মানুষ কি অবস্থার দাস?
ঈশ্বর ভাবে।
অথবা মানুষ অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করে চলে বলে মনে হয় অবস্থাই মানুষকে চালাচ্ছে?
লখার মার সুস্পষ্ট প্রেম নিবেদন গোঁয়ারের মতো প্রত্যাখ্যান করেছে, কিন্তু নিজে সে এমনভাবে বিচলিত অভিভূত হয়ে পড়বে সে তো ভাবতেও পারে নি।
তার নিষ্ঠুরতা লখার মা কিভাবে নিয়েছে–এটাই যেন প্ৰাণান্তকর দুর্ভাবনা দাঁড়িয়ে যায় ঈশ্বরের।
ঘরে গিয়ে কাঁদছে?
কিভাবে প্রতিশোধ নেওয়া যায় ভাবছে? অথবা ব্যাপারটা তুচ্ছ করে শূন্যে উড়িয়ে দিয়ে যেমন ছিল তেমনিভাবে চলছে?
লখার মাকে পুষবার মতো অবস্থা যদি তার থাকত।
প্রেম মেনে নিলে ভরণপোষণের দায়টাও মানতে হবে জেনেই তো সে তার সরল সহজ প্রেম নিবেদন অগ্রাহ্য করেছে।
সবাই ওই কথা বলে।
গৌরীকে কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবার কথা। কিছুদিন বাপের বাড়ির আদর ভোগ করে এলেই গৌরী সামলে সুমলে সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
কিন্তু গৌরী যেতে রাজি নয়।
একদিনের জন্যও যেতে রাজি নয়।
ঈশ্বরের কথা শুনে নয়, খানিকটা নিজের গরজেই লখার মা গৌরীকে বুঝিয়ে রাজি করার চেষ্টা করেছিল।
গৌরীর বিশ্রী মন মেজাজের জন্য বাড়িতে ঈশ্বরের নিদারুণ অশান্তি ভোগের ব্যাপারটা লখার মার ভালো লাগছিল না একটা মানুষের জন্য প্রাণে দরদ জাগলে তার দুর্দশা দেখে মন খারাপ হয়ে যায় বৈকি।
গৌরী বাপের বাড়ি গেলে কিছুদিনের জন্য ঈশ্বর রেহাই পাবে এটাই ছিল লখার মার আসল গরজ।
সে কল্পনাও করতে পারে নি বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করতে গেলে গৌরী এমন রেগে যাবে, গলা ফাটিয়ে পেঁচিয়ে তাকে এতসব অকথা-কুকথা শুনিয়ে দেবে।
লখার মাকে নিয়ে গৌরীর মনে এমন গভীর বিদ্বেষ জমা হয়েছে ঈশ্বরও সেটা ধারণা করতে পারে নি। গৌরী যেন সেটা তাকে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেবার জন্য উঠেপড়ে লাগে।
ঈশ্বরের সঙ্গে লখার মার নাম জড়িয়ে ঠিক বদনাম না রটলেও রসিক মানুষেরা একট হাসি-তামাশা কি আর চালায় না দুজনকে নিয়ে।
তারই জের টেনে গৌরী স্পষ্ট বলে যে, ঈশ্বরের মতলব সে বোঝে তাকে ভাগিয়ে দিয়ে। খালি বাড়িতে দুজনের মনের সুখে বজ্ঞাতি করার মতলব।
রাগ সামলাতে না পেরে ঈশ্বর একদিন তার গালে একটা চাপড় কষিয়ে দিয়ে বলে, খালি বাড়ি মানে? পিসি রয়েছে কুনো রয়েছে
কে কার কথা শোনে।
চাপড় খেয়ে এমন কাণ্ড শুরু করে গৌরী, মাঝে মাঝে একটু বিরাম দিয়ে ঝিমিয়ে নিয়ে দিবারাত্র বাড়িঘর এমনভাবে মাতিয়ে রাখে যে, তাকে শাসন করতে আর সাহস হয় না ঈশ্বরের।
হয় একেবারে খুন করে ফেলতে হয়, না হলে চুপ করে থাকতে হয়।
শাসন করে লাভ নেই।
লখার মা আসে না।
পথেঘাটে দেখা হলে বলে, না বাবা, আর গিয়ে কাজ নেই। এবার গেলে খ্যাক করে কামড়ে দেবে।
আমি কি করি তবে?
পুরুষমানুষ সামলে নাও।
ঈশ্বর মনে মনে হাসে, প্রাণের জ্বালার হাসি।
লখার মাকেও একটা চাপড় কমিয়ে দিয়ে দেখতে সাধ জাগে লখার মা কি করে।
পুরুষমানুষ!
কে জানে সে কি অপরাধ করেছে পুরুষ হয়ে জন্মে!
এদিকে নদীতে নিয়মিত চলাচল শুরু হয় স্টিমারের গৌরী বিয়োয় আরেকটা বাচ্চা।
বাচ্চা বিইয়ে গৌরীর শরীরে এক আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটতে থাকে।
তার মন-মেজাজে নয়–শরীরে।
লখার মা আসে না কিন্তু তার তো দশজনের সঙ্গে কারবার সংসারে চলাফেরার হরেক রকম কায়দা-কানুন জানা আছে।
সে কায়দা করে বলে।
দশজনে শোনে।
দু-চারজন খাতির করে না, পাঁচ-সাতজন তার মান রাখতে ঈশ্বরের বাড়িতে খাদ্য পাঠায় এরকম-ওরকম।
কেউ পাঠায় দু-এক সের চাল।
কেউ পাঠায় এক ভাঁড় ক্ষীর।
কেউ পাঠায় তরিতরকারি, কেউ পাঠায় মাছ।
সবাই তারা গরিব মানুষ তবু নিজের ঘরের টানাটানি অগ্রাহ্য করে পাঠায়।
পিসি মহাসমারোহে রাঁধে।
গৌরী পেট ভরার চেয়ে বেশি করে খায়।
বাচ্চা বিইয়ে খাই-খাই-বাই তার সত্যই বড় বেশিরকম বেড়ে গিয়েছিল।
খাদ্য পেয়েই কি এমনভাবে পুষ্ট হয়ে উঠল গৌরীর শরীর।
হলুদ নদীতে যেমন বান ডাকে, নদী কূলে কূলে পূর্ণ হয়ে বাঁধ ভেঙে চারিদিকে নোনা জলের বন্যা ঘটায়…
ক্ষেতে যেমন বন্যা অনাবৃষ্টির বাধা আর মালিক জমিদার জোতদারদের অনিয়ম অনাচার সত্ত্বেও ফসলের ছড়াছড়ি পড়ে যায়…
বনে যেমন নানা জাতের অসংখ্য গাছ মাটির রস টেনে প্রকৃতির নিয়মে পুষ্ট পরিপুষ্ট হয়ে ফল ফলিয়ে ওঠে…
তেমনিভাবে জোয়ার দেখা দেয় গৌরীর স্বাস্থ্যে।
শুধু যে মোটাসোটা হয়ে ওঠে তাই নয়, সর্বাঙ্গে তার যেন বান আসে, নব-যৌবনের।
কাজের চাপে দায়ের চাপে বিব্রত ঈশ্বরের দেহ মনে আফসোসের অন্ত থাকে না।
তারপর একদিন খবর আসে যে, গৌরীর ছোট বোনের বিয়ে।
উড়ো খবর নয়।
রীতিমতো নিমন্ত্রণ ও আবাহন।
গৌরীর পাগলাটে জ্যাঠা মাখন স্বয়ং এসে ঘরে বসে খবর জানায় ও নিমন্ত্রণ করে যায় দুপয়সা দামের সরু ছোট চিরুনি দিয়ে প্রায়-পাকা লম্বা দাড়ি আঁচড়াতে আঁচড়াতে।
ঈশ্বর শুধু এক ছিলিম তামাক সেজে দেয়–সব কথাতে মাথা নেড়ে যায় দিয়ে যায়। নিজে একটি কথাও বলে না।
পাগলা জ্যাঠা বিদায় নেবার পর গৌরী যেন গালে হাত দেবার ছলে নিজের গাল চাপড়ে বলে, মাগো মা, সুখীর হবে বিয়ে! এই সেদিন দেখে এলাম এইটুকু পুঁচকি, নাকে কাঁদছে মা মা করে তার নাকি বিয়ে! মা গো মা!
ঈশ্বর বলে, পাত্তর মোর জানা লোক! ইস্টিমার ঘাটে খাটে রামনাথ। বয়েস হয়েছে কত তার ঠিক নেই। বুড়ো বয়সে আবার বিয়ে করবে? কি আশ্চর্য কাণ্ড।
বিয়ে করতে দোষ কি?
কিছু না। বিয়ে তো করছে সবাই।
মুখে যাই বলুক, গৌরীর ভাব দেখে ঈশ্বর সত্যই আশ্চর্য হয়ে যায়। একটা বুড়োর সঙ্গে যে ছোট বোনটার বিয়ে হবে সেজন্য গৌরীর কিছুমাত্র মাথাব্যথা নেই বোনের বিয়ে হবে এটাই আসল কথা, একমাত্র কথা।
তারপর বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য গৌরী হঠাৎ যেন একেবারে পাগল হয়ে ওঠে।
জবর খবর রটে যায় যে গৌরী গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে।
গলায় দড়ি দিয়েই মরেছে কিনা সেটা অবশ্য সঠিক জানে না কেউ ড়ো শাড়ির আঁচল দিয়ে, গামছা পাকিয়ে নিয়ে, পুরোনো কাপড়ের জমানো পাড় দিয়ে কিংবা অন্যভাবে বিষটিষ খেয়েও সে আত্মহত্যা করে থাকতে পারে।
তাই নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা ঘামায় না। ঈশ্বরের এখানে গলায় দড়ি না দিয়ে বোনের বিয়েতে বাপের বাড়ি গিয়ে গৌরী আত্মহত্যা করেছে শুনে সকলে একটু দিশেহারা হয়ে যায়, একটু আতঙ্কের ভাব জাগে। কী দুরবস্থাই হয়েছিল ঈশ্বরের এখানে। রোগে শোকে অভাবে অনটনে মাথা বিগড়ে গিয়ে ঈশ্বর দু-একবার তাকে মারধর পর্যন্ত করেছিল। এখানে গলায় দড়ি না দিয়ে বাপের বাড়িতে বোনের বিয়ের উৎসবে কয়েকটা দিন জিরোতে গিয়ে গৌরী গলায় দড়ি দিয়ে বসল!
বনের মধ্যে তাকে নিয়ে অনেকের টানাটানি, হলুদ নদীর খেয়াঘাটে তার খাটুনি, তার চেনা লোকের এটা ওটা দায় চাপানোে–সব গড়িয়ে গিয়ে ঈশ্বরের হয়েছিল বিষম জ্বর। শালীর বিয়েতে নিজের যাওয়ার সাধ্য ছিল না। গৌরীকেও সে যেতে দিতে চায় নি। জ্বরের ঘোরে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করেছিল–শুধু গৌরীকে নয়, তার যে ভাই তাকে নিতে এসেছিল তাকেও। এই অবস্থায় দীনহীনার মতো ভাইয়ের সাথে বোনের বিয়ের উৎসবে গিয়ে লজ্জা দুঃখ অভিমান সইতে পারে নি বলে কি গলায় দড়ি দিবার ঝোঁক চাপল?
তবে মাঝে মাঝে লখার মা আসে, কিছুক্ষণ বসে যায়।
ঈশ্বর তখনন জ্বরে শয্যাগত। থুরথুরে বুড়ি পিসি ছাড়া তার সেবা করারও কেউ নেই।
মাঝে মাঝে রোস্তম আসে, সাধারণ দু-একজন শিকারি আসে, শান সাহেবের সঙ্গে নুরুলও দু-একবার ঘুরে যায়।
কারখানার লোকেরাও আসে কিন্তু তারাও শুধু পাঁচ-দশ মিনিট বসে।
তাদেরও জীবনযাত্রার প্রাণান্তকর ঝঞ্ঝাট, রোগ ব্যারাম বিপদ আপদ।
জ্বরেই হয়তো ঈশ্বর সাবাড় হয়ে যাবে কয়েকদিনের মধ্যে।
সকলে তাই পরামর্শ করে খবরটা চেপে যায়। শয্যাগত মরণাপন্ন মানুষটাকে খবরটা জানিয়ে আর লাভ কি হবে!
কিন্তু বিষমরকম ব্যাপার। মরা এমন সহজ আর বাঁচা এমন প্রাণান্তকর হলে তো জগৎ-সংসারে বাঁচার মানে একেবারে উল্টে দিতে হয় বাঁচার চেয়ে মরাই ভালো এই নীতি মানতে হয়।
তাই, দুদিন বাদেই প্রথম ভাষ্ট্রের শ্বাসরোধকারী প্রমোটের দুপুরে তিন মাসের মেয়েটাকে বুকে নিয়ে এবং কুনোর হাত ধরে গৌরীকে একা গাঁয়ে ফিরতে দিখে সারা গায়ে যেন শিহরণ বয়ে যায়।
মাগো মা, গৌরী, গলায় দড়ি তবে দিস নি তুই!
কি বলছ পাগলীর মতো, গলায় দড়ি দিতে যাব কেন গো?
একটি ফিরে এলি?
এসবোনি? জ্বরে মানুষটাকে কাতর দেখে গিয়েছি, ভাইরা কেউ দিতে এসবেনি, দু-চারদিন না গেলে কারু সময় হবেনি কো। নিজেই এলাম। মানুষটা বেঁচেবর্তে আছে তো সত্যি?
বেঁচে আছে বৈকি।
ডাক্তার কবরেজ দেখানো হয়েছে?
ডাক্তার দেখিয়ে হবে কি! গিয়ে বলে কয়ে ওষুধ এনে দেয়া হয়েছে।
বেশ মানুষ তো তোমরা এদিকে মানুষটাকে নিয়ে কত হৈচৈ, জ্বরে-ব্যারামে মরতে বসেছে, একটা ডাক্তার দেখালে না।
পয়সা-কড়ি কিছু বোধহয় বাগিয়ে টাগিয়ে এসেছে গৌরী বাপের বাড়ি বোনের বিয়েতে নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে–দুপুরে গায়ে ফিরে বিকালেই সে শঙ্কর ডাক্তারকে ঘরে ডেকে পাঠায়।
নগদ আগাম এক টাকা দক্ষিণা দিয়ে।
দেড় টাকা দিয়ে স্বচ্ছ শিশিতে ছ দাগ লালিম কুইনিন মিকারও আনায়।
শঙ্কর ছিল গাঁয়ের সেরা লম্পট আর বিবাণী বদ ছেলে। তার পিছনে অবশ্য ছিল বয়স্ক একজন বজ্জাত। তার একটা বজ্রাতিতে জড়িয়ে পড়ে শঙ্কর দু মাস জেলে গিয়েছিল। জেলে কয়েকটা অসুখে ভুগে মোটমাট কয়েক মাস হাসপাতালে থেকে রোগ ব্যারাম চিকিৎসা সম্পর্কে তার জ্ঞান জন্মেছিল অথবা বাড়িতে দু-একটা ডাক্তারি বই আর পঞ্জিকার বিজ্ঞাপন পড়ে বিদ্যালাভ করে সে বোকা গরিব নিরুপায় মানুষদের চিকিৎসা করার পেশা নিয়েছিল কে জানে।
অন্যরকম দু-চারজন ডাক্তার কবরেজ হাকিম এদিক ওদিক আছে, তারা সকলেই নিজে নিজে চিকিৎসা শেখা বাজে লোক, কিন্তু চালাক চতুর শঙ্করের উপর গৌরীর এত বিশ্বাস কেন তাই বা কে বলতে পারে!
ক দাগ ওষুধ ঈশ্বরের পেটে গিয়েছিল কেউ বলতে পারবে না।
নদেরচাঁদের বৌ হয়তো বললেও বলতে পারত–গৌরী নগদ পয়সা দিয়ে ডাক্তার আনিয়েছে। ওষুধ আনিয়েছে এই খবর শুনে সে একটু বেশি রাত্রে ধার চেয়ে ভিক্ষা চেয়ে কয়েক আনা পয়সা আদায়ের চেষ্টা করতে গিয়েছিল। কথার ছলে দরদ দেখাতে গিয়ে সে কি আর জিজ্ঞাসা করে নি যে, ডাক্তার কি বলেছে, ঈশ্বর ক দাগ ওষুধ খেয়েছে এবং ইতিমধ্যেই ওষুধে কাজ হবার লক্ষণ দেখা গিয়েছে?
কিন্তু ঘরে আর ফিরতে পারল কই নদেরষ্টাদের বৌ!
পাগলা নদীর কাঁচা বাঁধভাঙা মানুষসমান উঁচু ঢল প্রচণ্ড গর্জনে ছুটে এসে খড়কুটোর মতোই তাকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল কেউ জানে না!
হয়তো বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে হলুদ নদীর আসল স্রোতে।
অথবা হয়তো সে গিয়ে উঠেছে সবুজ বনের কোথাও, বন্যা শেষ হবার আগেই সেখানে সে মিলেমিশে শেষ হয়ে যাবে।
নদেরচাঁদের বৌ নাকি ছুটতে ছুটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়েছিল, মুখখামুখি দাঁড়িয়ে কয়েক মুহুর্তের মধ্যে কয়েকবার কপালে হাত ঠেকিয়ে ঢলকে প্রণাম করেছিল পাকা বাড়ির ছাতে দাঁড়িয়ে শম্ভু নিজে নাকি সে দৃশ্য দেখেছিল–গায়ের পাগলাটে স্বভাব-কবি ষাট পেরোনো শম্ভু।
কী তার বর্ণনা সেই দৃশ্যের!–বন্যার আদত ঝঞাট মিটে যাওয়ার পর জেরটা চলতে থাকার সময় পূজামণ্ডপে পূজার উৎসবে আনন্দ করতে সমাগত মানুষগুলির গায়ে কয়েকবার কাটা দিয়েছিল শুনতে শুনতে।
হয়তো নদেরচাঁদের বৌ কয়েক মুহূর্তের অবসরে যুক্ত কর কপালে ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে যতবার ঢলকে প্ৰণাম জানাতে পেরেছিল ঠিক ততবারই গায়ে কাঁটা দিয়েছিল সকলের।
মেঘলা আকাশ ছাড়া ছাড়া ভাঙা ভাঙা মেঘ। কয়েক মুহূর্ত আগে চতুর্দশীর চাদ একখণ্ড মেঘের আড়াল থেকে মুক্তি পেয়ে কঁকা আকাশের খণ্ডটায় এসেছিল। গর্জন করে এগিয়ে আসছে। বাঁধভাঙা জলের তোড়, সেই ফেনিল ভয়ঙ্কর গতিশীলতায় পড়েছে প্রাক্-পূর্ণিমার চাঁদের আলো–সুন্দরতম যেন উন্মাদ হয়ে ছুটে চলেছে। শম্ভুরও নাকি সাধ হয়েছিল প্রণাম করার।
এ-কাঁধে নাতি ও-কাঁধে নাতনিকে নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টায় ভাঙা সিঁড়ি বিয়ে সে ছাতে পালিয়েছিল, দুহাত আটক ছিল ওই দুটো বাচ্চার ভয় কমাতে দুজনকে বুকে চেপে ধরে লেপ্টে রাখার জন্য।
কিন্তু জ্যোত্মায় উদ্ভাসিত মহাসুন্দরের রূপধরা সেই ফেনাময় সর্বনাশকে জগৎ-জীবন কাটিয়ে দেওয়া আওয়াজ তুলে এগিয়ে আসতে দেখে তারও সত্যি নাকি কামনা জেগেছিল, বাচ্চা দুটোকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে দুটি হাত মুক্ত করে নিয়ে অন্তত একবার প্রণাম জানাতে।
ঈশ্বরের মাটির ঘর। প্রথম তোড়েই হেলে পড়েছে। তিন পুরুষের আমকাঠের চৌকিতে শায়িত জ্বরে অজ্ঞান ঈশ্বরকে বুকে তুলে নিয়ে চৌকিতেই উঠে দাঁড়িয়ে সামলাতে হয়েছে বধভাঙা ঢাল-বন্যার প্রথম তোড়।
কুনো আর বাচ্চা মেয়েটাকে বুকে নিয়ে পিসিও দাঁড়িয়েছে চৌকিতে। ভাগ্যে খড়ড়া ঘরের মাটির ভিটেটা অনেক উঁচু করে গাঁথা হয়েছিল—কপুরুষ আগে কে জানে।
নইলে আজ রক্ষা থাকত।
খুঁটি জীর্ণ হয়ে গিয়েছে। হেলে-পড়া চালাটা ঢলে পড়বেই! উঁচু করে গাঁথা মাটির ভিত, তার উপরে তিন পুরুষ আগেকার শক্ত উঁচু চৌকি। সেই চৌকির ওপরে জ্বরে অজ্ঞান স্বামীকে বুকে জাপটে ধরে ঘন অন্ধকারে এক হাঁটু জলস্রোতে দাঁড়িয়ে গৌরী জিজ্ঞাসা করে, কি করা যায় বল তো পিসি?
পিসি বলে, কি আর করা যাবে? এখনকার মতত বাঁচবার চেষ্টা করি আয় তারপর দেখা। যাবে। জল চাদ্দিকে ছড়িয়ে গেলে ভোর তক্ ভিটের কাছে নেমে যাবে সন্দ করি। সেবারও এমনি হয়েছিল।
গৌরী বলে, ভোর তক্ তুই আমি এমনিভাবে সেঁড়িয়ে রইব? এর মধ্যেই মানুষটার ভারে হাত-কঁধ যে টনটন করছে পিসি!
পিসি অভয় দিয়ে বলে, না না, ভোর তক্ রইতে হবে কেন! মোর হাত-কাষ টনটন করছে। না? বাঁধ ভেঙে জল এসেছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে। হাঁটুর ওপরে ছিল, হাঁটুর নিচে নেমেছে দেখছি না? আস্তে আস্তে চৌকির তলে নেমে যাবে।
কুনো কেঁদে উঠলে পিসি ধমক দিয়ে বলে, কাঁদলে জলে ফেলে দেব–চুপ কর।
তারপর গৌরীকে বলে, জল নেমে গেলেও চৌকির উপরটা কাদায় ভর্তি হয়ে থাকবে। চৌকিটা না ধুয়ে কিছু একটা না পেতে মানুষটাকে তো শোয়াতে পারবি নে।
চালাটা কাত হয়ে উল্টে পড়ে যায়।
চতুর্দশীর চাঁদের আলো খানিকক্ষণ আলোকিত করে রাখে তাদের প্লাবিত ঘর। তারপর বর্ষণমুখর মেঘ এসে চাদ ঢেকে তাদের ভিজিয়ে দিতে থাকে।
বুকে জাপানে জ্বরে অজ্ঞান ঈশ্বরের দেহটা জলে ভিজে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে উঠতে চায়।
প্ৰাণপণে তাকে সামলাতে সামলাতে গৌরী পাগলিনীর মতো চিৎকার করে বলে, আয়, পিসি, সবাই মিলে বন্যায় ঝাপিয়ে পড়ি। মরে গেলেই তো ফুরিয়ে গেল।
তারপর তোড় কমে এলে ঢলের জলে ভেসে আসে নৌকা–প্রথম নৌকাতেই আসে লখার মা, রোস্তম, খোলবাজিয়ে নিরঞ্জন, ভূতনাথ এবং আরো দু-একজন।
নৌকা শান সায়েবের। আরো কয়েকজনের বাড়ি উদ্ধার ও সাহায্যের কাজের জন্য যেতে হবে। জলের তোড়টা কমতেই লখার মার তাগিদে সবার আগে নৌকা আসে ঈশ্বরের ভাঙা বাড়িতে।
নুরুল আসে নি কিন্তু সেও বলে দিয়েছে সকলের আগে ঈশ্বরের বাড়ি যেতে হবে।
এই বন্যার মধ্যে আবার যেন আদর দেখা যায় ঈশ্বরের।
বনানীর তাগিদে প্রভাসও ব্যবস্থা করে একটা ছোট নৌকা ঈশ্বরের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
হেলে পড়া চালা দেখে লখার মা চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কোন নৌকায় যাবি লো গৌরী?
কোথা নিয়ে যাবে?
যেখানে উঁচু জমি আছে, যেখানে ঘরবাড়ি খাড়া আছে।
খাড়া কি উঁচু আছে ঘরবাড়ি জমিজায়গা? মানুষটার ইদিকে যায় যায় অবস্থা।
লখার মা এসে গলা চড়িয়ে বলে, বড্ড তুই নরম মানুষ, নইলে এ দশা হয়? চালাটা পড়ে গিয়েছে, উপায় কি? পায়ের নিচের মাটি তত সরে যায় নি। আয় সবাই মিলে ধরাধরি করে মানুষটাকে নৌকায় নামিয়ে আনি। মানুষের আশ্রয় মিলবেই, বন্যা হোক আর ভূমিকম্প হোক।
অসাধারণ একটি উপন্যাস। কেন যে আগে পড়লাম না।এইসব উপন্যাস পড়লে হুমায়ূন আহমেদ ছাই মনে হয়