আমার বাড়িতে কিন্তু ভাল জিনিস কিছু মজুত থাকে না–
শম্পাকে বসিয়ে তার সামনে খানকয়েক বিস্কুট আর কিছুটা হালুয়া ধরে দিয়ে চা ঢালতে ঢালতে পারুল বলে, রসগোল্লা-টসগোল্লা খেতে ইচ্ছে হলে নিজে দোকানে যেতে হবে।
আপাততঃ নয়, তবে ইচ্ছে খুবই হবে। শম্পা আগেই ঢকঢক করে এক গেলাস জল শেষ করে বলে, ওই ছোঁড়াটা সেরে উঠলেই যাওয়া যাবে। ভীষণ পেটুক ওটা, বুঝলে? মিষ্টি খাওয়ার যম একেবারে। আমি একলা খেলে দেখে হিংসেয় মরে যাবে। তা তোমার হালুয়াও কিছু মন্দ নয়। এখন তো মনে হচ্ছে স্বর্গের সুধা। চাও ঢালছো? গুড। তা তোমার রান্না-খাওয়া হয়ে গেছে?
পারুল হেসে উঠে বলে, সে কী রে! তুই আসছিস, আমি খেয়ে-দেয়ে বসে থাকবো?
তার মানে? শম্পা চোখ কপালে তুলে বলে, তুমি জানতে নাকি আমি আসছি
জানতাম বৈকি। পারুল হাসে, জানা যায়।
সে কী রে বাবা, জ্যোতিষ-ট্যোতিষ জানো নাকি?
পারুল আবারও মুখ টিপে হেসে বলে, ধরে নে জানি।
জানো? সত্যি?
শম্পা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলে, তাহলে খাওয়ার পর আমার হাতটা দেখো দিকি একবার। প্রেম, বিবাহ, পারিবারিক সুখ, শিক্ষাদীক্ষা, এসবের কী কী ফলাফল!
পারুল ওর মুখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে বলে, সব ফলই ভালো।
ওটা তো কঁকির কথা! দেখতে হবে…কই, তুমি চা খেলে না?
পারুল হেসে ফেলে, আমি এরকম বেলা বারোটায় চা খাই না।
আরে বাবা, এ করি না, এ খাই না, এসবের কোন মানে আছে? ইচ্ছে হলেই করবে!
তাহলে ধর ইচ্ছে হচ্ছে না।
সে আলাদা কথা। তবে না হয় আমাকেই আর এক কাপ দাও। আচ্ছা পিসি, ওকে একটু দিলে দোষ আছে?
ওকে? ও! মানে, চা? না না, এতো রোদের সময় জ্বরের ওপর–এই মাত্র ওষুধ খেয়েছে
তবে থাক। চা বলে মরে যায় কিনা! তাই একটু মন-কেমন করছে।
বলে অন্যমনাভাবে পেয়ালার ধারে চামচটা ঠুকঠুক করে ঠুকতে থাকে শম্পা।
ওর নামটা কি যেন বললি?
খেয়ে-দেয়ে ধাতস্থ হয়ে শম্পা মুখটা মুছতে মুছতে বলে, মানে মা-বাপের দেওয়া নাম সত্যবান, তবে আমি জাম্বুবান-টান বলি আর কি!
পারুল যেন মেয়েটার কথাবার্তায় ক্রমশই অধিকতর আকৃষ্ট হতে থাকে। আশ্চর্য তো, পারুলের সেই ছোড়দার মেয়ে এ! ছোড়দার চালচলন ধরণ-ধারণ সবই তো সনাতনী। সেই নাতনীর আবহাওয়া থেকে এমন একখানি বেহেড মেয়ে গজালো কী করে?
বললো, ভালই করো। তা হঠাৎ জাম্বুবানের গলায় মালা দেবার ইচ্ছে হলো যে?
ওই তোমরা বিধিলিপি না কি বল, তাই আর কি!
আমরা যে বিধিলিপিতে বিশ্বাসী, এটা তোকে কে বললো?
আরে বাবা, ও কি আর বলতে হয়? ও হতেই হয় সবাইকে, কোনো না কোনো সময়। এই আমাকেই দেখোনা, মানিও না কিছু আবার ওই হতভাগাটার জন্যে পুজোও মানত করে বসে আছি। এখন কী করে যে
পারুল হেসে বলে, আর আশ্চর্য কি, পিতৃপিতামহের রক্তধারা যাবে কোথায়? কিন্তু এই নিধিটিকে জোটালি কোথা থেকে?
ওমা! তুমি যে ঠিক পিসির মতো কথা বললে গো! হঠাৎ মনে হলো, পিসিই বুঝি কথা বলে উঠলো! গলার স্বরটাও তোমার পিসি-পিসি! যদিও দেখতে তুমি আরো অনেক সুন্দরী। তোমাদের বাবা বুড়ো খুব সুপুরুষ ছিল, তাই না?
ছিলেন। পারুল ঈষৎ গভীর সুরে বলে, মা-ও সুন্দর ছিলেন।
শম্পাও হঠাৎ গভীর সুরে বলে ওঠে, ভাবলে কিন্তু এক এক সময় ভারী আশ্চর্য লাগে। বাড়িটা সেই একই আছে, সেই ঘর দালান জানলা দরজা, অথচ মানুষগুলো বদলে যাচ্ছে, সংসারের রীতিনীতি বদলে যাচ্ছে, এক দল যাচ্ছে অন্য দল আসছে–
পারুল মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ, এক দল দেয়ালে মাথা ঠুকছে, আর পারের দল সেই দেয়াল ভাঙছে–
শম্পা একটু তাকিয়ে দেখে আবার বলে, তোমাদের দুই বোনে খুব মিল-কথায় চিন্তায়। কিন্তু বল তো, তোমার কি মনে হয় যারা ভাঙছে তারা ভুল করছে?
পারুল তেমনি মৃদু হেসে বলে, আমি বলার কে? কোনটা ভুল কোনটা ঠিক তার রায় দেবার মালিক শুধু ইতিহাস। শুধু এইটুকুই বলতে পারি, যা হচ্ছে তা অনিবার্য। ইতিহাসের নিয়ম। সেই নিয়ম রক্ষার্থে আমার বাবার নাতনী জাম্বুবানের গলায় মালা দেবে।…এখন আজ্ঞা ভঙ্গ হোক বাবা, যাই দেখি গে পিসি-ভাইঝিতে কি খেতে পারি। অবশ্য আমার রান্নাঘরে কোনো সমারোহের আশা কোরো না, নেহাৎ আলুসেদ্ধ ভাতেরই ব্যবস্থা। বড়জোর। খিচুড়ি।
ব্যস ব্যস, ওতেই চলবে। শম্পা বলে ওঠে, দূর দূর করে খেদিয়ে না দিয়ে বাড়িতে ঠাঁই দিয়েছ এই ঢের, আবার রাজভোগের বায়না করতে যাবো নাকি! আমার বেশী কথা-টথা আসে না তাই, নইলে তোমার উদ্দেশ্যে মহৎ-টহৎ বলে একটা প্রশস্তি গেয়ে দিতে পারতাম।
খুব বাঁচান যে বেশী কথাটথা আসে না, এখন যা দেখ গে তোর রুগীর কি হচ্ছে। এখন ঘুমোচ্ছে না ঘুম ভেঙেছে?
যাচ্ছি শম্পস সহসা গভীরভাবে বলে, ভেবে অবাক লাগছে, তোমায় না জেনে-চিনে এসে পড়লাম কী করে?
জানতিস চিনতিস না কে বললে?
জানতাম বলছো? ত হবে। হয়তো জানতাম, তাই সাহস হলো। হঠাৎ ওর এই জ্বরটরগুলো হয়েই–মানে কিছুদিন আগে একবার খুব শক্ত অসুখ করেছিল, বাঁচে কিনা। তা ভাল করে সারতে-না-সারতেই আবার খাটতে লেগে এইটি হলো। কুলিমজুরের কাজ তো! যাক, নিজের কথাই সাতকাহন করছি, তোমার কথা শুনি। তোমার ছেলে দু’জন তো অন্য জায়গায় থাকে, তোমার কাছে কে থাকে?
আমার কাছে? আমিই থাকি।
বাঃ চমৎকার! বেশ ভালই আছো মনে হচ্ছে। গঙ্গার ওপর বারান্দাবসানো এমন একখানি বাড়ি, শুধু নিজেকে নিয়ে আছো–
পারুল মৃদু হেসে বলে, শুধু নিজেকে নিয়ে থাকা তোর কাছে খুব আদর্শ জীবন বুঝি?
আমার কাছে? শম্পা হেসে ওঠে, আমি তো এটা ভাবতেই পারি না। আমার মনে হয়–কেউ আমায় ভালবাসছে না, কেউ আমার জন্যে হেদিয়ে মরছে না, কেউ আমার বিহনে পৃথিবী অন্ধকার দেখছে না, এমন জীবন অসহ্য। তবে তোমার কথা আলাদা-বয়েসটায়েস হয়ে গেছে!…আচ্ছা। যাই তাহলে নিচে!
পারুল বোধ করি শেষের বিদায়-প্রার্থনায় শুনতে পায় না, তাই আস্তে বলে, এতো কথা তুই শিখলি কোথা থেকে?
কি জানি! হয়তো নিজের থেকেই। তবে মা বলে নাকি পিসিই আমার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। পিসির দৃষ্টান্তই আমার পরকাল ঝরঝরে করে দিয়েছে! অথছ দেখো, মিলটিল কিছুই নেই। পিসি জীবনভোর শুধু বানানো প্রেমের গল্পই লিখলো, সত্যি প্রেমের ধার ধারলো না কখনো, আর আমি তো সেই আট বছর বয়স থেকেই প্রেমে পড়ে আসছি।
চমৎকার! তা সবগুলোই বোধ হয় “সত্যি” প্রেম?
তৎকালীন অবস্থায় তাই মনে হয় বটে, তবে কী জানো, ধোপে টেকে না। দু-দশদিন একটু ভালোবাসা-ফালোবাসা হলেই ছোঁড়ারা অমনি ধরে নেয় বিয়ে হবে। দু’চক্ষের বিষ। শুধু ভালোবাসাটা বুঝি বেশ একটা মজার জিনিস নয়।
পারুল ঈষৎ গম্ভীর গলায় বলে, তা মজার বটে। তবে কথা হচ্ছে এটিকেই বা তাহলে দু’চক্ষের বিষ দেখলি না কেন? বিয়ের প্রশ্ন তুলেই তো বাপের সঙ্গে ঝগড়া!
শম্পাও হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলে, এক্ষেত্রে ব্যাপার একটু আলাদা। এখানে ওই হতভাগাই বিয়ের বিপক্ষে। কেবলই বলে কিনা, সরে পড়ো বাবা, আমার দিক থেকে সরে পড়ো। তোমার বাবা কতো দামীটামী পাত্র ধরে এনে বিয়ে দিয়ে দেবে, আমি হতভাগা, চালচুলো নেই, চাকরির স্থিরতা নেই, বৌকে কী খাওয়াবো তার ঠিক নেই, আমার সঙ্গে দোস্তি করতে আসা কেন?…আমারও তাই রোখ চেপে গেছে
পারুল ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে বলে, এ বিয়েতে সুখী হতে পারবি?
শম্পা অম্লানবদনে বলে, হতে বাধা কী? সুখী হওয়া-টওয়া তো স্রেফ নিজের হাতে। তবে যদি হতভাগা মরে-ফরে যায় সে আলাদা কথা।
বালাই ষাট! পারুল বলে, তোর মুখে কি কিছুই আটকায় না বাছা?
পিসিও তাই বলে। শম্পা চলে যায় হাসতে হাসতে।
অভাবনীয় একটা বৃহৎ ভার ঘাড়ে পড়া সত্ত্বেও খুব একটা ভালো-লাগা ভালো-লাগা ভাব আসে পারুলের।