সেই মেঘে ঢাকা বিষণ্ণ আলোর মেদুর সকালে আমরা অবাক হয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। গতকাল থেকে নানাভাবে বেড়ে-ওঠা অস্বস্তিটাকে আমরা স্বাভাবিক ব্যাখ্যা দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চাইছিলাম, কিন্তু তা আর হবার নয়। এখানে যে অদ্ভুত আর অনৈসর্গিক কিছু ঘটছে সেটা আর অস্বীকার করা যাবে না। তবু বোধ করি। নিজেকে প্রবোধ দেবার জন্যই একটু ইতস্তত করে অসিতবাবুকে বললাম—আপনার হয়ত ভুল হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত পাতাগুলো ব্যাগে ভরেন নি, কোথাও পড়ে-উড়ে গিয়েছে—
অসিতবাবু ম্লান হেসে বললেন—আমার ভুল হয়নি, পরিষ্কার মনে আছে পাতাগুলো আমি ব্যাগে ভরেছি। বড় সাইজের থালার মত গোল পাতা, এমনিতে ধরাতে পারছিলাম না বলে ভাঁজ করে ঢোকাতে হয়েছিল। আমি ভুল করছি না—
আমি নির্মলবাবুর দিকে তাকিয়ে বললাম—আপনার মুখও কেমন যেন থমথমে, কিছু হয়েছে নাকি? তখন একবার যেন চমকে উঠলেন—
নির্মলবাবু বললেন-আমি এসব আধিদৈবিক ব্যাপার নিয়ে কখনো মাথা ঘামাই নি, বিজ্ঞান দিয়ে যা ব্যাখ্যা করা যায় না তাতে আমার কোনো বিশ্বাসও নেই। কিন্তু এখন ঘটনা যেমন দাঁড়াচ্ছে–
মেজকর্তা বললেন-কী রকম দাঁড়াচ্ছে? কী হয়েছে আপনার?
—আমিও কাল রাত্তিরে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছি, ওই ওঁদের মতই স্বপ্ন। আবছা, একই স্বপ্ন তিনজন মানুষ একই রাত্তিরে কখনো দেখতে পারে কি? আমি তো অন্তত শুনিনি–
-কী দেখেছেন আপনি? কী স্বপ্ন?
—দেখলাম তাবু থেকে বেরিয়ে ছায়া-ছায়া অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছি বনের মধ্যে। সময়টা বোধহয় রাত্তির, আকাশে কেমন একটা চাপা আলো। সেই বিষণ্ণ মনখারাপ করে দেওয়া আলোয় পৃথিবীকে অন্যরকম লাগছে। বুকের ভেতরে ভয়ের পাথর চেপে বসতে চাইছে স্বপ্নেই। ঘুরতে ঘুরতে জঙ্গলের মধ্যে সেই জায়গাটায় হাজির হলাম যেখানে বড় পাথরটা পড়েছিল। দেখলাম মাটিতে হড়কে যাবার দাগটা আর নেই, পাথরটা আবার পুরনো জায়গায় ফিরে এসেছে। তার পাশে একটা বিশাল বড় গাছ, গোল গোল থালার মত পাতা সেই গাছে। স্বপ্নেই ভাবলাম—ও, তাহলে তো সত্যিই এখানে একটা বড় গাছ আছে! কিন্তু এমন গাছ তো আগে কখনো দেখিনি? কী গাছ এটা? সঙ্গে সঙ্গে যেন কোথা থেকে কে বলল—এর নাম বুদ্ধ নারিকেল। স্বপ্নেই চারদিকে তাকালাম, কই কেউ নেই তো! কে তাহলে বলল কথাটা? এই সময়েই চমকে জেগে উঠলাম। রাত তখন আড়াইটে কী ভিটে হবে। আর ঘুম এল না। মনের ভেতর কী ভীষণ অস্বস্তি। এত স্পষ্ট স্বপ্নও হয়? তাছাড়া অমন অদ্ভুত গাছের নামই বা কী করে স্বপ্নে পেলাম? নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে কিছু তো আর স্বপ্নে পাওয়া সম্ভব নয়। এখন অসিতবাবুকেও একই নাম বলতে শুনে চমকে উঠেছিলাম। তাছাড়া–
মেজকর্তা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নির্মলবাবুর দিকে তাকিয়েছিলেন, বোধহয় যাচাই করে নিচ্ছিলেন তাঁর স্বপ্নকাহিনী। রাত্তিরে দেখা স্বপ্নের কথা পরের দিন সবটা ঠিকঠাক মনে থাকে না, বলতে গেলে কিছুটা বানানো হয়ে পড়ে। কিন্তু সার্ভেয়ার সাহেব দ্বিধাহীনভাবে একটুও না থেমে গড়গড় করে বলে যাচ্ছিলেন। বোঝাই যাচ্ছিল তিনি যা দেখেছেন তাই বলছেন, তৈরি করছেন না কিছু।
মেজকর্তা বললেন—তাছাড়া কী?
নির্মলবাবু একবার সেঁক গিললেন। যে কথা সত্য, কিন্তু শোনায় অসম্ভব, সে কথা বলবার সময় মানুষের যেমন বিপন্ন মুখভাব হয়, তেমনি মুখ করে তিনি বললেন–আর দেখলাম কী, রাত্তিরের অন্ধকারে সুযোগ পেয়ে চারদিকের পাহাড়গুলো যেন অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে, বেড়ার মত ঘিরে ধরেছে আমাদের তাবুগুলোকে। আর বাতাসে কেমন যেন একটা অদ্ভুত ফিসফিস শব্দ হচ্ছে, কেউ যেন কাউকে নিচু গলায় গোপনীয় কিছু বলছে। স্বপ্নেই চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, কোথাও কেউ নেই তো। ঘুমের ভেতরেই একটা দমবন্ধ করা ভয়ের ঢেউ এসে ধাক্কা দিচ্ছিল মনে। আজ সকালে উঠে প্রথমেই তাঁবুর বাইরে এসে পাহাড়ের দিকে তাকালাম। কই, পাহাড় তো সব তাদের জায়গাতেই আছে! স্বপ্নে যে কী ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!
নির্মল কাঞ্জিলাল গতকাল কি জলধর পণ্ডার কথা শুনেছিলেন? এখানেই তো ছিলেন বসে। সচেতনভাবে খেয়াল না করলেও বাতাসে ফিসফাস আর পাহাড় এগিয়ে আসার কথা নিশ্চয় কানে গিয়েছিল। সেটাই ঘুমের মধ্যে অবচেতন মনে প্রভাব বিস্তার করে স্বপ্ন দেখিয়েছে।
কিন্তু তাতে একটা জিনিসের ব্যাখ্যা হয় না। বুদ্ধ নারিকেল কথাটা উনি পেলেন কোথা থেকে? কোথায় সেই ষাট-সত্তর বছর আগে রাম গাঙ্গুলির মামাবাড়ির গ্রামের ঘটনা, আর কোথায় বিহার-উড়িষ্যার প্রান্তবর্তী এই নির্জন অরণ্যভূমি। আমারই তো নামটা মনে পড়েছে অনেক পরে—ওঁদের দুজনের এ নাম জানার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
জলধর পণ্ডা এসে কাছে দাঁড়াল। তার মুখচোখ গম্ভীর।
মেজকর্তা বললেন—কী খবর জলধর? ওদের সঙ্গে কথা হল?
–হইল কর্তা। কিন্তু খবর খারাপ, ওরা কাজ করতে চাইছে না।
মেজকর্তা টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে একটা বের করে ধরালেন। ধোঁয়া ছেড়ে সিগারেটের জুলন্ত ডগার দিকে চিন্তিতভাবে তাকিয়ে বললেন—জলধর, তুমি কী বলছ তুমি বুঝতে পারছ?
জলধরের ওই হাস্যোদ্রেককারী চেহারা আর বিচিত্র অ-কারান্ত উচ্চারণের পেছনে একটি বুদ্ধিমান এবং সপ্রতিভ ব্যক্তিত্ব বাস করে। তার এই রূপটা আমরা আগে কখনো দেখিনি। এবার দেখলাম এবং অবাক হলাম।
জলধর দৃঢ়গলায় বলল—আমি বুঝতে পারছি কর্তা। কাজ বন্ধ হয়ে গেলে কোম্পানির বহু টাকা লোকসান হয়ে যাবে, আমাদের সকলের কৈফিয়ৎ দিতে দিতে প্রাণ যাবে। কোম্পানির বড়বাবুরা এসব কথা বিশ্বাস করবে না। সব বুঝি বাবু, কিন্তু এরা একবার যখন বেঁকে বসেছে, আর এদের রাজি করানো যাবে না। এদের বিশ্বাস এই অঞ্চলে পাসাং মারা ক্ষেপেছে, এখানে আর থাকলে পাসাংমারার ভয়ানক অভিশাপ কাজ শেষ করে ফেরবার সময় পেছন পেছন যাবে, সমস্ত গ্রাম উজাড় করে দেবে। আমি অনেক বুঝিয়েছি, কোনো লাভ হয়নি।
–এখন তাহলে কী করবে?
—আমি এখনই কুলিদের নিয়ে ফিরে যাচ্ছি সিমডেগায়, লরিটা নিয়ে যাচ্ছি। যাবার পথে সাম পাহাড়টোলিতে ওদের নামিয়ে দিয়ে যাব। দেখি অন্য কোনো জায়গা থেকে লোক জোগাড় করতে পারি কিনা।
মেজকর্তা বললেন—সে কী! তাহলে আমরা কী করব?
—আপনারা এখানেই থাকুন। জিপটা রইল, যদি দরকার হয় এদিক-ওদিক যাতায়াত করতে পারবেন। ডহরু আপনাদের রান্নাবান্না করে দেবে। রসদ তো পনেরো দিনের মত রয়েছে, সে বিষয়ে চিন্তা নেই।
—তুমি কবে ফিরবে?
–আমার অন্তত দুদিন লাগবে। লোক জোগাড় করা সহজ কাজ নয়। এবার কোলেবীরা বা সীসার কাছে কোনো গ্রাম থেকে তোক নেব। ওদিকে বেশির ভাগই ক্রিশ্চান হয়েছে, রবিবারে যীশু ভজে। ওদের মধ্যে এসব ভূত-প্রেত আর অপদেবতায় বিশ্বাসটা কম। তবুও ঠিক করে বলা কঠিন–
–এখনই যাবে?
—এখনই যাব। নইলে এরা আমার পরোয়া না করে গাঁইতি-শাবল নিয়ে সারি বেঁধে নিজেদের গ্রামের পথে হাঁটতে শুরু করে দেবে। সেটা ভাল হবে না কর্তা। ভবিষ্যতে কখনো যদি বা আবার এদের ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা থাকে, এখন ভদ্রতা আর সাহায্য না করলে তা আর হবে না।
মেজকর্তা একটু ভেবে বললেন-যাও তাহলে, আর কোনো উপায় যখন নেই। চেষ্টা কোরো তাড়াতাড়ি ফিরতে।
জলধর পণ্ডা করিৎকর্মা লোক। কর্মসূচী একবার স্থির হয়ে যাবার পর সে আধঘণ্টার ভেতর সবকিছু গুছিয়ে চল্লিশ মিনিটের মাথায় রওনা হয়ে গেল। দেড়-দু মিনিটের মধ্যে লরির ইঞ্জিনের শব্দ মিলিয়ে এল পাহাড়িপথের বাঁকে। এখন অন্তত দুদিন অপেক্ষা ছাড়া আমাদের কিছু করবার নেই।
একাকীত্ব জিনিসটা বড় খারাপ। আদিবাসী কুলিরা আমার সমাজের লোক নয়, আমার শিক্ষিত শহুরে মানসিকতার সঙ্গে তাদের কোনো দিক দিয়ে মিলও নেই। তবু তারা চলে যাওয়ার পর আমাদের কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা ঠেকতে লাগল। মানুষের সঙ্গ এতই মধুর।
এবং স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কেমন যেন ভয়-ভয়ও করতে লাগল। কলকাতা শহরে বিদ্যুতের আলো আর গাড়িঘোড়ার ভিড়ে যা হেসে উড়িয়ে দেবার মত ব্যাপার, এখানে লোকালয় থেকে বহুদূরে নিবিড় বনের মধ্যে তা ভয়ের মুখোশ পরে সামনে এসে দাঁড়ায়।
অসিতবাবু পকেট থেকে নোটবুক বের করে তাতে কী যেন লিখছেন। মানুষটি বেশ আত্মস্থ, কবিপ্রকৃতির। চারদিকে লেখার উপাদান হিসেবে পরে ব্যবহার করা যেতে পারে এমন কিছু দেখতে পেলেই সঙ্গে সঙ্গে তা নোর্ট করে রাখেন। রাত্রিবেলায় পাকা ডায়েরিতে সেসব গুছিয়ে লেখেন। আমার বাঁদিকে একটা পিয়াশাল গাছ, তার গোড়ায় মেটে আলুর না কিসের যেন লতা। সেদিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ লতাটা যেন খুব হালকা হাওয়ায় একবার কেঁপে উঠল। কী ব্যাপার, এতক্ষণ তো বেশ গুমোট করে আছে আকাশে মেঘ থাকায়, বাতাস এলো কোথা থেকে? চারদিকে তাকালাম, না! বনভূমি একেবারে স্তব্ধনিশ্চল। তবে এই শান্তভাব ঝড়জলের পূর্বলক্ষণ, হয়ত বাতাস উঠবে এখনই।
ঠিক এইসময়েই লিখতে লিখতে অসিতবাবু বলে উঠলেন–এঃ!
মেজকর্তা বললেন—কী হল আপনার?
খোলা নোটবইটা দেখিয়ে অসিতবাবু বললেন-দেখুন না কাণ্ড, বৃষ্টি আসছে বোধহয়। একফোটা জল এসে পড়ল লেখার ওপরে—
তিনি পকেটবুকটা আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন। এক জায়গায় লেখার ওপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে দু-তিনটে অক্ষর ধেবড়ে গিয়েছে। অসিতবাবু আর ঝুঁকি না নিয়ে উঠে গিয়ে লেখার সরঞ্জাম তাবুতে রেখে এলেন। ভালই করলেন। কারণ এর পরেই বেশ মোটা মোটা বিন্দুতে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। ঝমঝম বর্ষণ নয়, বিরক্তিকর ছাগলতাড়ানি বৃষ্টি। আমাদের থাকার তাঁবুগুলোর পাশে একটা বড় তাবু খাটানো হয়েছে, সেটাকে আমরা বলি ওয়ার্কিং টেন্ট। মেজকর্তা উঠে পড়ে বললেন—চলুন, কাজের তাঁবুতে গিয়ে বসি। এখানে আর থাকা যাবে না। চেয়ারগুলো হাতে হাতে নিয়ে নিন–
চারদিকে তাকিয়ে দেখি মেঘের স্তর যেন আকাশ ছেড়ে নেমে এসেছে মাটির কাছে, সেজন্য ঘন ছায়ায় ঢেকেছে বনভূমি। বড় রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে পৃথিবীকে এমনি দেখায়, এটাও কি তবে তেমন কিছুরই পূর্বাভাস?
বৃষ্টিটা তখুনি ঝেপে এলো না, মেঘও থমকে রইল আকাশে। কিন্তু বাতাস একটু একটু করে বাড়তে লাগল, নিচু ঝোপ আর লতাপাতা লুটোপুটি করতে লাগল মাঝেমাঝেই। আর সেই হাওয়া বয়ে যাবার শব্দের মধ্যে কীসের যেন একটা ফিসফিস আওয়াজ।
ওস্তাদ লোক বটে ডহরু। আগেই বলেছি চারদিকে কী হচ্ছে না হচ্ছে সে বিষয়ে তার কোনও তাপ-উত্তাপ নেই, সে একজন নিবিষ্টমনা রন্ধনশিল্পী। আমরা তাঁবুর ভেতরে গিয়ে বসবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ডহরু এসে জিজ্ঞাসা করল, আমরা চা খাব কিনা। মেজকর্তা বললেন—তা খাওয়া যেতে পারে। কী নির্মলবাবু, হবে নাকি একটু?।
স্যাঁতসেতে মনকে চাঙ্গা করতে চায়ের মত জিনিস আর নেই। এই বিষণ্ণ, মেঘান্ধকার পরিবেশে সকলেরই মন কেমন যেন ভারি হয়ে উঠেছে। সার্ভেয়ার সাহেব বললেনমন্দ কি? হয়ে যাক—
দশমিনিটের মধ্যে এনামেলের মগে চা চলে এল। মেজকর্তা চা নিয়ে বললেন—ডহরু, টিপটিপ বৃষ্টি তো শুরু হয়ে গেল, তুমি রান্না করবে কীভাবে? উনুন নিভে যাবে না? মনে হচ্ছে বৃষ্টি আরো বাড়বে–
—চিন্তা নেই বাবু, রান্নার জায়গায় ছোট একটা ত্রিপল খাটিয়ে নিয়েছি মাথার ওপর। যদি ঝড়জল আরো বাড়ে তাহলে সব সরঞ্জাম নিয়ে আমার তাবুতে ঢুকে যাব, যে তাঁবুতে আমি আর জলধরা থাকি। এখন দু-দিন জলধরা থাকবে না, অনেক জায়গা খালি পাব–
—তাঁবুতে আগুন ধরে যাবে না?
—না বাবু। ভেতরে তো উনুন জ্বালব না, স্টোভেই হয়ে যাবে। বাবু, বিশুয়া কোথায়? এদিকে এসেছে নাকি? তার জন্যও চা বানিয়েছি যে!
বিশুয়া আমাদের জিপের ড্রাইভার। বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ বয়েসের সপ্রতিভ ছেলে। মেজকর্তা বললেন—যাবে আর কোথায়? ওদিকেই কোথাও আছে আর কী। বাথরুম করতে গিয়েছে হয়ত। দেখ একটু, আসবে এখন–
পরিবেশ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হলে মানুষের মন আশঙ্কায় টানটান হয়ে থাকে। আমরা সকলে নির্বিকার মুখে চা খেতে লাগলাম বটে, কিন্তু প্রত্যেকেই বুঝতে পারছিলাম প্রত্যেকে ভাবছে—বিশুয়া গেল কোথায়?
দশমিনিট পরে শূন্য মগ নামিয়ে রেখে নির্মলবাবু বললেন—বিশুয়া ফিরে এল কিনা দেখা দরকার। যদিও এ জঙ্গলে বোধহয় তেমন হিংস্র প্রাণী কিছু নেই, তবু আমরা এই কয়েকজন মাত্র তোক রয়েছি, খুব সাবধানে থাকা প্রয়োজন। ডহরুও কিছু জানালো না তো!
অসিতবাবু বললেন—চলুন তো দেখি কী ব্যাপার!
বাইরে এসে দেখি সেই মনখারাপ করে দেওয়া মেঘচাপা আলো আরো গাঢ় হয়েছে। এখন বেলা কতই বা হবে, বারোটা কী সাড়ে বারোটা, তাতেই যেন সন্ধে নেমে এসেছে। ওদিকে নিজের তাবুর সামনে দাঁড়িয়ে ডহরু কেমন অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।
মেজকর্তা বললেন—কী ডহরু, বিশুয়া ফিরল?
—না বাবু। চিন্তার কথা হল দেখছি, কোথায় যাবে বিশুয়া? যদি মাঠ করতেও গিয়ে থাকে, তাতেও তো এত সময় লাগতে পারে না–
এরপর আমরা বিশুয়ার নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকতে ডাকতে জঙ্গলের মধ্যে অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করলাম। কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। শেষে ডহরুই বলল—আচ্ছা বাবু, বিশুয়া ওদের দলের সঙ্গে লরিতে করে সিমডেগা চলে যায়নি তো? হয়ত ভেবেছে একা বসে থেকে কী করব, যাই ঘুরে আসি–
মেজকর্তা আর নির্মলবাবু এ কথা সমর্থন করলেন না। জলধর আমাদের জন্য জিপটা রেখে যাচ্ছে বলেছিল, এবং সে খুব দক্ষ ও চৌকস কর্মচারী। ভুল করে জিপের। ড্রাইভারকে নিয়ে চলে যাবে বলে মনে হয় না। তবে হ্যাঁ, কিছু ভুল-বোঝাবুঝি হয়ে থাকতে পারে। শেষমুহূর্তে কোনও দরকারেও হয়ত বিশুয়াকে সঙ্গে নেওয়া প্রয়োজন। হয়েছে, জলধর ভেবেছে বিশুয়া আমাদের জানিয়েছে, আবার বিশুয়া মনে করেছে জলধর নিশ্চয় আমাদের বলে রেখেছে। এছাড়া তো লোকটার অন্তর্ধানের আর কোনো ব্যাখ্যা হয় না। যাই হোক, আপাতত উদ্বেগ মনেই চেপে রেখে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই।
দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পর ডহরুকে তার রান্নার জিনিসপত্র নিয়ে সত্যি-সত্যিই তাঁবুতে ঢুকে পড়তে হল। হাওয়ার দাপটে মাথার ওপর থেকে ত্রিপল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। খোলা উনুনের আগুন জ্বালিয়ে রাখা যাচ্ছে না। পাঁচজনের রান্না অবশ্য তাঁবুর ভেতরেই স্টোভে করে নেওয়া যাবে।
দুর্যোগ আর দুঃসময়ের দুটো রূপ আছে। একটা রূপ আমাদের সন্ত্রস্ত করে, অন্যটা একধরণের বিচিত্র আনন্দের জন্ম দেয়। মানুষ যতই বলুক, সে শুধুমাত্র শান্তির পূজারী নয়। তাহলে আদিম যুগ থেকে মানবসভ্যতা একটুও অগ্রসর হত না। আরামে গাছের ছায়ায় শুয়ে গান গেয়ে দিন কাটানোর সুযোগ ছেড়ে মানুষ চিরকাল বেরিয়ে পড়েছে অজানার হাতছানিতে। প্রায়ান্ধকার বনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমারও গা-ছমছম করা অনুভূতি আর আনন্দ একসঙ্গে হল।
খাওয়া সেরে মেজকর্তা আর সার্ভেয়ার সাহেব কাজের কী আলোচনা করতে ওয়ার্কিং টেন্টে ঢুকলেন। আমি আর অসিতবাবু সিগারেট ধরিয়ে বনের ভেতর পায়চারি করতে লাগলাম। বৃষ্টি এখন পড়ছে না, কিন্তু থেকে থেকে শোঁ শোঁ করে বাতাস জেগে উঠছে। পরক্ষণেই আবার নেমে আসছে আশ্চর্য স্তব্ধতা। আবহাওয়ায় যেন একটু ঠাণ্ডারও ছোঁয়া।
একবার বাতাস একটু থামতেই অসিতবাবু হঠাৎ বললেন কে যেন বনের মধ্যে দিয়ে এদিকে আসছে, পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন?
বাতাস তখন থেমে আছে। সত্যিই শুনতে পেলাম ঝরা পাতার ওপর কার যেন ধীর
পদবিক্ষেপ। কে আসছে? কে?