সপ্তদশ পরিচ্ছেদঃ তালিকোটের যুদ্ধ
বর্ষান্তে শরতের প্রারম্ভে দিঙ্ঘমণ্ডল পরিস্কৃত এবং ধরাতল সুগম হইলে, দাক্ষিণাত্যে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সমর-দুন্দুভি বাজিয়া উঠিল। তালিকোটের প্রশস্ত ক্ষেত্রে উভয় বাহিনী পরস্পর বিজিগীষু হইয়া সম্মুখীন হইল। আহমদনগর, বিদর, বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সোলতানদিগের সৈন্যের সহিত নানাস্থান হইতে স্বজাতীয় হিতাভিলাষী ইসলামের গৌরবাকাঙ্খী যুবক যোদ্ধৃগণ আসিয়া যোগদান করিলেন। বীরকুলচূড়ামণি সোলতান হোসেন নিজাম শাহ দেওয়ান মুসলিমবাহিনীর সেনাপতিত্ব গ্রহণ করিলেন। এই ভীষণ আক্রমণোদ্যত হইয়া অবস্থান করিবার পরে, একদা প্রত্যুষে একদল হিন্দু সৈন্য মুসলিম বাহিনীর এক অংশ আক্রমণ করিল। এই আক্রমণের ফলে সেইদিন উভয় পক্ষে ভীষণ সমর ঝটিকা প্রবাহিত হইল। মুসলমান সৈন্য জেহাদের নামে এবং হিন্দু সৈন্য রাজ্য-রক্ষা-কল্পে মত্ত হইয়া যুদ্ধ করিতে লাগিল। হায়, হস্তী এবং বীরপুরুষদিগের পদভরে পৃথিবী কম্পিত হইল। তরবারির চাঞ্চল্যে, বর্শার দীপ্তিতে অসংখ্য বিদ্যুদ্বিকাশ হইতে লাগিল! তোপের গর্জনে চতুর্দিক প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। অশ্বারোহী, পদাতিন এবং গোলন্দাজ সৈন্যগণ অসাধারণ রণ-কৌশল প্রকাশ করিয়া যুদ্ধ করিতে লাগিল। সমস্ত দিবসের ভীষণ যুদ্ধেও কোন পক্ষের জয়-পরাজয় নির্ণয় হইল না।
এইরূপ ক্রমাগত তিন দিবস ভীষণভাবে সময় চলিল। চতুর্থ দিবস মোসলেমবাহিনী বিপুল বিক্রমে হিন্দুদিগকে আক্রমণ করিল। গাজিগণ “আল্লাহু আকবর” রবে মুহুর্মুহু আকাশ-পাতাল কম্পিত করিয়া ব্যাঘ্রেরর ন্যায় দুর্ধর্ষ বিক্রমে শক্র-সৈন্য সংহার করিতে লাগিল।
বৈশাখ-বাত্যা-তাড়িত সমুদ্রের ন্যায়, রণক্ষেত্র ভয়াবহ আকার ধারন করিল। সহস্র সহস্র হিন্দু সৈন্য আহত ও নিহত হইয়া ভূপতিত হইতে লাগিল। অপরাহৃকালে মুসলমানের বীর্যপ্রতাপ রোধে অসমর্থ হইয়া হিন্দু সৈন্য পশ্চাতে হটিতে লাগিল। তাহারা ধীরে ধীরে পশ্চাতে হটিয়া একটি উচ্চাবচ ভূমিতে যাইয়া স্থির হইল।
পরদিবস প্রত্যুষে বিজয়নগরের সৈন্যদল সে-স্থান হইতেও বিতাড়িত হইল। তৎপর দিবস বিজয়নগর হইতে বহু সংখ্যক নূতন তোপের আমদানি হওয়ায় হিন্দুসেনা সাহসী হইয়া তেজের সহিত পর্তুগীজ গোলন্দাজগণ অবিশ্রান্ত গোলা নিক্ষেপে মুসলমান পক্ষের বহু ক্ষতি সাধন করিল। হোসেন নিজাম শাহ্ ক্রোধে সিংহের ন্যায় গর্জন করিয়া একদল যোদ্ধাকে প্রাণের মমতা ত্যাগ করিয়া তোপের উপর পড়িয়া, তোপ কাড়িয়া লইতে বলিলেন। বঙ্গীয় পাঠান-বীর ঈসা খাঁ তোপের উপর পড়িবার জন্য ৫০ জন আত্মোৎসর্গকারী বীরপুরুষকে আহবান করিলেন। তাঁহার আহবানে অধীনস্থ দুই সহস্র যোদ্ধার প্রত্যেকেই শহীদ হইবার জন্য লালায়িত হইয়া তোপ কাড়িয়া লইবার জন্য উদ্যত হইলেন। ঈসা খাঁ তাঁহাদের রণোন্মত্ততা দর্শনে অতিমাত্র উৎসাহিত হইলেন এবং সকলকে নিরস্ত করিয়া বঙ্গীয় যুবকদিগের মধ্য হইতে বিনা বিচারে পঞ্চাশজনকে গ্রহণপূর্বক বিদ্যুৎদ্বেগে তোপ লক্ষ্য করিয়া ঘোড়া ছুটাইলেন। বাজপক্ষী যত দ্রুত চটকের উপর বা নেকড়ে বাঘ যত সত্বর মেষপালের উপর উৎপতিত হয়, ঈসা খাঁ বাঙ্গালী যোদ্ধৃগণকে লইয়া তদপেক্ষাও তীব্র বেগে, ভীষণ ঝটিকাবর্তের ন্যায় মুক্ত কৃপাণ করে “আল্লাহু আকবর” রবে গোলন্দাজ সেনার উপরে পতিত হইলেন! গোলার আঘাতে ৪৩ জন্য সৈনিক এবং পঁয়ত্রিশটি অশ্বদেহ চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া গেল। সাতজন মাত্র বীর করাল কৃপাণ করে তোপখানার উপর পতিত হইয়া তরবারির ক্ষিপ্র প্রহারে তোপ-পরিচালক গোলন্দাজগণকে খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিয়া ফেলিলেন। সমুদ্রের তরঙ্গের ন্যায় তোপখানা রক্ষা করিবার জন্য চতুর্দিক হইতে সৈন্যদল আসিয়া ভীষণ বিক্রমে তাহাদিগের প্রতি অস্ত্রশস্ত্র নিক্ষেপ করিতে লাগিল। সপ্তজন মুসলমান গাজী রুদ্ধশ্বাসে চরম বিক্রমে তরবারি চালাইতে লাগিলেন। দুইজন বিশেষ আহত এবং অবশিষ্ট পাঁচজন শরীরের স্থানে স্থানে আঘাত প্রাপ্ত হইয়াও ক্ষুদ্র শৈলের ন্যায় অসংখ্য ভীষণ আক্রমণরূপ নদীর প্রবাহকে গুরুতর বাধা প্রদান করিলেন। ওদিকে মুসলিম বাহিনীর অগ্রগামী দলের সৈন্যদল আসিয়া পড়ায় হিন্দু সেনা তোপখানা পরিত্যাগ করিয়া বৃকতাড়িত শৃগালের ন্যায় পশ্চাদগামী হইল। মুসলমান সেনা তখন তোপের মুখ ফিরাইয়া হিন্দু সেনাকে লক্ষ্য করিয়া তোপ দাগিতে লাগিল। চতুর্দিকে বজ্রনির্ঘোষ-নিনাদিত বনভূমির ন্যায় ভীতিসঙ্কুল হইয়া উঠিল। তোপের গোলার অভাব হওয়ায় সোলতান নিজাম শাহ রাশি রাশি পয়সা পুরিয়া তোপ দাগিতে আদেশ করিলেন। তাহাতে গোলা অপেক্ষা অধিকতর সূফল ফলিল। পয়সাগুলি বিচ্ছুরিত হইয়া চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত হওয়ায় বহুসংখ্য হিন্দু সেনা আহত এবং নিহত হইল। তাহার ফলে অবশিষ্ট সৈন্য-ব্যুহ ভগ্ন করিয়া নগরাভিমুখে পলায়ননপর হইল। মোসলেম সেনা পলায়নপর হিন্দু সেনার পশ্চাদ্ধাবিত হইয়া তাহাদিগকে হত্যা করিতে লাগিল। হিন্দু সেনা নগরে প্রবেশ করিয়া নগরদ্বার রুদ্ধ করিল এবং নগর পরিবেষ্টন করিয়া যে পরিখা ছিল, তাহার সেতু তুলিয়া ফেলিল।
বিজয়নগরের চতুর্দিক সমুচ্চ সুদৃঢ় প্রাচীর এবং দুই শত হস্ত পরিমিত প্রশস্ত ও বিশ হস্ত গভীর পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। পরিখার গর্ভে নানাবিধ তীক্ষ্মাগ্র শেল, শূল ও লৌহদণ্ড প্রোথিত ছিল এবং প্রাচীরোপটি প্রস্তর নিক্ষেপের উপযোগী বণ্ডসংখ্যক যন্ত্র ও তোপশ্রেণী সজ্জিত ছিল। মুসলমান সৈন্য, নগরের সিংহদ্বারের নিকটবর্তী হইয়া প্রাচীর ভাঙ্গিবার জন্য একস্থান লক্ষ্য করিয়া অনবরত তোপ দাগিতে লাগিল। বিজয়নগরের পক্ষে পুর্তগীজ গোলন্দাজগণও যথাযথ তাহার উত্তর দিতে লাগিল।
পরিখা অতিক্রম করিতে না পারিলে নগর আক্রমণের বিশেষ সুবিধা নাই দেখিয়া নিজাম শাহ পরিখা উত্তীর্ণ হইবার জন্য কৌশল ও বুদ্ধি প্রকাশ করিতে লাগিলেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু সংখ্যক নৌকা নির্মাণপূবর্ক পরীখা উত্তীর্ণ হইবার জন্য চেষ্টা করা হইল। কিন্তু উহাতে কোনই সুফল ফলিল না। অবশেষে বহুসংখ্যক প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বৃক্ষ ও প্রস্তর নিক্ষেপপূর্বক সেতু নির্মাণের পরামর্শ স্থির হইল। তোপের আশ্রয়ে ঈসা খাঁ একদশ ধর্মযোদ্ধা লইয়া সেতু রচনা করিতে লাগিলেন। বিপক্ষের গোলা ও প্রস্তর নিক্ষেপে দলে দলে বীরপুরুষ হত হইতে লাগিলেন, কিন্তু সে-দিকে আজ কাহারও দৃকপাত নাই! অসংখ্য শবদেহে পরিখার গর্ভদেশের কিয়দংশ পরিপূর্ণ হইয়া গেল। পরিখার জল রক্তস্রোতে আরক্ত হইয়া উঠিল। বহ সাধনা এবং বহ প্রাণদানে সেতুর কতক অংশ নির্মিত হইল বটে, কিন্তু প্রাচীরের উপরিস্থ তোপখানা হইতে অজস্রধারে অব্যর্থ লক্ষ্যে গোলা ও প্রস্তর বর্ষণ হওয়ায় অবশিষ্ট অংশ নির্মাণ করা অসম্ভব হইয়া পড়িল। ঈসা খাঁ এই প্রতিবন্ধকতায় আরও উত্তেজিত হইয়া ভীষণ গর্জন করিয়া উঠিলেন। বিংশতি হস্ত পরিমিত স্থান সেতু-নির্মাণ হইতে অবশিষ্ট ছিল। ঈসা খাঁ জলদগম্ভীর স্বরে সৈন্যবৃন্দকে আহবান করিয়া বলিলেন, “কে আছ আজ ধর্মপ্রাণ খোদাভক্ত সাচ্চা মুসলমান! এখনি এই সেতু হইতে আমার পশ্চাতে ঝাঁপাইয়া পড়। সাঁতার কাটিয়া এই অংশ অতিক্রম করিয়া দ্বারের মূলদেশে যেয়ে দ্বার ভাঙ্গবার চেষ্টা কর।”-এই কথা বলিয়া পাঠান-বীর উন্মত্তের ন্যায় পরিখার জলে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন।
তাঁহার সঙ্গে সহস্র সহস্র যোদ্ধা পরিখায় ঝাঁপাইয়া পড়িয়া পরপারে উত্তীর্ণ হইয়া আঁকশির সাহায্যে তীরে উঠিয়া দ্বারদেশ আক্রমণ করিলেন। সহস্রাধিক মুসলমান পরিখার জলগর্ভস্থ তীক্ষ্ণাগ্র অস্ত্রে এবং কামানের গোলার আঘাতে প্রাণত্যাগ করিলেন। ঈসা খাঁ পরিখা অতিক্রমকালে বাহুতে একটা তীক্ষ্ণাগ্র বিষাক্ত শূলের সাংঘাতিক আঘাত প্রাপ্ত হইলেন। কিন্তু রণোন্মত্ত অবস্থার তিনি তাহা কিছুমাত্র অনুভব করিতে পারিবেন না। ভীষণ বিস্ফোরক প্রয়োগে সিংহদ্বার চুরমার হইয়া গেল। তখন শাণিত কৃপাণ হস্তে ‘দীন্ দীন্’ রবে মুসলমান বীরগণ ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় নগরাভ্যন্তরে প্রবেশ করিল। সমর-কাণ্ড অতি প্রচণ্ড এবং লোমহর্ষণ-জনকভাবে চলিল! নাগরিক সৈন্যবৃন্দ রুদ্ধনিশ্বাসে আপনাদের বিক্রম নিঃশেষে একবার ভীষণ যুদ্ধোৎসাহ দেখাইল। কিন্ত উদ্বেলিত সাগর-প্রবাহের ন্যায় মুসলমান সৈন্যের প্রবেশ-গতি রোধ করে কাহার সাধ্য? অসংখ্য পৌত্তলিক যোদ্ধার ছিন্নমস্তকে রণভূমি দুর্গম হইয়া উঠিল। মহাবীর সোলতান নিজাম শাহ বিশ্বাসঘাতক রাম রায়ের অনুসন্ধান করিতে করিতে তাহাকে মৃতদেহপুঞ্জের মধ্যে আত্মলুক্কায়িতভাবে আবিস্কার করিয়া টানিয়া বাহির করিলেন। তাঁহার এই আত্মগোপনের ভাবে সকলেই হাস্য ও বিরূপ করিতে লাগিল। আহত হিন্দু সৈন্যগণ রাম রায়কে তিরস্কার ও অভিসম্পাত করিতে লাগিল। ঘৃণা ও লজ্জায় কাপুরুষ রাম রাজ্য সহসা মর্মে ছুরিকা বিদ্ধ করিয়া আত্মহত্যা করিলেন।
নগরবাসীগণ নিজাম শাহের আনুগত্য ও প্রভুত্ব স্বীকার করিয়া পনের লক্ষ টাকা নজর প্রদান করিলেন। নিজাম শাহ দুর্গশীর্ষ হইতে ত্রিশূল-অঙ্কিত পতাকা ভূতলে নিক্ষেপ করতঃ স্বকীয় ঐসলামিক পতাকা প্রোথিত করিলেন। মোসলেম বীরগণ “আল্লাহ আকবর” রবে আকাশ-পাতাল কম্পিত করিয়া জয়ধ্বনি করিয়া উঠিলেন। এইরূপে তালিকোট যুদ্ধে ফলে বিজয়নগর হিন্দু-শাসনের তামসী ছায়া হইতে উদ্ধার প্রাপ্ত হইয়া ঐসলামিক সুশাসনের উজ্জ্বল আলোকে আলোকিত হইল!
বিজয়নগরের বিজয় লাভের পরে মহাবীর ঈসা খাঁ দাক্ষিণাত্যের সোলতান ও প্রধান প্রধান সেনাপতিগণ কর্তৃক উচ্চকণ্ঠে প্রশংসিত হইলেন। তিনি যে বাহুতে বিষাক্ত শূলের আঘাত পাইয়াছিলেন, তাহারও চিকিৎসার বিশেষ বন্দোবস্ত হইল।