রাণুকে আর তার পিত্রালয়ের গণ্ডির মধ্যে ধরে রাখা যাচ্ছে না। যদিও তার দিদিদের এখনও বিয়ে হয়নি, কিন্তু রাণুর বিয়ে আর না দিলেই নয়। সে প্রায় অরক্ষণীয়া হয়ে উঠেছে।
সেই বিসর্জন নাটকের অভিনয়ের পর থেকেই তার প্রতি বহু পাত্রের পিতামাতাদের নজর পড়ে। পাত্রেরা নিজেরাও কম নজর দেয় না।
এখন রাণুর একা একা চলাফেরা তো নিরাপদ নয় বটেই, কারুর সঙ্গে বেরোলেও মধুলোভী পিঁপড়ের মতো অত্যুৎসাহী যুবকেরা তাকে ঘিরে ধরে।
কবিকেও এখন এই উপদ্রব সহ্য করতে হয়।
তিনি প্রায়শই রাণুকে সঙ্গে নিয়ে কোনও থিয়েটার দেখতে বা সভা-সমিতিতে যান, সেখানে কেউ কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলতে এসে আর জায়গা ছাড়ে না, তাদের আধখানা দৃষ্টি কবির দিকে, আর দেড়খানা চোখ রাণুর প্রতি।
কোনও সভাস্থলে কিংবা রঙ্গালয়ে রাণুকে দেখলেই যেন একটা চাপা ফিসফিসানি শোনা যায়, কে এই মেয়েটি? কে এই বিদ্যুৎবরণী?
কে এই সুকেশিনী, মঞ্জুভাষিণী?
রাণুর বাবা ও মা কবিকে জানিয়েছেন, তাঁরা রাণুর জন্য পাত্র দেখা শুরু করেছেন। অবশ্য কবি নিজে যদি কোনও পাত্র নির্বাচন করে দেন, তার চেয়ে ভাল কিছু আর হতে পারে না।
রাণুর কলেজে পড়া এখনও শেষ হয়নি, এর মধ্যেই অন্যের বাড়ি চলে যাবে? অবশ্য কবির আপত্তি জানাবার কোনও মুখ নেই, কারণ তিনি তাঁর নিজের তিন মেয়েরই বিবাহ দিয়েছেন রাণুর চেয়েও অনেক কম বয়েসে।
রাণুকে তিনি নিজের সঙ্গিনী করে রাখবেন কোন যুক্তিতে?
একবার তিনি রাণুকে একটা চিঠিতে হঠাৎ তাঁর ভেতরের হাহাকারের কথা সম্পূর্ণ ভাবে প্রকাশ করে ফেলেছিলেন। লিখেছিলেন :
… তোমার জীবনে, রাণু, যদি আমার মধ্যে সেই সদর দরজাটা খুঁজে পেতে, তাহলে খোলা আকাশের স্বাদ পেয়ে হয়তো খুশি হতে। তোমার অন্দরের দরজার অধিকার দাবি আমার তো চলবে না–এমনকি সেখানকার সত্যকার চাবিটি তোমার হাতেও নেই, যার হাতে আছে সে আপনি এসে প্রবেশ করবে, কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমি যা দিতে পারি, তুমি যদি তা চাইতে পারতে, তাহলে বড় দরজাটা খোলা ছিল। কোনও মেয়েই আজ পর্যন্ত সেই সত্যকার আমাকে সত্য করে চায়নি—যদি চাইত তাহলে আমি নিজে ধন্য হতুম। কেননা, মেয়েদের চাওয়া পুরুষদের পক্ষে একটা বড় শক্তি। সেই চাওয়ার বেগেই পুরুষ নিজের গূঢ় সম্পদকে আবিষ্কার করে। … শঙ্কর যখন তপস্যায় থাকেন তখন তাঁর নিজের পূর্ণতা আবৃত হয়ে থাকে। উমার প্রার্থনা তপস্যা রূপে তাঁকে আঘাত করে যখন জাগিয়ে দেয়, তখনই তিনি সুন্দর হয়ে, পূর্ণ হয়ে, চিরনবীন হয়ে বেরিয়ে আসেন। উমার এই তপস্যা না হলে তাঁর তো প্রকাশের ক্ষমতা নেই। কতকাল থেকে উৎসুক হয়ে আমি ইচ্ছা করেছি, কোনও মেয়ে আমার সম্পূর্ণ আমাকে প্রার্থনা করুক, আমার খণ্ডিত আমাকে নয়। আজও তা হল না—সেইজন্যই আমার সম্পূর্ণ উদ্বোধন হয়নি। কী জানি আমার উমা কোন দেশে কোথায় আছে। হয়তো আর জন্মে সেই তপস্বিনীর দেখা পাব।
রাণু এই চিঠি বারবার পড়েছে, আকুল ভাবে কেঁদেছে, কিন্তু কোনও উত্তর দিতে পারেনি। সে ভালবাসতে জানে, ভালবেসেছে কবিকে, কিন্তু ভালবাসার বিনিময়ে কী চাইতে হয়, তা সে জানে না। কবি তো এখানে শুধু কবি নন। নিজেকে বলছেন পুরুষ, আবেদন জানাচ্ছেন এক নারীর কাছে, রাণু যে এভাবে কখনও ভাবেনি। অত বড় একজন মানুষ, তাকে সমগ্র ভাবে চাইবার সাহস তার হবে কী করে? খণ্ডিত মানুষটিই ভানুদাদা, সেই অংশটিই সে আপন করে চেয়েছে।
শিলং পাহাড়ে যাবার কিছুদিন আগে কবি আর একবার গিয়েছিলেন কাশীতে। সেবারই প্রথম রাণুদের বাড়িতে রাত্রি যাপন করলেন। তখন থেকেই শুরু হয়েছে বিয়ের আলোচনা।
কবি বেদনার সঙ্গে মেনে নিয়েছেন, রাণুকে অন্য একজন পুরুষের হাতে সঁপে দিতেই হবে। তা বলে কি চিরবিচ্ছেদ হবে রাণুর সঙ্গে? তাঁর আশঙ্কা, রাণুর বাবা হয়তো তড়িঘড়ি করে এমন কোনও পাত্রের সঙ্গে সম্বন্ধ করবেন, যে রাণুকে নিয়ে যাবে দূর প্রবাসে। বিয়ে হোক, তবু রাণু থাকুক কাছাকাছি। এমন একটি ভাল বংশের, শিক্ষিত, রুচিবান পাত্র বাছতে হবে, যে রাণুকে ভালবাসবে, তাকে মর্যাদা দেবে, আবার কবির প্রতিও শ্রদ্ধাশীল, যে তাঁর সঙ্গে রাণুর যোগাযোগ রক্ষা করতে বাধা দেবে না।
সে ভার নিতে হবে তাঁকেই। এ কাজটি তাঁর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সম্পূর্ণ মনোযোগ যে দেবেন, তার সময় পান না। কর্তব্যের বোঝ যে সবসময় কাঁধে চেপে আছে। এর মধ্যে মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ দেহরক্ষা করলেন। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা উত্তাল। নজরুল ইসলাম নামে একটি অল্পবয়েসী ছেলে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বাংলা কবিতায় ঝড় বইয়ে দিয়েছে। এই তেজী তরুণটিকে বেশ পছন্দ করেন কবি। পত্রিকায় একটা উত্তেজক রচনাকে রাজদ্রোহমূলক অভিযোগ এনে পুলিশ তাকে বন্দি করে রেখেছে কারাগারে। প্রতিবাদে নজরুল শুরু করেছে আমরণ অনশন, কারুর কথাই শুনছে না। এভাবে ওর মৃত্যু হলে বাংলা সাহিত্যের নিদারুণ ক্ষতি হয়ে যাবে। তাকে অনশন ভঙ্গ করার জন্য পাঠাতে হল টেলিগ্রাম। কবির সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ নামের গীতিনাট্যটি নজরুলের নামে উৎসর্গ করে তার এক কপি পাঠিয়ে দিলেন জেলখানায়। বসন্ত’ নাটিকাটির অভিনয়েরও ব্যবস্থা হচ্ছে। কিন্তু কবির মনে সর্বক্ষণ চিন্তা, রাণুর বাবা কোনও পাত্রপক্ষকে কথা দিয়ে ফেলবেন না তো?
বেনারসের কোনও আমন্ত্রণই তিনি প্রত্যাখ্যান করেন না। সভাসমিতি তো আছেই, এই সুযোগে তিনি ফণিভূষণ ও সরযূকে বারবার বোঝালেন, কিছুদিন দেরি হয় হোক, তাঁকে না জানিয়ে, তাঁর সম্মতি না নিয়ে রাণুর বিবাহ ঠিক করা মোটেই উচিত হবে না।
বিশেষত তিনি সরযূকে একদিন আলাদা করে ডেকে বললেন, শোনো, রাণুর যে যোগ্য হবে, সে যেন রাণুকে ভুল না বোঝে। ওর মধ্যে যে দুর্দমতা আছে, তার সম্বন্ধেও অসহিষ্ণু হবেনা। মুশকিল এই, এটা তো জানোই, রাণুর জীবনের মাঝখানে কেমন করে আমি একটা কেন্দ্র দখল করে বসে আছি, সুতরাং ওর যেখানেই গতি হোক আমাকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে চলবে না, তাতে সমস্ত ব্যাপারটাই জটিল হয়ে উঠবে। সেই জট যদি ছাড়ানো সম্ভব হত, তাহলে সবই সোজা হত। কিন্তু ও বেদনা পেতে যেরকম অসাধারণ পটু, তাতে ওকে কাঁদাতে আমার মন সরে না। ওকে সম্পূর্ণ সান্ত্বনা দেবার পথ আমার হাতে নেই—তবে কিনা আমার অন্তরের স্নেহ পাবার পক্ষে ওর ভবিষ্যতেও যাতে কোনও ব্যাঘাত না হয়, এই সম্ভাবনার কথাই আমি আশা করতে পারি।
সরযু কবির পায়ের কাছে বসে পড়লেন। কবির প্রতি তাঁর এমনই ভক্তি যে কবির সম্মতি ছাড়া রাণুর বিয়ে দেবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
বারাণুসী থেকে কবির লক্ষৌ যাবার কথা। কাছাকাছি থেকেও রাণুর অদর্শন তাঁর কাছে অসহ, রাণুও তাঁকে ছাড়তে চায় না।
ফণিভূষণ কিছুটা খুঁত খুঁত করছিলেন। বিয়ের কথাবার্তা চলছে, এই সময় রাণুকে বাইরে পাঠানো কি ঠিক হবে? এবারেও সরযূর প্রবল সমর্থনে রাণু শেষ পর্যন্ত অনুমতি পেয়ে গেল।
কথায় বলে রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। রাণু যেন একই অঙ্গে দুই-ই।
লোকজনের মাঝখানে সে সপ্রতিভ। চাঞ্চল্য দমন করে চুপ করে বসে থাকতেও জানে। লক্ষৌ-এর গভর্নর ডিনার পার্টিতে আহ্বান করেছিলেন, সেখানে সে বিলিতি আদবকায়দা শিখে নিল চটপট।
আবার কবি অতুলপ্রসাদ সেনের বাড়ির সান্ধ্য আসরেও সে মধ্যমণি। অতুলপ্রসাদ দিনের বেলা হ্যাট-কোট পরা ব্যারিস্টার, সন্ধেবেলা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা খাঁটি বাঙালি, ঢোল-মৃদঙ্গ বাজিয়ে গান করেন, রাণুও আঁচলটি এমন ভাবে গলায় জড়িয়ে নিল, যেন পল্লিবাংলার লক্ষ্মী মেয়েটি।
অনেকের অনুরোধে সে এস্রাজ বাজিয়েও শোনাল। তখন সে যেন সাক্ষাৎ বীণাবাদিনী সরস্বতী!
একটা উঁচু বেদির ওপর বসানো হয়েছে তাকে, একটা লাল পাড়, সাদা সিল্কের শাড়ি পরা, কপালে একটি টিপ, পিঠের ওপর খোলা চুল, যেন একটা দিব্য আভা ফুটে বেরুচ্ছে তার সর্বাঙ্গ থেকে।
তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কবির বুক টনটন করতে লাগল।
এখানেও রাণুর পাণিপ্রার্থীর সংখ্যা অনেক। একটুক্ষণও চোখের আড়াল করার উপায় নেই।
লক্ষ্ণৌ থেকে কবিকে যেতে হয়েছিল করাচিতে, তিনি তাড়াতাড়ি রাণুকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বেনারসে।
শিলং থেকে ফেরার পর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কবিকে আবার যেতে হল আমেদাবাদের দিকে। এবারে সঙ্গে নিলেন এল্মহার্স্টকে।
নতুন নাটকটির এখনও শেষ অংশ লেখা হয়নি। পরিমার্জনও করছেন বারবার। সফর, বক্তৃতা, ভোজসভা এসব কিছু সেরেও লেখার কাজ চলছে ফাঁকে ফাঁকে।
লিমবিডি নামে একটি ছোট দেশীয় রাজ্যে থাকার সময় এক রাতে তিনি এল্মহার্স্টকে ডেকে বললেন, লেওনার্ড, আজ আমার মনটা বেশ খারাপ হয়ে আছে। কেন জানো? কারণটা শুনলে তুমি অবাক হবে। যে নাটকটা লিখছিলাম এতদিন ধরে, তার শেষ অংশে এসে গেছি, কালই সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। আজই শেষ করা যেত, কিন্তু এতদিন যে চরিত্রগুলির সঙ্গে রয়েছি, তাদের ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে না। অথচ বিদায় দিতে হবেই। শুধু আর একটা দিন বিলম্বিত করা।
এল্মহার্স্ট বলল, নাটকটি পড়তে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। শিগগিরই অনুবাদ হবে নিশ্চিত?
কবি বললেন, তা হবে, সুরেন আগেই জানিয়ে রেখেছে। এ নাটক তো তোমাকে পড়তে হবেই, কারণ এটা তোমাকেই উৎসর্গ করছি।
দারুণ বিস্মিত হয়ে এল্মহার্স্ট বলল, আমাকে? নিজেকে খুবই ধন্য ও সম্মানিত মনে করছি অবশ্যই। কিন্তু জানতে কৌতূহল হচ্ছে, কেন আমাকে উৎসর্গ করছেন?
কবি বললেন, কারণ, তুমিই তো এ নাটকের নায়ক।
আরও বেশি বিস্মিত হয়ে এল্মহার্স্ট বলল, মাই গুডনেস! নায়ক? আমি? আপনার নাটকের? আপনি রসিকতা করছেন আমার সঙ্গে।
কবি বললেন, তুমি রঞ্জন। নাটকের কেন্দ্রে আছে আমাদের রাণু, তার নাম নন্দিনী, সে তোমার জন্য প্রতীক্ষা করে থাকে। আর জালের আড়ালে রয়েছে অদৃশ্য রাজা, রঞ্জনের সঙ্গেই তার প্রধান প্রতিযোগিতা। আমি এ নাটকটাকে ঠিক রূপক বলতে চাই না।
এল্মহার্স্ট বললেন, কিন্তু হুবহু বাস্তব চরিত্র নিয়ে কি শিল্প হয়? শিল্পে নিশ্চিত তার অনেক রূপান্তর ঘটে।
কবি বললেন, তা অবশ্যই। তবে আমাদের তিনজনের আদলেই নাটকের মূল কাঠামোটি আমার প্রথম মনে আসে। রাণু জানে না, সে-ই আমাকে দিয়ে এ নাটকটি রচনা করিয়েছে। হয়তো তোমার কথা মাথার মধ্যে ছিল বলেই আমি রঞ্জনের মুখে কোনও সংলাপ বসাইনি।
আপনি বলছেন, রঞ্জনই এ নাটকের নায়ক। অথচ তার কোনও সংলাপ নেই? এরকম নাটক পৃথিবীতে আগে লেখা হয়েছে?
বিশ্বসাহিত্যের সব খবর তো জানি নে। স্বাভাবিক ভাবেই এই আঙ্গিকটি লেখার সময় এসে গেল। অন্য সবাই রঞ্জনের কথা বলছে, সে আসবে, আসবে, এসে পড়বে, কিন্তু শেষ দৃশ্যের আগে তাকে দেখা যাবে না। তখনও তার কথা বলার ক্ষমতা নেই।
আশ্চর্য, ভারী আশ্চর্য! আপনি চাইছেন, আমি নাটকটিতে ওই ভূমিকায় অভিনয় করব। আমার বাংলা উচ্চারণ ঠিক হবে না, তাই কি আপনি রঞ্জনের মুখে কথা বসাননি।
কবি হাসতে হাসতে বললেন, সেটা একটা কারণ হতে পারে। অবশ্যই। তবে, কারণ যাই-ই হোক, তা তো পাঠকদের জানবার কথা নয়। বাংলা নাটকে নায়করা বড্ড বেশি কথা বলে, লম্বা লম্বা লেকচার দেয়, আমার রঞ্জন বোবা নয়, তবু সে সংলাপহীন নায়ক।
আরও কিছুক্ষণ নাটকটি বিষয়ে আলোচনা চলে।
তাবপর একসময় এল্মহার্স্ট বলল, গুরুদেব, আমার একটি নিবেদন আছে। এবার হয়তো শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন থেকে আমার পাট চুকোতে হবে। আপনি ডরোথির কথা জানেন। সে আর অপেক্ষা করতে রাজি নয়। আমিও এখন তাকে বিয়ে করে সংসার ধর্ম শুরু করতে চাই।
কবি বললেন, এ তো ভারী সুখবর। তোমাকে আমি বেশিদিন ধরে রাখার কথা ভাবিইনি। আমার ছাত্র কর্মীরা তোমার ওপর বরাবরের মতন নির্ভরশীল হয়ে থাকবে, এ কখনও হতে পারে না। তুমি তাদের শুরুর কাজটি ধরিয়ে দেবে, তারপর তারা নিজের পায়ে দাঁড়াবে, এটাই তো ঠিক। আমার তো মনে হয়, সে রকম ভাবেই ওরা তৈরি হয়েছে।
এল্মহার্স্ট বলল, আমার যতদূর সাধ্য করেছি। কৃষি, পশুপালন ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পর্কে একটা চেতনা জাগ্রত হয়েছে, এখন কাজ চলতে থাকবে।
কবি বললেন, তাতেই আমি খুশি।
তারপর নিঃশব্দ হাসিতে মুখ ভরিয়ে, চক্ষু নাচিয়ে বললেন, আমি আরও বেশি খুশি তোমার বিবাহ-সম্ভাবনার কথা শুনে। আমার মন থেকে যেন একটা বোঝা নেমে গেল। বাপ রে, ইদানীং আমি লক্ষ করছিলুম যে তুমি কাশীর কন্যাটির প্রতি এত বেশি বেশি মনোেযোগ দিচ্ছিলে, যাতে সেই কন্যাটিরও মনের গতি যেন আগেকার পথ ছেড়ে তোমার দিকে ধাইছিল। আমার পক্ষে ভয় পাবারই কথা, তাই না?
এল্মহার্স্টও হেসে বলল, আপনার এ আশঙ্কার কোনও কারণই ছিল না। আপনি যে রকম একটি ত্রিভুজ প্রেমের ধারণা দিচ্ছেন, সেটা অলীক। মেয়েটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক খানিকটা ভালো লাগার, আর অনেকটাই কৌতুকের। তবে কিছুদিন ধরে আমার একটা কথা মনে হচ্ছে, সেটা বলব? হয়তো এ রকম কথা বলার অধিকার আমার নেই।
কবি বললেন, বলো, প্রাণ খুলে বলল। এল্মহার্স্ট বলল, আপনি অনেক বিষয়েই আমার সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করেন, তাই বলছি। রাণুর সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা আমি বুঝি। খুবই মধুর, নির্দোষ সম্পর্ক। কিন্তু এখন রাণুর বিয়ের কথাবার্তা চলছে, এখন বোধহয় আস্তে আস্তে আপনাদের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি করাই ভাল। এত বেশি চিঠি লেখা, ঘন ঘন দেখা হওয়া, আপনি বাইরে গেলে ওকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চান, এতে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা আছে।
কবি বলল, তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ। কিন্তু ও যে অবুঝ। কান্নাকাটি করে, বারবার আমার কাছে আসতে চায়। তবু, নিজেকে সরিয়ে নিতেই হবে। লিওনার্ড, তুমি ইওরোেপ চলে গেলেও আর একবার এসো। আমার খুব ইচ্ছে, এই নতুন নাটকটা মঞ্চস্থ করলে, তাতে তুমি, রাণু আর আমি অংশ নেবো। গূঢ় কথাটি আর কেউ বুঝতে পারবে না। তোমাকে দেখা যাবে একেবারে শেষ দৃশ্যে, শুয়ে আছে রঞ্জন, নন্দিনী ঝুকে তোমার চুলে একটা পালক এঁটে দেবে।