১৭. প্রদীপ বড় রাস্তায় পড়িয়া

প্রদীপ বড় রাস্তায় পড়িয়াই ট্যাক্সি লইয়া কাছাকাছি একটা ডিসপেনসারিতে আসিয়া উঠিল। ডাক্তারটি পরিচিত। ট্যাক্সিভাড়াটা তিনিই দিয়া দিলেন যা হোক। পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন আঘাত গুরুতর হইয়াছে। যে পরিমাণে রক্তক্ষয় হইয়াছে তাহাতে অন্যান্য আনুষঙ্গিক পীড়া হইবার সম্ভাবনা। ব্যাণ্ডেজ করিয়া দিয়া ডাক্তারবাবু কহিলেন,—“বাড়ি গিয়ে চুপ করে শুয়ে থাকুন গে। সঙ্গে এই ওষুধটাও নিয়ে যাবেন।

ঔষধটা পকেটে পুরিয়া প্রদীপ পায়ে হাঁটিয়াই বাহির হইয়া পড়িল। চুপ করিয়া শুইয়া থাকিবার জন্যই সে মাথা পাতিয়া আঘাত নিয়াছে আর কি! কিন্তু ঘা-টার সুতীব্র যন্ত্রণা তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিতেছিল। অজয়ও এমন করিয়া নমিতারই জন্য আঘাত নিয়াছে, কিন্তু সেটা আকস্মিক একটা দুর্ঘটনা মাত্র, নমিতার নিজের হাতের পরিবেষণ নয়। অজয়ের আচরণের মধ্যে কোথায় যেন একটা চোরের নীচতা আছে, কিন্তু এমন একটা সুপ্রবল দস্যুতার প্রমত্ততা নাই। প্রতিযোগিতায় সে-ই বোধ হয় বেশি লাভ করিল।

কিন্তু কেন যে তাহার মধ্যে হঠাৎ এই দুর্দাম চঞ্চলতা আসিল সে ইহা বুঝিয়া পাইল না। নমিতা যে আর কাহারো অন্তরের অন্তঃপুরে কায়াহীন কল্পনার মতও বিরাজ করিবে তাহাতেও প্রদীপের ক্ষমা নাই। সে হয় ত’ নির্জনলালিত ভাবমূর্তিতেই নমিতাকে আস্বাদ করিত—তাহার সমস্ত কর্মমুখর ব্যস্ততায় নিশীথরাত্রির স্বপ্নরঞ্জিনীর মত; তাহার এই বিশ্বাসও ছিল যে, যাহাকে এমন করিয়া কামনা করা যায় সে বিজ্ঞানের স্বাভাবিক রীতিতেই প্রতিধ্বনি করিয়া উঠিবে। কিন্তু অজয়ের ব্যস্ত আচরণে সে-প্রতীক্ষার অবিচল তপস্যা যেন সহসা ভাঙিয়া শূন্যে বিলীন হইয়া গেল। সত্যকে ঘিরিয়া ভাবের যে কুজ্ঞটিকা ছিল তাহা মিলাইয়া যাইতেই প্রদীপের চোখে পড়ল নমিতাকে না হইলে তাহার চলিবে না। যেমন তাহার বুকের নিশ্বাস, পকেটের পাথেয়। হয় ত’ নমিতার পক্ষে কোনো লৌকিক উপমাই যথেষ্ট নয়। কিন্তু তাহাকে লাভ করিতেই হইবে। প্রেমকে মহত্তর করিতে গিয়া যাহারা প্রণামের সাধনা করে, প্রদীপের তত প্রচুর ধৈৰ্য্য নাই। তাহাকে ছিনাইয়া, কাড়িয়া, মূলচ্যুত করিয়া তুলিয়া লইতে হইবে। পাওয়াটাই বড় কথা, রীতিটা অনর্থক। অজয় যতই কেননা নারীনিন্দুক হোক, ক্ষণকালের জন্য তাহার চোখে প্রদীপ নেশার ঘোর দেখিয়াছে—সে-নেশার পিছনে নিশ্চয়ই বঞ্চিত উপবাসী যৌবনের তৃষ্ণা ছিল। ছিল না? তাই ত’ সে যাইবার সময় নমিতার পাতিব্ৰত্যের প্রতি এমন নিদারুণ কশাঘাত করিতে দ্বিরুক্তি করিল না। নমিতা তাহার কাছে একটা প্রতীক মাত্র, কিন্তু প্রদীপের কাছে সে প্রতিমার অতিরিক্ত,—প্রাণবতী, দেহিনী। তাহাকে তাহার চাই—ভোগে, বিরহে, কর্মপ্রেরণায়, প্রদোষ-আলস্যে।

মনে পড়ে সেই রাণীগঞ্জে শালবনের তলায় তাহাদের দুই জনকে ফেলিয়া সুধী যখন ইচ্ছা করিয়াই সরিয়া পড়িয়াছিল, তখন সেই ঘনায়িত তিমিরবন্যার উপরে সে যে-দুইটি স্থির আঁখিপদ্মকে দুলিয়া উঠিতে দেখিয়াছিল তাহা তাহার সমস্ত কৰ্ম্ম-জগতের পারে দুইটি ক্ষুদ্র বাতায়ন হইয়া বিরাট অ-দেখা আকাশকে উদঘাটিত করিয়া ধরিয়াছে। সে-দুইটি চোখই তাহাকে উদভ্রান্ত করিয়া ফিরিয়াছে। কিন্তু সেদুইটি চোখকে তুলিয়া আনিতে গিয়া নমিতাকে সে অন্ধ করিয়া আসিল বুঝি। কাড়িতে গেলেও পাওয়া যায় না এমন কোন্ রত্নের লোভে সে দিশাহারা হইল! অজয়ের হঠকারিতা তাহাকে এমন করিয়া পাইয়া বসিল কেন? কিন্তু ঐ জড়স্তুপে প্রাণ সঞ্চার করিতে হইলে আঘাত না করিয়াই বা কী উপায় ছিল!

সমস্ত দুপুরটা টো-টো করিয়া প্রদীপ সন্ধ্যাকালে এক রেষ্টুর্যান্টে ঢুকিয়া যা-তা কতগুলি গলাধঃকরণ করিল। এখন সে কোথায়। যাইবে? কতগুলি লোক লইয়া রাত্রিকালে সে নমিতাকে চুরি করিলেই ত’ পারিত। দলের লোকেরা নারী-হরণের এই নিদারুণ প্রয়োজনীয়তা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিত না নিশ্চয়। মূখ। মাটির ভারতবর্ষের চেয়ে ঐ মাটির দেহটির মূল্য অনেক বেশি। দেশ সম্বন্ধে প্রতির আধিক্য ভাবাকুলতার একটা দুর্বল নিদর্শন মাত্র, তাহা প্রত্যক্ষ ও প্রখর নয় বলিয়াই প্রদীপের কাছে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর মনে হইল। তাহার চেয়ে নমিতার প্রতি তাহার এই প্রতি-নিশ্বাসের প্রেমে ঢের বেশি সত্য আছে। সব সত্যই সার্থক নয়। না-ই হোক। তবু এ সত্যকে সে আকাশের রৌদ্রের মত সমস্ত পৃথিবীতে বিকীর্ণ করিয়া দিয়া আসিয়াছে।

অগত্যা মেসেই সে ফিরিয়া আসিল। সমস্ত গা ব্যথা করিয়া জ্বর আসিয়া গেল—মাথাটা ছিঁড়িয়া পড়িতেছে। কিন্তু অজয়ের মত সে পলাইয়া বাচিবে না, এই ঘরে সে আত্মহত্যা করিবে। দেশ স্বাধীন না হোক, তাহাতে তাহার কিছু আসিয়া যাইবে না—তাহার চেয়েও বড় ব্যর্থতা তাহাকে গ্রাস করিয়াছে। একেবারে অপ্রয়োজনে এমন করিয়া সে প্রাণ দিবে—তাহাকে যে যতই ব্যঙ্গ করুক, তাহারা হৃদয়হীন, অমানুষ। সে রক্তের মাঝে অশ্রু দেখে, হত্যার অন্তরালে বৈধব্য। নিস্ফল কৰ্ম্মের পেছনে সে অতৃপ্তির হাহাকার শুনিতে পায়, প্রচেষ্টার পেছনে অভাবনীয় ব্যর্থতা। সে রাত জাগিয়া তারা দেখিয়াছে, ধূসর অতীতের কুয়াসায় বর্তমানকে ছায়াময় করিয়া তুলিয়াছে, নমিতার দুইটি শুষ্ণ-শীর্ণ ঠোঁটের প্রান্তে তাহারই একটি পিপাসা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়াছে। তাহার জীবন ত’ ভাগ্য-বিধাতা তাহার হিসাবের খাতায় বাজে-খরচের ঘরেই রাখিয়া দিয়াছেন—তাহার জন্য আবার জবাবদিহি কি? ঘরের মধ্যেকার পুঞ্জিত অন্ধকার যেন তাহার মুখ চাপিয়া ধরিয়াছে—এই তিমির-রাত্রির অবসান কোথায়? এই মেসের ময়লা বিছানায় শুইয়াই সে আকাশের জ্যোৎস্নায় গা ঢালিয়া দিয়াছে— সে-আকাশ সহসা এক নিশ্বাসে ফুরাইয়া গেল নাকি? কোথায় তাহার বাড়ি-ঘর, মা-বাপ, আত্মীয়-স্বজন! কেহ নাই। কোথায় নমিতা!

প্রদীপ ঝট্‌ করিয়া উঠিয়া বসিল। না, আলো জ্বালাইতে হইবে না। কাহারো এখনো ফিরিবার সম্ভাবনা নাই। কাজটা এখনই সারিতে হইবে। এমন অকর্মণ্যকে নিজ হাতে মারিয়া ফেলার মত গৌরব কোথায়? প্রদীপ পকেটে বাঁ-হাতটা ডুবাইয়া দিল।

অমনিই দরজা ঠেলিয়া যদুর প্রবেশ। সে এমন বোকা, জ্বরের ঘোরে তাড়াতাড়িতে দরজাটায় পর্যন্ত খিল লাগায় নাই। যদু কহিল,

—“আপনার একখানা চিঠি এসেছে।”

—“চিঠি!” প্রদীপ আকাশ থেকে পড়িল,—তাহার ঠিকানা লোকে কি করিয়া জানিতে পারিবে? অজয়ের চিঠি নয় ত’? নতুন কোনো বিপদে পড়িল নাকি? কিন্তু বিপদে পড়িলেও তাহার ত’ চিঠি লিখিবার কথা নয়। তাহাদের মধ্যে এখন কোনো সম্বন্ধের সূত্র রাখাও ত’ আর সমীচীন হইবে না। প্রদীপ হাত বাড়াইয়া চিঠিটা নিয়া কহিল, “আলোটা জ্বালা ত’ শিগগির। কী আবার ফ্যাসাদে পড়লাম।”

লণ্ঠনটা জ্বালাইতেই প্রদীপ চিঠিটার ঠিকানা দেখিল,—এমন হস্তাক্ষর পৃথিবীতে আগে কোথাও দেখিয়াছে বলিয়া মনে পড়িল না। তাহার মা নয় ত’? তিনি কি আজো বাঁচিয়া আছেন?

মোড়কটা খুলিয়া ফেলিতেই নীচে নাম দেখিল : নমিতা।

প্রদীপ চীৎকার করিয়া উঠিল : “এই চিঠি তোকে কে দিল? ধাপ্পাবাজ! আমার অসুখের সময় আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করতে এসেছিস?”

যদু কহিল,—“না বাবু, ইয়ার্কি করতে যাব কেন? পিওন এসে দিয়ে গেছে। আপনি তখন বাড়ি ছিলেন না।”

—“পিওন দিয়ে গেছে? আমি বাড়ি ছিলাম না! তুই বলছিস কি, যদু?”

পোষ্টাফিসের ষ্ট্যাম্প, দেখিয়া বুঝিল, সত্যই,—চিঠিটা ডাকেই আসিয়াছে। দু’টার সময়কার প্রথম ছাপ, এখানে পৌঁছিয়াছে সন্ধ্যা সাতটায়। তবু যেন প্রদীপের বিশ্বাস হয় না : “পিওন দিয়ে গেছে? তুই ঠিক জানিস? কেউ চালাকি করেনি ত’?”

—“কে আবার খামের মধ্যে বসে’ চালাকি করতে যাবে?”

—“সত্যিই, কে আবার চালাকি করবে! চালাকি করে’ কার বা কী লাভ? কে বা জানে এ-সব? কিন্তু শচীপ্রসাদ যদি চালাকি করে? ও, তুই তাকে কি করে চিবি? সে আবার আমার চুলের ঝু টি টেনে ধরেছিল। আচ্ছা, আমিও দেখে নেব। তুই বডড সময়ে চিঠিটা দিয়ে গেছি, যদু। নইলে শচীপ্রসাদকে শাসন না করেই যে কি করে মরতে যাচ্ছিলাম! হ্যাঁ, তুই যা। বডড জ্বর এসে গেল রে যদু। এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল দিয়ে যাস দিকি। আর, লণ্ঠনটা তক্তপোযের ওপর তুলে দে।”

লণ্ঠনটা তুলিয়া দিয়া যদু জল আনিতে গেল। কিন্তু এত কাছে আলো পাইয়াও চিঠিটা পড়িতে তাহার সাহস হইল না, চিঠিটা হাতে নিয়া মূর্তির মত স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। একবার চোখ বুলাইয়াই সে দেখিয়া নিয়াছে পত্রটি একটি কণা মাত্র, সামান্য কয়েক লাইন লিখিয়াই শেষ করিয়াছে। কিন্তু এমন নির্মম আঘাত করিয়া কিতাহার এমন প্রয়োজন ঘটিয়া গেল। অনুতাপ করিয়া ক্ষমা চাহিয়াছে বুঝি। কিম্বা হয় ত’ আরো ভৎসনা করিয়া পাঠাইয়াছে। তাহার জন্য আবার চিঠি কেন?

নিশ্বাস বন্ধ করিয়া প্রদীপ চিঠিটা পড়িয়া গেল :

প্রদীপবাবু,

এ-সংসারে আমার আর স্থান নেই। আত্মহত্যা করতে পারতাম বটে, কিন্তু মরুতে আমার ভয় করে। আর, এক মা ছিলেন, তিনিও বিমুখ হয়েছেন। এখন আপনি মাত্র আমার সহায়। এ বাড়ির বৌ হয়ে অবধি কোনদিন পথে বেরইনি, একা বেরুতে আমার পা কাঁপছে। আপনি আজ রাত্রি ঠিক একটার সময় আমাদের গলির মোড়ে অপেক্ষা করবেন—আমি এক-কাপড়ে বেরিয়ে আসব। তারপর আপনি আমাকে যেখানে নেবেন সেখানে যেতে আমি আর দ্বিধা করব। না। ইতি।

–নমিতা

যদু জল লইয়া আসিয়াছে; এক ঢোঁকে সবটা গিলিয়া ফেলিয়াও সে ঠাণ্ডা হইল না। যদুর হাতটা চাপিয়া কহিল,—“ঠিক বলছি, পিওন দিয়ে গেছে? গায়ে খাকির জামা, মাথায় পাগড়ি, পায়ে ফেটি বাধা। ঠিক বলছিস?”

যদু অপ্রস্তুত হইয়া কহিল,—“মিথ্যে বলে আমার লাত কি বাবু?”

—“না না, তুই মিথ্যে বলবি কেন? তুই কি তেমন ছেলে? তুই লক্ষ্মী, আর-জন্মে তুই আমার ভাই ছিলি। তোকে আমি আমার সব দিয়ে দিলাম।”

হাত ছাড়াইয়া নিয়া যদু কহিল,—“কী বলছেন বাবু? সামান্য একটা চিঠি এনে দিয়েছি—তাতে—”

-“তুই তার কিছু বুঝবি নে। লেখাপড়া তো কোনোদিন কিছু শিখলিনে, পরের বাড়িতে খালি বাসনই মাজলি। তুই যে একটি রত্ন, এ-কথা তুই নিজেই ভুলে আছিস। হ্যাঁ, তোর বিশ্বাস হচ্ছে না? এই সব—সব তোর। আর, আমার এমন কিছুই নেই যে তোকে দেওয়ার মত দিতে পারি। ঠিক বলছিস? পায়ে ফেটি বাঁধা, মাথায় পাগড়ি, গায়ে খাকির জামা—ঠিক? তুই যখন দেখেছি তখন ঠিক না হয়ে পারে? তুই কি আর আমার সঙ্গে চালাকি করবি?”

যদু ‘ছি’ বলিয়া জিভ কাটিল।

প্রদীপ অস্থির হইয়া উঠিয়াছে : “সব তোকে দিলাম। সব তোর। নিতে হবে। কিছুই আর আমার দরকার নেই। সে ভারি মজা,

এই বিছানা-বালিশ বাক্স-প্যারা জামা-কাপড়—সামান্য যা-কিছু মানুষের লাগে—এক-এক সময় একেবারে লাগে না। কিছু দিয়েই কিছু হয় না। হ্যাঁ, তুই বিশ্বাস করছিস না বুঝি? এ আর এমন কি রাজ্য তোকে দিচ্ছি যে প্রকাণ্ড একটা হাঁ করে আছিস। বোকাটা!”

যদু আমতা আমতা করিয়া কহিল,—“আপনার তা হলে কি করে’ চলবে?”

—“আমার চলবে না রে পাগলা, চলবে না। আমার আবার আর চলাচলি কিসের? হ্যাঁ, আরেকটা কাজ তোকে করে দিতে হবে ভাই।”

-“বলুন।”

—“মোড় থেকে একটা রিক্‌স নিয়ে আয় দিকি, একটু বেড়াতে বেরুব।”

—“আপনার যে জ্বর। পড়ে গিয়ে মাথা যে আপনার ফেটে গেছে।”

-“দেখছি না চেহারাটা ভালুকের মত, জ্বরও ভালুকের। কখন যে আসে, কখন যে নেমে যায় ঠাহর করা যায় না।”

প্রদীপের গলার উপরে যদু স্বচ্ছন্দে হাত রাখিল। ভীত হইয়া কহিল,—“গা যে পুড়ে যাচ্ছে।”

প্রদীপ ঠাট্টা করিয়া বলিল,-“ওটা তোর হাতের দোষ। যা, রিক্‌স্‌ আন একটা। জলদি।”

—“বাইরে যে হিম পড়ছে বাবু।”

—“দুত্তোর হিম। বেশ ত ঠাণ্ডায় আবার জ্বর জুড়িয়ে যাবে ‘খন। কোনোদিন ত’ আর লেখাপড়া শিখলিনে, কিসে করে যে কী হয় তোর চোদ্দপুরুষও বুঝে উঠতে পারবে না। যা। তোকে গালাগাল দিলাম না ওটা! কী মূখের পাল্লায়ই যে পড়েছি! বেশ জোয়ান দেখে রিক্‌স আনবি। হা হা—জোয়ান রিস্।”

যদু চলিয়া গেলে প্রদীপ আবার নতুন সমস্যায় পড়িল। টাকা কোথায়? পকেটের বাইরে ও ভেতরে দুই দিকেই সমান দুইটা শূন্য। তবে? অবিনাশের কাছে গিয়া সাহায্য চাহিবে? এখন সে কলিকাতায় না কালিঘাট-এ তাহারই বা ঠিকানা কি? হ্যাঁ, যখন সে সব ছাড়িয়াছে, তখন তাহার টাকাও লাগিবে না। পাগল! সে একা নয়, সঙ্গে নমিতা। সে-কথা সে ভুলিয়া গেল নাকি? না না, ভুলিতে সে মরিতে গিয়াছিল বটে, কিন্তু এখন মরিলেও সে ভুলিতে পারিত না। কিন্তু টাকা চাই। টাকার জন্য কোথায় সে প্রার্থী হইবে আজ? নমিতা মধ্যরাত্রিতে গলির মোড়টা একেলা আসিয়াই ঘুরিয়া যাইবে নাকি? বিশ্বাসঘাতক, প্রদীপ, চরিত্রহীন পাপিষ্ঠ। কুলনারীকে বাড়ির বাহির করিয়া সে আরামে বিছানায় শুইয়া জ্বর ভোগ করিতেছে। ছি! কিন্তু নমিতা নিশ্চয়ই সেমিজের তলায় টাকা নিয়া আসিবে। আনুক, তবু তার কাছ থেকে খরচ চাহিলে তাহার পুরুষগৰ্ব্ব ধূলায় লুষ্ঠিত হইবে যে। হোক, যে সহচারিণী বন্ধু, তার কাছ থেকে এটুকু সাহায্য নিলে লজ্জা কোথায়? নমিতা কোথায় টাকা পাইবে? গায়ে তাহার একখানা গয়না পর্যন্ত নাই। সে-সব অবনীবাবুর সিন্দুকে নিৰ্বাপিত মৃৎপ্রদীপের মত ঘুমাইয়া আছে। নমিতা সে-সিন্দুকের শক্তি কি করিয়া পরীক্ষা করিবে? না, না, টাকা চাই। কোনো দ্বিধা নাই, টাকা তাহাকে সংগ্রহ করিতেই হইবে।

কি ভাবিয়া প্রদীপ দরজায় খিল দিল। একটা লোহার শলা ঢুকাইয়া সজোরে একটা চাড় দিতেই প্রতিনিধানের ট্রাঙ্কের তলাটা ফাঁক হইয়া গেল। সে চুরি করিতেছে, হ্যাঁ, সে জানে। চুবিই করিতেছে সে। উদ্দেশ্যবিচারেই মহত্ত্ব প্রমাণিত হো, রীতিবিচারটা বর্বর প্রথা। ভগবান আছেন। যে চোর, যে নারীহর্তা তার জন্যও ভগবান আছেন। প্রতিনিধানের কাপড়ের তলায় কতগুলি নোট।

দরজায় কে টোকা দিল।

প্রদীপ জিজ্ঞাসা করিল : “কে?”

—“আমি, বাবু। রিস্ এসেছে।”

—“এসেছে? বেশ জোয়ান রিক্‌স ত’ রে?” বলিয়া হাসিতে হাসিতে সে দরজা খুলিয়া দিল।

আর এক মুহুর্ত দেরি করিল না : “চল্লাম রে যদু।”

যদু কহিল,—“আর আসবেন না?”

–“না।” বলিয়া অন্ধকার সিড়ি দিয়া হোঁচট খাইতে খাইতে সে নামিতে লাগিল। উপর হইতে যদুর প্রশ্ন শোনা গেল : “দড়িতে টাঙানো আপনার ঐ সিল্কের জামাটাও আমার।”

—“হ্যাঁ, তোর। সব। গরদ তসর সিল্ক মট্‌কা মসলিন আপাকা —সব।”

রিক্‌সয় চাপিয়া প্রদীপ কহিল –“চল কাশিপুর।”

রিক্‌স-ওয়ালা অবাক হইয়া কহিল,—“সে কি বাবু? সে ত’ বহুদূর।”

—“আচ্ছা, আচ্ছা, উল্টোমুখো করে’ নে গাড়িটা। ভবানীপুর চল।”

—“সে ও ত’ ঢের দূর বাবু।”

-“তবে কি সাবু খেয়ে গাড়ি টানিস? নে, হেদোয় যেতে পারবি?”

ডাণ্ডা তুলিয়া ঘণ্টা বাজাইয়া রিক্‌স-ওয়ালা টানিতে লাগিল।

প্রদীপ কহিল,–“বেশি মেহনৎ হলে আরেকটাতে চাপিয়ে দিস মনে করে। বুঝলি?”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *