রানু আজ একটু সকাল সকাল অফিস থেকে এসেছে। টগরকে নিয়ে একবার ডাক্তারের কাছে যাবে। দিন দিন এমন রোগা হয়ে যাচ্ছে কেন সে? ভিটামিন টিটামিন কিছু খাওয়ানো দরকার।
বাসায় ঢুকতে গিয়ে সে চমকে গেল। বসার ঘরের দরজা হাট করে খোলা। সিগারেটের গন্ধ আসছে। অথচ তালাবদ্ধ থাকার কথা। অপলা কলেজ থেকে ফিরবে। পাঁচটায। টগর খালার কাছে। অসময়ে তালা খুলে ঘরে বসে থাকবে কে?
আলম বসেছিল। রানুকে দেখে সে ফ্যাকাশেভাবে হাসল। রানু বলল, ঘরে ঢুকলে কি ভাবে?
নিচ থেকে চাবি এনে খুলেছি।
ভাল করেছ। কেমন আছ তুমি?
আলম জবাব দিল না। তার ফর্সা গাল ঈষৎ লাল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তাকে নার্ভাস প্রকৃতির মানুষ বলা যাবে না। কিন্তু আজ তাকে নার্ভাস লাগছে। রানু অস্বস্তিবোধ করতে লাগল। একজন নার্ভাস মানুষ হঠাৎ অস্বাভাবিক কিছু করে বসতে পারে। রানু বেশ সহজভাবেই বলল, তুমি বস, আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসছি।
আলম কিছু বলল না। আরেকটি সিগারেট ধরাল। রানু বলল, চা-টা কিছু খাবে?
না। পানি খাব। এক গ্রাস পানি দাও।
রানু পানি দিয়ে গেল। আলম একটি চুমুক দিয়েই গ্লাস নামিয়ে রাখল। বিস্বাদ কিছু মুখে দিলে মানুষের চোখ-মুখ যেভাবে বিকৃত হয় তার চোখ মুখও সে রকম হয়েছে। আলম বলল, একটু তাড়াতাড়ি আসবে রানু।
তোমার কী কোন তাড়া আছে?
না।
তাহলে বস। আমার দেরি হবে না।
রানু দেরি করতে লাগল। ঠিক এই মুহূর্তে আলমের সামনে বসে থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে না। সব সময় সব কিছু ভাল লাগে না। আলম একটি চমৎকার ছেলে। তার সঙ্গে গল্প করতে রানুর ভাল লাগে। কিন্তু আজ কেন জানি ইচ্ছা করছে না।
রানু অনেকখানি সময় নিয়ে গোসল করল। বালতিতে ভেজা কাপড় ছিল সেগুলি ধুয়ে ফেলল। কাজটা উল্টা করা হল। কাপড়গুলি আগে ধোয়া উচিত ছিল। সে দ্বিতীয়বার গায়ে পানি ঢালতে লাগল। তার মধ্যে কি শুচি বায়ুর কোন লক্ষণ দেখা দিচ্ছে? সম্ভবত দিচ্ছে। বাইরে কোথাও গেলেই সমস্ত শরীর নোংরা মনে হয়। এসব আগে ছিল না। নতুন দেখা দিয়েছে।
আলম গম্ভীর মুখে বসে আছে চেয়ারে। বসার ভঙ্গি রাগী রাগী! রানু ঘরে ঢুকেই বলল, দেরি করে ফেললাম তাই না?
হ্যাঁ তা করেছি। ঠিক এক ঘণ্টা ছ’মিনিট দেরি করেছ।
আই এ্যাম সরি।
আলম শীতল স্বরে বলল, তুমি ইচ্ছা করে এতটা দেরি করলে। আমার মনে হয় তুমি আমাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছি।
এড়িয়ে যাবার চেষ্টা কর কেন?
আমি জানি না কেন? কিন্তু তুমি করছি। এটা অবশ্যি নতুন না, প্রায়ই তুমি এরকম কর। কর না? বল কর, কি কর না?
আমরা সবাই কখনো কখনো প্ৰিয়জনদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। আমি যেমন করি তুমিও তেমন কর। ঠিক না?
আলম জবাব দিল না। রুমাল বের করে মুখ মুছল। এটা তার বিদায় নেবার লক্ষণ। উঠবার সময় হলেই সে রুমাল বের করে মুখ মোছে। চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে নেয়। অভ্যাসটা মেয়েলি। পুরুষ মানুষের চেহারা সম্পর্কে এতটা সচেতন হওয়া ঠিক না।
আলম বলল, আমি উঠছি।
এখনই উঠবে কি? বাস চা খাও।
সে হ্যাঁ না কিছুই বলল না। যেভাবে বসেছিল সেভাবেই বসে রইল।
রানু চা বানাতে চলে গেল। অপলা এসে ঢুকল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। পাঁচটা বেজে গেছে নাকি? অপলা আসে। পাঁচটার দিকে।
আলম ভাই কেমন আছেন?
ভাল।
এমন মুখ কালো করে রেখেছেন কেন? আপার সঙ্গে ঝগড়া-টগাড়া হয়েছে নাকি?
না।
দারুণ একটা খবর আছে দাঁড়ান বলছি। ভেরি এ্যাকসাইটিং। অপলা রূঢ়া ঘরে চলে গেল।
তোমার অফিস কেমন হল আপা?
ভাল।
টগর ফেরেনি এখনো?
না।
দারুণ একটা ব্যাপার হয়েছে আপা।
রানু কোনো রকম উৎসাহ দেখাল না। আপলা প্রায়ই দারুণ খবর ধলে। যে সব খবর বলে সেগুলি খুবই হালকা ব্যাপার।
আজ আমাদের কলেজে নবীন বরণ উৎসব হল। দু’জন বিখ্যাত লেখককে আনা হয়েছিল। একজন হচ্ছেন…আন্দাজ করত কে?
রানু জবাব দিল না।
দুলাভাই। চমৎকার একটা বক্তৃতা দিলেন। এমন সব হাসির কথা বলতে লাগলেন আমরা হাসতে হাসতে বাচি না। দুলাভাই যে এমন হাসাতে পারেন জানতাম না। সাধারণ সব গল্প এমন অন্য রকম করে বলতে লাগলেন একটা গল্প হচ্ছে একজন ভূতের গল্পের লেখককে নিয়ে। ভদ্রলোক একদিন দুপুরবেলা গল্প লিখতে বসেছে…
বলতে হবে না। গল্পটা আমি জানি। তুই বসার ঘরে চা-টা দিয়ে আয়।
গল্পটা শেষ করে যাই এক মিনিট লাগবে।
শেষ করার দরকার নেই।
অপলা থেমে থেমে বলল, দুলাভাই লোকটিকে তুমি পছন্দ না করতে পার কিন্তু তার গল্পগুলি তো ভাল। গল্প তো কোনো দোষ করেনি?
রানু উত্তর না দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। অপলা চা দিতে গিয়ে গল্প শুরু করেছে। হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে
বুঝলেন আলম ভাই, আমি তো ভাবিনি দুলাভাইকে দেখব। আমি প্রায় চিৎকার করে উঠেছিলাম। বহু কষ্টে সামলেছি। অনুষ্ঠান শেষে অটোগ্রাফ নেবার জন্য ঠেলা ঠেলি পড়ে গেল। আমিও অচেনা মেয়ের মত খাতাটা বাড়িয়ে দিয়েছি। তারপর কী হয়েছে শোনেন…
আলমের কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না। সে নিশ্চয়ই থমথমে মুখে বসে আছে।
বাড়ির সামনে রিকশা এসে থেমেছে। একজন অপরিচিত লোক টগরকে কোলে কবে নামছে রিকশা থেকে। কার না। কার হাতে ছেলেকে পাঠিযে দিয়েছেন খালা। রানু, টগরের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। টগর তাকাল। হাসল না, হাত নাড়ল না, কিছুই করল না। কী যে অদ্ভুত হচ্ছে ছেলেটা। সমস্ত দিন মাকে দেখেনি। কিন্তু সে নির্বিকার; যেন মাকে সারাদিন দেখতে না পাওয়া একটা স্বাভাবিক ঘটনা।
বসার ঘরে অপলা একাই কথা বলে যাচ্ছে। আর তার উচ্ছাস এবং আবেগ দুইই খুব উঁচু তারে বাধা। দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে এটাই কী উচ্ছাসের মূল কারণ?
আলম ভাই এই গল্পটা শোনেন। একজন লেখক শুধু ভূতের গল্প লেখেন। একদিন দুপুর বেলায়…
আপলা তোমার গল্পটা অন্যদিন শুনব। আজ আমার একটা কাজ আছে আমি উঠব।
এক মিনিট লাগবে। বসুন না।
প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। অন্য একদিন শুনব।
বসুন আপাকে ডাকি।
না থাক, ওকে ডাকতে হবে না।
আলম ভাই আপনাদের কী রাগারগি হয়েছে?
না না কিছুই হয়নি।
আলম ঘর থেকে বের হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টগর ঢুকাল। অপলা ব্যস্ত হয়ে পড়ল টগরকে নিয়ে।
এই টগর আজ কী হয়েছে বলত?
কী হয়েছে?
আমাদের ফাংশনে একজন বিখ্যাত লোক এসেছিলেন। সেই লোকটি লম্বা। চোখে কাল চশমা। বল তো লোকটি কে?
বাবা?
হুঁ। যা কাণ্ড হয়েছে না।
কী হয়েছে?
রানু বসার ঘরে ঢুকে দেখল টগর অপলার কোলে বসে আছে। মাকে ঢুকতে দেখে লাজুক ভঙ্গিতে হাসল।
কেমন ছিলে সাংবাদিন, টগর?
ভাল।
সারাদিন বাসাতেই ছিলে না। অন্য কোথাও গিয়েছিলে?
টগর সে কথার জবাব দিল না। মুখটিপে হাসল। যেন এটি একটি অপ্রয়োজনীয় কথা, এর জবাব দেবার দরকার নেই। বাবার কিছু কিছু স্বভাব সে পেয়ে যাচ্ছে। যে সব প্রশ্নের জবাব দেবার সে কোনো প্রয়োজন মনে করবে না সে সব প্রশ্নের সে জবাব দেবে না। রানু সব সময় ভাবত টগরের বাবা এটা অন্যদের ভাগিয়ে দেবার জন্যে করে থাকে। এখন মনে হয় না। এখন মনে হয়, এটা তার স্বভাব। রানু বলল,
টগর, দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেয়েছ?
টগর এই প্রশ্নটিরও জবাব দিল না। সম্ভবত এটাও তার কাছে একটি অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন। সে অপলার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কী যেন বলল। রানু শীতল স্বরে জিজ্ঞেস করল, কী বলছ টগর? টগর চুপ করে রইল। অপলা হাসি মুখে বলল, দুলাভাই আমাদের ফাংশনে কী বললেন তাই জানতে চাচ্ছে।
এটা ফিসফিস করে বলার দরকার কী?
হয়ত ভাবছে তুমি রেগে যাবে।
আমি রেগে যাব কেন?
না রাগলেও বিরক্ত হবে। তার কথা উঠলেই তুমি নীরব হও। হও না?
রানু লক্ষ্য করল অপলা কাটা কাটা জবাব দিচ্ছে। তার গলার স্বর তীক্ষু। যেন সে একটা ঝগড়া বাঁধাতে চায়। রাগিয়ে দিতে চায় রানুকে। টগর অপলার গলা জড়িয়ে ধরে কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে। রানু সহজ স্বরে বলল, যাও টগর, হাত-মুখ ধুয়ে আসা। আমি তোমাকে নিয়ে হাঁটতে যাব।
কোথায়?
রাস্তায় হাঁটব। শিশু পার্কের দিকেও যেতে পারি। যাবে?
টগর মাথা নাড়ল। সে যাবে কিন্তু তার মধ্যে তেমন কোনো উৎসাহ দেখা গেল না। যেন নেহায়েত মাকে খুশি করবার জন্যে রাজি হওয়া।
রাতে ঘুমুতে যাবার আগে রানু উঁকি দিলা অপলার ঘরে। সে গভীর মনযোগে খাতা খুলে দেখছে। রানুকে ঢুকতে দেখেই সে খাতা বন্ধ করে ফ্যাকাসে ভাবে হাসল। রানু লক্ষ্য করল অপলার মুখ লালচে হয়ে আছে।
তোর এখানে একটু বসি অপলা?
বস। আমার এখানে বসতে হলে আবার অনুমতি লাগবে নাকি?
অপলা নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসল। রানু বলল, তোর ঐ খাতায় তোর দুলাভাই কী অটোগ্রাফ দিয়েছে?
হুঁ।
দেখতে পারি?
অপলা খাতা বের করল। দুলাইনের একটি লেখা হায় সখী, এত স্বৰ্গপুরী নয়। পুষ্পোপ। কীট সম হেথা তৃষ্ণা জেগে রয়। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা দেখতে ভাল লাগে।
অপলা ভয়ে ভয়ে বলল, যারা অটোগ্রাফের জন্যে গিয়েছে দুলাভাই তাদের সবার খাতাতেই এ রকম সুন্দর সুন্দর লাইন লিখে দিয়েছেন।
জানি। এ রকম অসংখ্য লাইন তার মুখস্থ।
তুমি রাগ করনি তো আপা?
রাগ করব কেন?
অপলা মাথা নিচু করে বসে রইল। রানু বলল, কিন্তু তুই এমন ভাব করছিস যেন তোকে একটা প্রেমপত্র লিখে দিয়েছে। তুই এই লেখাটা কম করেও এক লক্ষ্য বার পড়েছিস; পড়িসনি।
তুমি শুধু শুধু রাগ করছ আপা।
না। রাগ করছি না। একজন লেখক তার ভক্ত পাঠিকাকে সুন্দর একটা কবিতার লাইন লিখে দিয়েছে এতে রাগ করার কিছু নেই। কিন্তু সেই পাঠিকা। যদি মনে করে এই লাইনটি তাল জন্যেই লেখা তাহলেই মুশকিল।
কী মুশকিল?
রানু বলল, তোকে একটা গল্প বলি শোেন–আমার বিয়ের পর পর একবার একটি মেয়ে তাকে চিঠি লিখল। বিবাহিতা মেয়ে। বিয়েতে ওর কিছু বই পেয়েছিল। সেই বই পড়ে আবেগে আপুত হয়ে লেখা চিঠি। ও চিঠির জবাব দিল। মেয়েটি আবার লিখল . . চমৎকার চিঠি। তারপর একদিন এল দেখা করতে। মেয়েটি দেখতে ভাল নয়। কালো বেঁটে অসম্ভব রোগা। তোর দুলাভাই ময়েটিকে দেখেই রেগে গেল। মুখ কালো করে বলল,–আমি এখন লিখছি, এখন কথা বলতে পারব না। অথচ এই মেয়েটিকে সে সুন্দর চিঠি লিখেছে, বই পাঠিয়েছে।
তারপর?
তারপর আবার কী। তোর দুলাভাই চলে গেল অন্য ঘরে। মেয়েটি ঘণ্টাখানিক বসে রইল আমি দু’একটা কথা-টথা বলতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে কথা বলতে আসেনি।
দুলাভাই আর কথা বললেন না?
না। তবে মেয়েটি যদি সুন্দরী হত সে তার সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাহিত্য নিয়ে আলাপ করত। আগ্রহ নিয়ে বলত জীবন কী, জীবনের মানে কী? মেয়েটি আবার ঘুরে ঘুরে আসত।
অপলা ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। রানু বলল, লোকটির মধ্যে কোনো কিছুর প্রতি কোনো মমতা নেই। মানুষের প্রতি যার মমতা নেই সে লেখক হতে পারে না। লেখকরা মানুষের কথা লেখেন। মমতা ছাড়া তাদের কথা লেখা যায় না।
কিন্তু তিনি তো লিখছেন।
ঐ সব ট্র্যাস। ডাস্টবিনে ফেলে দেবার জিনিস। যে কবিতার লাইন তোর খাতায় লিখেছে তার পেছনেও কোনো সত্য নেই। অন্যের ধার করা লাইন। তার গল্প উপন্যাসও সে রকম। তুই ঐ পাতাটি ছিঁড়ে ফেলে দে।
অপলা অবাক হয়ে বলল, কী বলছি তুমি?
ঠিকই বলছি, ছিঁড়ে ফেল।
না, ওটা আমি ছিঁড়ব না।
দে পাতাটা আমার কাছে।
অপলা খাতা দিল না। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। রানু খাতাটা হাতে নিয়ে মুহুর্তের মধ্যে ছিড়ি কুচি কুচি করে ফেলল।
আপা তুমি এ রকম করলে কেন?
ঠিকই করেছি।
না, তুমি ঠিক করনি। এটা আমার জিনিস। আমার জন্যে লেখা। এটা তুমি ছিড়তে পার না। তোমার নিজের যা আছে সে সব ছিঁড়ে ফেল। আমার গুলি কেন?
অপলা কেঁদে ফেলল। রানু বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বাইল আপলার দিকে। সে নিজেও নিজের আচরণে খুব অবাক হয়েছে। সে কেন এরকম করল? সমস্ত ব্যাপারটাই ঘটেছে আলমের জন্যে। আলম আজ না এলে এটা হত না। তার আসার কারণেই রানু, অস্থিরতায় ভুগছিল। খাতা ছিঁড়ে ফেলার পেছনে অন্য কোনো যুক্তি নেই। এমন ছেলেমানুষি একটি কাণ্ড রানু করতে পারে না।
অপলা, আই এ্যাম সরি। কিছু মনে করিস না।
আপলা টেবিলে মাথা রেখে কাঁদছে। রানু তার পিঠে হাত রাখল। হঠাৎ তার মনে হল অপলার মতো একটি মেয়ের সঙ্গে ওসমানের বিয়ে হলে বেশ হত। এই কথাটি তার কেন মনে হল
কে জানে।
ওসমান সাহেব বাথরুমে হাত-মুখ ধুচ্ছিলেন। কাল রাতে তার ভাল ঘুম হয়নি। চোখ লাল হয়ে আছে। মাথা ভার ভার। এই অবস্থাতেই তাকে বেরুতে হবে। আজ অনেকগুলি কথা বলবেন। কলেজে যাবেন। প্রিন্সিপ্যালকে বলবেন মাস্টারি। আর করব না। আমি অসুস্থ। মাস্টারিতে মন বসছে না। রানুর কাছে যাবেন। রানুকে বলবেন বেশ কিছু দিনের জন্য তিনি গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছেন। নবীর কাছে যেতে হবে। নবী। খবর পাঠিয়েছে খুব দরকার।
ওসমান সাহেব বাথরুম থেকে বেরিয়েই দেখলেন রানু এসেছে। সকাল সাতটায় হঠাৎ তার আসার কোনো কারণ নেই।
কী ব্যাপার রানু?
রানু সহজ স্বরে বলল, তুমি একটা কাগজে লিখে দাও–হায় সখা এত স্বৰ্গপুরি নয়। পুষ্পে কীট সম হেথা তৃষ্ণা জেগে রয়। তারপর নাম সই কর।
কেন?
দরকার আছে। এই নাও কাগজ।
ওসমান সাহেব লিখতে বসলেন।
লিখতে লিখতে বললেন, তুমি কেমন আছ রানু? রানু কিছু বলল না। ওসমান সাহেব বললেন, বাবার শরীর খারাপ হয়েছে। বেশ খারাপ।
তাতে তো তোমার কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। অন্যের অসুখ-বিসুখে তোমার কিছু যায় আসে না। তোমার উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা সুখে থাকলেই হল। ওরা সুখে আছে তো?
তিনি হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতেই বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন বাস। কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে আমার ভাল লাগে না। দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা ঝগড়ার আর বসার ভঙ্গিটা হচ্ছে সন্ধির।
বসলেই সন্ধি হয়ে যাবে তোমার সঙ্গে? কেন অদ্ভুত কথাবার্তা বলে আমাকে ভুলাতে চাইছ? আমি অপলা নই।
ওসমান সাহেব কাগজ এগিয়ে দিলেন। রানু দেখল। শুধু দু’টি লাইনই নয় বেশ ক’টি লাইন সেখানে লেখা। বিদায় অভিশাপ পুরো কবিতাটি তার মুখস্থ। বিয়ের রাতে কী মনে করে যেন সে কবিতাটি শুনিয়েছিল। হয় তো রানুকে অভিভূত করতে চেয়েছিল। রানু কী অভিভূত হয়েছিল। রানুর মনে পড়ল না।