মধ্যাহ্ন – দ্বিতীয় খণ্ড
কলকাতা সমাচার পত্রিকায় মৎস্যকন্যা বিষয়ে একটা খবর ছাপা হয়েছে। প্রথম পাতায় বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা সংবাদ। পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি অরুণাভ বিশ্বাস জানাচ্ছেন্ন
জীবিত মৎস্যকন্যা ধৃত
(অরুণাভ বিশ্বাস প্রেরিত)
কালীগঞ্জে গঙ্গার মোহনায় একটি মৎস্যকন্যা জীবিত অবস্থায় ধীবরদের জালে ধূত হয়। মৎস্যকন্যাকে এক নজর দেখিবার জন্যে শত শত লোক কালীগঞ্জে জমায়েত হয়। প্রত্যক্ষদশীর জবানিতে জানা যায়, মৎস্যকন্যার চুল সোনালি, চক্ষের রঙও সোনালি। গাত্রবর্ণ নীলাভ। ধূত হইবার পর হইতেই সে ক্রমাগত তাহার বাম হস্ত নাড়িতেছিল এবং দুৰ্বোধ্য ভাষায় বিলাপের মতো ধ্বনি করিতেছিল। তাহার চোখ হইতে ঈষৎ বাদামি বর্ণের অশ্রু নির্গত হইতেছিল। ধৃত হইবার দুই ঘণ্টার মধ্যে অঞ্চলের কিছু বিশিষ্টজনের প্ররোচনায় তাহাকে হত্যা করা হয়। অসমর্থিত এক সংবাদে জানা যায় যে, মৎস্যকন্যার মাংস আহার করিলে চিরযৌবন লাভ হয়। এই বিশ্বাসে মৎস্যকন্যাকে কাটিয়া তাহার মাংস অতি উচ্চমূল্যে বিক্রয় করা হইয়াছে। এই বিষয়ে পুলিশি মামলা হইয়াছে। পুলিশের উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি নিয়া পর্যালোচনা করা হইয়াছে এবং তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। যাহারা এই বর্বর কর্ম করিয়াছেন, তাহারা বর্তমানে পলাতক।
কলিকাতা সমাচার বান্ধবপুরে আসে না। সুলতান মিয়া নামে এক লোক পত্রিকা নিয়ে উপস্থিত হলো। শুধু পত্রিকা না, সে মৎস্যকন্যার দুই পিস মাংসও না-কি এনেছে, এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ল। সুলতান মিয়া নতুন লঞ্চ কোম্পানি লক্ষ্মী নেভিগেশনে বাবুর্চির কাজ করে। সোহাগগঞ্জ বাজারের হোটেলে মাঝেমধ্যে রাত কাটায়। তার বয়স ত্ৰিশের কাছাকাছি। ধূর্ত চোখ। হাত-পা সরু। হাঁটে কুজো হয়ে। তার থুতনিতে এক গোছা দাড়ির কারণে তাকে দেখায় আলাদিনের চল্লিশ চোরের এক চোরের মতো। লঞ্চ-স্টিমারের বাবুচরা বিনয়ী হয়, সে উদ্ধত প্রকৃতির।
সুলতান মিয়া মৎস্যকন্যার মাংস নিয়ে এসেছে শুনে শশাংক পাল তাকে ডেকে পাঠালেন। একজীবনে তিনি নানান ধরনের মাংস খেয়েছেন। মৎস্যকন্যার মাংস খাওয়া হয় নি।
শশাংক পালের এখন শেষ সময়। সারা শরীর ফুলে উঠেছে; শরীরে সাৰ্ব্বক্ষণিক ব্যথা। সেই ব্যথা ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করে। কালো পিঁপড়ায় কামড়ালে ব্যথা খানিকটা কমে। শশাংক পালের নিজের লোক সুলেমানের প্রধান কাজ হচ্ছে, কালো পিপড়া ধরে এনে শশাংক পালের গায়ে ছেড়ে দেয়া। পিঁপড়া ছাড়ার পর পর শশাংক পাল কাতর গলায় বলেন, কামড় দে বাবারা। কামড় দে। তোদের পায়ে ধরি। জমিদার শশাংক পাল তোদের পায়ে ধরছে। ঘটনা সহজ না। ঠিকমতো কামড় দে, পিরিচে মধু ঢেলে তোদের খেতে দিব। আরাম করে মধু খাবি।
পিঁপড়াদের খাবারের জন্যে পিরিচে। সত্যি সতি্যু মধু ঢেলে রাখা হয়। বিচিত্র কারণে পিঁপড়ারা মধু খাওয়ার কোনো আগ্রহ দেখায় না। শশাংক পাল নিজের গায়ে মধু মেখে দেখেছেন। পিঁপড়ারা তার সারা শরীরে হাঁটে, মধু মাখা অংশের ধায়েকাছে যায় না।
কালো পিঁপড়া কামড়ালে ব্যথা কমে, এই তথ্য তিনি আবিষ্কার করেছেন গাছ-চিকিৎসা করতে গিয়ে। গাছ-চিকিৎসায় পুরুন্টু কোনো একটা গাছকে জড়িয়ে ধরে থাকতে হয় এবং মনে মনে বলতে হয়- ‘হে বৃক্ষ! তুমি আমার রোগ তোমার শরীরে ধারণ করে আমাকে রোগমুক্ত কর।’ রোগমুক্তি না হওয়া পর্যন্ত গাছ জড়িয়ে থাকার নিয়ম। প্রবল বৃষ্টি এবং গাছের একটা ডাল ভেঙে পড়ার কারণে আট ঘণ্টার মধ্যেই শশাংক পাল বিশেষ এই চিকিৎসার ইতি ঘোষণা করেন। লাভের মধ্যে কালো পিঁপড়ায় কামড়ালে ব্যথা কমে এই তথ্য আবিষ্কার করেন।
সুলতান মিয়া খবর পেয়ে শশাংক পালের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সে সরাসরি তাকাতে পারছে না, কারণ শশাংক পাল সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় পাটিতে শুয়ে আছেন। শীতলপাটির উপর কলাপাতা বিছানো। একজন নিমগাছের ডাল দিয়ে তাকে বাতাস দিচ্ছে। নিমপাতার হাওয়া শরীরের জন্যে উপকারী। শশাংক পাল কিছুক্ষণ আগে বমি করেছেন। মুখ ধোয়া হয় নি। বেশ কিছু পুরুষ্ট নীল রঙের মাছি মুখের চারপাশে উড়াউড়ি করছে। নিমপাতার হাওয়ার কারণে মুখে বসতে পারছে না। তারা হতোদ্যম হয়ে চলেও যাচ্ছে না। রবার্ট ব্রুসের ধৈর্য নিয়ে চেষ্টা করেই যাচ্ছে।
শশাংক পাল বললেন, শরীরে কাপড় রাখতে পারি না। শরীর জ্বালা করে। এই জন্যে ন্যাংটা হয়ে আছি। বুঝেছ?
সুলতান মিয়া হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
শশাংক পাল বললেন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি বিদেশী মানুষ। তুমি কি আমাকে চেনো?
সুলতান মিয়া আবারো হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
আমার সম্বন্ধে কী জানো অল্পকথায় বলে। সারমর্ম বলবা, ইতিহাস শুরু করবা না। ইতিহাস শোনার সময় আমার নাই। জীবনের শেষপ্রান্তে উপস্থিত হয়েছি। এখন ঝটপট বলো, আমি কে?
আপনি জমিদার শশাংক পাল।
একসময় জমিদার ছিলাম। আমার রক্ষিতা ছিল চারজন। এখন আমি ফালতু। শশাংক পাল, বালস্য বাল। হা হা হা।
শশাংক পাল হেঁচকি না ওঠা পর্যন্ত হাসলেন। অতি কষ্টে বললেন, লোকমুখে শুনেছি। তুমি না-কি মৎস্যকন্যার মাংস নিয়ে এসেছ?
সুলতান মিয়া হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। শশাংক পাল বললেন, মাথা নাড়ােনাড়ি বন্ধ। হ্যাঁ বলবা কিংবা না বলবা। মৎস্যকন্যার মাংস এনেছ?
হ্যাঁ।
কতখানি এনেছ?
দুই পিস। এক পিস বিক্রি করে দিয়েছি। আরেক পিস আছে।
মৎস্যকন্যার মাংস খেলে চিরযৌবন লাভ হয়, এটা কি সত্য?
জানি না। লোকে বলে।
তুমি নিজে খেয়েছ?
না।
এক পিস মাংস যে বিক্রি করেছ, কার কাছে বিক্রি করেছ? তার নাম ঠিকানা বলে।
গোয়ালন্দে এক লোকের কাছে বিক্রি করেছি। কাপড়ের ব্যবসা করে। নাম জানি না।
কত টাকায় বিক্রি করেছ?
কত টাকায় বিক্রি করেছি সেটা আপনারে বলব না।
কেন বলবা না?
সুলতান মিয়া চুপ করে রইল। শশাংক পাল বললেন, আমার আগের দিন থাকলে বেয়াদবির জন্যে তোমাকে ন্যাংটা করে মাটিতে পুতে ফেলতাম। যাই হোক, এখন বলো মাংস কোথায় পেয়েছ?
কালিগঞ্জ থেকে এনেছি। যেখানে মৎস্যকন্যা ধরা পড়েছে সেখান থেকে এনেছি।
তার অর্থ কি এই যে, তুমি নিজ চোখে মৎস্যকন্যা দেখেছ?
হুঁ।
শশাংক পাল ধমক দিয়ে বললেন, ই আবার কী? আদবের সঙ্গে বলোদেখেছি কি দেখা নাই।
দেখেছি।
আমরা ছবিতে যেরকম দেখি সেরকম?
সুলতান মিয়া অস্পষ্ট গলায় বলল, সেরকমই, তবে মুখ ছোট।
গাত্ৰবৰ্ণ কী?
নীল।
তার বুকের সাইজ কী? বাঙালি মেয়েদের মতো, না-কি বুকও মুখের মতো ছোট?
খিয়াল নাই।
খিয়াল নাই মানে? বুক দেখো নাই? লজ্জা পেয়েছিলা? মৎস্যকন্যা উদাম গায়ে পানিতে ঘুরে। সে তো শাড়ি দিয়া শরীর ঢাকে না। তারে নগ্ন দেখাই স্বাভাবিক।
সুলতান মিয়া বলল, আমি যখন দেখেছি তখন উড়না দিয়া তার বুক ঢাকা छिन।
উড়না দিয়া বুক ঢাকার প্রয়োজন পড়ল কেন?
সুলতান মিয়া বলল, অনেক ছোট ছোট পুলাপান ছিল, এইজন্যে ঢাকা হয়েছিল। মাতব্বররা ঢাকতে বললেন।
শশাংক পাল বললেন, তুমি বিরাট মিথ্যুক, এইটা তুমি জানো? তুমি কিছুই দেখ নাই। সব বানায়ে বলতেছ। তুমি আছ টাকা কামানোর ধান্দায়। দুই পিস মাংস কোনখান থেকে যোগাড় করে সেটা বিক্রির ধান্দায় আছ। যে মাংস তুমি এনেছ আমার মন বলতেছে সেটা কুকুরের মাংস। তুমি এক ধান্দাবাজ, আমি তোমার চেয়ে বড় ধান্দাবাজ।
সুলতান মিয়া বলল, আপনার সঙ্গে কথা পাল্টাপাল্টি করব না। অনুমতি gनन अभि यादरे।
শশাংক পাল বললেন, অনুমতি দিলাম না। তুমি যে ধান্দাবাজ এটা স্বীকার করে তারপর বিদায় হও।
সুলতান মিয়া স্বাভাবিক গলায় হাই তুলতে তুলতে বলল, আচ্ছা স্বীকার করলাম। এখন বিদায় দেন। আপনার সঙ্গে আমি বাহাস করব না। আপনি যেটা বলেন সেটাই সত্য।
আমার সঙ্গে বাহাস করবা না কেন?
আমি কারোর সাথেই বাহাস করি না। আমার কাছে এক টুকরা মাংস আছে। দশ হাজার টাকা দাম। আপনে ইচ্ছা করলে খরিদ করতে পারেন।
শশাংক পাল বিক্ষিত গলায় বললেন, দশ হাজার টাকা দাম? তুই কন্স কী? দশ হাজার টাকায় একজোড়া জীবন্ত মৎস্যকন্যা পাওয়া যায়। তাদের সঙ্গে যৌনকর্ম করা যায়।
সুলতান নির্বিকার গলায় বলল, পাওয়া গেলে খরিদ করেন। যৌনকর্ম করতে চাইলে করেন। আপনার বড় পুসকুনি আছে। পুসকুনিতে ছাড়েন। আমারে তুই তুকারি করবেন না, আমি আপনার কর্মচারী না।
শশাংক পাল নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেন। এই বিদের বাচ্চার সঙ্গে কথা চালাচালির অর্থ হয় না। মূল প্রসঙ্গে যাওয়াই ভালো। তিনি হাই তুলতে তুলতে বললেন, মাংস খাইতে হয় কীভাবে? রান্না কইরা খাইতে হয়, না-কি কাঁচা খাইতে হয়?
জানি না।
এক হাজার টাকা নগদ দিতে পারি। যদি পোষায় দিয়া যা। টাকা নিয়া যা।
সুলতান স্পষ্ট গলায় বলল, না। বলেই বের হয়ে গেল। এক মুহুর্তের জন্যেও দাঁড়াল না।
শশাংক পাল ধাধায় পড়ে গেলেন। সত্যি কি এর কাছে আসল বস্তু আছে? চিরযৌবন সহজ ব্যাপার না। এর জন্যে রাজত্ব দিয়ে দেয়া যায়। রাজত্বের কাছে দশ হাজার টাকা কোনো টাকাই না। তাছাড়া টাকা দিয়ে তিনি করবেনইবা কী? মৃত্যু মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি মাথা ঘুরাতে পারেন না বলে দেখতে পারেন না। এক পিস মৎস্যকন্যার মাংস খেলে চিরযৌবন না পাওয়া গেলেও রোগটা তো সারিতে পারে।
বিষয়টা নিয়ে তিনি কি কারো সঙ্গে আলাপ করবেন? আলাপ-আলোচনা করার লোকও নাই। সব ধান্দাবাজ। সবাই আছে নিজের ধান্দায়। কাউকে বিশ্বাসও করা যায় না। মাওলানা ইদরিসকে খবর দিয়ে আনা যায়। সেও গাধা। গাধা মাওলানা। হাদিস-কোরানের বাইরে কিছুই জানে না। শশাংক পাল বিরক্ত গলায় ডাকলেন, সুলেমান! সুলেমান!
সুলেমান ঘোড়ায় চড়ে ভিক্ষা করে। দূর-দূরান্তে চলে যায়। সে এইসব বিষয় জানতে পারে। সুলেমানকে পাওয়া গেল না। জানা গেল কিছুক্ষণ আগে সে ঘোড়া নিয়ে বের হয়েছে। ভিক্ষাবৃত্তির প্রধান সমস্যা হচ্ছে, দিনের মধ্যে কিছুক্ষণ ভিক্ষা না করলে পেটের ভাত হজম হয় না।
শশাংক পালের মুখে মাছি বসেছে। নিমপাতা দিয়ে হাওয়া করে মাছি তাড়াবার কেউ নেই। তিনি নিজে হাত দিয়ে তাড়াতে পারেন। তাতে লাভ কী? আবার এসে বসবে।
পুকুরঘাটে কে যেন হাঁটাহাঁটি করছে। শুকনা পাতার ওপর হাঁটার শব্দ কানে আসছে। শরীর পুরোপুরি নষ্ট হওয়ায় একটা লাভ হয়েছে, কান পরিষ্কার হয়েছে। অনেক দূরের শব্দও শুনতে পান।
শশাংক পাল বললেন, হাঁটে কে? কাছে আস।
কেউ একজন এসে মাথার পেছনে দাঁড়াল। এমনভাবে সে দাঁড়িয়েছে যে তাকে দেখা যাচ্ছে না।
শশাংক পাল বললেন, গাধার মতো মাথার পিছনে দাঁড়ায়েছ। কেন? সামনে আসি তোমারে দেখি।
সারা গায়ে চাদর জড়ানো একজন শশাংক পালের পায়ের কাছে এসে দাঁড়াল।
তুমি কে?
আমার নাম লাবুস।
সুলেমানের পুলা না?
জি।
শরীরে চাদর কেন? ‘দরবেশ হয়েছ? এইখানে কী চাও?
বাপজানের খোঁজে আসছি।
সে গেছে ভিক্ষায়। তুমি একটা কাজ কর, আরেকটা ঘোড়া জোগাড় কর। বাপ-বেটায় একসঙ্গে ঘোড়ায় চইড়া ভিক্ষা করবো। মনোহর দৃশ্য। হা হা হা।
লাবুস তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না একটি নগ্ন মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে সে কোনোরকম লজ্জা পাচ্ছে। শশাংক পাল বললেন, নিমের ডাল হাতে নাও। আমারে বাতাস করা। ঘণ্টা হিসাবে পয়সা পাইবা। ঘণ্টায় দুই পয়সা। রাজি আছ?
লারুস, জবাব না দিয়ে নিমের ডাল দিয়ে বাতাস শুরু করল। ঘণ্টায় দুই পয়সা তার জন্যে যথেষ্ট। আজ সকাল থেকে সে কিছু খায় নি। সে বাবার কাছে এসেছিল দুপুরের খাবারের কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি-না সেই খোঁজে।
নিমের ডালের হাওয়ায় আরাম লাগছে। মাছিগুলি যে তাড়া খাচ্ছে এই দৃশ্য দেখেও ভালো লাগছে। শশাংক পাল বললেন, মৎস্যকন্যার মাংস নিয়ে একজন যে বান্ধবপুর বাজারে এসেছে এই খবর জানো?
লাবুস বলল, না।
হারামজাদা এক পিস মাংসের দাম চায় দশ হাজার টাকা। থাপড়ায়ে এর দাঁত ফেলা দরকার। তাকে থাপড়াতে পারব?
লারুস, জবাব দিল না। একমনে বাতাস করতে লাগল। শশাংক পাল বললেন, বাজারে তারে খুঁইজ্যা বাহির করা। তারপর তার দুই গালে দুই চড় দেও। প্রতি চড় এক টেকা হিসেবে দুই টেকা পাইবা। রাজি?
লাবুস জবাব দিল না।
শশাংক পাল বললেন, কত বড় ধান্দাবাজ, কুকুরের মাংস নিয়ে এসে বলে মৎস্যকন্যার মাংস! আমার কাছে বেচিতে চায়। ভাবছে কী? এই মাংস খাওয়ার চেয়ে গু খাওয়া ভালো। ঠিক না?
লাবুস বলল, ঠিক।
শশাংক পাল পরদিন দুপুর দুটিার সময় মৎস্যকন্যার মাংস খেলেন। কাঁচাই খেলেন। রান্না করলে যদি গুনাগুণ নষ্ট হয়ে যায়! মাংস খাবার সময় সুলতান সামনে বসে রইল। লবণভর্তি মাংস— খাওয়ার সময় শরীর উল্টে যাবার মতো হলো। শশাংক পাল হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, নুনা ইলিশের মতো স্বাদ। এর কারণ কী?
সুলতান বলল, মাংস যাতে নষ্ট হয়ে না যায়। এর জন্যে নুন দিয়ে জারানো। চাবায়ে খাওয়ার দরকার কী! ওষুধের ট্যাবলেটের মতো গিলে ফেলেন। এটা তো ওষুধই।
অনেক কষ্টে শশাংক পাল মাংস গিললেন। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই শরীরে জুলুনি শুরু হলো। যেন কেউ নাগা মরিচ বেটে শরীরে মাখিয়ে দিয়েছে। এমন ভয়ঙ্কর জুলুনি যে শশাংক পালের ইচ্ছা করছে নিজেই টান দিয়ে তার গায়ের চামড়া খুলে ফেলেন। তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, আমাকে ধরাধরি করে পুসকুনির পানিতে ড়ুবায়ে রাখা। আমার সর্বাঙ্গ জুলে যাচ্ছে গো। সর্বাঙ্গ কেউ যেন আগুন দিয়ে পুড়াচ্ছে। হায় ভগবান, এ-কী শাস্তি!
তাঁকে পুকুরের পানিতে ড়ুবানো হলো। দুইজন দুই দিক থেকে হাত ধরে আছে। তিনি মাথা ভাসিয়ে আছেন। মাঝে মাঝে মুখে পানির ছিটা দেয়া হচ্ছে। বান্ধবপুরের মানুষ পুকুরের চারদিকে জড়ো হলো। তাদের কৌতূহলের সীমা নাই। শশাংক পাল বললেন, দেখ মিনি মাগনার মজা। মৎস্যকন্যার মাংস খেয়ে আমি হয়েছি মৎস্যপুরুষ। পানিতে বাস করা শুরু করেছি। এমন মজা দেখবা না। কোনো সার্কাস পাটিতেও এই মজা নাই।
সন্ধ্যাবেল তিনি মাওলানা ইদরিসকে খবর দিলেন। ক্ষীণ গলায় বললেন, সবাই মজা দেখতে এসেছে, আপনি নাই, এটা কেমন কথা? মজা ভালো লাগে না?
মাওলানা বললেন, আপনি বিরাট যন্ত্রণার মধ্যে আছেন। মানুষের যন্ত্রণা দেখতে ইচ্ছা করে না।
এটা কী বললেন মাওলানা? যন্ত্রণা দেখার মধ্যেই আনন্দ। অন্যের যন্ত্রণা হচ্ছে, আমার হচ্ছে না— আনন্দ না?
মাওলানা জবাব দিলেন না। শশাংক পাল বললেন, আপনাকে ডেকেছি একটা অতি জরুরি এবং অতি গোপন কথা বলার জন্যে। খোশগল্প করার জন্যে ডাকি নাই।
মাওলানা বললেন, বলেন কথা। আমি আছি।
শশাংক পাল ক্ষীণ গলায় বললেন, কথাটা শুধু আপনারে বলব। দুইজন আমার হাত ধরে আছে। এখন বললে তারাও শুনবে। আমি চাই না তারা শুনুক। এই তোরা দুইজন আমাকে শুকনায় তোল। কিছুক্ষণের জন্যে বিদায় হ। মাওলানার সঙ্গে কথা শেষ হবার পর আবার পানিতে নামাবি।
শশাংক পাল তার অতি জরুরি গোপন কথা মাওলানাকে বলে শেষ করলেন। তাকে আবারো পানিতে নামানো হলো। মধ্যরাত থেকে তিনি বিকারগ্রস্তের প্রলাপ শুরু করলেন। অতি উচ্চকণ্ঠে বলতে শুরু করলেন–
তোমরা যারা আমার আশেপাশে আছ তারা শোন। মন দিয়ে শোন। স্বৰ্গ নরক সবই আছে। আমি অবিশ্বাসী নাস্তিক ছিলাম। এখন আস্তিক। আমি ডান চোখে স্বৰ্গ দেখছি। একই সঙ্গে বাম চোখে নরক দেখছি। স্বৰ্গ সম্পর্কে এতদিন যা শুনেছি সবই ভুল। স্বৰ্গ তোমাদের সবার কল্পনার চেয়েও মনোহর। স্বর্গে যারা বাস করেন, তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভাসতে ভাসতে যান। নরকের কথা কিছু বলব না। নরক তোমাদের সবার কল্পনার চেয়েও ভয়ঙ্কর। ভগবান, আমাকে ক্ষমা কর। ভয়ঙ্কর নরকের হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর।
বিকারগ্রস্তের মতো চিৎকার করতে করতেই শশাংক পালের মৃত্যু হলো।
বড়গাঙের পাশে নিমাই শ্মশান ঘাটে তার চিতার আয়োজন হলো। মুখাগ্নি করার কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। পুরোহিত বললেন, নিকট আত্মীয়ের অভাবে তাকে পিতৃসম জ্ঞান করতেন এমন কেউ মুখাগ্নি করতে পারেন।
মড়া পোড়ানো দেখতে প্রচুর জনসমাগম হয়েছে। পুরোহিতের কথাতে তাদের মধ্য থেকে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল না।
পুরোহিত বললেন, স্বধর্মের স্ববর্ণের যে-কেউ হলেই হবে। প্রয়োজনে নিম্নবর্ণের যে-কেউ আসতে পারেন। শাস্ত্রে এই বিধান রাখা হয়েছে।
কেউ এগিয়ে আসছে না। এদিকে আকাশে মেঘা জমতে শুরু করেছে। চৈত্র বৈশাখে ঝড়-বৃষ্টি হয়। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে, আজ বড় ধরনের ঝড় আসবে। বাতাস থমথমে।
পুরোহিত বললেন, কেউ কি আসবেন?
ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন বলল, অন্য ধর্মের কেউ কি এই কাজটা করতে পারেন?
আপনি কে?
আমি হাফেজ ইদরিস।
হ্যাঁ পারবেন।
সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় শশাংক পালকে উপুড় করে শোয়ানো হয়েছে। তার মাথা উত্তরমুখী।
মাওলানা ইদরিস আগুন হাতে নিয়ে পুরোহিতের সঙ্গে মন্ত্র পাঠ করছেন—
‘ওঁ দেবাশ্চাগ্নিমুখী এনং দহন্তু!’
মন্ত্র পাঠের শেষে চিতা প্ৰদক্ষিণ শুরু হলো। পুরোহিত মন্ত্র পড়ছেন, মাওলানা ইদরিস বিড়বিড় করে সেই মন্ত্র বলছেন—
‘ওঁ কৃত্বা তু দুষ্কৃতং কৰ্ম জানতা বাপ্যজানতা।
মৃত্যুকালবশং প্রাপ্য নরং পঞ্চত্মাগতম।
ধৰ্ম্মাধৰ্ম্মসমাযুক্তং লোভমোহসমাবৃতম।
দহেয়ং সৰ্ব্বগাত্রানি দিব্যান লোকান মা গচ্ছতি।’
‘তিনি জ্ঞানত বা অজ্ঞানতাবশত অনেক দুষ্কৃত কাজ করেছেন। মানুষের মৃত্যু প্ৰাপ্য, প্রকৃতির এই বিধানে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। এই ব্যক্তির ধর্ম অধৰ্ম লোভ-মোহ সমাবৃত হয়েই মৃত্যু হয়েছে। এখন হে অগ্নিদেব, আপনি তাকে দহন করে দেবলোকে নিয়ে যান।’
মুখে আগুন দেয়ামাত্রই ঝড় শুরু হলো। বাতাস পেয়ে আগুন তেজি হলো। নামল বৃষ্টি, সেই বৃষ্টিতেও আগুন নিভল না। লোকজন সবাই বিদায় নিয়েছে। পুরোহিত এবং মাওলানা ইদরিস বসে আছেন। আধা টিন কেরোসিন বেঁচে গেছে। এই কেরোসিন পুরোহিতের প্রাপ্য। মাওলানার সামনে এই টিন নিয়ে যেতে তাঁর লজ্জা লাগছে। বিধর্মী মানুষ। নিশ্চয়ই জানে না বেঁচে যাওয়া সবকিছুই পুরোহিতের প্রাপ্য। সে হয়তো ভেবে বসবে লোভী পুরোহিত।
এককালের অতি প্রতাপশালী জমিদার শশাংক পালের মৃত্যু হলো ১২ই চৈত্র ১৩৪৭ সনে।
ইংরেজি ২৩ মার্চ ১৯৪০ সন। বিশেষ একটা দিন। ওই দিন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ‘লাহোর প্রস্তাব’ ঘোষণা করেন। লাহোর প্রস্তাবে উত্তরপশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব ওঠে। লাহোর অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন পুরোদমে চলছে। জার্মান আর্মি গ্রুপ সি বেলজিয়ামের ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়ে নেদারল্যান্ড আক্রমণ করেছে। অতি অল্প সময়ে তারা ফ্রান্সের গভীরে ঢুকে যায়। দুর্ভেদ্য মাজিনো লাইন কোনো কাজেই আসে না।
লন্ডনে চলতে থাকে টানা বিমান আক্রমণ। ব্রিটিশ সিংহ থমকে দাঁড়ায়। কারণ বোমা পড়ছে বাকিংহাম প্রাসাদে। যেখানে বাস করেন। রানি এলিজাবেথ। রানিকে প্রাসাদ থেকে গোপন আবাসে সরিয়ে নেয়া হলো। কেউ জানে না। কোথায় রানি। হঠাৎ হঠাৎ গোপন আবাস থেকে বের হন। ইংরেজের প্রিয় খেলা শিয়াল শিকারে বের হন। ঘোড়ায় চড়ে শিয়াল তাড়া করেন। আনন্দময় এই খেলাতেও তাঁর মনে বসে না। বড় অস্থির সময় কাটে।
ভারতবাসীরা যুদ্ধে কোন পক্ষ সমর্থন করবে। ঠিক বুঝতে পারে না। হিন্দুমুসলমান দুই পক্ষে ভাগ হয়েছে। এক পক্ষ ব্রিটিশ রাজকে সমর্থন করলে অন্য পক্ষ তা করতে পারে না। কোলকাতার মুসলমানদের কেউ কেউ অদ্ভুত স্লোগানও দিতে শুরু করেছে—
কানামে বিড়ি
মু মে পান
লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।
এই লড়াই কার বিরুদ্ধে? ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে, না-কি হিন্দুদের বিরুদ্ধে?
রাতে মাওলানা খেতে বসেছেন। তাঁর স্ত্রী জুলেখা সন্তানসম্ভবা। পিঁড়িতে বসতে কষ্ট হয় বলে স্বামীর খাবার সময় সে পাখা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। খাবার সময় গল্পগুজব মাওলানা পছন্দ করেন না। খাওয়া হচ্ছে ইবাদত। ইবাদতের সময় গল্পগুজব চলে না। তারপরেও মাঝেমধ্যে মনের ভুলে জুলেখা দু’একটা প্রশ্ন করে ফেলে। আজ যেমন করল। কৌতূহলী গলায় বলল, জমিদার শশাংক বাবু আপনাকে যে গোপন কথাটা বলেছে সেটা কী?
ইদরিস বললেন, গোপন কথা তোমাকে কেন বলব?
জুলেখা বলল, আমি আপনার স্ত্রী এইজন্যে বলবেন।
ইদরিস বললেন, তুমি আমার স্বভাব জানো। এই কাজ আমি কখনো করব না।
জুলেখা বলল, গোপন কথা কি জমিজমার বিলি ব্যবস্থা নিয়ে?
মাওলানা বললেন, না। এই বিষয়ে তুমি আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করবা না।
অন্য কোনো বিষয়ে কি কিছু বলব?
বলো।
আপনি নামাজ কালাম ছেড়ে দিয়েছেন কেন? লোকমুখে শুনলাম শশাংক পালের মুখাগ্নি করেছেন। আপনি তাঁর কে?
মাওলানা জবাব দিলেন না। তার কপালে কুঞ্চন রেখা দেখা দিল।
জুলেখা নিচু গলায় বলল, আমি আপনার সঙ্গে বাস করতে আসার পরই আপনি নামাজ কালাম ছেড়েছেন। নিজেকে আমার দোষী মনে হয়।
ইদরিস বললেন, কে দোষী কে নির্দোষী সেই বিচার আল্লাহপাক করবেন। এইসব নিয়া চিন্তা করবা না।
লোকে বলে আপনার মাথা না-কি পুরাপুরি খারাপ হয়েছে। এটা কি সত্যি?
ইদরিস বললেন, আমি বাস করি তোমার সাথে। আমার মাথা খারাপ হলে সবের আগে তুমি বুঝবা।
জুলেখা বলল, রাতে আপনি ঘুমান না। উঠানে মোড়ার উপর বসে থাকেন।
চিন্তা করি। এইজন্যে ঘুমাই না। মানুষ ঘুমের মধ্যে চিন্তা করতে পারে না। চিন্তা করতে হয় জাগ্রত অবস্থায়।
কী নিয়া চিন্তা করেন?
সেটা তোমারে বলব না।
কেন বলবেন না? কেউ তো আপনারে বলে নাই-চিন্তার বিষয় নিয়া তুমি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করবা না। কেউ তো আপনারে নিষেধ করে নাই।
ইদরিস চাপা গলায় বললেন, নিষেধ করেছে।
জুলেখা আগ্রহ নিয়ে বলল, কে নিষেধ করেছে?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মাওলানা খাওয়া শেষ করে হাত ধোয়ার জন্যে বারান্দায় চলে গেলেন। বারান্দায় কলসিভর্তি পানি এবং লোটা রাখা আছে। মাওলানা বারান্দায় এসেই ডান পায়ে মেঝেতে কয়েকবার বাড়ি দিলেন। মাস চারেক হলো বাড়িতে একটা সাপ দেখা যাচ্ছে। বিশাল শঙ্খচূড়। বাস্তুসাপের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় না। বাস্তুসােপ গৃহস্থের জন্যে মঙ্গল এবং কল্যাণ নিয়ে আসে। তাছাড়া জুলেখার সন্তান হবে। এই সময়ে কোনো জীবজন্তুকে কষ্ট দেয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। জুলেখা পিতলের একটা বাটিতে প্রতিদিন সাপের জন্যে দুধ রেখে দিচ্ছে। সাপকে কখনো দুধ খেতে দেখা যায় নি। তবে বাটির দুধ থাকছে না। কেউ একজন খেয়ে নিচ্ছে। সাপের কারণে খরচ বেড়েছে। সারারাত খাটের নিচে হারিকেন জ্বলিয়ে রাখতে হয়। যুদ্ধের কারণে কেরোসিনের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। বাজারে বলাবলি হচ্ছে কয়েকদিন পর এক ফোঁটা কেরোসিনও পাওয়া যাবে না। সব কেরোসিন চলে যাচ্ছে ফৌজিদের কাছে। তারা সারাগায়ে কেরোসিন মেখে বনেজঙ্গলে যুদ্ধ করে। কেরোসিন মাখার কারণে সাপখোপ পোকামাকড় তাদের কাছে আসে না।
মাওলানা উঠানে তার নির্দিষ্ট জায়গায় মোড়ার ওপর পা তুলে বসেছেন। চিন্তা এখনো শুরু করেন নি। জুলেখা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে পান নিয়ে তাঁর কাছে আসবে। তিনি পান চিবাতে চিবাতে চিন্তা শুরু করবেন। তার আজ রাতের চিন্তার বিষয় ঠিক করা আছে। শশাংক পালের যন্ত্রণা দেখে চিন্তাটা মাথায় এসেছে। তিনি অতি সাধারণ একজন মানুষ হয়েও অন্যের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেন না। পরম করুণাময় আল্লাহপাক কীভাবে তাঁর সৃষ্ট জগতের যন্ত্রণায় নির্বিকার থাকেন! অনন্ত নরকে তাঁর সৃষ্ট প্রাণী মানুষ জুলতে পুড়তে থাকবে, আর তিনি থাকবেন নির্বিকার? তাহলে কি তিনি এমন একজন যিনি যন্ত্রণাবোধ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত? তাই যদি হয়, তাহলে তো তিনি আনন্দবোধ থেকেও মুক্ত। সেরকমই কিছু হবে। সূরা এখলাসে তিনি বলেছেন, ‘ওয়ালাম ইয়া কুল্লাহু কুফু। আন আহাদ।’ যার অর্থ আমার সমকক্ষ কেহই না। মাওলানা মনে করেন— এই অনুবাদ ঠিক না। অনুবাদটা হবে— ‘আমি অন্য কাহারো মতো নই‘।
পান নেন।
ইদরিস পান নিলেন। জুলেখা হাতে করে পিড়ি নিয়ে এসেছে। সে মাওলানার পাশে পিড়ি রেখে পিড়িতে বসতে বসতে বলল, আজ রাতে আমিও আপনার মতো চিন্তা করব।
মাওলানা আগ্রহ নিয়ে বললেন, কী নিয়া চিন্তা করবা?
আমার মেয়েটারে নিয়া চিন্তা করব।
তোমার যে মেয়ে হবে এটা তুমি ক্যামনে জানো? ছেলেও তো হইতে পারে। পেটের সন্তান ছেলে না মেয়ে এই রহস্য আল্লাহপাক ভেদ করেন না। জন্মের পরে তিনি রহস্য ভেদ করেন।
জুলেখা বলল, আমার যে মেয়ে হবে এইটা আমি জানি। তাকায়া দেখেন, আমার চেহারা অনেক সুন্দর হয়েছে। এর অর্থ জানেন?
না।
এর অর্থ আমার মেয়ে হবে। মেয়ের মা সুন্দরী, ছেলের মা বান্দরী।
মাওলানা জবাব দিলেন না। ঝড়বৃষ্টির শেষে চৈত্র মাসের মেঘশূন্য আকাশ। এত বড় চাঁদ উঠেছে। নিশ্চয়ই পূর্ণিমা। গাছপালার ফাঁক দিয়ে জোছনা গলে গলে পড়ছে। কী অপূর্ব দৃশ্য! শশাংক পাল এই দৃশ্য আজ দেখতে পারছেন না। কিংবা কে জানে, এরচে‘ও অনেক সুন্দর দৃশ্য তিনি এখন দেখছেন। আল্লাহপাক তাকে ক্ষমা করেছেন। হয়তো তিনি তাকে বলেছেন— পৃথিবীতে শেষ দিনগুলি তোর অনেক কষ্টে গেছে। এখন আয় আরাম কর। তোকে দিলাম চিরযৌবন।
জুলেখা মিষ্টি করে ডাকল, মীরার বাপ!
মাওলানা চমকে উঠে বললেন, কী বললা?
জুলেখা চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলল, আপনারে মীরার বাপ বলে ডাকলাম। আমি আমার মেয়ের নাম রাখব মীরা।
হিন্দু নাম?
নামের কোনো হিন্দু মুসলমান নাই। নাম নামাজ রোজা করে না, পূজা করে না। নাম মানুষের একটা পোশাক। পোশাকের কি কোনো ধর্ম থাকে?
ইদরিস বিস্মিত হয়ে বললেন, তোমার ভালো বুদ্ধি।
জুলেখা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি আমার ভালো বুদ্ধি। মানুষ আমার রূপটা শুধু দেখে, বুদ্ধি দেখে না। আপনি দেখেছেন, আমার ভালো লাগল।
ইদরিস বললেন, আরেকটা পান খাব।
জুলেখা বলল, পান দিতেছি। তার আগে একটা কথা বলি, মন দিয়া শুনেন। শশাংক পাল আপনারে একটা গোপন কথা বলেছে, আপনি যেটা আমারে বলেন নাই। আমার একটা গোপন কথা আছে, সেটা আপনারে এখন বলব।
বলো।
আমার মেয়েটার জন্মের পর আমি আপনারে ছেড়ে চলে যাব।
মাওলানা অবাক হয়ে বললেন, কেন?
জুলেখা স্বাভাবিক গলায় বলল, আমার কারণে আপনি বিরাট বিপদে পড়েছেন। সমাজে পতিত হয়েছেন। নামাজ কালাম ছেড়েছেন। মাথা খারাপের দিকে যাইতেছেন। আমি আপনারে মুক্তি দিব।
মেয়েটাকে কি নিয়ে যাবে?
না। তাকে আপনার কাছে দিয়া যাব। আপনি মেয়েটারে ভালো মানুষ হওয়া শিখাইবেন। আমি চাই আমার মেয়ে আপনার মতো ভালো মানুষ হোক।
জুলেখার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। গাল ভেজা। ভেজা গালে চাঁদের আলো চকচক করছে। মাওলানা বিস্মিত হয়ে বললেন, কাঁদতেছ কেন?
জুলেখা সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছে বলল, আর কাঁদব না। বলেই সে ফিক করে হাসল। মাওলানা মুগ্ধ হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর স্ত্রী যে পৃথিবীর অতি রূপবতীদের একজন এটা তার মনেই থাকে না। হঠাৎ হঠাৎ বুঝতে পারেন। তখন তাঁর বড় বিস্ময় লাগে। পবিত্র কোরান শরিফে বেহেশতের আয়তচক্ষু হুরদের বর্ণনা আছে। তারা কি জুলেখা নামের এই মেয়ের চেয়েও সুন্দর? আল্লাহপাক যখন বলেছেন তখন অবশ্যই সুন্দর। কিন্তু সেই সৌন্দর্য কী রকম? কাকে আমরা সৌন্দর্য বলি? ফুল সুন্দর লাগে কেন? পাতাকে ফুলের মতো সুন্দর লাগে না, অথচ ফুলকে লাগে। ফুলের গন্ধ আছে। এইজন্যে কি? গন্ধ ছাড়াও তো ফুল আছে। সেই ফুলও তো সুন্দর।
জুলেখা বলল, কী চিন্তা করেন?
মাওলানা জবাব না দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশে পূৰ্ণচন্দ্র। সেই চন্দ্ৰও সুন্দর লাগছে। সুন্দর তাহলে কী?
জুলেখা বলল, গান শুনবেন?
মাওলানা বললেন, না। গানবাজনা নিষেধ আছে।
নিষেধ থাকলেও শুনেন। আপনারে গান শুনাইতে ইচ্ছা করতেছে। বেহেশতে হুরদের গান শুনবেন। দুনিয়াতে আমি শুনাব। তখন তুলনা করবেন।
জুলেখা, গান শুনব না।
আপনে চন্দ্ৰ দেখতেছেন। আমি চন্দ্ৰ নিয়া গান করব।
বলেই জুলেখা গান শুরু করল।
ও আমার চন্দ্ৰসখারে
তোর কারণে হইলাম দিওয়ানা
ও আমার চন্দ্ৰসখারে
মিছামিছি হইছি দিওয়ানা।
আকাশের চাঁদের দিকে আরো একজন তাকিয়ে আছে। তার নাম লাবুস। সে বসে আছে লঞ্চঘাটায়। মাঝরাতে ভেঁপু বাজিয়ে লক্ষ্মী নেভিগেশন কোম্পানির শেষ লঞ্চ গোয়ালন্দ থেকে আসে। দূরের লঞ্চটাকে মনে হয় ঝাড়বাতি। ঝাড়বাতিটা আস্তে আস্তে লঞ্চের আকৃতি নেয়। দেখতে ভালো লাগে।
আজকের দিনটা লাবুসের ভালো কেটেছে। দুপুরে খাওয়া না হলেও সন্ধ্যায় ভারপেট খেয়েছে। খাওয়ার আয়োজন শশাংক পালের বাড়িতে। শ্মশানযাত্রীদের জন্যে খিচুড়ির আয়োজন ছিল। খিচুড়ি খেতে কেউ আসে নি।
লাবুস কলাপাতা নিয়ে বসেছে। বাবুর্চি কলাপাতায় খিচুড়ি ঢালতে ঢালতে বলল, শ্মশানযাত্রীর খাওয়া খায় মুসলমানে! এর নাম কলিকাল।
লাবুস বলল, অভাবের কোনো হিন্দু মুসলমান নাই।
বাবুর্চি বলল, কথা কইস না। মুখ বন্ধ কইরা খা। যত পারস খা। পাঁচ সের চাউলের খিচুড়ি। সব নষ্ট।
লাবুস মুখ বন্ধ করেই খেয়ে গেল। তিন-চারদিনের খাবার একসঙ্গে খেয়ে ফেলার ব্যবস্থা নেই। ব্যবস্থা থাকলে সে খেত। তাহলে আগামী কয়েকদিন তাকে আর খাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হতো না। মানুষ হবার প্রধান সমস্যা, সে জরুরি কোনো জিনিসই জমা করে রাখতে পারে না। দিনের খাবার দিনে খেতে হয়। দিনের ঘুম দিনে ঘুমাতে হয়। খাওয়া এবং ঘুম কোনোটিই জমা রাখা যায় না।
লঞ্চ ভোঁ দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাঁকের ভেতর থেকে তাকে দেখা যাবে। আজ আকাশে থালার মতো চাদ। চাঁদের আলো এবং লঞ্চের আলো মিলেমিশে কী সুন্দর দৃশ্যই না হবে! সুন্দর দৃশ্য দেখার আকুলতা লারুসকে ব্যাকুল করল।
তার মতো আরো একজন ব্যাকুল হলেন। তিনি বহুদূর দেশ আমেরিকায় বাস করেন। তাকে বলা হয় ‘জঙ্গলের কবি’। নাম রবার্ট ফ্রষ্ট। তিনি জঙ্গলের আলোছায়ায় হেঁটে বেড়ান। এবং প্রায়ই বলেন, অদ্ভুত সুন্দর এই পৃথিবীর সঙ্গে তার প্রেমিকের কলহের মতো কলহ।
I had a lower’s quarrel with the World.
And were an epitaph to be my story
I’d have a short One ready for my own.
I would have written of me on my Stone;
I had a lower’s quarrel with the world.