পরপর তিন কাপ চা খেয়ে ফেলল বাকের।
সে বসেছে জলিল মিয়ার স্টলে। দৃষ্টি এগার নম্বরের বাড়িটির দিকে। কম্পাউন্ডওয়ালা বাড়ি। এক মাস হল ভাড়া দেয়া হয়েছে। সন্দেহজনক ভাড়াটে। নজর রাখতে হচ্ছে সে জন্যেই। তার একটা দায়িত্ব আছে। চোখের সামনে বেচাল কিছু হতে দেয়া যায় না। এটা ভদ্রলোকের পাড়া। সবাই ফ্যামিলি ম্যান। ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাস করে। এলেবেলে কেউ না।
বাকের হাতের ইশারায় জলিল মিয়াকে ডাকল। জলিল মিয়া ক্যাশ সামলাচ্ছিল। সকাল বেলাটা বিজনেসের আসল সময়। ক্যাশ ফেলে হুঁট করে উঠে আসা যায় না। কিন্তু না গিয়েই বা উপায় কি? বাকের ভাই ডাকছেন। জলিল মিয়া বহু কষ্টে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলল। বিনীত একটা ভঙ্গি করে বলল, কি বাকের ভাই?
কাছে আসতে বললাম। এক মাইল দূরে থেকে কি বাকের ভাই? তাড়াতাড়ি আসেন। প্রাইভেট কথা আছে।
জলিল মিয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করে উঠে এল। বাকের গলার স্বর খাদে নামিয়ে ফেলল।
এগার নম্বর বাড়িটার ব্যাপার কি?
জানি না তো বাকের ভাই।
ভাল করে দেখলে কি মনে হয়।
জলিল মিয়া তাকাল এগার নম্বর বাড়ির দিকে। কিছুই বুঝতে পারল না। আর দশটা বাড়ির মতই। আলাদা কিছু না। নতুন রঙ করা হয়েছে এই যা।
বোঝা যায় কিছু?
জি না।
একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে না, বাড়ির সামনে? কালো রঙের।
হুঁ, তা আছে।
বোঝা যায় কিছু?
জি না।
চোখ-কান বন্ধ করে দোকান করেন, বোঝা যাবে কি? চোখ দু’টি খুলে পকেটে রেখে দিলেই হয়। সেইটাই ভাল। ব্যবহার যখন হয় না।
জলিল মিয়া এটাকে রসিকতা মনে করে হাসতে চেষ্টা করল। বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে না কি রিকশা দাঁড়িয়ে আছে তা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় তার নেই। একদল চোর নিয়ে দোকান চালাতে হচ্ছে। এদিক-ওদিক তাকাবার সময় কি আছে? চায়ের সন্টল করতে গেলে ম্যানেজারের দশটা চোখ থাকতে হয়। তাকিয়ে থাকতে হয় দশ দিকে। তার দু’টা মাত্র চোখ।
বাকের ভাই আমি যাই। ক্যাশ খালি।
বাকের সে কথার জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়াল। কালো গাড়িটার মালিক বের হয়ে আসছে। লোকটার ওপর চোখ রাখা দরকার। লোকটা মুশকো জোয়ান। চকচকে একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে আছে। তাকে বিদেয় দিতে আঠার-উনিশ বছরের একটা মেয়ে গেটের বাইরে এসেছে; খুব হাত নাড়ছে। লোকটা গম্ভীর।
বাকের এগিয়ে গেল। তার হাতে সিগারেট। মেয়েটাকে কাছ থেকে দেখা দরকার। দুই বোন এবং এদের মা থাকে এ বাড়িতে। মেয়েদের বাবা থাকে ইরান অথবা ইরাকে। বাড়িওয়ালা তাই বলল। পয়সাওয়ালা ফ্যামিলি। এক বছরের ভাড়া অ্যাডভান্স দিয়েছে। এতেই বাড়িওয়ালা খুশি। এদের নজর শুধু টাকার দিকে। টাকা ঠিকমত পেলেই হল। অন্য কিছু দেখবে না।
বাকের গেটের কাছে পৌঁছবার আগেই মেয়েটি ভেতরে ঢুকে গেল। চিমশে ধরনের এক বুড়ো এসে গেটে তালা লাগিয়ে দিল। এটাও সন্দেহজনক। সব সময় গেটে তালা থাকবে কেন? তাছাড়া বুড়োর ধরন-ধারণাও কেমন কেমন। মাটির দিকে তাকিয়ে হাটে। কারো চোখের দিকে তাকায় না। মনে পাপ আছে নিশ্চয়ই। বাকেরের সঙ্গে এক’দিন অল্প কিছু কথা হয়েছে।
বুড়ো বাজার করে ফিরছিল। দুহাতে দুটো ব্যাগ। ব্যাগের ভারে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। রীতিমত ঘামছে। বাকের এগিয়ে গিয়ে বলল, কেমন আছেন ভাই?
বুড়ো দারুণ চমকে উঠল। হাত থেকে বাজারের ব্যাগ পড়ে যাবার মত অবস্থা। ব্যাগ নামিয়ে কপালের ঘাম মুছল।
গোটা বাজারটাই কিনে এনেছেন দেখি। এত কি কিনলেন?
আমাকে বলছেন?
আপনাকে ছাড়া আর কাকে বলব? আর কেউ কি আছে। আশপাশে? এত বাজার যে–ব্যাপার কি? পার্টি-ফার্টি নাকি?
সপ্তাহের বাজার।
চলে যাচ্ছেন কেন? দাঁড়ান দুটো কথা বলি। এই পাড়ায় নতুন এসেছেন আলাপ-পরিচয় হয় নাই। আমার নাম বাকের। নেন সিগারেট নেন।
আমি সিগারেট খাই না। অন্যদিন আপনার সঙ্গে কথা বলব। আজ আমার একটু তাড়া अজি।
নামটা বলে যান।
জোবেদ আলী।
মেয়ে দু’টির কে হন। আপনি?
চাচা। দূর সম্পর্কের চাচা।
জোবেদ আলী হাঁটা ধরল। এবং দুবার পেছন ফিরে তাকাল। চোখের দৃষ্টি মাছের মত। খুবই সন্দেহজনক।
তালাবদ্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বাকের দ্বিতীয় সিগারেটটি ধরাল। সাড়ে দশটা বাজে। চড়াচড় করে রোদ বাড়ছে। রোদের মধ্যে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। সানগ্নাস সঙ্গে নেই। মাথা ধরে যাবে। বাকের গেটের ভেতর উঁকি দিল। বাড়িটা ভাল সাজিয়েছে। ফুলের টব দিয়ে ছয়লাব করে ফেলেছে। একটা কুকুরও আছে। এ পাড়ায় কুকুরওয়ালা বাড়ি তাহলে দু’টা হল। বদরুদ্দীন সাহেবের বাড়িতেও কুকুর আছে। সেই কুকুরটা অবশ্যি দেশী। এদেরটার মত না। এই বাড়ির কুকুরটা উলের বলের মত, দেখলেই লাথি দিতে ইচ্ছা করে। এক’দিন নিৰ্ঘাৎ লাথি বসাবে। এখনই পা নিশপিশ করছে।
বাকের দেখল মুনা হনহন করে যাচ্ছে। আজও সে দেরি করল অফিসে যেতে। রিকশা পেতে আরো আধঘণ্টা লাগবে। অফিসে পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে এগারটা বেজে যাবে। কেউ অবশ্যি কিছু বলবে না। মেয়ে মানুষ হয়ে জন্মানোর অনেক অসুবিধা আছে।
মুনা। এই মুনা।
মুনা থমকে দাঁড়াল।
অফিসে যাচ্ছে নাকি?
হ্যাঁ।
চল, রিকশা ঠিক করে দেই।
রিকশা আমি নিজেই ঠিক করতে পারব।
চল না, আমার চেনা রিকশাওয়ালা আছে। হাফ ভাড়ায় নিয়ে যাবে।
বাকের সঙ্গে সঙ্গে আসতে লাগল। মুনা কিছু বলল না। বলে লাভ নেই। সে আসবেই। সারা পথ বকবক করতে করতে মাথা ধরিয়ে দেবে।
এগার নম্বর বাড়ির ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছ?
কি ব্যাপার?
দু’টি মেয়ে মাকে নিয়ে একা থাকে।
তাতে অসুবিধা কি?
না কোনো অসুবিধা নাই। মেয়েগুলি স্কুল-কলেজ কোথাও যায় না বাড়িতেই থাকে। গাড়ি করে নানান কিসিমের লোকজন আসে প্রায়ই। আজ সকালেই একজনকে দেখলাম।
পরের ব্যাপার নিয়ে এত মাথা ঘামান কেন, বাকের ভাই?
বেচাল কিছু কিনা তাই ভাবছি। পাড়ার একটা ইজতের ব্যাপার আছে না? ভেসে যেতে দেয়া যায় না।
পাড়ার ইজ্জতের দায়িত্বটা আপনাকে দিল কে?
না, তা না। দায়িত্ব কিছু না।
বাকের খানিকটা বিষগ্ন হয়ে পড়ল। মুনার সঙ্গে দেখা হলেই তার এ রকম হয়। মন কেমন খারাপ হয়ে যায়। বাকের ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে রিকশার খোঁজে। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল। এই সময় রিকশা পাওয়া মুশকিল। বড় রাস্তা পর্যন্ত যেতে হবে।
মুনা অফিসে ঢুকতেই পাল বাবু বললেন, আজ এত দেরি করলেন যে? বড় সাহেব তিনবার আপনাকে খোঁজ করেছেন। যান। তাড়াতাড়ি যান। ভাল একটা এক্সকিউজতৈরি করুন। বলবেন রিকশা এক্সিডেন্ট হয়েছে। মুনা হাসল। বড় সাহেব কাউকে ডাকলেই পাল বাবু অস্থির হয়ে পড়েন। কত রকম অদ্ভুত সাইকোলজি থাকে মানুষের। বেশির ভাগ মানুষই কি অন্যের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায়? পাল বাবু উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, যান। অপেক্ষা করছেন কেন?
যাচ্ছি।
যাচ্ছি বলেও মুনা তার চেয়ারে বসল। টেবিল ভর্তি ফাইল। একটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিমছাম টেবিল বোধ হয় তার কখনো হবে না। রোক একগাদা ফাইল জমা হয়ে থাকবে। বড় বড় ফিগার ভর্তি ফাইল। প্রতি পাতায় দশটা করে ভুল থাকবে। ক্যালকুলেটর টিপে টিপে ফিগার চেক করতে করতে মাথা ধরে যাবে এবং বমি বমি ভাব আসবে। কুৎসিত ব্যাপার। পাল বাবু বললেন, আবার বসে পড়লেন কেন?
শরীরটা বিশেষ ভাল না পাল বাবু। ফাইল দেখে মাথা ঘুরাচ্ছে। বমি আসছে। মনে হচ্ছে বমি করে দেব।
মুনা মুখ বিকৃত করল।
স্যারের সঙ্গে দেখা করে আসেন। তারপর রেস্ট নেন। এক গ্লাস লেবুর সরবত খান। শরীর ফ্রেশ হয়ে যাবে। ভিটামিন সি আছে। খুব এফেকটিভ। যান যান দেরি করবেন না, স্যারের সঙ্গে ঝামেলাটা সেরে আসুন। আমি সরবতের ব্যবস্থা করছি।
ঝামেলা করতে হবে না। আমি অফিসে বেশিক্ষণ থাকব না। এক্ষুণি চলে যাব।
কেন?
বলেছি তো আপনাকে, আমার শরীরটা ভাল না। মাথা ঘুরছে।
বড় সাহেব কাকে যেন টেলিফোন করছিলেন। হাত ইশারা করে মুনাকে বসতে বললেন। টেলিফোন নিশ্চয়ই খুব ব্যক্তিগত। তিনি নিচু গলায় কথা বলছেন এবং মনে হচ্ছে মুনার উপস্থিতিতে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছেন। মুনার একবার ইচ্ছে হল বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু বড় সাহেব হাত ইশারা করে বসতে বলেছেন। মুনা ইতস্তত করতে লাগল। কথাবার্তা শুনতে ইচ্ছে করছে না, তবু শুনতে হচ্ছে। অফিসের এত বড় একজন মানুষ কেমন অসহায় গলায় কার যেন রাগ ভাঙবার চেষ্টা করছেন। নিশ্চয়ই তার স্ত্রীর।
বসুন। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
মুনা বসল। এই লোকটির অফিসে অনেক বদনাম আছে। কিন্তু মুনা কোনোটিই বিশ্বাস করে না। তার ধারণা ছোটখাটো এই মানুষটি নিতান্তই ভাল মানুষ। শুধু ভাল না, বেশ ভাল।
মিস মুনা!
জি।
ব্যাপার কি বলুন তো? তিন মাসের ছুটি চেয়েছেন।
আমার স্যার ছুটি পাওনা আছে।
সে তো সবারই আছে। আমারও হিসেব করলে এক বছরের ছুটি পাওনা হবে। তাই বলে কি আমি এক বছরের ছুটি নেব? বলুন?
মুনা জবাব দিল না। তার ধারণা ছিল ছুটি দিতে তিনি আপত্তি করবেন না।
মিস মুনা আপনার কি শরীর খারাপ?
জি না স্যার। শরীর ভালই।–
তাহলে এত লম্বা ছুটি দিয়ে কি করবেন? আপনার মামার চাকরি সংক্রান্ত যে ঝামেলা ছিল তাও তো মিটে গেছে বলে আমার ধারণা। মেটেনি?
জি মিটেছে।
বড় সাহেব সিগারেট প্যাকেট নাড়াতে নাড়াতে বললেন, মেটারনিটি লিভ ছাড়া এত লম্বা ছুটি কখনো দেয়া হয় না। বুঝতে পারছেন? তবে বিয়ে-টিয়ের কোনো ব্যাপার হলে মাস খানেক ছুটি নিন।
বিয়ে-টিয়ের কোনো ব্যাপার নয় স্যার।
ও আচ্ছা।
স্যার আমি তাহলে উঠি?
ঠিক আছে যান। অফিসে কি রকম কাজের চাপ বুঝতেই পারছেন। ইয়ার এন্ডিং। নিশ্চয়ই আপনার টেবিলে দশ-পনেরটা ফাইল পড়ে আছে। আছে না?
জি আছে।
বড় সাহেব ফাইলপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মুনা খুব মন খারাপ করে তার টেবিলে ফিরল। সে ধরেই নিয়েছিল আজ তার ছুটি হবে। এতটা আশা উচিত হয়নি। কেন সে করল কে জানে।
টেবিলে কি ফাইলের সংখ্যা আরো বেড়েছে? মুনা শুকনো মুখ করে তার চেয়ারে বসতেই পাল বাবু বিশাল এক গ্লাস লেবুর সরবত নিয়ে এলেন। সেটা দেখা মাত্র গা গুলাতে শুরু করল।
নিন এক চুমুকে খেয়ে ফেলুন। হেভি ট্রাবল হয়েছে জোগাড় করতে। লেবু কিনে এনে বানানো। ক্যান্টিনওয়ালাকে এক টাকা দিয়েছি চিনির জন্য। তাও ব্যাটা দিতে চায় না। যত ছোটলোক এসে জড় হয়েছে। নিন খান। চুমুক দিন।
রেখে দিন আপনি। আমি ধীরে-সুস্থে খাব। এখন ইচ্ছে করছে না।
মুনা দুপুর পর্যন্ত একনাগাড়ে কাজ করল। একটা থেকে লাঞ্চ ব্ৰেক। লাঞ্চ ব্রেকের কিছু সময় আগেই সেকশনাল ইনচার্জ মতিন সাহেব এসে বিরস মুখে বললেন, আপনি কি ছুটির দরখাস্ত করেছিলেন? মুনা মাথা নাড়ল। মতিন সাহেবের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল নয়। কথাবার্তা তেমন হয়। না।
ছুটির দরখাস্ত তো আমার মাধ্যমে যাওয়ার কথা, আপনি সরাসরি করেছেন কেন? ব্যাপার কি?
আপনি ঐ দিন ছিলেন না–তাই।
ঐদিন ছিলাম না, পরে এসেছি তো। নিখোজ তো হয়ে যাইনি। অফিসের একটা ডেকোরাম আছে। আইন-কানুন আছে। সে সব মানা উচিত। নাকি আপনি মনে করেন উচিত না?
মুনা কিছু বলল না। আশপাশের সবাই তাকাচ্ছে। টাইপিস্ট দু’জন টাইপ বন্ধ করে কাগজপত্র নাড়াচাড়া করছে। মতিন সাহেবের কথা শোনার জন্য টাইপ বন্ধ করার প্রয়োজন ছিল না। তিনি বেশ উঁচু গলাতেই কথা বলছেন। ইচ্ছে করেই বলছেন। সবাইকে শোনাতে চান।
মিস মুনা।
জি স্যার।
বড় সাহেবের সাথে আপনার ব্যক্তিগত পরিচয় থাকতে পারে। শুধু আপনার কেন অনেকেরই থাকতে পারে তার মানে এই না যে, সামান্য ব্যাপারেও তার কাছে যেতে হবে। ভবিষ্যতে এটা দয়া করে মনে রাখবেন। প্লিজ।
মুনার চোখ ভিজে উঠল। সে কি বলবে ভেবে পেল না। সরি বলবে না চুপ করে থাকবে? মতিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। একটা টাইপ করা কাগজ এগিয়ে দিলেন তার দিকে। থমথমে গলায় বললেন, এই নিন। অর্ডার। বড় সাহেব আপনাকে দুমাসের ছুটি মঞ্জর করেছেন। যান বাড়ি গিয়ে ঘুমান। কাজের সময়টাতে যদি আপনাদের ছুটির দরকার হয় তাহলে অফিস খোলা রাখার মানে কি? সব বন্ধ করে দিলেই হয়।
মতিন সাহেব কি বলছেন না বলছেন তা মুনার কানে ঢুকছে না। সে টাইপ করা অর্ডারটি দ্বিতীয়বারের মত পড়ছে–স্বাস্থ্যগত কারণে আপনাকে দুমাসের ছুটি মঞ্জর করা হল। আপনি ছুটিতে যাবার আগে আপনার দায়িত্ব ডিলিং সেকশনের জুনিয়র এসিসটেন্ট জনাব রকিবউদ্দিন ভুইয়াকে বুঝিয়ে দিয়ে যাবেন।…
অফিস থেকে বেরুতে পাঁচটা বেজে গেল। পাল বাবু সঙ্গে এলেন রিকশা খুঁজে দেবার জন্যে। আসল কারণ অবশ্যি দুমাস ছুটি নেবার রহস্যটা জানা। এত কৌতূহল মানুষদের? মানুষের কৌতূহল যদি কিছু কম থাকত তাহলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর হত। কিংবা কে জানে হয়ত কৌতূহল আছে বলেই হয়ত পৃথিবী সুন্দর।
হঠাৎ ছুটি নিলেন ব্যাপার কি?
এমনি নিলাম।
আমরা আরো ভাবলাম বিয়ে-টিয়ের ব্যাপার।
না। ঐ ব্যাপার হলে আপনারা জানতেন। জানতেন না?
অবশ্যি ঠিক। ওদের সেই কথাই বলেছিলাম।
কাদের?
কলিগদের। সবাই জিজ্ঞেস করছিল।
মুনা রিকশায় উঠে পড়ল। ঝকঝকে সুন্দর আকাশ। অপরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাটে লোকজন গিজগিজ করছে কিন্তু আকাশটা কি নির্জন কি পরিষ্কার। মুনার বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। একা একা ঘুরতে ইচ্ছা করছে। কালও অফিস থেকে ফিরে একা একা বেশ খানিকক্ষণ ঘুরেছে। শাহবাগের একটা দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেস্ট্রি কোক খেয়েছে। আজও কি সে রকম করবে? নাকি যাবে মামুনের কাছে? এক’দিন না এক’দিন তো যেতেই হবে। আজই সে দিন হতে অসুবিধা কি? এখন অবশ্যি তাকে পাওয়া যাবে না। অপেক্ষা করতে হবে সন্ধ্যা পর্যন্ত। কিংবা কে জানে হয়ত পাওয়া যাবে। না পাওয়া গেলেও কোনো ক্ষতি নেই।
মামুন অবাক হয়ে বলল, বিশ্বাস হচ্ছে না। তুমি এসেছি। আমার ধারণা ছিল তুমি কোনোদিনই আসবে না। তোমাকে শান্ত করবার জন্যে আমাকেই যেতে হবে। রাগ ভাঙাতে হবে। তোমার নেচার তো জানি। আজই যাব ভেবেছিলাম।
যাওনি তো।
না। যাইনি। সাহস হয়নি। তোমাকে কি বলর, কিভাবে ক্ষমা চাইব। তাই ভাবছিলাম ক’দিন ধরে। মারাত্মক মেন্টাল প্রেসার গেছে। এই ক’দিন ধরে। ইউ কেননট ইমাজিন।
এখন কি প্রেসারটা কমেছে?
হ্যাঁ কমেছে। যখন তুমি বলবে। আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ তখন পুরোপুরি কমে যাবে। এক মিনিট ব্যস, আমি আসছি।
কোথায় যাচ্ছে?
চা-টা দিতে বলি। যাব। আর আসব। রিল্যাক্স কর।
মামুন চটি ফটফট করতে করতে খুব ব্যস্ত ভাবে নিচে নেমে গেল। নেমে যাওয়ার ভঙ্গি কত সহজ কত স্বাভাবিক। মুনা নিজের মনেই খানিকক্ষণ হাসল। একটি দশ-এগার বছরের ছেলে কৌতূহলী হয়ে উঁকি দিচ্ছে। নতুন কাজের ছেলে বোধহয়। এই মেসে দু’দিন পরপরই নতুন কাজের ছেলে আসে। কিছুদিন থাকে তারপর কোনো-এক বোর্ডারের জিনিসপত্র চুরি করে চলে যায়। একবার মামুনের জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে গেল। ঐ ছেলেটার নাম ছিল রাখাল। মুনার সঙ্গে ভালই খাতির ছিল। তাকে আসতে দেখলেই ছুটে মামুনকে খবর দিত। মামুন যখন থাকত না সে ঘর খুলে দিত। মেঝেতে বসে গল্প করত।
রাখাল কি কারো নাম হয়? তুই তো আর গরু, চড়াস না যে নাম থাকতে হবে রাখাল?
আপা কি করমুকন। বাপ-মায় রাখছে।
হিন্দুদের রাখাল না থাকে। কিন্তু মুসলমান। নামটা বদলানো দরকার বুঝলি? সুন্দর রেখে একটা নাম দেব তোর। ঠিক আছে?
জি আইচ্ছা!
মুনা ভেবে রেখেছিল তারা যখন নতুন বাসা করবে তখন রাখালকে মেস থেকে নিয়ে নেবে। যেখানে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করে সেখানে একটি চটপটে কাজের ছেলে দরকার। বাজার করবে, রান্না করবে, বাড়ি পাহারা দেবে।
চেহারা দেখে মানুষকে বোঝা বোধ হয় খুব মুশকিল। এই রাখাল যে এই কাণ্ড করবে। কে জানত।
মামুন একগাদা খাবার-দাবার এনেছে। ডালপুরি, পেঁয়াজু। ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা।
মুনা চা খাও। নিজে ঢেলে নাও। বেশ লাগছে খেতে। মামুন তার বিছানায় পা তুলে বসেছে। মাঝে মাঝে পা নাড়াচ্ছে। পা নাচান দেখতে ভাল লাগে না। আগে অনেকবার মামুনকে সে পা নাচাবার জন্যে বকা দিয়েছে। আজ কিছুই বলল না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
মুনা!
বল।
তুমি আসায় আমি যে কি পরিমাণ খুশি হয়েছি তা তোমাকে বোঝানো মুশকিল। যা দুশ্চিন্তা করছিলাম। ঐ দিনের ব্যাপারটার জন্যে আমি খুব দুঃখিত।
দুঃখিত?
হ্যাঁ। দুঃখিত। লজ্জিত। অনুতপ্ত। ব্যথিত।
এত কিছু একসঙ্গে?
মামুন লক্ষ্য করল, মুনা চা খাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার মুখ ভাবলেশহীন। যেন সে তার কোনো কথা শুনতে পাচ্ছে না। তাকিয়ে আছে দূরে কোথাও।
মুনা।
মুনা তাকাল তার দিকে, জবাব দিল না। মামুন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ঐ দিনটার ঘটনা আমি জাস্টিফাই করতে অনেক চেষ্টা করেছি। দেখ মুনা, আমাদের বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে আছে। আমবা দুজনে মিলে একটা বাড়ি ভাড়া করেছি। ঘর সাজাবার জিনিসপত্র কিনেছি। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা হয়নি। কিন্তু ধরতে গেলে আমরা স্বামী-স্ত্রী। ঠিক না? বল তুমি, অ্যাম আই রাইট?
মুনা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল। মামুন তা লক্ষ্য করল না। যেন সে ক্লাসে বক্তৃতা করছে এমন ভঙ্গিতে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলতে লাগল, দেখ মুনা, ঐদিন আশপাশে কেউ ছিল না। তুমি এবং আমি। হঠাৎ আমার বুদ্ধিাশুদ্ধি গুলিয়ে গেল। তুমি ব্যাপারটা কি ভাবে নেবে কিছুই ভাবলাম না। মানে…।
থাক আমি শুনতে চাই না।
শুনতে না চাওয়াই ভাল। আমিও বলতে চাই না। তার চেয়ে ভাবা যাক এ জাতীয় কিছু কখনো আমাদের মধ্যে হয়নি, ওটা ছিল একটা দুঃস্বপ্ন।
মুনা তীক্ষু চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মামুনের কেন জানি মনে হল চোখ দু’টিতে কোনো প্ৰাণ নেই। পশুর চোখের মত চোখ। যেখানে আবেগের ছায়া পড়ে না।
মুনা! তুমি কি আমাকে ক্ষমা করেছ?
ক্ষমা চাও তুমি?
হ্যাঁ চাই। ক্ষমা চাব না মানে? কি ভাব তুমি আমাকে, পশু?
না পশু ভাবি না। মানুষই ভাবি।
তাহলে বল তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ।
ঠিক আছে করলাম। এখন আমি উঠব।
পাগল, এখনি উঠবে মানে? রাত আটটা পর্যন্ত থাকবে। তারপর আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব এবং তোমাদের বাসায় রাতে খাব। তোমার মামার সঙ্গে কথা বলে বিয়ের ডেট ফাইনাল করব। বিয়েটা এক সপ্তাহের ভেতর সেরে ফেলতে হবে। এমনিতেই যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে।
মামুন অবাক হয়ে দেখল মুনা উঠে দাঁড়াচ্ছে। সে কি সত্যি চলে যাবে? মামুন হাত ধরে তাকে টেনে বসাতে গেল। মুনা কঠিন স্বরে বলল, হাত ছাড়। মামুন হাত ছেড়ে দিল। মুনা নিচু গলায় প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, আমি এখানে এসেছিলাম একটা কথা বলবার জন্যে। কথাটা হচ্ছে তোমাকে আমি বিয়ে করব না।
কি বলছি পাগলের মত?
যা বলছি ভেবেচিন্তেই বলছি। আমি এক সপ্তাহ ধরেই ভাবছি। আজ তোমাকে বললাম।
সামান্য একটা অ্যাকসিডেন্টকে তুমি এত বড় করে দেখছি কেন? ভিক্টোরিয়ান যুগের কোন মহিলা তো তুমি না। এ কালের মেয়ে এ যুগের মেয়ে।
আমি কোন যুগের মহিলা জানি না। যে কথাটা বলতে এসেছিলাম বলে গেলাম।
শোন মুনা, শোন আমার কথা শোন। ছেলেমানুষির একটা সীমা থাকা দরকার। আমার কথাটা শোন। শান্ত হয়ে বাস।
মুনা কঠিন স্বরে বলল, আমার হাত ছাড় নয়ত আমি চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করব। মামুন হাত ছেড়ে দিল। মুনা ঘর থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে এল। একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না।
সন্ধ্যা হয় হয় করছে। সন্ধ্যার আগে আগে সব কিছু কেমন অন্য রকম লাগে। পরিচিত। ঘরবাড়ি এমনকি পরিচিত মানুষকেও অপরিচিত মনে হয়। মুনা রিকশা করে বাড়ি ফিরছে। তার বারবার মনে হচ্ছে নিতান্তই অচেনা একটি শহরের অজানা একটি রাস্তায় তার রিকশা যাচ্ছে। এই বোধহয় ভাল। চেনা মানুষের চেয়ে অচেনা মানুষ ভাল।
মুনা বাড়ি ফিরল সন্ধ্যা পার করে। রিকশা থেকে নেমেই দেখল, বাকের ঠিক আগের জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে বাকেরকে লাগছে ভূতের মত। সে মুনাকে দেখেই লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এল। ভারী গলায় বলল, সন্ধ্যার পর মেয়েদের এমন একা একা ঘোরাফেরা করা ঠিক না। রোজ চেষ্টা করবে সন্ধ্যার আগে ফিরতে।
আপনি কি সারাদিন এই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন?
আরে না। কি যে বল; আমার কাজ আছে না?
বাকের সঙ্গে সঙ্গে আসতে লাগল। মুনা বিরক্ত গলায় বলল, আপনি আমার পেছনে পেছনে আসছেন কেন? বাকের থমকে দাঁড়াল। অবাক হয়ে বলল, তোমার কি হয়েছে?
কিছুই হয়নি। হবে। আবার কি?
কাঁদছ কেন?
কি আশ্চৰ্য। আমি কাঁদছি কেন সেই কৈফিযতও আপনাকে দিতে হবে?
না তা না। তোমাকে কাঁদতে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কেউ কিছু বলেছে?
কেউ কিছু বলেনি। আর বললেও আপনার কিছু যায় আসে না। প্লিজ, আমাকে বিরক্ত করবেন না।
না না বিরক্ত করব কেন? যাও বাসায় যাও।
মুনা ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গেল। বাকের তাকিয়ে রইল। মুনাকে সে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে। তাকে সে কখনো কাঁদতে দেখেনি। কত রকম দুঃখ থাকে মানুষের। মানুষ হয়ে জন্মানোটাই একটা বাজে ব্যাপার।
বাকের এগিয়ে গেল। সাতটার ওপর বাজে। বয়েজ ক্লাবে নাটকের রিহার্সেল শুরু হবে। ছেলে-ছোকরাদের কারবার। বয়স্ক কারো থাকা দরকার। নাটকের জন্যে টাকা তুলে দিতে হবে। চার-পাঁচ হাজার টাকার কমে নাটক নামানো যায় না। এরা হুঁট করে একটা ডিসিসান নেয় ক্যামেলা সামলাতে হয় তাকে।
রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ হচ্ছে!
এত রাতে রান্নাঘরে কে? মুনা ঘড়ি দেখল। রাত দুটো। চোর নাকি? বাসন-কোসন নড়াচড়া হচ্ছে। চোররা এত শব্দ করে কিছু করবে না। তাছাড়া সে জেগে আছে। টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। চোর আসার কথা নয়। একবার দেখে এলে হয়। কিন্তু কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। আগে কখনো এ রকম হত না। কিন্তু এখন কোথেকে একটা ভয় ঢুকে গেছে মনে। সন্ধ্যার পর পর একা একা রিকশায় চড়তে ভয় করে। দুপুর রাতে ঘুম ভাঙলে ভয় করে।
মুনা নিচু স্বরে ডাকল, বকুল, বকুল! বকুল নড়ল না। তার ঘুম পাথরের মত। টেনে বিছানা থেকে নামালেও ঘুম ভাঙবে না। বিয়ে হলে এই মেয়ের খুব ঝামেলা হবে। স্বামী বেচারা খুব বিরক্ত হবে। পৃথিবীর সব স্বামীরাই বোধ হয় চায় রাতে গায়ে হাত দেয়া মাত্র স্ত্রী জেগে উঠে আদুরে গলায় বলবে কি চাও? মুনা এসব আজেবাজে কথা ভাবছে কেন? তার নিজের ওপর রাগ লাগল। সে বকুলের শাড়ি ঠিক করে দিল। এত বড় মেয়ে কিন্তু কি বিশ্রী ঘুমুবার ভঙ্গি।
বকুল, বকুল।
বকুল পাশ ফিরল। কিন্তু কোনো শব্দ করল না। তার মুখ হাসি হাসি। সুন্দর কোনো স্বপ্ন দেখছে বোধ হয়। ওর বয়সে সে শুধু ভয়ের স্বপ্ন দেখত। একটা স্বপ্ন ছিল সাপের। স্বপ্নটা এত স্পষ্ট যে সব সময় মনে হত সত্যি। সে পুকুরে গোসল করতে গিয়েছে। পানিতে পা ছোঁয়াবার সঙ্গে সঙ্গে পানিতে ভাসতে ভাসতে একটা সাপ আসতে থাকে তার দিকে। সে দৌড়াতে শুরু করে। সাপট তার পিছু ছাড়ে না। সে পাগলের মত কত অলিতে গলিতে ঢোকে৷ কিন্তু সাপটা থাকেই। পেছনে ফিরলেই সে দেখে লাল পুতির মত দু’টি চোখ। চেরা জিব। কি কুৎসিত স্বপ্ন! এমনিতেই কত ভয়াবহ সমস্যা মানুষের থাকে। ঘুমের মধ্যেও সেসব সমস্যা উঠে আসতে হবে? স্বপ্নটা কেন সব সময় আনন্দের হয় না?
বকুল, বকুল!
কি।
উঠ তো একটু। রান্নাঘরটা দেখে আসি। কে যেন খুঁটখাট করছে।
বকুল উঠে বসিল, বিছানা থেকে নামল। তার ঘুম কাটেনি। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে সে হেলে পড়ে যাচ্ছে। চোখ আধিবোজা। এখন মুনার মায়া লাগছে। ঘুম না ভাঙালেই হত।
স্বপ্ন দেখছিলি নাকি, এই বকুল।
না। কটা বাজে আপ?
দু’টা পাঁচ।
তারা দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বারান্দাটা বেশ ঠাণ্ডা। কার্তিক মাসের মাঝামাঝি ঠাণ্ডা হবারই কথা। কিন্তু ঘরে গুমটি গরম। এখনো ফ্যান ছেড়ে ঘুমুতে হয়। যখন পুরোপুরি শীত পড়বে তখন এই ঘরটি হয়ে যাবে হিমশীতল। কি অদ্ভুত যে বাড়ি।
রান্নাঘরে কিছুই নেই। জানালা বন্ধ। শিকল তোলা। বকুল বলল, ইঁদুর শব্দ করছে আপা। খুব ইঁদুর হয়েছে। এত মোটা একটা ধাড়ি ইঁদুর দেখেছি। মুনা কিছু বলল না। বকুল হাই তুলছে। ঘুম ভাড়িয়ে ওকে তুলে আনাটা খুব অন্যায় হয়েছে।
কে? কথা বলছে কে?
শওকত সাহেবের মোটা গলা শোনা গেল। মুনা বলল, মামা আমি। শওকত সাহেব। আর কিছু বললেন না। মুনা ভেবেছিল মামা জিজ্ঞেস করবেন, এত রাতে কি করছিস? তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে আসবেন। কিন্তু তিনি তা করছেন না। মামা কি বদলে যাচ্ছেন? হঠাৎ একা হয়ে পড়লে মানুষ দ্রুত বদলে যেতে শুরু করে। মুনা নিজেও কি বদলাচ্ছে না?
বকুল শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়ল। হয়ত প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্ন দেখতে শুরু করছে। বিড়বিড় করে কি সব যেন বলছে। কেমন গভীর শোনাচ্ছে তার গলা। ঘুমের মধ্যে মানুষের গলার স্বর বদলে যায় নাকি? মুনা বাতি নিভিয়ে দিল। ঘুম আসবে না। বাকি রাতটা কাটাতে হবে জেগে। ইদানীং তার ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। সন্ধ্যায় খুব ঘুম পায়। চোখের পাতা খুলে রাখা যায় না। এমন ঘুম। বিছানায় শোবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম কেটে যায়।
একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। ফ্যানটা বন্ধ করে দিলে হয়। উঠতে ইচ্ছা হচ্ছে না। তবু সে উঠত কিন্তু তার ধারণা হল ফ্যান বন্ধ করলেই আবার গরম লাগতে শুরু করবে। আবার বিছানা ছেড়ে নেমে যেতে হবে ফ্যান ছাড়বার জন্যে। রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ হচ্ছে। ইদুর। ইদুরের উপদ্রব আগে ছিল না। হঠাৎ হয়েছে। শুধু নয়। সেই সঙ্গে প্রচুর তেলাপোকা। এত তেলাপোকাও আগে ছিল না। ঐদিন বাবু বলছিল, মা মারা যাবার পর বাড়িটা অন্য রকম হয়ে গেছে। বলেই সে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেল। এটা একটা সাধারণ সহজ কথা। এর মধ্যে লজ্জা পাওয়ার মত কিছু নেই। মামির মৃত্যুর পর বাড়িটা সত্যি সত্যি কিছু বদলেছে। মনে হয় বাড়িটা আগের মত নেই। পরিবর্তন কোথায় হয়েছে তা অবশ্যি ধরা যাচ্ছে না।
ভেতরের দিকে দরজা খোলার শব্দ হচ্ছে। মামা জেগেছেন। বারান্দার ইজিচেয়ারে তিনি এখন বসে থাকেন। রাত তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে তিনি জেগে ওঠেন। তারপর তার ঘুম হয় না। বুড়ো বয়সের কত রকম সমস্যা। কিংবা কে জানে এটা হয়ত তেমন কোনো সমস্যা নয়; বুড়োদের হয়ত জেগে থাকতেই ভাল লাগে। মামা আজ ইজিচেয়ারে শুয়ে নেই। হাঁটাহাঁটি করছেন। সাড়ে তিনটা কি বেজে গেছে? মুনা ঘড়ি দেখতে চেষ্টা করল। আগের ঘড়িটায় অন্ধকারে সময় দেখা যেত। এটাতে দেখা যায় না। রেডিয়াম ডায়াল নেই। বাতি জ্বালাতে হবে। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকার চেয়ে বাতি জ্বালিয়ে ঘড়িটা দেখা যেতে পারে। কিছুক্ষণ গল্প করা যেতে পারে মামার সঙ্গে।
শওকত সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, তুই এখনো জেগে? মুনা মাথা নাড়ল।
প্রায়ই জেগে থাকিস নাকি? বাতি জ্বালা দেখি।
হুঁ থাকি।
শরীর ঠিক আছে তো?
হুঁ আছে।
একটা চেয়ার এনে আমার কাছে বাস তো দেখি।
না মামা, আমি এখন শুয়ে পড়ব। ঘুম আসছে।
পাঁচ-দশ মিনিট বাস।
মুনা চেয়ার নিয়ে এল। শওকত সাহেব মুনার পিঠে হাত রেখে কোমল স্বরে বললেন, শুনলাম অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিস। কি হয়েছে?
কিছু হয়নি। হবে কি? শরীরটা খারাপ তাই ছুটি নিলাম।
মামুনকে তো আর এ বাড়িতে আসতে দেখি না।
আমি আসতে নিষেধ করেছি। তাই আসে না। মামা, তোমাকে তো একবার বলেছি। ওকে আমি এখন পছন্দ করি না। ঐ প্রসঙ্গ থাক।
একটা মানুষকে এত দিন ধরে পছন্দ করে আসছিস। বিয়ে ঠিকঠাক। এখন হঠাৎ করে…।
মামা, ঐ প্রসঙ্গ বাদ দাও।
বাদ দেব কেন? জানতেও পারব না?
না পারবে না? এত জেনে কি করবে? বেশি জানা ভাল না। মুনা হাসতে চেষ্টা করল। তার ইচ্ছে করছে উঠে চলে যেতে। কিন্তু যেতে পারছে না। কারণ মামা তার পিঠে হাত দিয়ে রেখেছেন। পিঠ থেকে হাত নামিয়ে উঠে চলে যাওয়া যায় না।
মামুনকে একবার আসতে বলিস। ওর সঙ্গে কথা বলব।
মামা, পিঠ থেকে হাত নামাও আমি এখন ঘুমুতে যাব।
এখন আর ঘুমিয়ে কি কারবি। ভোর তো হয়ে গেল। তোর তো অফিসও নেই। আয় গল্প করে সারারাত কাটিয়ে দেই।
কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব। চোখ জ্বালা করছে।
শওকত সাহেব হাত নামিয়ে নিলেন। তার নিজেরও কেমন ঝিমুনী এসে যাচ্ছে। বয়স হয়ে যাচ্ছে। একটা বয়সের পর সবাই খুব ঝিমুতে পছন্দ করে। ঝিমুনোর মত বয়স কি তার হয়েছে? রিটায়ারমেন্টের এখনো তিন বছর বাকি। বরুণ বাবুরও তিন বছর বাকি রিটায়ারমেন্টের। কিন্তু এখনো তাকে জোয়ান বলে মনে হয়। জুলপির কাছে কিছু চুল পাকা ছাড়া মাথার সব চুল কালো। ঝিমুতে ঝিমুতে শওকত সাহেব একসময় সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লেন।
তাকে ডেকে তুলল। বকুল। তিনি দেখলেন রোদে চারদিক ঝলমল করছে। এত বেলা হয়ে গেছে। তিনি কল্পনাও করেননি।
ক’টা বাজে রে?
দশটা।
কি সর্বনাশ! আগে ডাকিসনি কেন?
মুনা আপা নিষেধ করে গিয়েছে।
নিষেধ করলেই হল? আমার কি অফিস-টফিস নেই?
শওকত সাহেব অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যে ভাবেই হোক এগারটার আগে অফিসে পৌঁছতে হবে। বড় সাহেব এগারটার সময় আসেন। এসেই একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে যান। কে কে এখনো আসেনি সেটা মনে মনে নোট করেন।
বকুল!
জি।
মুনাকে ডেকে আন।
আপা তো বের হয়ে গেছে।
কোথায় গেছে? অফিস থেকে তো ছুটি নিয়েছে শুনলাম।
কোথায় গেছে জানি না বাবা। কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
জিজ্ঞেস করিাসনি কেন?
কাল জিজ্ঞেস করেছিলাম তাতে খুব রেগে গেল।
রাগলে রাগবে। রোজ জিজ্ঞেস করবি। ওর ব্যাপারটা কি?
জানি না বাবা।
জানি না বললে তো হবে না। জানতে হবে।
মুনা কাঁধে কালো ব্যাগ ঝুঁলিয়ে হাঁটছে। ক’দিন ধরেই সে এ রকম করছে। উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটা। কোনো একটি দোকানের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ানো তারপর আবার হাঁটা।
আকাশে গানগনে সূৰ্য। ঘামে মুনার মুখ চটচট করছে কিন্তু ভাল লাগছে হাঁটতে। মনে হচ্ছে কোথাও কোনো বন্ধন নেই। অফিসের তাড়া নেই। ঘর ফেরার আকর্ষণ নেই। শুধু হেঁটে বেড়ানো।
মুনা এগারটার সময় রিকশা নিয়ে নিল। যাবে যাত্রাবাড়ি। যাত্রাবাড়িতে তার এক চাচা থাকেন–মনিব চাচা। তার সঙ্গে কোনরকম যোগাযোগ নেই। হঠাৎ করেই তার কথা মনে পড়ল। মুনার দুঃসময়ে তিনি কোনো রকম দায়িত্ব নেননি। মুখ শুকনো করে বলেছিলেন, নিজের ছেলেমেয়েই মানুষ করতে পারি না। আর অন্যের মেয়ে মানুষ করব কি ভাবে? অসম্ভব। মেয়ের মামারা আছে তারা দেখুক। আমি গরিব মানুষ। নিজের চলে না।
মনিব সাহেব বাড়িতেই ছিলেন। তিনি মুনাকে দেখে খুবই অবাক হলেন। ভারী গলায় বললেন, কি রে তুই কি মনে করে? ভাল আছিস?
ভালই আছি। আপনি কেমন আছেন?
আর আমার থাকা। ব্লাড প্রেসার, নড়তে-চড়তে পারি না।
আপনি একা নাকি? আর কেউ নেই?
আছে সবাই আছে যা ভেতরে যা।
সবাই যথেষ্ট খাতির-যত্ন করল। চাচি মুনাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেক দুঃখের কথা বললেন। বড় ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। বেঁটা মিচকা শয়তান। এর কথা তাকে লাগাচ্ছে তার কথা ওকে লাগাচ্ছে। বড় মেয়ের এখনো বিয়ে হয়নি। কিন্তু ছোটটা বিয়ে করে ফেলেছে। তার একটা বাচ্চাও আছে। জামাইয়ের কোনো চাকরি-বাকরি নাই। শ্বশুর বাড়িতে থাকে। মুরুব্বিদের সামনে সিগারেট খায়। হায়া-শরম কিছুই নাই। আদব-কায়দা তো নাই-ই।
মুনা অবাক হয়ে লক্ষ্য করল কেউ তার কথা বিশেষ জানতে চাচ্ছে না। সবাই নিজেদের সমস্যা বলতে ব্যস্ত। অন্যের ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা নেই। মুনা থাকতে থাকতেই ছোট মেয়ে তার স্বামীর সঙ্গে একটা কুৎসিত ঝগড়া করে ফেলল। তুই-তুকারি গালিগালাজ বিশ্ৰী কাণ্ড। বাইরের একজন মানুষ আছে। এ নিয়ে কেউ চিন্তিত নয়। অন্যদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে যাবে।
বাড়ির মানুষজনের মধ্যে নতুন বৌটিকেই বরং ভাল লাগল। তাকে মোটেই মিচকা শয়তান বলে মনে হল না। কথাবার্তা চমৎকার। বেশ বুদ্ধিাশুদ্ধি আছে। মুনাকে তার ঘরে নিয়ে চা বানিয়ে খাওয়ালো। এই ছোট একটুখানি ঘরে চায়ের সরঞ্জাম এবং কেরোসিন কুকার।
বুঝলেন আপা, এই সংসারে কিছুদিন থাকলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আলাদা যে বাসা করব সে উপায়ও নেই। ও যা টাকা-পয়সা পায় তাতে সকলের নাশতার খরচটাই ওঠে না।
করে কি সে?
সিনেমায় ছোটখাটো পার্ট করে।
বল কি?
হুঁ। বেশির ভাগ গুণ্ডার পার্ট পায়। মাথা কামিয়ে অভিনয় করতে হয়।
মুনা বড়ই অবাক হল। তার ধারণা ছিল না। আত্মীয়দের মধ্যে কেউ সিনেমায় অভিনয় করে।
সংসার চলে কিভাবে?
চলে কোথায়? চলে না। দেশ থেকে চাল-ডাল আসে। বাবা টুকটাক কিছু ব্যবসা করেন। এখন অসুখে পড়ে সেই ব্যবসার খুব খারাপ অবস্থা। কি যে হবে ভাবতেও পারি না।
মুনাকে দুপুর বেলা খেয়ে তারপর আসতে হল। খাবার আয়োজন বেশ ভাল। মাছ, গোসত ভাজাভুজি। অনেক কয়টা পদ। বুঝাই যাচ্ছে এটা বিশেষ করে তার জন্যেই করা।
খাওয়া শেষ হবার পর মবিন চাচা নিজেই তাকে রিকশায় উঠিয়ে দিতে এলেন, তোর খোঁজখবর নেই মা! নেবার মত অবস্থা আমার না। নরকে বাস করি বুঝলি। ছেলে বিয়ে দিয়ে ডাইনি। ঘরে এমেছি। সব ছারখার করে দিচ্ছে। এমনি তো খুব মিষ্টি কথাবার্তা। কিন্তু আসলে বিষকন্যা। আসিস মাঝে-মধ্যে। তোর কথা মনে হয় প্রায়ই। ঐদিনও তোর চাচিকে বলছিলাম।
রিকশা ছুটে চলেছে। মুনার ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। বেশ কষ্ট করে তাকে জেগে থাকতে হচ্ছে। আগামীকাল কোথায় যাওয়া যায়। তাই ভাবতে ভাবতে মুনার ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা করতে লাগল।