বিয়ে ও সংসার
পিতৃতন্ত্র নারীর জন্যে যে-পেশাটি রেখেছে, তা বিয়ে ও সংসার; এ-ই। পিতৃতন্ত্রের নির্ধারিত নারীর নিয়তি। এরই মাধ্যমে নারীকে বিস্তৃত জীবন থেকে সংকুচিত ক’রে, তার মনুষ্যত্ব ছেটে ফেলে, তাকে পরিণত করা হয় সম্ভাবনাশূন্য অবিকশিত প্রাণীতে। নারীকে দেয়া হয়েছে বিয়ে নামের অনিবাৰ্য স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন, যার মধ্য দিয়ে সে ঢোকে একটি পুরুষের সংসার বা পরিবারে; পালন করে পুরুষটির গৃহিণীর ভূমিকা, কিন্তু বন্দী থাকে দাসীত্বে। প্রথাগত স্ত্রীর ভূমিকা একটি প্রশংসিত পরিচারিকার ভূমিকা, যে তার প্রভুর সংসার দেখাশোনার সাথে কাম ও উত্তরাধিকার দিয়ে চরিতার্থ করে প্রভুর জীবন। বিয়ে ও সংসার নারীর সম্ভাবনার সমাপ্তি; অবশ্য পুরুষতন্ত্র বিশ্বাস করে না। নারীর কোনো সম্ভাবনায়ই, মনে করে দাসীত্বেই নারী লাভ করে পরিপূর্ণতা। এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২১৪) পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের প্রতিষ্ঠাকে বলেছেন “স্ত্রীজাতির এক বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়’; এর ফলে পুরুষ গৃহস্থলির কর্তৃত্বও দখল করল, স্ত্রীলোক হল পদানত, শৃংখলিত, পুরুষের লালসার দাসী, সন্তানসৃষ্টির যন্ত্র মাত্র। বিয়ে, তাঁর মতে, ‘মোটেই স্ত্রী ও পুরুষের সদ্ভাব সূত্রে দেখা দেয় নি, দেখা দেয় ‘নারী পুরুষের একজন কর্তৃক অপরের উপর আধিপত্য হিসাবে”; আর পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে স্ত্রী-ই হল প্রথম ঘরোয়া ঝি’। এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৯) দেখিয়েছেন ‘আধুনিক ব্যক্তিগত পরিবার স্ত্রীলোকের প্রকাশ্য অথবা গোপন গাৰ্হস্থ দাসত্বের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে… বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্ততপক্ষে বিত্তবান শ্রেণীগুলির মধ্যে পুরুষই হচ্ছে ৬পার্জনকারী, পরিবারের ভরণপোষণের কর্তা এবং এইজন্যই তার আধিপত্য দেখা দেয়, যার জন্য কোন বিশেষ আইনগত সুবিধা দরকার পড়ে না। পরিবারের মধ্যে সে হচ্ছে বুর্জোয়া; স্ত্রী হচ্ছে প্রলেতারিয়োত।’ প্রতিটি পরিবার গড়ে ওঠে একজন ব্ৰাহ্মণ ও একটি শূদীর সমবায়ে, যাতে পুরুষটি ব্ৰাহ্মণ নারীটি শূদ্রী। পুরুষই বিয়ে ও সংসারের কর্তা, সে-ই সংসারে সার্বভৌম, তার বিধানই সংসারে ধ্রুব ধর্মগ্রন্থ নারীটি ওই সংসারের পরিচারিকা। বাড়ির দাসীর সাখে বুর্জেয়া স্ত্রীটির পার্থক্য হচ্ছে দাসীটিকে (যৎসামান্য) বেতন দেয়া হয়, আর নারীটি (কখনো কখনো মর্যাদা ও বিলাসে) রক্ষিত হয়। রোজা লুক্সেমবার্গ তাঁর সময়ের বুর্জোয়া নারীদের বলেছিলেন ‘পরগাছার পরগাছা’, ম্যাককিনন (১৯৮২, ৮) প্রলেতারিয়েত নারীদের বলেছেন ‘ক্রীতদাসের ক্রীতদাসী; এবং মিল রয়েছে দু-শ্রেণীর নারীর মধ্যেই যে তারা একই রকমে শোষিত। রক্ষণশীল বঙ্কিমও ‘প্রাচীনা ও নবীনায় (১৮৮৭, ২৫১) বলেছেন, ‘পুরুষ প্ৰভু, স্ত্রী দাসী; স্ত্রী জল তুলে, রন্ধন করে, বাটনা বাটে, কুটনা কোটে। বরং বেতনভাগিনী দাসীর কিঞ্চিৎ স্বাধীনতা আছে, কিন্তু বনিতা দুহিতা স্বাসার তাহাও ছিল না।’ তবে তারা শুধু শোষক ও শোষিতই নয়, তাদের ভিন্নতা আরো বেশি; শোষকশোষিতরা হয় একই প্ৰজাতির, কিন্তু স্বামীেূীঘ ভাবগতভাবে বিধাতা ও ভক্তের পর্যায়ের; হিন্দুমতে পতি পরম গুরু; সে ‘স্বামী’, ‘পতি’, বা ‘ঈশ্বর’: মুসলমান মতে স্বামীর পায়ের নিচে বেহেস্ত, স্বামী প্রায় সেজদার উপযুক্ত; খ্রিস্টান মতে স্বামীই নারীর ঈশ্বর। মিল্টনের ইভ আদমের কাছে আত্মসমৰ্পণ ক’রে বলে। [উদ্ধৃত, ওলস্টোনক্র্যাফ্ট্ (১৭৯২, ১০১)] :
আমার প্রণেতা ও ব্যবস্থাপক, তুমি যা আদেশ কবো
প্রশ্নহীন আমি মান্য করি; এ-ই বিধাতার বিধি:
বিধাতা তোমার বিধি, তুমিই আমার : এর বেশি কিছু
না জানাই নারীর সবচেয়ে সুখকর জ্ঞান ও গুণ।
নারী আজো রয়ে গেছে বিবি হাওয়ার পর্যায়েই।
সমাজ বিয়ে ও সংসারের নামে নারীর জন্যে বিধিবদ্ধ করেছে। এ-ভবিতব্যই। বিয়ের জন্যে দরকার পুরুষ ও নারী দুজনকে; তবে বিয়েতে তাদের ভূমিকা সমান নয়; পুরুষ
নারী অক্রিয়; তার বিয়ে হয় অন্যদের দৌত্যে, বা প্রাকৃতিক ক্রিয়াকলাপের মতো। প্রতিটি পিতৃতন্ত্র বিয়ের যে-বিধান তৈরি করেছে, তা সম্পূর্ণ পুরুষের স্বার্থে প্রস্তুত, নারীর স্বাৰ্থ তাতে দেখা হয় নি; নারীকে ব্যক্তি হিশেবেই গণ্য করা হয় নি। হিন্দু বিধানে বিয়ে নারীরলি, মুসলমান বিধানে বিয়ে চুক্তিবদ্ধ দেহদান, খ্রিস্টান বিধানে বিয়ে নারীর অস্তিত্ব বাতিল। এ-সম্পর্কে আগেই, ‘পিতৃতন্ত্রের খড়গ’ পরিচ্ছেদে, বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। বিয়ে পুরুষ ও নারীর কাছে ভিন্ন ব্যাপার; বিয়ে দুটি অসম মানুষের স্থায়ী বা অস্থায়ী সম্পর্ক, ও চুক্তি, যাতে বাতিল হয়ে যায় নারীটির স্বায়ত্তশাসন। তবে বিধানের থেকে অনেক মানুষ উৎকৃষ্ট ব’লে সব সময় বিধানের পীড়ন সহ্য করতে হয় না। নারীকে, কিন্তু গোপনে সে মেনে নেয় নিজের ভাগ্য। পুরুষ স্বাধীন সম্পূর্ণ ব্যক্তি, সে উপার্জন করে, উপার্জনই তাকে প্রতিষ্ঠা করে ব্যক্তি হিশেবে: নারী করে গৃহস্থালি ও গর্ভধারণের কাজ, যা কখনো তাকে পুরুষের সমকক্ষ ক’রে তোলে না। মনু{৯:৩] যে বলেছেন, ‘নারীকে কুমারীকালে পিতা, যৌবনে স্বামী ও বার্ধক্যে পুত্ররা রক্ষা করবে, নারী কখনোই স্বাধীন থাকার যোগ্য নয়’, এটা সব পিতৃতন্ত্রেরই বিশ্বাস; নারীকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দিলে বিপন্ন হয়ে পড়ে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারসংস্থা। নারী কখনোই স্বায়ত্তশাসিত নয়; সে বিয়ের আগে বাপের বাড়িতে আশ্ৰিত থাকে, বিয়ের ফলে ঘটে তার প্রভুবদল; পিতার বদলে স্বামীটি হয় তার নতুন প্ৰভু। এক প্ৰভু ধর্মীয় বা সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে তাকে হস্তান্তরিত করে আরেক প্রভুর কাছে; এ-হস্তান্তরণ চুক্তি সাধারণত সম্পন্ন হয় দু-প্ৰভু, শ্বশুর ও জামাতার, মধ্যে। বিয়েতে নারী পাত্র নির্বাচন করে না, কিন্তু বিধান ও সামাজিক পরিস্থিতি অনুসারে তার পক্ষে অবিবাহিত থাকাও অসম্ভব, তাই বিয়ে তার জন্যে জীবিকার একমাত্র উপায়। বিয়ের মধ্য দিয়েই নারীর ব্যবস্থা হয় জীবনধারণের: তার অস্তিত্ত্বের যে কিছুটা মূল্য আছে নারী তা প্রমাণ করে বিয়ের মধ্য দিয়েই; বিয়ে ছাড়া তার অস্তিত্ত্বের কোনো মূল্য নেই, বিয়ে ছাড়া তার অস্তিত্ব পিতৃতন্ত্রের কাছে আপত্তিকর। তবে সমাজ যে চায় অবশ্যই বিবাহিত হ’তে হবে নারীকে, তা নারীর জন্যে নয়; তা সমাজ ও পুরুষের জন্যে।
সমাজ দু-কারণে চায় নারী বিয়ে বসবে, না বসে থাকতে পারবে না; হিন্দু পিতৃতন্ত্র এমন ব্যবস্থা করেছে যে নারীকে শেষ নিশ্বাসের পূর্ব-মুহূর্তে বা কোনো বস্তুর সাথে হ’লেও অবশ্যই বিয়ে বসতে হবে। নারীর বিয়ে না করা সমাজের সাথে আমাজনীয় বেয়াদবি, মারাত্মক সমাজদ্রোহিতা। বিয়ে নারীর জন্যে অবধারিত, এর প্রথম কারণ সমাজের জন্যে তাকে সন্তান, সম্ভব হ’লে পুরুষ, উৎপাদন করতে হবে, তাকে মা হ’তে হবে; মানুষ প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব পালন করতে হবে তাকে। তবে পুরুষতন্ত্র মনে করে মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার ভার পুরুষকেই দিয়েছে প্রকৃতি, নারীর কাজ শুধু অক্রিয় আধারের ভূমিকা পালন করা: নারী যদি আধারের ভূমিকা পালনে সম্মত না হয়, তাহলে পুরুষ, যেমন ফ্ৰযোড বলেছেন, নারীর সম্মতির অপেক্ষা না ক’রেই তার জরায়ুতে উৎপাদন করবে মানুষ। দ্বিতীয় কারণ তাকে পরিতৃপ্ত করতে হবে পুরুষের কাম, পরিচর্য করতে হবে পুরুষের সংসার। নারীর জন্যে বিয়ে পুরুষসেবা, যার বিনিময়ে পুরুষ তার ভরণপোষণ করে! যে-দুটি কারণে নারীকে বাধ্য করা হয় বিয়েতে, তাতে নারীকে মানবিক সমস্ত এলাকা থেকে তাড়িয়ে ঢোকানো হয়। জৈবিক এলাকায়, সেখানে তার একমাত্র কাজ প্ৰাণপোষণ ও লালন। নারী উৎপাদন করে পুরুষের উত্তরাধিকারী; তার ভূমিকাই যদিও প্রধান এতে, কিন্তু তা মুছে দেয়া হয়, সন্তান পরিচয় ধারণ করে শুধু পুরুষের। কামের পরিতৃপ্তি বিয্যের আশুউদ্দেশ্য; বিয়ের দিন কেউ মানবজাতির ভবিষ্যতের কথা ভাবে না, ভাবে যৌনসংসর্গের কথা; এবং ভাবে পুরুষটির দিক থেকে। নারীটি অনাঘাত কিনা, পুরুষটি কীভাবে নারীটিকে ভোগ করবে: ক’রে তৃপ্তি পাবে কিনা, নারীটি কতোখানি উপযুক্ত সম্ভোগের, এসবই সংগোপন বিবেচনার বিষয় হয়। সবার। এজন্যেই বিয়ের আগে মেয়ের দেহটিকে নানাভাবে আকর্ষণীয় ক’রে তোলা হয়; আর পুরুষটিকে সুখাদ্য খাইয়ে ক’রে তোলা হয় কামশক্তিমান। বিয়েতে পুরুষের কােমই প্রধান, নারীর কামের পরিতৃপ্তি বিয়ের উদ্দেশ্য নয়; পুরুষের কাম মেটাতে গিয়ে যদি নারীর কামও মেটে, তাহলে আপত্তি নেই, যদি না মেটে তাহলে তা আপত্তিকর। বিয়ের বাইরে নারীর কামের পরিতৃপ্তি নিষিদ্ধ। বহুবিবাহের সুবিধা ভোগ করে পুরুষ চিরকালই; হিন্দুধর্ম ও ইসলামে তা স্বীকৃতও; তাছাড়াও পুরুষ মিলিত হয় দাসীর সাথে, পুরুষ উপপত্নী রাখে, বেশ্যাসম্ভোগ করে; কিন্তু নারী একটি পুরুষ ছাড়া আর কোথাও কাম পরিতৃপ্ত করতে পারে না। কামনিষ্ঠতা পুরুষের কাছে প্রত্যাশা করা হয় না, কিন্তু নারীর জন্যে তা বিধিবদ্ধ; নারী ওই বিধান থেকে বিচ্যুত হ’লে পায় চরম শাস্তি।
বিয়ে স্বামীস্ত্রী উভয়েরই জন্যে একই সাথে ভার ও উপকারী, তবে দুজনের পরিস্থিতি ভিন্ন। পুরুষ বিয়ে না করলেও সমাজে গৃহীত হয়, সমাজে গৃহীত হওয়ার একমাত্র শর্তই পুরুষ হওয়া; কিন্তু নারী শুধু বিয়ের মধ্য দিয়েই গৃহীত হতে পারে সমাজে। বিয়ে তাকে একটি সংসার দেয়, যদিও সংসারটি তার নয়; সে পরিচিত হয়। পুরুষটির পরিচয়ে, অৰ্থাৎ পুরুষের সংস্পর্শে সে স্থান পায় সমাজে। বিয়ে না হ’লে তার জীবনই নষ্ট। তাই তাকে বিয়ে দেয়ার জন্যে ব্যগ্র থাকে পিতামাতা, তাতে তার মত আছে কিনা তাতে কেউ আগ্রহ বোধ করে না; সমাজ ধরেই নেয় বিয়ের জন্যে প্রস্তুত থাকাই নারীত্ব। প্রথাগত সমাজে তার জন্যে ঠিক করা হয় একটি স্বামী; অপ্ৰথাগত সমাজে তাকে সাধনা করতে হয় স্বামী ধরার। প্রথা-অপ্ৰথার মিশ্র সমাজে তার অবস্থা হয়ে ওঠে আরো জটিল, তাকে প্রস্তুত থাকতে হয় যে-কোনো পুরুষের জন্যে, আবার তাকে ফাঁদ পাততে হয় বিশেষ পুরুষের জন্যে, যেমন বাঙলাদেশে। তবে বিয়েতে সে অক্রিয়; সে বিয়ে করে না, বিয়ে বসে বা তাকে বিয়ে দেয়া হয়। পুরুষ বিয়ে করে অস্তিত্বসম্প্রসারণের জন্যে; বাল্যকাল থেকেই সে তার অস্তিত্বকে সম্প্রসারিত করতে থাকে, বিয়ে তার অস্তিত্বসম্প্রসারণ প্রক্রিয়ার একটি অংশ, তার অস্তিত্বের চূড়ান্ত সার্থকতা নয়। তার জীবন যেমন সক্রিয়তার, বিয়েতেও সে তেমনই সক্রিয়; বিয়ে তার প্রতিষ্ঠার ভিত্তিকে দৃঢ়তা দেয়। বিয়ে নারীকে কিছু অধিকার দেয়; বিয়ের মাধ্যমে সে পায় নিরাপত্তা, তবে সব নারী নিরাপত্তা পায় না, কিন্তু সে পরিণত হয় একটি পুরুষের অস্থাবর সম্পত্তিতে।
বিয়ের ফলে উদ্ভূত সংসার সংস্থাটির প্রধান হয় পুরুষটি; সে-ই হয় সমাজে পরিবার বা সংসারের প্রতিনিধি। একটি পরিবার সৃষ্টি একটি নতুন সামন্ত রাজ্য সৃষ্টির মতো; সেখানে অধিরাজ পুরুষটি, আর নারীটি ওই রাজ্যে লুপ্ত করে দেয় নিজের সত্তা। পশ্চিমে নারীটিকে গ্ৰহণ করতে হয়। পুরুষটির নাম, সে অন্তর্ভুক্ত হয়। পুরুষটির ধর্মে ও শ্রেণীতে; তার সমস্ত জীবন বদল করতে হয় একটি নতুন জীবনের সাথে। মূলত নারীর কোনো ধর্ম ও শ্রেণী নেই, সে যে-প্রভুর অধীনে যায় অন্তৰ্ভুক্ত হয় সে-প্রভুরই ধর্ম ও শ্রেণীতে। নাম বদল নারীকে নতুন শূদ্র পরিণত করে; হিন্দুধর্ম অনুসারে ব্ৰাহ্মণ দুবার জন্ম নেয়, কিন্তু নারীও জন্ম নেয় দুবার, দ্বিতীয় জন্ম ঘটে তার বিয়েতে;-শূদ্ররূপে। আমাদের দেশে নারীর নামই ছিলো এক সময় বাহুল্য, তাই স্বামীর নাম গ্ৰহণ করতে হতো না তাকে; তবে পশ্চিমের প্রভাবে এ-দেশেও বিত্তশালীদের মধ্যে প্রচলিত হয় পুরুষাধিপত্যের এ-রীতিটি। পুরুষতন্ত্র নারীকে কিছুতেই স্বাধীন, নিজের নামেও স্বাধীন থাকতে দেয় না; এর করুণ রূপ দেখা যায় বেগম রোকেয়ার নামে। বাঙলায় পুরুষতন্ত্রের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন যিনি, তার নামের সাথেও পুরুষতািন্ত্র স্বামীর নামটি যোগ করে তীকে ক’রে তুলেছে রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন! নারীর পক্ষে পুরুষাধিপত্য থেকে মুক্তি পাওয়া এতোই কঠিন। বিয়ের ফলে নারীটি যোগ দেয় পুরুষটির সংসারে, হয় পুরুষটির অর্ধাঙ্গিনী; সৃষ্টি হয় একটি পরিবার। এক সময় পুরুষটি স্ত্রীটিকেই বলতো নিজের পরিবার, তবে সে-ই পরিবারে সর্বময়। পুরুষটি যেখানে থাকে বা থাকতে বলে, সেখানে থাকে এবং যেভাবে চলতে বলে, সেভাবে চলে নারীটি। নারীটি ছিড়ে ফেলে তার প্রাক্তন জীবনের সাথে সম্পর্ক। নারীটি পুরুষটিকে দেয় দেহ, তার কুমারীত্ব, তাকে থাকতে হয়। পুরুষটির একান্ত অনুগত। পুরুষটির কাছে সে হয়ে ওঠে বিকশিত দেহের এক অবিকশিত বালিকা।
পুরুষটির রয়েছে আর্থনীতিক ভিত্তি, নারীটির নেই; পিতৃতন্ত্র সূচনাব কালেই নারীকে আর্থ ভিত্তি থেকে উৎখাত ক’রে পুরুষনির্ভরতাকে ক’রে তুলেছে তার ভবিতব্য। আর্থনীতিক ভিত্তি যার নেই, সে পৃথিবীতে দাঁড়াতে পারে না, তার কোনো মেরুদণ্ড নেই। নারী আর্থ মেরুদণ্ডহীন; তার রখনো দরকার ‘ভাতার”। স্বামীটি উপার্জন করে, সে গৃহে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে না; সে অংশ গ্ৰহণ করে সভ্যতায়। নারীটি দণ্ডিত হয় সন্তানপ্রসবের জৈবিক ও সংসারের ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্ত কাজে। নারী শুধু দেহ সৃষ্টি ও দেহ লালনের কাজে নিযুক্ত থাকে ব’লে দেহোত্তীর্ণ হতে পারে না; কিন্তু পুরুষটি দেহোত্তীর্ণ, সে শুধু সম্ভোগের সময়ই জড়িত হয় দেহের সাথে। পুরুষের জন্যে রয়েছে দু-ই : প্রকৃতি ও সংস্কৃতি; পুরুষ বিয়ের মধ্য দিয়ে তার দেহকে যেমন পরিতৃপ্ত করে, তেমনই গৃহের বাইরে গিয়ে অংশ নেয় দেহোন্তীর্ণ সভ্যতায়। সঙ্গম ও সন্তান সৃষ্টি কোনো মহৎ মানবিক কাজ কিনা, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে; তবে পিতৃতন্ত্র একে জরুরি মনে করলেও মহৎ মনে করে না। তাই নারীর কাজে কোনো মহত্ত্ব নেই, সে সভ্যতায় অংশ গ্রহণ করে না। যে-নারীরা সভ্যতায় অংশ নিয়েছে ও নেয়, পুরুষতন্ত্র তাদের মনে করে বিকৃত। অনেকেই মনে করেন। জৈবিকতাই যেহেতু নারীকে বন্দী ক’রে রেখেছে আদিম স্তরে, সন্তান ধারণই যেহেতু তার প্রধান সীমাবদ্ধতা, তাই নারীকে মুক্তির জন্যে সন্তান ধারণই অস্বীকার করতে হবে। পুরুষ তার পেশা ও সামাজিক কাজের মধ্য দিয়ে বিকশিত সম্প্রসারিত করে নিজেকে; যখন সে এসবে ক্লান্তি বোধ করে, তখন বিশ্রাম নেয় গৃহের মনোরমতায়। গৃহ পুরুষের জন্যে বিশ্রামকক্ষ, সে গৃহের নয়। বাঙালি কবি, কালিদাস রায়, বলেছেন, ‘গৃহই মোদের সব, প্ৰাণপণে করি তার আঁধার হরণ, /নিভে যদি কার ক্ষতি? গৃহের ক্ষতির আর হয় কি পূরণ। কিন্তু পুরুষ গৃহের অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করে গৃহের বাইরে থেকে, গৃহের ওই অন্ধকারে যে থাকে সে নারী। সে গৃহিণী, কুলবতী, কুলবালা, কুলস্ত্রী, কুলনারী, পুরনারী, পুরস্ত্রী; সে সভ্যতার কেউ নয়, সে গৃহের অন্ধকারের।
প্রসব, পালন, ও সংসাবের কাজে নিয়োজিত থেকে নারী প্ৰজাতির সংরক্ষণ করে, এবং নিজে থেকে যায় অপরিবর্তিত। এ-জন্যেই পুরুষতন্ত্র তৈরি করেছে চিরন্তন নারীপ্রকৃতি, চিরন্তনী, শাশ্বতী প্রভৃতি ছক। সে কোনো কিছুর ওপর প্রভাব বিস্তার করে না, সে ঘরের সীমার বাইরে গেলেও ঘর ও বাইরের মধ্যে তার সেতু হয়ে থাকে স্বামীটি। দেশের বিখ্যাত নারীটিরও পরিচয় স্বামীর স্ত্রী হিশেবে; পিতৃতন্ত্র যে-সব নারীকে স্বীকৃতি দেয়, তারাও স্বামীর পরিচয় দিয়েই বোধ করে গৌরব। বিয়ে আজো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রথাগত ব্যাপারগুলোর একটি, চলছে প্রথাগত রীতিতেই। বিয়ে চাপিয়ে দেয়া হয় নারীর ওপর, পুরুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয না; কেননা নারীর সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। বিয়ে না হ’লে সে হয়। পিতা, ভাই বা অন্য কারো গলগ্ৰহ দাসী; তার জীবনের একটি নির্দিষ্ট সময় কেটে যাওয়ার পর পিতার বাড়িই তার জন্যে সবচেয়ে অসুখকর, অবিবাহিত অবস্থায় পিতার বাড়িতে থাকা কলঙ্ক। সে অরক্ষণীয়া। বিয়ে তাকে একটি সংসার দেয়। তাই সে একটি স্বামী চায়, এমন একটি স্বামী খোঁজে, যার অবস্থান তার অনেক ওপরে। নারী যেহেতু যে-শ্রেণীতে থাকে অন্তর্ভুক্ত হয় সে-শ্রেণীরই, তাই নিজের শ্রেণীউন্নতির জন্যে চায় তার চেয়ে ওপরের শ্রেণীর স্বামী, সমোজও তাই চায়। পেশাজীবী নারীরাও বিয়ে বসে তাদের থেকে অনেক উঁচুপেশার পুরুষের সাথে; দরিদ্র পরিবারে স্বামীস্ত্রীটির মধ্যে আর্থভিত্তির যে-পার্থক্য থাকে, তার চেয়ে বেশি পার্থক্য থাকে সাধারণত পেশাজীবী স্বামীস্ট্রীর মধ্যে; তাই স্বামী থাকে। প্রথাগত স্বামী, স্ত্রী প্রথাগত স্ত্রী।
বিয়েতে নারীর কাম কিছুটা মেটে, তবে তার কাম নিজের জন্যে নয়; সে নিজের কাম দিয়ে সেবা করে পুরুষটির। সে দেহদান করে, পুরুষটি তাকে সম্ভোগ করে, বিনিময়ে তার ভরণপোষণ করে। নারীর দেহ সে একটি পণ্যরূপে কিনে নেয়, পণ্যটিকে নিজের সুবিধা মতো ব্যবহার করে; কিন্তু এটি পণ্য হিশেবে উৎকৃষ্ট। এটি যেমন অক্রিয়ভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, তেমনই সক্রিয় হ’তে পারে গ র কাজে : তার কাজ দেহদান, সন্তান ধারণ, প্রসব ও পালন, আর ঘরকন্না। এর জন্যে তাকে কোনো বিশেষ যোগ্যতা অর্জন করতে হয় না, কোনো বিশেষ কুঁকিও নিতে হয় না। তাই পেশা হিশেবে নারীর কাছে একে মনে হয় চমৎকার। তার সামনে অন্য কোনো পেশার দরোজা খোলা নেই, কোনো পেশাই তার জন্যে এতো সহজ সুবিধাজনক নয়। তাই পেশা হিশেবে নারীর জন্যে আজো বিয়েই শ্রেষ্ঠ পেশা! অপদাৰ্থ উচ্চ ও মধ্যবিত্ত নারীরা এর সুবিধা ভোগ করে চরমভাবে; তারা দেহদান ও প্রসবের জৈবিক ভূমিকা পালন ছাড়া আর কোনো ভূমিকাই পালন করে না। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত নারীদের জন্যে বিয়ে আকর্ষণীয় বৈধ পবিত্র পতিতাবৃত্তি; তাই তাদের নিজেদের বা অভিভাবকদের প্রধান উদ্বেগ একটি উৎকৃষ্ট খদের বা স্বামী সংগ্ৰহ করা। তারা দরকার হ’লে স্বামী কিনে নেয়। এরা সুবিধাজনক পেশার আলস্যে অপদাৰ্থ হয়ে উঠে এক সময় দেহদানের যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলে; তখন তাদের আমলা, লুঠতরাজ্যদক্ষ পতিরা খোঁজে। নতুন নারী। এরা বাস করে কারুকার্যখচিত আরামদায়ক কারাগারে, এবং কাজ করে নারীমুক্তির প্রতিপক্ষরুপে।
অবিবাহিত নারীর কামপরিতৃপ্তি পৃথিবীর অধিকাংশ জুড়ে নিষিদ্ধ; পশ্চিমের মুক্ত সমাজে তার পক্ষে কাম পরিতৃপ্ত করা আর অসম্ভব নয়, কিন্তু অত্যন্ত নিষিদ্ধ পূর্বাঞ্চলে। বিবাহিত নারীর বিবাহবহির্ভূত কামসম্পর্ক আইনগত অপরাধ, কিন্তু অবিবাহিত নারীর কামসম্পর্ক আরো মারাত্মক অপরাধ। কাম চাইলে নারীকে বিয়ে করতেই হবে। মাতৃত্বের জয়গান গাওয়া প্রতিটি পিতৃতন্ত্রের অভ্যাস, কিন্তু পিতৃতন্ত্র বিশুদ্ধ মাতৃত্বে বিশ্বাস করে না; বিশ্বাস করে বিবাহিত মাতৃত্বে। মাতৃত্ব বিবাহিত নারীর গৌরব, অবিবাহিত নারীর কলঙ্ক। তাই তরুণীর জীবনের লক্ষ্যই বিয়ে, কিন্তু বিয়ে কোনো তরুণের জীবনের লক্ষ্য নয়। তার লক্ষ্য আর্থনীতিক সাফল্য, বিয়ে তার জীবনের একটি কাজ। আজকের তরুণের চোখে বিয়ে আগের মতো মোহ সৃষ্টি করে না, এটা তার কাছে বোঝাই মনে হয়, কেননা বিয়ের উপকাবিতা আগের থেকে অনেক ক’মে গেছে। পশ্চিমে থাকা, খাওয়া, কামযাপন করা সম্ভব সংসার পাতার থেকে অনেক সহজে; পুবে বিয়ের বাইরে কামযাপন প্ৰায় অসম্ভব বলে আজো বিয়ের প্রতি তরুণদের আগ্রহ রয়েছে। বদ্ধ সমাজে বিয়েতে প্ররোচিত করে, মুক্ত সমাজে বিয়েতে অহীহ করে; বিয়ে মুক্তির নয়, বন্ধনের ব্যাপার। বাঙলায় একে “বিবাহবন্ধন’ই বলা হয়ে থাকে। বিয়ে জীবনকে কিছুটা চরিতাৰ্থ করে; বিয়ে নরনারীকে নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি দেয়, কামের পরিতৃপ্তি ঘটায়, সন্তান ও সংসার দেয়: নিরর্থক জীবনকে প্রথাগতভাবে অর্থপূর্ণ ক’রে তোলে। তবে পুরুষ যে বিয়ে খুব চায়, তা নয়; নারীই পুরুষের মধ্যে এ-চাওয়া সৃষ্টি করে। অধিকাংশ সমাজেই এখনো বিয়ে ঠিক করা হয়, তাতে উদ্যোগ নেয় পাত্রীপক্ষই বেশি, কেননা বিয়ে ছাড়া নারীর জীবনে কোনো সাফল্য নেই, কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সব দেশেই কনে দেখার রীতি প্ৰচলিত ছিলো; বাঙলাদেশে আজো আছে। গ্রামে মেয়েরা চরম লাঞ্ছনার মধ্যে আজো নিজেদের দেখায়. রূপ ও বিদ্যার পরীক্ষা দেয়; শহরেও কোনো নিউ মার্কেট, বিপনিবিতানে পিতামাতারা প্রদর্শন করে কন্যাদের। তাদের মাংস পছন্দ হ’লেই পুরুষেরা এগিয়ে আসে।
তরুণীরা বিয়ের প্রতীক্ষা করে, তবে ভয়ও পায়; কেননা বিয়েতে তাদের ঠেলে ফেলা হয় জীবনের পরিণতিতে, যার ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বিয়ে নারীটির জন্যে বেশি উপকারী পুরুষটির থেকে, বিয়ে ছাড়া তার আর কোনো পরিণতি নেই; তবে বিয়েতে ত্যাগ স্বীকার করতে হয় নারীকেই, পুরুষকে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে হয় না। নারীটিকে ছিড়ে ফেলতে হয় তার অতীতের সাথে সম্পর্ক, যো-জীবনের মধ্যে সে বেড়ে উঠেছে সেখান থেকে বিয়ে তাকে উপড়ে নিয়ে স্থাপন করে অন্য জীবনে, দিন দিন অচেনা হয়ে যায় তার পরিচিত মুখ আর দৃশ্যগুলো। তাই বিয়ে যতোই ঘনিয়ে আসে ততোই উদ্বিগ্ন বোধ করে তরুণীরা, ভবিষ্যৎ জীবনের চিন্তা যেমন তাদের বিপন্ন করে তেমনই দুৰ্বহ হয়ে ওঠে একটি পুরুষের কাছে আত্মদানের ভাবনা। তারা বোঝে এ-ই। তাদের জন্যে ভালো, এ-ই। তাদের জীবনের লক্ষ), এ-ই। তাদের জীবনসমস্যার শ্ৰেষ্ঠ সমাধান, তবু মনের তলে থাকে ভয়। বিয়ে তাদের জন্যে নিরুদ্দেশ যাত্রা; যদি ওই যাত্রার শেষে থাকে কোনো সব পেয়েছির দেশ, তাহলে চমৎকার, নইলে তা বিভীষিকা। পৃথিবীর অধিকাংশ মেয়ের জন্যে বিয়ে আনন্দ নয়, পরিত্রাণ; কিন্তু বিপর্যয়ের সম্ভাবনার কথাও তাদের বুকে জেগে থাকে। মুসলমান সমাজে বিয়ের কথা মনে এলেই তালাকের কথাও মনে আসে; এ-তালাক পশ্চিমের বিবাহবিচ্ছেদ নয়। পশ্চিমের নারী আজ অসহায় নয়, বিবাহবিচ্ছেদ তার জন্যে বিপর্যয় নয়, কিন্তু দরিদ্র সমাজে তা খড়গের মতো নারীটির মাথার ওপর ঝুলতে থাকে।
প্ৰেম এখন কিংবদন্তির মতো চারপাশে ছড়ানো, এটা এক আধুনিক পুরাণ; তবে প্রেম বিয়ের ভিত্তি নয়, এমনকি বিয়ের সিমেন্টও নয়। বিয়েতে চাওয়া হয় না যে নারীপুরুষ পরস্পরকে ভালোরাসবে প্রেমিকপ্রেমিকার মতো, এমনকি নারীটিকেও প্রেমের দায়িত্ব দেয়া হয় না; তার কাছে চাওয়া হয় সে পালন করবে। স্ত্রীর দায়িত্ব। প্রেম নয়, তার কাছে কাম চাওযা হয়; স্ত্রী হ’তে হ’লে তাকে এ-শর্তটি অবশ্যই পূরণ করতে হবে। তবে তাকে মানতে হবে যে বিয়ের বাইরে সে কোনো কামসম্পর্ক পাতবে না: পুরুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এটি, তবে তা মানা হয় না, কঠোরভাবে মানতে হয় শুধু নারীকেই। পুরুষ আজো একপতিপক্ষী বিয়ে মেনে নেয় নি, বিয়ের বাইরে পুরুষের কামপরিতৃপ্তির অজস্র রাস্তা খোলা রয়েছে। বিয়ে নারীর কামতৃপ্তির জন্যে নয়, তার কামদমনের জন্যে। নারীর কামতৃপ্তি বিবেচনার বিষয় বলে মনে করে না সংসারসংস্থাটি, মনে করে নারী ক্ষণিক সুখের বদলে বহন করবে। দীর্ঘ গৰ্ভ ও প্রসবের বেদনা। বাইবেলে স্পষ্টভাবেই উচ্চারণ করা হয়েছে অভিশাপটি : ‘আমি তোমার গর্ভবেদনা অতিশয় বৃদ্ধি করিব, তুমি বেদনাতে সন্তান প্রসব করিবে’! আদিপুস্তক, ৩:১৬]। পিতৃতান্ত্রিকেরা বিশ্বাস করে যে নারী মর্ষকামী, তার পীড়ন দরকার; পীড়নের মধ্য দিয়েই তার ভেতর জেগে ওঠে মাতৃত্ব। প্রসব নারীর কাছে সুখকর নয়, প্রসবে কোনো অসামান্য অপার্থিব অনুভূতি নেই; বিকল্প থাকলে নারী প্রসবের দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে নিতো নিজেকে। নারী ভোগ করে প্রসবের যন্ত্রণা, পুরুষের এসব নেই; পুরুষ চায় শয্যায় তার স্ত্রীটি হবে সমস্ত যৌনাবেদনময়ী অভিনেত্রীর সমষ্টি; তারা নারীকে চায় সব সময় সতী, কিন্তু শয্যায় বারাঙ্গনা। এ-বিরোধ কী ক’রে সে মেটাবে? যাকে বাল্যকাল থেকে শেখানো হয়েছে কাম খারাপ, সে কী ক’রে মেতে উঠবে শারীরিক প্রমোদে? মতেন বলেছেন, ‘আমরা একাধারে চাই স্বাস্থ্যুবতী, তীব্ৰ, গোলগাল, এবং সতী- অর্থাৎ গরম ও ঠাণ্ডা, দু-ই’ দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ৪৫৬)। এখন এ-অপপ্রত্যাশার শিকার পূর্বাঞ্চলের নারীরা, যেখানে পুরুষ পাশবিক।
মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিয়ের সময় কনেটিকে কুমারী থাকতো হতো না, বরং বিয়ের আগেই তার সতীত্বমোচন করতে হতো, না হ’লেই তা গণ্য হতো ত্রুটি ব’লে; কিন্তু পিতৃতন্ত্র তার রন্ধে আবিষ্কার করে একটি দামি চ্ছদ। বিয়েতে নারীটির দায়িত্ব চম ৎকারভাবে প্যাককরা অটুট চছদসমৃদ্ধ একটি যোনি স্বামীটিকে উপহার দেয়া দ্ৰ নারী, তার লিঙ্গ ও শরীর’]। এটা যে-কোনো তরুণীর মনে জাগায় ভয়, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার মুসলমান দেশগুলোতে আজো তা নববিবাহিত নারীর বিভীষিকা। পৃথিবীর নানা দেশে আজো বাসর রাতের ভোরে শয্যায় খোজা হয়। রক্ত। বাঙলাদেশে রক্ত খোজা বিভীষিকা হয়ে ওঠে নি কখনো, তবে আজো তা খোজা হয়, পুরুষটি ও তার আত্মীয়রা বিছানায় রক্ত পেলে সুখ বোধ করে। নারীর জন্যে বাসর রাত বলাৎকারের রাত; বাঙলাদেশ ধর্ষণের দেশ, তবু বিয়েতে যতো বলাৎকার সম্পন্ন হয় এখানে তার একাংশও সড়কে বা খেতের আলো হয় না। অধিকাংশ নারী পুলক বোধ না ক’রেই মা, দাদীনানী হয়; অনেকে কামবোধ না ক’রেই মেটায় স্বামীর কাম। যদিও নারীদের কাম অশেষ কিন্তু বিয়ের ফলে অনেকেই কামবোধ হারিয়ে ফেলে, কাম হয়ে ওঠে তাদের জন্যে পীড়ন।
য়ে ও সংসার নারীকে দেয় দুটি ভূমিকা : গৃহিণী ও জননী। প্রথাগতভাবে নারী এ-দুটি ভূমিকা সম্পন্ন করতে পারলেই নারীর জীবন সাৰ্থক বলে গণ্য করা হয়। নারীর এ-দুটি ভূমিকাকে খুবই আদর্শায়িত করেছে পিতৃতন্ত্র; সমস্ত ধর্ম সমাজ সংস্কৃতি নারীর এ-দুটি ভূমিকার স্তবগানে মুখর। তবে নারীর এ-ভূমিকা দুটিই নারীর মুক্তির প্রতিবন্ধক, সাম্যের বিরোধী। এ-ভূমিকা দুটিকে পেরিয়ে যেতে না পারলে নারী বন্দী হয়ে থাকবেই, তাকে থাকতেই হবে ঘরে ও আঁতুড় ঘরে। দুটি ভূমিকাই নারীকে পালন করতে হয় গৃহবন্দীত্বের মধ্যে মানবিক সমস্ত ক্রিয়াকলাপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে; এ-ভূমিকা দুটিই নারীকে বহিষ্কৃত করে সভ্যতা থেকে। প্রথাগতভাবে মনে করা হয় নারী বিয়ের পর স্ত্রী, ও মায়ের দায়িত্ব হাসিমুখে চমৎকারভাবে পালন করবে, কেননা এগুলোই তার জন্যে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক, যেনো নারীর জৈবনির্দেশের মধ্যে খচিত হয়ে আছে কীভাবে সন্তানকে দুধ খাওয়াতে হবে, কীভাবে ঢালতে হবে স্বামীর পা ধোয়ার পানি, কীভাবে ইন্ত্রি করতে হবে স্বামীর শার্ট, কীভাবে বসে থাকতে হবে শিশুবিদ্যালয়ের পাশের রাস্তায়- এসব নির্দেশা! প্রথাগতদের ঋষি বঙ্কিম (১৮৮৭, ২৫২-২৫৩) ‘নবীনা’র কয়েকটি ক্রটি ধরেছিলেন :
‘তাঁহাদের প্রথম দোষ আলস্য। প্রাচীনা অত্যন্ত শ্রমশালিনী এবং গৃহকর্মে সুপটু ছিলেন; নবীনা ঘোরতর বাবু;… গৃহকৰ্ম্মের ভার, প্রায় পরিচারিকার প্রতি সমৰ্পিত। ইহাতে অনেক অনিষ্ট জন্মিতেছে;-প্রথম শারীরিক পরিশ্রমের অল্পতায় যুবতীগণের শরীর বালশূন্য এবং রোগের আগার হইয়া উঠিতেছে।… স্ত্রীগণের আলস্যের আর একটি গুরুতর কুফল এই যে, সন্তান দুৰ্ব্বল এবং ক্ষীণজীবী হয়। শিশুদিগের নিত্য রোগ এবং অকালমৃত্যু অনেক সময়ই জননীর শ্রমে অনুরাগীশূন্যতার ফল।… নবীনগণ গৃহকৰ্ম্মে নিতান্ত অশিক্ষিতা এবং অপটু। …তিনি পশুজাতির অপেক্ষা কিঞ্চিৎ ভাল হইলে হইতে পারেন, কিন্তু তাঁহার স্ত্রীজন্ম নিরর্থক।… গৃহিণী গৃহকৰ্ম্ম না জানিলে রুগ্নগৃহিণীর গৃহের ন্যায় সকলই বিশৃঙ্খল হইয়া পড়ে; অর্থে উপকার হয় না;…
স্ত্রীলোকের প্রথম ধৰ্ম্ম পাতিব্ৰত্য।… নবীনাগণ পতিব্ৰতা বটে, কিন্তু যত লোকনিন্দাভিয়ে, তত ধৰ্ম্মভয়ে নহে। ….ধৰ্ম্মে যে নবীনাগণ প্রাচীন দিগের অপেক্ষা নিকৃষ্ট, তাহার একটি বিশেষ কারণ অসম্পূর্ণ শিক্ষা। লেখাপড়া বা অন্য প্রকারের শিক্ষা তাহারা যাহা কিঞ্চিৎ প্রাপ্ত হয়েনি, তাহাতেই বুঝিতে পাবেন যে, প্রাচীন ধর্মের শাসন অমূলক।‘
এ হচ্ছে প্রথাগতদের বিশ্বাসী; এর সবই সহজে বাতিল ক’রে দেয়া সম্ভব, কিন্তু আজো বাতিল হয় নি। নবীনাদের মূল দোষ শিক্ষা; অসম্পূর্ণ শিক্ষা; আর অল্পবিদ্যা সত্যই ভয়ঙ্করী, কেননা তা আরো শেখার আগ্রহ সৃষ্টি করে, এবং প্রথার অন্তঃসারশূন্যতা বুঝতে শেখায়। নারীর স্থান গৃহ, সে গৃহ সাজিয়েগুছিয়ে রাখবে, সংসার ঠিক মতো চলার জন্যে সব কিছু করবে, এ হচ্ছে প্রথাগত বিধান। যে-নারী এটা করে না সে অস্বাভাবিক, অনৈতিক, নারী নামের অযোগ্য। কিন্তু গৃহস্থলির কাজ শুধু নারীকেই কেনো করতে হবে, পুরুষও তা করতে পারে। পুরুষকে রেহাই দেয়া হয় এ-ক্লান্তিকর কাজ থেকে, যাতে পুরুষ অংশ নিতে পারে সভ্যতার কাজে-রাজনীতি, বিজ্ঞান, ব্যবসা, সাহিত্যে, এমনকি প্রমোদে। বঙ্কিমের যে-প্রবীণারা জল তুলতো, বাটনা বাটতো, তাদের স্বাস্থ্যের যে এতে উন্নতি ঘটতো এমন নয়; পুরুষও তাহলে নিতো স্বাস্থোন্নতির ওই এ-পদ্ধতি। এটা নারীপীড়ন, এবং পীড়ন আদর্শায়িতকরণ। বাইবেলের হিতোপদেশ ‘গুণবতী ভাৰ্যার বর্ণনায় বলেছে যে “তিনি রাত্ৰি থাকিতে উঠেন, আর নিজ পরিজনন্দিগকে খাদ্য দেন, ‘তিনি বলে কটি বন্ধন করেন, আপনি বাহুযুগল বলশালী করেন, ‘রাত্ৰিতে তাহার দীপ নিৰ্ব্বাণ হয় না’ এবং তিনি আলস্যের খাদ্য খান না”: অর্থাৎ গুণবতী গৃহিণী এক সার্বক্ষণিক দাসী। সবাই বাইবেলে বিশ্বাস করে না, কিন্তু বিশ্বাস করে। এ-বাণীতে। সংসারের কাজগুলো চাপিয়ে দেয়া হয় নারীর ওপর, ক্লান্তিকর বিরক্তিকর কাজগুলো সম্পন্ন করাই তার জন্যে ধর্ম, এসব কাজ যার জীবনে পুনরাবৃত্ত হয়, তার কোনো সম্ভাবনার বিকাশ ঘটতে পারে না।
সামন্ত ও বুর্জোয়া দু-সমাজই গৃহিণীপনাকে এক মহৎ ভাবাদর্শে পরিণত করেছে, গৃহ ও গৃহিণীর স্তুতি করেছে ও করছে, যদিও উত্তম গৃহিণী উত্তম পরিচারিকা মাত্র। অম্বুজাসুন্দরী নামের এক নারী কবি লিখেছিলেন [দ্ৰ যোগেন্দ্ৰনাথ (১৩৬০, ৩৩৭)];
বড় ভালবাসি আমি বঙ্গ-কুল-নারী,
ধাবিত নম্রতা মাখা, ঘোমটায় মুখ ঢাকা
রয়েছে উনন-ধাবে চিরকাল ধবি,
বড় ভালবাসি আমি বঙ্গ-কুল-নারী।
নয়নে কজলা-দাগা, অধরে তাম্বুল-বাগ
ললাটে সিন্দুর-বিন্দু লক্ষ্মীর আসন,…
বুক-ভরা স্নেহ-ধারা, পতি-প্ৰেমে মাতোয়ারা
স্থির সবসীর ন্যায় গম্ভীর সুস্থিব।
এর কাব্যটুকুর মূল্য নেই; সেটুকু বাদ দিলে সত্য যা থাকে, তা হচ্ছে “রয়েছে উনন-ধারে চিরকাল ধরি।’ গৃহ তার স্থান, তবে গৃহসুখ তার জন্যে নয়; তার কাজ গৃহকে পুরুষদের জন্যে সুখকর করে তোলা। গৃহে তার সমস্ত কাজ পুরুষদের লক্ষ্য ক’রে, গৃহ তার দ্বিতীয় দেহ; পুরুষের জন্যে যেমন তাকে আকর্ষণীয় করতে হয় দেহখানি তেমনই আকৰ্ষণীয় করতে হয় গৃহখানিকে। সামন্ত সমাজে নারীর স্থানই গৃহ, তাই নারীকে দেয়া হযেছে গৃহের সমস্ত ক্লান্তিকর কাজ। ওই কাজগুলো সে যেখানে করতো সে-এলাকাটি হতো গৃহের নিকৃষ্টতম অংশ; গৃহের নিকৃষ্ট অংশে জীবনের নিকৃষ্ট কাজগুলো গৃহিণীকে সম্পন্ন করতে হতো পুরুষের সম্পূর্ণ পরিতৃপ্তি ঘটিয়ে। দরিদ্র নারীদের গৃহ নেই, তবে কাজের অভাব নেই। আধুনিক বুর্জোয়ারা ব্যবসার স্বার্থে সৃষ্টি করেছে পালে পালে গৃহিণী, গৃহিণী সৃষ্টিতে তাদের গবেষণা ও প্রচারের শেষ নেই; তারা আপ্রাণ চেষ্টা ক’রে চলছে পুরোনো গৃহিণীকে আধুনিক সময়ে প্রতিষ্ঠিত করতে। একটি আদর্শ গৃহিণী সৃষ্টির অর্থ হচ্ছে একরাশ পণ্য বিক্রয়ের নিশ্চিত সম্ভাবনা সৃষ্টি; এবং প্রগতিশীলতা প্রতিরোধ।
গৃহিণী এমন নারী, যে নিজের সমস্ত সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান ক’রে ঢেকে আরামদায়ক বন্দীশিবিরে; সে পণ্য উৎপাদনকারীদের মানসসুন্দরী, যাকে লক্ষ্য ক’রে পৃথিবীর দিকে দিকে ঘুরছে পুঁজিবাদী কারখানাগুলোর চাকা। আদর্শ গৃহিণীর কাজ হচ্ছে পুঁজিবাদী পণ্যে নিজের গৃহ ভরে তোলা। ধনী বিশ্বে আদর্শ গৃহিণীদের গন্তব্য বিপনকেন্দ্র; গরিব বিশ্বে ধনী গৃহিণীদের গন্তব্য বিপনিকেন্দ্র। তাদের স্বামীদের পবিত্র গৃহ ব্যাংক, আর স্থল মস্তিষ্কহীন আদর্শ গৃহিণীদের পবিত্র এলাকা বিপনিকেন্দ্র। ধনী বিশ্বে গৃহিণীদের গৃহের কাজ করতে হয়; কিন্তু গরিব বিশ্বে দাসদাসী এতোই সুলভ যে ধনী গৃহিণীদের সাংসারিক কাজও করতে হয় না, তবে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র নারীরা ব্যগ্র থাকে নিপুণভাবে গৃহিণীর দায়িত্ব পালন করতে। গরিব বিশ্বে শোষণ সহজ, তাই ধনী গৃহগুলাতে উৎপন্ন হয় একপাল অপদাৰ্থ নারী, যারা দেহসম্ভোগ ছাড়া আর কোনো স্বপ্ন দেখে না। তারা জীবনকে বাতিল ক’রে দিয়ে মনে করে জীবন উপভোগ করছে। গৃহিণীর কাজ এমন কাজ, যা পেশা, আবার পেশা নয়। গৃহিণী হওয়ার জন্যে প্রশিক্ষণ নিতে হয় না, মনে করা হয় যে প্রতিটি নারীর মধ্যেই রয়েছে একেকটি অনন্যসাধারণ গৃহিণী, যে জেগে ওঠে সংসারে ঢুকেই। গৃহিণীর কাজ হচ্ছে পুনরাবৃত্তির পর পুনরাবৃত্তি; আদর্শ গৃহিণী একই কাজ ফিরে ফিরে করে, প্রতিদিন করে, কাজ করতে করতেও তার কাজের শেষ হয় না, তার কোনো অবসর নেই। তার জীবন হচ্ছে রান্না, ধোয়ামোছা, কাপড় ধোয়া, ইন্ত্রি করা, রান্না, ধােয়ামোছা, কাপড় ধােয়া, ইন্ত্রি করা, রান্না। গৃহিণীর কাজকে ‘পেশা’ বলা পশ্চিমি সুভাষণ; এটি তৈরি করা হয়েছে গৃহিণীর নিরর্থক কাজকে অর্থপূর্ণ ক’রে তোলার জন্যে। যে-কোনো পেশায় রয়েছে বিশেষ অধিকার ও দাযিত্ব, গৃহিণীর কাজে তা নেই, তার বেতন নেই, কাজের নির্দিষ্ট সময় নেই, অনেককে ব্যস্ত থাকতে হয়। সারাক্ষণ অনেককে করতে হয় না কিছুই। কোনো পেশায় না থাকাই হচ্ছে গৃহিণীর পেশায় থাকা; বিবাহিত যে-নারী আর কিছু নয়, যে কোনো আৰ্থযোগ্যতা অর্জন করে নি, সে-ই গৃহিণী। তার কাজকে মর্যাদা দিলে আছে, না দিলে নেই; এমন মহৎ কাজে জড়িত গৃহিণী।
চল্লিশের দশক থেকে পশ্চিমে পুঁজিবাদ আবার বিয়ে, সংসার, গৃহিণীকে গৌরবান্বিত করার সর্বগ্রাসী অভিযানে নামে; তার লক্ষ্য পণ্য বিক্রয়, সে জানে গৃহিণী হচ্ছে আদর্শ ক্ৰেতা; তাই নারীকে আবার আদর্শ নারী, খাঁটি গৃহিণী, বিশুদ্ধ মাতা ক’রে তোলার ধর্মযুদ্ধ শুরু করে পুঁজিবাদ। যে-নারী কোনো পেশায় জড়িত, যে নিজে চিন্তা করে, যে ব্যক্তিগত সাফল্যের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, বিয়ে সংসার পণ্য তার কাছে গৌণ; কিন্তু যে-নারী কোনো বাইরের জগত নেই, তার থাকে বিয়ে, গৃহ, পণ্য, কাম। পুঁজিবাদী মাধ্যমগুলো নিরন্তর প্রচার চালাতে থাকে যে পেশা নারীকে অসুখী করে, পেশা নারীর নারীত্ব নষ্ট করে; নারীর জীবন চরিতার্থ হয় বিয়ে, সংসার, কাম, আর পণ্যে। তারা তরুণীদের মনে ভয় ঢুকিযে দেয জ্ঞান আর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে, তাদের মনে এমন ধারণা সৃষ্টি করে যে বিশ্বে কী হচ্ছে তা নিয়ে ঘর্মািক্ত থাকা পুরুষের কাজ; নারীদের কাজ পড়াশুনো চুকিয়ে দিয়ে সতেরো আঠারো বছর বয়সে বিয়ে ও ঘরসংসার এবং মাতৃত্ব ও পণ্যস্তুপে জীবন চরিতার্থ করা। পুঁজিবাদী কারখানাগুলো উৎপাদন করতে থাকে পণ্য, আর প্রচার মাধ্যমগুলো উৎপাদন করতে থাকে খাঁটি গৃহিণী, যারা তরুণী, অগভীর, রূপসী, অক্রিয়; শয্যাকক্ষ, রান্নাঘর, কাম, শিশু, গৃহ যাদের জগত। এদের বার বার শোনানো হয় খাদ্য, পোশাক, রূপচর্চা, আসবাবপত্র ও কামের কথা; তাদের জীবনে নিষিদ্ধ হয়ে যায় জ্ঞান, রাজনীতি, চেতনা, যা কিছু মানবিক। তাদের দীক্ষিত কিবা হয় এ-ধর্মে যে নারীর বাইরে জগতে প্রতিষ্ঠা লাভের বাসনা বিকৃতি, তাদের জন্যে পুণ্য হচ্ছে অক্রিয় কাম, পুরুষাধিপত্য ও বিয়োনোর মধ্যে জীবনকে পূর্ণ করা। তাদের শেখানো হয় যে নারীকে হতে হবে “গৃহিণী’; এবং তাদের অহমিকাকে তৃপ্ত করার জন্যে বলা হয় তাদের ‘পেশা : গৃহিণী”। তাদের কাজ রান্না, ঘর ঝাঁটা, মায়া, কাপড় ধোয়া, ইন্ত্রি করা, রান্না। চিন্তাজগতের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই তাদের; তারা বই পড়ে না, পড়ে বিনোদনমূলক পত্রিকা, যেগুলোতে থাকে রান্না, রূপচর্চা, গৃহসজ্জার কথা; যেগুলোতে থাকে না কোনো পেশাজীবী নারীর কথা, একমাত্র ‘পেশাজীবী’ যে-নারী এগুলোতে ফিরে ফিরে স্থান পায়, সে অভিনেত্রী;–পুরুষের প্রধান সম্ভোগ্যপণ্য ও নারীমুক্তির এক বড়ো প্রতিপক্ষ। গৃহিণীর কাজ পশ্চিমে খুব কমে গেছে, গৃহে এতো কাজে নেই যে সে কাজে ব্যস্ত রাখবে নিজেকে। হাতে কাজে নেই, অথচ সময়ের অভাব নেই, এমন গৃহিণী কী করতে পারে? সে পারে নিরর্থক কাজকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে। পার্কিন্সনের একটি সূত্র বদলে ফ্রাইডান (১৯৬৩, ২০৫-২২৫) নতুন সূত্র তৈরি করেছেন যে “গিন্নিপনা ফেপে সবটুকু সময়কে ভরে রাখে”; অৰ্থাৎ খাঁটি গৃহিণীর হাতে কাজ না থাকলে সে চালডাল মিশিয়ে বাছতে বসে! পেশাজীবী নারী যে-কাজ করবে আধা ঘন্টায়, আদর্শ গৃহিণী করবে। চার ঘন্টায়, তার কাজে নেই। কিন্তু সময় অনেক। আদর্শ গৃহিণী এক শোচনীয় অপচয়।
গৃহিণীর মহত্তম কাজ প্রসব করা, মা হওয়া। পুরোনো কাল থেকেই সবচেয়ে আদর্শায়িত ভূমিকাগুলোর একটি মা; পিতৃতন্ত্র মায়ের জয়গানে অনেক শ্লোক রচনা করেছে। এর মূল কারণ নারীর মর্ষকামিতার চূড়ান্ত রূপ মা; মা এমন নারী, যার জীবন অপাের দুঃখের। মা ভাবমূর্তির মধ্যে গৌরবায়িত করা হয়েছে অশেষ যন্ত্রণা সহ্য করার শক্তিকে, মা দুঃখের নারীমূর্তি। মা সভ্যতার শ্রেষ্ঠ শহীদ। কিন্তু নারীকে কি চিরকাল বেছে নিতে হবে অপার দুঃখকেই, নারী কি যন্ত্রণা ভোগ ক’রেই পাবে মহিমা, শহীদ হওয়াই হবে নারীর নিয়তি আদি নারীবাদীরা নারীর মা ভূমিকাটিকে প্রত্যাখ্যান করেন নি, তবে আক্রমণ করেছিলেন; শার্লোিট পার্কিন্স গিলম্যান (১৮৯৮) পরিহাস ক’রে বলেছিলেন যে অন্য কোনো গ্রহের কোনো সমাজবিজ্ঞানী এসে যদি শোনেন মানবপ্রজাতির কল্যাণের জন্যে মায়ের ত্যাগাস্বীকারের” কথা, তবে তিনি অত্যন্ত অভিভূত ও মুগ্ধ হবেন। ‘কী চমৎকার’ বলবেন তিনি। কী পরম করুণ ও কোমল! মানবজাতির অর্ধেক সমস্ত মানবিক উৎসাহ ও কাজ ফেলে তাদের সমস্ত সময়, শক্তি ও নিষ্ঠা নিয়োগ করছে মাতৃত্বে! সে-মহান জাতিকে লালন ও পালন করার জন্যে যাতে সে ভালোভাবে অন্তর্ভুক্তও নয়! কী মহান অসামান্য শহীদত্বরণ দ্র। উইলিয়মস্ (১৯৭৭, ২৯৬)]! প্রথাগতভাবে নারীদের সারা বছর ধ’রে গর্ভবতী ক’রে রাখাই ছিলো পুরুষের কৃতিত্ব, আর নারীদের গৌরব ছিলো জরায়ুর উর্বরতায়; কিন্তু আধুনিক কালেও যখন পরিবার পরিকল্পনা হয়ে উঠেছে মহাজাগতিক শ্লোগান, তখনও পুঁজিবাদ নারীদের শেখাচ্ছে মাতৃত্বেই নায়ীর পূর্ণতা: কেননা তা প্রকাশ করে নারীদের মৌল আদিমতা। ফ্রাইডান (১৯৬৩, ২৯৫) পেশ করেছেন এক গৃহিণী মায়ের স্বপ্লভঙ্গের তাৎপৰ্যপূর্ণ স্বীকারোক্তি :
‘আমি স্ত্রী ও মায়ের সুন্দর ভাবমূর্তিটি রক্ষা করার জন্যে খুব পরিশ্রম করতাম। আমি আমার সব সন্তান প্রসব করেছি। স্বাভাবিকভাবে। আমি তাদের বুকের দুধ দিয়েছি। একবার এক পার্টিতে এক বৃদ্ধায় কথায় আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম, যখন আমি তাঁকে বলি যে সস্তান প্রসবই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, আদিম পাশবিক কাজ, এবং তিনি আমাকে বলেন, ‘তুমি কি পশুর চেয়ে বেশি কিছু হ’তে চাও না?’
স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব, তাকে বুকের দুধ খাওয়ানো, ঘন ঘন তার কথা বদলানো, তার বিদ্যালয়ের পাশের রাস্তায় বসে থাকাতে নারীর মুক্তি নেই। মার্কিন গৃহিণীরা এক দিন দেখতে পায় গৃহ, কাম, সন্তান, স্বামী, আসবাবপত্র তাদের আটকে ফেলেছে; বাতিল হয়ে গেছে তাদের সত্তা। তাকে ধরেছে এক নতুন রোগে, যার নাম “গৃহিণীর ক্লান্তি’, যে-ধারাবাহিক পুলকের জন্যে সে পাগল ছিলো, সে পুলকও দুর্লভ হয়ে উঠেছে, স্বামীও চ’লে গেছে। অন্য তরুণীর শয্যায়; তাকে গ্ৰাস করেছে এমন এক সমস্যা যার কোনো নাম নেই। বিয়ে, কাম, সংসার, মাতৃত্বে মুক্তি নেই নারীর। মানুষ মুক্তি পেতে পারে শুধু মানুষ হয়ে।
বাঙলাদেশে বিয়ে ও সংসার নারীর অনিবাৰ্য তীর্থ গরিব নারীদের জন্যে তা অবধারিত উৎপীড়নের লীলাক্ষেত্র, মধ্য ও উচ্চবিত্ত নারীদের জন্যে সুখকর বন্দীশিবির। বিয়ে ও সংসার এখন বিশেষ পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে শিক্ষিত তরুণীদের জন্যে; তাদের শিক্ষা সমস্ত লক্ষ্য ও তাৎপর্য হারিয়ে নিরর্থক হয়ে উঠছে। বিয়ে ও সংসার তাদেরও জীবনের প্রধান, একমাত্র, লক্ষ্য; বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া নিরর্থক অপব্যয়। বিয়ে এখানে তরুণীদের অত্যন্ত দরকার, সমাজ তাদের দেয় না অবিবাহিত কামের অধিকার, এবং জীবিকার কোনো নিশ্চয়তা। কিন্তু বিয়ে ও সংসারই জীবনের লক্ষ্য হয়ে বাতিল ক’রে দিচ্ছে জীবনকে। প্রথম উচ্চশিক্ষিত বাঙালি তরুণীদের অনেকেই বিয়ে করেন নি; চিকিৎসক বিধুমুখী, যামিনী, আর রাধারানী, সুরবালা, হেমপ্ৰভা, লজ্জাবতী বিয়ে করেন নি; বা অনেকে বিয়ে করেছিলেন বেশি বয়সে- চন্দ্ৰমুখী বসু, ভার্জিনিয়া মেরি মিত্র, কামিনী রায়, সরলা, কুমুদিনী বিয়ে করেন। তিরিশ পেরোনোর পর; এবং যারা বিয়ে করেছিলেন, তাদের কারো কারো জীবনে শিক্ষা ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিলো। প্রথম দিকের স্নাতক কামিনী রায় বিয়ের আগে কবিতা লিখেছিলেন, বিয়ের পর বিয়ের সুখে এতো পাগল হয়ে যান যে আর কবিতা লেখেন নি; আবার লেখেন যখন স্বামীর মৃত্যুতে মুক্তি পান সংসারের সুখ থেকে। আজো যে তাকে স্মরণ করি, তা ওই সুখের বিয়ের জন্যে নয়; কয়েকটি পদ্যের জন্যে। ষাটের দশকেও বাঙলাদেশের শিক্ষিত তরুণীরা বিয়ে ও সংসারের বাইরের স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করতো, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলতা এখন এতো প্রবল যে তরুণীদের অন্যান্য স্বপ্ন সম্পূর্ণ নষ্ট করে বিয়েকেই ক’রে তোলা হয়েছে একমাত্র দুঃস্বপ্ন। প্রগতিশীলেরাও আজ কন্যাদের সতেরো বছর বয়সে স্বামীর সংসারে পাঠিয়ে জীবন সার্থক করেন। দুর্বর পশ্চাৎমুখিতার ফলে তরুণীদের জন্যে উচ্চশিক্ষা তাদের সমস্যার সমাধান না হয়ে রূপ নিচ্ছে সংকটের; যদি তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে না। ঢুকতো, তাহলে ষোলোসতেরো বছর বয়সে কারো সংসারে ঢুকে জরায়ুর সাফল্য অর্জন করতে পারতো, কিন্তু এখন উচ্চশিক্ষা তাদের জন্যে কোনো পেশার ব্যবস্থাও করে না, এবং বিয়ের সম্ভাবনাও নষ্ট করে। আজকের প্রতিক্রিয়াশীল তরুণেরা তাদের পিতামহদের মতো আবার উন্মাদ হয়ে উঠেছে কিশোরীসম্ভোগের জন্যে; তারা চিকিৎসক প্রকৌশলী আমলা হয়ে ব্যগ্রতা বোধ করছে। দশম শ্রেণীর বালিকার দেহ ভোগের জন্যে। তারা শিক্ষাকে ভয় পায়, শিক্ষিত নারীকে ভয় পায়, তারা তৃপ্তি বোধ করে নির্বোধ বালিকায়।
বিয়ে, একপতিপত্নী বিয়ে, সংসার ও মাতৃত্ব সম্প্রতি নারীবাদীদের তীব্র আক্রমণেব বিষয় হয়েছে; কারণ প্রধানত। এরই মাধ্যমে পীড়ন করা হয় নারীদের, বাতিল ক’রে দেয়া হয় তাদের সত্তা। নষ্ট ক’রে দেয়া হয় তাদের সম্ভাবনা, তাদের মেধা ও প্রতিভা। আমি কতিপয় নারীকে জানি, যারা ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ও চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় থেকে, কিন্তু এখন তাদের কোনো পার্থক্য নেই মাধ্যমিক পাশ গৃহিণীর সাথে; সংসার তাদের মেধা গ্ৰাস করেছে। একজন জানিয়েছেন তাঁর অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে উঠেছে যে তিনি বই পড়ে বুঝতে পারেন। না, ভালো সাময়িকীও পড়তে পারেন না, পড়তে পারেন। শুধু রম্যপত্রিকার কেলেঙ্কারি, যদিও ছাত্রজীবনে তিনি লিখতেন। চমৎকার প্রবন্ধ। বিয়ে সংসার নারীদের কী ক’রে তোলে বোঝা যায় তাদের দিকে তাকালে। বিয়ে সংসাব কি আজো জীবনের প্রার্থিত লক্ষ্য হওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমে বিয়েসংসার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে, বাঙলাদেশেও আর বিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব’লে বিবেচিত হওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিয়ে কি সামঞ্জস্যপূর্ণ স্বাধীনতা ও সাম্যের সাথে? বিয়ে এখনো নারীটিকে অধীন ক’রে তোলে পুরুষটির, পুরুষটি নারীটির থেকে কম যোগ্যতাসম্পন্ন হ’লেও। বিয়েতে স্বামী স্ত্রীর যে-প্রথাগত ভূমিকা রয়েছে, তারও বদল ঘটা দরকার; স্ত্রীকেই যে দেখতে হবে সংসার, একে আর অবধারিত মনে করার কারণ নেই। দরিদ্র দেশগুলোতে নারীদের অবস্থা শোচনীয়, শুধু প্ৰগতিশীলতা তাদের উদ্ধার করতে পারে ওই শোচনীয়তা থেকে। নারীর জন্যে প্রগতিশীলতা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, প্রতিক্রিয়াশীলতা নারীর চিরশত্ৰু। পশ্চিমে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের, যাতে স্বামী কুলপতি স্ত্রী দাসী ও আর্থনীতিকভাবে নির্ভরশীল, তার মৃত্যুর সম্ভাবনা। নারীর শিক্ষা, কাম, ও আর্থনীতিক স্বাধীনতা, যাকে বলা হয় “ইএসই ফ্যাক্টর’, বদলে দিচ্ছে বিয়ে ও সংসারের চরিত্র। প্রথাগত বদ্ধ বিয়ের বদলে দেখা দিচ্ছে উন্মুক্ত বিয়ে, বহুজনীয় বিয়ে, একত্ৰবাস: এবং বদলে যাচ্ছে পবিবার সংস্থা। } প্রথাগত বিয়ে একদিন এখানেও হয়ে উঠবে অতীতের ব্যাপার।