১৭. মৃণালিনী
রবির বিলাতযাত্রার দ্বিতীয় চেষ্টাও যখন ব্যর্থ হল, দেবেন ঠাকুর ঠিক করলেন তাঁর বিয়ে দেবেন। কাদম্বরী একটু সামলে উঠেছেন দেখে রবি তার ভাগনে সত্যকে নিয়ে এবার বিলেতের জাহাজেও উঠেছিলেন। কিন্তু যত জাহাজ দূরে যায়, ততই বাড়ির টান বাড়তে থাকে সত্যর মনে। যদিও দু-তিন বছর বিয়ে হয়েছে, তবু বউয়ের মুখ মনে পড়ে তার বুক হু হু করে। মাদ্রাজ পর্যন্ত গিয়ে সত্য বেঁকে বসল, আর যাবে না। তার নাকি পেটব্যথা, রক্ত আমাশা। এখান থেকেই সে কলকাতা ফিরবে। এই জাহাজে রবির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে আশুতোষ চৌধুরীর। রবি ফিরতে চান না, কিন্তু যখন আশু ও রবি মিলে প্রাণপণ চেষ্টাতেও সত্যকে আটকে রাখা গেল না, তখন তার সঙ্গে রবিও লটবহর গুটিয়ে জাহাজ থেকে নেমে পড়লেন।
নেমে পড়লেই তো হল না, এবার জবাবদিহির পালা। রবি ভয়ে ভয়ে বাবামশায়কে টেলিগ্রাম করলেন মাদ্রাজ থেকেই। দেবেন অপরাধী দুজনকে তক্ষুনি নির্দেশ দিলেন সোজা মুসৌরিতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে। সুতরাং মাদ্রাজ থেকে সুরাটে সত্যেনের কাছে একদিন কাটিয়ে মুসৌরি পৌঁছলেন রবি।
দেবেন এখন বেশ কিছুদিন ধরেই পাহাড়ে থাকছেন। দার্জিলিং থেকে নেমে কলকাতা হয়ে নৌকো করে এসেছিলেন হরিদ্বার। তারপর দেরাদুন হয়ে মুসৌরিতে আশ্রয় নিয়েছেন বেশ কিছুদিন। মাঝে মাঝে সার্জেন ম্যাকলারেনের কাছে অর্শ, পায়ের ঘা ইত্যাদি চিকিৎসার জন্য দেরাদুনে নেমে আসেন, আবার ফিরে যান মুসৌরিতে। ছেলে আর জামাইরা এসে ঘুরে যান মাঝে মাঝেই। জ্যোতি এসে একমাস কাটিয়ে গেছেন। বর্ণকুমারীর স্বামী সতীশ স্কটল্যান্ড থেকে ডিগ্রি নিয়ে ফিরে দেখা করতে এলেন দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে। জামাতার সাফল্যে খুশি হয়ে মহর্ষি মেয়ে-জামাইকে বারো হাজার টাকার চেক উপহার দিয়েছেন, নিজস্ব বাড়ি করার জন্য। টাকা দিয়েছেন স্বর্ণকুমারীকেও।
রবি ও সত্যকে বিশেষ বকুনি দিলেন না দেবেন্দ্রনাথ, সত্য যেতে পারবে কি না তা নিয়ে তিনি আগে থেকেই সন্দিহান ছিলেন। রবিকে বললেন, ব্যারিস্টার হওয়া যখন তোমার কপালে নেই, এবার বিয়ে করে সংসারী হও।
রবি মাথা নিচু করে নিরুত্তর বসে থাকলেন। তার মোটেই একটি নিরক্ষর বালিকাকে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। কিছুদিন বাবার কাছে কাটিয়ে ঘরে ফিরে এলেন তিনি।
শুরু হয়ে গেল রবির পাত্রী খোঁজার তোড়জোড়। জ্ঞানদার ইচ্ছে রবির উপযুক্ত বউ খুঁজে আনবেন তিনিই, তারপর তাকে ঘষেমেজে বিবির সঙ্গে কনভেন্ট স্কুলে পাঠাবেন। কাদম্বরীর আবার কনভেন্ট-চর্চায় আস্থা নেই, তিনি চান রবির বউকে কাব্যসাহিত্যের পাঠ দিতে। এবার আর দাসী পাঠিয়ে বউ খোঁজা হবে না, বউঠানেরা নিজেরাই রবির পাত্রী খুঁজতে যাবেন ঠিক করলেন। ঠাকুরবাড়ির ইতিহাসে এ এক নতুন ঘটনা।
এক ধনী মাদ্রাজি জমিদারের মেয়ের সঙ্গে রবির বিয়ের প্রস্তাব এল, মেয়েটি সাতলক্ষ টাকার উত্তরাধিকারিণী। দল বেঁধে জ্যোতি, জ্ঞানদা, কাদম্বরীরা রবিকে নিয়ে চললেন পাত্রী দেখতে। জমিদারগৃহে প্রথমেই দুটি অল্পবয়সি মেয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করতে এলেন। তার মধ্যে রূপসি, তুখোড় মেয়েটিকে সবার মনে ধরল। গান নিয়েও অনেক আলাপ করলেন মেয়েটি। চুপচাপ, সাধাসিধে অন্যজন সবার অলক্ষ্যে দামি কাপড়ে জড়ানো পুঁটুলির মতো বসে রইলেন। এরপর ঘরে এলেন গৃহকর্তা জমিদারমশাই। মদ্রজা রূপসিটিকে দেখিয়ে বললেন, আলাপ করিয়ে দিই, হিয়ার ইজ মাই ওয়াইফ। আর জড়ভরত মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন, হিয়ার ইজ মাই ডটার। অতিথিরা কোনওরকমে এ ওর সঙ্গে চোখাচোখি করে ভদ্রতা বজায় রাখলেন আর বাড়ি ফিরে হাসিতে ফেটে পড়লেন।
আহা, রবির খুব মনে ধরেছিল জমিদারগিন্নিকে, হেসে গড়িয়ে পড়েন কাদম্বরী। জ্ঞানদাও হাসিতে যোগ দিয়ে বললেন, এবার দেখছি আর ঝুঁকি না নিয়ে রবির জন্য মৃণালিনী খুঁজতে যশোরেই যেতে হবে।
জ্যোতিও হাসতে হাসতে বলেন, হ্যাঁ, যশোরের কোনও এক মেয়ে নিশ্চয় রবির জন্য তপস্যা করছে, রবি তাকে উদ্ধার করবে বলে।
জ্যোতি, রবি, জ্ঞানদা, কাদম্বরী সবাই দল বেঁধে জ্যৈষ্ঠমাসের ভ্যাদভ্যাদে গরমে যশোের রওনা দিলেন, সঙ্গে চলল রূপা, বিবি, সুরেন আর দাসদাসী বামুনঠাকুর। আস্তানা নেওয়া হল জ্ঞানদার ভাইদের বাড়িতে। প্রায় প্রতিদিনই চেঙ্গুটিয়া, দক্ষিণডিহি ইত্যাদি আশেপাশের নানা জায়গায় পালকিতে, নৌকোয় কনে দেখার পর্ব চলল। কিন্তু যশোরে এবার যেন পাত্রী কম পড়েছে, কাউকে আর বউঠানদের মনে ধরে না।
জ্যৈষ্ঠের ভ্যাপসানির সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল কিছুদিনের মধ্যেই। এদিককার গ্রামের রাস্তাঘাট কাদামাখা, পিছল। মেয়েরা সাধারণত পালকিতেই যাতায়াত করছেন, কাছাকাছির মধ্যে হলে রবি-জ্যোতিরা পাড়ার অন্য পুরুষদের সঙ্গে পায়ে হাঁটেন। ঠাকুরবাড়ির লোকেদের এমন রাস্তায় চলাফেরা করার অভ্যেস নেই বলেই প্রতিপদে পড়ে যাবার আশঙ্কা।
সেই আশঙ্কাই একদিন সত্যি হল, দক্ষিণদিহি গাঁয়ের এক পাত্রী দেখার অভিযানে পেছল রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে কাদায় আছাড় খেয়ে পড়ে গেলেন স্বয়ং পাত্র। লখনউ চিকনের বাহারি আচকান ও ঢাকাই চাদরে সুসজ্জিত রবির সারা গা কাদায় মাখামাখি। নতুনবউঠানের স্বহস্তে নকশা করা কার্পেটের জুতোজাড়া আর খুঁজেই পাওয়া গেল না। আর কী আশ্চর্য, রবির এহেন দুর্বিপাকে কে একটা মেয়ে যেন আশপাশ থেকে হেসে উঠল। বিব্রত রবির মনে হল, কোথা হইতে এক সুমিষ্ট উচ্চকণ্ঠে তরল হাস্যলহরী উচ্ছ্বসিত হইয়া নিকটবর্তী অশথগাছের পাখিগুলিকে সচকিত করিয়া দিল।
সকলেই রবিকে টেনে তুলতে ব্যস্ত, পেছনের পালকি থেকে বউঠানেরা উঁকিঝুঁকি দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ হাসির উৎস খোঁজারও চেষ্টা করছে। বেচারা রবিরও চোখে পড়ল, একরাশ নতুন ইটের পাঁজার ওপর বসে একটি মেয়ে হাসির চোটে এখনই শতধা হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। একজন ছুটে গিয়ে অপরাধী বালিকাকে ধরে নিয়ে এল।
দেখা গেল লোকটি ঠাকুরবাড়ির কাছারির কর্মচারী বেণী রায় মশাই, আর মেয়েটি তারই বালিকা কন্যা ভবতারিণী। বেণী ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন। গাঁয়ের রাস্তায় হঠাৎ মনিবদের দেখে তিনি যেমন আপ্লুত, কন্যার অশিষ্ট আচরণে তেমনই সংকুচিত। জ্যোতি আর রবিকে তিনি নিজের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য পেড়াপেড়ি শুরু করলেন। বিশেষত, রবিবাবুর পোশাক বদলানো দরকার। ছোটবাবুর উপযুক্ত জামাকাপড় না দিতে পারলেও পরিষ্কার ধুতিচাদর তো বেণী রায় দিতে পারবেন!
জ্যোতি ভেবে দেখলেন, কথাটা ঠিক। রবি এরকম কাদা মেখে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে, এ অবস্থায় তো পাত্রীর বাড়ি যাওয়াও যাবে না। অগত্যা সদলবলে বেণী রায়ের বাড়িতে হাজির হলেন তারা। সেখানে গিয়ে বেণীর মেয়ের কীর্তি সবিস্তারে জানতে পেরে হেসে কুটিপাটি হতে থাকলেন জ্ঞানদা ও কাদম্বরী। তাদের সামনে অবশ্য বেশ সাজিয়ে গুজিয়েই নিয়ে আসা হল ভবতারিণীকে।
মেয়েটি মন্দ নয়, কুটুমবাড়িতে ফিরে তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে বসে কাদম্বরী বলেন, সুন্দরী না হলেও বেশ সরল আর চটপটে মনে হচ্ছে। এর সঙ্গে রবিকে মানাবে ভাল।
জ্যোতি মজা করে বলে ওঠেন, এ-সব আশ্চর্য রহস্য কী করে বোঝ তুমি বউ? এ মেয়ের চেয়ে রূপসি কি রবির জুটবে না মনে কর?
জ্ঞানদাও খুঁতখুঁত করেন একটু, আর কটা মেয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নিলেই হবে। ভবতারিণী তো গানও জানে না, লেখাপড়াও না!
কাদম্বরী একমত হন না, ও-সব শিখিয়ে নিলেই হবে, ঠাকুরবাড়ির বউরা আবার কবে কী শিখে এসেছে, জোড়াসাঁকোর পাঠশালাতেই আমাদের সব শিক্ষা।
জ্যোতি জানতে চান, এত মেয়ে দেখে শেষে একেই কী দেখে তোমার এত ভাল লাগল বলো তো? রবিকে বেকায়দায় ফেলেছে বলে?
কাদম্বরী বলেন, কেন দেখছ না, এ মেয়েটি অন্যদের মতো গেঁয়ো নয়, লজ্জায় একেবারে জড়ভরত হয়ে বসে থাকে না, সহজভাবে কথা বলতে পারে। একে বেশ শিখিয়ে পড়িয়ে মনোমতো করে গড়ে নেওয়া যাবে।
আসলে রবির সুন্দরী বউ আসুক কাদম্বরী তা চায় না, জ্ঞানদা হাসতে হাসতে ঢিল ছুড়লেন, বউ বেশি সুন্দরী হলে রবি তার নতুনবউঠানকে ভুলে যায় যদি!
জ্ঞানদার বাক্যবাণে কাদম্বরীর মনে লাগে। কী কুটিল মেজোবউ! তিনিও জবাব দিতে ছাড়েন না, তা কেন বলছ মেজদি, রবির বউয়ের সঙ্গে আমার কোনও প্রতিযোগিতা নেই। সে হবে আমার অতি আদরের। আমি যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছি, তা যেন তাকে সইতে না হয়।
এবার জ্ঞানদার গায়ে হুল ফোটে যেন, শোনো নতুনবউ আমি যা যা। করেছি, আমি যা সয়েছি, তা তুমি সাতজন্মেও পারবে না।
রবি এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন, এবার আর পারেন না। বলে ওঠেন, দোহাই তোমাদের বউঠান, আবার শুরু কোরো না! এরকম করলে তো আমি বিয়েই করব না। বরং ভাবছি, এই মেয়ে দেখা কাণ্ড নিয়ে একটা গল্প লিখে ফেলব।
কাদম্বরী হাসতে হাসতে বলেন, শোনো রবি, তোমার সেই গল্পে পাত্রের কাদায় পড়ে যাওয়ার কথাটা লিখতে ভুলো না যেন!
আর তাই দেখে পাত্রীর খিলখিল করে হেসে ওঠার কথাটাও বাদ দিসনে যেন। জ্যোতি যোগ করেন।
তারপরেই কাদম্বরীর পিঠে হাত রেখে বলেন, শোনো বউ, তোমার এ মেয়েটাকে পছন্দ হয়েছে, ভাল কথা। আর দু-একটা মেয়ে দেখলে যদি মেজোবউঠানের শান্তি হয় তাতেই বা আপত্তি কীসের? তারপর না হয় ভাবা যাবে। রবির মতামতটাও তো শুনতে হবে আমাদের।
ঘন মেঘের মতো পরিবেশটাকে একটু হালকা করার জন্য রবি বলেন, না বউঠান, আমার আর বিয়ে করার জন্য তর সইছে না, গান না জানুক, লেখাপড়া শিখুক না শিখুক, কাল সকালে উঠে যে মেয়েকে দেখবে তার গলাতেই ঝুলিয়ে দাও আমাকে। আর পণ্ডিতেরা তো স্ত্রীলোককে লেখাপড়া শেখাতে বারণ করেন, ঘরের বউ একবার নাটক-নভেল পড়া ধরলে তার সংসারধর্ম নাকি লাটে ওঠে!
কাদম্বরী হাত বাড়িয়ে চুল ধরে নেড়ে দিয়ে বলেন, দাঁড়াও, তোমার পণ্ডিত ভজনার ফল দেখাচ্ছি।
রবির হাতে একটি পত্রিকা, তিনি হাসতে হাসতে সরে গিয়ে বলেন, দেখো জ্যোতিদাদা, সেই তোমার লাজুক বালিকাবউটি লেখাপড়া শিখে কেমন মারমুখি হয়ে উঠেছে। ঠিকই লিখেছেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, শোনো, পড়ে শোনাই, ছেলেরা ইংরাজী শিখিয়া সাহেব হইয়াছেন, মেয়েরা ইংরাজী না শিখিয়াই বিবি হইতে বসিল। গৃহ এবং গৃহোপকরণ অপরিচ্ছন্ন থাকে, খাওয়া দাওয়া খারাপ হয়, শরীর মাটি হইয়া যায়…–
ইস, তাই বইকী! কাদম্বরী ফুঁসে ওঠেন, লেখাপড়া না শিখলে পরিচ্ছন্নতা ব্যাপারটাই বোঝা যায় না, এটা তোমাদের ভূদেববাবুকে সামনে পেলে বুঝিয়ে দিতাম।
জ্ঞানদাও হাসতে হাসতে যোগ দেন, ভূদেববাবুদের জন্যই এ দেশের মেয়েদের উন্নতি আটকে আছে। ওঁদের একবার বিলেতে ঘুরে আসার দাওয়াই দেওয়া দরকার, তা হলে দেখতে পেতেন শিক্ষিত মেয়েরা ঘরকন্না করবে না– এ ধারণা কত ভুল। বরং ওদের কাছেই আমরা গুছিয়ে সংসার করার পাঠ নিতে পারি। রবি একটু কড়া করে এ-সব লেখার জবাব দিতে পার না!
জ্যোতিরিন্দ্র হাসতে থাকেন, রবিকে বলছ মেজোবউঠান, রবি সেই যে বিলেতের মেয়েদের ভূরি ভূরি প্রশংসা করে ভারতীতে লিখেছিল, তাই পড়েই তো বাবামশাই ভয় পেয়ে গেলেন, রবি না আবার মেম বিয়ে করে বসে! সেজন্যই রবিকে মাঝপথে পড়া থামিয়ে দেশে ফেরার হুকুম দিলেন। আবার ওকে লিখতে বলছ!
রবি হাসতে হাসতে বললেন, আমাকে লিখতে হবে কেন, এখন তো তোমাদের মধ্য থেকেই সরস্বতী বীণাবাদিনীরা বেশ প্রতিবাদ করে লিখছেন, আমাদের ভারতীতে লাহোরিণীর লেখাই বা কম কীসে?
সেই লেখার জন্য শ্বশুরবাড়িতে ওকে অনেক নিমেন্দও শুনতে হয়, কাদম্বরী বলেন। অথচ ও তো সত্যি কথাই লিখেছে। মেয়েদের পোশাক আশাক কী রকম হবে তা কেন পুরুষেরা ঠিক করে দেবেন?
জ্ঞানদা কাদম্বরীর দিকে তাকিয়ে বলেন, আচ্ছা, নতুনবউ, তুমি ভাবো তো, যে রবি বিলিতিবালাদের দেখে এত মুগ্ধ হয়েছিল, তার এখন এই গ্রামবাংলার ভবতারিণীকে কি পছন্দ হবে? রবি আবার ভবতারিণীর পোশাক ডিজাইন করতে চাইবে না তো?
তা হলে আর তুমিই বা কেন গ্রামবাংলায় ছুটে এলে মেজোবউঠান? রবি কাদম্বরীকে বাঁচাতে চান, আমার বিয়ের জন্য সরাসরি বিলেতের গোরিমেম খুঁজলেই পারতে!
তা হলে তোমার ভবতারিণীকে খুব পছন্দ হয়েছে বলো? জ্ঞানদা গোমড়া মুখে বললেন, তোমাদের দেওর-বউঠানের যখন এত পছন্দ, তা হলে আমিই বা মেয়ে খুঁজে মরি কেন? যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর!
কিংবা বলা যায়, যার বিয়ে তার হুশ নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই। জ্যোতি ফোড়ন কাটেন, মেজোবউঠান, তুমি বরং ভবতারিণীকে বেশ করে সর-ময়দা মাখানোর ব্যবস্থা কোরো, যেমন মা তোমাদের মাখাতেন!
মুখ দেখে রবি বুঝতে পারেন মেজোবউঠান চটেছেন। দুই জায়ের মন কষাকষিতে তিনি যে কাদম্বরীর পক্ষ নিয়ে ফেলেছেন! তাড়াতাড়ি জ্ঞানদার পায়ের কাছে বসে পড়ে মানভঞ্জনের জন্য তিনি বলেন, হে দেবী, তুমি ক্রুদ্ধ হলে সামান্য এই মানবসন্তান আর বিয়েই করবে না। এই দুষ্টু বালিকাকে বিয়ে করতে আমার বয়েই গেছে। বিয়েতে কাজ নেই, তার চেয়ে চলো যশোরের ভ্যাপসা গ্রামপথ ছেড়ে আমরা সেই মেঘাচ্ছন্ন ব্রাইটন ভিলায় ফিরে যাই।
.
যশোরের পথে আচমকাই একদিন রবি ও জ্যোতির দেখা হয়ে গেল হ্যারিসাহেবের সঙ্গে। চুল উসকোখুসকো, উদাস উদাস ভাব। তাঁর সঙ্গে আরও উসকোখুসকো একটি কিশোর। জানা গেল সে ছেলেটি স্বদেশি করে। হ্যারি এই স্বদেশি দলটার সঙ্গে খুব জড়িয়ে পড়েছেন। তাঁরা গ্রামের মানুষের। সাহায্য সমর্থনও জোগাড় করতে চান।
হ্যারিকে নিয়ে রবি জ্যোতিরা কুটুমবাড়িতে পৌঁছতেই রূপা কোথা থেকে দেখতে পেয়ে ছুটে এল, হ্যারিকে দেখে তার আনন্দ আর ধরে না। হ্যারি যেভাবে এদেশের স্বরাজের জন্য স্বদেশিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, তাতে গর্বে বুক ভরে ওঠে রূপার। কিন্তু এত লোকের মাঝে কোনও কথাই বলা সম্ভব নয়, আর পাড়াগাঁয়ে পুরুষের সঙ্গে কথা বলায় আরও কড়াকড়ি। দু-একটি কথা বলেই কাদম্বরীর রক্তচক্ষুর ভয়ে ভেতরে চলে যেতে হল তাকে।
চা-জলখাবার দেওয়ার অছিলায় রূপা আরও একবার বৈঠকখানাঘরে এল। হ্যারি একটি চিরকুট গুঁজে দিলেন তার হাতে। দুরুদুরু বুকে রূপা চিরকুট নিয়ে সোজা পুকুরপাড়ে চলে যায়, খুলে দেখে কাল দুপুরে পাড়ার পোডোমন্দিরের পেছনে দেখা করতে বলেছেন হ্যারি। রূপার রক্তে বিপ্লবের ছোঁয়া লাগে।
আরও যে কদিন ঠাকুর পরিবার যশোরের কুটুমবাড়িতে রইলেন, রূপা আর হ্যারির গোপন অভিসার ততদিনই চলতে লাগল। প্রেমের ঘোড়া যত ছুটল ততই বেগবান হয়ে উঠল ওদের বিপ্লবের স্বপ্ন। হ্যারির ঝুলি থেকে বেরনো লালশালুতে মোড়ানো গীতার ওপর হাত রেখে, অজানা ভবিষ্যতের তোয়াক্কা না করে, পোডোমন্দিরের ভাঙা সিঁড়িতে বসে ওরা আজীবন পাশে থাকার শপথ নিল।
ওদিকে, সারা যশোর চষে ফেলেও ভবতারিণীর চেয়ে পছন্দসই কোনও মেয়ে খুঁজে পেলেন না জ্ঞানদা। অগত্যা বেণী রায়ের মেয়ের সঙ্গেই রবির বিয়ে দেওয়া হবে, মোটামুটি এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যশোর ছাড়লেন ঠাকুর পরিবার। রূপাও চোখের জলে হ্যারির কাছে বিদায় নিল।
রবি অবশ্য জোড়াসাঁকোয় ফিরে বিয়ে নিয়ে ফের দোনোমনো করছিলেন। জ্যোতির কাছে খবর পেয়ে দেবেন ঠাকুর জরুরি তলব করলেন রবিকে মুসৌরিতে। এবার ট্রেনের সেকেন্ড ক্লাসে রবির সঙ্গী হল বিবি আর সুরেন। প্রিয় দুই বালক বালিকার সঙ্গে অনর্গল গান, কথা, দুষ্টুমি, খুনসুটিতে রবির যাত্রাপথটি বেশ ছেলেমানুষি রোমাঞ্চে ভরে উঠল। এ-যাত্রায় তাদের সঙ্গে কোনও দাসীচাকর ছিল না। তাই খাওয়াদাওয়ার পর কখনও ট্রেনের টয়লেটে গিয়ে এঁটো বাসন ধুতে হচ্ছে বিবিকে আর কখনও সুরেন গিয়ে খাবার কিনে আনার চেষ্টা করছে। জীবনের এ-সব অনিবার্য শিক্ষার মধ্যে দিয়েই তারা স্বাধীনতা উপভোগ করছে।
এবারে মহর্ষি বিয়ে না করার জন্য রবিকে ধমক দিলেন। এভাবে বসে থাকলে চলবে না, সংসারী হয়ে পারিবারিক কাজকর্মে মনোযোগ দিতে হবে, জমিদারির কাজ শিখতে হবে। এরপর আর রবির কোনও আপত্তি টেকেনি, ঠাকুরবাড়ির সরকারি খাতায় রবিবাবুর বিয়ের হিসাব লেখা শুরু হয়ে গেল। যশোরে দূত পাঠিয়ে পাকা কথার সঙ্গে আশীর্বাদী পাঠানো হল হিরের গয়না ও পুতুল।
.
শহর কলকাতা তখন আদালত অবমাননার দায়ে সুরেন্দ্রনাথের দুমাসের কারাবরণ ও মুক্তির তামাশা নিয়ে উত্তাল। মুক্তির পর তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হল নিমতলার ফ্রি চার্চ কলেজে। দেশপ্রেমের জোয়ারে ছাত্রদল ও তরুণেরা সুরেন্দ্রনাথকে মাথায় তুলে নিল। জনসভায় রবি সুরেন্দ্রনাথের জন্য কয়েকটি নতুন গান গাইলেন।
কিন্তু রবির কোনও লেখায় ঘটনার উল্লেখমাত্র না দেখে অনেকেই ভুরু তুললেন। বিশেষত পরিবারের মধ্যে থেকেই স্বর্ণকুমারী প্রশ্ন করলেন, রবি তোর কিন্তু সুরেন্দ্রনাথের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করে লেখা উচিত ছিল!
রবি বিরক্ত হন, নদিদি, তোমার আর আমার ভাবনা যে সব সময়ে এক হবে এটা ধরে নিচ্ছ কেন? ওঁর জন্য গান লিখে গাইলাম তো, আবার প্রতিবাদ করে লিখতে হবে তার কী মানে আছে? কোনওকিছুতেই এত বাড়াবাড়ি আমার পছন্দ নয়।
কট্টর জাতীয়বাদী জানকীনাথ এ ব্যাপারে অতি উৎসাহী। জানতে চান, কেন রবি, বাড়াবাড়ি কীসে দেখলে?
রবি হাসেন, এই যে তোমাদের বাচ্চা মেয়ে সরলা আর তার বন্ধুদের এমন দেশপ্রেম জেগেছে যে এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রোজ কালো ফিতে হাতে বেঁধে স্কুলে যাচ্ছে, এটা বাড়াবাড়ি না? ওরা পলিটিকসের কী বোঝে? আমি তো শুনেছি, বেথুনের উঁচু ক্লাসের ওর দুই মন্ত্রদাত্রী কামিনী রায় ও অবলা বসু যা শেখান ওরা অন্ধের মতো তাই অনুসরণ করে। এতে অহেতুক উত্তেজনা ছড়ায় কিন্তু প্রকৃত দেশপ্রেম জাগে না।
স্বর্ণ রুষ্ট হয়ে বলেন, যাই বল রবি, আমি তোর সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। সরলা এর মধ্যে এত কাণ্ড করেছে জানতাম না ঠিকই, কিন্তু শুনে আমার রীতিমতো গর্ব হচ্ছে।
কিন্তু এ-সব বাড়াবাড়িতে আমার মন সায় দেয়না। ছাত্রসমাজের কাছে জাতীয়তা যেন গভীর উপলব্ধি না হয়ে নিছক হুজুগ হয়ে উঠছে। আর এই উপলক্ষে বাংলা সংবাদপত্রগুলি যেভাবে রুচিহীন ইংরেজ-নিন্দায় মেতে উঠেছে তাও তো অসহ্য। ভদ্রলোকের তিরস্কারই বা ভদ্রভাষায় হবে না কেন? রবি প্রশ্ন তোলেন।
স্বর্ণ ও জানকী নিজেদের কাজের বাইরে সারাদিন মেতে থাকেন জাতীয়তা আর থিওসফির চর্চায়। দুটো বিষয়ের মধ্যে কোনও সম্বন্ধ নেই, কিন্তু দুটিতেই স্বামী-স্ত্রীর সমান উৎসাহ। একদিকে জানকীর কংগ্রেসি রাজনীতি আর অন্যদিকে থিওসফিকাল সোসাইটির পরলোকচর্চা।
মহিলা থিওসফিকাল সোসাইটির সভাপতি হয়েছেন স্বর্ণ। তাঁর কাশিয়াবাগানের বাড়িতেই জড়ো হন সবাই, যেসব মহিলাদের স্বামী বা বাড়ির পুরুষরা থিওসফিস্ট তারাই সদস্যা। কলকাতার অভিজাত পরিবারগুলির অনেক মহিলার সঙ্গে এভাবে বন্ধুত্ব হয়েছে স্বর্ণকুমারীর। থিওসফিকাল সোসাইটির দুই প্রতিষ্ঠাতা মাদাম ব্লাটাভস্কি ও কর্নেল অলকট প্রায়ই আসেন। তারা মেয়েদের দীক্ষা দেন, মহিলারা তাঁদের স্থান দেন ভগবানের পরেই।
একদিন রবি গিয়ে দেখলেন সবাই হলঘরে বসে আছেন। অলকট সাহেব কী একটা কথা বলতে বলতে শো করে হলঘরের পাশের শোবার ঘরে চলে গেলেন, দু-এক মিনিট পরে ফিরে এসে বললেন যে, মহাত্মা কুথোমির আবির্ভাব হয়েছিল ওই ঘরে, তিনি তার বার্তা শোনার জন্য ডাক পাঠিয়েছিলেন অলকটকে, শুনিয়ে চলে গেছেন।
উপস্থিত মহিলারা বিস্ময়ে আনন্দে শিউরে উঠলেন, স্বর্ণ যেন দিব্যবিভায় আলোকিত হয়ে উঠলেন। মহাত্মা কুথোমির অলৌকিক আবির্ভাবে পবিত্র হয়ে গিয়েছে তার ঘরবাড়ি। তার বড় মেয়ে হিরন্ময়ী তো দীক্ষিত হয়েছেই, পরিবেশে এমন অপার্থিব আবেশ তৈরি হয়েছে যে বাচ্চা সরলাও আবদার করতে লাগল দীক্ষা নেওয়ার জন্য। রবি নিজেও একটু-আধটু পরলোকচর্চা করেন, প্ল্যানচেটে তার তীব্র আগ্রহ। কিন্তু থিওসফিকাল সোসাইটির এই আবহ তার কাছে ভাঁওতাবাজি মনে হল। নদিদি কী করে এ-সবের মধ্যে ডুবে গেলেন কে জানে! ক্রমশই তার সঙ্গে রবির মনের অনেক দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। তিনি কাশিয়াবাগান থেকে নিঃশব্দে পালিয়ে এলেন।
আরেকপ্রস্থ হইচই শুরু হল কারোয়ারে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে। কাশিয়াবাগানে আর জোড়াসাঁকোর বৈঠকখানায় দরজি বসেছে। নানারকম পোশাক সেলাই করতে। কাদম্বরী স্বর্ণকুমারীরা নতুন নতুন ডিজাইনের জ্যাকেট করতে দিয়েছেন। ঠাকুরবাড়ির একটা বড় দল মিলে কারোয়ার বেড়াতে যাওয়া ঠিক হয়েছে। সদর স্ট্রিটের দল অর্থাৎ জ্যোতি, রবি ও কাদম্বরী, কাশিয়াবাগান থেকে জানকী ও স্বর্ণকুমারী, জোড়াসাঁকোর সৌদামিনী ও প্রতিভা সবাই যাবেন। কর্নাটকের পাহাড় ঘেরা এই অপরূপ সমুদ্রশহর এখন সত্যেনের কর্মস্থল।
রবির মনে আসন্ন বিয়ের চাপ। পারবেন কি মানিয়ে নিতে? সমুদ্রতীরে হাঁটতে হাঁটতে কাদম্বরীর কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে ফেলেন তিনি, কোথাকার কোন এক বালিকা এসে জীবনটাকে বদলে দেবে! সেই ভীরু গ্রামবালিকার সঙ্গে কী কথা বলব নতুনবউঠান?
সমুদ্রের ঢেউ এসে প্রবল কোলাহলে আছড়ে পড়ে রবির পায়ের কাছে, যেন তারা রবিকে আশ্বাস দিতে চায়।
প্রথম সমুদ্র-দর্শনে এসে কাদম্বরীর মন খুশি খুশি। তিনি রবির গালে টোকা দিয়ে বলেন, আহা, বউয়ের সঙ্গে কী কথা বলবে তা আবার শিখিয়ে দিতে হবে নাকি? ও তো সরলা ইন্দিরাদের বয়সি, ওদের সঙ্গে এত কথা বল আর বউয়ের সঙ্গে পারবে না?
না বউঠান, তুমি বুঝতে পারছ না, রবির গলায় উদবেগ, কথা বলার আগে তো তাকে সব শিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করে নিতে হবে! আমার এত সময় কোথায়? বিবি, সরলা তো আমাদের মেয়ে, আমাদের বাড়ির আবহাওয়ায় বড় হয়েছে। তাদের সঙ্গে সেই বালিকার তুলনা?
সে তো হবেই। কাদম্বরী বলেন, শোবার ঘরের সেই শিক্ষানবিশিটাই তো সবচেয়ে রোম্যান্টিক। আমি তো প্রথম প্রথম সারাদিন অপেক্ষা করে থাকতাম সেই পাঠশালার জন্য, কখন তোমার নতুনদাদা এসে আমাকে মেঘদূত পড়াবেন, কখন গান শেখাবেন পিয়ানো বাজিয়ে!
বহুদিন আগে হঠাৎ দেখে ফেলা জ্যোতিদাদা ও নতুনবউঠানের একটি ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের স্মৃতি মনে পড়ে রবির বুকে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। আকুল হয়ে কাদম্বরীর দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, তখন আমাকে তোমরা কোনও গুরুত্ব দিতে না, আমার খুব ঈর্ষা হত জানো! আমার বউ এলে তুমি দূরে চলে যাবে না তো, নতুনবউঠান?
হাঁটতে হাঁটতে ওঁরা অনেক দূর চলে এসেছেন, যেখানে গিরিবন্ধুর উপকূলরেখার মধ্য দিয়ে সমুদ্রের সঙ্গে এসে মিশেছে শীর্ণতোয়া কালানদী। একটু পেছনেই শোনা যাচ্ছে বিবি ও প্রতিভার সোনাঝরা গলার গান, স্বর্ণ সৌদামিনী-জ্ঞানদার কলকাকলি। তীরে বসে পড়ে বালি নিয়ে খেলতে থাকেন কাদম্বরী। রবিও বসে পড়েন পাশে, বালুচরে আঁকিবুকি করতে করতে কী যেন লিখছেন। কাদম্বরী মুখ বাড়িয়ে দেখেন বালির অক্ষরে লেখা, হেকেটি ঠাকরুন।
বিষণ্ণ মুখ তুলে তিনি বলেন, এবার তুমি হেকেটিকে ভুলে যাবে রবি, এখন যে অন্য কোনও ঠাকরুন আসছেন!
কী বলছ বউঠান, রবি আঁতকে ওঠেন, তোমার জন্য আমি বিলেত যাওয়া বাতিল করেছি, তোমার জন্য মেজোবউঠানের শত ডাকাডাকিতেও তাঁর বাড়ি থাকতে যাই না, তোমার দু নয়নে উৎসর্গ করেছি আমার রাশি রাশি কবিতা। কাদম্বরীর হাতদুটি বালি থেকে তুলে নিয়ে নিজের হাতে চেপে ধরেন রবি।
হইচই করে ছুটে এসে ওঁদের জড়িয়ে ধরে বিবি ও প্রতিভা। পেছনের বড়দের দলটিও পৌঁছে যায়। বালির ওপর গোল হয়ে বসে শুরু হয় অন্য এক আড্ডা।
কাদম্বরীর দিকে রবির বাড়তি মনোযোগ জ্ঞানদা লক্ষ করেন। কী এত কথা ওদের? কাদম্বরী যেন দিনদিন গ্রাস করে ফেলছে রবিকে। কাঁচা মাথা চিবিয়ে খাচ্ছেন হেকেটি ঠাকরুন। বলেই ফেলেন তিনি, তোমরা অমন আলাদা হয়ে যাও কেন রবি? আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বুঝি একেবারেই ভাল লাগে না?
অমন অন্যায় অভিযোগ কেন মেজোবউঠান, রবি বলেন, আমার আর নতুন বউঠানের হাঁটার জোর একটু বেশি, তাই বুঝি রাগ করেছ?
শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা কোরো না রবি, জ্ঞানদা ছাড়বার পাত্রী নন, আসলে কাদম্বরী আমার সঙ্গে মিশতে দিতে চায় না, ওর কান্নাকাটির ভয়েই আমার বাড়িতে তুমি থাকতে পার না। ব্রাইটনে থাকতে তুমি আমাদের সঙ্গে কত গল্প করতে!
সৌদামিনী সকলের দিদি, তিনিই এখন জোড়াসাঁকো বাড়ির গৃহকত্রী, সবাইকে নিয়ে চলতে চান। জ্ঞানদাকে থামিয়ে আস্তে করে বললেন, আঃ মেজোবউ।
কাদম্বরী কিন্তু চুপ করে থাকতে পারলেন না, দেখছ তো বড়ঠাকুরঝি, মেজদি কেমন করে বলছেন! এজন্যেই তো আলাদা আলাদা হাঁটছিলাম। আমার ঘরে শান্তি নেই, সমুদ্রের ধারে এসেও কি দুদণ্ড শান্তি পাব না?
স্বর্ণকুমারী সকলের মধ্যে থেকেও উদাসিনী। সমুদ্রের দিক থেকে মুখ না ফিরিয়েই তিনি বলেন, এত উদার, বিশাল জলরাশির সামনে দাঁড়িয়েও তোমরা এমন তুচ্ছ বিষয়ে কথা বলছ কেন!
কোনও কিছু ভাল লাগে না কাদম্বরীর। পেছন ফিরে সমুদ্রের ধার দিয়ে জোরে হাঁটতে থাকেন। বিবি প্রতিভারা লঘু পায়ে তার পেছনে দৌড়য়। বাধা হয়েই রবি জ্ঞানদা সৌদামিনী স্বর্ণকুমারীরাও তার পিছু পিছু বাংলোর দিকে ফিরতে শুরু করেন। সারাটা রাস্তায় সমুদ্র গর্জন করে এই অশান্তির প্রতিবাদ জানায়।
জজসাহেব সত্যেনের এই বাংলোটি খাঁটি বার্মাটিকে তৈরি বিশাল প্রাসাদের মতত। সমুদ্র প্রতি মুহূর্তে পায়ের কাছে ছলাৎ ছলাৎ সেলাম জানিয়ে যায়। নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় শুধু জলধ্বনির মাঝে নিঝুম বসে থাকেন জ্যোতিরিন্দ্র। মায়াবী সমুদ্রের ধরা না দেওয়া ভঙ্গি দেখে তার তীব্রভাবে বিনোদিনীর মুখ মনে পড়ছে। মুখ, চোখ, স্তন, কোমর সব স্মৃতিপটে ভেসে উঠে যেন আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তার সেই অনিন্দ্যসুন্দর অঙ্গে শয়তান গুরমুখের থাবা পড়েছে। তার মনেও কি সে জায়গা পেয়েছিল? এই অপরূপ সমুদ্রতীর, এই তারাখচিত রাত্রি কিছুই যেন মনে ছাপ ফেলে না জ্যোতির, তার এখুনি ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে বিনোদিনীর কাছে। মাইল মাইল দূরত্ব পেরিয়ে, সমুদ্রের নোনা বাতাস ভেদ করে বিনোদের শরীরের ঘ্রাণ নাকে এসে পাগল করে তোলে জ্যোতিকে।
জ্ঞানদারা ফিরে এসেও দেখলেন জ্যোতি মুখ নিচু করে নিঝুম বসে আছেন। রবি ও জ্ঞানদা তার দুপাশে এসে বসেন।
ঈষৎ উদবিগ্ন জ্ঞানদা জ্যোতিকে আদর করে কাঁধে হাত রেখে জানতে চান, কী হয়েছে নতুনঠাকুরপো, মন খারাপ? আমাদের সঙ্গে এলে না কেন?
জ্যোতি চুপচাপ মেজোবউঠানের কাঁধের ওপর মাথা রাখেন। সমুদ্রের ঢেউ যেরকম বাংলোর সিঁড়িতে এসে টোকা মারে, জ্যোতির কপালের ওপর সেরকম মায়াবী টোকায় শুশ্রূষা করতে চায় জ্ঞানদার আঙুলগুলি।
নীরবতা ভেঙে রবি হঠাৎ মেজোবউঠানের দিকে আঙুল তুলে গেয়ে ওঠেন, হেদে গো নন্দরানী/আমাদের শ্যামকে ছেড়ে দাও
রবি দু-তিনবার গাওয়ার পরেই গান-পাগল ভাইঝিরা তার সঙ্গে গলা মেলাতে শুরু করে। নতুন গান তুলে নেওয়ার আশ্চর্য গুণ আছে ওদের। প্রবির কিন্নরকণ্ঠের সঙ্গে বিবি আর প্রতিভার রিনরিনে সুরেলা গলা মিশে উদ্বেগভরা সন্ধেটা আবার মনোরম হয়ে ওঠে।
.
কিছুদিনের মধ্যেই জোড়াসাঁকো থেকে খবর এল রবির বিয়ের সব ব্যবস্থা পাকা। কার্তিক মাসের শেষের দিকে কারোয়ার থেকেই জাহাজে বোম্বাই এসে রেলপথে কলকাতায় ফিরে এলেন রবি, জ্যোতি ও কাদম্বরী। কী এক বিচিত্র কারণে জ্ঞানদা রবির বিয়েতে যেতে চাইলেন না। সৌদামিনীও কারোয়ারে থেকে গেলেন।
বিয়ে করতেই হবে অথচ বিয়ে নিয়ে রবির দুশ্চিন্তা কমে না। তার মধ্যেই বন্ধু প্রিয়নাথ সেন ও নগেন্দ্রনাথ গুপ্তকে নিজের বিয়ের নেমন্তন্নের চিঠি পাঠিয়ে জানালেন, আগামী রবিবার ২৪শে অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান্ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভবিবাহ হইবেক। আপনি তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬নং যোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহাদি সন্দর্শন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়বর্গকে বাধিত করিবেন। ইতি। অনুগত। শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবির গায়েহলুদ হয়ে গেল সাদামাটাভাবে। তারপরেই ও-বাড়িতে আইবুড়োভাত খেতে যেতে হল মেজোকাকিমার কাছে। মেজোকাকিমা যোগমায়া নিজেও যশোরের মেয়ে, তার ওপর ভবতারিণী তার দূর সম্পর্কের বোন। তিনি তাই এই সম্বন্ধে খুব খুশি।
পাঁচ নম্বর বাড়ির তিন ভাইপো অবন গগন সমরেরাও রবিকা আসছেন বলে উত্তেজিত হয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। সবুজরঙের নকশা করা জমকালো দৌড়দার শাল গায়ে দিয়ে রবি যখন খেতে এলেন, ভাইপো অবনের মনে হল যেন দিল্লির বাদশা এসেছেন। ঘরে থরে থরে অন্নব্যঞ্জন সাজানো, সুচিত্রিত পিঁড়ি পেতে রবিকে বসানো হল। তাকে ঘিরে যত দিদি, বউঠান, কাকিমার দল প্রশ্নের বাণ ছোটাচ্ছেন, কী রে বউ পছন্দ হল?
কী রে রবি, বউ কেমন হবে?
রবি লজ্জায় মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছেন, উত্তর দিচ্ছেন না। মনে মনে তিনিও ভাবছেন, সত্যি তো, বউ কেমন হবে?
রবির বিয়ে হল খুব সাধারণভাবে। রবি এ ঘর থেকে একটু হেঁটে ও ঘরে গেলেন বিয়ে করতে, নিজেরই বাড়ির পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে অন্দরে এলেন। ঠাকুরবাড়ির নিয়মমতো কনেপক্ষকে কলকাতায় এসে বিয়ে দিতে হল, বিয়ে হল জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই।
কোনও ধুমধাম নেই। শুধু দু-একজন বন্ধুবান্ধব। বাড়ির লোকেরা আর শ্বশুরবাড়ির কয়েকজন। রবির বিয়ের সাজ বলতে পারিবারিক একটি বেনারসি শাল, যার যখন বিয়ে হয় তিনি গায়ে দেন বরসজ্জার উপকরণ হিসেবে। রবি এসে দাঁড়ালেন সিঁড়ির ওপরে, কালোডুরে বেনারসি পরা এক আত্মীয় বরণ করে নিলেন তাঁকে।
কনেকে অন্দরে এনে সাতপাক ঘোরানো হলে বরকনে চললেন বাইরের দালানের সম্প্রদানস্থলে। সম্প্রদানে বাড়ির মেয়ে বউরা যায় না, শুধু ছোটরাই সাক্ষী রইল।
বাসরে বসেই রবি নিজের স্নায়বিক উত্তেজনা ঢাকার জন্য ঠাট্টাতামাশা শুরু করলেন। মেয়েরা অনেক যত্ন করে ভাঁড়কুলো খেলার আয়োজন করেছে, বরকনেকে ঘিরে খেলতে বসেছে আর খেলার শুরুতেই রবি সব ভাঁড় উপুড় করে খেলা পণ্ড করে দিলেন। কিছুতেই যেন তাঁর মন বসছে না।
মেয়েবউরা সব হইচই করে ওঠেন। ছোটকাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরী বলে উঠলেন, ও কী করিস রবি? এই বুঝি তোর ভাঁড়খেলা? ভাঁড়গুলো সব উলটেপালটে দিচ্ছিস কেন?
রবি চারদিকে তাকিয়ে নতুনবউঠানকে কোথাও দেখতে পান না। ছটফট করে বলে ওঠেন, কী করব ছোটকাকিমা, দেখছ না, সব যে উলটো পালটা হয়ে যাচ্ছে! আমি তাই নিজেই ভাঁড়গুলো উলটে দিচ্ছি।
কোথায় গেলেন নতুনবউঠান? রবির বিয়ে আর তিনিই নেই? বিয়ের পিঁড়ি ছেড়ে তাকে খুঁজে আনতে চান রবি, কিন্তু পরক্ষণেই বালিকাবধূর ঘোমটা ঢাকা মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবেন এর তো কোনও দোষ নেই! মেয়েরা সবাই তাঁকে গান গাইতে সাধাসাধি করছে। ছোটকাকিমাও। হঠাৎই রবি নববধূর দিকে তাকিয়ে যেন দুষ্টুমি করে নদিদির লেখা একটি গান গেয়ে ওঠেন,
আ মরি লাবণ্যময়ী/ কে ও স্থির সৌদামিনী/
পূর্ণিমা-জোছনা দিয়ে/ মার্জিত বদনখানি!
নেহারিয়া রূপ হায়,/ আঁখি না ফিরিতে চায়,/
অঙ্গরা কি বিদ্যেধরী/ কে রূপসী নাহি জানি।
বেচারি রোগা শ্যামলা গাঁয়ের বধূটি লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে আরও বড় করে ঘোমটা টানেন। কার সঙ্গে তার বিয়ে হল, কোথায় এসে পড়লেন, কিছুই তিনি জানেন না। রবি আরও দু-একটি গান গাইলেন, কিন্তু আসর যেন কিছুতেই জমল না। কোথায় গেলেন জ্যোতিদাদা, কোথায় নতুনবউঠান? মেজদাদা মেজোবউঠানই বা কেন এলেন না, রবি বুঝতে পারেন না। যে বাড়ির খিলানে খিলানে সৃষ্টির উল্লাস ভেসে বেড়ায়, রবির বিয়ের দিনে কেন যেন সেই সুর বাজল না।
বরং একটি দুঃসংবাদ এসে বাড়ির পরিবেশ আরও ম্রিয়মাণ করে তুলল। শিলাইদহে জমিদারির কাজ দেখতে গিয়েছিলেন বড় জামাই সারদাপ্রসাদ, হঠাৎ তার মৃত্যু হয়েছে। সৌদামিনী তখন কারোয়ারে, জ্যোতি তার পাঠালেন গুরুতর অসুস্থতার খবর দিয়ে। দুদিন পরেই তড়িঘড়ি সৌদামিনীকে নিয়ে শোকস্তব্ধ জোড়াসাঁকোয় পৌঁছলেন সত্যেন ও জ্ঞানদা।
শোকের মধ্য দিয়ে অচেনা শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে বালিকাবধূর পরিচয় ঘটল। রবির নামের সঙ্গে মিলিয়ে এ বাড়িতে তার নতুন নাম রাখা হল মৃণালিনী।