পৌরানিক উপাখ্যান
পুরাণসমূহের পঞ্চলক্ষ্মণের মধ্যে এক লক্ষণ হচ্ছে সর্গ । সৰ্গ মানে সৃষ্টি । সব পুরাণেই সৃষ্টি প্রকরণ বর্ণিত হয়েছে। এই বর্ণনা অনুযায়ী ব্ৰহ্মা প্ৰথমে সনৎকুমার, সনন্দ, সনক, সনাতন ও বিভু, এই পাঁচ ঋষিগণকে সৃষ্টি করেন। কিন্তু তাঁরা ঊর্ধ্বরেতা থাকায় প্ৰজাসৃষ্টি হল না। তখন ব্ৰহ্মা নিজেকে দুইভাগে বিভক্ত করেন। তাঁর এক অংশ পুরুষ ও অপর অংশ স্ত্রী হল। তিনি পুরুষের নাম দিলেন মনু, আর স্ত্রীর নাম দিলেন শতরূপা । তারা পরস্পর বিবাহিত হয়ে ব্ৰহ্মাকে জিজ্ঞাসা করল–‘পিতঃ কোন কর্মের দ্বারা আমরা আপনার যথোচিত সেবা করব ?’ ব্ৰহ্মা বললেন–‘তোমরা মৈথন কর্মদ্বারা প্ৰজা উৎপাদন কর । তাতেই আমার তুষ্টি।’ তখন থেকে মৈথন কর্মের প্রবর্তন হল ।
মনু ও শতরূপার কন্যা প্ৰসূতি, প্ৰজাপতি দক্ষের ভার্যা হন । দক্ষ ও প্ৰসূতির সতী নামে এক কন্যা হয় । দক্ষ শিবের সঙ্গে তার বিবাহ দেন । কিন্তু শিব কোনদিন তাকে যথোচিত সম্মান দেখাতে পারেন নি মনে করে, দক্ষ শিবের ওপর খুব বিরূপ হন। দক্ষ এক মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করে, সকলকে নিমন্ত্রণ করেন, কিন্তু শিব ও সতীকে নিমন্ত্রণ করেন না । সতী এই যজ্ঞে যাবার জন্য ব্যগ্র হয়ে পড়েন । শিব বাধা দেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সতী পিতৃগৃহে যান। সেখানে যজ্ঞস্থলে পিতার মুখে শিবনিন্দা শুনে, সতী পিতার সম্মুখেই দেহত্যাগ করেন। শিব খবর পেয়ে তার অনুচরদের নিয়ে যজ্ঞস্থলে এসে উপস্থিত হন । দক্ষযজ্ঞ তিনি পণ্ড করে দেন ও দক্ষের মুগুচ্ছেদ করে। দক্ষপিতা ব্ৰহ্মার অনুরোধে শিব দক্ষকে প্ৰাণদান করেন বটে, কিন্তু তার নিজ মুণ্ডের বদলে ছাগমুণ্ড দেন। তারপর শিব সতীর শোকে কাতর হয়ে, সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে প্ৰলয় নাচন শুরু করেন । সৃষ্টি ধ্বংস হবার উপক্রম দেখে, বিষ্ণু নিজ চক্রদ্বারা সতীর দেহ খণ্ড বিখণ্ড করে দেন। যে যে জায়গায় সতীর দেহাংশ পড়ে, পরবর্তীকালে তা মহাপীঠ নামে খ্যাত হয় । এই ভাবে একান্ন মহাপীঠের উৎপত্তি হয় ।
মনুর উল্লেখ আগেই করেছি। ব্ৰহ্মার দেহ থেকে উদ্ভূত বলে এর নাম স্বয়ম্ভুব মনু । শতরূপার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। এদেরই পুত্রকন্যা থেকে মানব জাতির বিস্তার হয় । সত্য, ত্ৰেতা, দ্বাপর ও কলি-এই চার যুগে চতুৰ্দশ মনু জন্মগ্রহণ করেন। এক এক মনুর অধিকার কালকে ‘মন্বন্তর’ বলা হয় ৷ এক মন্বন্তর শেষ হলে, দেবতা ও মনুপুত্ররা বিলুপ্ত হন । আবার নূতন দেবতা ও মানুষের সৃষ্টি হয় ।
।। দুই ॥
দক্ষ রাজার অন্যতম কন্যা অদিতি হতে কশ্যপের ঔরসে বিবস্বানের জন্ম হয়। স্ত্রী সংজ্ঞার গর্ভে বিবস্বানের বৈবস্বত মনু নামে এক পুত্র হয় । বৈবস্বত মনু বদরিকাশ্রমে তপস্যা শুরু করেন। একদিন এক ক্ষুদ্র মৎস্য এসে বৈবস্বত মনুকে বলে ‘আপনি আমাকে বলবান মৎস্যদের হাত থেকে রক্ষা করুন । মনু তাকে এক জালার মধ্যে রাখেন । মাছটি বড় হলে তাকে এক পুষ্করিণীতে রাখেন। তারপর আরও বড় হলে নদীতে ছেড়ে দেন । নদীতেও তার স্থান সন্ধুলান না হওয়ায়, তাকে সমুদ্রে স্থান দেন। একদিন এই মৎস্য মনুকে বলে–‘এখন প্ৰলয়কাল আসন্ন, সবই জলে ডুবে যাবে। আপনি শক্ত রজ্জ্বযুক্ত একখানা নৌকায় সপ্তর্ষিদের নিয়ে বসুন। আমি শৃঙ্গদ্বারা আপনাকে পৰ্বতশৃঙ্গে নিয়ে যাব।’ এইভাবে মনু ও বেদদ্রষ্টা ঋষিরা রক্ষা পান। প্লাবনের পর মানুষের পালনীয় আচার ব্যবহার ও ক্রিয়া কলাপের যথাকর্তব্য নির্ধারণ করে, মনু একখানা সংহিতা প্ৰণয়ণ করেন । সেটাই হচ্ছে মনুসংহিতা ।
পৃথিবীতে দুই রাজবংশ সৃষ্টি হয়—চন্দ্রবংশ ও সূর্যবংশ । চন্দ্রবংশের দুই শাখা–পুরুবংশ ও যদুবংশ । পুরুবংশের এক বিখ্যাত রাজা হচ্ছেন দুষ্মন্ত । একদিন মৃগয়া করতে গিয়ে শ্রান্ত হয়ে তিনি মালিনী নদীর তীরে কন্বমুনির আশ্রমে এসে উপস্থিত হন । সেখানে কন্বমুনির পালিত কন্যা শকুন্তলার সঙ্গে তার প্রণয় হয়। গন্ধৰ্বমতে তিনি শকুন্তলাকে বিবাহ করেন। তঁদের এক বলশালী পুত্র হয়। এই পুত্রের নাম ভরত। ভারতের নাম থেকেই আমাদের দেশের নাম ভারতবর্ষ হয়েছে। ভারতবর্ষ জম্বুদ্বীপের এক অংশ। জম্বুদ্বীপ পৃথিবীর সপ্তদ্বীপের অন্যতম। বাকী ছয়টি দ্বীপ হচ্ছে-প্লক্ষ, শাল্মলী, কুশ, শাক ও পুষ্কর।
।। তিন ।।
দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যে আছে । বৈদিক সাহিত্যে আরও আছে পুরূরবা ও উর্বশীর কথা । শতপথব্রাহ্মণ অনুযায়ী একবার চন্দ্ৰ বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে হরণ করে নিয়ে যায়। তারার গর্ভে চন্দ্রের এক পুত্র হয়। এই পুত্রের নাম বুধ । বুধের সঙ্গে ইলার বিবাহ হয়। ইলার গর্ভে বুধের পুরূরবা নামে এক পুত্র হয়। একবার ইন্দ্ৰসভায় রাজা পুন্ধর বা আহুত হন। সেখানে তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে উৰ্বশী নাচতে নাচতে তার দিকে তাকায় । এতে উর্বশীর তালভঙ্গ হয় । ফলে, ইন্দ্রের শাপে উৰ্বশীকে মর্ত্যে এসে বাস করতে হয় । মর্ত্যে কয়েকটি শর্তে উৰ্বশীর সঙ্গে পুরূরবার মিলন হয়। শর্তগুলি হচ্ছে(১) উর্বশীর সামনে পুরস্কারবা কোনদিন বিবস্ত্র হবেন না, (২) পুরূরবা দিনে তিনবার উর্বশীকে আলিঙ্গন করতে পারবেন। কিন্তু তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্গম করতে পারবেন না, ও (৩) উৰ্বশী বিছানায় দুটি মেষ নিয়ে শয়ন করবে এবং কেউ ওই মেষ হরণ করতে পারবে না । এইভাবে উর্বশী ও পুরূরবা বহুবৎসর পরম সুখে বসবাস করে। এদিকে স্বগের গন্ধৰ্বোরা উর্বশীকে স্বর্গে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় । একদিন বিশ্ববসু নামে এক গন্ধৰ্ব উর্বশীর মেষ দুটি হরণ করে । উৰ্বশী কেঁদে উঠলে, পুরূরবা বিবস্ত্র অবস্থাতেই মেষ দুটি উদ্ধারের জন্য বিশ্ববসুর পিছনে ছুটে যান। সেই সময় আকস্মিক বজ্রপাতের বিদ্যুতালোকে উর্বশী পুরূরিবাকে বিবস্ত্র দেখে তাকে ত্যাগ করে চলে যান । পুরূরবা উর্বশীর সন্ধানে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ান। একদিন কুরুক্ষেত্রের কাছে চারজন অপসারীর সঙ্গে উর্বশীকে স্নানরতা দেখে, তাকে ফিরে যাবার জন্য কান্নাকাটি করেন । অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর উর্বশী এক শর্তে রাজী হন । প্ৰতি বৎসর মাত্র একদিন এসে তিনি পুরূরবার সঙ্গে মিলিত হবেন, এবং তাতেই তঁদের পুত্রসন্তান হবে। এইভাবে মিলিত হয়ে তাঁদের পাঁচটি সন্তান হয়। তারপর উর্বশী পুরূরবাকে জানান যে স্বগের গন্ধৰ্বরা তাকে যে কোন বর দিতে প্ৰস্তুত । পুরূরবা উর্বশীর সঙ্গে চিরজীবন যাপন করতে চান । গন্ধর্বরা পুন্ধরবাকে গন্ধৰ্বলোকে স্থান দেয়। এইভাবে পুন্ধর বা উর্বশীর চিরসঙ্গী হয়ে থাকেন।
।। চাের ৷।
এবার আর এক বৈদিক কাহিনী বলব । সত্যকাম ও জবালার কাহিনী। এই কাহিনী ছন্দোগ্য উপনিষদের চতুর্থ প্ৰপাঠকে আছে। একদিন সত্যকাম বিদ্যার্থী হয়ে গৌতম ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হয় । গৌতম তার পিতার নাম ও গোত্র জানতে চান । সত্যকাম বলে— ‘আমি জানি না, তবে মার কাছ থেকে জেনে আসি ।’ মা জবালা যৌবনে বহুচারিণী ছিলেন। সেই সময় তাঁর গভে সত্যকামের জন্ম হয় । সেজন্য তিনিও সত্যকামের পিতার নাম জানেন না । সত্যকাম মার কাছে এসে প্রশ্ন করলে, মা বলেন–‘তোমার পিতার নাম আমি জানি না । তুমি মহৰ্ষিকে বল, আমি জবালার পুত্র।’ সত্যকাম ফিরে এসে গৌতমকে সেই কথা বলে। তার সত্যবাদিতায় সন্তুষ্ট হয়ে গৌতম তাকে শিষ্যরূপে গ্ৰহণ করে। গৌতম বলেন– ‘ব্রাহ্মণ, তুমি সত্য হতে ভ্ৰষ্ট হও নি। ব্ৰাহ্মণ ভিন্ন কারুর পক্ষে এরূপ সত্যাচারণ কখনও সম্ভব নয় ।’
।। পাঁচ ।।
শ্বেতকেতুর কাহিনী আছে মহাভারতের আদিপর্বে । একদিন শ্বেতকেতু পিতা উদ্দালকের কাছে বসে থাকার সময় একজন ব্ৰাহ্মণ এসে তার মাকে ধরে নিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে যৌনমিলনে প্ৰবৃত্ত হয় । এই দেখে শ্বেতকেতু ক্রুদ্ধ হয় । কিন্তু উদালক তাকে ক্ৰোধ নিবারণ করতে বলেন,–এই বলে ‘স্ত্রীলোকেরা গাভীদের মত স্বাধীন। সহস্ৰ পুরুষে আসক্ত হলেও তাদের অধৰ্ম হয় না। ইহাই সনাতন ধর্ম।’ সেই থেকে শ্বেতকেতু মনুষ্য সমাজে বিবাহ প্রথার প্রচলন করে এবং বলে যে, স্ত্রী স্বামী ভিন্ন অপর পুরুষে উপগত হবে, সে মহাপাপে লিপ্ত হবে ।
মহাভারতের বনপর্বে রাজর্ষি শিবির কাহিনী আছে । একদিন এক ব্ৰাহ্মণ শিবির কাছে এসে বললেন, ‘আমি অন্নপ্রার্থী’, তোমার পুত্র বৃহদগর্ভকে বধ কর, তার মাংস, আর অন্ন পাক করে আমার প্রতীক্ষায় থাক ।’ শিবি তার পুত্রের পক্কমাংস একটি পাত্রে রেখে তা মাথায় নিয়ে ব্ৰাহ্মণের খোঁজ করতে লাগলেন। একজন তাকে বলল, ‘ব্ৰাহ্মণ ক্রুদ্ধ হয়ে আপনার গৃহ, কোষাগার, আয়ুধাগার, অন্তপুর, অশ্বশালা, হস্তিশালা দগ্ধ করছেন।’ শিবি আবিকৃতমুখে ব্ৰাহ্মণের কাছে গিয়ে বললেন, ‘ভগবন, আপনার অন্ন প্ৰস্তুত হয়েছে, ভোজন করুণ ৷’ ব্ৰাহ্মণ বিস্ময়ে অধোমুখ হয়ে রইলেন । শিবি আবার অনুরোধ করলে ব্ৰাহ্মণ বললেন, ‘তুমিই খাও।’ শিবি অব্যাকুলচিত্তে ব্ৰাহ্মণের আজ্ঞা পালন করতে উদ্যত হলেন । ব্ৰাহ্মণ তখন তাঁর হাত ধরে বললেন, ‘তুমি জিতক্ৰোধ, ব্ৰাহ্মণের জন্য তুমি সবই ত্যাগ করতে পার।’ শিবি দেখলেন, দেবকুমারতুল্য পুতগন্ধান্বিত অলঙ্কারধারী তাঁর পুত্র সম্মুখে রয়েছে। ব্ৰাহ্মণ অন্তর্হিত হলেন । তিনি স্বয়ং বিধাতা, রাজর্ষি শিবিকে পরীক্ষা করতে এসেছিলেন ।
।। ছয়।।
সমুদ্রমন্থনের উপাখ্যান রামায়ণের বালকাণ্ডে, মহাভারতের আদিকাণ্ডে ও পুরাণসমূহে আছে । তবে বিভিন্ন গ্রন্থে কাহিনীটির কিছু তারতম্য আছে। রামায়ণ অনুযায়ী অমৃত পান করে অজয়, অমর ও নিরাময় হবার উদ্দেশ্যে অসুর ও দেবতারা সমুদ্রমন্থনে প্ৰবৃত্ত হয়। তারা মন্দর পর্বতকে মন্থনদণ্ড ও বাসুকীকে মন্থন রাজ্জু করে ক্ষীরোদ সমুদ্র মন্থন করতে থাকে। প্ৰথমে বাসুকী বিষ বমন করে । দেবতারা ভীত হয়ে শিবের কাছে ছুটে যায়। শিব ওই বিষ পান করে নীলকণ্ঠ হন । আবার মন্থন আরম্ভ করলে মন্দর পর্বত পাতালে প্ৰবেশ করে । তখন বিষ্ণু কুৰ্মরূপ ধারণ করে মন্দর পর্বতকে পৃষ্ঠে ধারণ করে সাগরতলে শয়ন করেন । হাজার বছর মন্থনের পর ধন্বন্তরির আবির্ভাব হয় । তারপর ওঠে অসংখ্য অপ্সরাগণ ও বরুণের মেয়ে বারুণী বা সুরা । এরপর ওঠে উচ্চৈশ্ৰবা অশ্ব, ও কৌস্তভমনি। সবশেষে ওঠে অমৃত । অমৃতের অধিকার নিয়ে দেবাসুরে ঘোর সংগ্ৰাম হলো, বিষ্ণু মোহিনীরূপ ধারণ করে, ওই অমৃত হরণ করেন । বহু বৎসর যুদ্ধের পর দেবতারা জয়ী হন ও ইন্দ্ৰ ত্ৰিলোকের অধিকারী হন ।
মহাভারত অনুযায়ী ব্ৰহ্মার আদেশে দেবতা ও অসুরগণ সমুদ্রমন্থনে প্ৰবৃত্ত হন । সমুদ্র থেকে ক্ৰমান্বয়ে চন্দ্ৰদেব ও ঘৃত হস্তে লক্ষ্মী, সুরাদেবী, উচ্চৈশ্ৰবা ও কৌস্তভমনি ওঠে। সবশেষে অমৃতভাণ্ড হাতে ধন্বন্তরি ও পরে গজরাজ ঐরাবত ওঠে। কৌস্তভমনি নারায়ণ এবং উচ্চৈশ্ৰবা ও ঐরাবত ইন্দ্র গ্রহণ করেন। এর পরে ওঠে কালকূট বিষ । মহাদেব তা পান করে নীলকণ্ঠ হন । অমৃত ও লক্ষ্মীর অধিকার নিয়ে দেবাসুরের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হয় । নারায়ণ মোহিনীরূপ ধারণ করে, অসুরদের মোহিত করেন । তারপর দেবগণ নারায়ণের হাত থেকে ওই অমৃত গ্ৰহণ করে পান করে । এই সময় রাহু নামে এক দানব দেবতার ছদ্মবেশে অমৃতের কিছু অংশ পান করে। কিন্তু সে গলাধঃকরণ করবার আগেই নারায়ণ সুদৰ্শন চক্র দ্বারা তার কণ্ঠচ্ছেদ করেন ।
যদিও বায়ু ও মৎস্য পুরাণে সমুদ্রমন্থনের উপাখ্যানটা অনুরূপ কাঠামোর ভিত্তিতে রচিত, তা হলেও কোন কোন পুরাণ অনুযায়ী পৃথুরাজার উপদেশে ধরীত্রীকে গাভীরূপ করে, তা থেকে অমৃত উৎপন্ন করে । তারপর দুর্বাসার অভিশাপে ওই অমৃত সমুদ্রগর্ভে পতিত হয় । দেবতারা তখন বিষ্ণুর শরণাপন্ন হয়। তখন বিষ্ণু নিজে কুৰ্মরূপ ধারণ করে মন্দর পর্বতকে পৃষ্ঠে ধারণ করলে দেবতারা বাসুকীকে মন্থনরজ্জ্বরূপে ব্যবহার করে সমুদ্রমন্থন করে অমৃত উদ্ধার করে ।
।৷ সাত ॥
আগের অনুচ্ছেদে পৃথু রাজার উল্লেখ করা হয়েছে। পৃথু বেণ রাজার পুত্র । বেদে পৃথুর উল্লেখ আছে, বেণ অত্যন্ত প্ৰজাপীড়ক রাজা ছিলেন । তাঁর শাসনকালে একের স্ত্রীতে অপরের উপগমন—এই পশুধৰ্ম প্রচলিত হয়। নিজে পুণ্যহীন হলেও পুত্ৰ পৃথুর পুণ্যের কল্যাণে তাঁর স্বর্গ লাভ ঘটে। ব্ৰহ্মা প্ৰমুখ দেবতারা পৃথুকে পৃথিবীর অধিপতি করেন। বেণের আমলে পৃথিবী খাদ্যশস্য ইত্যাদি দ্রব্য থেকে প্ৰজাবর্গকে বঞ্চিত করছিলেন। পৃথ, শরের সাহায্যে পৃথিবীকে আক্রমণ করে । পৃথিবী গো-রূপ ধারণ করে পালিয়ে যায়। পৃথ, তার পশ্চাদ্ধাবন করে। পলায়নে সক্ষম না হয়ে, পৃথিবী পৃথুর শরণাপন্ন হয় । তখন পৃথ, পৃথিবীকে বলেন- ‘তুমি আমার কন্যা হও, ও প্রজাদের জীবিকার ব্যবস্থা কর।’ পৃথিবী বলে যে এর জন্য তাকে দোহন করতে হবে, কিন্তু বৎস না হলে তার দুগ্ধ নিসৃত হবে না । অতঃপর স্বয়ম্বুব মনুকে বৎস কল্পনা করে, পৃথ, স্বহস্তে গো-রূপ পৃথিবীকে দোহন করে। এই দোহনের ফলে, প্ৰজার অন্নলাভ করে আজও জীবনধারণ করছে। মহাভারত অনুযায়ী পৃথু, পৃথিবীকে দোহন করে সপ্তদশ প্রকার শস্য উৎপাদন করেন। পৃথুর কন্যা বলেই পৃথিবী নামের উৎপত্তি ।
।। আট ।।
পুরূরবা ও উর্বশীর কথা আগেই বলেছি। এঁদের এক পুত্রের নাম আয়ু। আয়ুর পুত্ৰ নহুষ। নহুষের ছয় পুত্র, জ্যেষ্ঠ যযাতি নামে প্রসিদ্ধ। যযাতির কথা পরে বলছি । আগে নহুষের কথা বলে নিই। নহুষের কথা মহাভারতের আদি, বন ও শান্তিপর্বে ও পদ্মপুরাণে আছে। নাহুষ অতি পুণ্যবান ও বীর্যবান রাজা ছিলেন। সাধনা দ্বারা তিনি আত্মসংযম অভ্যাস করেছিলেন । ভোগবিলাসে নিরাসক্ত হয়ে, তিনি নিজেকে পুণ্যকর্মে এমনভাবে আত্মনিয়োগ করেন যে একবার ইন্দ্ৰ ব্ৰহ্মহত্যা ও মিথ্যাচারে বৃত্ৰাসুরকে বধ করে যখন জল মধ্যে আত্মগোপন করেন, তখন দেবতা ও মহৰ্ষিরা নহুষকে দেবরাজ করেন । ইন্দ্ৰত্ব পেয়ে নহুষ অত্যন্ত কামপরায়ণ ও অত্যাচারী হয়ে ওঠেন । সেজন্য মহর্ষিরা তাকে আসনচ্যুত করবার পরিকল্পনা করেন । একদিন মহৰ্ষিরা যখন নহুষকে শিবিকায় বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন একসময় তাঁরা শ্ৰান্ত হয়ে নহুষকে প্রশ্ন করেন, ‘বিজয়িশ্রেষ্ঠ, ব্রহ্ম যে গোপ্রন (যজ্ঞে গোবধ ) সম্বন্ধে বলেছেন, তা তুমি প্রামাণিক মনে কর কী না ?’ নহুষ মোহ বশে উত্তর দেন, ‘না, ওই মন্ত্র প্রামাণিক নয়।’ ঋষিরা বলেন, ‘তুমি অধর্মে নিরত, তাই ধৰ্ম বোঝ না । প্ৰাচীন মহর্ষিগণ ওই মন্ত্র প্রামাণিক মনে করেন, আমরাও করি ।’ গোবধ অস্বীকার করার দরুণ নহুষ অভিশপ্ত হয়ে ভূতলে পতিত হন। অপর এক কাহিনী অনুযায়ী ইন্দ্ৰত্ব পাবার পর নহুষ ইন্দ্রের স্ত্রী শচীকে স্ত্রীরূপে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। শচী নহুষকে বলে যে ঋষিবাহিত শিবিকায় যদি নহুষ তাঁর কাছে আসেন, তবেই তিনি নহুষের অনুগামিনী হবেন । শিবিকায় যাবার সময় নহুষ ঋষিদের সঙ্গে মন্ত্র সম্বন্ধে তর্কবিতর্ক ও বিবাদ করতে থাকেন । ওই সময় অগস্ত্য ঋষির মাথায় তাঁর পা ঠেকে । এর ফলে অগস্ত্যের শাপে নহুষ সর্পরূপে বিশাখবনে পতিত হন । নহুষের করুণ প্রার্থনায় অগস্ত্য বলেন যে একদিন যুধিষ্ঠির তঁকে শাপমুক্ত করবেন।
।। নয় ।।
নহুষের ছেলে যযাতির দুই বিয়ে। এক স্ত্রী দেবযানী দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের মেয়ে, আর অপর স্ত্রী শৰ্মিষ্ঠা দৈত্যরাজ বৃষপর্বার মেয়ে । তার মানে ক্ষত্রিয় হয়ে, যযাতি বামুনের মেয়েকেও বিয়ে করেছিল, আবার দৈত্যের মেয়েকেও বিয়ে করেছিল। তবে শুক্রাচাৰ্য যখন দেবযানীর সঙ্গে যযাতির বিয়ে দিয়েছিল, তখন শর্ত করিয়ে নিয়েছিল যে যযাতি শৰ্মিষ্ঠার সঙ্গে সহবাস করতে পারবে না । কিন্তু ঋতুকাল উপস্থিত হলে, শৰ্মিষ্ঠার অনুনয়-বিনয়ে ও দেবযানীর অজ্ঞাতে যযাতি শৰ্মিষ্ঠার গর্ভে এক পুত্র উৎপাদন করেন । দেবযানী পিতা শুক্রাচার্যের কাছে গিয়ে স্বামী ও শমিষ্ঠার বিরুদ্ধে নালিশ করে। শুক্রাচার্য যযাতিকে দুৰ্জয় জরাগ্রস্ত হবার অভিশাপ দেন। তবে যযাতির অনুনয়ে বলেন যে যযাতি অন্যের দেহে নিজের জরা সংক্রামিত করতে পারবে । যযাতি পুত্রদের তার জরা গ্ৰহণ করতে বলেন। দেবযানীর গর্ভজাত দুইপুত্র ও শমিষ্ঠার গর্ভজাত প্ৰথম দুইপুত্র জরা গ্রহণে অস্বীকার করে। মাত্র শৰ্মিষ্ঠার কনিষ্ঠ পুত্র পুরু জরা গ্রহণ করে পিতাকে তার যৌবন দেয়। এক হাজার বৎসর ইন্দ্ৰিয় সম্ভোগের পর যযাতি পুরুকে আবার তার যৌবন ফিরিয়ে দেয় । তারপর কঠোর তপস্যা করে যযাতি স্বর্গ লাভ করে, কিন্তু নিজেকে অতি ধাৰ্মিক মনে করায়, ইন্দ্ৰ তাঁকে স্বর্গভ্ৰষ্ট করে অন্তরীক্ষে ফেলে দেন। যযাতির দৌহিত্ররা মাতামহের এই অবস্থা দেখে তঁদের পুণ্যবলে তাঁকে আবার স্বর্গে পাঠিয়ে দেয়।
যযাতির যে দৌহিত্রদের কথা বললাম, তারা হচ্ছে যযাতির মেয়ে মাধবীর পুত্ৰগণ । মাধবীর উপাখ্যান মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে আছে। একবার বিশ্বামিত্রের শিষ্য গালব বিশ্বামিত্ৰকে গুরুদক্ষিণা দিতে চাইলে বিশ্বামিত্র বলেন, তিনি চাঁদের মত শুভ্ৰ এক কন্যা ও আটশত অশ্ব গুরুদক্ষিণা চান । গালব বিপদে পড়ে, রাজা যযাতির কাছে যায় । যযাতি তাঁর মেয়ে মাধবীকে গালবের হাতে দিয়ে বলেন যে অন্যান্য রাজারা এই মেয়ের শুদ্ধস্বরূপ গালবকে আটশত অশ্বদান করবেন । গালব মাধবীকে নিয়ে প্ৰথমে অযোধ্যার রাজা হর্যশ্বের কাছে যান । হর্যশ্ব মাধবীর গর্ভে বংশুমনা নামে এক পুত্র উৎপাদন করে গালবকে দুইশত অশ্ব দেন । এক ব্ৰহ্মজ্ঞ মুনির বরে মাধবীর কুমারীত্ব বজায় থাকে । তারপর গালব যথাক্রমে মাধবীকে কাশীরাজ দিবোদাস ও ভোজরাজ উশীনরের কাছে নিয়ে যায়। তাঁরা মাধবীর গর্ভে যথাক্রমে প্ৰতদািন ও শিবি-কে উৎপাদন করেন ও গালবকে প্ৰত্যেকে দুইশত অশ্ব দেন। পরে আর অশ্ব পাওয়া না যাওয়ায় গালব বিশ্বামিত্ৰকে ছয়শত অশ্ব ও মাধবীকে দান করেন। বিশ্বামিত্রের ঔরসে মাধবীর অষ্টক নামে এক পুত্র হয়। বিশ্বামিত্র তাকেই ধর্ম, অর্থ ও অশ্বগুলি দান করে মাধবীকে গালবের হাতে দিয়ে বনে গমন করেন । গালব মাধবীকে যযাতির হাতে ফিরিয়ে দেন। পরে যযাতি মাধবীর বিবাহের জন্য এক স্বয়ংবরা সভার আয়োজন করেন । কিন্তু মাধবী সকল রাজকে প্রত্যাখ্যান করে বনে গিয়ে ধর্মপালনে রত হয় ।
।। দশ ।।
শিবি রাজার সত্যপরায়ণতার কথা আগেই বলেছি। এখন বলিরাজার সত্যপরায়ণতার কথা কিছু বলি। বলি ছিলেন দৈত্যরাজ, হরিভক্ত প্রহ্লাদের পৌত্র ও বিরোচনের পুত্র। নিজের তপস্যার দ্বারা ও ইন্দ্ৰাদি দেবতাদের পরাস্ত করে বলি ত্ৰিভুবনের অধীশ্বর হন। রাজ্যচু্যত হয়ে দেবগণ বিষ্ণুর শরণাপন্ন হয়। বিষ্ণু বামণরূপে কশ্যপের পুত্র হয়ে জন্মান ও বলির যজ্ঞানুষ্ঠানে ত্রিপাদভূমি প্রার্থনা করেন । বলি সম্মত হন । কিন্তু দান পাওয়া মাত্র বামণ বিশাল আকার ধারণ করে দুইপদ দ্বারা স্বৰ্গ ও মর্ত্য অধিকার করে, নাভি থেকে নির্গত তৃতীয় পদ রাখবার স্থান বলিকে নির্দেশ করতে বলেন । বলি তার নিজের মাথার ওপর তৃতীয় পদ রাখতে বলেন । এমন সময় পিতামহ প্রহ্লাদ সেখানে উপস্থিত হয়ে বিষ্ণুকে বলির বন্ধন মোচন করার প্রার্থনা জানায়। তার প্রার্থনায় কিষ্ণু বলির বন্ধন মোচন করে, ও তার সত্যপরায়ণতার প্ৰশংসা করে ও দেবতাদের দুগ্ধপ্রাপ্য রসাতলে তার স্থান করে দেন ।
।। এগার ।।
হরিশ্চন্দ্র রাজাও তার দান, ধ্যান ও সত্যপরায়ণতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ঐতরেয়ত্ৰাহ্মণ অনুযায়ী অপুত্ৰক রাজা হরিশ্চন্দ্ৰ পুত্রলাভের জন্য নরমেধ যজ্ঞ করেন। মার্কণ্ডেয়পুরাণ অনুযায়ী রাজা হরিশ্চন্দ্র একদিন মৃগয়ায় বেরিয়ে বনমধ্যে বিশ্বামিত্র মুনির তপস্যার বিঘ্ন ঘটান । তাঁর কৃতকর্মের জন্য বিশ্বামিত্ৰ তার কাছ থেকে দান চাইলেন । বিশ্বামিত্র তার কাছ থেকে দান হিসাবে সোনাদান রাজ্য প্রভৃতি সবই আদায় করে নিলেন । অবশিষ্ট রইল মাত্র তার পরিধেয় বস্ত্র ও স্ত্রী শৈব্যা ও পুত্র রোহিত। কিন্তু বিশ্বামিত্ৰ দক্ষিণা চাইলে, তাঁর আর কিছু না থাকায় তিনি এক ব্ৰাহ্মণের কাছে স্ত্রী শৈব্যা ও পুত্র রোহিতকে বিক্রয় করে দিলেন । পরে তিনি নিজেকেও এক চণ্ডালের কাছে দাসরূপে বিক্রয় করে দিলেন । প্ৰাপ্ত অর্থ তিনি দক্ষিণাস্বরূপ বিশ্বামিত্ৰকে দিলেন । চণ্ডালের দাস রূপে হরিশচন্দ্ৰ শ্মশানে কাজ করতে লাগলেন। এক বছর পরে সর্পাঘাতে রোহিতের মৃত্যু হয় । দাহের জন্য শৈব্যা মৃত পুত্রকে শ্মশানে নিয়ে আসে। সেখানে হরিশ্চন্দ্র ও শৈব্যা পরস্পরকে চিনতে পারে। তখন তাঁরা স্থির করেন, মৃতপুত্রের চিতায় দুজনেই প্ৰাণ বিসর্জন দেবেন। এই সময় দেবতাগণ ও ধর্ম বিশ্বামিত্রের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত হন । হরিশচন্দ্ৰকে তাঁরা সহমৃত হতে নিষেধ করেন। তাঁরা তাকে স্বর্গে নিয়ে যেতে চান । হরিশ্চন্দ্ৰ বলে সে তাঁর প্রভু চণ্ডালের বিনা অনুমতিতে স্বর্গে যেতে পারেন না। তখন চণ্ডাল বলে, তিনিই ধর্ম । রোহিত প্ৰাণ ফিরে পায় । তখন হরিশ্চন্দ্র রোহিতকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে স্বর্গে যান। সেখানে নারদের প্ররোচনায় তিনি আত্মপ্ৰশংসায় রত হন । এর জন্য স্বর্গ থেকে তাঁর পতন ঘটে। কিন্তু পতনের সময় তিনি অনুতপ্ত হওয়ায়, দেবতারা তাঁকে ক্ষমা করেন, কিন্তু তাঁকে অন্তরীক্ষে এক বায়বীয় স্থানে বাস করতে হয়।
।। বার ।।
ত্ৰেতাযুগে স্ত্রী পুরুষ হত, এবং পুরুষ স্ত্রী হত । এই রূপান্তরের কথা রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে বর্ণিত হয়েছে । বাল্হীক দেশে কর্দম রাজার ‘ইল’ নামে এক পুত্র ছিল। একদিন মৃগয়া করতে তিনি কাৰ্তিকের জন্ম স্থানে এসে উপস্থিত হন । সেখানে মহাদেব স্ত্রীরূপ ধারণ করে উমার মনোরঞ্জন করছিলেন । সেখানে সকল প্ৰাণী স্ত্রীত্ব প্ৰাপ্ত হয়েছিল । রাজা ইলও অনুচরবর্গসহ স্ত্রীত্ব প্রাপ্ত হলেন । তখন তিনি মহাদেব ও উমার শরণাপন্ন হন । তাদের প্রসন্ন করাতে তিনি বর পেলেন যে তিনি একমাস পুরুষ হবেন, আবার একমাস স্ত্রী হবেন । প্রথম মাসে রাজা ইল লোকসুন্দরী নারী হয়ে স্ত্রীভাবাপন্ন অনুচরদের সঙ্গে সেই কাননে বেড়াতে লাগলেন। চন্দ্রের পুত্র বুধ সেখানে তপস্যা করছিল। বুধ সেই সুন্দরী ললনাকে দেখে কামবাণে বিদ্ধ হল এবং তাকে বলল ‘আমি ভগবান চন্দ্রের প্রিয় পুত্ৰ, তুমি আমাকে ভজনা কর।’ ‘ভেজস্ব মাং বরারোহে ভক্ত্যা স্নিগ্ধেন চক্ষুসা।’ ( উত্তরকাণ্ড ১০২।৪ ) । তখন বুধ ইলর সহিত রমণে প্ৰবৃত্ত হল । এই ভাবে ইল এক মাস স্ত্রী হয়ে বুধের কামবাসনা পূর্ণ করতেন, এবং একমাস পুরুষ হয়ে ধর্মচর্চায় নিযুক্ত হতেন । এইরূপে আট মাস। গত হলে নবম মাসে ইল পুরুরবা নামে এক পুত্র প্রসব করলেন । পুত্রকে বুধের হতে দিয়ে, ইল অশ্বমেধ যজ্ঞ করল ও মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে পুরুষত্ব পেল ।
।। তের ।।
যোগনিরত ব্ৰহ্মার চক্ষু থেকে নিৰ্গত অশ্রুবিন্দু হতে এক বানরের জন্ম হয়। তার নাম ঋক্ষরজা । এক দিন তিনি সুমেরু পর্বতে এক সরোবরতীরে বসে জলমধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পান, এবং তাকে শত্রু মনে করে তিনি জলে পড়েন ও আবার জল থেকে ওঠেন । অবগাহনের ফলে তিনি এক পরমা সুন্দরী নারীরূপ পান । সেই অনিন্দ্যসুন্দরী বরাঙ্গনাকে দেখে ইন্দ্র ও সূর্য দুজনেই কামবশে পীড়িত হন । ইন্দ্রের বীর্য ঋক্ষরজার বালে ( কেশে ) পতিত হয়, এবং সেই বীর্য থেকে উৎপন্ন পুত্রের নাম হয় বালী, আর সূর্যদেবের বীর্য পতিত হয় ঋক্ষরজার গ্রীবায় এবং সে বীর্য থেকে উৎপন্ন পুত্রের নাম হয় সুগ্ৰীব । বানররূপ ফিরে পেয়ে ঋক্ষরজা। তার দুই পুত্রকে নিয়ে ব্ৰহ্মার কাছে যায়। ব্ৰহ্মা তুষ্ট হয়ে এক দেবদূতের সাহায্যে তাদের কিষ্কিন্ধ্যার রাজপদে অভিষিক্ত করবার জন্য পাঠিয়ে দেন । ব্ৰহ্মার আজ্ঞায় ঋক্ষরজা পৃথিবীর সমস্ত বানরকুলের অধিপতি হন।
বলপূর্বক নারীধর্ষণের অনেক দৃষ্টান্ত আগে দিয়েছি। এখানে আর একটা দৃষ্টান্ত দিব । রাজা ইক্ষাকুর একশত পুত্র ছিল । কনিষ্ঠের নাম দণ্ড । দণ্ড অতিশয় মূঢ় ও মুর্থ ছিল । রাজা তার আচরণে রুষ্ট হয়ে তাকে বিন্ধ্য ও শৈবাল পর্বতের মধ্যে এক রাজ্য দিলেন । দণ্ড সেখানে মধুমন্ত নামে এক নগর স্থাপন করে শুক্রাচার্যের সাহায্যে রাজত্ব করতে লাগলেন । একদা চৈত্রমাসে মহর্ষি শুক্রাচার্যের আশ্রমে গিয়ে তাঁর অসামান্য রূপবতী কন্যা অরজাকে দেখে কামাতুর হয়ে বলপূর্বক তাকে স্পর্শ করতে যায়। অরজা বলে ‘আমি আমার পিতার অধীনা । যদি আপনি আমার প্রতি আসক্ত হয়ে থাকেন, তবে আপনি আমার পিতার নিকট আমার পাণি প্রার্থনা করুন ।’ দণ্ড কামশরে জর্জরিত হয়ে বলে–‘তোমার জন্য আমার হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে, আমি এক মূহুৰ্তও অপেক্ষা করতে পারছি না।’ এই বলে দণ্ড অরজাকে বাহুযুগল দ্বারা বলপূর্বক ধারণ করে মৈথুনে প্ৰবৃত্ত হয়। শুক্রাচার্য আশ্রমে ফিরে এসে কন্যার কাছে সব কথা শুনে ক্ৰোধে প্ৰজ্জ্বলিত হয়ে দণ্ডকে অভিশাপ দেন যে সাতদিনের মধ্যে প্ৰজাসমেত তার সমস্ত রাজ্য ধূলিসাৎ হবে । বিন্ধ্য ও শৈবল পর্বতের মধ্যবর্তী ভূভাগ দণ্ডরাজ্য দণ্ডের অপরাধে শাপগ্ৰস্ত হয়ে এর নাম হয়েছে ‘দণ্ডকারণ্য’ তৎপর তপস্বীগণ এখানে বাস করেন, সেজন্য এর নাম হয় ‘জনস্থান’
।। চোদ্দ ।।
শিবের বীর্যতেজের কথা রামায়ণের আদিকাণ্ডের ৩৫-৩৭ সর্গে বিবৃত হয়েছে। সেই কাহিনী অনুযায়ী হিমবান পত্নী মেনকার গর্ভে দুই কন্যা রত্ন লাভ করেন। — (১) গঙ্গ ও (২) উমা। দেবগণের অনুরোধে গঙ্গাকে তিনি দেবগণকে প্রদান করেন। তাঁরা গঙ্গাকে নিয়ে প্রস্থান করেন, তারপর হিমবান কনিষ্ঠা কন্যা তপস্বিনী উমাকে রুদ্রহস্তে সমর্পণ করেন। মহাদেব বিবাহান্তে উমার সহিত রতিক্রিয়া করতে আরম্ভ করেন। কিন্তু রতিক্রিয়া করতে করতে দেবপরিমিত শতবর্ষ বিগত হলেও সেই দেবীতে কোন পুত্রোৎপাদন হল না (অর্থাৎ শুক্রক্ষরণ হল না)। তখন তখন পিতামহ দেবগণসহ ‘এই বীর্যে যে পুত্রোৎপাদন হবে, তা কে ধারণ করবে ?’ এরূপ বিচার করে মহাদেবের নিকট গমন করে প্রণিপাতপূর্বক বললেন, ‘দেবাদিদেব ! আপনি আমাদের প্ৰতি প্ৰসন্ন হউন ! এই সকল লোক আপনার তেজধারণে সমর্থ নয় ; আপনি ব্ৰাহ্মতপোযুক্ত হয়ে দেবীর সহিত তপস্যা করে ত্ৰৈলোক্যের মঙ্গলের জন্য তেজধারণ করুন এবং সমস্ত লোক রক্ষা করুন ।’ তখন মহাদেব বললেন, ‘সুরগণ ! আমি উমার সহিত স্বীয় তেজেই তেজধারণ করব, তোমরা ও পৃথিবী সকলেই শান্তিলাভ কর। কিন্তু আমার যে অনুত্তম তেজ স্বস্থান হতে বিচলিত হয়েছে তা কে ধারণ করবে, তা নির্দেশ কর ।’ তখণ দেবতারা বললেন, ‘আপনার যে তেজ ক্ষুব্ধ হয়েছে, পৃথিবী তা ধারণ করবে।’ তারপর মহাদেব বীৰ্যত্যাগ করলেন, এবং সেই বীর্যের তেজে পৃথিবী, কানন ও গিরি পরিব্যাপ্ত হল । তখন দেবগণের অনুরোধে অগ্নিদেব পবনদেবের সঙ্গে মিলিত হয়ে সেই রুদ্র-তেজে প্ৰবেশ করলেন, এবং সেই তেজ অগ্নি কর্তৃক ব্যাপ্ত হয়ে পৰ্বত রূপে পরিণত হ’ল । সেই পর্বতে এক শরবন সৃষ্ট হল । সেই শরবনে কার্তিকের জন্ম হল ।
।। পনেরো ।।
মনে হয়, মহিষমৰ্দিনীর উপাখ্যানের সঙ্গে পাঠকরা পরিচিত । রম্ভ নামে এক দুর্দান্ত অসুর মহাদেবকে তপস্যায় প্রীত করে, মহাদেবের বরে এক ত্ৰিলোক বিজয়ী পুত্ৰ পায় । সেই পুত্ৰই মহিষাসুর। ব্ৰহ্মার বরে সে পুরুষের অবধ্য হয় । মহিষাসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হয়। অবধ্য জেনে বিষ্ণু দেবতাদের নিজ নিজ স্ত্রীর সহিত মিলিত হয়ে, সম্মিলিত তেজ থেকে এক অপূর্ব লাবন্যময়ী নারীদেবতা সৃষ্টি করতে বলেন । তাঁরই হাতে মহিষাসুরের মৃত্যু ঘটবে। মহিষাসুরের তিনবার আবির্ভাব ঘটেছিল এবং তিনবারই দেবী ত্ৰিবিধিরূপ ধারণ করে তাকে বধ করেন। প্ৰথমবার দেবী উপচণ্ডী, দ্বিতীয়বারে ভদ্রকালী ও তৃতীয়বারে দূর্গারূপ ধারণ করেন । এ সম্বন্ধে বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন বিবরণ আছে।
৷৷ ষোল ।।
এবার দুই দেবতা সূর্য ও বিষ্ণুর সারথিদের সম্বন্ধে কিছু বলব। সূর্যের সারথি অরুণ ও বিষ্ণুর সারথি গরুড় । অরুণ ও গরুড়ের উৎপত্তি মহাভারতের আদিপর্বে বিবৃত আছে। ঋগ্বেদে আছে ব্ৰহ্মার লোম হতে বালখিল্য নামে অঙ্গুষ্ঠ প্ৰমাণ যাট হাজার ঋষির জন্ম হয় । বালখিল্য ঋষিরা যজ্ঞের জন্য কাঠ আনবার জন্য নিযুক্ত হয় । তারা সকলে মিলিতভাবে মাত্র একটি পত্র বহন করে আনবার সময় জলপূৰ্ণ এক গোস্পদের মধ্যে পড়ে যায় । এই দেখে ইন্দ্ৰ তাদের উপহাস করে । বালখিল্য ঋষির ইন্দ্রের চেয়েও বলশালী অপর ইন্দ্ৰ কশ্যপের শরণাপন্ন হয় । কশ্যপ বালখিল্য ঋষিদের বলেন যে ব্ৰহ্মা ইন্দ্ৰকে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং অপর এক ইন্দ্ৰ সৃষ্টি করলে ব্ৰহ্মার অপমান করা হবে । তবে তাদের মহাযজ্ঞের ফলে ইন্দ্রের পরিবর্তে এক পক্ষিশ্রেষ্ঠ জন্মগ্রহণ করবে। কাশ্যপের স্ত্রী বিনতা ঋতুস্নান করে তাঁর কাছে এলে, তিনি স্ত্রীর মনোবাসনা পূর্ণ করে বলেন যে বালখিল্য ঋষিদের যজ্ঞের ফলে তার গর্ভে দুই বীরপুত্র জন্ম গ্ৰহণ করবে এবং তারা সমস্ত পক্ষীজাতির ওপর ইন্দ্ৰত্ব করবে। এই দুই বীরপুত্রের নামই অরুণ ও গরুড় ।
এই সকল পৌরানিক উপাখ্যানের নৃতাত্ত্বিক ভাষ্যের প্রয়োজন আছে । তবে তা গবেষণা সাপেক্ষ ।
WOW