১৭. পুলিশের কার্‌রবাই

পুলিশের কার্‌রবাই

কোনও বে-কানুনি কারবার যেমন খুন, চুরি, ডাকাতি মানেই পুলিশের আমদানি বেড়ে যাওয়া। একবার এক চৌরাহার মুখে নজরে পড়ল সদ্যোজাত একটি শিশুর লাশ। গোরায়েত (goraet) খবর করতে গেল থানায়। থানেদারকে এত্তেলা করল লাশ মেলার। বাচ্চাটার নাড়িও কাটা নয়; মনে হয় কেউ ইচ্ছে করে ফেলে গেছে। গোরায়েতকে অনেক জেরা করে দারোগাজি যা বুঝলেন তা হল, দৌতলমন্দ সাহু ভবানী কুলবারের বেটা কুলু কুলবার আর বেসুহাগ মুসম্মত লছমনিয়ার বেশ কিছুদিন ধরেই একটা নাজায়েজ রিস্তা ছিল। গোরায়েতের মনে হয় এ জরুর তাদেরই বাচ্চা। বাচ্চার লাশ যেখানে মিলেছে তার থেকে সাহুর মকান কত দূর? স্রেফ পাঁচ ক্রোশ দারোগাজি! ভবানী সাহু কি রেস্তোদার? আলবাত! লাখো রুপিয়া কী দৌলত হবে খোদাবন্দ। জব্বর খানের উপর হুকুম হল, কুলু কুলবার আর লছমনিয়াকে হাজির করানোর। দারোগাজি গেলেন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিপোর্ট করতে। জব্বর খান যখন গেল আসামিদের ধরতে তখন থানেদার সেই মাংসপিণ্ডটা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠিয়ে আর্জি জানাল, “রোজ রোজ এই ভ্রূণহত্যা বেড়েই চলেছে। হুজুরের অজানা নয় তাঁর এই খাদিমের কোনও এক্তিয়ারই নেই তহকিকাত করার যতক্ষণ না হুজুরের হুকুম মিলছে। গোরায়েতের খবর মোতাবেক ফিদবির (fidwee) মনে হয় গুনাহগারদের শনাক্ত করা সম্ভব। ইত্যাদি, ইত্যাদি…” ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিলেন, তহকিকাত জারি রাখ। হস্ব-ই-জাবিতা (husb-i-zabitah)।

কুলু কুলবার আর লছমনিয়াকে তো হাজির করা হল আর লেখাও হয়ে গেল যে তারাই হচ্ছে আসল গুনাহগার। কেবল ওই দু’জন নয় ধরে আনা হয়েছিল এক বুড্ডি চামারিনকেও। এই চিমড়ে বুড্ডির ছিল জড়িবুটির কারবার। একেই বানানো হল এক নম্বর ইশাদি। বুড্ডি শপথ নিয়ে একরার করল যে, ন’মাস আগে লছমনিয়া তাকে খবর করে। তারপর জানতে চায়, তার কাছে এমন কোনও দাওয়াই হবে কী যা দিয়ে তার মহব্বতের নিশান ঢাকা যাবে? ইশাদি তাকে কিছুটা চুরন দেয় আর কিমত হিসাবে সে পেয়েছিল এক টাকা। আসামি লছমনিয়া সাফ জানাল, এটা ঝুঠা ইলজাম আর সেই সঙ্গে আরও বলল, কোনও দাইকে দিয়ে সে নজর আন্দাজ করাতে নারাজ। থানেদার বেয়াকুব ছিল না। সে বুঝে গেল এই সব কাজ জবরদস্তি করে হওয়ার নয়। পরদিন সাহু ভবানী কুলবার থানায় হাজির। থানেদারের সঙ্গে সে একটা রফা করতে চায়। ইশারায় বুঝিয়েও দিল আসলে তার বেটা বেকসুর। “সাহুজি আমি তো পাবন্দ। গোরায়েত কবুল করেছে তোমার বেটা গুনাহগার আর দাই একরার করেছে যে লছমনিয়া তার কাছ থেকে চুরন খরিদ করে। এদিকে ম্যাজিস্ট্রেট হুজুর তো হুকুম দিয়েই রেখেছেন, আসামিদের গ্রেফতার করে চালান করতে হবে। তারপর কানুন কানুনের পথে চলবে। এখান থেকে কাছারি কেবল কুড়ি মাইল রাস্তা। তোমার বেটা আর লছমনিয়া বেকসুর হলে হুজুর আলবাত তাদের খালাস করে দেবেন আর হুজুরের বিচার যে নওশেরওয়ান (Nou sherwan)-এর মতোই মশহুর এতো সবার জানা। সাহু বুঝে নিল এবার কিছু না খসালেই নয়। শুরু হল দারোগার সঙ্গে দরদাম। একশো টাকায় রফা হল তার বেটাকে তখুনি খালাস করা হবে। বহুত আচ্ছা, এই বলে থানেদার হুকুম দিল, কুলু কো আভি ছোড় দো। কুলু আবার লছমনিয়াকে ছাড়া যেতে নারাজ। তাই ভবানী সাহুকে আরও পঞ্চাশ টাকা কবুল করতে হল। আজাদি মেলায় তারা তো খুশ। থানেদারও এক লোটা পানির হুকুম করে আরামের শ্বাস ছাড়াল। আচমকাই থানেদারকে বলতে শোনা গেল, উলহম-দুল-ইল্লালহ! (Ulham-dool-illah)

এরপর জরুর ম্যাজিস্ট্রেট হুজুরের কাছে একটা আর্জি পেশ হল। যেখানে বলা ছিল আসামিদের খিলাফ কোনও ঠোস সাবুদ মেলেনি। আসলে গোরায়েতই হল মুফসিদ (moofsid) যে কুলু আর লছমনিয়ার খিলাফ ঝুঠা ইলজাম আনে। ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুম মোতাবেক বেচারাকে বরখাস্ত করা হল, তারপর গেল নোকরি আর আখেরে যেতে হল হাজত।

কোনও এক জনাব, জাতে ফিরিঙ্গি, লালকান (Lall Cawn) বলে এক ইজ্জতদার জমিদারের বেটিকে ইলোপ করে। জমিদার সেই বেয়াদবি বরদাস্ত করতে না পেরে ছুটল ম্যাজিস্ট্রেটের দরবারে। আর্জি, আভি আভি জারি করতে হবে তল্লাশি পরোয়ানা আর কোতোয়ালকে যেতে হবে সেই ফিরিঙ্গির কুঠিতে। যেখানে আছে তার জানে জিগর শক্কর লব (sukkur lub)। ম্যাজিস্ট্রেটও তার কথামতো একটা কড়া হুকুম জারি করলেন। কোতোয়াল ফিরিঙ্গির কুঠিতে গিয়ে ইজাজত চাইল তল্লাশি চালানোর। সাহেব তাকে খাতির করে নিয়ে গেল কুঠির অন্দরে। হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল পঞ্চাশ মোহরের এক থলি। এবার সাহেব বলতে বসল, “দোস্ত! তুমি হচ্ছ ইমানদার আদমি। তোমার কাছে তল্লাশির পরোয়ানাও আছে। বেশক তুমি শক্কর লবের তল্লাশি চালিয়ে যাও। শুধু খেয়াল রেখ আমার কিমতি বাক্স আর আলমারির যেন কোনও লোকসান না হয়। ওর ভিতরেই তো আমি আমার কিমতি সামান রেখে থাকি।” কোতোয়াল এবার সাক্ষীদের সামনে প্রত্যেকটা কামরার তল্লাশি নিতে শুরু করল। কমসে কম আধা ডজন পাড়াপড়শি তখন সেখানে মজুদ। কিন্তু খোঁজ মিলল না কোনও ঔরতের। সময় মতো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিপোর্টও দাখিল হল। শুধু সেখানে মোহরের কথাটা জিকির (zikar) করা ছিল না। মোহর তো তার উর্দির ভিতর মহফুজ ছিল। কথাটা হল যে সেই ফিরিঙ্গি কি সচমুচ ইলোপ করেছিল? যদি করে থাকে তা হলে তল্লাশির সময় সেই ঔরত ছিল কোথায়? আলবাত সে ওই কুঠিতেই ছিল। শক্কর লব হল এক আনমোল মোতি আর ফিরিঙ্গিও দৌলতমন্দ সওদাগর। কিছুতেই সে ওই খুবসুরত হাসিনাকে খোয়াতে নারাজ। শক্কর লবকে খুব হুঁশিয়ারির সঙ্গে রাখা হয়েছিল একটা কাপড়ের আলমারির ভিতর। কোতোয়াল যা খুলেই দেখেনি!

জেলার নীলকরদের সব থেকে বেশি লোকসান করে গোরু-ছাগল। আহিরদের দেখা যায় গোরু-ছাগলের পাল নিয়ে চরাতে গেছে নীল বোনা জমিতে। বদমাইশির একটা মতলবও থাকে তাদের। চরাতে যাওয়ার সময় এরা সঙ্গে করে নিয়ে যায় ডান্ডা। ইরাদা গোরু-ছাগলকে আটকালে সেগুলোর ইস্তেমাল। মাঝে মাঝেই দুই তরফে লেগে যেত কাজিয়া। এক তরফে আহিররা আর অন্য তরফে নীলকরদের নফর-চাকর। নীলের আবাদ বাঁচাতে ১৮৩২ সালে পাশ হয় এক খাস আইন। কিন্তু সেই আইনেও যে নীলকরদের সবসময় সুবিধা মিলত তাও না। থানেদারদের নিয়মমাফিক বখশিশ দিলে তারা জবরদস্তি চালাত আম আদমির উপর আর বখশিশ না মিললে তারাই খাড়া হয়ে যেত নীলকরদের খিলাফ। একবার একটা খুব মজাদার কিস্‌সা শুনেছিলাম। আমার পাঠকদের আমি সেটা শোনাতে চাই। এক নীলকর তার আবাদে গোরু-ছাগল ঢুকে পড়ায় মহা খাপ্পা। সেগুলোকে ধরে সে পাঠিয়ে দিল থানায়। থানেদারের সঙ্গে তার দহরম-মহরম না থাকায় খালাস হয়ে গেল গোরু-ছাগলের পাল। সেই নীলকর একদিন ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে বসে বড় হাজরি সারছে, তখন জানতে চাইল, তার জমিতে চরতে আসা গোরু-ছাগলের উপর গুলি চালালে কী হবে? মৌত না হলে কিছুই হবে না, জবাব দিলেন হুজুর। যদি ল্যাংড়া বানিয়ে দিই? জরুর সাজা মিলবে। ওহঃ! তবে ওগুলোর ল্যাজ ছেঁটে দিলে কেমন হয়? সেটা করতেই পার, তাতে তো কারও কোনও লোকসান নেই। থানেদার এর কিছুদিন পর ম্যাজিস্ট্রেট হুজুরের কাছে একটা নালিশ রুজু করল। নীলকর সাহেব নাকি কুড়িটা গোরুর ল্যাজ ছেঁটে থানায় পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন তার উপর কী হুকুম। ম্যাজিস্ট্রেট হুজুর জানালেন, গোরুগুলো তাদের মালিকের কাছে পাঠিয়ে দাও। সেইদিনই একটা চিঠি এল তাঁর কাছে। নীলকর দাওয়াত পাঠিয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট আর তার ইয়ার দোস্তরা সব জমা হলে পরিবেশন করা হল বাটি ভরা সুরুয়া। সবাই সেদিন খানার খুব তারিফ করলেন যার ভিতর খোদ ম্যাজিস্ট্রেটও একজন।

এর দিন কয়েক পর নীলকর সাহেবের নামে সমন এল ফৌজদারি আদালতের। অভিযোগ গোরুদের জখম করা। নীলকর হাজির হল আদালতে। অভিযোগ কবুল করে জানাল, হ্যাঁ সেই কেটে নিয়েছে গোরুর ল্যাজ। কারণ নীলের আবাদ বরবাদ করছিল গোরুগুলো। সওয়াল উঠল অতগুলো ল্যাজ দিয়ে সে কী করল। জবাব মিলল, গোরুর ল্যাজ ছাটাই করাটা কোনও বেয়াদবি হতে পারে না। বিশেষ করে আহিররা যখন সেগুলো মুচড়ে মুচড়ে তাদের তকলিফ দেয় তার সঙ্গে তুলনা করলে। সে তো গোরুগুলোকে ওরকম তকলিফের হাত থেকে কেবল ছুটকারা দিয়েছে আর যদি সওয়াল গোরুর ল্যাজ হয় তা হলে সেদিনের চেয়ে ভাল অক্সটেল সুপের স্বাদ আগে কেউ পরখ করেনি। ম্যাজিস্ট্রেট তার জবাব শুনে হেসে উঠলেন। খারিজ হল মামলা।

১. মহফুজ: সুরক্ষিত, নিরাপদ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *