১৭. মেসঘরে ঢুকে সবাই অবাক হল

ট্রেনিং ক্যাম্প।

লরেনকো মারকুইস।

মোজাম্বিক, আফ্রিকা।

২৪শে ডিসেম্বর। বুধবার।

সন্ধ্যা ৭টা।

মেসঘরে ঢুকে সবাই অবাক হল। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। টি বোন স্টেক, বেকড পটেটো, লাসানিয়া এবং পর্তুগিজ রেড ওয়াইন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। শেফ এসে বললটি বোন স্টেক প্রচুর আছে, কারো দরকার হলে তাকে জানালেই হবে। তবে রেড ওয়াইনের সাপ্লাই কম। নিম্নমানের কিছু হোয়াইট ওয়াইন আছে। প্রয়োজনে দেওয়া যেতে পারে।

মেসঘরে রীতিমতো হৈচৈ পড়ে গেল। সাধারণত সাড়ে সাতটার মধ্যে খাবার পর্ব শেষ হয়। আজ আটটা বেজে গেল। তবু কয়েক জনকে ব্যস্ত দেখা গেল।

শেফ এসে বলল, ডিনার শেষ হবার পর হার্ভি ফকনার কিছু বলবেন। সবাইকে থাকতে বলা হয়েছে।

আগামীকাল ক্রিসমাস। সেই উপলক্ষে ছুটি এবং বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করা হবে হয়তে। শহরে নিয়ে যাওয়া হবে। আফ্রিকান মেয়েদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর একটা সুযোগ হবে। মন্দ কী?

হার্ভি ফকনার মেসঘরে ঢুকল হাসিমুখে। তার স্বভাবসুলভ অন্তরঙ্গ স্বরে বলল, খাবার পছন্দ হয়েছে?

হয়েছে, হয়েছে।

রেড ওয়াইন কেমন ছিল?

অপূর্বতবে স্যার, পরিমাণ খুবই কম।

আলো জিনিস কমই খেতে হয়। তোমাদের জন্যে একটা জরুরি খবর নিয়ে এসেছি। আমাদের ওড়বার সময় হয়েছে।

মেসঘরে একটি নিস্তব্ধতা নেমে এল। কেউ শ্বাস ফেললেও শোনা যাবে এমন অবস্থা।

আমরা রাত বারটায় এখান থেকে রওনা হব। এয়ারপোর্টের দিকে। পৌঁছতে লাগবে এক ঘন্টা। সেখানে আমাদের জন্যে একটা ট্রান্সপোর্ট বিমান অপেক্ষা করছে। ভোর সাড়ে তিনটায় আমরা পৌঁছে যাব।

কোথায়?

কোথায় যাব এটা বলার সময় এসেছে। আমরা যাচ্ছি মোরান্ডায়।

মেসঘরে একটি মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল। হার্ভি কথা বলা শুরু করার সঙ্গে-সঙ্গে গুঞ্জন থেমে গেল।

অনেক বার বলা হয়েছে, তবু আরেক বার বলছি, বিমান থেকে প্যারাশুট দিয়ে জ্যাম্প করবার পর আমাদের হাতে সময় থাকবে এক ঘন্টা পঁচিশ মিনিট। এই সময়ের ভেতর কাজ শেষ করতে না-পারলে মোরান্ডা থেকে জীবিত অবস্থায় কেউ বের হয়ে আসতে পারব না।

মেসঘরে কোনো শব্দ হল না।

একটি কথা আমি সবাইকে মনে রাখতে বলছি। সেটা হচ্ছে, আমাদের বিপক্ষে যেসেনাবাহিনী আছে তা যথেষ্টই শক্তিশালী। জেনারেল ডোফা হচ্ছেন মোরান্ডার প্রধান সামরিক প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট। তিনি একজন প্রথম শ্রেণীর জেনারেল। কারো কিছু বলার আছে?

কেউ কিছু বলল না।

তা হলে যাত্রার প্রস্তুতি নেওয়া যাক। বন্ধরা, শুভ যাত্ৰা। তৈরি হতে শুরু কর।

রবিনসন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে একটি চিঠি লিখল পিটারকে। চিঠিটি তার পছন্দ হল না, সে আবার একটি লিখল। সেটিও পছন্দ হল না। মানসিক উত্তেজনায় এটা হচ্ছে। যা লিখতে ইচ্ছা হচ্ছে তা লেখা হচ্ছে না। সে তৃতীয় চিঠিটি লিখতে শুরু করল।

 

প্রিয় পিটার, তুমি কেমন আছ? আগামী কাল ক্রিসমাস। নিশ্চয়ই তোমার মা এসে গেছেন এবং তোমার দুই বোনটিও এসেছে। আমি কল্পনায় দেখছি তোমরা ক্রিসমাস টি সাজাতে শুরু করছ। আহু, যদি থাকতে পারতাম। খুব ইচ্ছা হচ্ছে ক্রিসমান টি সাজানোর ব্যাপারে তোমাদের সাহায্য করি। কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছা কখনো পূর্ণ হয় না। এই সত্যটি তুমি যত বড় হবে, ততই বুঝবে। তোমাকে একসময় কথা দিয়েছিলাম কখনো তোমাকে ছেড়ে যাব না। কিন্তু একসময় চলে গেলাম। এবং হয়তো আর ফিরব না। যদি এরকম কিছু হয়, দুঃখ করবে না। মানুষের জীবনটাই এরকম। যখন বড় হবে, তখন তোমার মা তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবেন কিংবা তুমি নিজেই সব বুঝতে পারবে। আজ আমাকে যতটা হৃদয়হীন মনে হচ্ছে, সে-দিন হয়তো ততটা মনে হবে না। হয়তো খানিকটা ভালো বাসবে। এই জিনিসটির অভাব আমি সারা জীবন অনুভব করেছি। আজকের এই ক্রিসমাস ডের চমৎকার রাতে প্রার্থনা করছি যেন ভালবাসার অভাবে তোমাকে কখনো কষ্ট পেতে না হয়। চুমু নাও।

রবিনসন

 

রবিনসন চিঠি খামে ভরে ঠিকানা লিখল। এই চিঠি নিজের হাতে পোস্ট করে যেতে হবে। সবচেয়ে কাছের পোস্ট বক্স এখান থেকে প্রায় ছ মাইল। জিপ নিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু রবিনসন ঠিক করল হেঁটেই যাবে। হাতে এখনো প্রচুর সময়। বারটা বাজতে দেরি আছে।

ক্যাম্পের গেটে ফকনার দাঁড়িয়ে চুরুট টানছিল। সে ভুরু কুঁচকে বলল, কোথায় যাচ্ছ?

চিঠি পোস্ট করতে। পিটারকে একটা চিঠি লিখেছি।

পোস্ট করার জন্য তোমাকে যেতে হবে কেন? এখানে রেখে দাও। যথাসময়ে পোস্ট হবে।

এটা আমি নিজেই পোস্ট করতে চাই। আমার ধারণা পিটারের কাছে এটাই হবে আমার শেষ চিঠি।

এরকম মনে হবার কারণ কি?

মৃত্যুর ব্যাপারটি মানুষ আগেই টের পায়।

তুমি শুধু-শুধু ভয় পাম্। তুমি ফিরে আসবে।

রবিনসন কোন কথা বলল না। ফকনার বলল, কাউকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও। একা যে না।

কেন? তোমার কি ধারণা আমি পালিয়ে যাব?

ফকনার তার জবাব দিল না। গম্ভীর মুখে দ্বিতীয় সিগারেটটি ধরাল এবং হাত ইশারা করে বলল, ঐ ওকে সঙ্গে নিয়ে যাও।

বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। রাস্তা গিয়েছে বনের ভেতর দিয়ে। নিৰ্জন রাস্তা শীতল হাওয়া বইছে। রবিনসন মৃদু গলায় বলল, তোমার কি ঠাণ্ডা লাগছে?

তাঁর সঙ্গী বলল, জ্বিনা স্যার।

আমাকে স্যার বলার দরকার নেই। নাম ধরে ডাকবে। তোমার কি নাম?

জলিল।

হাঁটতে ভালোই লাগছে, কি বল জলিল?

জ্বি স্যার।

রবিনসন হঠাৎ করেই তার নাতি প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। সে কেমন একা-একা কথা বলে। একদিন দেখা গেল সে একটা কসমস ফুল তুলে এদিক-সেদিক তাকিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে। তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করাতে সে বলেছে, খুব সুন্দর তো, তাই খেতে ইচ্ছা করে। রবিনসন রাস্তা কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। তার সঙ্গীও হাসল।

একটিই নাতি আপনার? হ্যাঁ। বড় চমৎকার ছেলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *