মনোয়ারার মনে সকাল থেকে কু ডাকছিল। মনে হচ্ছিল আজ ভয়ংকর কিছু ঘটবে। কেউ খুব খারাপ কোন খবর নিয়ে আসবে। বিব্রত গলায় সেই খারাপ খবর দিয়ে বলবে–সবই আল্লাহপাকের ইচ্ছা। আল্লাহপাক যা করেন মানুষের মঙ্গলের কথা চিন্তা কইরা করেন। উনি পরম দয়ালু রাহমানুর রহিম। যদিও মনোয়ারা তার জীবনে আল্লাহর পরম দয়ার তেমন কোন পরিচয় পাননি। তার কাছে প্রায়ই মনে হয়–আল্লাহ খুব কঠিন হৃদয়ের কেউ–মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাকে বিচলিত করে না। তার বিশাল সৃষ্টিজগৎ। মানুষের মঙ্গল নিয়ে চিন্তা-ভাবনার তাঁর সময় কোথায়? যার সামান্য ইশারায় জগৎ সৃষ্টি হয়, তার ইচ্ছা হলেই সমগ্র মানবজাতির দুঃখ-কষ্ট দূর হবার কথা। তা তো হয় না–মানুষের দুঃখ কষ্ট শুধুই বাড়ে–শুধুই বাড়ে।
মনোয়ারা উঠোনে বসে আছেন। পুষ্প তাঁর মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। পুষ্পের মুখও শুকনো। সে কাল রাতে রাজবাড়ি থেকে চলে এসেছে। সারারাত কেঁদেছে। কি হয়েছে কিছুই বলেনি। মনোয়ারাও জিজ্ঞেস করেননি। তিনি অস্থির তার নিজের চিন্তায়। অন্যের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর মত তার মনের অবস্থা না। মনোয়ারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে। কাউকে আসতে দেখলে প্রবল উত্তেজনা বোধ করছেন–কেউ কি আসছে? দুঃসংবাদ নিয়ে ক্লান্ত পায়ে কোন একজন–যে অনেক ভনিতা করে শেষটায় বলবে–সবই আল্লাহপাকেরু ইচ্ছা।
মনোয়ারার বুক ধ্বক করে উঠল, কে যেন আসছে। এখনো অনেক দূরে, তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না কিন্তু হাঁটার ভঙ্গিটা পরিচিত। মনোয়ারারুদ্ধকণ্ঠে বললেন, ও পুষ্প, এইটা কে আসে, তোর বাপজান না?
পুষ্প চুলের বিলি কাটা বন্ধ করে এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। হ্যাঁ, সেরকমই তো মনে হচ্ছে। উনার পিছনে আরো একজন কে যেন আসছে।
মনোয়ারা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন—পুষ্প তোর বাপজান না?
পুষ্প বিকট একটা চিৎকার দিয়ে ছুটতে শুরু করল। পুষ্পের চিৎকারে ঘরের ভেতর থেকে কুসুম বের হল। এত বড় মেয়ে কিন্তু হায়াশরম বিসর্জন দিয়ে ছোটবোনের মতই বিকট চিৎকার দিয়ে সেও ছুটতে শুরু করল।
মনোয়ারার চোখে পানি এসে গেছে। তিনি চোখের পানি মুছে ফেললেন। একটু আগেই তিনি যে আল্লাহর দয়া সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেছিলেন তার জন্যে তাঁর লজ্জার সীমা রইল না।
রাস্তার উপরই মোবারককে তার দুই মেয়ে জড়িয়ে ধরে ফেলেছে। মোবারক কপট ধমক দিচ্ছেন–তোরা আদবকায়দা কিছুই জানস না–রাস্তার উপরে কি শুরু করছস! ছাড় দেখি ছাড়। আহা রে যন্ত্রণা!
মোবারকের পেছনে লাল শার্ট পরা ছেলেটি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। সম্ভবত এমন আবেগঘন মুহূর্ত দেখে তার অভ্যেস নেই। তার তাকিয়ে থাকতে লজ্জা লাগছে, আবার চোখ নামিয়ে নিতেও পারছে না।
মোবারক হাসিমুখে বললেন, সুরুজ, এই দুইটা আমার দুই পাগলা মাইয়া। বড়টার নাম কুসুম, আর ছোটটা পুষ্প।
সুরুজ চোখ নামিয়ে ফেলল, অস্বস্তি নিয়ে কাশল। কুসুমের বুক ধ্বক ধ্বক করে উঠল। সুরুজ নামের এই যুবন এমন ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে নেবে কেন? এমন ভঙ্গিতে কাশবে কেন? বাপজান এই ছেলেকে কেন নিয়ে এসেছে?
মোবারকের সঙ্গে সুরুজের পরিচয় নিন্দালিশ বাজারে। এক কাঠের দোকানে সে পেটে-ভাতে কাজ করে। রাতে দোকানে শুয়ে থাকে। ঘর পাহারা দেয়। বাবা-মা নেই, অনাথ ছেলে। নৌকার জন্যে কাঠ কিনতে গিয়ে ছেলেটাকে তার বড়ই পছন্দ হল। বড়ই নরম স্বভাব। চেহারা-ছবি সুন্দর। কিছুক্ষণ কথা বলার পরেই ছেলেটাকে ঘরের ছেলে বলে মনে হতে লাগল। মোবারক এক পর্যায়ে বললেন, চল আমার সঙ্গে। এক লগে ব্যবসাপাতি করবা। নৌকা লইয়া দেশ-বৈদেশ ঘুরি, সাথে আপনার লোক থাকলে ভাল লাগে। যাইবা? সুরুজ সঙ্গে সঙ্গে বলল, জ্বি আইচ্চা।
নৌকা বাইতে পার?
জ্বে না।
নৌকা বাওন এমন কোন শক্ত কাম না।
শক্ত কামরে আমি ডরাই না মোবারক ভাই।
মোবারক খানিকক্ষণ এক দৃষ্টিতে সুরুজের দিকে তাকিয়ে বলল, শোন, তুমি বয়সে মেলা ছোট। আমারে ভাই ডাকব মাচা ডাকবা। কোন অসুবিধা আছে?
জ্বে না।
সম্পর্ক পাল্টানোর পেছনে মোবারকের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা কাজ করেছে। হেলেটাকে তার ভালই মনে ধরেছে। কুসুমের সঙ্গে বিয়ে দেয়া যেতে পারে। ছেলের চেহারা-ছবি ভাল, আদব-কায়দা ভাল। সমস্যা একটাই–অনাথ ছেলে। অনাথ ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক করতে নেই। অনাথ ছেলে মানে ভাগ্যহীন ছেলে। ভাগ্যহীনের সাথে সম্পর্ক করলে মেয়ের ভাগ্যও নষ্ট হবে। মেয়েও কষ্ট করবে সারাজীবন। এইসব মুরুব্বীদের কথা। মুরুব্বীরা তো না জেনে-শুনে কথা বলেন না।
মনোয়ারার আনন্দের কোন সীমা নেই। শাহানাকে দিয়ে তিনি যখন প্রার্থনা করিয়েছেন তখনি বুঝে গেছেন কাজ হবে। এক একজন মানুষ আল্লাহর রহমত নিয়ে পৃথিবীতে আসে। এই মেয়েটিও এসেছে। তার কথা আল্লাহ অগ্রাহ্য করেননি। সঙ্গে সঙ্গে ছেলে জোগাড় করে দিয়েছেন। অনাথ ছেলে, ঘরবাড়ি নেই, টাকা-পয়সা নেই–তাতে কি? আল্লাহপাকের এনে দেয়া ছেলে, তিনিই রিজিকের ব্যবস্থা করবেন। শুকরানা আদায়ের জন্যে তিনি জুম্মাঘরে শুক্রবারে সিন্নি মানত করলেন। ছেলেটাকে তিনি যত দেখছেন তত তার ভাল লাগছে। কি সুন্দর করে চাচী ডাকে! কি নরম করে কথা বলে, চোখ তুলে তাকায় না। দেখেই বোঝা যায়, এই ছেলে কোনদিন মায়ের আদর পায়নি। আদর-যত্নের সঙ্গে সে পরিচিত নয়। আদর পেলেই চেহারা কেমন হয়ে যায়। দুপুরে ভাত বেড়ে দিয়ে তিনি ইচ্ছা করেই কুসুমকে বললেন–ও কুসুম, গরম আইজ বেজায় পড়ছে, পাংখা দিয়া বাতাস কর।
কুসুম হাসিমুখে বলল, পাংখা দিয়া মাথার মধ্যে একটা বাড়ি দিয়া দেই মা?
ক্যান, বাড়ি দিবি ক্যান?
ইচ্ছা করতাছে।
মনোয়ারা আতংকিত গলায় বললেন, থাউক বাতাস লাগব না। মেয়ের মতগতি ঠিক নেই। পাখা দিয়ে বাড়ি দিয়েও বসতে পারে। জ্বীনের আছর যে মেয়ের উপর আছে এতে অস্বীকার করার কিছু নেই। সাধারণত পুরুষ জ্বীনগুলি কুমারী মেয়েদেরই বিরক্ত করে। বিয়ের পর আর করে না। আল্লাহ আল্লাহ করে বিয়ে দিয়ে দিতে পারলে জ্বীনের উপদ্রব থেকেও বাঁচা যায়।
ছেলেটারে তোর কেমন লাগে রে কুসুম?
ভাল।
অনাথ ছেলে তো–এরার মায়া-মুহব্বত থাকে বেশি।
মায়া-মুহব্বত বেশি থাকনই ভাল।
মনোয়ারা প্রায় অস্পষ্ট গলায় বললেন–দেখি যদি আল্লাহ পাকের ইচ্ছা হয়…
তিনি কথা শেষ করলেন না। ব্যাপার এখনই বলা ঠিক হবে না। মেয়ের মেজাজের ঠিক নেই। ফট করে উল্টে যেতে পারে। কি দরকার ঝামেলা বাড়ানোর। ভালয় ভালয় মেয়ে পার করতে পারলে আল্লাহর দরবারে হাজার শুকরিয়া।
কুসুম বলল, কথা তো মা শেষ করলা না।
তোর বাপজানের ইচ্ছা তোর সাথে বিবাহ দেয়।
ও আইচ্ছা।
আমরার ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কিছুই হইব না। সবই আল্লাহপাকের উপরে। কার সাথে কার বিবাহ হইব এইটা আল্লার ঘরে সোনার কলম দিয়া লেখা থাকে। মানুষের করনের কিছু নাই–তবু একটা চেষ্টা।
কুসুম হাসছে। মনোয়ারার মনে হল সে খুশি হয়েই হাসছে। হাসলে এত সুন্দর লাগে তার মেয়েটাকে!
বিয়া কবে হইতাছে মা?
শ্রাবণ মাস বিয়ার জন্য ভাল–দেখি কি হয়। এক কথায় তো আর বিয়া হয়। জোগাড়যন্ত্র আছে।
জোগাড়যন্ত্রের কি আছে, মৌলবী ডাইক্যা আন–কবুল কবুল কবুল। বিয়া শেষ।
মনোয়ারা শংকিত চোখে মেয়েকে দেখছেন। মেয়ের কথাবার্তা সাধারণ মানুষের মত মনে হচ্ছে না, কথাবার্তা-হাবভাবে জ্বীনের ইশারা আছে। বিয়ে যত তাড়াতাড়ি হয় ততই ভাল।
মার পীড়াপীড়িতেই কুসুমকে তেল দিয়ে চুল বাঁধতে হল। দুই বেনীতে কুসুমকে ভাল লাগে। দুই বেনী করা হয়েছে। এক রঙের দুটা ফিতা থাকলে সুন্দর হত। দুই রঙের দুটা ফিতা। একটা লাল একটা সবুজ। তাতেও কুসুমকে সুন্দর লাগছে। চোখে কাজল দিয়েছে গাঢ় করে। কুসুমের সুন্দর চোখ আরো সুন্দর লাগছে। বাপের এবারে আনা এক রঙের সবুজ শাড়ি খুব ফুটেছে। কুসুম যেন ঝলমল করছে।
মোবারক ফিরেছেন শুনে মতি এসেছে দেখা করতে। ঘরের উঠানে কুসুমের সঙ্গে দেখা। মতি হকচকিয়ে গেল। ঝাটা হাতে উঠান ঝাট দিচ্ছে ফুটফুটে এক পরী। মতি কিছু বলার আগেই কুসুম বলল, আমরার গাতক ভাইয়েরাই ভাল?
হা শইল ভাল। এমন সাজ কেন কুসুম?
কুসুম হাসিমুখে বলল, বিয়ার কন্যা, না সাজলে কর?
বিয়ার কন্যা?
কুসুমের হাসি আরো বিস্তৃত হল। মাথার বেনী দুলিয়ে বলল, আফনে ভাবছিলেন কি জন্মে আমার বিবাহ হইব না? আমি কানাও না, লেংড়াও না। আমার চেহারা ছবি ভাল। এই দেহেন কত লম্বা চুল। আমার বিয়া হইব না ক্যান?
কি কও তুমি, বিয়া তো হইবই। বিয়া না হওনের কি আছে?
সবের তো হয় না। আল্লার ঘরে সোনার কলম দিয়া লেখা না থাকলে বিয়া হয় না।
পাত্র কে?
পাত্রের নাম ক্যামনে কই, পাপ হইব না? দিনে দুপুরে আসমানে যে জিনিশ থাকে সেই জিনিশের নামে তার নাম।
সুরুজ?
এই তো পারছেন। লোকে আফনেরে বোকা কয় এইটা ঠিক না। আফনের বুদ্ধি আছে। অল্পবিস্তর হইলেও আছে।
কুসুম গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করল, বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এই খবরে মতি মোটেই বিচলিত হচ্ছে না। বরং তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুশি হয়েছে। বেশ খুশি।
মতি আগ্রহের সঙ্গে বলল, বিয়ার তারিখ হইছে?
না হয় নাই, তয় শ্রাবণ মাসেই হইব। শ্রাবণ মাস বিয়াশাদীর জন্য ভাল।
তোমার বিয়ার দিন বড় কইরা একটা গানের আসর করব কুসুম।
কইরেন।
ধুম বাদ্য-বাজনা হইব।
আমার শুননের উপায় নাই। আমি হইলাম বিয়ার কইন্যা।
মোবারক চাচা কই?
জানি না কই। পাড়া ঘুরতে গেছে।
উনারে বলবা খুঁজ নিতে আসছিলাম।
বলব, অবশ্যই বলব।
তোমার বিবাহ, এইটা শুইন্যা মনে বড় আনন্দ হইতাছে কুসুম। বড় আনন্দ!
আমারো আনন্দ হইতাছে। বাপ-মার গলার মধ্যে কই মাছের কাঁটা হইয়া বিন্দা ছিলাম। কাটা হওনের দুঃখু আছে। আছে না?
অবশ্যই আছে। অবশ্যই আছে। তোমারে আইজ বড়ই সৌন্দর্য লাগতাছে কুসুম। বড়ই সৌন্দর্য।
সৌন্দর্য মাইনষের চউক্ষে। যার চউখ সুন্দর তার সব সুন্দর। আফনের চউখ সুন্দর।
মতি কুসুমের বাড়ি থেকে বিষণ্ণ মুখে ফিরল। কুসুমের বিয়ে শ্রাবণ মাসে ঠিক হয়ে গেলে সমস্যা আছে। হাত একেবারে খালি। গানের আসর করার কথা দিয়ে ফেলেছে। আসরটা সে করবে কি ভাবে?