আনিসের ঘুম যখন ভাঙল, তখন কোলাহল স্তিমিত হয়ে এসেছে। সে কতক্ষণ ঘুমিয়েছে, ঠিক বুঝতে পারছে না। জারী কি চলে গিয়েছে নাকি? উঠোনে সারি সারি আলো জ্বলছে।
গেটের বাতিগুলি জ্বলছে–নিভছে। তার বিছানার খানিকটা অংশ বারান্দার বাতিতে আলোকিত হয়ে রয়েছে।
আনিস ঘাড় উঁচু করে জানালা দিয়ে তাকাল। না, বরের গাড়ি এখনো যায় নি। জরী এখনো এই বাড়িতেই আছে! যাবার আগে দেখা করতে এখানে আসবে নিশ্চয়ই। আনিস তখন কী বলবে ভেবে পেল না। খুব গুছিয়ে কিছু একটা বলা উচিত, যাতে জরীর মনের সব গ্রানি কেটে যায়। কিন্তু আনিস কোনো কথাই গুছিয়ে বলতে পারে না।
জরীকে বিয়ের সাজে কেমন দেখাচ্ছে কে জানে? আনিস হয়তো দেখে চিনতেই পারবে না। জারী কি হুঁট করে তাকে সালাম করে বসবে নাকি? এই একটি বিশ্ৰী অভ্যেস আছে তার। ঈদের দিন কথা নেই, বার্তা নেই, সেজেগুজে এসে টুপ করে এক সালাম। কিছু বললে বলবে–সিনিওরিটির একটা ভ্যালু আছে না? তারপরই খিলখিল হাসি।
আনিস অন্ধকার ঘরে চুপচাপ শুয়ে রইল। ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজে। বরযাত্রীরা তৈরি হয়েছে বিদায় নিতে। সবাই জরীকে ধরাধরি করে উঠোনে নিয়ে এল। রাজ্যের লোক সেখানে এসে ভিড় করেছে। যাবার আগে সবাই একটু কথা বলবে। দুএকটি কী আচার-অনুষ্ঠানও আছে।
আনিস জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে আছে। বরের সাজান গাড়ি ব্যাক করে আরো পিছনে আনা হচ্ছে। গাড়িতে উঠতে যেন কনেকে হাঁটতে না হয়। উপর থেকে জরীর ঝলমলে লাল শাড়ির খানিকটা চোখে পড়ে। খুব আগ্রহ নিয়ে আনিস সেদিকে তাকিয়ে রইল। যাবার আগে জারী নিশ্চয়ই ঘাড় ফিরিয়ে তাকাবে।
আনিস, আনিস।
কে?
আমি টিংকুমণি। আমি এসেছি।
এস এস।
তোমার ব্যথা কমেছ?
কমেছে।
আচ্ছা।
সারা দিনের ক্লান্তিতে মেয়েটির মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। চুল এলোমেলো। আজ কেউ তার দিকে নজর দেবার সময় পায় নি। আনিস তাকে কাছে টেনে নিল। জানালার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ঐ দেখ টিংকু। জরী চলে যাচ্ছে।
টিংকু সে-কথায় কান দিল না। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমি ব্যথা পেয়েছি, হাত ভেঙে গেছে।
আহা আহা! একটু হাতি-হাতি খেলবে টিংকু?
না, আমার ঘুম পাচ্ছে।
ছোট ছোট হাতে আনিসের গলা জড়িয়ে ধরে টিংকু কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পডল।
ক্রমে ক্রমে রাত বাড়তে লাগল। বাড়ির আলোগুলি নিভে যেতে লাগল। বাগানের গোলাপ আর হাস্নুহেনা-ঝাড় থেকে ভেসে এল ফুলের সৌরভ। অনেক দূরে একটি নিশি-পাওয়া কুকুর কাঁদতে লাগল।
তারও অনেক পরে আকাশে একফালি চাঁদ উঠল। তার আলো এসে পড়ল নিদ্রিত শিশুটির মুখে। জ্যোৎস্নালোকিত একটি শিশুর কোমল মুখ, তার চারপাশে কী বিপুল অন্ধকার। গভীর বিষাদে আনিসের চোখে জল এল। যে-জীবন দোয়েলের, ফড়িংয়ের–মানুষের সাথে তার কোনো কালেই দেখা হয় না।
Nice