১৭. মাধবী
০১.
আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া ছিলেন। আমি তার বিশেষ পরিচয় দেব না, পরিচয় দিলে অনেকে চিনেও ফেলবেন। তিনি এখন একা থাকেন, পয়সাপাতি স্বােপার্জিত এবং প্রচুর। দুনিয়া তাকে প্রচুর যন্ত্রণা দিলেও, তিনি খুব আক্ষেপ করেন না। মাঝে মাঝে তির্যক মন্তব্য করেন পুরুষদের ব্যাপারে, কিন্তু তাই বলে নিজেকেও একেবারে অকলঙ্ক চন্দ্রের মতো সাধ্বী-শিরোমণি ভাবেন না এবং নিজের সম্বন্ধে তার এতটাই অহংবোধ ছিল এবং এখনও। আছে যে, শুধুমাত্র পুরুষদের গালাগাল দিয়ে নিজেকে ‘বলি’ বা ‘শিকার’ ভেবে স্তব্ধ হয়েও বসে থাকেন না। এমন মহিলা আমি খুব বেশি দেখিনি, আমার যৌবন-সন্ধিতে আমার চাইতে বেশ খানিকটা বড়, এত সুন্দরী, এত সুরুচিসম্পন্না, এত শিক্ষিত মহিলা আমি খুব কম দেখেছি। একটি বিদেশি কনসুলেট অফিসে ভাল পদেই তিনি কাজ করতেন। এবং আমার সেই বয়সে তার “অ্যাডমায়ারার’দের দেখে আমি স্বস্তি পেতাম না। আমার বয়স তার থেকে অনেক কম হলেও আমার সঙ্গে তার কিছু আত্মীয়নিবন্ধন অহৈতুকী সখ্য ছিল। তবে এটাও ঠিক, তার অনেক খবর পেলেও আরও অনেক খবরই আমি পেতাম না, কিন্তু অন্যান্য ঈর্ষাকাতর আত্মীয়রা তার সম্বন্ধে সত্য, মিথ্যা, কল্পিত অনেক খবর আমাকেই দেওয়ার চেষ্টা করত।
এই আত্মীয়ার প্রধান দোষ ছিল– তিনি অসম্ভব সুন্দরী, অসম্ভব স্মার্ট এবং স্বপ্রয়োজনে তথা পছন্দের মানুষের প্রয়োজনে সীমিত পরিমাণে ফেমিনিটি এক্সপ্লয়েট করতে দ্বিধা বোধ করতেন না। কলেজ-জীবনের পর পরই অতিরিক্ত ‘ফ্লার্টেশন’ ধারণ করতে না পেরে ঝোঁকের মাথায় বিয়ে করে ফেলেছিলেন। সে-বিয়ে বেশি দিন টিকল না, ছেলেটি বড়লোকের ঘরের ছেলে হলেও বেশ ব্যক্তিত্বহীন এবং অতি সুন্দর দেখতে। কেন যে এই বিয়েটা ভেঙে গেল, সেটা বিচার করা খুব মুশকিল কিন্তু তার চেয়েও বেশি কঠিন ছিল এই বিচার– কেন এই বিয়েটা হল? চিন্তনীয় বিষয় ছিল এটাই যে, এই ছেলেকে বিয়ে করার জন্য আমার আত্মীয়া দিদিটি ঘরে থেকে পালিয়েছিলেন। অবশ্য পালানোর দিন রাত্রিবেলা তিনি মা-বাবাকে এস টি ডি করে জানিয়েও দিয়েছিলেন। তার মা-বাবার কথা কী বলব– তারা অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ ছিলেন। ছোটবেলা থেকে সমধিক প্রশ্রয়ে তারা মেয়েকে মানুষ করেছিলেন এবং মেয়ের সৌন্দৰ্য্য, ব্যক্তিত্ব এবং প্রগলভতা যেহেতু তার সার্বত্রিক আকর্ষণ তৈরি করত, এজন্য তারা বেশ গর্বিতও বোধ করতেন। তবে এমন প্রশ্রয়-পোষক মা-বাবাকে পুরো ঘটনা না বলে কেন যে মেয়ে হঠাৎ পালিয়ে বিয়ে করতে গেল, এটা তারাও কোনওদিন বোঝেননি। মেয়ে পালিয়ে যাবার পর বারবার শুধু তারা এটাই বলতেন– আমরা কি কোনওদিন ওর চলাফেরায় বাধা দিয়েছি, না স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছি? আমাদের বললেই তো হত, বিয়ে দিয়ে দিতাম।
কিন্তু সাড়ে চার-পাঁচ মাস পরে পলায়নী প্রেমে ইতি দিয়ে মেয়ে যখন বাবা-মার কাছে ফিরে এল, তখন বাবা-মা এই ভেবে পরম শান্তি পেলেন যে, আরও বড় দুর্যোগ ঘটার আগে মেয়ে ফিরে এসেছে।
পাড়ার লোকজন এবার দিদিকে একটু বেশিই দেখতে লাগল, চায়ের দোকান থেকে আরম্ভ করে নানান জায়গায় নানান মুখরোচক আলোচনাও করতে লাগল, কিন্তু পাড়ার ছেলেদের মধ্যে যেহেতু এই ধারণাটা দৃঢ়তপ্রাথিত ছিল যে, এ মহিলা আমাদের নাগালের মধ্যে কেউ নয় এবং টিটকিরিও জোরে করলে কীসের থেকে কী হবে জানি না, অতএব তারা পথিমধ্যে অনায়াস এবং সায়াস দেহদর্শন-সুখ থেকে বঞ্চিত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল। তবে আমাকে তার আত্মীয় জানা সত্ত্বেও আমার সামনেও পাড়ার ছেলেরা তাকে নিয়ে এমন সব মন্তব্য করে ফেলত, যেটা তৎকালীন দিনে অবাঞ্ছিত দেহতত্ত্বের পরিসর। আমার চুপ করে থাকা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না।
যাই হোক, তিনি পলায়নের তথাকথিত কলঙ্ক পদ্মপত্রের ওপর জলবিন্দুর মতো টুসকি দিয়ে সরিয়ে দিলেন এবং এম এ ক্লাসে ভর্তি হলেন। এর বছর দশেক পরে যখন আরও অনেক কাণ্ড ঘটে গেছে তখন একদিন আমি জিজ্ঞাসা করলাম– তুমি সেই পালিয়েই বা গেলে কেন, আবার ফিরেই বা এলে কেন? এর উত্তর ছিল অদ্ভুত। বললেন– দুটো কারণ আছে। এক নম্বর, পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার মধ্যে দারুণ একটা রোমাঞ্চ অথবা রোম্যান্টিক ব্যাপার আছে। আমি সেই রোমাঞ্চটা চেয়েছিলাম। দুই, ছেলেটাকে প্রথমে আমার দারুণ লেগেছিল, এত সুন্দর কথা বলে। আমি বললাম– বোঝা গেল, এবার ফিরে আসার কারণটা? বললেন– রোমাঞ্চটা তো পনেরো দিনেই ফুস, তারপরেই দিনগুলো কেমন আলু-বেগুন-ঝিঙে হয়ে গেল। তাও চলত, কিন্তু ছেলেটাকে দেখলাম– কেমন যেন! এক্কেবারে ‘কোল্ড’। অত কথাবার্তা, সব কেমন উলটো হয়ে গেল। আমি বললাম তুমি কী বলছ, শব্দগুলো ভেবে বলছ তো? এ কথার উত্তর মেলেনি, হয়তো আমি তার চেয়ে খানিক ছোট ছিলাম বলেই, হয়তো বা সেটা কথার কথাই ছিল।
তবে এই ঘটনার পরেও বেশ সাফল্যের সঙ্গে এম এ পাশ করলেন তিনি। তারপর শুনলাম তিনি দিল্লি চলে গেছেন কনসুলেটের অফিসে চাকরি নিয়ে। তার বছর খানেক পরে কলকাতায় দেখা হল। কপালে বড় টিপ, মা ভরি সিন্দুর, সঙ্গে একটি টুকটুকে রাজস্থানী ছেলে। বছর চারেক তার সঙ্গে কেটেছিল বলে জানি। আমার নিজেরও চাকরি জীবন শুরু হওয়ায় অনেক দিন তার সঙ্গে দেখাও হয়নি। ওঁর মা-বাবা বলেছিলেন- বিয়ে ভেঙে গেছে, ও এখন একাই আছে। আমার সঙ্গে দিল্লিতেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় আরও দু’বছর পর। দেখা হয়, মানে, আমি দেখা করি। আমি একটা সেমিনারে বক্তৃতা দিতে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় ফোন করি এবং দেখা করি। দেখলাম তিনি বেশ খোশ মেজাজেই আছেন, প্রচুর বন্ধুবান্ধব, বাঙালি-অবাঙালি– ছেলে বন্ধু, মেয়ে বন্ধু সবই। চেহারাটি এখনও বেশ খাশা রেখেছেন, শরীরে কিঞ্চিৎ মেদ যুক্ত হয়েছে, তাতে তার সৌন্দর্য বেড়েছে বই কমেনি। বন্ধু-বান্ধবের দৌরাত্ম শেষ হলে একান্তে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার রাজস্থান-গৌরবের কী হল? বললেন– কী হল আবার, নেশা কেটে গেল। আরে, বিয়ের এক বছর পর থেকেই বলে ছেলে চাই, মেয়ে চাই। পরম্পরাকে বারেমে কুছ শোচনা হয়। ওর মা-বাবার সাতটা ছেলেমেয়ে। তা হলে বুঝতে পারছিস- পরম্পরা রাখতে গেলে এত দিনে আমার চারটে ছেলেমেয়ে হয়ে যেত।
আমি বললাম– এটা আবার কেমন কথা। একটা সময়ে ছেলেমেয়ে তো চাইবেই। দিদি বললেন- হ্যাঁ, তা তো চাইবেই। আমি তবু চার বছর টিকে ছিলাম কোনও রকমে; আর বলেছিলাম– একটা অ্যাডপট’ করব। ও রাজি হল না। বলে– আমার নিজের ছেলে চাই– তেরি কেঁকমে মেরা অপনা। আমি সরে এসেছি। তবে জানিস তো রাজস্থান গৌরব ছেলেটা ভাল ছিল। আমার সঙ্গে কখনও সখনও টেলিফোনে কথাও হয়। আবার একটা বিয়ে করেছে এবং এর মধ্যেই একটা ছেলে হয়ে গেছে, দু নম্বর আসছে। আমি বললাম– তার না হয় দু-নম্বর আসছে। তা তুমি এখন কী করবে, তোমারও তো বয়স বাড়ছে, একটা সিকিওরিটি’ও তো চাই। তিনি বললেন আমার সিকিওরিটি আমি নিজে, আমার তেত্রিশ বছর বয়েস, এখনও শরীরটা ভালই আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা কী জানিস– আমি এত ‘সিকিওরড়’ থাকতে চাই না। তা ছাড়া সিকিওরিটি বলতে তুই বুঝিসটা কী? টাকার ‘সিকিওরিটি’ মেয়ে মানুষের শরীরের সিকিওরিটি– তাই তো? তুই আজকে রাত্রে এখানে থেকে যা, সব বলব। আমি বললাম তুমি বেশ রেগে গেছ বলে মনে হচ্ছে। ঠিক আছে, এসব কথা থাক। দিল্লিতে তোমার কেমন কাটছে বলো?
সেদিন রাত সাড়ে বারোটা-একটা পর্যন্ত ছিলাম দিদির বাড়িতে। কথাবার্তাও হয়েছিল অনেকক্ষণ এবং তা যথেষ্টই খোলামেলা। মেয়েদের নিরাপত্তা-বিষয়ক কথায় আমি বলেছিলাম– দেখো, টাকা-পয়সার সিকিওরিটির কথা তোমার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই খাটে না, কারণ তুমি নিজেই রোজগার করছ, কিন্তু হাজার হলেও তুমি তো একটা মেয়ে, এবং অন্য মেয়েদের ক্ষেত্রেও শারীরিক শক্তি কম বলেই নিরাপত্তার প্রশ্নটা আসেই। হয়তো এই কারণেই আমাদের প্রাচীন মনু মহারাজ বলেছিলেন… দিদি থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন– তোদের এই এক দোষ, যেখানে-সেখানে একটা দুটো সংস্কৃত শ্লোক না বললে তোদের ভাত হজম হয় না। আরে কী বলবি, আমি তো জানি– ওই তো সেই ক্লিশে-হওয়া কথাটা মেয়েদের কোনও স্বাতন্ত্র নেই। অল্প বয়সে সে বাপের অধীন, যৌবনে স্বামীর আর বয়স হলে ছেলের তাঁবেদারিতে থাকবে। আমি বললাম– হ্যাঁ ঠিক তাই।
আমার এই দিদিটি যেহেতু বহুল পড়াশুনো-করা বিদগ্ধা রমণী, অতএব ‘সোসিওলজি’র বেজটা ওকে অনেক ভাবতে শিখিয়েছে। দিদি বললেন- দেখ, ভারতবর্ষের আপামর জনের ক্ষেত্রে যেখানে মেয়েদের ‘ইকোনোমিক সাফিসিয়েন্সি’ একেবারে নেই, সেখানে শারীরিক নিরাপত্তার জন্য তোদের মনুর কথাটা ধর্মের মতো যেভাবে বলা হয়েছে, সেটা কিন্তু মন্দ নয়। এমনকী অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বা সাচ্ছল্য থাকলেও মেয়েদের শারীরিক দুর্বলতা সবলতায় পরিণত হয় না। সেখানে বাপ-ভাই, স্বামী অথবা ছেলে তাদের সুরক্ষা দিচ্ছে– এ ব্যাপারটা আমার খুব খারাপ লাগে না, বরং মানবিকই লাগে। কিন্তু ঝামেলা লাগে ওই জায়গায়, যেখানে মনু বলবে– অতএব স্ত্রীলোকের কোনও স্বাধীনতা নেই– ন স্ত্রী স্বাতন্ত্রমহতি। এটা কেমন কথা? মেয়েদের কোনও স্বতন্ত্রতা থাকবে না? আমি বললাম- মনুর এই শব্দটা সকলেই খারাপভাবে ধরে এবং না বুঝে ‘কোট’ করে। আমি মনু মহারাজের আহামরি কোনও ‘সাপোর্টার’ নই, কিন্তু এটা জেনো, মেয়েদের সুরক্ষা দেবার ব্যাপারে অথবা ঘরে আটকে রাখার ব্যাপারে ওঁর বৃহত্তর চিন্তা ছিল– বর্ণধর্ম অথবা রক্তের বিশুদ্ধতা, বিশেষ করে উচ্চতর বর্ণের কোনও মেয়েদের গর্ভে যাতে কোনওভাবে তথাকথিত অনুৎকৃষ্ট বীজ বাহিত না হয়, সেটার জন্য মনুর মাথাব্যথা ছিল অনেক বেশি। সেইজন্যই তিনি স্বতন্ত্রতার এত বিরোধী। আমি এবার সামান্য প্রলেপ দিয়ে বললাম– আমি ওভাবে কথাটা বলতে চাইনি। তোমার সঙ্গে ঠাট্টাও করছিলাম খানিক। তবে এটা আমার একটু দুশ্চিন্তাই লাগে– তোমার তেত্রিশ বছর বয়েস, তুমি একা থাকো, তার মধ্যে কোনও একটা খবরের কাগজে নাকি কী একটা গবেষণার ফল বেরিয়েছে। সেটা বলছে– একত্রিশ বছর বয়সে নাকি মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দর দেখায়! প্লাস দু-বছরে সেটা নিশ্চয়ই ভয়ংকর নীচে নেমে যাবার কথা নয়। আমি সেইজন্য ‘সিকিওরিটি’র কথাটা বলেছি।
এই ব্যাজস্তুতিতে দিদির পিত্তোপশম হল খানিক। খুব খোলাখুলি মেজাজে বললেন দেখ, আমার জীবনে পুরুষদের আনাগোনা অনেক দিনই এবং তা এখনও আছে, আর সেটা যে সব সময়েই খুব ‘এসথেটিক’ পর্যায়ে থাকে এমন দাবিও আমি করি না। আর ঠিক সেইজন্যেই বলেছিলাম এত ‘সিকিউরিটি আমি চাই না। আমার অল্প বয়সে আমি যখন পথ চলেছি, ছেলেগুলো যখন সব করে তাকিয়ে দেখত, গিলত, আমি সেটা এনজয়’ করেছি। সামান্য সামান্য বিপদেও যে পড়িনি তাও নয়। তবে অধিকতর পরশ্রীকাতর পুরুষদের জন্য আমি বেঁচেও গেছি। অর্থাৎ কিনা, এই ধর, একজন হাত ধরে টানল, এখানে-ওখানে হাত লাগানোর চেষ্টা করল, তখন অন্য ভাল লোক অথবা অধিকতর খারাপ লোক তার হাত থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্য আমার অন্য হাত ধরে টেনেছে, সেটাকেও দু-ঘা কষিয়েছে, কিন্তু রক্ষা করার হিরো-ভাব তখনও থেকে যাওয়ায় সেই মুহূর্তে সে আমার গায়ে হাত ছোঁয়াতে পারেনি তেমন করে, কিন্তু তার চোখ-মুখ দেখে আমি বেশ বুঝতাম– তার ইচ্ছেটাও কোনও নিষ্কাম সাধু পুরুষের নয়।
আমি এবার নিরুপায় হয়ে বললাম আমি আর নিতে পারছি না, দিদি। আমি গোবেচারা সংস্কৃতের লোক, আপাদমস্তক সংরক্ষণশীলতার চর্চা করি, তার মধ্যে তুমি যে কী সব জীবনকাহিনি বলছ, আমি আর নিতে পারছি না। দিদি বললেন– সংরক্ষণশীল বলিস না, বল ভণ্ড। ব্যাটা! আমি জানি না ভেবেছিস? তোদের সংস্কৃত সাহিত্যের পুরুষগুলো কতটা জৈব হয়, আমি জানি না ভেবেছিস। আমি অনুবাদ পড়েছি অনেক। তোদের অত বড় নাটক ‘শকুন্তলা’ সেখানে তোদের দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে দেখামাত্রই যে সব দেহজ বর্ণনা দিয়েছে, সেগুলো কী? তবে জানিস তো, ওটাই সঠিক রি-অ্যাকশন’, আমার সঙ্গে দেখা হওয়া পুরুষদের মধ্যে আমি সেই ‘রি-অ্যাকশন’ই দেখেছি, তবে সেটা চোখে, মুখে, হাবে, ভাবে। মুখে না বলার ব্যাপারটা আধুনিক ভদ্রতা অথবা ভণ্ডামি। তবে আমার কথা যদি বলিস, আমি এটা এনজয় করি, এই তেত্রিশ বছর বয়সেও ‘এনজয় করি। এটা বলতে পারি– আমার সঙ্গে যারা মিশেছে, যাদের অনেককে আমি একটু বেশি প্রশ্রয়ও দিয়েছি কখনও, তারা কিন্তু সবাই খুব ভাল নয়। অনেকেই আছে যারা ‘সেক্সয়ালিটি’র বাইরে কিছু বোঝে না, কিন্তু কী করা যাবে তাদের চরিত্রটাই ওরকম। কিন্তু আমি যাদের নিজে প্রশ্রয়। দিয়েছি, তারা কি সবাই ‘সেক্সয়ালিটি’র ঊর্ধ্বে নাকি? তাদের হয়তো বাড়তি কিছু গুণ আছে, কিন্তু যেখানে সেক্সয়ালিটির প্রশ্ন আসে, সেখানে তো আমিও তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছি; আমার ফেমিনিটি যে তারা এনজয় করেছে এবং এখনও করে, সেখানে আমিও তো একটা পার্টি। আর ঠিক সেইজন্যই পুরুষদের সব সময় আমি শুধু দৃষি না,আমি ওদের ভালবাসি মাঝে মাঝে।
রাত হয়ে আসছিল, এবার ফেরার প্রয়োজন। দিদি বললেন- থেকে যা, আমার এই একার ফ্ল্যাটে অন্য কেউ এসে রাত্রে থাকে না, এটা ভাবিস না। আমি বললাম– থাকতেই পারতাম, তবে কিনা তাতে অন্য লোকে আমাকেও না আবার অন্য কেউ ভেবে বসে। দিদি বললেন– তা ভাবলেই বা কী? তোর ভাবনা তোর কাছে, আমার ভাবনা আমার, অন্য কে কী ভাবল, তাতে কিসসু আসে যায় না আমার। আমি বললাম তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হই, দিদি! আমার থাকা না-থাকাটা বড় কথা নয়, তবে শেষ প্রশ্নটা আমার মনের মধ্যে থেকেই যায়– তোমার এমনকী বয়স, এখনও তো একটা বিয়ে করতে পারো, ‘লাইফে তো একটা সেটলড়’ ভাব আসে। তোমার অসুবিধেটা কোথায়? দিদি বললেন– আমাকে দেখে কি তোর ‘আনসেটড’ মনে হচ্ছে? এতক্ষণ এখানে থাকলি, খাওয়া-দাওয়া করলি, ঘর-দোরের অবস্থা দেখলি– কোথাও কী আমাকে ‘আনসেটলড়’ লাগল? নাকি একবারও তোর মনে হল যে, আমার কোনও মানসিক স্থিরতা নেই, আমি খুব হাহুতাশ করে কষ্টে আছি? মনে হল তোর?
খানিকটা উষ্মা প্রকাশ করার পর দিদি এবার স্থির হয়ে বললেন- দেখ, যেভাবে আমি জীবন কাটিয়েছি, তাতে আর আমাকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না। তবে সবচেয়ে বড় কথা, আমি নিজেই আর বিয়ে করতে চাই না। দু-দুটো বিয়ে তো আমি করেই দেখলাম। আমার কাছে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে যে, বিয়ের আগে পুরুষ-মানুষের মধ্যে যত ‘রোম্যান্স’ যত উষ্ণতা থাকে সেটাকে তুই প্রেম বলবি কিনা, সেটা তুই-ই বসে বসে ভাব– কিন্তু ওই উষ্ণতা, রোম্যান্স বিয়ের কিছুদিন পর থেকে আর থাকে না। একটা প্রেম-দ্যাখানো ভাব যেটা দেখিস, ওটাকে আমি প্রেমের কর্তব্য বলি। আর যে-পুরুষ মানুষগুলোকে দেখিস বিয়ের সাত বছর পরেও ‘ওগো শুনছো বলে বাথরুমে যাবারও অনুমতি নেয়, ওগুলোকে আমি তোদের মতো স্ত্রৈণও মনে করি না, ওরা অসহায় সমাজ-জীবন কাটিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু ওদের একটু সুযোগ দিয়ে দ্যাখ, স্ত্রৈণর জায়গায় ‘ঝৈন’ হতে ওদের একটুও সময় লাগবে না। আর আমার কথা যদি বলিস, আমি এখনও বেশ ‘মার্গীতব্যা’ অবস্থায় আছি। এক বছর আগেও আমি একটা লিভ টুগেদার’-এ ছিলাম, দেখলাম সেখানেও কিছু দিনের মধ্যেই আমার পার্টনার ছেলেটি দায় সারা ভাব দেখাচ্ছে, অথচ এই সামান্য ‘সেটলমেন্টের আগেই তার মতো উষ্ণ, রোম্যান্টিক আর কেউ ছিল না। আমার এটাই খারাপ লাগে। প্রেম, ভালবাসা অথবা শরীর নিয়ে যদি পুরুষেরা দায় সারতে আরম্ভ করে, তখন সেই পুরুষদের আর আমার ভাল লাগে না। আমি ওদের দোষও দিই না, কেননা এটাই পুরুষের প্রকৃতি। অথচ দ্যাখ, এই যে আমি চলছি, এখন কিন্তু আমার ‘অ্যাডমায়ারার’-এর সংখ্যা কম নেই– সেটা আমার বন্ধুত্ব পাবার জন্যই হোক, অথবা সেক্স-এর জন্যই হোক। তুই কি জানিস যে লোকটা আমার সঙ্গে ‘লিভ টুগেদারে’ ছ’মাসে দায় সারতে আরম্ভ করছিল, সে পূর্বতর উষ্ণতায় আবারও দু-একদিন থেকে যায় আমার সঙ্গে। তাতেই বুঝি– এত সব বিয়ে করা পুরুষ মানুষের চেয়ে একা থাকা অনেক ভাল, আমি একা থাকতে ভালবাসি, নতুন করে পাবার জন্য ক্ষণে-ক্ষণে হারানোটাই অনেক ভাল। আমি বেশ আছি। এবার চল, তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি কোন চুলোয় যাবি সেখানে। আমি যাবার আগে বললাম–আমি এবার তোমার কথা লিখব, আমি মহাভারতের মাধবীকে নিয়ে তোমার কথা লিখব। সবটা হয়তো মিলবে না, কিন্তু জেনো সেই মহাভারতীয় মিথের ‘আনকনশাসে’ তুমি আছ, তুমি পুরুষদের অপছন্দ করোনি কোনওদিন, অথচ রাগ না করেও পুরুষের প্রতি এমন উদাসীন আর ক’জন আছে, আমি জানি না।
.
০২.
মহাভারতে এই কাহিনির সূত্রপাত এক বিপরীত পরিস্থিতিতে। দুর্যোধন পাণ্ডবদের রাজ্যলাভে অতিরিক্ত আগ্রহী হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু কোনও বিষয়ে অতিরিক্ত আগ্রহ যে মানুষের বিপদ ডেকে আনে, সেটা দুর্যোধনকে বোঝাবার জন্য নারদ ব্রহ্মচারী গালবের কাহিনি বলেছিলেন। আমরা যে মাধবীর জীবন নিয়ে কথা বলতে চাইছি, সেখানে গালবও তেমন সংপৃক্ত নন, মাধবীর জীবনটাই সেখান অনেক বড় হয়ে উঠেছে, কিন্তু গালব এখানে সবচেয়ে বড় দর্শকের ভূমিকায় আছেন, মাধবীর জীবন-ঘটনায় তিনি ‘ইনস্ট্রমেনটাল’, অতএব গালবের কথা এখানে ভূমিকায় আসবে। গালব বিশ্বামিত্রের শিষ্য ছিলেন। কোনও এক সময় বিশ্বামিত্র ভগবান ধর্মকে তুষ্ট করার জন্য কঠিন কৃচ্ছসাধন করছিলেন। সেই সময়ে গালব বিশ্বামিত্রের সেবা-পরিচর্যা করে তাকে যথাসম্ভব সুস্থ রেখেছিলেন। বিশ্বামিত্র তার নিজের সাধনে সিদ্ধিলাভ করার পর এটা অনুভব করলেন যে, তার তপঃক্লিষ্টতার দিনগুলিতে গালবের অবদান কিছু কম নয়। ফলে উপযুক্ত শিষ্যের জন্য তার যেমন গর্বও হল, তেমনই হল সন্তোষ। তিনি প্রীত হয়ে শিষ্যকে বললেন- যা তুমি লাভ করতে এসেছিলে, তা লাভ হয়ে গেছে তোমার। এবার তুমি এই গুরুকুল থেকে বিদায় নিয়ে তোমার অভীষ্ট স্থানে যেতে পারো, আমি অনুমতি দিলাম- অনুজ্ঞাতো ময়া বৎস যথেষ্টং গচ্ছ গালব।
এটা অনেকেরই জানা নেই যে, সেকালে গুরুকুলে বিদ্যালাভ করতে গেলে কোনও ‘টুইশন ফি লাগত না, কিন্তু বিদ্যালাভ হয়ে গেলে শিষ্যরা কখনও কখনও যেমন গুরুকার্য করার জন্য সম্মান-দক্ষিণা কিছু দিতেন বা দিতে চাইতেন, তেমনই গুরুরাও কখনও কখনও সম্মান-দক্ষিণা চাইতেন। গুরুদের সেকালে অর্থলাভের অন্য উপায় না থাকায় শিষ্যের ওপরে অন্যায় চাপও তৈরি করে ফেলতেন কখনও কখনও। শিষ্যরা সাধারণত দেশের রাজা বা অন্য কোনও ধনী ব্যক্তির কাছে গিয়ে গুরুদক্ষিণার আনুকূল্য চাইতেন এবং ব্রহ্মচারী শিষ্যকে দান করাটা যেহেতু মহাপুণ্য বলে গণ্য হত, অতএব ধনীরা এই অর্থ দিতে উন্মুখ থাকতেন। তবু এটা ঠিক যে, শিষ্যদের মাঝে মাঝে অসুবিধে হতই।
গালবের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। বিশ্বামিত্র ঋষি তাঁর কাছে কিছু চাননি, তিনি নিজেই হয়তো বা অতিরিক্ত কৃতজ্ঞতাবশত, নয়তো দক্ষিণা দানের বহুশ্রুতিতে মুগ্ধ হয়ে তিনি নিজেই বিশ্বামিত্রকে বললেন– আপনি যে গুরুকার্য করেছেন, তার জন্য আপনাকে কী দক্ষিণা দেব– দক্ষিণাঃ কাঃ প্রযচ্ছামি ভবতে গুরুকর্মণি। আমি দক্ষিণাদানের পুণ্য-কথা শুনেছি– স্বর্গ, শান্তি, নির্বাণ, আরও কত কী; তো আপনি বলুন– কী নিয়ে আসব আপনার জন্য কিমাহরামি গুৰ্বৰ্থং ব্রবীতু ভগবানিতি? শিষ্য হিসেবে গালবের এই আগ্রহের মধ্যে যেন কৃতজ্ঞতার চেয়েও গুরুকার্যের মূল্য চুকিয়ে দেবার একটা তাড়না ছিল এবং বিশ্বামিত্র সেটা পছন্দ করেননি। তিনি গালবের অবস্থা জানতেন। এতদিন তার কঠিন পরিচর্যা করে গালব কতটা ক্লান্ত, তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন সেটা এবং এখন এই শ্রান্ত-বিধ্বস্ত অবস্থায় আবার দক্ষিণার আনুকূল্য যোগাড় করতে যাওয়াটা যে কতটা কষ্টসাধ্য সেটা বুঝেই বিশ্বামিত্র সকরুণ ভাবে গালবকে বললেন– তুমি যাও তো, স্বচ্ছন্দে যাও এখান থেকে অসকৃদ গচ্ছ গচ্ছেতি বিশ্বামিত্ৰেণ ভাষিতঃ।
বিশ্বামিত্র বারবার গালবকে চলে যেতে বললেও গালব বারবারই গুরুদক্ষিণার আগ্রহ দেখাতে থাকেন তার কাছে, বলতে থাকেন কী দেব আপনাকে বলুন– কিং দদানীতি বহুশো গালবঃ প্রত্যভাষত। শিষ্যের এই অত্যাগ্রহে ঋষি বিশ্বামিত্রের এবার রাগ হল। তিনি গালবকে বললেন–ঠিক আছে, তোমার যখন এত হচ্ছে, তা হলে আটশো ঘোড়া দেবে আমাকে। তবে সে ঘোড়া যেমন তেমন নয়। প্রত্যেকটি ঘোড়ার এক দিকের কানটি হবে কালো, ডান দিকেরটা সাদা আর ঘোড়ার গাগুলো হবে চাঁদের মতো জ্যোৎস্না-ধোয়া। এইরকম ঘোড়া আটশো আমার চাই এবং তুমি বেশি দেরি করবে না এগুলো আনতে অষ্টৌ শতানি মে দেহি গচ্ছ গালব মা চিরম্।
এক মুহূর্তে বিশ্বামিত্র-শিষ্য গালবের মুখ শুকিয়ে গেল। তার ধারণা ছিল না যে, দক্ষিণাদানের এই বায়নার ফল কী হতে পারে। তিনি দক্ষিণা দিতে চেয়েছেন বটে কিন্তু তার পরিমাণ এবং অপ্রাপ্যতা যে এইরকম হবে, তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। সেই থেকে দুশ্চিন্তায় রাত্রে তার ঘুম আসে না, তিনি উঠলে বসতে পারেন না, বসলে উঠতে পারেন না, আহারে রুচি নেই– নাস্তে ন শেতে নাহারং কুরুতে গালবস্তদা। চিন্তায় দুঃখে তার শরীর শুকিয়ে গেল, গায়ের রং হয়ে গেল ফ্যাকাশে। কোনও যে উপায় হবে একটা, তাও নয়। এমন কোনও বন্ধুও নেই তার, যাঁর কাছে প্রচুর অর্থ আছে এবং যে সাহায্য করবে এই বিপন্ন সময়ে। তার সঞ্চিত ধন নেই, আর অল্প সময়ের মধ্যে এত অর্থও তিনি উপার্জন করতে পারবেন না যা দিয়ে ওই নির্দিষ্ট প্রকারের অশ্ব কিনে গুরুকে দিতে পারেন। গালব মনে-মনে ঋণী বোধ করতে থাকলেন এবং প্রতিজ্ঞাত অশ্ব না দিতে পারার অক্ষমতায় মিথ্যাবাদিতার দায়ও অনুভব করতে লাগলেন।
নিতান্ত ভগ্নমনোরথ হয়ে গালব শেষ পর্যন্ত ভগবান বিষ্ণুরূপী কৃষ্ণের আশ্রয় গ্রহণ করলেন। গালবের স্মরণ-মাত্রেই কৃষ্ণ-বিষ্ণুর বাহন গরুড় দর্শন দিলেন গালবের সামনে এবং পরম বন্ধুর মতো সমস্ত সহায়তার অঙ্গীকার করলেন গালবের জন্য! গরুড়ের কাছে গালব খুব স্পষ্ট করে নিজের প্রয়োজনের কথা না বলায় গরুড় খানিকক্ষণ গালবকে নিজের পিঠে চড়িয়ে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে ইতস্তত ঘোরালেন, গুরুর কাছে প্রতিজ্ঞাত সেই অশ্বের কোনও সন্ধান গালব পেলেন না। আবার এর মধ্যেই পড়বি পড় বাঘের মুখে গালবের সঙ্গে বিশ্বামিত্র-গুরুর দেখা হয়ে গেল। বিশ্বামিত্র কোনও ভণিতা না করেই গালবকে শুনিয়ে বললেন– কী হে ব্রাহ্মণ! আমি তো চাইনি, তুমি নিজে থেকেই যে দক্ষিণা দেবার জন্য প্রতিশ্রুত হয়েছিলে, সেটা এবার দাও, সময় তো অনেক গড়িয়ে গেল– যন্ত্বয়া স্বয়মেবার্থঃ প্রতিজ্ঞাতে মম দ্বিজ। বিশ্বামিত্র চলে গেলেন এবং গরুড় তখন আর গালবের ওপর ভরসা না রেখে নিজেই গালবকে বললেন– দেখো, সোনা-দানা, অর্থ-ধন এই বসুন্ধরাতেই আছে, কিন্তু এমন উদ্দেশ্যহীন চেষ্টায় তা পাওয়া যাবে না। আবার টাকা-পয়সা না হলে তুমি সেই অদ্ভুত ঘোড়াগুলোও যোগাড় করতে পারবে না। অতএব চলো, আগে কোনও বড় বংশের, বড় মনের রাজার কাছে যাই।
গরুড় এই প্রস্তাব দেবার পর নিজে থেকেই তার এক বন্ধু রাজার কথা জানালেন এবং আমরা তার নাম জানি– তিনি চন্দ্রবংশীয় নহুষের পুত্র যযাতি। তাকে কে না চেনে? দেবযানী-শর্মিষ্ঠার কারণে তিনি যেমন বিখ্যাত, তেমনই বিখ্যাত তিনি তাঁর যদু-পুরু প্রভৃতি পুত্রদের জন্য। গরুড় গালবকে বললেন– যযাতির এককালে অনেক অর্থ-সম্পত্তি ছিল। অতএব অর্থের ব্যাপারে আমিও তাকে বলব, আর তুমিও যাচনা-প্রার্থনা করবে এবং আমার মনে হয় তিনি দেবেন– স দাস্যতি ময়া চোক্তো ভবতা চার্থিতঃ স্বয়ম। গরুড় এবং গালব দু’জনেই যযাতির কাছে উপস্থিত হলেন। যযাতির দিক থেকে গৃহস্থের আদর-প্রদর্শন যত ছিল, গরুড় ও গালবের দিক থেকে ততই ছিল বহুমিনন আর প্রশংসা। গরুড় নিজেই যযাতির কাছে গালবের দক্ষিণা দেবার ইচ্ছা এবং গুরু বিশ্বামিত্রের এই খামখেয়ালি যাচনার কথা জানালেন সবিস্তারে। সব শুনে যযাতি একটু দুঃখিত হয়েই গরুড়কে বললেন– সখা! আগে আমার যেমন ধনসম্পত্তি ছিল, এখন আর তা নেই। কিন্তু ব্রহ্মচারী প্রার্থী দাতার কাছে এসে ফিরে যাবে– এমন পাপ আমি করতে পারব না। অতএব তোমাদের অভীষ্ট অর্থ অথবা তার বিনিময়ে অশ্বগুলি যাতে লাভ করতে পারো, তার একটা উপায় আমি করে দিচ্ছি– তত্ত্ব দাস্যামি যৎকাৰ্যম ইদং সম্পাদযিষ্যতি।
যযাতি এবার বললেন– দেখো, আমার ঘরে রূপ-গুণসম্পন্না এক অতি সুলক্ষণা কন্যা আছে। এমনই তার রূপ যে, দানব-মানব-দেবতা যেই তাকে দেখুক, দেখামাত্রই তাকে কামনা করে সদা দেব-মনুষ্যানাম অসুরাণাঞ্চ গালব। আর শুধু রূপই নয়, যাঁরা বংশলাভের জন্য ধর্মত পুত্রকামনা করেন, তারাও আমার এই দেবকন্যার মতো মেয়েটিকে পেলে বংশকর পুত্রলাভের ধর্মও লাভ করবেন– ইয়ং সুরসুতপ্ৰখ্যা সর্বধর্মোপচায়িনী। স্বর্গসুন্দরীর মতো রূপ আমার এই মেয়েটিকে পাবার জন্য এক একজন রাজা তাদের রাজ্য পর্যন্ত দিয়ে দেবেন– অস্যাঃ শুল্কং প্রদাস্যন্তি নৃপা রাজ্যমপি স্বয়ম্– সেখানে কালো কানওয়ালা আটশো ঘোড়ার কথা আর কী বলব? অতএব গালব! তুমি নিশ্চিন্ত মনে আমার এই মেয়েটিকে নিয়ে যাও। আমার মেয়ের নাম মাধবী। মাধবীকে দিয়ে তোমারও অভীষ্ট পূরণ হবে আবার আমিও হয়তো আমার মেয়ের ঘরে একটা-দুটো নাতি পাব- স ভবান প্রতিগৃহ্নাতু মমৈতাং মাধবীং সুতাম।
বিশ্বামিত্রের শিষ্য গালব এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেননি একবারও। পিতা হিসেবে যযাতি তার নিজের মেয়েকে অন্যের যৌন ব্যবহারে নিযুক্ত করছেন সামাজিক বিধি-নিয়মের বাইরে গিয়ে এবং তার মেয়েরও কোনও অনুমতি গ্রহণ করছেন না– এইসব নৈতিক প্রশ্ন গালবের মনে উঠল না এবং তিনি নিজেও যে এই সামাজিক বিধি-ভঙ্গের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করছেন, সেটাও একেবারের তরেও ভেবে দেখলেন না। গুরুদক্ষিণা দানের জন্য অশ্বলাভের একটা উপায় বেরোনো মাত্রেই গালব যযাতিকে বলেছেন– আপনার সঙ্গে আবার আমার দেখা হবে। কথাটা বলেই মাধবীকে নিয়ে প্রস্থান করলেন। গালব– পুনর্ধক্ষ্যাব ইত্যুত্ত্বা প্রস্থে সহ কন্যয়া। আর গরুড়, যিনি এতক্ষণ গালবের সঙ্গে ঘুরছিলেন এবং বন্ধু হিসেবে যযাতির বাড়িতে গালবকে নিয়ে এসেছিলেন, তিনিও বিনা দ্বিধায় তা হলে এবার তোমার কালো-কানের ঘোড়া পাবার একটা উপায় পাওয়া গেছে– উপলব্ধমিদং দ্বারম্ অশ্বনামিতি চাণ্ডজঃ- এই কথা বলেই গরুড়ও গালবের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। মাধবী রইলেন গালবের সঙ্গে এবং গালব আর এতটুকু সময়ও নষ্ট করলেন না। তিনি তক্ষুনি ভাবতে বসে গেলেন বিখ্যাত রাজাদের মধ্যে কার কাছে গেলে এই কন্যাটির পরিবর্তে ভাল শুল্ক পাওয়া যাবে, অর্থাৎ টাকা পাওয়া যাবে– চিন্তয়ানঃ ক্ষমং দানে রাজানং শুল্কতোহগমৎ।
এখানে প্রাথমিকভাবে তিনটি চরিত্র নেমে এল- যযাতি, মাধবী এবং গালব। পিতা হিসেবে যযাতির পৌরুষেয় অধিকার এখানে খুব স্পষ্ট। ঔরসজাতা কন্যার ওপর পিতা যযাতির অধিকার-বোধ এতটাই প্রবল যে, একবারের তরেও তিনি মাধবীকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেননি যে, এই কাজটা তিনি করতে যাচ্ছেন। অথবা এমন একটা যৌনতার প্রকল্প যেখানে মাধবী ব্যবহৃত এবং ব্যবহৃত হবেন বার বার, সেখানে একবারও মেয়েকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন না যে, এমন একটা অসামান্য যৌনতার মধ্যে সে যাবে কিনা! চিন্তা করলেন না গালবও। তিনি সদ্য বিদ্যাচর্চা শেষ করেছেন, অথচ একবারও তার মনে প্রশ্ন উঠল না যে, এক যৌবনান্বিতা রমণীকে স্বকার্য-সাধনের জন্য এইভাবে ব্যবহার করা ঠিক হবে কিনা। পশ্চিমি সমাজতত্ত্ববিদদের মধ্যে প্রখ্যাত জরজেস দুমজেইল মাধবীর জন্য কিছু সময় দিয়েছেন তার Destiny of a King বইটিতে। তিনি পিতা যযাতির মধ্যে গর্বের ঔদ্ধত্য বা ‘ভ্যানিটি’ দেখতে পেয়েছেন। যযাতি পুরাতন প্রখ্যাত রাজা, তাঁর ঐশ্বর্য সম্পদ শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু পূর্বেশ্বর্যের অভিমান-মত্ততা যায়নি। অতএব মানীর মহত্ত্ব দেখাতে গিয়ে নিজের মেয়েকে তিনি ব্যবহার করছেন নিজের বনেদিয়ানা দেখানোর জন্য। এর অন্য পাশে রয়েছেন ‘অ্যারোগান্ট’ বিশ্বামিত্র, যিনি বিচিত্র এক গুরুদক্ষিণা চাইছেন শিষ্যের ক্ষমতা-অক্ষমতা বিচার না করে। আর শিষ্য গালবের চিন্তাজগতে গুরুভক্তি প্রদর্শনের বাড়াবাড়ি দেখানো ছাড়া অন্য কোনও নৈতিকতা কাজ করছে না। তিনি একটি সুন্দরী রমণীকে নিজের কাজ মেটানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছেন বিনা জিজ্ঞাসায়, বিনা সেই রমণীর অনুমতিতে।
মাধবীকে হাতে পেয়ে গালব ইক্ষাকু বংশের প্রসিদ্ধ রাজা হর্যশ্বের কথা ভাবলেন। তিনি যেমন বীরপুরুষ তেমনই ঐশ্বর্যশালী রাজা। হয়তো তার কাছে গেলে একবারেই কাজ হয়ে যাবে। গালব হ্যশ্ব রাজার কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন আমার হাতে এই অসামান্যা সুন্দরী রমণীটি আছে। আপনি এই কন্যাটির মাধ্যমে আপনার বংশবৃদ্ধি করতে পারেন। কিন্তু এঁকে ভার্যা হিসেবে গ্রহণ করতে হলে আপনাকে শুল্ক দান করতে হবে– ইয়ং শুল্কেন ভার্যার্থং হ্যশ্ব প্রতিগৃহ্যতাম। তবে হ্যাঁ, শুল্কের বিষয়টা আমি বলব এবং সেটা আগে শুনে তারপর আপনার কর্তব্য স্থির করুন।
মহাভারতের কবি বড় বুদ্ধি করে এবং বেশ লৌকিক-নির্মাণ-নিপুণতায় এই জায়গাটা সাজিয়েছেন। আমরা প্রথমে দেখছি- মহারাজ হর্যশ্ব- ইক্ষাকু-কুলধুরন্ধর– এই সময়ে তার যথেষ্টই বয়স হয়ে যাবার কথা, অথচ এখনও তার কোনও পুত্রসন্তান নেই– এইজন্য তাঁর যথেষ্ট হতাশা আছে এবং সেই হতাশায় এখনও তার নিশ্বাস দীর্ঘতর হয়– দীর্ঘমুফঞ্চ নিশ্বস্য প্রজাহেতেপোত্তম। অর্থাৎ একটি সুন্দরী রমণীর সঙ্গে মিলন-প্রার্থনার যুক্তি হিসেবে প্রথমত এক ধরনের শাস্ত্রীয় কল্পের ভাবনা আসছে হর্যশ্বের মনে এবং তাতে পুত্রলাভের যুক্তিটা ভীষণভাবে একটা শাস্ত্রীয় প্রয়োজন হয়ে ওঠে। কিন্তু পরমুহূর্তেই মহাভারতের কবি বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, এটা এক ধরনের চক্ষু ধৌত করার যুক্তিমাত্র, আসল প্রয়োজনটা বিখ্যাত রাজার বুক ঠেলে মুখে বেরিয়ে আসছে। হ্যশ্ব এই রমণী-শরীরের প্রত্যঙ্গ-সংস্থানে দৃষ্টি দিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন– এই কন্যার শরীরে ছয়টি অঙ্গ উন্নত, পাঁচটি অঙ্গ সূক্ষ্ম– উন্নতেষুন্নতা ষটসু সুক্ষ্মা সূক্ষ্মেষু পঞ্চসু– তিনটি স্থান গভীর আর পাঁচটি স্থান রক্তবর্ণ। এই সাধারণ বাচনিকতায় যদি বোঝা না যায়, তাই মাধবীর সামনেই হযশ্ব বললেন– দুই নিতম্ব, দুই ঊরু, কপাল এবং নাসিকা– এই ছয়টি অঙ্গ উন্নত। এঁর অঙ্গুলীর পর্বগুলি, কেশ, লোম, নখ এবং চর্ম– এই পাঁচটি সূক্ষ্ম। কণ্ঠস্বর, স্বভাব এবং নাভি গভীর, আর পাণিতল, পদতল, বাম-দক্ষিণ নয়নের প্রান্ত এবং নখ– এই পাঁচটি রক্তবর্ণ।
হর্যশ্ব রমণী-শরীরে আরও বেশ কিছু শাস্ত্রীয় সুলক্ষণের কথা বললেন, কিন্তু সেগুলির শাস্ত্রীয় তাৎপর্য যাই হোক, হর্যশ্ব এটা বুঝেছেন যে, মাধবী খুব সাধারণ সুন্দরী রমণী নন, ইনি যেখানেই থাকবেন- দেবতা, অসুর, দানব, মানব, গন্ধর্ব সবারই তিনি চোখে পড়বেন– বহুদেবাসুরালোকা বহুগন্ধর্বদর্শনা। হ্যশ্ব অনুভব করলেন এই অতিসুলক্ষণা রমণী রাজচক্রবর্তী পুত্র উপহার দিতে পারে তাকে অর্থাৎ লালসামুখর মিলনকামিতাকে আবারও পুত্রলাভের শাস্ত্রীয়তায় আগুণ্ঠিত করা। হর্য গালবকে বললেন– আপনি আমার ধন-সম্পদের ভাবনাটা মাথায় রেখে শুল্কের কথা বলুন। গালব আর দেরি করলেন না, তার আসল কাজ হয়ে গেছে। অতএব নির্দ্বিধায় বলেন– এক দিকের কানগুলি হবে শ্যামবর্ণ, গায়ের রং চাঁদের মতো শুভ্রবর্ণ হবে, সেগুলি দেশজ হবে, অথচ সুন্দর হয়ানাং চন্দ্ৰশুভ্ৰাণাং দেশজানাং বপুষ্মতাম। এইরকম অশ্ব আটাশোটি দিতে হবে আমাকে এবং তখনই এই রমণী আপনার পুত্রদের জননী হতে পারে।
অবশেষে গালবও কিন্তু সব বুঝেও প্রকট রতিলিপ্সার মধ্যে পুত্রলাভের মতো শাস্ত্রীয়তার নির্মোক চাপিয়ে দিয়েই নিজের প্রয়োজনের কথাটা জানিয়েছেন। আসলে মহাভারতের যে সমাজ এবং সেই সমাজে যারা ধর্ম এবং ব্রাহ্মণ্যের কথা বলেছেন, তারা অন্তত এই মিথ্যা প্রবঞ্চনাটা করতেন না– যেমনটা মনু মহারাজের কালে যথেষ্টই করা হয়েছে- যেন পুরুষ-মানুষেরা যে নারী-সঙ্গ করছেন, তা তারা দয়া করে বংশরক্ষার কারণেই করছেন। মহাভারতের যে সব জায়গায় নীতি উপদেশের মাধ্যমে জীবনের সত্য উদঘাটনের চেষ্টা চলেছে, সেখানেও স্ত্রীলোক বলতে পুরুষের কাছে উত্তম রতিলাভ এবং পুত্রলাভ দুটোই বলা হয়েছে অর্থাৎ ‘সেক্স অ্যান্ড প্রোক্রিয়েশন’–রতি-পুত্রফলা নারী। যদিও মনু মহারাজের সামাজিক কাল পরিণত হওয়ার জন্য রতিলিপ্সার মধ্যে পুত্রলাভের ধর্মাবরণ সৃষ্টি করার কাজটা মহাভারতের সময় থেকেই তৈরি হয়েছে, কিন্তু তবু স্ত্রীলোকের কাছে রতিলিন্সার সত্যটা মহাভারতের পুরুষ লুকিয়ে রাখে না। এই কারণেই মহাভারতে গালবের বলা নির্দিষ্ট গোত্রের আটশো ঘোড়ার হাঁক শুনেই হর্যশ্ব রাজার অন্তরে একই সঙ্গে কামনা এবং কামনা বিফল হওয়ার কাতরতা সৃষ্টি হচ্ছে উবাচ গালবং দীননা… হ্যশ্বঃ কামমোহিতঃ। তিনি বলে উঠলেন– মহর্ষি! আপনি যে-ধরনের ঘোড়াগুলি চাইছেন, তেমন ঘোড়া আমার অশ্বশালায় দু’শোটা-মাত্র আছে। অন্য রকমের শত শত ঘোড়া আমার অশ্বশালায় আছে, কিন্তু সেগুলো তো আপনার চলবে না– দ্বে মে শতে সন্নিহিতে হয়ানাং যদ্বিধাস্তব।
হর্যশ্ব খুব কাতরভাবে নিজের অসহায়তার কথা জানালেন। গালবের আটশো ঘোড়া চাই, আর তার আছে দু’শো, অথচ অসামান্যা সুন্দরী মাধবীকে দেখে নিজের লালসাকেও তিনি দমিত করতে পারছেন না। এই অবস্থায় আরও দীনতর আবেদন জানিয়ে হ্যশ্ব গালবকে বললেন– বেশি দরকার নেই, আপনি যেমন বলছিলেন– আমার বহুতর পুত্রের জননী হতে পারে এই মেয়ে– ততস্তব ভবিত্রীয়ং পুত্ৰাণাং জননী শুভা– তা অত বেশি দরকার নেই আমার। এই রমণীর গর্ভে আমি যাতে একটি মাত্র পুত্রের জন্ম দিতে পারি, আমার এই ইচ্ছেটা অন্তত পূরণ করুন দয়া করে– অস্যামেতং ভবান কামং সম্পাদয়তু মে বর। অর্থাৎ হর্যশ্বরাজার নিবেদনের তাৎপর্য এই– তিনি একবার অন্তত এই সুন্দরী রমণীর সঙ্গে মিলিত হতে চান।
আমরা এতক্ষণ যে-সব সংলাপ শুনেছি, সেগুলি তো এই একবিংশ শতাব্দীর পরিশীলিত হৃদয়কে আক্রান্ত করবে, অন্তত প্রতিবাদী করে তুলবে আমাদের লোক দেখানো মৌখিকতাকে। তার ওপরে এইসব বড় বড় প্রশ্ন তো উঠবেই– পিতা যযাতির কী অধিকার আছে তার মেয়েকে ব্যবহার করে অন্যের কাজ উদ্ধার করার! কই, একবারও তো মাধবীকে জিজ্ঞাসা করা হল না যে, তোমাকে এইভাবে স্বকার্যসাধনের জন্য গালব ঋষি ব্যবহার করবেন এবং রাজাদের কাছ থেকে গুরুদক্ষিণার অর্থ-বস্তু সংগ্রহ করবেন, তা তুমি এতে রাজি আছ কিনা? বেশ তো এসব না-হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু এটা কী চলছিল এতক্ষণ গালব বলছেন– আমার হাতে এই মেয়ে আছে, শুল্কের পরিবর্তে এঁকে দিতে পারি। হ্যশ্ব রাজা বলছেন– মেয়েটিকে চাই আমি, কিন্তু শুল্ক দেবার মতো অত পরিমাণ বস্তু আমার কাছে নেই। যতটুকু আছে, তাই দিয়ে যতটুকু হয়, সেই ব্যবস্থা করতে পারো। মেয়েটার যা চেহারা, উচ্চাবচ প্রত্যঙ্গ-সংস্থান ইত্যাদি ইত্যাদি– এগুলি কী চলছিল এতক্ষণ?
জায়গাটা আজকের দিনের প্রগতিবাদিনী তর্কপ্রিয় রমণীদের পক্ষে লুফে নেবার মতোও বটে। একজন তো রাগে, দুঃখে একটি বড় প্রকাশকের সংকলন গ্রন্থে ‘ইউজেবল উইমেন’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে মাধবীর করুণ অবস্থার জন্য তৎকালীন পুরুষ-সমাজকে একেবারে তুলোধোনা করে ছেড়েছেন। তার মতে পিতা যযাতি মেয়ে বলেই মাধবীর স্ত্রৈণ মর্যাদা নিয়ে এতটুকু ভাবেননি, আর গালব মাধবীর শরীর নিয়ে প্রায় একজন প্রস্টিটিউশন এজেন্ট’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ। আর সেই বয়স্ক সব রাজারা, যারা অর্থ বা বস্তুর বিনিময়ে মাধবীকে ভোগ করেত চাইছেন, নারী শরীর ছাড়া তাদের কাছে আর কিছুই ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না। অতএব একজন পুরুষ নয়, বিভিন্ন স্থানে থাকা বিভিন্ন পুরুষ বিভিন্ন কারণে মাধবীর সঙ্গে যে ব্যবহারটা করছেন, সেখানে সত্যই এমনই এক দুঃসহ চিত্র ফুটে ওঠে, যেখানে ‘কমোডিটাইজেশন’ যাকে বলে তার চরম রূপটাই ধরা পড়ে।
তবু কথা কিছু থেকে যায় এবং মহাকাব্য মহাভারত যখন এই রকম একটা কাহিনি লেখে, তখন তার বিচার করার জন্যও একটা মানসিক ব্যাপ্তির প্রয়োজন হয়। সেই ব্যাপ্তি না থাকলে মহাভারতীয় সমাজের সম্পূর্ণ বোধ হয় না। বিশেষত যাঁরা মহাভারতের একটা দুটো জায়গা খামচা দিয়ে তুলে এনে একটা গভীর সিদ্ধান্ত প্রচার করে দেন, তাদের বিদ্যা এবং বোধ নিয়েও কিছু কথা বলার থাকে। মনে রাখবেন– এতদ্বারা আমি এমন কিছু বলতে চাইছি না যে স্ত্রীলোককে ‘কমোডিটাইজ করাটা মহাভারতীয় পৌরুষেয়তার আদত নয়। কমোডিটাইজেশন’-এর ধারণাটা বিংশ-একবিংশ শতাব্দীর পরিশীলিত চিন্তার ফসল এবং সেটা পুরুষশাসিত সমাজে স্ত্রীলোকের প্রতি পুরুষের ব্যবহারের নিরিখে নির্ণীত এবং সেই ব্যবহার প্রায়শই হয় বলেই ‘কমোডিটাইজেশন’-এর ধারণাটাকে আমরা ‘কনসেপ্ট হিসেবে গ্রহণ করেছি। কিন্তু মহাভারতীয় মাধবীর ক্ষেত্রে এটাই হয়েছে, এটা বলাটাও যেমন অতিসরলীকরণ, তেমনই আরও অতিসরলীকরণের নমুনা হবে এই কাহিনির নিরিখে মহাভারতের সমাজটাকে ধরে ফেলা। কেননা সমাজকে বুঝতে হলে সেই সমাজের সাধারণ রীতি-নীতি-প্রবৃত্তি দিয়েই বুঝতে হবে এবং বুঝতে হবে ‘কনটেক্সচুয়ালি’
মহাভারতের মধ্যে যে-সব জায়গায় বিধি-নিষেধাত্মক ‘ডাইডাকটিক’ কথাবার্তা আছে, সে-সব জায়গায় শুল্কের পরিবর্তে বা টাকা-পয়সার পরিবর্তে মেয়েদের বিয়ে করাটাই ভয়ঙ্কর অপরাধের মধ্যে পড়ে, সেখানে মাধবীর ঘটনাটা তো রীতিমতো বেশ্যাগৃহের আচরিত ভাবনার মধ্যে পড়ার কথা। মহাভারতের শান্তিপর্বে যুধিষ্ঠিরের একটি সদর্থক প্রশ্নের উত্তরে ভীষ্ম বলেছিলেন– দেখো বাছা যুধিষ্ঠির! বিয়ের সময় এই টাকা-পয়সার লেনদেন ব্যাপারটাই ভীষণ খারাপ –নৈব নিষ্ঠাকরং শুল্কম। কন্যার পিতারা বরপক্ষের কাছে পণের টাকা চান তখনই, যখন দেখেন বরের বুদ্ধি কম, বয়স বেশি অথবা বর অর্থহীন। এইরকম গুণহীন বরের ক্ষেত্রেই কন্যাপণের প্রশ্ন ওঠে। পণের বিষয়ে ভীষ্ম যেটা বলেছেন, সেই বরপক্ষের দুর্বলতাটাই পণপ্রথা চালু করে দিয়েছিল সেকালে। ব্যাপারটা উলটো হয়ে ফিরে এসেছে পরবর্তী কালে, যখন পুরুষ-সমাজ নিজেদের স্বার্থবুদ্ধিতে এটা বুঝেছে যে, মেয়েরা শারীরিক ক্ষেত্রে এবং অর্থাগমের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত দুর্বল, অতএব সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই বরপণ চালু হয়ে উঠল। তবে এই চালুমির পিছনে পুরুষের দুষ্টতার ইতিহাস আরও আছে, সেটা আমাদের আলোচনায় এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। বরঞ্চ বলার দরকার এটাই যে, ভারতবর্ষীয় সমাজের বিস্তারে প্রথম দিকে কন্যাপণই চালু ছিল এবং তা এতটাই যে, সেটাকে সমাজ-বিহিত করার জন্য একটু ধর্মভাবও নিহিত করা হয়েছে কন্যাপণের মধ্যে। কন্যার পিতা কন্যার ওপর স্বস্বত্ব নাশ করে বরের কাছে সম্প্রদান করছেন এবং দানধর্মের নিয়মে ভীষ্ম বলেছেন– দান যখন করা হচ্ছে, তখন তার বদলে কিছু নেওয়াটা অধর্ম নয় অর্থাৎ মেয়ের বাপ কন্যাদানের মতো একটা আন্তরিক দান করছে, তার বদলে সে কিছু নিতেই পারে। প্রতিগৃহ্য ভবেদ দেয় এষ ধর্মঃ সনাতনঃ।
সমাজের চাপেই হোক বা পৌরুষেয়তার চাপেই হোক, দানধর্মের নিরিখে কন্যাপণের নীতি ভীষ্ম সাধারণভাবে পরম অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেনে নিয়েছেন বটে, কিন্তু একই সঙ্গে বিবাহের ক্ষেত্রে টাকা-পয়সার লেন-দেন ব্যাপারটা মহাভারতীয় সমাজের প্রতিভূ প্রধান ভীষ্ম একেবারেই পছন্দ করেননি। কন্যাপক্ষ অথবা বরপক্ষ যে কেউ পণ নিচ্ছে– এই ব্যাপারটাকে ভীষ্ম দ্রব্যবিক্রয়ের শামিল বলে মনে করেছেন। অর্থাৎ পণ নেওয়াটাই ভীষ্ম ‘কমোডিটাইজেশন’-এর তন্ত্র বলে মনে করেছেন। তিনি বলেছেন– শুল্কগ্রহণের প্রথাটাই অন্যায় কন্যা ক্রয়ও কোরো না, কন্যা বিক্রয়ও কোরো না–ন হেব ভার্যা ক্রেতব্যা ন বিক্রেতব্যা কথঞ্চন। ক্রয় এবং বিক্রয় কথাটা ‘কমোডিটি’র ধারণা থেকেই উচ্চারিত শুধু নয়, এই দুটি শব্দে বরপক্ষ এবং কন্যাপক্ষ দু’পক্ষই জড়িয়ে গেল। এই ক্রয়-বিক্রয় পণের মাধ্যমে হয় বলেই মহাভারত রীতিমতো ঘেন্না দেখিয়ে বলেছে– ঘরের দাসীটিকেও যে ক্রয়-বিক্রয় করে, সেই লোভী পাপিষ্ঠ ব্যক্তির ভাবনা-চিন্তাও আসলে দাস-দাসীর মতো হয়ে যায়– ভবেত্তেষাং তথা নিষ্ঠা লুব্ধানাং পাপচেতসাম্।
এই রকমটা করা উচিত এবং এই-রকমটা নয়– ঠিক এই ধরনের বিধি-নিষেধমূলক শাস্ত্রীয় উপদেশের মধ্যে কন্যাপণের ক্ষেত্রে কন্যার পিতা বা অভিভাবকের হাতে অর্থ খুঁজে দেওয়াটা শাস্ত্রীয়ভাবে অন্যায় এবং ব্যবহারিকভাবে ঘৃণ্য বলে মনে করেছে মহাভারত; কিন্তু মহাভারতের সমাজে কন্যাপণের একটা দেশাচার, কুলাচার কোথাও কোথাও ছিল– একথা পাণ্ডুর সঙ্গে মাদ্রীর বিবাহের সময়ে প্রমাণিত হয়েছে। মাদ্রীর বিয়ের সময় মাদ্রীর ভাই শল্য খুব সঙ্কোচের সঙ্গে ভীষ্মকে নিজেদের কুলাচার জানিয়ে বলেছিলেন আমাদের এইরকম বংশনিয়ম আছে বটে এবং সেইজন্যই এই কন্যা বরণ করে নিয়ে যাবার জন্য একটু কিছু আপনি দিন, একথা আপনাকে বলতে আমার সংকোচ হচ্ছেন চ যুক্তং তথা বক্তৃং ভবান দেহীতি সত্তম। তা ভীষ্ম মদ্রদেশের কুলাচার মেনে হস্তিনাপুরের রাজগৌরব দেখিয়ে মাদ্রীর দাদা শল্যর হাতে অনেক সোনাদানা ধনরত্ন দিয়েছিলেন এবং অতটা শল্য চানওনি। কিন্তু মহাভারতে এই ঘটনাটাকে কি কোনও উপায়ে এইভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে যে, অর্থের বিনিময়ে স্ত্রীলোককে ভোগ করার জন্য এই পৌরুষেয় ব্যবস্থা চালু হয়েছিল? নাকি পরবর্তী কালে যখন বরপণ চালু হয়, তখন উলটো দিকে এইরকম বলা যাবে যে, অর্থের বিনিময়ে পুরুষকে ভোগ করার জন্য বরপণ চালু হয়েছিল? আসলে পণপ্রথা একটা সামাজিক অভিশাপ, কিন্তু সেখানে অর্থলোভের সঙ্গে জড়িত আছে বৈবাহিক সমস্যা এবং সে সমস্যার পিছনেও আছে অন্যতর পৌরুষেয় শক্তি, তার সঙ্গে মাধবীর ঘটনা মেলানো যায় না।
বিশেষত গালব-মাধবীর ঘটনা-কাহিনি মহাভারতে এমন একটা কনটেকসচুয়াল’ উদ্দেশ্য নিয়ে লিখিত হয়েছে, যেখানে বোঝা যায় এটা মহাভারতীয় সমাজের রীতি নয় এবং এই কাহিনির তাৎপর্য অন্যত্র। বিশেষত এইরকম ঘটনার দ্বিতীয় উদাহরণও মহাভারতে পাওয়া যাবে না এবং ঠিক সেইজন্যই এই প্ৰায়াদ্ভুত ঘটনাটা–প্রসঙ্গ উল্লেখপূর্বক ব্যাখ্যা না করে মহাভারতের সমুদ্রকল্প বিস্তার থেকে হঠাৎ এক অঞ্জলি জল তুলে নিয়ে বললাম– এটাই অমুক নদীর জল, এটা ‘কমোডিটাইজেশন’-এর উদাহরণ, মাধবী আসলে ‘ইউজেবল উওম্যান’ আমার কাছে এ-কথা খানিক অল্পজ্ঞ ব্যক্তির অতি উত্তেজনা বলে মনে হয়। যদি তা না হয়, তা হলে যে-মুহূর্তে হর্যশ্ব রাজা গালব ঋষিকে প্রস্তাব দিলেন দেখুন, আপনার বলা ওইরকম নির্দিষ্ট অশ্ব আমার কাছে দু’শোর বেশি নেই, এই অবস্থায় আমার ইচ্ছেটার কথা একবার ভাববেন, তখন সেই মুহূর্তে মাধবীর উত্তরটা কিন্তু ‘উইমেনস ডিজায়ার’ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে হয়।
লক্ষণীয়, হর্যস্ব মাধবীকে দেখে ‘কামমোহিত ছিলেন। ফলে পর্যাপ্ত অশ্ব না থাকলেও মাত্র দু’শো ঘোড়ার পরিবর্তে তিনি যখন মাধবীর সঙ্গ-কামনা করে মাত্র একটি সন্তানের জন্য গালব ঋষির অনুমোদন ভিক্ষা করছেন, তখন কিন্তু গালব কোনও উত্তর দিতে পারেননি, তিনি সেই মুহূর্তে বিভ্রান্ত, কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। যযাতি-কন্যা মাধবীকে তিনি আর তো ব্যবহার করতে পারবেন না, অতএব তাঁর গুরুদক্ষিণার কী হবে? গালব ঋষির এই বিভ্রান্ত হতভম্ব অবস্থায় প্রথম কথা বলছেন মাধবী! এতক্ষণ তার মুখ দিয়ে কোনও কথা আমরা শুনতে পাইনি। পিতা যযাতি যখন তাঁকে গালব-ঋষির হাতে দিয়েছেন, তখন ঋষির গুরুকার্যে সাহায্য করার জন্য তিনি নিজের স্বার্থের একটি কথাও বলেননি এবং মহাভারতের মহাকাব্যিক পরিমণ্ডলে এখানে তাকে জিজ্ঞাসা করাও হল না, পিতৃকার্যে ঋষিকার্যে তার কোনও সম্মতি আছে কিনা; বস্তুত এই আক্ষেপ একেবারেই অবান্তর। মহাকাব্যিক সমাজে পৌরুষেয়তার সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে চলাটা মহাকাব্যিক রমণীর অভ্যাসের মধ্যে পড়ে।
মহাকাব্যিক মহাভারতের রমণী এতটা পারেন বলেই হ্যশ্বরাজার কামোন্মুখ প্রস্তাবনায় গালব ঋষি যখন বিভ্রান্ত, তখন মাধবী নিজেই গালবকে বললেন- আপনি বিব্রত হবেন না, ঋষি! আমাকে এক ব্রহ্মবাদী মুনি বর দিয়েছেন যে, তুমি যদি জৈব রতির মাধ্যমে সন্তান-লাভও করো, তা হলে প্রত্যেক প্রসবের পরেই তুমি কনাভাব লাভ করবে– প্রসূত্যন্তে প্রসূত্যন্তে কন্যৈব ত্বং ভবিষ্যসি। অতএব গালব! আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনি নিশ্চিন্তে হ্যশ্ব রাজার হাতে আমাকে সমর্পণ করুন এবং পরিবর্তে আপনার নির্দিষ্ট দু’শো ঘোড়া আপনি নিয়ে নিন। এইভাবে আমি চার জন রাজার কাছে নিজেকে সমর্পণ করলেই তো আপনার আটশো ঘোড়াও হয়ে যাবে আর আমারও চার-চারটে ছেলে হবে। আপনি আর চিন্তা করবেন না, আপনি এইভাবেই গুরুদক্ষিণা দেবার সংকল্পটা শেষ করুন– ক্রিয়তাম উপসংহারো গুর্থং দ্বিজসত্তম– আর এ ছাড়া আর কোনও উপায়ও নেই, আপনি কী বলেন?
মাধবীকে নিয়ে যাঁরা পুরুষশাসনের গল্প লেখেন, তাঁরা মাধবীর এই উক্তিগুলি উদ্ধার করেন না। করলে, ‘কমোডিটাইজেশন’-এর গল্পও জমে না, ‘ইউজেব উইমেন’ নিয়ে প্রবন্ধ ফঁদাটাও বেকার হয়ে যায়। আমরা বলব– মহাভারতের চরিত্র নিয়ে ব্যক্তিসিদ্ধির প্রবন্ধ। লিখতে হলে, সেই চরিত্রকে সম্পূর্ণভাবে উপস্থিত করতে হবে, খামচা মেরে নয়। এখানে দেখার বিষয় যেটা, সেটা হল– মাধবীর নিজের ইচ্ছা। যযাতি যে মুহূর্তে তাকে গালবের হাতে দিয়েছেন, সেই মুহূর্তেই তিনি জানেন যে, তিনি কোনও রাজা-মহারাজার কণ্ঠলগ্না হতে যাচ্ছেন এবং নিজের শরীর সম্বন্ধেও তিনি এতটাই সচেতন যে, তিনি জানেন তাকে দেখলেই অতিবড় রাজারও ভোগস্পৃহা জন্মাবে। কিন্তু ভোগেচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতেও তার খুব একটা ছুঁৎমার্গ নেই। এবং একটা নয়– গালবকে তিনি যখন প্রত্যেক প্রসবান্তে কন্যাভাবের খবর শোনাচ্ছেন, সেই মুহূর্তেই মাধবী বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি খুব ‘ডিটাচড’ ভাবেই অন্যান্য রাজাদের যৌন আচরণে সাড়া দিতে পারেন, তার দিক থেকে কোনও সমস্যা নেই।
এখানে খেয়াল করতে হবে– মহাভারতের মহাকাব্যিক রমণীরা ‘সেক্সয়ালিটি’ ব্যাপারটাকে মধ্যযুগীয় স্পর্শকাতরতায় গ্রহণ করেননি। বিশেষত সমাজের দিকে তাকালেই যেহেতু বহুপুরুষগামিতার প্রশ্ন দেখা দেয়, তার জন্য সঙ্গম বা প্রসূতির পরেও দেবতা ঋষি-মুনির বরাভয়ে কন্যাভাব প্রাপ্ত হওয়ার একটা অলৌকিক প্রলেপ থাকে। এই জিনিস আমরা মহাভারতের অন্যতমা নায়িকা সত্যবতীর ক্ষেত্রে দেখেছি, কুন্তীর ক্ষেত্রে দেখেছি এবং স্বয়ং দ্রৌপদীর ক্ষেত্রেও দেখেছি। এঁরা প্রত্যেকেই এমন একটা সময়ে মুনি-ঋষি দেবতার কাছে আপন কন্যাভাবের স্থিতির জন্য প্রার্থনা জানাচ্ছেন, যখন পুরুষের যৌন আচরণে তাদের কন্যাভাব লঙ্ঘিত হচ্ছে, অথচ এই যৌন আচরণে তাদের সায় আছে। কিন্তু যৌনক্রিয়ায় অনুকূলভাবে প্রতিক্রিয় হলেও সামাজিক দৃষ্টিতে বিবাহপূর্ব যৌনতায় আসক্ত হলে– যেমনটি সত্যবতীর ক্ষেত্রে এবং কুন্তীর ক্ষেত্রে হচ্ছিল– তেমনটি হলে বৈবাহিক জীবনে যাতে কোনও সমস্যা না হয়, সেইজন্যই পুনরায় কন্যাভাবের জন্য আবেদন এসেছে সত্যবতীর মুখে ঋষি পরাশরের কাছে এবং কুন্তীর মুখে দেবতা সূর্যের কাছে। আর দ্রৌপদী নাকি পূর্বজন্মেই পঞ্চস্বামী লাভ করার জন্য দেবতার বরে প্রত্যেক পর্যায়ক্রান্ত স্বামীর কাছেই কন্যাভাব বজায় রাখতে পারতেন– মহানুভাবা কিল সা সুমধ্যমা। বভূব কন্যৈব গতে গতেহহনি।
আপনারা কী মনে করেন? লৌকিক সামাজিকতায় কন্যাভাব দূষিত হলে যে কলঙ্ক লেপন ঘটে, দৈবশক্তি বা আর্যশক্তির অলৌকিকত্বে সেই তথাকথিত সামাজিক দূষণ ধুয়ে মুছে যায়? মহাকাব্যের সাদৃষ্টিকী দৃষ্টিতে আমাদের তা মনে হয় না। আমাদের ধারণা, সত্যবতী, কুন্তী বা দ্রৌপদীর মতো মহাকাব্যের বৃহতী-মহতী নায়িকারা যেহেতু অন্যতর মহাকাব্যিক অভ্যুদয়ের সূচনা করেছেন, অতএব তাদের বিবাহপূর্বকালীন যৌন লঙ্ঘন অথবা বিবাহোত্তর বহু-পুরুষগামিতার ঘটনাকে সামাজিকের চোখে ব্যতিক্রমীভাবে সম্মত করে নেবার জন্যই আর্যশক্তি অথবা দৈবশক্তির অবতারনা ঘটেছে এখানে। তা ছাড়া সাধারণ লৌকিক সমাজে যুবক-যুবতীর পারস্পরিক কুতুহলে, অথবা পুরুষের অন্যায় আগ্রহ বা অত্যাগ্রহে রমণীকুলেও স্থলন তো ঘটেই, কন্যাভাবও দূষিত হয় কখনও কখনও। তো আমাদের শাস্ত্রকারেরা এই সামাজিক ব্যবহারকে একেবারে অস্বাভাবিক অন্যায় বলে ধরে নেননি। বশিষ্ঠস্মৃতি, অত্রিস্মৃতি অথবা পরাশর-স্মৃতির মতো সামাজিক আইনের গ্রন্থে এমনটা বলা হয়েছে যে, বিপদে পড়ে মেয়েদের এই যৌন লঙঘন ঘটতে পারে, বলাৎকারের ঘটনাও ঘটতে পারে, বিবাহিতা রমণীর ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে এই সব ব্যত্যয়, কিন্তু তাই বলে সেই মেয়েকে ত্যাগ করতে হবে, তাকে তাড়িয়ে দিতে হবে ঘর থেকে এমন কাজ করতে না করেছেন বশিষ্ঠ মুনি। তিনি বলেছেন– এইসব দুর্ঘটনা ঘটলে কন্যা বা স্ত্রীর পুষ্পকালের অপেক্ষা করো। সে পুষ্পবতী হলে ঋতুর মাধ্যমেই শুদ্ধা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে আবার– পুষ্পকালমুপাসীত ঋতুকালেন শুধ্যতি। হয়তো এতখানি গ্রহণযোগ্যতা ছিল বলেই ঋতুশুদ্ধি না ঘটলেও কানীন পুত্র সেকালের সমাজের চোখে ঘৃণা বা অবহেলার পাত্র ছিল না।
যদি এই দিক থেকে মাধবীর বক্তব্য বিচার করি, তা হলে বুঝব– তিনি নিজের কন্যাত্ব এবং সতীত্ব নিয়ে খুব আতঙ্কিত ছিলেন না এবং যৌনতার ক্ষেত্রে তার মানসিক প্রস্তুতি এমনই যে, গালবের কাছে তিনি নিজেই প্রস্তাব দিচ্ছেন যে, হ্যশ্ব রাজার পুত্র-কামনা এবং কামনার প্রয়োজনে তিনি নিজেই তার সঙ্গে মিলিত হতে রাজি। শুধু তাই নয়, তিনি নিজের কুমারীত্ব নিয়েও তত চিন্তিত নন, কেননা ব্রহ্মবাদী ঋষির বরেই হোক, অথবা বৃহত্তর প্রয়োজনে তিনি নিজের শরীরকে সতীচ্ছন্নতায় আবৃত করতে চান না বলেই হোক, তিনি হর্যশ্ব রাজার একটি সন্তান ধারণ করতে স্বেচ্ছায় স্বীকৃত হচ্ছেন। এর মধ্যে হর্যশ্ব কৃত তার উচ্চাবচ শরীর সংস্থানের বর্ণনাটা মাধবীর আত্মতুষ্টিও যেমন ঘটিয়েছে, তেমনই যুবতী রমণী হিসেবে তার শারীরিক শংসা শারীর মিলনের উদ্দীপন হিসেবেও কাজ করছে। বলে আমরা মনে করি। সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য এ কথাটাও বলতে হবে যে, এই সম্পূর্ণ ঘটনার মধ্যে মাধবীর দিক থেকে একটা ‘ডিটাচমেন্ট’-ও আছে; হয়তো বা সেটা এক ধরনের অনাসক্ত কর্তব্য পালনের মতো, কিন্তু সামনাসামনি তার আন্তরিকতারও অভাব নেই– তিনি অসহায় কামমোহিত হর্যশ্ব রাজাকেও তার অভীষ্ট এবং একান্তকাম্য শরীর দিয়ে তৃপ্ত করতে চান কেননা তাতে গালব ঋষির গুরুদক্ষিণার দায় সিদ্ধ হবে; অন্যদিকে তিনি তাঁর বহুস্তুত রমণী-শরীর নিয়েও মানসিকভাবে আকণ্ঠ ব্যাপৃত নন, অথবা এতটাই নিজের সম্বন্ধে তার আস্থাবোধ, যাতে বলতে পারেন– একটা সন্তান দেওয়া নিয়ে তো কথা। তো প্রত্যেক প্রসবের পরেই আমি আবারও কুমারীই তো বটে– প্রসূত্যন্তে প্রসূত্যন্তে কন্যেব ত্বং ভবিষ্যসি– অতএব গালবকে তিনি বলছেন– গালব! চিন্তা কোরো না, চারজন রাজার কাছে আমাকে দান করো তুমি। তোমার আটশো ঘোড়ার প্রতিশ্রুতি ঠিক থাকবে তাতে–নৃপেভ্যো হি চতুর্ভস্তে পূর্ণান্যস্টেী শতানি চ।
এখানে আর একটা অন্তরাল ঘটনা বোধহয় এরই মধ্যে অন্তহীনভাবে চলছে। পিতা যযাতি গালব ঋষির হাতে মাধবীকে দিয়েছেন তার প্রতিশ্রুত গুরুদক্ষিণা-সিদ্ধির জন্য। গালব ব্রহ্মচারী যুবক। সদ্য বিদ্যালাভ সম্পূর্ণ করেছেন, মাধবী তার সঙ্গে যাচ্ছেন অসহায় ব্রাহ্মণের প্রতিজ্ঞা পূরণে সাহায্য করতে। গালব যখন হ্যশ্ব রাজার কাছে আসেন, তখন ভেবেছিলেন যে, রাজার সঙ্গে রাজকুমারীর বিয়ে হবে, মাধবী ইক্ষাকুবংশের রাজবধূ হবেন, অতএব মাধবীকে একবারের তরে ব্যবহার করলেও তিনি তাকে জলে ফেলে দিচ্ছেন না। কিন্তু যে-মুহূর্তে হয় বলেছিলেন– আমার কাছে মাত্র দু’শো ঘোড়াই আছে। অথচ মাধবীকে আমি চাই, সেই মুহূর্তে অসীম অসহায় এক লজ্জা তাকে গ্রাস করেছিল। একজন বিখ্যাতবংশীয় রাজা, যিনি পরম নির্লজ্জভাবে মাধবীর সামনেই তার উচ্চাবচ শরীর-সংস্থান বর্ণনা করে তাকে কামনা করছেন, অথচ প্রস্তাবিত আটশো অশ্ব তার দেবার ক্ষমতা নেই– এই অবস্থায় বিব্রত গালবকে আশ্বস্ত করছেন মাধবী। কেন করছেন, তার কি অসহায় ছন্নছাড়া ব্রাহ্মণ যুবককে ভাল লেগেছিল? মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে এ কথা উচ্চারণ করেননি, সম্পর্কের স্পষ্টতা না থাকলে তিনি তা করবেন না। কিন্তু কোথাও কখনও যেন। মনে হয়– গুরুদক্ষিণার চক্রে পড়ে যাওয়া ইতস্তত ভ্রাম্যমাণ এই যুবকটির প্রতি মাধবীর কিছু করুণামিশ্রিত দুর্বলতাও হয়তো আছে।
মাধবীর স্বেচ্ছা-প্রণোদিত কথা শুনে গালব মুক্তি পেলেন যেন। গালব হ্যশ্ব রাজাকে। বললেন- আপনি গ্রহণ করুন এই কন্যাকে, কিন্তু মনে রাখবেন মহারাজ! আপনি এক চতুর্থাংশ ঘোড়া দেবেন যেহেতু, অতএব এই রমণীর গর্ভে একটিই মাত্র পুত্র উৎপাদন করবেন– চতুর্ভাগেন শুল্কস্য জনয়কৈমাত্মজম। মহারাজ হর্যশ্ব গালবকে অভিনন্দন। জানিয়ে মাধবীকে গ্রহণ করলেন সুতোৎপত্তির জন্য। অন্তত এই কারণটাই ধর্মশাস্ত্রের নিয়মে দেখাতে হয় এবং বিবাহের অন্যতম ফল যে রতিশান্তি, সেটা ধর্মশাস্ত্রের মতে গৌণফল বলেই মহাভারতের কবি সব বুঝিয়ে দিয়েও সামাজিকদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছেন। এটাও এখানে লক্ষ করার মতো যে, হর্যশ্ব রাজা মাধবীকে এমনিই গ্রহণ করলেন, নাকি বিবাহ করলেন বিধিসম্মতভাবে। আমরা মনে করি– ঠিক এই মুহূর্তে স্পষ্টোচ্চারিত শব্দে প্রকাশ না করলেও প্রতিগ্রহ’ শব্দের অর্থ যেহেতু ‘বিবাহ’-ই এবং বিবাহের জন্য নির্ধারিতা কন্যাই যেহেতু প্রতিগ্ৰহ’ শব্দের অভিধেয় অর্থ, অতএব সেই শব্দটিকে ক্রিয়াপদে প্রয়োগ করে মহাভারতের কবি বুঝিয়ে দিলেন যে, হ্যশ্ব মাধবীকে বিবাহ করেছেন বিধি-নিয়ম ক্ষেত্রেই প্রতিগৃহ্য স তাং কন্যাং গালবং প্রতিনন্দ্য চ। এবং এটা যদি না হত তা হলে মাধবীর গর্ভে যে বিরাট অভ্যুদয়শালী ইক্ষাকুবংশের ধুরন্ধর পুত্ৰ বসুমনা জন্মালেন, তাঁর এত মর্যাদা উচ্চারিত হত না স্বয়ং সামাজিক মহাকবির মুখে।
রাজার পুত্রলাভের খবর পেয়েই গালব ঋষি এলেন রাজার কাছে। বললেন– আপনার সূর্যবংশে সূর্যের মতোই তো এক পুত্র লাভ করেছেন আপনি। কিন্তু আমার তো কপাল, আমাকে শুল্কসংগ্রহের জন্য অন্য রাজাদের কাছেও যেতে হবে। অতএব সময় তো হয়ে গেল, মহারাজ– কালো গন্তুং নরশ্রেষ্ঠ শুল্কাৰ্থম অপরং নৃপম। হ্যশ্ব রাজা তার সত্য রক্ষা করে মাধবীকে এনে দিলেন গালবের কাছে এবং মাধবীও দীপ্ত রাজৈশ্বর্য ত্যাগ করে কুমারী কন্যার মতো গালবের সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগলেন– কুমারী কামতো ভূত্বা গালবং পৃষ্ঠতোহগাৎ। অর্থাৎ মহাকাব্যের কবি এই মুহূর্তে মাধবীর নির্বিকার ভাবের সঙ্গে তার অনায়াস অনাসক্ত আচরণটাকে প্রায় পুরুষসুলভ ব্যক্তিত্বের আভাসে দেখছেন। দৈবভাব বা আর্ষতায় তিনি কতটা কুমারীত্ব লাভ করেছেন জানি না, কিন্তু একটি সন্তান প্রসব করার। পর নিজেকে আবার কুমারী ভেবে নিয়ে অন্যতর এক পুরুষের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে প্রবেশ করতে যে ব্যক্তিত্ব লাগে, তাকে ‘কামাবশায়িতা’ বলব কিনা, সেটা চলন্তিকার আভিধানিক যুক্তিতেও যেমন মেনে নিতে পারি, তেমনই পারি রমণীর পুরুষায়ণী শক্তির যুক্তিতেও। ‘কামাবশায়িতা’ কথাটা আমার বন্ধু অপরাজিতার কাছ থেকে ধার করা।
যাই হোক, মাধবীকে সঙ্গে নিয়ে গালব এবার কাশীপতি বিখ্যাত দিবোদাস রাজার কাছে পৌঁছোলেন। দিবোদাসের কাছে যাবার আগে গালব মাধবীর কাছে যেমন তাঁর খ্যাতির বর্ণনা করেছেন, তেমনই এই অপরিচিত পুরুষের সম্বন্ধে মাধবীর মনের মধ্যে একটা আনুকূল্য ঘনিয়ে আনবারও চেষ্টা করছেন। একজন অভিজাত বংশীয়া রমণীর মনের মধ্যে এক পুরুষ থেকে পুরুষান্তর-গমনের কল্পনায় আশঙ্কা থাকাটাই খুব স্বাভাবিক। বিশেষ করে পুরুষের যৌন ব্যবহারের মধ্যে পৌরুষেয় বিকারগুলিও অপরিচিতা রমণীর কাছে আশঙ্কনীয়ভাবেই চিন্তার বস্তু হয়ে ওঠে। হয়তো এই কারণেই দিবোদাসের কাছে যাবার আগে গালব মাধবীকে বলছেন– তুমি চিন্তা কোরো না, ভদ্রে! তুমি ধীরে ধীরে চল আমার সঙ্গে তত্র গচ্ছাবহে ভদ্রে শনৈরাগচ্ছ মা শুচঃ। দেখো, আমি যতটুকু জানি– দিবোদাস খুব ধার্মিক রাজা, খুব সংযমী মানুষও বটে। সর্বদা তিনি সত্যে স্থিত আছেন, অতএব চিন্তা কোরো না তুমি, আমরা তার কাছে যাব- ধার্মিকঃ সংযমে যুক্তঃ সত্যে চৈব জনেশ্বর। হয়তো পূর্ব রাজা হর্যশ্ব যেভাবে মাধবীর সামনেই তার শরীর নিয়ে কথা বলেছিলেন, তার মধ্যে যে ইঙ্গিত ছিল, গালব বুঝি এখন তার ওপর প্রলেপ রচনা করছেন।
গালবের কথাগুলি খুব মিথ্যাও ছিল না। গালব যখন দিবোদাসের কাছে গিয়ে তার প্রস্তাব দিলেন, তখন দিবোদাস খুব সংযতভাবে জানিয়েছেন– আমি পূর্বে শুনেছি মাধবীর কথা। কাজেই এঁর সম্বন্ধে আর বেশি কথা বলার প্রয়োজনই নেই– শ্রুতমেতন্ময়া পূর্বং কিমুক্কা বিস্তরং দ্বিজ। আমি এঁর কথা শোনামাত্রই মনে মনে তাঁকে চেয়েছি। আর আমার সত্যিই ভাল লাগছে দেখে যে, আপনি অন্যান্য রাজাদের ছেড়ে দিয়ে আমার কাছেই এসেছেন- মামেবমুপতোহসি… যদুৎসৃজ্য নরাধিপান। তবে সত্য কথা আগেই জানিয়ে রাখি– আমারও অশ্বধন কিন্তু মহারাজ হর্যশ্বের মতোই ওই বিশেষ প্রকারের ঘোড়া আমার কাছেও ওই দু’শাই আছে এবং আমিও এই রমণীর গর্ভে একটিই মাত্র পুত্র উৎপাদন করতে চাই– অহমপ্যেকমেবাস্যাং জনয়িষ্যামি পার্থিবম্।
এটা বোঝা যাচ্ছে যে, মাধবীর রূপ-গুণ এবং তার নিরাসক্ত রতি-সম্পর্কের কথা অযোধ্যার ভূমিমণ্ডল থেকে কাশীখণ্ডে এসে পৌঁছেছে এবং হয়তো বা নির্দিষ্ট অশ্বধন আছে বলেই দিবোদাস আশা করতে আরম্ভ করেছিলেন যে, মাধবী একদিন তার কাছেও উপস্থিত হবেন। এ কথা জানাতেও তিনি লজ্জাবোধ করেননি যে, মাধবীর অসামান্য রূপের কথা তিনি শুনেছেন এবং তার কথা শ্রবণমাত্রেই তিনি তাকে লাভ করার আশা করতে আরম্ভ করেছেন– কাঙিক্ষতো ময়ৈযোর্থঃ ত্বৈব দ্বিজসত্তম। তবে দিবোদাসের ক্ষেত্রে কামনার ভাগটা আমরা একটু অন্যরকম দেখছি, তার মুখের ভাষাও একজন বিদগ্ধা রমণীর কাছে সুখশ্রাব্য। আরও লক্ষণীয়, গালব কন্যাভাবিতা মাধবীকে দিবোদাসের হাতে দিতেই তিনি বেদবিধি অনুসারে তাকে বিবাহ করলেন– বিধিপূর্বঞ্চ তাং রাজা কন্যাং প্রতিগৃহীতবান।
এই সংবাদটাকেও আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। তার মানে, মাধবী বহুপুরুষগামী হওয়া সত্ত্বেও তিনি গণিকা-বেশ্যার সমতা লাভ করছেন না কিন্তু পুরুষের রতিতৃপ্তির প্রসঙ্গটা এখানে অবশ্যই খুব জোরদার, কিন্তু অন্যের দ্বারা উপভুক্তা হওয়া সত্ত্বেও মাধবীর স্বাত্মারোপিত কন্যাভাবের জন্যই হোক অথবা বংশের ধারা বিধিসম্মতভাবে বজায় রাখার জন্যই হোক, মাধবীকে কিন্তু বিধিসম্মতভাবেই বিবাহ করতে হচ্ছে। এটাকে মাধবীর প্রতি সম্মান-প্রদর্শনের পরিসর বলেই ধরতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, কাশীশ্বর দিবোদাসের সঙ্গে মাধবীর বৈবাহিক প্রসঙ্গে পৌরাণিক যত বিখ্যাত স্বামী-স্ত্রীর উদাহরণ আছে, স্বামিত্ব এবং সতীত্বের ক্ষেত্রে পুরাণগুলি যাঁদের দৃষ্টান্ত বলে মনে করে, সেই সব উদাহরণ একের পর এক এখানে উচ্চারণ করে শেষে বলা হল- রাম যেমন সীতার সঙ্গে, কৃষ্ণ যেমন রুক্মিণীর সঙ্গে রমণ করেছেন, ঠিক সেইভাবেই রাজর্ষি দিবোদাস মাধবীর সঙ্গে রমণ করতে লাগলেন এবং সেই বিধিসম্মত রতির ফল হল মাধবীর গর্ভজাত পুত্ৰ পুরাণ-বিখ্যাত প্রতর্দন–মাধবী জনয়ামাস পুত্রমেকং প্রতদন। দিবোদাস পুত্রলাভ করার সঙ্গে সঙ্গে গালব ঋষি আবারও উপস্থিত হলেন তাঁর কাছে। দিবোদাস কাল বিলম্ব না করে মাধবীকে গালবের কাছে প্রত্যর্পণ করলেন।
আবারও পথ চলা শুরু হল। মহাভারতের কবি মিতভাষায় মন্তব্য করলেন– হর্যশ্বের গৃহে পূর্বোপভুক্তা রাজলক্ষ্মীর মতো দিবোদাসের ঐশ্বর্যলক্ষ্মীকেও ত্যাগ করে মাধবী আবারও গালবের সঙ্গে চলতে লাগলেন নিজের সত্যে স্থিত থেকে এবং সেই কন্যা-ভাব আবারও সংক্রমিত হল তার মধ্যে– তথৈব ত্বং শ্রিয়ং ত্যক্তা কন্যা ভূহ যশস্বিনী। কথাটা প্রত্যেক বারই উচ্চারণ করছেন মহাভারতের কবি– আবারও তিনি কন্যা হয়ে গালবের সঙ্গে পথ চলতে লাগলেন। আমাদের দেশের বিশাল যে সাংস্কারিক জগৎ, সেখানে সতীত্বের অহংকারে পুত্রোপম পুরুষের স্পর্শও দূষণযোগ্য মনে করেছেন সীতা এবং তিনি হনুমানের পিঠে চড়ে স্বামীর কাছে আসতেও সযত্নে অস্বীকার করেছেন। ঠিক এই সামাজিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে মহাভারতের কবি কিন্তু এমন একটা বৈপ্লবিক চরিত্র চিত্রণ করছেন, যেখানে যৌনতার বিষয়ে প্রথাগত সংস্কারের বাইরেও আরও একটা তর্ক-যুক্তি যেন কাজ করছে। একথা ঠিক যে, ভারতবর্ষের ধর্মশাস্ত্র এবং উপদেশের জায়গায় মহাভারতও একই কথা বলবে। বলবে যৌনতা মানেই অন্যায় এবং সেটা পাপ। বিধিসম্মত বিবাহের মাধ্যমে এই পাপমুক্তি ঘটতে পারে এবং সেখানে সন্তান লাভ করে বংশরক্ষা করাটাই প্রধান প্রয়োজন।
আমরা বলব– এই ভাবনার মধ্যে নতুন কিছু নেই, ভারতবর্ষে এই সিদ্ধান্তের জন্য মনুর মতো ধর্মশাস্ত্রকারেরা যেরকম, সেইরকম ওই দেশেও সেইন্ট টমাস আকুনাস আছেন, আছেন অগাস্টাইন। এবং আশ্চর্য যে, মাধবীর ক্ষেত্রেও প্রত্যেক বার একটি রাজার সঙ্গে তার বিধিসিদ্ধ বিবাহ হচ্ছে এবং তিনি নিঃসন্তান পুরুষের বংশরক্ষায় সাহায্য করছেন। অতএব এটা ‘মরাল সেক্স, যেটাকে প্রাচীন মত দেখানোর জন্য বলা হয়েছে marriage prevents us from using others merely as instruments for fulfilling our sexual appetites. অথচ আপাতদৃষ্টিতে স্বয়ং মাধবীকেই অনেকের ইউজেবল মনে হচ্ছে। হয়তো এর কারণ একটাই, তিনি বহু পুরুষের সঙ্গ করছেন। আমরা তো বলব– মহাভারতে মাধবীর এই উদাহরণটাকে মহাভারতীয় কালে স্ত্রীলোকের ইচ্ছার মূল্য হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত। কেননা পরার্থ-সাধনের মতো এক মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখেও গালবকে তিনি প্রথমেই হতাশ করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে নিজের কন্যাভাবের যুক্তিটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তিনি স্বেচ্ছায় এই বহুগামিতায় অনুমোদন দিয়েছেন। মহাভারতের কবি এবং মহাভারতের সমাজ মাধবীকে সহায়তা দিয়েছে ধর্মশাস্ত্রীয় যুক্তিতে। প্রত্যেক পুরুষ গমনে একবার করে বিবাহ এবং পুনরায় কন্যাভাবের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ‘সেক্স’ ব্যাপারটাও ‘রিডিমেবল হয়ে ওঠে। আমার এক পুরাতনী পরিচিতা সিনেমার নায়িকা, যিনি সেকালে যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন এবং খানিক পুরুষ-গমনে অভ্যস্ত ছিলেন, তিনি একদিন বলেছিলেন- সমস্যাটা বহুপুরুষগামিতা বা বহুনারীগমনের মধ্যে নয়, সমস্যাটা আসলে ‘পাপবোধ’ নিয়ে। কথাটা প্রায় পণ্ডিত-গবেষক প্রাইমোরাটজ-এর কাছাকাছি নিয়ে যায়– যিনি বলেছিলেন– স্ত্রী-পুরুষের যৌনাচারের মধ্যে বিশেষ নৈতিকতার তাৎপর্য নেই, কেননা যৌনাচার নীতিগতভাবে আপন স্বতন্ত্রাতেই নিরপেক্ষ– সেক্স ইজ মর্যালি নিউট্রাল।
বাংলা অনুবাদটা তেমন ভাল হল না এবং ততোধিক ভালভাবেও আমরা মাধবীর যৌন ব্যবহার বোঝাতে পারছি না। তবে এটা বলতেই পারি যে, তাঁর কন্যাভাবের আর্ষ যুক্তিটা আসলে তার পাপবোধহীনতার প্রতিরূপ এবং এটা আপনাকে খানিকটা মানতেই হবে যে, মহাভারতে সত্যবতী, কুন্তী এবং দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে বারংবার সেই কন্যাভাবের উপযোগ দেখিয়ে ‘প্রিমেরিটাল’ বা ‘পোলিয়েনড্রাস’ যৌনতার মধ্যে সেই পাপবোধ নিরসনেরই চেষ্টা করা হয়েছে দেবতার বর বা ঋষির আশীর্বাদের মাধ্যমে। মাধবীর ক্ষেত্রটা আরও একটু আলাদা– তিনি বিবাহ করছেন, বিবাহিত স্বামীর জন্য পুত্রোৎপাদন করছেন, কিন্তু তার পরেই পূর্বস্বামী এবং তার দীপ্তা রাজলক্ষ্মীকে ত্যাগ করে অন্য পুরুষের অঙ্কশায়িনী হয়েছেন স্বেচ্ছায়, কিন্তু পরার্থতায়– শুধু গালবের জন্য, যদিও এই কাহিনির মধ্যে অন্যতর এক তাৎপর্যও ফুটে উঠবে, যেখানে সমাজের অনন্ত পৌরুষেয়তার মধ্যে বংশধারা রক্ষার ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের উপযোগের জায়গাটাও তাৎক্ষণিকভাবে প্রধান হয়ে উঠবে। কিন্তু সে কথা পরে।
মাধবী গালবের পিছন-পিছন এবার ভোজরাজ্যে এসে পৌঁছোলেন। এই রাজ্যের রাজার নাম উশীনর। গালব তাকে বললেন–মহারাজ! এই কন্যার গর্ভে আপনি চন্দ্র-সূর্যের মতো দুটি পুত্র লাভ করতে পারেন, তাতে ইহলোক-পরলোক দুইই চরিতার্থ হবে আপনার। তবে আমার একটা প্রয়োজন আছে এখানে। দুটি পুত্র-রত্ন-লাভের পরিবর্তে আমাকে কালো কানওয়ালা চারশোটি সাদা ঘোড়া দিতে হবে। আমি নিজের জন্য এসব চাইছি না, কিন্তু গুরুদক্ষিণার দায় মেটাতে আমার এই চেষ্টা– গুৰ্বৰ্থোহয়ং সমারম্ভো ন হয়ৈঃ কৃতমস্তি মে। উশীনর বললেন– আপনার কথা সব শুনলাম বটে, কিন্তু দুর্দৈব আমার। আমার কাছেও দু’শোর বেশি ঘোড়া নেই। সুতরাং গালব! আমিও এই কন্যার গর্ভে একটিই মাত্র পুত্র লাভ করতে চাই, আপনি দেবকন্যাসদৃশী এই কুমারী রমণীকে দান করুন আমার হাতে কুমারীং দেবগর্ভাভাম একপুত্ৰভবায় মে।
‘প্রতিগ্রহ’ অর্থাৎ বিবাহার্থক শব্দটা এখানেও এল, যদিও সেটা প্রযোজক ক্রিয়ায় এইভাবে বলা হল যে, গালব ঋষি উশীনর রাজার সঙ্গে মাধবীর বিধিবৎ পাণিগ্রহণ-কর্ম করিয়ে তখনকার মতো বনে চলে গেলেন– উশীনরং প্রতিগ্রাহ্য গালবঃ প্রযৌ বনম। উশীনরের সঙ্গে মাধবী থাকতে আরম্ভ করলে এই প্রথম আমরা দেখলাম উশীনর রাজা মাধবীকে পেয়ে পর্বতগুহায়, প্রবাহিণী নদীর পাশে, পাহাড়ি ঝরনায়, নানান উপবনে, বনে এবং গৃহের ভিতরেও তাঁর সঙ্গে পরমানন্দে দিন কাটাতে লাগলেন।
তারপর মাধবীর গর্ভে উশীনর ভবিষ্যতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা শিবিকে লাভ করলেন। গালব ফিরে এলেন বন থেকে এবং মাধবীকে নিয়ে আবারও দেখা করলেন বিষ্ণুবাহন গরুড়ের সঙ্গে কীভাবে তার গুরুদক্ষিণার চতুর্থ ভাগ আরও দু’শ ঘোড়া পাওয়া যায়। এই আলোচনা করতে। গরুড় বললেন– তুমি এসে ভালই করেছ এবং শোনো–আমি যতটুকু জানি, সেই শ্যামকর্ণ চন্দ্রবর্ণ অশ্ব ওই ছ’শোর বেশি আর কোথাও অবশিষ্ট নেই। তুমি বরঞ্চ তোমার গুরুর কাছে আত্মসমর্পণ করে ওই দু’শো অশ্বের পরিবর্তে মাধবীকেই গুরুর কাছে নিবেদন করো–ইমামশ্বশভ্যাং বৈ দ্বাভ্যাং তস্মৈ নিবেদয়। আর ছ’শো অশ্ব তো তোমার আছেই।
শেষ পর্যন্ত সেই অসহ্য অপছন্দের জায়গাটা এসেই গেল, যেখানে মাত্র দু’শা অশ্বের পরিবর্ত হিসেবে মাধবী ব্যবহৃত হচ্ছেন। তবে আমরা বলব– এটা নতুন কিছু নয়, এর আগের তিনটি জায়গাতেও তিনি দু’শো করে অশ্বশুল্কের পরিবর্তেই ব্যবহৃত হয়েছেন, কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তার নিজের ইচ্ছা, বিবাহ এবং পুত্রোৎপাদনের ভূমিকা থাকায় আজকের পরিশীলিত দৃষ্টিতে তার অবস্থান নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। যাই হোক, ছয় শত শ্যামকর্ণ শুভ্রবর্ণ অশ্ব আর মাধবীকে নিয়ে গালব এবার গুরু বিশ্বামিত্রের কাছে উপস্থিত হলেন এবং গরুড় ঠিক যেভাবে বলেছিলেন, সেইভাবেই তিনি বললেন– গুরুদেব! আপনার অভীষ্ট এই ঘোড়া ছ’শো আমি পেয়েছি, কিন্তু আর দু’শো পাইনি। তার পরিবর্তে আপনি এই কন্যাটিকে গ্রহণ করুন। বিখ্যাত রাজাদের মধ্যে ইক্ষাকু-কুল-ধুরন্ধর হর্যশ্ব, কাশীশ্বর দিবোদাস এবং ভোজরাজ উশীনর পর্যায়ক্রমে এই কন্যার গর্ভে তিন জন ধার্মিক পুত্র লাভ করেছেন এবং আপনিও যদি এই কন্যার গর্ভে একটি মহোত্তম পুত্র লাভ করেন, তবে গুরুর কাছে আমি অঋণী হই– চতুর্থং জনয়ত্বেকং ভবানপি নরোত্তমম্।
ঠিক এই মুহূর্তে মনুষ্যদৃষ্টিতে সবচেয়ে স্বাভাবিক, অথচ বিশ্বামিত্র মুনি বলেই সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনাটি ঘটল। বিশ্বামিত্র মাধবীর শান্ত সমাহিত এবং অশেষ যৌবনান্বিত রূপ দেখে মোহিত হয়েছিলেন নিশ্চয়ই এবং সেইজন্যই গালবকে ঈষৎ তিরস্কারের সুরেই যেন বললেন– গালব! ঘটনা যখন এইরকমই যে, তুমি অশ্বের পরিবর্তে অন্য মহান রাজাদের কাছে এঁকে দিয়েছ। তা হলে আগেই কেন এই কন্যাকে আমার কাছে নিয়ে আসোনি– কিমিয়ং পূর্বমেবেহ ন দত্তা মম গালব– তা হলে তো এই রমণীর গর্ভে আমি চার-চারটি পুত্রলাভ করতে পারতাম। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতিতে এবং যে শুল্কভাবনার মধ্যে তুমি আমার কাছে এঁকে নিয়ে এসেছ, তাতে এই রমণীর গর্ভে আমি একটি পুত্র লাভ করেই সন্তুষ্ট থাকব প্রতিগৃহ্নামি তে কন্যা একপুত্রফলায় বৈ। অর্থাৎ যে প্রতিগ্রহণ প্রতিগ্রহ বা বৈবাহিক ঘটনা ঘটল এবং বিশ্বামিত্রও মাধবীর গর্ভে অষ্টক নামে এক মহান পুত্র লাভ করলেন– আত্মজং জনয়ামাস মাধবীপুত্ৰমষ্টকম। পুত্রজন্মের পরেই বিশ্বামিত্র তাঁর পুত্রকে সেই ছ’শোটি ঘোড়া এবং ধনৈশ্বর্য দান করে তাকে ক্ষত্রিয় ধর্মে স্থাপন করলেন এবং মাধবীকে ফিরিয়ে দিলেন শিষ্য গালবের হাতে। বিশ্বামিত্র বনে চলে গেলেন নির্যাত্য কন্যাং শিষ্যায় কৌশিকোহপি বনং যযৌ।
গালব ঠিক করলেন– যাঁর কাছ থেকে মাধবীকে নিয়ে এসেছিলেন সেই যযাতি পিতার কাছেই পিরিয়ে দেবেন তাকে। ফিরিয়ে দেবার আগে অসীম কৃতজ্ঞতায় গালব মাধবীকে বললেন- তোমার প্রথম পুত্র বসুমনা অসাধারণ দাতা। তোমার দ্বিতীয় পুত্র প্রতর্দন এক মহাবীর যোদ্ধা, তৃতীয় পুত্র শিবি সত্যধর্মে স্থিত আছেন নিরবধি, আর তোমার চতুর্থ পুত্র। অষ্টক বিশ্বামিত্রের ভূতপূর্ব রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ক্ষত্রিয়োচিত যজ্ঞকর্ম করছেন। গালব এবার মাধবীকে রমণীর সৌন্দৰ্য-স্বরূপেই সম্বোধন করে বললেন- বরারোহে! সুমধ্যমে! তুমি এবার চল আমার সঙ্গে। তুমি একই সঙ্গে তোমার পুত্রগণের মাধ্যমে পিতা যযাতির মেয়ের ঘরের পিণ্ড-প্রয়োজন সম্পন্ন করেছ, চার জন রাজা-রাজর্ষিকে তুমি পুত্র দান করেছ এবং আমাকেও তুমি গুরুদক্ষিণার দায় থেকে মুক্ত করেছ। চলো, এবার তোমায় ফিরিয়ে দেব তোমার পিতার কাছে।
গালব যযাতির কাছে মাধবীকে ফিরিয়ে দিয়ে বনে গেলেন তপস্যা করতে। ঠিক এই সময়ে মাধবী মানসিক দিক থেকে কেমন ছিলেন, এই ঔপন্যাসিক অভিমুখ মহাভারত বর্ণনা করে না। মহাভারত ঘটনা বলে যায় এবং তা থেকে যদি আপনি মনের কথা বোঝেন! যেমন এখন দেখছি– তাঁর পিতা যযাতি একটা স্বয়ংবরের ব্যবস্থা করতে চাইছেন মাধবীর জন্য। অন্তত চার জায়গায় চারজন পুরুষের সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছে এবং সব জায়গায় তিনি একটি করে পুত্র লাভও করেছেন, তবে অলৌকিকভাবে মণ্ডিত মাধবীর সেই কন্যাত্ব এখনও আছে এবং যযাতি নিশ্চয়ই ভেবেছেন তার কন্যাটি পরার্থ-নিষ্পদনপরতায় চার বার বিবাহিত হলেও বিবাহিত জীবন বলে তিনি কিছু পাননি, অতএব সেইজন্যই তিনি মাধবীর জন্য এক স্বয়ংবর সভার আয়োজন করলেন প্রয়াগের এক আশ্ৰমভূমিতে। যযাতির জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ দুই পুত্র যদু এবং পুরু স্বয়ংবরমাল্যধারিণী ভগিনী মাধবীকে রথে চড়িয়ে নিয়ে চললেন আশ্রমের দিকে। লক্ষণীয়, এই স্বয়ংবর সভায় শুধু রাজা, ঋষি এবং সাধারণ মানুষেরাই উপস্থিত ছিলেন না, ছিল বনের পশু, আকাশচারী পক্ষীরা এবং বন-পর্বতের প্রাণীরা শৈল-দ্রুম-বনৌকানাম আসীত্তত্র সমাগমঃ। স্বয়ংবর সভায় মাধবীর বন্ধুজনেরা সমাগত পাণিপ্রার্থীদের চিনিয়ে দিয়ে তাদের পরিচয় জানাতে থাকলে নির্দিশ্যমানেষু তু সা বরেষু বরবর্ণিনী–মাধবী কাউকেই পছন্দ করতে পারলেন না। সমাগত সকলকে অতিক্রম করে মাধবী তপোবনকেই বর হিসেবে বরণ করে নিলেন–বরানুক্রম্য সর্বাংস্তান বরং বৃতবতী বনম্।
শেষ অবধি মাধবীর মতো এক অসামান্যা সুন্দরী রমণী যুবতীজনোচিত সমস্ত উপভোগ ছেড়ে আরণ্যক তপস্যার পথ নির্বাচন করলেন– এই ঘটনায় আধুনিক বিদ্বান-বিদুষীদের জিহ্বা তীক্ষ্ণতর হয়ে উঠেছে। পুরাতন সমাজের পৌরুষেয় অত্যাচারে নারীর বঞ্চনা মাধবীর আচরণে যেন নিরুচ্চার প্রতিবাদের রূপ ধারণ করেছে– এই তথ্য মাথায় রেখে বিদুষীরা মাধবীকে পৌরুষেয় অত্যাচারের বলি ‘ইউজেবল উইমেন’দের একমা বলে কঠিন আলোচনা করে ফেললেন, আর ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের মতো ঐতিহাসিক তার সোশ্যাল হিসট্রি অব ইন্ডিয়াতে মাত্র দু-লাইনে মাধবীর জীবনী বর্ণনা করে মন্তব্য করলেন– পিতা যযাতি তার মেয়ে মাধবীকে গালবের হাতে ছেড়ে দিলেন আর গালব তাকে যৌন ব্যবহার করলেন গুরুদক্ষিণা দেবার জন্য। তিনি পর্যায়ক্রমে তিনজন অপুত্রক রাজার কাছে মাধবীকে ব্যবসায়িক কৌশলে সমর্পণ করলেন। প্রত্যেক রাজাই তাঁদের পুত্রসন্তান জন্মানোর পর মাধবীকে পরিত্যাগ করলেন। এমনকী যখন গুরুদক্ষিণার সম্পূর্ণ দায় মিটল না, তখন গালবও তাকে পরিত্যাগ করলেন, তিনি মাধবীকেই দিয়ে দিলেন গুরুর কাছে। মহাভারত মহাকাব্য এই সমস্ত লোকগুলোকেই আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে বিরাট বিরাট মানুষ মনে করে। মাধবীর বাবা যযাতি এখানে তার করুণাগুণের জন্য প্রশংসিত হচ্ছেন, গালব প্রশংসিত হচ্ছেন তাঁর গুরুভক্তির জন্য আর বিশ্বামিত্র তার বিদ্যার জন্য প্রশংসা লাভ করছেন, অবশেষে মাধবীর মুক্তি ঘটল অনন্ত স্তব্ধতার মধ্যে।
ব্রজদুলাল ‘সোশ্যাল হিসট্রি’ লিখছেন, কিন্তু প্রথমত ‘কনটেশট’-টাই তিনি বোঝেননি। মহাকাব্যে যখন কাহিনি বর্ণনা করা হয়, তখন মহাকাব্যিক বর্ণনীয় রীতিতেই যযাতি মহান রাজা, বিশ্বামিত্রও ব্রহ্মর্ষি বলে সম্বোধিত এবং গালবও খুব গুরুভক্ত। কিন্তু মহাভারতে ‘কনটেকশট’-টা এই রকম নয়। সেখানে যুদ্ধের উদ্যোগপর্বে যুদ্ধোৎসাহী দুর্যোধনকে যুদ্ধ থেকে বিরত করার জন্য রাষ্ট্রতত্ত্ববিদ নারদ উপদেশ দিয়ে বলেছেন– তুমি আত্মীয় পরিজন-বন্ধুদের ভাল কথাটা শোনো। আর এটাও জেনো কোনও একটা বিশেষ বিষয়ে অতিরিক্ত আগ্রহ দেখিয়ে একরোখা লোকের মতো একগুঁয়েমি কোরো না। একগুঁয়েমি করে একটা বিশেষ ব্যাপারেই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করাটা ভয়ংকর বিপত্তি ডেকে আনতে পারে– ন কর্তব্যশ্চ নিৰ্বন্ধো নিৰ্বন্ধো হি সুদারুণঃ। নারদ বললেন– এই একগুঁয়েমি আর একটি বিষয়েই অতিরিক্ত আগ্রহ যে কী বিপত্তি ঘটনা করতে পারে, সে-বিষয়ে একটা ইতিহাসের কথা আছে শোনো একগুঁয়েমি করে প্রাচীন কালে গালব বিপর্যস্ত হয়ে হার মেনে গিয়েছিলেন– যথা নির্বতঃ প্রাপ্তো গালবেন পরাভবঃ।
এটা কি গালবের প্রশংসা হল? আসলে আমি দেখেছি–মহোদয় পুরুষেরাও গৌণসূত্রে মহাভারত পড়েন এবং খামচা খামচা ঘটনা বর্ণনা করে পূর্বভাবিত আপন সিদ্ধান্তকে সপ্রমাণ করতে চান। আবার তার মধ্যে বিংশ-একবিংশ শতাব্দীর অভিজাত পরিশীলন দিয়ে খ্রিষ্টপূর্ব শতাব্দীর বিচারটা এমনভাবেই করেন যাতে প্রগতিকামিনী মহিলাদের মধ্যেও যথেষ্ট বাহবা পাওয়া যায়। সশ্রদ্ধে জানাই, প্রাচীন কালে পৌরুষেয় অত্যাচারের হাজারো নমুনা আছে এবং সেই নমুনার ইতিহাস আপনাদের থেকে আমি আরও বেশি জানি বলে, আরও বেশি লজ্জা পাই। কিন্তু মহাভারত মহাকাব্যটাকে আমি নারীপ্রগতি-ভাবনার ক্ষেত্রে একটা বড় দলিল বলে মনে করি। কিন্তু মহাভারতের যেখান সেখান থেকে এক একটা কাহিনি টেনে এনেই আপনি স্বমত-সাধন করবেন– মহাভারত এতটা ছোটও নয়, এতটা জটিলও নয় এবং সেটাকে বুঝতেও হবে মহাকাব্যিক মনন-শৈলীতে।
আমরা কী ‘সোশ্যাল হিসট্রি’ লিখব? তার আগে গালবের প্রসঙ্গ টেনে এনে নারদই সোশ্যাল হিসট্রি বলছেন। বলছেন– একটা বিশেষ ক্ষেত্রে একগুঁয়েমি আর বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে গালবের পরাভব লাভ করার কাহিনিটা আমি ইতিহাসের কথা হিসেবে বলছি-অত্রাপদাহরীম ইতিহাসং পুরাতন। মনে রাখবেন এই কাহিনিকে ইতিহাস বলামাত্রই বুঝতে হবে যে, গালবের কথা বহুকাল ধরে লোকমুখে চলছে এবং এইরকম একটা ঘটনা কোনও কালে ঘটেও ছিল। নারদ সেই সামাজিক ইতিহাস দুর্যোধনকে শোনাচ্ছেন তাকে যুদ্ধের আগ্রহ থেকে প্রতিনিবৃত্ত করার জন্য। অতএব গালবের ইতিহাস নিন্দার্থে প্রযুক্ত, প্রশংসার জন্য নয়। আরও বিচিত্র কথা হল এই যে, মহাভারত কীভাবে পড়তে হয় যদি বোঝেন, তা হলে দেখবেন– একগুঁয়েমির বাড়াবাড়িটা শুধু গালবের ক্ষেত্রে নয়, গালব-কাহিনির প্রত্যেকটি চরিত্রের মধ্যেই এই বাড়াবাড়িটা আছে– এক জনের উপলক্ষে মহাভারতের কবি আর একজনের কথাও বলে দেন।
প্রথমে তো আমাদের বিশ্বামিত্র গুরু আর শিষ্য গালবের কথাই ধরতে হবে। সেকালের দিনে গুরুগৃহে পড়তে গেলে ‘টিউশন ফি নেবার চল ছিল না। গুরুকুলে খাটাখাটনি ছিল– সেটা অন্য কথা। গালবও অনেক খাটাখাটনি করেছেন এবং গুরু বিশ্বামিত্র তাঁর প্রতি এতটাই সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, প্রথমে তিনি কোনও গুরুদক্ষিণা নিতেই চাননি। গালবই তার বাড়াবাড়িটা আরম্ভ করেছেন। বিশ্বামিত্র প্রথম থেকেই না-না করে যাচ্ছেন, কিন্তু গালব তা সত্ত্বেও ‘কিং দদানি, কিং দদানি’– কী দেবো আপনাকে, কী দেবো– এই একগুঁয়েমিটা করতেই থাকলেন। মহাভারত এটাকেই বলেছে অত্যাগ্রহ অর্থাৎ ‘নির্বন্ধ। আবার বিশ্বামিত্রের দিক থেকেও দেখুন, তিনি রেগে গেছেন, রেগে যাবার কারণও এখানে যথেষ্ট আছে। কিন্তু তাই বলে সম্পদহীন শিষ্যের কাছে এমন নির্দিষ্ট কতগুলি ঘোড়া চাইবেন যা কারও কাছে নেই। অথবা এমন ঘোড়া যে গুণতিতে আটশোটা পাওয়া যাবে না– এ কথা বোধহয় তিনি বুঝেই বলেছিলেন গালবকে এবং প্রথম দিকে এসে অশ্বের মহার্ঘতা জানালেও বিশ্বামিত্র নিজের জেদ থেকে সরলেন না।
যা হোক অনেক শলামর্শ সেরে গরুড়কে নিয়ে গালব যখন দক্ষিণার অশ্ব যোগাড় করার জন্য যযাতির কাছে গেলেন, তখন সামর্থ্যহীন যযাতি নিজের দান- শৌণ্ডতা দেখানোর জন্যই অতিথিকে নিরাশ করলেন না, তিনি নিজের মেয়ে মাধবীকেই গালবের হাতে দিয়ে বসলেন– অভীষ্টলাভের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। এটাও বাড়াবাড়ি অথবা দানের বিষয়ে অতিনির্বন্ধ। মহাভারতে এ রকম দৃষ্টান্ত আর একটাও দেখা যাবে না। অন্যদিকে মাধবীকে দেখুন, তিনিও গালবের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি রকমের করুণা এবং দয়া দেখাচ্ছেন। গালব হ্যশ্ব রাজার কাছে আটশো ঘোড়া না পেয়ে যখন বিভ্রান্ত, তখন মাধবী নিজেই নিজেকে বিনিময়যোগ্য করে তুললেন অন্তত চার জন পুরুষের কাছে। মাধবী যদি নিজে অন্তত চার জন পুরুষের উপভোগ-সহনীয়তার কথা না জানাতেন গালবকে অথবা না জানাতেন প্রত্যেকটি পুরুষ-সংক্রমণের পর তার নির্বিকার কন্যাভাবের কথা, তা হলে গালব ঋষির এমন ক্ষমতা হত না যে, তিনি তাকে ব্যবহার করেন। আর এখানেও একটা বাড়াবাড়ি আছে, যেন তেন প্রকারে গালবের সংকট মোচন করাটা মাধবীর দায়িত্বের মধ্যে এসে পড়েছে, সেই অত্যাগ্রহে চার চার জন পুরুষের কাছে তাকে ব্যবহার করলেও তার কিছু হবে না- এই নিবন্ধ’ বা ‘বিষয়ের প্রতি অত্যাগ্রহটা কি মাধবীর নীরবতা নাকি যযাতি বা গালবের পৌরুষেয় অভিসন্ধি, যেখানে এক অসহায়া রমণী ‘ইউজেবল হয়ে উঠছেন।
তা হলে দেখুন, এক অত্যাগ্রহ থেকে কতগুলি অত্যাগ্রহের সৃষ্টি হচ্ছে এবং এই অত্যাগ্রহ থেকে ওই তিনজন অপুত্রক রাজাও মুক্ত নন। তাদের সামর্থ্য নেই, অথচ মাধবীকে দেখে তাদের ভোগেচ্ছাও চরমে উঠছে, পুত্রলাভের ইচ্ছাটাও হয়তো পূর্বোক্ত কারণেই প্রবল হচ্ছে। কিন্তু বাড়াবাড়িটা এইখানে যে, একমাত্র হ্যশ্ব ছাড়া অন্য দুই রাজা মাধবীকে পূর্বোপভুক্তা এবং বিবাহিতা জানা সত্ত্বেও মাধবীর ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। গালবের সেই দক্ষিণাদানের অত্যাগ্রহ থেকে মাধবীর আত্ম-সম্প্রদানের ঘটনা পর্যন্ত প্রত্যেকটি ঘটনায় এখানে বাড়াবাড়ি আছে এবং মহাভারত দেখাতে চায় সংসারে মহৎ, দয়ালু বা পরার্থপর হয়ে ওঠার মধ্যেও কখনও কখনও এমন ধরনের অত্যাগ্রহ মনের মধ্যে কাজ করতে থাকে, সেখানে যুদ্ধের বিষয়ে দুর্যোধন কারও কথা শুনছেন না, সে বিষয়ে নির্বন্ধ বা অত্যাগ্রহ প্রকাশ করছেন– এই প্রসঙ্গেই কিন্তু গালবের কাহিনিটা আসছে, পুরুষ কীভাবে নারীদের নিয়ে ব্যাবসা করে এটা দেখানোর জন্য মাধবীর উদাহরণ প্রচার করাটাও একটু বাড়াবাড়ি বা অত্যাগ্রহের কাজ হবে বলে আমার মনে হয়।
দেখুন মাধবী যে তপোবনকেই বর হিসেবে বেছে নিলেন, অথবা তপোবনে তপস্যার ইচ্ছেটাই যে তার মধ্যে বেশি প্রকট হয়ে উঠল– এই ঘটনাটাকে যে আমরা তার দিক থেকে খুব বড় একটা প্রতিবাদ বা পিতার প্রতি তাঁর অভিমান-প্রতিক্রিয়া হিসেবে গণ্য করব, সেটাও খুব মহাভারত-বোধের পরিচয় হবে না। আমি জানি, এখানে অনেক লেখক লেখিকাই আধুনিক যুগের লেখ্যধারার করুণায় মাধবীর তপোবন আশ্রয়ের ইচ্ছাটাকে এক অসহায় বহুপুরুষোভুক্তা নারীর বিকল্পহীন আশ্রয় হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন; তাঁদের জানাই মহাভারতের নারীরা রামায়ণের নারীর মতো এত অসহায়বৃত্তি নন। তাদের অনেকের মনের মধ্যেই অনেক দুরন্তপনা আছে। বিশেষত যে-রমণী স্বেচ্ছায় চার-চারজন পুরুষের অঙ্কশায়িনী হয়েছেন বিনা কোনও মানসিক তাড়নায় এবং বিনা কোনও মানসিক যন্ত্রণায় তার তপোবন আশ্রয়ের ঘটনাকে মহাভারতেচিত-ভাবেই একটা বৈরাগ্যের উদাহরণ হিসেবে, এমনকী খুব উদার এক বৈরাগ্য-বিলাস হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
মহাভারতে এই বৈরাগ্যটা অনেক ক্ষেত্রেই একটা ট্রেইট’ হিসেবে কাজ করে। পূর্বোক্ত ঐতিহাসিক মাধবীর ব্যাপারে ‘অ্যাবানডান্’ কথাটা খুব করুণাঘনভাবে ব্যবহার করেছেন। আমরা বলব– ওই ‘অ্যাবাভান’-টাই খুব গভীরভাবে মহাভারতের ‘ট্রেইট’, ওটাই মহাভারতের শেষ রস। একটা ভয়ংকরী সর্বগ্রাসী আসক্তি থেকে হঠাৎই একটা নিরাসক্তিতে চলে যাওয়া, আসক্ত হয়েও অনাসক্ত থাকা– এই অসম্ভব ‘অ্যাবানডান’ মহাভারতের মুনি-ঋষি থেকে আরম্ভ করে অনেক মনুষ্যচরিত্রের মধ্যেও কাজ করে এবং তা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। পরাশর সত্যবতীকে উপভোগ করে মহাভারতের কবির পরম অভ্যুদয় ঘটিয়ে চলে গেলেন ছেলেকে নিয়েই। তারপরেই অনাসক্তি। তিনি আর ফিরে আসেননি। আবার সত্যবতীর দিক থেকেও কোনও অনুশোচনা নেই, কোনও ভাবনাই নেই। এটাও একটা ‘অ্যাবানডা। একই কথা কুন্তীর সূর্যসম্ভোগের ক্ষেত্রেও খাটে, খাটে দ্রৌপদীর ক্ষেত্রেও। এখানে মাধবীর প্রতি অত্যাগ্রহী রাজাদের দেখুন। তারা মাধবীর শরীর-সংস্থান বর্ণনা করে ভোগ করছেন, কিন্তু কাল পূর্ণ হলেই মাধবীকে ছেড়ে দিচ্ছেন– এটাও ব্রজদুলালবাবুর ‘আব্যানডান’ নয়, ঔচিত্যবোধে নীতিগত ‘অ্যাবানডা’। মহাভারতের কবি বারবার মাধবীর ক্ষেত্রেও এই পরিত্যাগ-মর্ম প্রকাশ করে বলেছেন– মাধবী পূর্বোপভুক্তা ঐশ্বর্যময়ী রাজলক্ষ্মীকে পরিত্যাগ করে পুনরায় অন্য এক রাজার কাছে গেছেন। বিবাহিত স্বামী, তার ঔরসজাত পুত্র এবং অভ্যস্ত রাজৈশ্বর্য পরিত্যাগ করে বারবার যিনি চলে আসছেন, তার পক্ষে স্বয়ংবর-সৌভাগ্য পরিত্যাগ করে বনবাসী হওয়াটাও খুব আশ্চর্য কিছু নয়। বিশেষত সংসারের সুখ, শারীর মিলন এবং রাজসমাদর সবটাই তার যথেষ্ট দেখা হয়ে গেছে দেখে দেখে তিনি খানিক ক্লান্তও বটে, হয়তো বা এরই মধ্যে পৌরুষেয়তার অবিচারও একদেশিকভাবে অন্তর্গত, কিন্তু সেটাই সব নয় এবং সবার ওপরে তার ‘অ্যাবানডান’-এর ভাবনাটাই মহাকাব্যিক বিচারে বেশি বিচারসহ হয়ে ওঠে। তিন জন বিশিষ্ট রাজা এবং এক রাজর্ষির সঙ্গে পর্যায়ক্রমে সংসার করে পুনরায় আবার এক নতুন সংসার পাতার অনীহাটাই হয়তো এখানে তপোবন-বাসের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
অতএব অভিমান নয়, ঘৃণা নয়, অন্তর্জাত কোনও ক্রোধও নয়– পরার্থসাধনের মহত্ত্ব প্রকট করার একটা বিপ্রতীপ অত্যাগ্রহ যেমন যযাতি এবং গালবের মধ্যে দেখা গেছে, মাধবীর মধ্যেও সেটাই আছে। আর সেটা করতে গিয়েই একসময় তার মধ্যে মহাভারতের অন্য অনেক চরিত্রের মতোই একটা ‘হিরোইক আবাতান চলে এসেছে। হয়তো বা এর চেয়েও বড় কথা হল– যযাতি, গালব এবং মাধবীর সম্পূর্ণ সমন্বয়ী কাহিনি-চিত্রে মহাভারতের ‘হিরোইক’ ঔদার্য এবং মহত্ত্বটাই প্রধান, যেটা সবচেয়ে ভাল ধরেছেন প্রখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ জরজেস মেজিল। দ্যুমেজিল লিখেছেন- শুধু যে গালবের মতো এক ব্রহ্মচারী পুরুষ এক রমণীকে ব্যবসায়িকভাবে কাজে লাগিয়ে গুরুভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাল– এটাই এই মহাভারতীয় কাহিনির তাৎপর্য নয়। মাধবীর বাবা যে যযাতি গালবের অভীষ্ট পূরণ করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত মেয়েটিকে তুলে দিলেন তার হাতে এর মধ্যেও সেই মহাকাব্যিক বদান্যতার ইঙ্গিত আছে। এবং মাধবীর ব্যাপারে মেজিলের বক্তব্য হল- Does not the young girl herself, seeing her guardian in a quandary, propose, heroically also, perhaps–that he divide her worth in moon-colored horses by four and thus multiply by four the number of her partners.
দ্যুমেজিল সঠিকভাবেই মহাভারতের মহাকাব্যিক ঐশ্বর্য মাথায় রেখেই জানিয়েছেন– আটশো ঘোড়ার বদলে চার জন রাজার সঙ্গ ব্যাপারটাকে যদি প্রভিশনাল’ ধরা যায়, তবুও বিভিন্ন পর্যায়ে ওই চার-চারটি বিবাহেরও সম্পূর্ণ বৈধতা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সেই বিবাহগুলির সত্যতা এবং সম্মান দুইই সম্পূর্ণ স্বীকার করতে হবে। দেবতারাও এই বিবাহে কোনও দোষ দেখেননি। এখন যদি শুধু মাধবীর দিক থেকেই ঘটনা বিচার করতে হয়, তা হলেও সেটাকে মহাকাব্য মহাভারতের ভাবনাতেই করতে হবে।
এই যে মাধবী স্বয়ংবর বিবাহের ভবিষ্যৎ সুখ অতিক্রম করে অরণ্য আশ্রয় করলেন, এটাকে যাঁরা মাধবীর বিরাট অভিমান ভেবে পৌরুষের অত্যাচারের কাহিনি কেঁদে বসেছেন, তারা স্বাভীষ্ট প্রতিপাদন করছেন মাত্র। কেননা মাধবীর ঘটনার মহাকাব্যের উদ্দেশ্য আরও অনেক দূর প্রসারিত এবং সেটা মহাকাব্যিক দৃষ্টিতেই বুঝতে হবে। আরও লক্ষণীয়, তপোবনে মাধবী খুব কষ্টে এবং অবসাদে জীবন কাটাচ্ছিলেন, এমনটাও নয় কিন্তু। তপোবন-বাসের বিধিতে উপবাস, ব্ৰতদীক্ষা এবং নিয়মের কড়াকড়ি কিছু ছিলই। কিন্তু এর মধ্যেও তাঁর জীবনধারণের ভাবনাটার মধ্যে যেন একটা গভীর বন্ধন-মুক্তির আনন্দ দেখতে পাচ্ছি। বনের মধ্যে কখনও তিনি নরম সবুজ তৃণরাজির মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কখনও পান করছেন নদীর শীতল-নির্মল জল, আবার কখনও গভীর বনে– যেখানে বাঘ-সিংহের উপদ্রব নেই– তেমন জায়গায় হরিণদের সঙ্গে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। তখন তাকে দেখেও মৃগযুথের মধ্যে এক হরিণীর মতো মনে হয়– চরন্তী হরিণৈঃ সাধং মৃগীব বনচারিণী।
দ্যুমেজিল মহাভারতের বিস্তারে মাধবীকে মহাকাব্যিক দৃষ্টিতে বিচার করে লিখেছেন– মাধবী কোনও পাপ করেননি, কোনও পাপবোধেও তিনি ভুগছেন না। যে আরণ্যক জীবন তিনি বেছে নিয়েছেন, তার মধ্যে পশুত্বহীন এক আরণ্যকতা আছে এবং সেটা তিনি উপভোগ করছেন নিজের মধ্যেও– which she undertakes when she again finds herself free, is not an act of repentence, a sinner’s expiation, but the belated realization of a voca tion long thwarted–for approximately four years–by the execution of an urgent duty. এর মধ্যে ধর্ম তো আছেই আর আছে ভবিষ্যতের ধর্মার্থসিদ্ধির প্রয়োজন, যেটা মাধবীর মাধ্যমেই সম্পূর্ণ হবে, যদিও সেখানে আরও এক পরার্থসাধন লুকিয়ে আছে intended for another person’s advantage এবং এইখানেই মহাভারতের তৎকালীন মহাকাব্যিক অভিসন্ধিটুকু স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মহাভারতকে যাঁরা সংরক্ষণশীল ভাবনায় দেখেন, তারাও এখন বলবেন যে, মাধবীর কাহিনিতে চার জন অপুত্রক রাজার পুত্রেরা বলা উচিত, মাধবীর মতো মেয়ের ঘরে যযাতি যে সব নাতিদের পেলেন– সেই পুত্রেরা এবার যযাতির পরকালের কাজে লাগছেন এবং এটাই মাধবীর কাহিনির প্রধান উপযোগ। সবচেয়ে বড় কথা- মাধবীর কাহিনিতে এটাই তৎকালীন সমাজের বিশ্বাসের বিস্তার। ঘটনাটা সংক্ষেপে বলি। মহারাজ যযাতির জীবন আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়। শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর সঙ্গে বিবাহের পরেও শর্মিষ্ঠার সঙ্গে তার পার্ষিক মিলন, শুক্রাচার্যের অভিশাপ– হাজার বছরের জরা। শর্মিষ্ঠার গর্ভজাত পুত্র পুরু তার জরা গ্রহণ করে যৌবন ফিরিয়ে দিলেন এবং অনন্ত ভোগের পর যযাতি স্বীকার করলেন– কাম উপভোগ করে কামনার শান্তি হয় না– তিনি পুনরায় জরা গ্রহণ করে পুরুকে সিংহাসনে বসালেন, অনেক তপস্যার পর মারা গেলেন। পুরু আর যদু– শর্মিষ্ঠা এবং দেবযানীর গর্ভে দুই জ্যেষ্ঠ পুত্রের পিণ্ডলাভ করে যযাতি স্বর্গে গেলেন এবং সুখময় স্বর্গসুখ ভোগ করতে লাগলেন বহু বছর ধরে।
তারপর অন্য লোকের ক্ষেত্রে যা হয় না, যযাতির তাই হল। তিনি বহুকাল স্বর্গবাস করে খানিক উদ্ধত হয়ে উঠলেন এবং স্বর্গ থেকে তার পতন হল। মহাভারতের উদ্যোগপর্বে যখন মাধবীর কাহিনি বিস্তারিত হচ্ছে, সেখানে দেখা যাবে– যযাতির এই স্বর্গপতন আপন তপস্যাবলে রোধ করছেন তার মেয়ের ঘরে জন্মানো সেই নাতিরা অর্থাৎ মাধবীর সেই বৎসরান্তিক মিলনজাত বীর তপস্বী পুত্রেরা। যযাতির ঔরসজাত যদু-পুরু ইত্যাদি পুত্রদের পিতৃপিণ্ড তাদের পিতাকে স্বর্গে ধারণ করতে পারল না, আর তার মেয়ের ঘরের ছেলেদের যাজ্ঞিক ক্রিয়া তার স্বর্গপতন রোধ করে তাকে পুনরায় স্বর্গে স্থিত করছে, এমনকী মেয়ে হলেও মাধবীরও সেখানে অবদান আছে– এই সম্পূর্ণ কাহিনি মহাভারত এখন বলবে এবং তৎকালীন সমাজের পৌরুষেয়তার মধ্যে এই কাহিনি-বিস্তার যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা শুধু মহাভারতের উদ্যোগপর্বে মাধবীর শেষ জীবনের কাহিনির মধ্যেই আসেনি, সেটা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে মহাভারতের আদিপর্বে, যেখানে যযাতির উপাখ্যানটাই প্রধান, মাধবী সেখানে প্রায় উল্লিখিতই নন, কিন্তু তারই গর্ভজাত চার পুত্রের কথা সেখানে সবিস্তারে আছে।
মহাভারতের আদিপর্বে যযাতি যখন স্বর্গলোকে পুণ্যভোগ করছেন, এবং সেই পুণ্যবলে স্বর্গস্থানেও যখন তিনি এক বিরাট মান্যগণ্য মানুষ হয়ে উঠেছেন, এই সময় দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে তার দেখা হয়। ইন্দ্র তার কাছে জীবনের নানান কর্তব্য সম্বন্ধে জানতে চাইলে তিনি বিস্তর উপদেশ দিলেন এবং সে উপদেশগুলি এমন যেন তিনি স্বয়ং সেইসব উপদেশের মূর্ত প্রতিফলন। এবার ইন্দ্র তাকে খুব ঠাণ্ডা মাথায় বললেন– আপনি তো সাংসারিক জীবন শেষ করে বহুদিন মুনিবৃত্তি অবলম্বন করে বনে বাস করেছিলেন। এবার বলুন তো- আপনি তপস্যায় কার সমান হয়েছেন। যযাতি সাহংকারে বললেন– আমি দেবতা মনুষ্য-মহর্ষিদের মধ্যে কাউকেই আমার সমান তপস্বী বলে মনে করি না। ইন্দ্র দুঃখিত হয়ে বললেন- আপনি যখন আপনার সমান এবং আপনার চেয়ে উৎকৃষ্ট তপস্বীদের এইভাবে খাটো করলেন তবে এখনই স্বর্গ থেকে আপনার পতন ঘটবে। পতন অবধারিত জেনেই যযাতি আর কথা বাড়ালেন না। দেবরাজকে তিনি অনুরোধ করলেন– স্বর্গ থেকে যদি আমার পতনই হয়, তবে আমি যেন সাধু-সজ্জনের ভিতরে গিয়ে পড়ি। এমনিতে যযাতি পুণ্যবান কীর্তিশালী মানুষ; দেবরাজ তার প্রার্থনা মেনে নিলেন।
স্বর্গ থেকে পতনের কালে যযাতি এক সময় দেখলেন– নৈমিষারণ্যে চার জন রাজা যজ্ঞ করছেন। যজ্ঞে আহুতি দেওয়া ঘৃত-ভস্মের গন্ধ স্বর্গের দ্বার পর্যন্ত পৌঁছোচ্ছে তেষাম অধ্বরজং ধূমং স্বর্গদ্বারমুপস্থিতম। যযাতি সেই ঘৃতধূম আঘ্রাণ করতে করতে সেই ধূমধারার ভূমিদিশা অনুসরণ করে স্বর্গ থেকে পতিত হলেন সেই পুণ্য যজ্ঞস্থলে। সেখানে চারজন রাজা যজ্ঞস্নান করে যজ্ঞ করছিলেন। যযাতি তাদের মাঝে এসে দাঁড়ালেন। তিনি এই চার জন রাজাকে চিনতে পারলেন না, রাজারাও চিনতে পারলেন না তাকে। এই চারজন আসলে যযাতি-কন্যা মাধবীর পুত্র হয়শ্বের ঔরসজাত বসুমান বা বসুমনা, কাশীশ্বর দিবোদাসের পুত্র প্রতর্দন, উশীনরের ঔরসজাত শিবি এবং বিশ্বামিত্রের আত্মজ অষ্টক। মহাভারতের আদিপর্বের কাহিনি-বিস্তারে মাধবীর কথা এবং নাম কোনওটাই উচ্চারিত হয়নি এবং মাধবীর চার ছেলের নাম কোথাও কোথাও বলা হলেও প্রধানত বৈশ্বামিত্র অষ্টকই সেখানে কথা বলেছেন মাতামহ যযাতির সঙ্গে। আদিপর্বের কাহিনিতে আরও একটা বিশিষ্টতা হল- যযাতি স্বর্গ থেকে পুরোপুরি পতিত হচ্ছেন না, তিনি আকাশ মার্গ থেকেই অষ্টকের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাচ্ছেন আর অষ্টক ছাড়া মাধবীর আর তিন পুত্র একেবারে শেষে তাদের সঞ্চিত পুণ্য দান করছেন যযাতিকে পুনরায় স্বর্গে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। আর বসুমনা উদ্যোগপর্বে মাধবীর কাহিনিতে হশ্বের পুত্র হলেও আদিপর্বে ঈষৎ অন্য নাম উষদশ্বের পুত্র।
আমরা আদিপর্বের কাহিনিতে প্রবেশ করব না, কেননা এখানে যযাতি অষ্টকের সঙ্গে জীবন-যাপনের দার্শনিক সংলাপে রত আছেন। কথাগুলি যথেষ্টই মূল্যবান, কিন্তু আমাদের কৌতূহলের জায়গা হল যযাতি এবং তার মেয়ের ঘরের ছেলেরা কেউই তাদের নিজস্ব পরিচয় দিচ্ছেন না, কিন্তু মহাভারতের কণ্বক-ঠাকুর বৈশম্পায়ন জানাচ্ছেন– অষ্টক তার মাতামহের সঙ্গে কথা বলছেন– মাতামহং সর্বগুণোপপন্নং/ অথষ্টকঃ পুনরেবান্বপৃচ্ছ।
আর বৃহৎ-বিরাট এক দার্শনিক সংলাপের শেষে যযাতির চার দুহিতৃপুত্ররা তাদের সঞ্চিত পুণ্যভাগ যযাতিকে দিলেন প্রায় বিনা পরিচয়েই, যদিও যযাতি রাজা এর আগে চার দৌহিত্রের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র এড়িয়ে গেলেও তাদের বদান্যতায় মুগ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত বলেছেন– তোমরা আমার অত্যন্ত নিজের জন, আমি তোমাদের মাতামহ এই গোপন কথাটা এবার জেনেই নাও- গুহ্যঞ্চার্থং মামকেভ্যো ব্রবীমি! মাতামহোহহং ভবতাং প্রকাশম। লক্ষণীয়, এখানেও কিন্তু মাতা মাধবীর নাম উচ্চারিত হল না একবারও, কিন্তু পরিশেষে মহাভারতের কণ্বক-ঠাকুর এই সত্যটা যযাতি-কাহিনির তাৎপর্য হিসেবে জানাচ্ছেন– গার্হস্থ-পরম্পরায় পুত্র-সন্তানই সব নয়, তারা যযাতির স্বর্গপতন রোধ করতে পারেননি, কিন্তু মেয়ের ঘরের ছেলেরা তার সেই উপকার করলেন যাতে তাদের মাতামহ চিরস্থায়ী আবাস লাভ করলেন স্বর্গলোকে এবং রাজা স মহাত্মা হ্যতীব। স্বৈদৌহিত্রৈ-স্তারিতোহমিত্রসাহ।
হয়তো মাতামহ এবং দৌহিত্রদের এই কাহিনিতে তন্তু হিসেবে দুহিতা মাধবীর আত্মদানের মাহাত্মকাহিনি নেই বলেই যুদ্ধের উদ্যোগপর্বে এসে মাধবীর কাহিনি বিশদভাবে লিখতে হয়েছে মহাভারতের কবিকে। এখানে বিশেষত্ব এই যে, যজ্ঞস্থলে পতিত হওয়া মাত্রই চার দৌহিত্র যখন যযাতির পরিচয়-প্রশ্ন করছেন, তখন যযাতি বলছেন– আমি যযাতি। আমার পুণ্য ক্ষয় হয়ে গেছে, তাই স্বর্গ থেকে পতন ঘটেছে আমার। এখানে বিরাট দার্শনিক সংলাপ চলল না বহুক্ষণ ধরে। বসুমনা, প্রতদন, শিবি এবং অষ্টক এখানে সঙ্গে সঙ্গে তাদের যজ্ঞকর্মের পুণ্যফল গ্রহণ করতে বললেন যযাতিকে। যযাতি অস্বীকার করলেন অপরের পুণ্যভাগ নিয়ে নিজের স্বার্থ পূরণ করতে। বিশেষত যযাতি বললেন– আমি তো ব্রাহ্মণ নই যে, অন্যের দান প্রতিগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করব। আমি ক্ষত্রিয়। এই অবস্থায় আদিপর্বে মাধবীর চার পুত্র মাতৃপরিচয় না দিয়েই নিজেদের ক্ষত্রিয়ত্বের কথা বলেছিলেন, কিন্তু এখানে প্রশ্ন ওঠা-মাত্রই বনচারিণী মাধবীকে আমরা যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হতে দেখছি। মাধবীকে দেখে চারজন রাজাই তাকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন–তপস্বিনী মা আমাদের! কষ্ট করে তোমার আবার এখানে আসার প্রয়োজন হল কেন? কী আদেশ তোমার বলো। আমরা তোমার ছেলে, আমরা সকলেই তোমার আজ্ঞার অধীন, তুমি যা আদেশ করবে তাই করব– আজ্ঞাপ্যা হি বয়ং সর্বে তব পুত্ৰাস্তপোধনে।
আমরা মনে করি–মহাভারতে মাধবী-কাহিনির তাৎপর্য এইখানে। তৎকালীন সমাজের দৃষ্টিতে মহাভারতের কবি এখানে পৌরুষেয়তার বিপরীত মেরুতে গিয়ে মেয়েদের শক্তির জায়গাটা দেখাচ্ছেন। পারলৌকিক জগৎটা মহাভারত পুরাণে এক ভয়ংকর গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, যেখানে পুত্র-সন্তানের ভূমিকাটা মেয়েদের চেয়ে বড় হয়ে উঠে পুরুষতান্ত্রিকতাকে প্রশ্রয় দেয়। কিন্তু যযাতির পারলৌকিক জীবনের কাহিনিতে তার আপন ঔরসজাত পুত্র সন্তানদের ভূমিকা কার্যকরী হচ্ছে না। এখানে মেয়ের ঘরের অপেক্ষা রয়েছে। হয়তো মেয়ের ঘরের পুত্র সন্তানের কথায় পৌরুষেয়তা একভাবে জয়ী হয়, কিন্তু তবু মেয়েদের একটা ক্ষমতার পরিসর তৈরি হচ্ছে। যযাতির পারলৌকিক স্থিতির জন্য মেয়ের ঘর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বড় কথা– পিতৃপুরুষের পুণ্য-পাপের ক্ষেত্রে মেয়েদের যে intervention– এটা যে সমাজের পুরুষাবসায়িতার প্রেক্ষিতে কতটা বিপ্রতীপভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা তারাই বুঝবেন, যাঁরা পৌরাণিক সমাজটাকে চেনেন। লক্ষ করে দেখুন, পুত্রদের বিনয়-বচন শুনে মাধবী যযাতির সামনে গিয়ে তার প্রত্যেক পুত্রের মস্তক স্পর্শ করে বলেছেন– রাজশ্রেষ্ঠ পিতা আমার! এরা সব আমার ছেলে, আপনার নাতি, আপনার মেয়ের ঘরের ছেলে সব, এরা কেউ আপনার পর নয়– দৌহিত্ৰাস্তব রাজেন্দ্র মম পুত্রা ন তে পরাঃ। এরাই আপনাকে সমূহ স্বর্গপতন থেকে উদ্ধার করবে।
মাধবীর কোনও অভিমান নেই পিতার ওপর, কোনও রাগও নেই। বরঞ্চ পিতার পারলৌকিক বিপন্নতায় আজ তিনি পুত্র-সন্তানদের মতোই তার শাস্ত্রীয় সহায় হয়ে উঠছেন। যে ত্যাগ এবং অনাসক্তিতে পিতার দান-ধর্মকে তিনি মর্যাদা দিয়েছিলেন, যে অনাসক্ত চেতনায় তিনি চার-চার জন পুরুষের বিবাহিতা স্ত্রী হয়েও বন্য জীবন বরণ করে নিয়েছেন, ঠিক সেই গৌরবেই আজ তিনি পিতাকে বলছেন– আমি আপনার সেই মেয়ে মাধবী, আমিও তো বন্য হরিণীদের মধ্যে বাস করে ত্যাগ-বৈরাগ্যে অনেক পুণ্য সঞ্চয় করেছি– অহং তে দুহিতা রাজন মাধবী মৃগচারিণী। আমার সেই সঞ্চিত পুণ্য থেকে অর্ধেক আপনি গ্রহণ করুন। মাধবী মেয়ে হিসেবে শুধুমাত্র মমতাময় এক বক্তব্য নিবেদন করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, পিতার পারলৌকিক কৃত্যে এত দিন শুধু পুত্রসন্তানের ভূমিকাই মুখ্য হয়ে উঠত, কিন্তু তাদের সঞ্চিত পুণ্যভার পিতা যযাতিকে সম্পূর্ণ ধারণ করতে পারল না। আজকে পুনরায় তার স্বর্গস্থিতির জন্য মেয়ের ঘরের পুরুষ সন্তানদের ভূমিকায় যেমন কন্যার আধ্যাত্মিক ক্ষমতায়ন ঘটছে, তেমনই মাধবী নিজেও কন্যা হিসেবে পিতার পারলৌকিক স্থিতির মধ্যে অংশ গ্রহণ করছেন। তিনি বলছেন– আমিও তো তপস্যার দ্বারা পুণ্যসঞ্চয় করেছি, সেই পুণ্যের অর্ধেক ভাগ তোমার জন্য রইল– ময়াপুপচিতো ধর্মস্ততোইধং প্রতিগৃহ্যতাম। তা ছাড়া এই তো তোমার সময়, যখন মানুষ সন্তানদের পিতৃকৃত্যের ফল ভোগ করে, পুত্র-সন্তানের পিতৃকৃত্যের ফল ভোগ করে, পুত্র-সন্তানের পিতৃকৃত্যের পরেও মানুষ মেয়ের ঘরের ছেলে, দৌহিত্রদের কাছ থেকে পুণ্যভাগ আশা করে– তুমি তো তাই চেয়েছিল, যার জন্য গালবের সঙ্গে গিয়ে আমি তোমার নাতিদের গর্ভে ধারণ করেছি– তস্মাদিচ্ছন্তি দৌহিত্রান যথা ত্বং বসুধাধিপ।
মহাভারতে মাধবীর কাহিনির তাৎপর্য কিন্তু এইখানে। তৎকালীন পুরুষপ্রধান সমাজে একটা স্মার্ত বা ধর্মশাস্ত্রীয় দ্বন্দ্ব এইভাবেই তৈরি হয়েছিল। দ্বন্দ্ব ছিল যে, শুধু পুরুষ সন্তানই পিতৃকৃত্যের অধিকারী। পরবর্তী কালে মেয়ের ঘরের ছেলেরা প্রেতজনের পুত্রাভাবে শ্রাদ্ধাদিকর্মের অধিকারী হয়েছে, অধিকারী হয়েছে মেয়েরাও, কিন্তু তার মধ্যেও কিছু পৌরুষেয়তা আছে, সেই স্মৃতি শাস্ত্রীয় ভাবনায় এখন আমরা প্রবেশ করব না। শুধু এইটুকু জানিয়ে ক্ষান্ত হব যে, মাধবী পুরুষায়িত সমাজে মেয়েদের একটা ভূমিকা এবং গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করছেন। এর মধ্যে চার জন রাজার সঙ্গ এবং তাদের ঔরসে সন্তান ধারণের ঘটনাটা আজকের পরিশীলিত চিন্তনে স্ত্রীলোককে একটা ব্যবহারিক বস্তুপিণ্ডে পরিণত করলেও মহাভারতের কাল এই বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। তার মানে এই নয় যে, স্ত্রীলোকের যৌনতার ক্ষেত্রটা বেশ উদার ছিল, কিন্তু সেটা না হলেও এই ক্ষেত্র অনেক প্রসারিত এবং মুক্ত ছিল নিশ্চয়, বিশেষত মাধবীর চার-চারজন পুরুষসঙ্গের মধ্যে যাঁরা পৌরুষেয় ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ করছেন, তারা কিন্তু বিপ্রতীপভাবে চিরকালীন সতীত্বের ভাবনাতেই বেশি আবদ্ধ হয়ে আছেন। পুরুষসঙ্গের ক্ষেত্রে মাধবীর স্পষ্ট, ত্বরিত এবং নিজস্ব অনুমোদনটা তাদের মাথাতেই আসে না। তার মধ্যে মাধবীর বিধিসম্মত চার-চারটি বিবাহ– আমরা মনে করি, এটা সতীত্বের পরিভ্রষ্ট ব্যবহারিক বঞ্চনার চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক।
পরিশেষে আরও দু-একটি কথা জানাতে হবে। মাধবীর চার পুত্র এবং স্বয়ং মাধবী স্বর্গভ্রষ্ট যযাতিকে মর্ত্যভূমিতে পা রাখবার আগেই নিজেদের সৃঞ্চিত পুণ্যবলে তাকে স্বর্গে প্রতিষ্ঠা করলেন। ঠিক এই সময়ে আমরা গালব ঋষিকেও একবার দেখতে পাই। তিনিও তার সঞ্চিত পুণ্যের অষ্টম ভাগ যযাতিকে দিতে এসেছেন। এখানে একটা রোম্যান্টিক কল্পনা চলতেই থাকে। যযাতি তার হাতেই কন্যা মাধবীকে সঁপে দিয়েছিলেন, তিনি তাকে নিয়ে গেছেন বিভিন্ন রাজার কাছে এবং গালবের জন্যই মাধবী একের বদলে চারজন রাজার সঙ্গ করতে রাজি হয়েছিলেন সেই গালব আজ উপস্থিত হয়েছেন। সে কি মাধবীর জন্য? আমরা বলব– মহাভারত এখানে অনেকটাই নির্বিকার, বরঞ্চ গালব যযাতির প্রতি কৃতজ্ঞতাবশতই আজ এখানে উপস্থিত, যযাতি যদি তাকে অনুগ্রহ না করতেন, তা হলে গুরুর কাছে প্রতিজ্ঞা পালন করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অতএব গালবের এই সময়ে উপস্থিত হওয়াটা মাধবীর প্রতি কোনও সহমর্মিতায় নয়, এটা আমরা হলফ করে বলতে পারি।
মাধবী এবং মাধবীর চার পুত্র নিয়ে স্মৃতিশাস্ত্রীয় বিধানের যেটুকু প্রসার ঘটেছে স্ত্রীলোকের ক্ষমতায়নে, মহামতি দ্যুমেজিল এখানে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন– যযাতি বোধহয় সেই মূল রাজপুরুষ যার পুত্র পরম্পরায় ভারতবর্ষে অনেকগুলি রাজবংশের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। মূল ভূখণ্ডে তার কনিষ্ঠপুত্র পুরুর অবস্থিতি ছাড়াও যদু, দ্রুহ্য, তুর্বসুর মাধ্যমে আর্য-অনার্য বিভিন্ন নিবাসে বিভিন্ন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। মেজিল বলছেন– কন্যা মাধবীর মাধ্যমে চার জন রাজার ঔরসে যে পুত্রগুলি জন্মাল, তাতে যযাতি আরও প্রসারিত হলেন এবং এঁরা হচ্ছেন সেই ‘সেকেন্ড সেট অব কিংস’ যাঁদের প্রভাব বুদ্ধের সময় পর্যন্ত প্রসারিত। কাজেই মেজিলের মতে মাধবী আসলে তৎকালীন সময়ে ক্ষত্রিয়-রাজবংশ প্রসারণের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছেন। এমনকী যে বিশ্বামিত্র মুনি, যিনি পূর্বে ক্ষত্রিয় ছিলেন এবং পরে ব্রাহ্মণ্য লাভ করেন, তিনিও যে বংশধারা তৈরি করেছেন মাধবীর গর্ভে, তিনিও ক্ষত্রিয় হিসেবেই পরিচিত হয়েছেন এবং তিনিও রাজা।
সত্যি কথা বলতে কী, আমরা দ্যুমেজিলের মতও মেনে নিতে খানিক রাজি আছি, কেননা সেখানেও মাধবীর বংশকারিতার ভাবনাই আছে, যেমনটা আছে যযাতির দুহিতৃ পুত্রের স্মৃতিশাস্ত্রীয় বংশকারিতার মাধ্যমে যযাতির স্বর্গচ্যুতি রোধ করার মধ্যে। যদি বলি, মহাভারতে মাধবী কাহিনির এটাই ‘প্রাইমারি মোটিফ, তা হলে ভুল হয় না, কিন্তু এই কাহিনির একটা আলটেরিয়র মোটিফ’ও আছে এবং সেটা কিন্তু সেই ‘অত্যাগ্রহ’ অর্থাৎ একটা বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি– এর মধ্যে যযাতির অতিরিক্ত বদান্যতা যেমন আছে, তেমনই আছে গালবের দক্ষিণা-দানের অত্যাগ্রহ। এখানে বিশ্বামিত্র মুনির অত্যাগ্রহ যেমন দক্ষিণার পরিমাণ যথা বস্তুটা নিয়ে অনর্থক বাড়াবাড়ি– ভাবুন একবার, আটশো ঘোড়া চাই, তার প্রত্যেকটার কানগুলো হবে কালো অথচ শরীরটা যেন জ্যোৎস্না-ধোয়া শুভ্রবর্ণ– এটা একটা ভয়ংকর বাড়াবাড়ি। আর মাধবীর কথা তো বলেইছি– সমস্ত স্ত্রীলোকের একপতিক পাতিব্রত অতিক্রম করে তিনি স্বেচ্ছায় চার চার জন স্বামীর যৌন সম্বন্ধ এবং বলা উচিত, যৌন অত্যাচারও মেনে নিয়েছেন পুত্রলাভের জন্য। তবে এখানে স্ত্রীলোককে পণ্য হিসেবে পৌরুষেয় ব্যবহার করার প্রবণতার চেয়েও অনেক বেশি ‘ইনট্রিগিং’ হল পুরুষের যৌন আচরণ। বেশি বয়সের ইম্ফাকু-কুল-ধুরন্ধর যেভাবে মাধবীকে দেখেই তার শরীর বর্ণনা করে যৌনতা উপভোগ করেছেন, তার চেয়েও বেশি ‘ইনট্রিগিং’ ছিল বিশ্বামিত্র গুরুর আসঙ্গ লিপ্সার প্রসঙ্গ, যেটা একজন বৈরাগ্যবান মুনির পক্ষে নিতান্তই বাড়াবাড়ি ছিল। গালবকে তিনি বলেছিলেন– ঘোড়াই যখন যোগাড় করতে পারোনি, তখন আমার কাছে মাধবীকে নিয়ে আগে এলেই পারতে– আমি চার-চারটি পুত্র সন্তানের পিতা হতে পারতাম। এটা কি ‘শুধু’ ‘প্রেক্রিয়েশন’ বা ‘প্রোজেনি’র তাড়না! নাকি তার চেয়েও মহাশক্তিশালিনী সেই যৌনতা, যা একজন তপস্বী গুরুকেও শিষ্যের সামনে লজ্জিত করে না।
মহাভারত কিন্তু নির্লজ্জভাবেই এই সব কথা বলেছে, কাজেই মাধবীর জীবনে যদি পুরুষের অত্যাচারের প্রসঙ্গটাই প্রধান হত, সেটা বলতেও তিনি নির্লজ্জই হতেন। এটা ভীষণ রকমের ঠিক যে, মহাভারতে মাধবীর চরিত্র-ভাবনা অত্যন্ত জটিল এবং ঘটনা পরম্পরায় দৃষ্টি রাখলে একটা আপাত সিদ্ধান্ত নেবার বিভ্রান্তিটাও খুব স্বাভাবিক। কিন্তু কেউ যদি মাধবীর কাহিনিতে একটা ঘটনা লক্ষ করেন, তা হলে বুঝবেন কোনও বিকৃত কামনায় স্ত্রীলোককে আক্রান্ত করাটা মাধবী-কাহিনির উদ্দেশ্য নয়। গুরুঠাকুরের ঘোড়া যোগাড় করার জন্য গালব যখন বিষ্ণুবাহন গরুড়ের পিঠে চড়ে পৃথিবীর চার দিক চষে ফেলেছেন, তখন তিনি ঋষভ পর্বতে বিশ্রাম করার সময় শাণ্ডিলী নামে এক তপস্বিনী ব্রাহ্মণীকে দেখতে পান। বস্তুত তিনিই খাবার-দাবার দিয়ে দুই নতুন অতিথিকে তৃপ্ত করেন। খাবার খেয়ে দু’জনের চোখেই ঘুম নেমেছে, এমন সময় গরুড়ের ঘুম ভেঙে গেল এবং তিনি হঠাৎই চোখের সামনে সেই সর্বাঙ্গসুন্দরী তপস্বিনীকে দেখতে পেলেন– তাং দৃষ্টা চারুসর্বাঙ্গীং তাপসীং ব্রহ্মচারিণীম। তাকে দেখে গরুড়ের মনে হল– এই তপস্বিনী রমণীকে তিনি নিয়ে যাবেন গ্রহীতুং হি মনশ্চক্রে। কিন্তু এই ভাবনা মনের মধ্যে আসামাত্রেই গরুড়ের সমস্ত পাখা-পালকগুলি গা থেকে খসে গেল। গরুড়ের এই অবস্থা দেখে পথের বন্ধু গালব খুব বিষণ্ণ হলেন। তিনি বললেন- তুমি কি ধর্মদূষক কোনও চিন্তা করেছ ভায়া! খুব অল্পদূষিত কুচিন্তার ফল তো এটা নয়–ন হ্যয়ং ভবতঃ স্বল্পো ব্যভিচারো ভবিষ্যতি!
গরুড় বললেন– দ্যাখো ভায়া! আমি কখনও খারাপ কিছু ভাবিনি। শুধু ভেবেছিলাম– এই সিদ্ধা রমণীর স্থান এই ঋষভ পর্বত নয়। যেখানে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের মতো ভগবৎপুরুষ আছেন, সেইখানে এঁকে নিয়ে যাব বলে ভেবেছিলাম এবং এই সত্য এই তপস্বিনী শাণ্ডিলীর কাছেও জানাব। গরুড় শাণ্ডিলীকে বললেন আপনার প্রতি মর্যাদার গৌরবেই আমি এইরকম ভেবেছিলাম, কিন্তু সেটা আপনার ভাল লাগেনি। কিন্তু আপনি দয়া করে ভুল বুঝবেন না আমাকে। গরুড়ের আকুতি শুনে শাণ্ডিলী তাকে নতুন পাখা গজানোর আশীর্বাদ দিলেন, কিন্তু সাবধান করে দিয়ে বললেন– আমাকে নীচ-চক্ষুতে দেখলে তার ফল ভাল হবে না। তুমি যদি নিজের জন্য আমাকে নিয়ে যাবার কথা ভাবতে–যদি ত্বমাত্মননা হ্যর্থে মাঞ্চৈবাদাতুমিচ্ছসি, তা হলে তোমার মোটেই ভাল হত না। আমি শুধু বলব আমাকে যেন খারাপ চোখে দেখার চেষ্টা কোরো না, আর শুধু আমি কেন, কোনও মেয়েকেই যেন গর্হিত চোখে দেখার চেষ্টা কোরো না- ন চ তে গহনীয়াহং গর্হিতব্যাঃ স্ত্রিয়ঃ ক্কচিৎ। তুমি নিজের জন্য আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা না ভেবে দেবদেব মহাদেব বা বিষ্ণুর জন্য আমার কথা ভেবেছিলে, তাতে সেই পরম দেবতাদের আশীর্বাদেই আবার তোমার পাখা গজাবে– তস্যৈব হি প্রসাদেন দেবদেবস্য চিন্তনাৎ।
আমরা বলব– মাধবী-কাহিনির সুর বাঁধা হয়ে গেছে এইখানে। এখানে সবটাই পরের জন্য ঘটছে– যযাতি পরের জন্য ভাবছেন, গালব পরের জন্য ভাবছেন, মাধবীও পরের জন্য ভাবছেন কিন্তু সমস্ত ভাবনাগুলির মধ্যেই অত্যাগ্রহ বা বাড়াবাড়ি আছে বলেই এই অত্যাগ্রহ ত্যাগ করার জন্য যুদ্ধপ্রিয় দুর্যোধনকে উদ্যোগপর্বে গালব এবং মাধবীর কাহিনি শোনানো হচ্ছে। মহাভারতে মাধবী কাহিনির এটাই ‘আলটেরিয়র মোটিভ।