা খেয়ে কাচের পেপার-ওয়েটেটা ছিটকে মাটিতে পড়তেই দেখলাম নো-অ্যাডমিশন লেখা কালো পর্দাটা নড়ে উঠল, একটুখানি ফাঁক দিয়ে প্রাণকেষ্টর দুই উদ্বিগ্ন চোখ আমার দিকে জল অল করে তাকিয়ে আছে।

ওদিকে দোকানের মালিক তখন ফুটপাথের উপর দাঁড়িয়ে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছেন সেই পথের দিকে, গ্রীষ্মমধ্যাহ্নের যে-নির্জন পথ দিয়ে শরৎচন্দ্রের দীর্ঘ দেহ ধীরপদক্ষেপে মনোহরপুকুর রোডের মোড়ে এসে মিলিয়ে গেল।

 

বিশুদা এবার থামলেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন সিগারেট এগিয়ে দিল, আরেকজন পকেট থেকে দেশলাই বার করে ধরিয়ে দিল। বেয়ারা অমর ছুটে চলে গেল চা আনবার জন্যে।

আমি বললুম-বিশুদা আপনার অনুপস্থিতিতে আমরা আপনার সম্বন্ধে বৈঠকে যে-সব কটুকাটব্য করেছি তা প্রত্যাহার করছি।

বৈঠকের সবাই আমার প্রস্তাবে সম্মতি জানালেন শুধু একজন ছাড়া। সব্যসাচী লেখক বললেন—তা না হয় হল। কিন্তু আমার মনে একটা খটকা থেকে গিয়েছে। বিশুদা আমাদের বৈঠকে বরাবরই গর্বের সঙ্গে জাহির করে এসেছেন যে শরৎবাবুর সঙ্গে ওঁর পরিচয় সাধারণ পরিচয় নয়, এক গেলাসের ইয়ার বললেই হয়। তাই যদি হবে তাহলে বিশুদার সঙ্গে শরৎবাবু একটিও কথা বললেন না কেন?

সব্যসাচী লেখক এবার একটা অকাট্য যুক্তি ছেড়েছেন। আমাদেরও তো এতক্ষণ এটা খেয়াল হয় নি। পাঁচ জোড়া জিজ্ঞাসু চোখ বিশুদার মুখের উপর ফোকাস ফেলল, উনি কিন্তু নির্বিকার। ঠোঁটের কোণায় কৌতুকপূর্ণ হাসির ঝিলিক তুলে আপন মনে পা দোলাচ্ছেন।

কিছুক্ষণ বিরতির পর বিশুদাই মুখ খুললেন। বললেন—ঘটনাটা হচ্ছিল ওষুধের দোকানদার আর শরৎবাবুকে নিয়ে। তার মধ্যে আমার কথা আসবে কেন? আর এলেও, যেহেতু ঘটনাটা আমিই বলছি, সেই হেতু নিজের কথা বলাটা আমি ভালগারিটি বলেই মনে করি। শরৎবাবুর সঙ্গে মামার কথা হয়েছিল বইকি। ওষুধ নিয়ে দোকান থেকে যাবার সময় আমার দকে হঠাৎ তাঁর নজর পড়ল। কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন–চেনা চেনা বলে মনে হচ্ছে।

আমি বললুম-রসচক্রর আসরে নিয়মিতই যাই, সেখানেই আমাকে দেখেছেন।

-ও, তাহলে তুমিও একজন রসচক্রী। তা এই দুপুরে এখানে কোন রসের সন্ধানে।

আমি বললাম-এসেছিলাম ওষুধের সন্ধানে, কিছু রসের সন্ধানও তো পেয়ে গেলাম। কিন্তু আপনি এই রোদে ছাতা না নিয়ে বেরোলেন কেন?

শরৎবাবু বললেন–ছাতা নিয়েই বেরনো উচিত ছিল। বেরোবার সময় ভুলে লাঠিটা নিয়েই বেরিয়ে পড়েছি। লাঠিটাই সব সময় হাতে রাখা আমার অভ্যেস।

–আপনি নিজে না এসে চাকরকে পাঠিয়ে দিলেই তো পারতেন।

শরৎবাবু বললেন–দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার ঘণ্টা খানিক বাদেই পেটে একটা যন্ত্রণা শুরু হয়। নতুন একটা ওষুধ বেরিয়েছে, এইটা খেলে একটু আরাম বোধ করি। ভেবেছিলাম ওষুধটা আনতে চাকরকেই পাঠাব। ব্যাটা কাল সারারাত কোথায় কাটিয়েছে কে জানে, দুপুরে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। তাই নিজেই বেরিয়ে পড়লাম। এ কথা বলেই শরৎবাবু বাড়ির দিকে রওনা হলেন, আমিও দোকানে ফিরে এলাম। . বিশুদার কথা থামতেই আসরের গাল্পিক লেখক বললেন—বাংলা দেশে জীবদ্দশায় পাঠক-ভাগ্য শরৎবাবুর মত আর কারোর হয় নি। অথচ শরৎবাবুর পাঠকভীতি সর্বজনবিদিত। এই কারণে কোন সভাসমিতিতে ওঁকে নিয়ে যাওয়া ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আর বক্তৃতা? নৈব নৈব চ।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল বার্নার্ড শ-র সম্বন্ধে একটা বিখ্যাত গল্প। বার্নার্ড শর তখন খুব নাম-ডাক। একদিন লণ্ডনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, এক ভদ্রমহিলা হাইহিল জুতোর খুটখুট খুটখুট দ্রুত শব্দ তুলে বার্নার্ড শর পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়েই বার বার ঘুরে ঘুরে শ-কে দেখছেন। বার্নার্ড শ লম্বা লম্বা পা ফেলে ভদ্রমহিলার কাছে এসে বললেন–ম্যাডাম, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন। আমিই জর্জ বার্নার্ড শ।

পার্ক ফার্মেসির সেই দোকানদারের কথা ঘুরে ফিরে বার বার মনে পড়ছিল। এমন একনিষ্ঠ পাঠক সচরাচর দেখা যায় না। বিশুদাকে তাই বললাম-আপনার মুখে ঘটনাটা শুনে সেই দোকানের মালিকের উপর কিন্তু আমার অসীম শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। চলুন, সেই নমস্ক ব্যক্তিটিকে একবার দেখে আসি। বিশেষ করে সেই কম্পাউণ্ডার প্রাণকেষ্টকে।

দীর্ঘ নিঃশাস ফেলে বিশুদা বললেন–দুঃখের কথা আর বলেন কেন। কয়েক বছর পরের কথা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বেধে গেছে। আমার স্ত্রীর মরণাপন্ন অসুখ, তাঁকে ল্যান্সডাউন রোডের রামকৃষ্ণ মিশনের হাসপাতালে রেখেছি। একদিন ডাক্তার একটা ইনজেকশন কিনে আনতে বললেন, যা লিসে স্টীট ছাড়া আর কোন অঞ্চলের ওষুধের দোকানে পাওয়া সম্ভব নয়। পার্ক ফার্মেসির কথা মনে পড়ে গেল। লিণ্ডসে স্টীট ছুটব? তার চাইতে কাছের এই দোকানটা একবার দেখাই যাক। গেলাম দেশপ্রিয় পার্কের পূর্বদিকের রাস্তায়। সেখানে গিয়ে দেখি পার্ক ফার্মেসির কোন চিহ্নই নেই। সে তল্লাটটা ভেঙ্গেচুরে সেখানে এক বিরাট ইমারত গড়ে উঠছে, শুনলাম কোন এক ব্যাঙ্কের বাড়ি তৈরী হচ্ছে।

সব্যসাচী লেখক মন্তব্য করলেন-উপন্যাস পড়েই বোধ হয় ভদ্রলোক ব্যবসাটা লাটে তুলে দিলেন এবং এর জন্যে শরৎবাবুই দায়ী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *