সত্যিই কি কোনও প্রেম করেছি আমি নাকি প্রেমের ধারণাট্ি বয়ে বেরিয়েছি কেবল? এই একটি অদ্ভুত প্রশ্ন আমি করতে শুরু করি নিজেকে। রুদ্রর সঙ্গে আমার যে সম্পর্কটি ছিল, তাকে কী কী কারণে প্রেম বলা যায় এবং কী কী কারণে বলা যায় না, তার একটি হিসেব কষে দেখি রুদ্রর জন্য আমার আকর্ষণ তীব্র ছিল বটে, রুদ্রর অনাচার আমাকে রুদ্র থেকে দীর্ঘদিন ফেরায়নি বটে, এর পেছনের কারণ প্রেম নয়, অন্যকিছু। অন্যকিছুতে আছে নিঃসঙ্গতা, আছে প্রেম করার আগ্রহ এবং প্রেমের ধারণা। প্রেম করলে সামাজিক যে আচরণটি মানুষ করে সেটি আমি জেনেছিলাম বলে আচরণটি আমি করে গেছি। আচরণটি শেখা। আচরণটি নিজস্ব নয়। রুদ্রর কিছু কবিতা আমি সাপ্তাহিক পত্রিকায় পড়েছিলাম, এইমাত্রই। এরপর একদিন রুদ্রর চিঠি পাই আমি, যখন সে আমার সম্পাদিক কবিতা পত্রিকা সেঁজুতির জন্য কবিতা পাঠায়। উত্তরে আমিও চিঠি লিখি। এভাবেই চিঠির যোগাযোগ। যাকে কোনওদিন দেখিনি, যার সম্পর্কে জানি না কিছু তার প্রেমে পড়ে গেলাম! দেখতে রুদ্র কোনও অর্থেই সুপুরুষ ছিল না, তাকে প্রথম দেখে আমার বিবমিষা ছাড়া আর কিছুর উদ্রেক হয়নি। রুদ্রর কবিতা আমার ভাল লাগত, এরকম তো কত কারও কবিতাই আমার ভাল লাগে। প্রেমে আসলে আমি পড়েছিলাম প্রেম ব্যপারটির।
কৈশোরে আমি আর চন্দনা প্রেমে পড়েছিলাম সিনেমার নায়ক জাফর ইকবালের। জাফর ইকবালের রূপ আমাদের আকর্ষণ করেছিল। আকর্ষণের জন্য কিছু না কিছু থাকতে হয়। রূপ নয় গুণ। কিন্তু সেটিও সত্যিকার প্রেম নয়। কিশোর বয়সে এমন হয়ই। জাফর ইকবালের সঙ্গে চিঠিতে বন্ধুত্ব হয়েছিল আমাদের। জাফর এমনকী চন্দনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল। জাফরের সঙ্গে কোনও একদিন সত্যিকার দেখা হবে, এরকম একটি স্বপ্ন ছিল আমার। স্বপ্নটি আমি লালন করেছি দীর্ঘকাল। ঢাকায় জাফর ইকবালের পাঁচ নয়াপল্টনের বাড়ির সামনে দিয়েই ছোটদার বাড়িতে গিয়েছি, কোনওদিন ঢুকিনি তার বাড়িতে। হবে একদিন দেখা, কোথাও একদিন দেখা হবে। নাহ, দেখা হয়নি। দেখা হবেও না কোনওদিন। দেশের সবচেয়ে সুদর্শন নায়কটি অল্প বয়সে হঠাৎ একদিন ভোরবেলা মরে গেল। কোনও অসুখ নেই, বিসুখ নেই। সুস্থ সবল একটি মানুষ মরে গেল! কী অবিশ্বাস্য গা অবশ করা খবর! সোনিয়া নামের এক মেয়েকে জাফর বিয়ে করেছিল, সোনিয়ার সঙ্গে তার মনের মিল হয়নি, সোনিয়া চলে গিয়েছিল জাফরকে ছেড়ে, সে কারণেই কি না জানি না বিরহে একাকীত্বে অতিরিক্ত মদ্যপানে নিজের মৃত্যু ঘটিয়েছে সে।
যখন থেকে হিন্দি ছবি দেখতে শুরু করি, অমিতাভ বচ্চনের জন্য কি রকম পাগল পাগল লাগত। আবার অমিতাভ যখন রেখার সঙ্গে প্রেম করত, তা দেখতেও ভাল লাগত। রেখার সঙ্গে মানাত খুব অমিতাভকে। নিজে মনে মনে রেখা হয়ে অমিতাভের প্রেম গ্রহণ করতাম। কিন্তু রেখা তো আমি নই। আমি আমিই। আমাকে ভালবাসার জন্য কোনও সুদর্শন যুবক কোথাও অপেক্ষা করে নেই। আমিই কেবল বসে বসে সুদর্শন সুপুরুষের অপেক্ষা করি। কৈশোর কাটলে আফজাল হোসেনের সঙ্গে আমার খুব প্রেম করতে ইচ্ছে হত। সত্যি বলতে কী, এই ইচ্ছেটি আমার কোনওদিনই চলে যায়নি। আফজাল অতি সুদর্শন ছেলে। নাটকের ছেলে। টেলিভিশন আর মঞ্চের জনপ্রিয় অভিনেতা আফজাল। নিজে নাটক লেখে। চমৎকার সব প্রেমের গল্প। নতুন উপন্যাসও লিখছে। প্রকাশক বিদ্যাপ্রকাশ। খোকাই তাগাদা দিয়ে দিয়ে আফজালকে লেখাচ্ছেন। আফজালকে আমি প্রথম দেখি দশ আগে ফেব্রুয়ারির বইমেলায়। এত লম্বা যে কোনও কেনা প্যাণ্ট তার আঁটে না, গোঁড়ালির ওপর প্যান্ট উঠে আছে, সেটি পরেই সে ঘুরে বেড়াচ্ছে মেলায়। রুদ্রর সঙ্গে পরিচয় ছিল আফজালের। আফজালকে ডেকে রুদ্র কথা বলল। এরপর আরও দুএকদিন এখানে সেখানে টুকরো টুকরো দেখা হয়েছে। নাটকের মেয়ে সুবর্ণার সঙ্গে আফজালের প্রেম ছিল। কিন্তু সে প্রেম একসময় ভেঙে যায়। আফজাল একা হয়ে গেল। মাত্রা নামে নয়াপল্টনে, ঠিক ছোটদার বাড়ির পেছনে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা খুলে বসল। ছোটদার বাড়িতে যেতে আসতে দেখি মাত্রার আপিস। রুদ্রর সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকাকালীন আফজাল-মোহটি সংস্কার-চাপা ছিল। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর কতবার যে মাত্রা ছাড়া আবেগ উথলে উঠে আমাকে মাত্রায় ঢোকাতে চেয়েছে, ঢুকিয়ে বলাতে চেয়েছে ভালবাসার কথা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সৌন্দর্যের পাশে মনে মনে আফজালকে দাঁড় করিয়ে দেখেছি চমৎকার মানাচ্ছে। তারপরও মাত্রায় আমার ঢোকা হয়নি, বলা হয়নি কিছু। আবেগের লাগাম টেনে ধরেছি প্রতিবারই। অনেক বছর আগে, ময়মনসিংহের দুই কবি শফিকুল ইসলাম সেলিম আর আতাউল করিম সফিক আফজাল হোসেন আর ইমদাদুল হক মিলনকে ময়মনসিংহে নিয়ে ছিল অনুষ্ঠান করতে। মহাকালি ইশকুলে অনুষ্ঠান। সেলিম আর সফিকের অনুরোধে সেই অনুষ্ঠানে আমার গল্প পড়তে যেতে হল। তখন আমি কয়েকটি গল্প লিখেছি সংবাদ পত্রিকার মেয়েদের পাতায়। মাধবীর জীবন কথা গল্পটি সাধু ভাষায় লেখা। এটি আমার গল্পগুলোর মধ্যে আমার বিচারে সবচেয়ে ভাল। অনেকের গল্প পড়ার পর একেবারে শেষে অতিথিদের গল্প পড়ার আগে ছিল আমার গল্প পড়া। কিন্তু পড়তে উঠে বিচ্ছিরি কাণ্ড শুরু হল। দর্শকরা হৈ হৈ করতে শুরু করল। কেউ আমার গল্প পড়া শুনতে চায় না। হৈ হৈ এর মধ্যে গল্পের সামান্য অংশ পড়ে আমাকে মঞ্চ থেকে নেমে পড়তে হয়েছে। বাধ্য হয়েছি নেমে পড়তে। আমার জানা হয়নি হৈ হৈ কি আমাকে অপছন্দ করার কারণে নাকি অতিথিদের গল্প শোনার জন্য অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিল শ্রোতারা, সে কারণে। যে কারণেই হোক আমার আর সে রাতে আফজাল বা মিলন কারও সঙ্গে কথা বলার মুখ ছিল না! ওই হৈ হৈ ঘটনার কথা মনে পড়লেই মাত্রায় নেমে আফজালকে ভালবাসার কথাটি বলার যে কল্পনাটি হঠাৎ হঠাৎ করি, সেটিকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিই। আফজালের মাত্রায় আমি গিয়েছি ঠিকই একদিন, তবে আফজালের জন্য নয়, মিলনের জন্য। তখন আমি আর মিলন ভারতে বেড়াতে যাবো। মিলনের বিকেল কাটত মাত্রায় আড্ডা দিয়ে। মিলন বলেছিল তার সঙ্গে মাত্রায় দেখা করতে। মাত্রায় মিলন নেই এ কথাটি আফজাল আমাকে জানিয়ে দিলেই পারত। কিন্তু আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে দরজা থেকে নিয়ে গেল তার ঘরে। বসালো। চা খাওয়ালো। অনেকক্ষণ বিজ্ঞাপন নিয়ে নাটক উপন্যাস নিয়ে কথা বলল। একটি মোটা ইংরেজি উপন্যাস আমাকে উপহার দিল। যাবার সময় দরজা পর্যন্ত এল বিদায় দিতে। আবার যেতে বলল। এমন আদর আমার প্রত্যাশিত ছিল না। সেদিন সারাদিন তিরতির করা একটি সুখ আমার হৃদয়ের শীতল য়চ্ছ জলে সাঁতার কেটে বেড়ালো। আফজালের সঙ্গে আমার শেষ দেখাটি এই সেদিন, খোকার বাড়িতে। খোকা আমাকে নেমন্তন্ন করলেন তাঁর বাড়িতে। সন্ধেবেলায় হঠাৎ ফোন তাঁর, এক্ষুনি চলে আসেন। কেন? রাতে খাবেন, আমার বউ রান্না করেছে। তখনই যে শাড়ি সামনে ছিল সেটি পরে সোজা চলে যাই খোকার বাড়িতে রিক্সা নিয়ে। খানিকটা আলু থালু, খানিকটা ঘরোয়া বেশে খোকার বাড়িতে ঢুকি। ভেবেছিলাম আমাকেই কেবল খেতে বলেছেন খোকা। কিন্তু ঘরে ঢুকে চমকে উঠি। দেখি আফজাল বসে আছে, সঙ্গে তার স্ত্রী। নতুন বিয়ে করেছে, বউকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। বিয়ে করেছে বলে, বউ আছে বলে সঙ্গে আফজাল-মোহ আমার দূর হয়নি মোটেও। কিন্তু সমস্ত আবেগ আমি কিছু একটার তলে চাপা দিয়ে রাখি। প্রকাশক তাঁর দুই লেখককে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। লেখক আফজালের সঙ্গে লেখক তসলিমার যে রকম সৌজন্য কথাবার্তা হওয়া মানায় সেরকমই কথা হয়েছে। তখন আমি আর সেই হৈ হৈ করা দর্শক শ্রোতার সামনে গল্প পাঠ না করতে পেরে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে বাধ্য হওয়া তসলিমা নই, দেশের জনপ্রিয় লেখক, আনন্দ পুরস্কার পাওয়া তসলিমা। তবে কোনও অহংকার আমার চিবুক উঁচু করায়নি। যে মানুষের জন্য গোপনে গোপনে তৃষ্ণা থাকে, তার সামনে এলে সব অহংকার কাঁচের বাসনের মত ভেঙে পড়ে।
স্বপ্নের পুরুষ স্বপ্নেই থেকে যাওয়াটা হয়ত ভাল। নিত্যদিনের সংসারযাপনে স্বপ্নকে এনে ধুলো না লাগানোই হয়ত ভাল। স্বপ্ন চিরকাল নাগালের বাইরে থাক, পরিচ্ছত থাক, ঝকঝকে সুন্দর থাক। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাক স্বপ্ন। জীবন ভর স্বপ্নের ঘুড়ি ওড়াবো আকাশে, কোনওদিন ভোঁ কাট্টা না হোক সেই ঘুড়ি। আনন্দ থাক স্বপ্ন নিয়ে। এই ভেবে ভেবে স্বপ্নকে দূরে রেখেছি নিজের দুঃখ শোক থেকে, নিজের কালি কালিমা থেকে। নিজেকে বরং ধুলো কাদায় মাখিয়েছি। শরীরের প্রয়োজনে শরীর বিনিময় হয়েছে কিছু পুরুষের সঙ্গে। প্রথম শরীরী সুখ আবিস্কারের উত্তেজনা ছিল রুদ্রর সঙ্গে। রুদ্র যখন জীবনে নেই, তখন এক এক করে মিলন, নাইম, মিনারের সঙ্গে হল শরীরের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা। এ খেলায় আমার সুখ হলেও তাদের সুখই ছিল প্রধান। কলকাতায় জালালের সঙ্গেও তিনটে রাত কেটেছে বিচিত্র সম্ভোগে। এক সন্ধেবেলায় এসে জীবনের গল্প বলেছিল সে। সারারাত তার গল্প শুনেছি, কী করে তার প্রেম হয়েছিল, বিয়ে হয়েছিল, কী করে সেই বিয়ে ভেঙেছে, কি করে একাকীত্ব তাকে নাশ করে দিচ্ছে। মদ্যপান করতে করতে কথা বলছিল সে, ভোর হবার আগে আগে মদ্য পান শেষ হলে হঠাৎ আমাকেই আমূল পান করতে শুরু করে। আমি না বলি না। না বলি না এই কারণে যে, আমি না বলতে পারি না তা নয়, না বলার কোনও প্রয়োজন মনে করি না, তাই না বলি না। জালাল আমার প্রেমে পড়েনি, সে তখন প্রেম করছিল চিত্রা লাহিড়ী নামের এক উঠতি কবির সঙ্গে। শরীর তো হল, কিন্তু শরীরই তো শেষ কথা নয়। বাঁশির সঙ্গে প্রেম না হলে বাঁশি দীর্ঘদিন বাজে না। আমার আনন্দ পুরস্কার পাওয়ার খবরে জালাল খুশি হয়েছিল, কিন্তু খুশিটি কি তেমন খুশি ছিল! একটি চিকন ঈর্ষা দেখেছি তার চোখের তারায়। পুরস্কার অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে বলেছিল, আমি নাকি যৌন শব্দটি খুব বেশি ব্যবহার করেছি। অবশ্য বলেছে এটি তার নিজের মন্তব্য নয়, অনুষ্ঠানে তার পাশের চেয়ারে বসা একটি লোকের মন্তব্য। কিন্তু কেন জালাল এটি শোনাতে গেল আমাকে! তার নিজেরও হয়ত তাই মনে হয়েছে। জালাল যৌনতাকে গোপনে রাতের জন্য রেখে দিতে চায়, যৌনতার উদ্দেশ্য নিয়ে কোনও মেয়ের একলা ঘরে গিয়ে নিজের করুণ গল্প শুনিয়ে মেয়েকে কাতর করে মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে নিজের যৌনক্ষুধা মেটাতে চায়, কিন্তু দিনের আলো ফুটলে জনসমক্ষে যৌনতার কোনও প্রসঙ্গ সে প্রসঙ্গ শ্লীল হলেও জিভে আনা তার কাছে অশ্লীলতা। মুসলমান ঘটিদের মুসলমানের শহর ঢাকায় বেড়ানোর খুব শখ। জালাল ঢাকায় বেড়াতে এসে আমার বাড়িতে উঠেছে। অবশ্য আমি কোনও সঙ্গ দিতে পারিনি, নিজেই সে ঘুরে বেড়িয়েছে একা, চেনা পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করেছে। জালালের কোনও গল্প আমাকে আর কাতর করেনি। আসলে আমার সময়ই ছিল না তার গল্প শোনার। বাড়িতে সে স্নান করছে, খাচ্ছে, বেরিয়ে যাচ্ছে, ফিরে আসছে। আতিথেয়তার কোনও ত্রুটি হয়নি। ত্রুটি হয়ত ছিল না, কিন্তু শীতলতা ছিল। জালাল যদি ভেবে থাকে যে আমার শরীরটি সে হাত বাড়ালেই পাবে, তবে তার ভাবনার ঘাড়ে একটি হাতুড়ির আঘাত পড়েছে এই যা। রাতে আমি আমার ঘরের দরজা ভাল করে সেঁটে ঘুমিয়েছি। জালাল মিলনের ঘরে গিয়ে কখন ঘুমিয়েছে, কখন উঠেছে তার কোনও খবর রাখা আমার হয়ে ওঠেনি। আমার তো ভোরবেলা হাসপাতালে চলে যেতে হয়। আমার তো গোটা দিন বা রাতের অবসর নেই যে সময় দেব! কলকাতা আর ঢাকা এক নয়। কলকাতায় আমি ছুটি কাটাই। ঢাকায় আমার আকণ্ঠ ব্যস্ততা। শরীরে পুরুষের স্পর্শ না থাকলেই শরীর যে কোনও পুরুষের জন্য জেগে ওঠে না। এ শরীরের অভ্যেস আছে পুরুষস্পর্শহীন দীর্ঘবছর কাটিয়ে দেওয়ার। তাছাড়া খানিকটা হলেও মন চাই। অতি রাতে অতি আবেগে কিছু অতিউর্বর শুক্রাণুর আক্রমণে ঋতুস্রাব বন্ধ করে বসে থাকব, আর নাইম এসে নিজের কীর্তি ভেবে গর্ভপাতে সাহায্য করবে, এতে নাইমের ওপর শোধ নেওয়া হয়ত হয়, আমার শরীরে বা মনে কোনও সুখ হয় না। জালাল বলে আমি নাকি খুব পাল্টো গেছি। পাল্টো হয়ত কিছুটা গেছিই, পাল্টাবো না কেন, মন তখন আমার কায়সারে।
আমার যদিও বিশ্বাস ছিল, পুরুষের সঙ্গে প্রেম এ জীবনে আমি আর করছি না অথবা কোনও পুরুষের সঙ্গে নিজের এই জীবনটি আমি আর জড়াচ্ছি না, কিন্তু খানিকটা জড়িয়ে পড়ি আমি, অনেকটা ইচ্ছে করেই পড়ি। ভেবেছিলাম নিজের সংসার নিয়ে, ডাক্তারি নিয়ে,সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে চমৎকার বাকি জীবন কাটিয়ে দেব, পুরুষের কোনও প্রয়োজন আমার জীবনে নেই। কিন্তু একদিন ঠিকই আশ্চর্য সুন্দর এক যুবককে দেখে চোখ ফেরাতে পারি না। বার বার চোখ যায় যুবকের দৈর্ঘে প্রস্থে, ডাগর দুটো চোখে, খাড়া নাকে, যুবকের গোলাপি ঠোঁটে, মিষ্টি হাসিতে। যে তৃষ্ণাতুর চোখে পুরুষেরা দেখে কোনও রূপবতী রমণীকে, সে চোখে আমি কায়সারের রূপ দেখি। সুদর্শন যুবকের জন্য আকাঙ্খা আমার সারা জীবনের। জীবনে সাধ মেটেনি। সাধ না মেটা হৃদয়টি কায়সারকে কামনা করে। অবশ্য মনে মনে। কিন্তু মনের কথাটি খুব বেশিদিন মনের মধ্যে বসে থাকেনি। শেরাটনের স্ক্রু ড্রাইভার এক রাতে হাট করে খুলে দিল বন্ধ অর্গল। কায়সার কোনও ডাক্তার নয়, লেখক নয়। কায়সার আমার কোনও বই পড়েনি। কলকাতার আজকাল পত্রিকার সাংবাদিক বাহারউদ্দিন আমার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন তাঁর জয়দেবপুরের বন্ধু কায়সারকে নিয়ে। তখনই কায়সারকে আমি প্রথম দেখি। বাহারউদ্দিন কলকাতা ফিরে যান, কিন্তু কায়সার ফিরে ফিরে আসে আমার বাড়িতে। কায়সারের জগত আর আমার জগতে কোনও মিল নেই। এক জগতের মানুষের সঙ্গে তো অনেক হয়েছে, এবার অন্য জগতে ঢুকে দেখি না কেন, কেমন সে জগতের চেহারা! টেলিফোনের জন্য আবেদন করে রেখেছি বছর আগে, এখনও টেলিফোন পাওয়ার খবর নেই। কায়সার আগ বাড়িয়ে বলে, সে চেষ্টা করবে টেলিফোন পেতে, তবে আমাকে যেতে হবে টেলিফোন মন্ত্রীর বাড়ি। আমাকে সে টেলিফোন মন্ত্রীর বাড়িতে নিয়ে যায় একদিন। বাড়ি যাওয়া মানে চা বিস্কুট খাওয়া আর মন্ত্রী যা বলবে, মন দিয়ে শোনা আর হেসে বিদেয় নেওয়া। কায়সারের অনুরোধে মন্ত্রী আমার টেলিফোনের আবেদনে নজর দেন। সে কারণেই আমার টেলিফোন পাওয়া হল। তা না হলে টেলিফোনের দেখা কখনও মিলত কী না সন্দেহ। ময়মনসিংহের বাড়িতে আমি নিজে টেলিফোন নিয়েছিলাম, আমাকে কোনও মন্ত্রীর বাড়ি দৌড়োতে হয়নি, আবেদন করেছি, মিলেছে। কিন্তু ঢাকা যেহেতু ময়মনসিংহ নয়, তাই শুধূ আবেদনে চিড়ে ভেজে না। আজকাল দুর্নীতি এমনই বেড়েছে দেশটিতে যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঘুষ না দিয়ে কোনও আবেদনের কাগজ এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে সরানো যায় না। ওপরতলায় খাতির থাকলেই কাগজের পা গজায়। কায়সারের কল্যাণে বাড়িতে টেলিফোন আসায় তার কদর বেড়ে যায় আমার বাড়িতে। এরশাদ আমলে কায়সার ছিল গাজিপুর উপজেলার চেয়ারম্যান। এ নিয়ে তার অহংকারের শেষ নেই। কায়সারের জগত সম্পর্কে যখন আরও জানা হয় আমার, দেখি সেই জগতটি ক্ষমতার রাজনীতির আর দুর্বোধ্য ব্যবসা বাণিজ্যের। কায়সার কোনও বড় রুই কাতলা নয়, নিতান্তই পুঁটি মাছ এই ঘোলা পুকুরে। রুই কাতলা হওয়ার শখ তার খুব। কায়সার যখন বীরদর্পে তার সম্পর্কে যেন উচ্চ ধারণা লালন করি, বলতে থাকে যে তার সঙ্গে এই মন্ত্রীর চেনা আছে, ওই মন্ত্রী তার বন্ধু, এই নেতা তার আত্মীয়, ওই নেতা তাকে মান্য করে, শুনতে বড় জঘন্য লাগে। আমি বুঝি যে কায়সারের জীবন আর আমার জীবন সম্পূর্ণই আলাদা। তার ওপর কায়সার বিবাহিত, ঘরে দুটো মেয়ে আছে। একজনের নাম অনন্যা আরেকজনের নাম সুখ। সুখ নামটি, কী অদ্ভুত, আমি ভেবেছিলাম নিজের যদি কখনও মেয়ে হয়, রাখব। কায়সারের বউ হেনু, বেটে, ধবধবে ফর্সা গোলগাল মেয়েমানুষ। হেনুর সঙ্গে একবারই মাত্র আমার দেখা হয়েছে। তাও নির্মলেন্দু গুণের কারণে। গাড়িতে হেনুকে রেখে কায়সার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। গুণ তখন আমার বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে গাড়িটি দেখেন। ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে বসা গাড়িতে, কায়সারের বউ নাকি!’ কায়সারের মুখ মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে। এরপর আমিই কায়সার আর গুণকে নিয়ে নিচে যাই বউটিকে দেখতে। হেনুর কথা কায়সার পারতপক্ষে আমার কাছে বলে না, আমি জানতে চাইলে দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টো ফেলে। হেনুকে নিয়ে এমন কী নিজের দুটো মেয়ে নিয়েও তার অস্বস্তির শেষ নেই। যদি প্রমাণ করতে পারত যে বাড়িতে তার কেবল মা আছে, ভাই আছে, কোনও বউ বাচ্চা নেই, তাহলে যেন সে আরাম পেত। কিন্তু কায়সারের বউ বাচ্চা নিয়ে আমার কোনও অস্বস্তি হয় না যখন সে মুগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকায় বা আমার একটি হাত সে ছুঁতে চায় নিঃশব্দে। আমি আমার হাতটিকে দূরে সরিয়ে রাখি না। যখন ঠোঁট বাড়ায় ঠোঁটের দিকে, খুব সহজেই আমার ঠোঁট কায়সারের ঠোঁটের নাগালে চলে আসে। এটি যত না কায়সারের প্রয়োজনে, তার চেয়ে বেশি আমার নিজের প্রয়োজনে। কায়সার চুপসে থাকে প্রথম দিন, আমার উথলিত উষ্ণ শরীরটির ওপর তার আশঙ্কার আঙুল কাঁপে। ধীরে ধীরে তার সংকোচের বরফ গলে যায় আমার উষ্ণতায়। আমার ছিল শরীরের প্রয়োজন, তার ছিল মনের। কায়সারের শরীর আমাকে দেয় আনন্দ, আমার দ্যূতি তাকে দেয় তৃপ্তি। কায়সারের সঙ্গে আমার কোনও বাঁধন গড়ে ওঠে না। মুক্ত একটি সম্পর্ক আমাদের। যে সম্পর্কে কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কারও নাক গলানো নেই। সম্পর্কটি নিরেট প্রয়োজনের জন্য, অথবা ঠিক তার জন্যও নয়। সম্পর্কটি কিছুর জন্যই নয়, যদি কিছুর জন্য হয়ও, ঠিক কিসের জন্য তা নিয়ে কেউই আমরা প্রশ্ন করি না, সম্পর্কটি টিকে থাকে, সম্পর্কটিতে কোনও ক্ষতি নেই বলে সম্পর্কটি টিকে থাকে। কায়সার এমন যে তাকে না হলেও চলে, আবার তাকে না হলেও চলে না। পর পর চারদিন এল কায়সার, এরপর পাঁচ দিনের না এলে মনে হয় কী যেন কি হয়নি আজ। এ বাড়িতে সে অনেকটা অভ্যেসের মত। দু সপ্তাহ আসেনি, দুসপ্তাহ পর হঠাৎ তার উপস্থিতি খানিকটা চমক আনে।
‘কী কায়সার ভাই। আপনে ত লাপাত্তা হইয়া গেছেন। এই বাড়ির রাস্তা ভুইলা গেছেন নাকি! খিরাজ টিরাজ আজকাল কেমন জুটতাছে কন!’
‘দূর মিলন, বাজে কথা বলবা না ত!’
কায়সার গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে।
কায়সারের চেয়ারম্যানি এখন নেই আর। জয়দেবপুর থেকে প্রতিদিন ঢাকা এসে মতিঝিলের বিভিন্ন আপিসে ঢুঁ মারে। আমি অনুমান করতে পারি না তার জীবিকার উৎস। বলে তার ব্যবসা আছে, পার্টনার আছে, পার্টনারদের সঙ্গে ব্যবসার কথাবার্তা বলতে সে ঢাকা আসে। কায়সারের জীবিকা নিয়ে যখন প্রশ্ন জাগে, মিলন বলে, ‘আরে বুবু, বুঝেন না কেন, কায়সার ভাই খিরাজ খায়।’
‘খিরাজ!’
‘হ খিরাজ খায়।’
খিরাজ শব্দটি আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। খিরাজ মানে কি জিজ্ঞেস করলে মিলন বলে ‘এই আর কি! তোমার ইন্ডাস্ট্রি আমার এলাকায় আছে, তা আমারে কিছু টাকা পয়সা দেও, আমি তোমার ইন্ডাস্ট্রি সামলানোর চেষ্টা করব, কোনও বদলোক তোমার ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি করতে পারবে না। চেয়ারম্যান থাকাকালীন কাউরে বোধহয় ব্যবসায় হেল্প করছিল ক্ষমতা খাডাইয়া, তাদের কাছ থেকে এহন আদায় করে।’
কায়সার এলে জিজ্ঞেস করি, ‘কিরে তুই নাকি খিরাজ খাস?’ খুব অল্পদিনেই সম্বোধন তুইএ চলে এসেছে। আপনি থেকে তুমির সিঁড়িতে পা না দিয়েই লম্ফ দিয়ে তুই এ।
কায়সার মুচকি হাসে। খিরাজ শব্দটি তাকেও হাসায়। এই যে আমি ভাবছি তাকে নিয়ে, তার খিরাজ নিয়ে হলেও তাকে নিয়েই তো ভাবছি, এটুকুই তাকে আনন্দ দেয়। কায়সারের মুচকি হাসিটি সহজে সরতে চায় না।
আমাদের সম্পর্কটি কোনও অর্থেই প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক নয়, যদিও কায়সার মনে প্রাণে তাই কামনা করে, কিন্তু কায়সারকে প্রেমিক ভাবা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। কায়সার বন্ধুর মত। ঘরের লোকের মত। কুলসুম নেই বাড়িতে, ঘর মোছা হচ্ছে না কদিন, কায়সারই জামা জুতো খুলে নেমে পড়ে ঘর মুছতে। প্রতিটি আদেশ অনুরোধ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কায়সার বোঝে যে তার প্রেমে আমি পড়িনি। আমার প্রেমিক হওয়ার জন্য সে মরিয়া হয়ে ওঠে। আমি তাকে সুন্দর বললে সে এমনি আহ্লাদে আটখানা হয় যে সারা মুখ ঝিলমিল করে, মাত্র ছমাস বা বছর খানিক আগে, গর্বিত গ্রীবা নেড়ে বলে, যে, সে আরও সুন্দর ছিল। কায়সারকে দুবছর বয়সী শিশুর মত মনে হয় আমার মাঝে মাঝে। কেবল যে শিশুসুলভ আচরণই সে করে তা নয়। হিংসুটে প্রেমিকের মতও তার আচরণ। আমার বাড়িতে যে লোকই আসে, তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। সন্দেহ, কারও সঙ্গে বুঝি গোপনে গোপনে আমার প্রেম হচ্ছে। কায়সারের সন্দেহ দেখে হাসি পায় আবার রাগও ধরে। তার হীনমন্যতার আমি পরোয়া করি না। তাকে পাত্তা দিলেই সে খুশিতে নাচে। পাত্তা না পেলে পাগল হয়ে ওঠে, এই বুঝি তাকে আমি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি! না, কায়সারকে ছুঁড়ে ফেলার আদপেই কোনও ইচ্ছে আমার নেই। তবে আমাকে সে কোনও কারণে বিরক্ত করুক তা আমি চাই না। বিরক্ত আমি নিজেকে হতে দিই না। যখনই সে তার কুটকচালের মুখ খোলে, সোজা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিই। আমার জীবনে কোনও হর্তাকর্তা রাখতে আমি রাজি নই। ‘খসরু কে? কেন আসে? কী চায়? আলমগীর লোকটিকে কেন আমি ঢুকতে দিচ্ছি বাড়িতে? রশীদের সঙ্গে কি সম্পর্ক!’ এসব প্রশ্ন করতে গিয়ে সে দেখেছে যে আমি কিছুতেই তার ঘোঁট পাকানো ঘোঁৎ ঘোঁৎ সহ্য করি না। ঔদ্ধত্য আর যেখানেই সে দেখাক, আমার কাছে নয। আমার বাড়িতে কে আসবে না আসবে, আমার জীবন কি করে কি ভাবে চলবে সে আমি বুঝব।
কায়সার নিজের ধনদৌলতের গল্প প্রায়ই করে। তার অঢেল সম্পদ। অঢেল টাকা পয়সা। ঢাকায় বাড়ি বানাচ্ছে সে। নতুন একটি গাড়ি কিনছে। একদিন মিলন, ইয়াসমিন আর আমি কায়সারের বাড়িতে বেড়াতে যাবার জন্য তৈরি হলাম। মহা উৎসাহে যাত্রা শুরু হল। বাড়িতে কায়সারের মা আর অন্য আত্মীয়রা ছিল, কিন্তু হেনু ছিল না, সে কারণেই সম্ভবত সে আমাদের নিয়ে গেছে তার বাড়িতে। জয়দেবপুরে ছোট একটি দোতলা বাড়ি কায়সারের। তার নিজের বাড়ি নয়, তার বাপের বাড়ি। বাড়িটিতে ধন দৌলতের কোনও চিহ্ন দেখা যায়নি। আমাদের নিয়ে কায়সারের কোথায় বসাই কী খাওয়াইএর ব্যস্ততা থাকার পরও মিলনের মন ভরেনি, হতাশ হয়ে বলে, ‘কী বুবু, এত না গপ্প করছিল কায়সার ভাই। ভাবছিলাম সাতমহলা বাড়ি বোধহয় তার। অহন ত দেহি ছাল উডা বাড়ি। ভাঙ্গা চেয়ার টেবিল। তার ওই গাড়িডাই আছে বেডাগিরি দেহানোর লাইগ্যা। গাড়িডা বোধহয় কিনছে খিরাজের পইসা দিয়া।’ নিজেকে ধনকুবের প্রমাণ করতে চেয়ে কায়সার যতই চেষ্টা করে সম্মান পেতে, তত সে আমাদের কাছে সম্মান হারায়। দিন দিন সে একটি হাস্যকর বস্তুতে পরিণত হয়। তার কথা, তার অঙ্গভঙ্গি সবই আমাদের বিকেলের চায়ের সঙ্গে ভাজা মুড়ির মত আনন্দ দেয়। যেন আমরা সার্কাসের জোকার দেখছি, সারাক্ষণই। তবে আমি যখন কায়সারকে নিয়ে আমার শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করি, তখন তাকে আমি ভালবাসি। আমাকে সে আনন্দ দেয়। গভীর গোপন আনন্দ। পুরুষকে সুখ দেবার জন্য তাদের শরীরের তলে একটি বস্তু বা মাংসপিণ্ড হিসেবে আমি আর ব্যবহৃত হতে দিই না নিজেকে। আমার অঙ্গে কোনও জোয়ার এসেছে কি না তার খবর কোনও পুরুষই আগে নেয়নি, না নিয়েই ঝাঁপ দিয়েছে স্নান করতে। কায়সারও সে খবর নিত না, যেহেতু পুরুষের অভ্যেস নেই নেওয়ার। কিন্তু তাকে আমি বলি খবর নিতে, চাঁদ হয়ে আমাকে জোয়ার দিতে। বলি আমাকে জাগাতে, বাজাতে। শরীরের প্রতি রোমকূপ স্পর্শ করে করে শরীরকে ভালবাসতে বলি। মগ্ন হতে বলি। কায়সার হয়। আমাকে সে আনন্দ দিয়ে আনন্দ পায়। ধীরে ধীরে এমন হয় যে আমার আনন্দই প্রধান হয়ে ওঠে। আমার সুখের জন্যই সব আয়োজন। কায়সারকে আমিই ভোগ করি। আমার যখন ইচ্ছে তখন। যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে। আমার যে তাকে প্রয়োজন, এই ব্যপারটিই তাকে অহংকারী করে তোলে। কায়সার আমাকে আরও নানাভাবে আনন্দ দিতে চায়। আমাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যায়। আমার জন্য হঠাৎ হঠাৎ কিছু উপহার নিয়ে আসে। আমাকে খুশি করার জন্য সে প্রাণ ঢেলে দেয়। সাধ্য তো আছেই, সাধ্যের বাইরেও অনেক কিছু করতে সে প্রস্তুত হয়। যখন আমাকে মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ বদলি করে দেওয়া হল জামালপুরে, তখন কায়সারের গাড়িতে জামালপুর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। মহানন্দে সে রওনা হয় আমাকে নিয়ে। জামালপুরের সিভিল সার্জন আপিসে গিয়ে চাকরিতে যোগদান করে ছুটি নিয়ে চলে আসব পরদিন, এই কথা। জামালপুরের যাত্রাটি চমৎকার যাত্রা। পথে ময়মনসিংহে থেমেছি, অবকাশে রাত কাটিয়ে পরদিন আবার জামালপুরের দিকে রওনা হয়েছি। ঢাকার ব্যস্ততা ছেড়ে দূরে কোথাও আমার এমন বেরিয়ে পড়া হয় না অনেকদিন। কায়সার গাড়ি চালাতে চালাতে আমাকে তার জীবনের অনেক কথা বলে। তার শৈশব কৈশোরের কথা। তার বাল্যকালের সঙ্গীদের কথা, খেলাধুলার কথা। শেশবগুলো আমাদের এত মেলে যে কায়সার আমার চেয়ে বছর দশেকের বড় হলেও তাকে আমার সমবয়সী বলে মনে হয়। তাকে দেখতেও বয়স কম লাগে, চপলতা তার বয়স কমিয়ে রাখে। ইট পাথরের শহর ছেড়ে ট্রাকের বাসের তীব্র চিৎকার থেকে দূরে গাছগাছালি ঘেরা মাটির বাড়িঘর দেখতে দেখতে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের জমি দেখতে দেখতে শান্ত শান্ত গ্রাম পার হই। দূরে কোথাও যেতে পারলে আমার সবসময়ই ভাল লাগে। জামালপুরের সার্কিটহাউজে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়। সিভিল সার্জন দুটো ঘরের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন, বলেছি একটি ঘরেই আমাদের চলবে। প্রশ্ন করেন, উনি কি আপনার স্বামী?
না।
তাহলে দুটি ঘর..
না, একটা ঘরেই আমাদের চলবে।
আমাদের বয়স সেদিন কমে গিয়ে ষোলোয় পৌঁচেছিল! উত্তেজিত উন্মত্ত উচ্ছঅল শরীর সপ্তম আকাশেই ঘুরে বেরিয়েছে সারারাত। কায়সারকে এত আনন্দ পেতে আগে দেখিনি। আমাকে একা করে পাওয়া তার হয় না এমন। ঢাকার ব্যস্ততা থেকে বহু দূরে দুজনের কেবল দুজনের জন্য সময় কাটানোর এমন একটি সুযোগ তার জন্য স্বর্গ পাওয়া। ঢাকায় আমার সময় হয় না তেমন কায়সারকে সময় দেবার। কিন্তু যেটুকু সময়ই আমার জোটে তার জন্য, তার মন না ভরলেও আমার মন ভরে। কায়সারের সঙ্গে ঘন ঘন কদিন দেখা হয়, আবার অনেকদিনের জন্য সে উধাও, তখন মন কেমন কেমন করে। কায়সার কেবল খুঁিটনাটি খুনসুটির জন্য নয়, গভীর গম্ভীর আলোচনার জন্যও। ‘কি রে তোর কাছে কোনও চাকরি টাকরি আছে নাকি, একটা চাকরি দে তো আমার এক ফুপাতো ভাইয়ের জন্য।’ তার একটি অভ্যেস, কোনও কিছুতে কখনও সে না বলে না। তার ক্ষমতা না থাকলেও সে কথা দেবে সে চাকরির ব্যবস্থা করবে। চেষ্টা করে সে। অনেক কিছু করারই চেষ্টা করে। বেশির ভাগ কথাই সে রাখতে পারে না। ফুপাতো ভাই মোতালেব অনেকদিন বেকার বসে আছে। আমার কাছে প্রায়ই আসে একটি চাকরির জন্য। এই অভাবের অনিয়মের দেশে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশ করলেও চাকরি পাওয়া যায় না। কারও অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামুটি রকম চলনসই হলেই অভাবী আত্মীয়দের ভিড় বাড়ে। কেউ আসে টাকা পয়সার সাহায্যের জন্য, কেউ চাকরি বাকরির জন্য। আমার নিজের তো ক্ষমতা নেই কাউকে চাকরি দেবার। সুতরাং আমার অনুরোধে কায়সারই রুটি বানানোর কারখানার মালিক বন্ধুকে ধরে বিএসসি পাশ মোতালেবকে একটি কাজ দিল। ছোট কাজ। তবু তো কাজ! বেকার যুবকেরা যে কোনও কাজ পেয়েই বর্তে যায়। কায়সারের এই কৃতিত্বে তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা বাড়ে। এটিই চায় সে, সে যে নিতান্তই তুচ্ছ কোনও বস্তু নয়, তারও যে কিছু হলেও ক্ষমতা আছে, সেটি সে ব্যগ্র হয়ে বোঝাতে চায়। কায়সার তার লাল গাড়িটিতে আমাকে পাশে বসিয়ে তার ধনী বন্ধুদের আপিস বা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আমাকে মুগ্ধ করতে চায়। কিন্তু সে দেখে এসব আমাকে মুগ্ধ করে না। একবার কাকরাইলের মোড়ে তার গাড়ির সঙ্গে একটি রিক্সার ধাককা লাগল, গাড়ি থামিয়ে ছুটে গিয়ে সে রিক্সাঅলাকে বেদম মার দিতে লাগল। গাড়ির ভেতর থেকে চেঁচিয়ে তাকে থামতে বলেও পারি না থামাতে, শেষ পর্যন্ত গাড়ি থেকে নেমে মোড় ভর্তি মানুষের সামনে তাকে টেনে এনে গাড়িতে ওঠাতে হয়। কায়সার গজরাতে থাকে তার গাড়িতে দাগ পড়েছে বলে। তার অমানুষিক কাণ্ড দেখে এমনই আমার রাগ হয়েছিল যে তাকে আমি আমার বাড়িতে ঢুকতে দিইনি কয়েকদিন। ধীরে ধীরে কায়সার বোঝে যে আমি তার গায়ের শক্তি আর তার চেয়ারম্যানি শক্তিকে মোটেও পছন্দ করছি না। সে আমার পছন্দ পেতে এরপর মানবিকতার গল্প শোনাতে থাকে। জয়দেবপুরের অনেক গরিব লোক তার কাছে আসে সাহায্য পেতে এবং সে তাদের এই দিয়ে ওই দিয়ে সাহায্য করে। কায়সার আমার আড়ালে কেমন তা আমার জানা হয় না, আমার কাছে এসে তাকে মানবিক হতেই হয়। আবেগে একদিন সে কবিতা লিখতে শুরু করে। কবিতাগুলো সবই আমাকে উদ্দেশ্য করে। আমি যখন সাংবাদিক বা সাহিত্যিকদের সঙ্গে ব্যস্ত কথা বলায়, কায়সার ঘণ্টা দুঘণ্টা আমার জন্য অপেক্ষা করে আর কবিতা লেখে। কখনও ‘কিরে তুই তো ভালই লিখতে পারসঞ্চ বললে সে রঙিন হয়ে ওঠে সলজ্জ অহংকারে। লেখায় আরও মন দেয়। সেও যে লিখতে পারে, কেবল আমি নই, সেটি সে আমাকে দেখাতে চায়। জীবনে যে লোক কোনও বই পড়েনি, সে বই পড়তে শুরু করে। কায়সারের সঙ্গে আমার অতিসহজ অতিসরল অনিয়মিত কিন্তু বাঁধা সম্পর্কটি থেকে যায়। সম্পর্কটি কোনও পীড়নের সৃষ্টি করে না। সম্পর্কটি আমার সময় নষ্ট করে না। সম্পর্কটিকে জল সার দিয়ে বড় করার চেষ্টা করতে হয় না। সম্পর্কের কোনও পরিণতি নিয়ে ভাবতে হয় না। সম্পর্কটি আমার দুশ্চিন্তা ঘোচায়। পুরুষহীন-একাকীত্বের যন্ত্রণা ঘোচায়। কায়সার আমার কাছে কখনও যুবক, কখনও শিশু। কখনও সে দৃশ্যমান, কখনও সে অদৃশ্য। তবে সে যতক্ষণ আমার সামনে থাকে, সে আমার, সম্পর্ণই সে আমার। সে মানুষ কিম্বা অমানুষ সে আমার। সে শত্রু কিংবা বন্ধু, সে আমার। আমার রাগ, দুঃখ, আমার কষ্ট, সুখ সব তার ওপর বর্ষণ করতে পারি আমি। রাগ হলে ছিঁড়ে রক্তাক্ত করলাম, কষ্ট হলে কাঁদলাম, সুখ হলে হৈ চৈ করলাম, নিঃশব্দে কিন্তু সাদরে সে বরণ করে সব। কখনও তাকে বুকের কাছে নিয়ে আদর করছি, কখনও ধমকে বিদেয় করছি। কায়সার রাগ করে না কোনও চড়, ঘুষি, লাথিতে। সে জানে আবার তাকে আমি বুকে নেব। হয়ত সে বোঝে, যে, তার জন্য আমার একধরনের ভালবাসা আছে। আসলে, আছে। ভালবাসা আমার প্রিয় পুতুলটির জন্যও তো আমার আছে। বাইরের হাজার রকম কাজের পর সারা দিনের শেষে একটি নিজের কিছু সে মানুষ হোক, সে বস্তু হোক, মানুষ চায়। কায়সার আমার সেরকম। কায়সার আমাকে ভালবাসে, এটি আমাকে স্বস্তি দেয়, এটি আমাকে সুখ দেয়, আমাকে নিরাপত্তা দেয়, আমাকে মুক্তি দেয়, আমাকে ব্যস্ত হতে দেয় কাজে। কায়সারকে, আমি না অনুভব করলেও, এটা ঠিক, যে আমার ভীষণ রকম প্রয়োজন। তাকে নিয়ে আমি যে কোনও কোথাও যেতে পারি। কোনও কুণ্ঠা আমার ত্রিসীমানায় ঘেঁসে না। আমার সাহিত্যিক বন্ধুদের বাড়িতে তাকে নিয়ে যাই অথবা তারা আমার বাড়িতে এসে কায়সারকে দেখে, আমাদের আড্ডায় এক কিনারে সে যখন চুপচাপ বসে থাকে। কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে না, এ কে, এর সঙ্গে কী আমার সম্পর্ক। আমি অনুমান করি যে তারা অনুমান করে নিচ্ছে সম্পর্কটি কি! এতে কারও কারও চোখ হয়ত কপালে ওঠে। কারও কপালের চোখের দিকে আমি মোটেও ফিরে তাকাই না। ফিরে না তাকালেই কপালের চোখ ধীরে ধীরে চোখের জায়গায় ফিরে আসে।
বাড়িতে বোন আছে, বোনজামাই আছে, কুলসুম আছে, এমন কী মা আছেন, আর আমি কায়সারকে আমার শোবার ঘরে নিয়ে দরজা বন্ধ করছি। কেউ এ নিয়ে কোনও কথা বলে না, এমন কী মাও নন। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলে আমি নই, মা বরং নিজেকে লুকিয়ে রাখেন অন্য ঘরে যেন মাকে দেখে আমার কোনও সংকোচ না হয়। আমার সুখে তিনি বাধা হয়ে দাঁড়ান না। মা আমাকে সুখী দেখতে চান, আমাকে তৃপ্ত দেখতে চান।
মা এত বেশি আমাকে নিয়ে ভাবেন যে আমার অর্থনৈতিক কোনও দুরবস্থা না থাকলেও তিনি আমার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন। তিনি থাকলে তাঁর জন্য বাড়তি খাবার দরকার হয়, তাই তিনি চলে যান ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহ থেকে চাল ডাল আনাজপাতি যখনই যা তিনি সংগ্রহ করতে পারেন, নিয়ে উদয় হন। বসে বসে দীর্ঘদিন সেই অন্ন ধ্বংস করতে তিনি রাজি নন বলে আবার উধাও হন। উধাও হওয়ার আগে অবশ্য কুলসুমকে শিখিয়ে দিয়ে যান আমাকে যত্ন করার সকল রকম পদ্ধতি। আমি কি অনেকটা বাবার মত হয়ে যাচ্ছি! বাবার মত প্রতাপ আমার। সংসার চলে আমার টাকায়, সম্পূর্ণই আমার নির্দেশে। শান্তিবাগের বাড়িতে যেমন সবাই আমাকে সমীহ করে চলে, আমার কখন কী প্রয়োজন, তা আমি না চাইতেই হাতের কাছে এগিয়ে দেয়, অবকাশের লোকেরাও বুঝে শুনে কথা বলে। বাবাও আমার দিকে আর কড়া চোখে মুখ খিঁচিয়ে তাকান না বরং তিনি আমাকে স্বর নরম করে বলেন, ‘তোমার কি কোনও পরিচিত কেউ আছে কোনও কোনও চাকরি টাকরি দেওয়ার! থাকলে মঞ্জুরে কোনও রকম একটা চাকরির যোগাড় কইরা দিও।’ মঞ্জু ঈমান কাকার ছেলে। লেখাপড়া করেনি বেশি। বাবা যেমন তার নান্দাইলের বাড়ির সবার লেখাপড়া চাকরি বাকরির দেখাশোনা করেন, আমাকেও ওরকম করতে হয় অনেকটা। খসরুকে বলে মঞ্জুকে একটি চাকরি জুটিয়ে দিই। সাভারে খসরুর জেনারেটর তৈরির কারখানা আছে, সেই কারখানায় অল্প বেতনে শ্রমিকের একটি চাকরি। আমাদের কোনও বড় বড় মামা কাকা নেই কোনও উঁচু পদে, যাদের কাছে বিপদে আপদে সাহায্যের জন্য যাওয়া যায়। আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে যদি কারও যশ খ্যাতি প্রতিপত্তি থাকে, সে বাবার। এরপর যতটুকু যা আছে, আমার। মঞ্জুকে আর মোতালেবকে খসরু আর কায়সারকে বলে চাকরি দুটো দিয়ে সংসারে বাবার মত একটি অবস্থান হয় আমার। কায়সারকে নিয়ে আমি অবকাশে গিয়েছি, বাবা একবারও প্রশ্ন করেননি কে এই ছেলে কী পরিচয়, কেন তার সঙ্গে আমি মিশছি। আসলে এসব প্রশ্নের অনেক উর্ধে আমি। এ কী কেবলই আমি স্বনির্ভর বলে! তা ঠিক নয়। আমি তো আরমানিটোলায় থাকাকালীনও স্বনির্ভর ছিলাম। এ তবে কী কারণে! আমি দায়িত্ববান বলে! ইয়াসমিন আর মিলনের দায়িত্ব নিয়েছি বলে! অন্তত আমার বাড়িতে তাদের থাকা খাওয়ার! নাকি আমি বড় হয়েছি বলে। অর্থাৎ বয়স হয়েছে বলে! কত আর বয়স, তিরিশও তো হয়নি। নাকি আগের চেয়ে আমার য়চ্ছলত! বেশি বলে! নাকি আমাকে বলে কোনও লাভ হয় না বলে, আমি কারও উপদেশের তোয়াককা করি না বলে! নাকি আমার নাম হয়েছে বলে! নাম তো তখনও আমার ছিল, যখন আমাকে আমার সুখের সংসার ভেঙে ঘাড় ধরে বাবা আমাকে ময়মনসিংহে নিয়ে এসেছিলেন বন্দি করার জন্য! নাকি এখন আমার বেশি নাম হয়েছে বলে! যে কারণেই হোক আমার ভাল লাগে যে আমার কোনো কাজে আমাকে কেউ বাধা দেবার নেই। স্বাধীনতার সত্যিকার স্বাদ আমি উপভোগ করি।
বন্ধু, শুভাকাঙ্খী, কবি সাহিত্যিক কেউ না কেউ আমার বাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই আসছেন। সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি সমাজ নিয়ে ধুম আড্ডা হচ্ছে। ঘন ঘন চা পান হচ্ছে। দুপুর বা রাতের খাবার সময় হলে খাবার দেওয়া হচ্ছে টেবিলে। যার যখন ইচ্ছে খেয়ে নিচ্ছে। অতিথি আপ্যায়নেও আমি মার স্বভাব পেয়েছি। কলকাতা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এলেন, শরৎ মুখোপাধ্যায় আর বিজয়া মুখোপাধ্যায় ঢাকায় বেড়াতে এসে দেখা করে গেলেন। যে কারুকে আমি আপ্যায়ন করতে পারি, বন্ধুদের যে কেউ আমার বাড়িতে যে কদিন ইচ্ছে কাটাতে পারে, এমনই সুস্থ সুন্দর মুক্ত একটি পরিবেশ আমি ধীরে ধীরে তৈরি করে নিয়েছি। ঠিক যেরকম আমি চাই, সেরকম করে আমার সংসার, আমার জগত এবং জীবন সাজিয়েছি। আত্মীয় স্বজনের চেয়ে বন্ধুরাই আমার কাছে বেশি বড়, বেশি আপন। অবসর বলে যদি কিছু থেকে থাকে আমার, বন্ধুদের জন্যই রাখি। কালো পাহাড়ের মত মানুষটি যার মুখে কখনও হাসি ফুটতে দেখিনি সেই বাদল বসু এলেন আনন্দ থেকে নতুন প্রকাশিত বই নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য নিয়ে। বাদল বসুকে কাছ থেকে জানলে তিনি যে মোটেও বেরসিক মানুষ নন, তা বোঝা যায়। তাঁর মুখে হাসি তো ফোটেই, খুব ভাল ফোটে। ফুটলে কি হবে, আমার মুখের হাসিটি নিবে গেল যখন নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্যের পাতায় পাতায় মারাত্মক মারাত্মক ভুল দেখলাম। ‘এ কি! বইটির কি প্রুফ দেখা হয়নি!’ বাদল বসু বই ঘেঁটে বিষণ্ন মুখে বললেন, ‘সব্বনাশ হয়ে গেছে, প্রুফ দেখা হয়নি।’
‘বই বিক্রি করা তাহলে বন্ধ করুন।’
বাদল বসুর মত ডাকসাইটে লোকের মুখের ওপর বলে দিতে পারি ছাপা হওয়া পাঁচ হাজার বইয়ের বিক্রি বন্ধ করে দিতে। একটি ঝকঝকে সুন্দর পঈচ্ছদের নতুন বই হাতে নিয়ে মন ভালর বদলে মন খারাপ হয়ে থাকে। বাদল বসু বললেন ‘ছাপা যখন হয়ে গেছে তখন বিক্রি হয়ে যাক। এর পরের সংস্করণে ভুল সংশোধন করা যাবে।’ কিন্তু যে পাঠকেরা এই বইটি কিনবে তারা তো ঠকে যাচ্ছে, একটি শুদ্ধ বাক্যও পাবে না বইটিতে! ভাববে আমিই বুঝি এরকম ভুল ভাল লিখেছি। এত বড় প্রকাশনীটি নিজেদের ভুলের প্রায়শ্চিত্য করেনি, লেখকের অনুরোধের পরও বই বিক্রি বন্ধ হয়নি। বাংলাদেশের প্রকাশনীগুলো আনন্দ পাবলিশার্স থেকে অনেক ছোট। কিন্তু আমি যদি ছোট প্রকাশনীর ছোট প্রকাশকদের বলতাম প্রুফ না দেখা বই বাজারে না ছাড়তে, আমার বিশ্বাস তারা আমার কথা রাখতেন। আনন্দ আমাকে দীর্ঘদিন বিষাদে ভরিয়ে রাখে।
কিন্তু কতদিন আর বিষাদ পুষে রাখা যায়! জীবনে মনস্তাপ, সন্তাপ, বিষাদ, বিধুর, পীড়া পরিতাপের তো শেষ নেই। বিষাদকে একপাশে সরিয়ে রেখে নতুন কাজে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। চারদিকের কুৎসা রটনা, নিগ্রহ নৃশংসতা, ঈর্ষা পরশ্রীকাতরতার থিকথিকে কাদার ওপর আমি জানি আমাকে মেরুদণ্ড শক্ত করে চলতে হবে, না চললে যে কোনও মুহূর্তেই আমি হোঁচট খাবো। ভেঙে যাবো। আমাকে ভেঙে ফেলার জন্য হাতে হাতে হাতুড়ি। জনপ্রিয়তার যত ভাল দিক আছে, তত মন্দ দিকও আছে। ভাল দিকগুলোর মধ্যে আমাকে আর পত্রিকা আপিসে যেতে হয় না লেখা দিতে, পত্রিকা থেকেই লেখা নিয়ে যেতে লোক পাঠানো হয়। যাই লিখি না কেন, যেমনই লিখি না কেন, ছাপা হয়। প্রকাশকরা টাকা রেখে যান বাড়িতে। জীবনে যে টাকা নিজের জন্য কখনও কল্পনা করতে পারিনি, সে সব অংকের টাকা আমার টেবিলে যে কোনও ঠোঙার কাগজের মত পড়ে থাকে। মন্দ দিক অনেক আছে। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি। একাধিক বিয়ে করেছি এর অর্থ একাধিক পুরুষের সঙ্গে শুয়েছি (আমার স্বামী তালিকায় এমন অনেক লোকের নাম আছে, যাদের নাম আমি জীবনে শুনিনি)। আমি বেলাজ, বেহায়া, চরিত্রহীন। সুনীলের সঙ্গে খাতির ছিল তাই সুনীল আমাকে আনন্দ পুরস্কার দিয়েছেন (আনন্দ পুরস্কার কমিটিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন, শুনেছি তিনিই একমাত্র কমিটির সদস্য যিনি আমার পুরস্কার পাওয়ায় আপত্তি করেছিলেন)। আমি পুরুষ বিদ্বেষী। আমি ধর্ম বিদ্বেষী। আমি র এর এজেন্ট। আমার লেখা লেখা নয়, পিওর পর্নোগ্রাফি। ইত্যাদি ইত্যাদি। বন্ধু যত বাড়ে, আমার শত্রু বাড়ে দ্বিগুণ।
শত্রু বাড়ে, কতরকম মানুষ যে তবু আমার কাছে আসে! নানা বয়সের মেয়ে নানা রকম সমস্যার কথা শোনাতে আসে। এমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছে তার পরিবারের লোকেরা যে ছেলেকে তার পছন্দ নয়। স্বামীর সঙ্গে অন্য মেয়ের সম্পর্ক। স্বামী মারধোর করে। স্বামী তালাক দিয়েছে। বাবা লেখাপড়া করতে দেয় না। স্বামী চাকরি করতে দেয় না। আপিসের বস শরীর চায়। যে কথা আর কাউকে বলতে পারে না, আমার কাছে বলে, দেখেছি, তারা ভারমুক্ত হয়। নিমন্ত্রণ নামে একটি উপন্যাস বেরোলো। গল্পটি ছোট, শীলা নামের এক ষোল সতেরো বছর বয়সের মেয়ে একটি সুদর্শনের যুবকের প্রেমে পড়ে। কিন্তু প্রেমে পড়লে কী হবে, সুদর্শনের মনে তো কোনও প্রেম নেই। যুবকটি একদিন নিমন্ত্রণ করে শীলাকে, শীলা ভেবেছিল যুবকটি তাকে ভালবাসে। শীলা নিমন্ত্রণে যায়, নিমন্ত্রণ না ছাই, শীলাকে একটি খালি বাড়িতে নিয়ে কয়েকটি বন্ধু মিলে ধর্ষণ করে সেই যুবক। এমন মর্মান্তিক করুণ কাহিনীটিকে লোকে বলতে লাগল অশ্লীল অশ্লীল। পড়া যায় না। ছোঁয়া যায় না। যেহেতু ধর্ষণের নৃশংস বর্ণনা দিয়েছি বইটিতে, তাই এটি অশ্লীল, তাই এটি পর্নোগ্রাফি। সমাজে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু লেখা যাবে না। লিখলে ঢি ঢি পড়ে যাবে। সমাজচ্যূত হব, একঘরে হব। লোকে আমাকে থুতু ছিটোবে। ছিটোয় থুতু। থুতু ছিটোনো যখন চলছে, এক বিকেলে অচেনা এক ভদ্রমহিলা এলেন আমার বাড়িতে নিমন্ত্রণ বইটি সম্পর্কে বলতে। বইটি তিনি একাধিকবার পড়েছেন এবং তাঁর দুই মেয়েকে পড়িয়েছেন। যে বইটি এমন নোংরা যে স্পর্শ করলে গা ধুতে হয়, যে বইটির অশ্লীল শব্দ পড়ে ঘেন্না হয় লোকের, সেই বইটি তিনি তাঁর কিশোরী মেয়েদের পড়িয়েছেন, তাও নাকি রীতিমত আদেশ করে! ভদ্রমহিলা বলেন, এই বইটি প্রতিটি কিশোরীর পড়া অবশ্য কর্তব্য। তিনি মনে করেন তাঁর মেয়েরা এখন অনেক বেশি সাবধানে চলাফেরা করার চেষ্টা করবে, ভুলিয়ে ভালিয়ে কেউ তাদের কোনও খালি ঘরে নিয়ে যেতে পারবে না। এই বইটি লেখার জন্য আমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে এরকম বই যেন আরও লিখি সেই অনুরোধ করলেন তিনি। বাইরের একশ থুতুর ছিটে ঘরের একটি ছোট্ট রুমালে মুছে নিই।
আমাকে ঢাকা থেকে সরিয়ে দেওয়ার কারণ কি? অনেকে অনুমান করেন, আমার লেখা। আমার লেখা পছন্দ হচ্ছে না কিছু কিছু সরকারি কর্তার। বিএনপির নিজস্ব পত্রিকা দৈনিক দিনকালে আপন মনের মাধুরি মিশায়ে আমাকে অপবাদ দেওয়া হয়, আমার বড় বাড় বেড়েছে, অশ্লীলতা আর অধর্মে ডুবে আমি আবোল তাবোল বকছি। আমাকে আমার জায়গা থেকে তুলে এখন দূরে কোথাও ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াই তো বুদ্ধিমানের কাজ। সাপ খোপের কামড় থেকে নিজেকে বাঁচাতে বাঁচাতেই আমার জীবন যাবে, হাতে আর কলম তোলার শক্তি পাবো না। জামালপুরের গহীন গ্রামে গিয়ে আমার চাকরি করা সম্ভব নয়, আমাকে ঢাকার কোনও জায়গায় বদলি করা হোক, ঢাকায় না হলে ঢাকার আশেপাশে হলেও চলবে এই অনুরোধ জানিয়ে লেখা আমার দরখাস্তে স্বাস্থ্য সচিব মঞ্জুরুল করিমের সই নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দিই। মঞ্জুরুল করিমের আরেকটি পরিচয় তিনি কবি, কবি ইমরান নূর। কবি বলেই সইটি দিয়েছেন তিনি। ইমরান নূরের পরামর্শে নির্মলেন্দু গুণ কিছু একটা হবে এই আশা নিয়ে আমাকে নিয়ে যান শেখ হাসিনার কাছে। আমার বিশ্বাস না হলেও নির্মলেন্দু গুণের বিশ্বাস হাসিনা চাইলে আমার বদলি পাল্টাতে সাহায্য করতে পারেন। হাসিনার সঙ্গে গুণের জানাশোনা অনেকদিনের। দুজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সঙ্গে পড়েছেন। হাসিনার উদ্দেশে ছাত্রাবস্থায় তিনি সম্ভবত কিছু প্রেমের কবিতা লিখেছিলেন, যেমন লিখেছিলেন বিউটি কুইন পূরবী বসুকে নিয়ে।
হাসিনার মিন্টো রোডের বাসভবনে এর আগে দুবার আমি গিয়েছি। প্রথম তো রোজার সময় ইফতারির দাওয়াত খেতে, সেদিনই গুণ হাসিনার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর হাসিনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল শেখ মুজিবর রহমানের জন্মদিনে ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে। হাসিনা অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছিলেন। বত্রিশ নম্বর বাড়িতে ওই প্রথম আমি গিয়েছি। বুক ছিঁড়ে যায় কষ্টে যখন দেখি সিঁড়ির সেই জায়গাটি যেখানে শেখ মুজিব দাঁড়িয়েছিলেন আর বুক তাঁর গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে গেল। পনেরোই আগস্ট উনিশশ পঁচাত্তর সাল। কী ভয়ংকর একটি দিন। শেখ মুজিবের পুরো পরিবারের ষোলো জনকে খুন করা হয়েছিল সেদিন। ভাল যে শেখ হাসিনা আর তাঁর বোন শেখ রেহানা দেশে ছিলেন না পনেরোই আগস্টে, তাহলেও তাঁদেরও খুন করা হত। আজ বীর দর্পে শেখ মুজিবের খুনীরা রাস্তায় হেঁটে বেড়ায়। খুনীগুলো ফ্রিডম পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দলও শুরু করেছে, এর ছাত্র সংগঠনের নাম যুব কমাণ্ড। জামাতে ইসলামির মতই অবলীলায় সন্ত্রাস চালাচ্ছে সারা দেশে। আজ শেখ হাসিনার মুখে আমরা শেখ মুজিবরের মুখটি দেখি। ঘোর আঁধারে একটি ক্ষীণ আলোর রশ্মি আমাদের আমাদের হৃদয়ে স্বপ্ন রচনা করে। হাসিনার সঙ্গে মিন্টো রোডে আরেকবার আমার দেখা হয়, কয়েকজন কবিকে যখন ডেকেছিলেন দুপুরের খাবার খেতে। শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হক, বেলাল চৌধুরী আর আমি। হাসিনা অনেকক্ষণ তাঁর স্বামীর কথা বললেন, স্বামীটি যে কী নচ্ছ!র, তারই নিখুঁত বর্ণনা। স্বামী ওয়াজেদ মিয়া নাকি ফাঁক পেলেই খালেদা জিয়াকে ফোন করে রসের গপ্প মারেন। রাজনীতি বা সাহিত্য নিয়ে কোনও গভীর আলোচনায় হাসিনা যাননি। খাওয়া দাওয়া ঘর সংসার এসব বিষয় নিয়ে বেশির ভাগ সময় একাই কথা বলেছেন। আমি চুপচাপ বসে দেখছিলাম শেখ হাসিনাকে, তাঁর কথাবার্তা আমাকে মোটেও মুগ্ধ করেনি। আমি আওয়ামী লীগের কোনও সদস্য নই, কিছু নই, আওয়ামি-চক্ষু খুলে রাখি না যখন নেষনীকে দেখি। হজ্ব করে আসার পর হাসিনা কালো পট্টি বেঁধেছেন মাথায়, একটি চুলও যেন কারও নজরে না পড়ে। মেয়েদের চুলের মত অসভ্য নোংরা জিনিস যেন আর কিছু নেই, যে করেই হোক চুল ঢাকার জন্য তাই এত আকুলিবিকুলি। হাসিনার কালো পট্টির ঢং দেখলে আমার সত্যিই রাগ হয়। ধর্ম নিয়ে হাসিনা ঘরে সেদিন কোনও কথা বলেননি। ধর্ম নিয়ে বলেন বাইরে। তারপরও জানি, তাঁর দিকেই আজ তাকিয়ে আছে দেশের প্রগতিবাদী মানুষেরা। তিনিই যদি স্বাধীনতার শত্রুদের হাত থেকে, মৌলবাদীর হাত থেকে, সাম্প্রদায়িকতার কামড় থেকে দেশকে রক্ষা করেন।
শেখ হাসিনা যখন আমাদের সামনে এসে বসলেন, নির্মলেন্দু গুণই বললেন, ‘তসলিমাকে তো বদলি করে দিয়েছে, আপনি এখন ওকে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করেন।’
হাসিনা বললেন, ‘আমি তো ক্ষমতায় নেই। ক্ষমতায় থাকলে সম্ভব হত। আমি তো কিছু করতে পারবো না।’
‘তারপরও দেখেন। খালেদা সরকার তো ওকে খুব ভোগাচ্ছে। পাসপোর্ট এখনও দিচ্ছে না। আর ওরকম জায়গায় বদলি..। ওর লেখালেখি ওরা পছন্দ করে না বলেই এসব করছে।’
হাসিনা শ্লেষের সঙ্গে বললেন, ‘ওর লেখা তো আমারও পছন্দ হয় না।’
নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়। গুণ ম্যাড়ম্যাড়ে কণ্ঠে বলেন, ‘কেন, পছন্দ হয় না কেন?’
‘ধর্ম সম্পর্কে ও কিছু না জেনে লেখে। ইসলামে যে নারী পুরুষের অধিকার সমান, ইসলামে মেয়েদের মর্যাদা যে সবচেয়ে বেশি —এইগুলো তো ও অস্বীকার করে।’
হাসিনা বিরোধীদলের নেত্রী। চব্বিশ ঘন্টা তাঁর ব্যস্ততা। আমাদের জন্য সামান্য সময় ব্যয় করে ব্যস্ততা অথবা অন্য যে কারণেই হোক তিনি উঠে গেলেন। যাবার আগে তাঁর দলের এক সদস্যকে বলে দিলেন, আমার ব্যপারটি দেখার জন্য। সদস্যটি টুকে নিলেন কোথায় ছিলাম, কোথায় আমাকে বদলি করেছে এ দুটো তথ্য। আমার ব্যপারটি দেখার জন্য মিন্টো রোডের কারও তেমন আগ্রহ লক্ষ করিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রতিদিন খবর নিতে যাই বদলি পাল্টানোর কতটুকু কি হল অথবা আদৌ কিছু হবে কি না। দুর্ধর্ষ ডাকাতের মত চেহারার মানু নামের বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের ডাক্তার নেতার হাতে তখন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ঢাকা থেকে লোক সরিয়ে লোক ঢোকানোর। মানু আমার দিকে যেভাবে আগ্রহ নিয়ে তাকায়, তার চোখ দেখেই বুঝি সে আমাকে নামে চেনে, আমার লেখা পড়ে সে, পছন্দ করে কি করে না সে আমার জানা হয় না। মানু যে বিকেলে লিস্টিটি ফাইনাল করবে, সেদিন যেতে বলে আমাকে অধিদপ্তরে। নিরীহ প্রাণীটি গিয়ে হাজির হই আদৌ আমার যাবার কোনও প্রয়োজন আছে কী না কিছুই না জেনে। মানু একা ঘরে আমাকে নিয়ে লিস্টিটি দেখায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি খালি পদ আছে, সেই পদটিতে আমাকে ঢোকানো যায় কি না মানু ভাবছে। মানু বসে আছে, তার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে আমি খুশিতে রঙিন হয়ে উঠি। কিন্তু রঙিন হওয়া মুখ ফ্যাকাসে হতে থাকে যখন কোথায় আমার পোস্টিং হবে সম্পূর্ণই তার ওপর নির্ভর করছে এই বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার দিকে পা পা করে এগোতে থাকে। সে এগোচ্ছে, আমি পিছোচ্ছি। পিছোতে পিছোতে আমি দেয়ালে। মানু আমাকে দেয়ালের কোণে বেঁধে ফেলেছে। কী তার উদ্দেশ্য! এই খালি আপিসে আমাকে সে কি ভোগ করতে চায়! ভাল জায়গায় পোস্টিং দেওয়ার লোভ দেখিয়ে! ভয়ে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে তখন কাঠ নয়, লোহা হয়ে আছে। ঘৃণায় আমার থুতু ছিটোতে ইচ্ছে করে মানুর মুখে। কিন্তু থুতু ছিটোলে কী লাভ। তার উদ্দেশ্য হয়ত সে যে করেই হোক সফল করতে চাইবে! আমার চেয়ে দ্বিগুণ কেন, চতুর্গুণ বেশি শক্তি ধারণ করে সে শরীরে। তার সঙ্গে লড়াইয়ে গিয়ে আমি সফল হব না। এ মুহূর্তে একটিই পথ আছে লাঞ্ছনা থেকে বাঁচার, তা মানুর নাগালের বাইরে চলে যাওয়া। দেয়ালের কোণটির কাছেই দরজা। পেছনে আমার স্পর্ধা দেখে ক্রোধে দাঁতে দাঁত পেষা মানুকে ফেলে আমি দ্রুত দরজা খুলে বের হয়ে যাই। দৌড়ে পার হই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বারান্দা। দৌড়ে নিচের তলায় নামি। দৌড়ে জনতার মধ্যে। দৌড়ে রিক্সায়। বুকের ধুকপুক থামে কিন্তু চোখ জলে ভরে ওঠে অপমানে। না হয় হোক ঢাকার কোথাও চাকরি। ভাল পোস্টিংএর দরকার নেই আমার।
যৌনতার রানী আমি, আমি জরায়ুর স্বাধীনতা চাই আমার সম্পর্কে এরকম প্রচারের কোনও কমতি নেই। এতে হয়ত অনেকে ভাবে হাত বাড়ালেই বুঝি আমাকে পাওয়া যায়। না ভাবলেও ধারণা তো আছেই যে মেয়েমানুষকে দেয়ালের কোণ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারলেই সাধ মেটানো যায়। কোনও ঝাড় জঙ্গলে আমাকে ছুঁড়ে দেওয়া হবে চাকরি করতে, এমন আশঙ্কার একশ পোকা নিশিদিন আমাকে কুট কুট করে কাটে। পোকার সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। পোকাময় ডাক্তারের হাতে বদলির কাগজ এল একদিন। বদলি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বিস্ময়ের ভেলা আমাকে নিয়ে আনন্দ সাগরে ভাসে।