১৭. নেহরু, গান্ধী পরিবার ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রসঙ্গে
“রাজীব ছিল নেহাতই অপরিণত, রাজনীতির অআকখ সে জানত না”–বসু মন্তব্য করলেন। বসুর সঙ্গে নেহরু এবং গান্ধী পরিবারের যোগাযোগ পাঁচদশকের পুরোন। নেহরুর সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয় লন্ডনে তিরিশের দশকে। নেহরুর মত বসুর মনেও তখন রোম্যান্টিক দেশপ্রেমের স্বপ্ন আর ফ্যাসিবাদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ ছিল। তখন বসুর বয়স মাত্র বাইশ বছর, সমাজতন্ত্রের আদর্শে অনুপ্রাণিত এক নবীন যুবক। প্রথম সাক্ষাতেই তিনি নেহরুকে নিজের মহৎ উদ্দেশ্যের কথা জানিয়েছিলেন। নেহরু উৎসাহ দিয়েছিলেন কিন্তু এ কথাও বলেছিলেন যে প্রথম কাজ হল কিন্তু ভারতকে স্বাধীন করা। বসু তাঁর সঙ্গে একমত হয়েছিলেন। বসু বললেন, “আমাদের সঙ্গে যখন আলোচনা হচ্ছিল, তখন নেহরু আমাদের বলেছিলেন ‘আমি জানি, তোমরা ছাত্ররা গান্ধীজির সঙ্গে অনেক বিষয়ে একমত হতে পার না কিন্তু একটা কথার উত্তর তোমরা আমাকে দাও তো, যখন হিটলার চেকোশ্লোভাকিয়া আক্রমণ করেছিলেন তখন কোনও প্রতিরোধ আসেনি কেন? গান্ধীজি কিন্তু প্রতিরোধ করতেন, যদিও সেটা হয়তো অহিংসই হত।’ আমাদের কাছে নেহরুর এই প্রশ্নের কোনও সন্তোষজনক উত্তর তখন ছিল না।”
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বসু ও নেহরুর মধ্যে আদর্শগত ফারাক ক্রমশ বাড়তে থাকে। নেহরু প্রাকস্বাধীনতা পর্যায়ের ফ্যাসিবিরোধী, সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা থেকে বহুদূরে সরে যান আর বসু চলে আসেন সেই সব ধ্যানধারণার একেবারে নিবিড় অন্তরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পরেও বেশ কয়েকবার বসু নেহরুর সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রতিটি সাক্ষাৎকারই ছিল ষোলআনা ভদ্রতার সঙ্গে খানিকটা ক্ষোভ মেশানো। বসু বললেন, “মাঝে মাঝে উনি মেজাজ হারিয়ে ফেলতেন, ধৈর্যভরে আমার সব কথা শুনতেন কিন্তু মনে হত যেন একটা টেনশন রয়েছে।” তবে কোনও সাক্ষাৎকারই তিক্ততার স্বাদ এনে দেয়নি। প্রায়ই বসু দেখা করতেন পশ্চিমবঙ্গের নানা সমস্যা নিয়ে, দাবী দাওয়া নিয়ে। বিরোধীপক্ষের ব্যক্তি হলেও তাঁকে মর্যাদা দিতে নেহরু জানতেন। নেহরুর অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই বসু সমর্থন করেন না। কিন্তু বসুর যুক্তি নেহরু সব সময়েই মন দিয়ে শুনতেন এবং ন্যায়সংগত দাবী অধিকাংশক্ষেত্রে মেনেও নিতেন। তেলেঙ্গানা আন্দোলনের বন্দীমুক্তির দাবী নিয়ে যখন বসু নেহরুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন নেহরু সবটাই ভালভাবে অনুধাবন করেছিলেন। বসু বুঝেছিলেন নেহরু বন্দীদের মুক্তি দিয়ে দেবেন। কংগ্রেসের বিদেশনীতি সম্পর্কে বসু ও তাঁর দলের অভিমত তিনি জানতে চেয়েছিলেন।
ইন্দোচীন সীমান্ত সংঘর্ষ যখন তুঙ্গে ওঠে সেই সময় নেহরুর সঙ্গে আবার বসুর আদানপ্রদান হয়। “তখন আমাকে নেহরু একটা মেসেজ পাঠিয়ে জানান যে উনি চীন সম্পর্কে আমাদের অবস্থা সম্বন্ধে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ”—বললেন বসু। তখন ডাঃ বিধানচন্দ্ৰ রায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি প্রায়ই নেহরুকে চিঠিতে লিখতেন যাতে তিনি কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেন। কিন্তু ভালমন্দ সঠিক যাচাই না করে এ বিষয়ে কোনও হঠকারী সিদ্ধান্ত নেহরু নিতে চান নি। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কে লেখা নেহরুর চিঠি থেকে একটা জীবন্ত সমস্যার প্রতি তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। বসুর মতে কমিউনিজম সম্বন্ধে নেহরুর ধারণা ছিল অসম্পূর্ণ
১৯৫৫ সালের ১৩ই ডিসেম্বর বিধানসভায় গোয়ায় পর্তুগীজ শাসন সম্বন্ধে নেহরুর অবস্থানের প্রশংসা করেছিলেন বসু। আবার একই সঙ্গে বসু মনে করেন যে ১৯৫৯ সালে কেরালায় কমিউনিস্টদের শেষ করে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নেহরু নিয়েছিলেন তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। তিনি যে মুখ্যমন্ত্রী ই. এম. এস. নাম্বুদিরিপাদকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন একথা এখন কারও অজানা নয়। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এই সরকার ভেঙে দেওয়া এবং আবার নতুন নির্বাচনের অনুষ্ঠান করা
নেহরুর বিচক্ষণ রাজনীতিকের মস্তিষ্ক ছিল। “কিন্তু ইন্দিরা যখন প্রধানমন্ত্রী হয়, ওর রাজনীতির কোনও ভিতই ছিল না।”—বললেন বসু। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বসুর পরিচয় পাঁচদশকের। বসু বলেন ইন্দিরা ছিল “প্রতিশোধপরায়ণ আর বিবেকহীন।” তিরিশের দশকে বসু তখন লন্ডনে। ফিরোজ গান্ধী লন্ডন মজলিশের সভায় অল ইন্ডিয়া লীগে নিয়মিত আসতেন। বসুর সঙ্গে বন্ধুত্ব এইভাবেই হয়। তবে ইন্দিরা তখন রাজনীতির ব্যাপারে তেমন উৎসাহী ছিলেন না। কিন্তু বসুর বেশ স্পষ্ট মনে আছে প্রতি বছর ট্রাফালগার স্কোয়ারে তাঁদের জমায়েতে হাড়কাঁপানো শীতের ভোরে জানুয়ারি মাসে ইন্দিরা ঠিক হাজির হতেন। পরনে থাকত লম্বা কোট, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন, মনে হত রাজনীতির ঘটনাস্রোত তাঁকে তেমন টানছে না। কিন্তু ফিরোজ ছিল বেশ খোলামেলা, কথাবার্তা বেশ বলতে পারত।
“আসলে যে কেউ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারে”—মন্তব্য করেন বসু, “যদিও ইন্দিরা বাবার সঙ্গে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বহু জায়গায় ঘুরেছে। রাজনীতিও খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছে, প্রকৃত রাজনীতিতে যথার্থ ট্রেনিং কিন্তু তার ছিল না। তবুও ইন্দিরা তো দেশ চালিয়েছে।” রাজনীতির বাইরে ইন্দিরার সঙ্গে বসুর সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। “কিন্তু ইন্দিরা”, বসু বলেন, “অনেকের সঙ্গে একই সময় ভদ্র আবার খুবই রুক্ষ হতেও পারত। বাবা ও মেয়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচার আচরণের মধ্যে অনেক অমিলও ছিল।” বসুর মতে আজকের রাজনীতিতে মূল্যবোধের অভাবের মূলে কিন্তু ইন্দিরা। “ইন্দিরাই দুর্নীতি আরম্ভ করে”, বসু বললেন, “ইন্দিরার দুটো বড় দোষ ছিল, রাজনৈতিক বাড়াবাড়ি আর প্রতিশোধ নেওয়া। ক্ষমতাবলে ও রাজনৈতিক, এমনকি ব্যক্তিগত শোধও তুলেছে। অনেক সময় উস্কানিতেও পরিস্থিতি চরমে উঠেছে।” উদাহরণস্বরূপ বসু সিদ্ধার্থশংকর রায়ের নাম করলেন। “যখন যুক্তফ্রন্ট প্রথম ক্ষমতায় এল তখন ইন্দিরা গান্ধী”, বসু জানালেন, “পশ্চিমবঙ্গে একটাও উন্নয়ন-প্রকল্প অনুমোদন করেন নি। আসলে ইন্দিরা নিজেই অনিশ্চয়তায় ভুগত”, বললেন বসু, “সরকারটাকে ও মনে করত পৈর্তৃক সম্পত্তি। আর ও কাউকে বিশ্বাস করতে পারত না। সব সময়েই মন্ত্রিসভায় অদলবদল ঘটাত, যেন ‘জিগ্গ্স পাল’ খেলা হচ্ছে, পাছে কোনও বিশেষ ব্যক্তি বেশি ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে, এই ওর ভয় ছিল। আর সবচেয়ে খারাপ কাজ করেছিল, সঞ্জয় গান্ধীর ব্যাপারটা।”
ইন্দিরা গান্ধী, বসু বললেন, কোনও ব্যক্তিগত সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না। যখনই জ্যোর্তিময় বসু পার্লামেন্টে সঞ্জয় গান্ধীর জনগণের গাড়ির কথা তুলতেন, ইন্দিরা ক্রোধে ফেটে পড়তেন। “জ্যোর্তিময় কোদালকে কোদাল বলতে ভয় পেত না”, বসু বলেন “সঞ্জয়ের কারখানার জন্য হরিয়ানায় সামান্য দামে জোর করে জমি দখল করার কথা বলত, ইন্দিরা সহ্য করতে পারত না। আসলে ইন্দিরা মুখে বলত এক রকম আর কাজ করত আর এক রকম।” একদিকে পাশ্চাত্যবিরোধী প্রচার চালাতো আবার আর একদিকে সি. আই. এ-র কাছ থেকে কমিউনিস্টদের শেষ করার জন্য টাকা নিয়েছিল। এক সময়কার ইউ. এস. অ্যামবাসাডর ড্যানিয়েল প্যাট্রিক মইনিহান তাঁর এক বইয়ে ইন্দিরা সম্বন্ধে এই অভিযোগ করে গেছেন। আর বিস্ময়ের কথা, মইনিহানের এই অভিযোগের বিরুদ্ধে ইন্দিরা নিজে বা তার পক্ষে অন্য কেউ প্রতিবাদও জানায়নি”–বলেন বসু।
যদি কোনও প্রস্তাব ইন্দিরার পছন্দ না হত তাহলে কখনও কখনও তিনি রাগ করে মিটিং ছেড়ে চলেও যেতেন। ১৯৭২ সালের নির্বাচনের সময় বসু নানা অভিযোগ নিয়ে ইন্দিরার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, কিন্তু তখন তিনি বসুর কোনও কথা শুনতেই রাজী ছিলেন না। “এটাই ছিল নেহরু আর ইন্দিরার মধ্যে প্রধান অমিল।” বসু বলেন, “নেহরুও কথার মাঝে মাঝে মেজাজ গরম করতেন কিন্তু মাথাটা যুক্তিপূর্ণ ছিল আর তাছাড়া উনি ছোটখাটো ব্যক্তিগত স্বার্থের ওপরেও উঠতে পারতেন, কিন্তু ইন্দিরা সেটা একেবারেই পারত না। ইন্দিরা চাইত তার মনের মত গণতন্ত্র।”
বসু জানালেন জনস্বার্থে কোনও আইন হয়তো ইন্দিরা প্রণয়ন করেছেন আর সেটাকে বিদেশি গণমাধ্যমে বেশ বড় করে তুলেও ধরছেন কিন্তু এদিকে জনগণই সেই আইনের কথা জানে না কেননা রাজ্যগুলোতে তা সরকারীভাবে জানানোই হয়নি। ১৯৭৫ সালে ভূমিহীন কৃষকদের জমিদাররা উচ্ছেদ করতে পারবে না এই মর্মে একটা আইন পাস হয় কিন্তু সাধারণ মানুষ সেই আইনের কথা কিছুই জানত না— “আমরা ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় এসে এই আইন বাস্তবে প্রয়োগ করি”–বসু বললেন। ‘বন্ডেড লেবার’ নিয়েও সেই এক কথা—”আই ওয়াশ ছাড়া আর কিছুই নয়”—বসুর মন্তব্য
জরুরী অবস্থার ভয়ংকর দিনগুলোর কথা দেশের মানুষ এখনও ভোলেনি, গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্রই তখন কায়েম হয়েছিল। “তবে ইন্দিরার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি একেবারেই ছিল না, ওকে ওর তোষামোদকারীরা বুঝিয়েছিল ও জিতবেই, স্বৈরতন্ত্রের এই এক বিপদ”, বসু বললেন, “চোখে ঠুলি পরে থাকে, বাস্তব সত্যটা ঠিক দেখা যায় না, ইন্দিরাও জনগণের নাড়ীর গতি বুঝতে পারেনি। ফলে ও হেরে গেল।”
“আমি অবশ্য ভাবিনি ও ঠিক এইভাবে হেরে যাবে”, বসু বললেন, “কিন্তু জনগণ ঠিক রায়ই দিয়েছিল। আর সত্যি কথা বলতে কি, যখন ইন্দিরা আবার ক্ষমতায় ফিরে এল, ভারতীয় রাজনীতিতে আবার ফিরে এল দুর্নীতি। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হল এম. এল. এ. আর এম. পি-দের নিয়ে বিবেকহীন ঘোড়া বেচাকেনার খেলা। ওটাতো আশির দশকে ইন্দিরা সরকারেরই আমদানি।” এ প্রসঙ্গে বসু আর একটা ঘটনার কথা বললেন, ১৯৮৩ সালে কাশ্মীরে ডাঃ ফারুক আবদুল্লার ন্যাশানাল কনফারেন্স দল জয়লাভ করল। ইন্দিরা ফারুক আবদুল্লাকে ‘দেশ বিদ্বেষী’, ‘ইন্দিরা বিরোধী’ আখ্যা দিলেন আর এম. এল. এ. কেনা শুরু করলেন। বসু তখন ইন্দিরাকে বলেছিলেন, এটা করা ঠিক হচ্ছে না, এটা শেখ আবদুল্লার পার্টি। তিনি তো বার বার জোর দিয়ে বলছেন তিনি একজন ভারতীয়, তিনি কাশ্মীরকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দিতে চান না, কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশ হোক এটাও তিনি চান না। তিনি একজন খাঁটি দেশপ্রেমী। “ইন্দিরা গান্ধীর”, বসু বললেন, “এই অবস্থার সুযোগ নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ইন্দিরা রেগে গেলেন, তিনি বললেন এসব কথা ওরা বসুকে বলছে, আসলে কাজে কিন্তু ঠিক উল্টোটাই করছে। বস্তুত ইন্দিরা কোনও অ-কংগ্রেসী সরকারকে বরদাস্ত করতে পারত না। যেই কংগ্রেসরা বিরোধী দলের সদস্য কিনে নিল, আর ফারুক আবদুল্লার সঙ্গে বোঝাপড়া হয়ে গেল অমনি ফারুক দেশপ্রেমী হয়ে গেলেন।”
১৯৯০ সালে বসু যখন লন্ডনে তখন ফারুক আবদুল্লা তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। “আমার ভারতে কোনও ভূমিকা নেই, কাশ্মীরেও নেই”—ফারুক দুঃখ করে বসুকে বলেছিলেন, “আমি তো আপনাকে আগেই বলেছিলাম, এমনটাই হবে, যাই হোক এখন কংগ্রেস বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, কিন্তু আপনি কাশ্মীরের লোকদের কি সাহায্য করেছেন?” বসু জিজ্ঞেস করেন। “কি করব বলুন, কংগ্রেস একটা বড় পার্টি। কাশ্মীরের জন্য অনেক কিছু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু কিছুই করেনি, শেষ পর্যন্ত।”—ফারুক উত্তর দেন।
এই প্রসঙ্গে আলোচনার সময় বসু এন. কে. সিং-এর লেখা ‘দ্য প্লেইন ট্রুথ’ নামে একটা বইয়ের উল্লেখ করলেন। সেখানে একটা ঘটনার চমৎকার বর্ণনা আছে। পড়লে বোঝা যায় ইন্দিরা গান্ধীর কাছে রাজনীতিতে নৈতিকতার মূল্য কতটা ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস দলের এক সদস্য অমৃত নাহাতা ‘কিসসা কুরসি কা’ নামে একটা ফিল্ম প্রোডিউস করেন। রাজনীতিতে নেতারা কতটা বিবেকহীন হতে পারেন ক্ষমতা দখলের জন্য সেটাই ছিল এই ছবির বিষয়। একটা ছোট পুস্তিকায় নাহাতা লিখেছিলেন তিনি কেন এই ছবিটা করেছিলেন। এক সন্ধ্যায় তিনি ইন্দিরা গান্ধী আর অন্য কয়েকজন রাজনীতিকের সঙ্গে ডিনারে বসেছিলেন। এমন সময় কথাবার্তার মাঝে শ্রীমতি গান্ধী নাহাতাকে জিজ্ঞেস করেন, “নাহাতাজি, রাজনীতিতে আবার ন্যায় অন্যায় কি?” মিঃ নাহাতা রীতিমত বিস্মিত হয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিল গান্ধীজির দেশের, নেহরুর দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন রাজনীতিতে ন্যায়ের কোনও স্থান নেই। বলা বাহুল্য এই ছবি চিরতরে অন্ধকারেই থেকে যায়, দিনের আলো আর দেখতে পায় না।
বসুর মতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার পেছনে মূল কারণ ইন্দিরাই ছিলেন। ১৯৬৭ সালে কংগ্রেস ভাগ হয়ে যাওয়ার পর উনি বামপন্থী দলগুলোর সমর্থনেই টিঁকে ছিলেন। বসুর সঙ্গে ইন্দিরা সে সময় নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পর আবার ইন্দিরা মনোবল ফিরে পান এবং বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফিরে আসেন। আর তারপর থেকেই প্রবল প্রতাপে চলে ইন্দিরা-রাজ। “তবে ইন্দিরার খুব সাহস ছিল”, বসু বলেন, “এই ফিরে আসাটা বেশ কৃতিত্বের ছিল, যদিও আমাদের একটুও ভাল লাগেনি—১৯৮০-র নির্বাচনের পর আমি ইন্দিরাকে কথাটা বলেওছিলাম।”
তবে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আসমান জমিন ফারাক থাকলেও ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বসুর ব্যক্তিগত সম্পর্কে এর কোনও প্রভাব পড়েনি। “যখন কংগ্রেসের কয়েকজন নেতা আমাকে বলেছিলেন ইন্দিরার জন্য দার্জিলিং-এ থাকার ব্যবস্থা করতে, তখন ও প্রাইম মিনিস্টার ছিল না, আমি মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে থাকার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। ইন্দিরা নাতিনাতনীদের নিয়ে সেখানে চিড়িয়াখানাও দেখতে গিয়েছিল।”—বসু বললেন। ইন্দিরা আর ফিরোজ গান্ধী একবার ভূপেশ গুপ্ত আন্ডার গ্রাউন্ড থাকার সময় তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। বসু বললেন, “ইন্দিরাকে ঐভাবে মারা হত না, যদি না ও পাঞ্জাব সম্বন্ধে ঐ রকম হঠকারী সিদ্ধান্ত নিত। আমি বার বার ওকে বলেছিলাম কিভাবে এগোতে হবে, ও ধৈর্যভরে মন দিয়ে সে সব কথা শুনত কিন্তু শেষপর্যন্ত নিজের মতেই কাজ করল; যখন সব অপারেশন শেষ তখন আমাকে ফোন করে বলল ‘দিল্লী আসুন তাড়াতাড়ি, জরুরী কথা আছে’। আমি বললাম, ‘এমন সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?’—উত্তরে ও বলেছিল, নিতেই হল, আর কোনও উপায় ছিল না’।
“রাজীব গান্ধীর ওপর প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হল, ওর পরিবারের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও। আর তাছাড়া ও সংসদীয় দলের সদস্যও ছিল না, মন্ত্রীও ছিল না। আমি দিল্লীতে গেলাম ইন্দিরাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিতে, রাজীবকে আমি তখন তত ভাল করে চিনতাম না, যাই হোক ওকে আমি দিল্লীতে যে ভয়ংকর শিখ হত্যা চলছিল সে ব্যাপারে ওর সঙ্গে কথা বললাম। বললাম মিলিটারির সাহায্য নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে—ইন্দিরা মারা যাওয়ার পর রাজীব গান্ধীর সঙ্গে বসুর এই প্রথম সাক্ষাৎকার ছিল। রাজীবের সঙ্গে কাজ করতে বসুর বেশ অসুবিধা ছিল। “রাজীব রাজনীতিকই ছিল না, ওর কোনও ভিতও ছিল না, ভাল করে দেখার বা বোঝার ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনটাই ছিল না।” প্রথম প্রথম রাজীবও বসুকে শত্রু হিসেবেই চিহ্নিত করেছিলেন। প্রথম কয়েক মাস শাণিত আক্রমণ করতেও ছাড়েন নি আর বসুর কোন কথাতেও তিনি আমল দিতেন না। কিন্তু ১৯৮৭-র নির্বাচনে পরাজয় আর বসুর রাজনৈতিক সাফল্য—এই দুটো কারণে রাজীব বসু সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন বদলাতে বাধ্য হয়েছিলেন। স্বীকারও করেছিলেন বসুর মত দক্ষ রাজনীতিক কিন্তু আর কেউ নেই।
রাজ্যের গোর্খাল্যান্ড সমস্যা প্রসঙ্গে বসু বললেন “এই সমস্যাটা নিয়ে আমি বহুবার রাজীবকে বুঝিয়েছি কিন্তু ব্যাপারটার গুরুত্ব ও বুঝতেই পারেনি আর ও চলত ওর স্তাবকদের বুদ্ধিতে, দেশের ভালমন্দ নিয়ে ওর আসলে কোন মাথাব্যথাই ছিল না। পরে অবশ্য দার্জিলিং সমস্যা নিয়ে আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হয়েছিল।”
সবচেয়ে দুঃখজনক হল রাজীবকে বলা হত সবচেয়ে “পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির” নেতা, শেষপর্যন্ত কিন্তু দেখা গেল রাজীবই আশির দশকের সবচেয়ে “ক্লিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।” যখন ভি. পি. সিং সাবমেরিন কেনার ব্যাপারে তদন্ত করার কথা বললেন তখনি সে দপ্তর বদলে ফেলল। আর বফর্স কামান কেনার কেলেংকারির কথা তো এখন সকলেরই জানা; এখন আরও রহস্যভেদ হতে চলেছে। বসুর মতে, “অভিযোগগুলো ঠেকাবার বুদ্ধি রাজীবের ছিল না আর পার্লামেন্টে ‘এর মধ্যে কোনও দালাল ছিল না’ এইসব মন্তব্য করে ব্যাপারটা ও আরও জটিল করে তোলে।—ও মায়ের মতই স্বৈরাচারী মনোবৃত্তির ব্যক্তি ছিল, কিন্তু মায়ের চাতুর্য আর প্রতিশোধস্পৃহা ওর ছিল না।” বসু বললেন, “তবে মায়ের পরম্পরাটা ও ভালই চালিয়ে গেছে— দুর্নীতি,—হয়তো খানিকটা অজান্তেই।” ইন্দিরা ও রাজীব গান্ধী দুজনের সঙ্গেই বসুর ব্যক্তিগত সম্পর্কে কখনই কোনও চিড় কিন্তু ধরেনি যদিও বসু তাঁদের রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং কাজকর্ম নিয়ে বার বার কড়া সমালোচনা করে এসেছেন।
ইন্দিরা গান্ধীর বাড়িতে ডিনারে বসুর আগেও সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ আলাপ পরিচয় হয়েছে। বসুর মতে “সোনিয়া বুদ্ধিমতী মহিলা, কংগ্রেসের সঙ্গে খুব বুদ্ধিসম্মত ব্যবহার করে, রাজনীতিতে যোগ না দিয়ে সে বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে।” একবার যখন সোনিয়া গান্ধীর নাম ভারতের রাষ্ট্রপতির পদের জন্য সাধারণভাবে প্রস্তাবিত হয় তখন বি. জে. পি. আপত্তি জানিয়েছিল কারণ সোনিয়া একজন ‘বিদেশিনী’–বসু বললেন “আমি বলেছিলাম, তা কেন? সোনিয়া তো বিদেশী নয়, তিনি তো ভারতীয় নাগরিক। আর ভারতীয় নাগরিকের সব ন্যায্য অধিকারই তার থাকা উচিত।” সম্প্রতি সোনিয়া গান্ধীর আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসী রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধেও বসু একই মন্তব্য করেন।
গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে বসুর ব্যক্তিগত কোনও বিদ্বেষ নেই। যেটা ছিল সেটা হল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক লড়াই, আর একটু ব্যাপকস্তরে বলা যেতে পারে কমিউনিজম আর ক্যাপিটালিজম-এর লড়াই। তবে বসু বলেন, “নেহরুর মৃত্যুর পর কাজকর্ম করতে গিয়ে দেখেছি স্তরের যেন ক্রমশই অবনতি হয়েছে, আর এমন কিছু ভুল তারা করেছে, যার ক্ষতিপূরণ করা কখনও সম্ভব নয়।”
২
সুদীর্ঘ ষাট বছর ধরে বসু ভারতীয় রাজনীতিতে রয়েছেন। এই কালসীমার মধ্যে তিনি হরেকরকম রাজনীতিকের সঙ্গে চিন্তার আদানপ্রদান করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সুদক্ষ, কেউ বা সুচতুর, কেউ বা নেহাতই সাদামাটা। সকলের সঙ্গেই বসু তাঁর বুদ্ধিমত্তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রয়োগ করেছেন। এখন তিরাশি বছর বয়সে বসু বলেন, “আমি সবাইকে ভালই চিনি, কারোকে চিনতে আমার বাকি নেই।” অতি সহজেই বসু বুঝে ফেলেন তাদের চিন্তার গতিবিধি, উদ্দেশ্যের অলিগলি। আর অকুণ্ঠ প্ৰশংসা পেলে একটু সতর্ক হয়ে যান। রাজনীতিতে বিনা উদ্দেশ্যে, বিনা কারণে কোন কিছু ঘটে না, প্রশংসা তো দূরের কথা।
যাই হোক ১৯৯৬ সালের জুন মাসে দিল্লীতে নতুন যুক্তফ্রন্ট সরকারের স্টিয়ারিং কমিটির মিটিং সেরে ফেরার পর বসুকে বেশ চিন্তান্বিত মনে হল। রাজনীতিতে তখন এক দুঃসহ অবস্থা চলছে, চলছে প্রধানমন্ত্রীর, আমলার, পাওয়ারব্রোকার আর তথা- কথিত সাধুসন্তের কেলেংকারি। “যে সব অভিযোগ হাওয়ায় ভাসছে” বসু বললেন, “সে সব যদি সত্যি প্রমাণিত হয় তাহলে সেটা খুবই দুঃখের কথা।” একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, ‘তাঁর আবার বিদ্যাবুদ্ধিও আছে’, তিনি যে ঘুষ মামলায় জড়িয়ে পড়বেন এটা তাঁর কল্পনার বাইরে।
বসু বললেন, “রাও তাঁর মাইনরিটি সরকার নিয়ে কোনওরকমে টেনে টেনে পুরো পাঁচ বছরের মেয়াদ চালিয়েছিলেন। অনেকবারই মনে হয়েছে এই বুঝি বিরোধীদের চাপে সরকার ভেঙে পড়বে, কিন্তু প্রতিবারই সরকার টিঁকে গেছে। এখন বলা হচ্ছে ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন—সেই ১৯৯৩ সালে অনাস্থা প্রস্তাবের ঠেলা সামলাতে আর গদি রাখতে তিনি এই কাজ করেছিলেন। এখন তো খবরের কাগজ খুললেই এই সব খবর। কোর্টে তাঁকে সমন করা হচ্ছে— এই সব। আমার ১৯৯১ সালের একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। কংগ্রেসের এক গোষ্ঠীর ডাকা এক নির্বাচনী সভায় উনি কলকাতায় এসেছিলেন, আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেন আর একটা অভিযোগের বিরুদ্ধেও কিন্তু কোনও ‘সাপোর্টিং’ তথ্য দিলেন না। যাই হোক একজন শিক্ষিত লোক যে এমন হতে পারে এটা ভাবলে আমার দুঃখ হয়। তবে হ্যাঁ, কখনও কখনও ভারতে শিক্ষিত লোকেরাই উন্নতিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের রাজ্যেই ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে তো শিক্ষিত মানুষরাই সংস্কারের কাজে মূল বাধা দিয়েছিল।”
বসুর মতে যদি জয়প্রকাশ নারায়ণ আজ দেশের হাল ধরতেন তাহলে দেশের এই দুরবস্থা হত না। “জয়প্রকাশ নারায়ণ”, বসু শ্রদ্ধাভরে বললেন, “আমার দাদার সঙ্গে নিউইয়র্কে পড়ার সময় একঘরে থাকতেন। আমি তাঁকে চিনি ৪৬-৪৭ সাল থেকে। তখন তিনি ছিলেন ইন্ডিয়া রেলওয়ে মেন্স’ ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট আর আমি ছিলাম ভাইস প্রেসিডেন্ট। ১৯৪৯ সালের রেল ধর্মঘট নিয়ে আমাদের মতের বিরোধ ছিল। আমি দানাপুরে গেলাম, আন্ডার গ্রাউন্ডে রইলাম, আর এই ধর্মঘটের ব্যাপারেই জে. পি. আমাকে আমার পদ থেকে ‘এক্সপেল’ করলেন। একটা সময় ছিল যখন দেশের লোক মনে করত উনি নেহরুর উত্তরসূরি হবেন। উনি দেশের জন্য অনেক ভাল কাজ করেছেন আর ইন্দিরাবিরোধী আন্দোলন উনিই প্রথম সেই সময়ে শুরু করেন যখন দেশে গণতন্ত্রের একজন সত্যিকারের রক্ষক দরকার ছিল তখন তিনি রাজনীতিতে ফেরেন। আমি অনেকবার ওঁকে জিজ্ঞেস করেছি, উনি আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন না কেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। তবুও আমরা পরস্পরকে নিজেদের কর্মসূচি জানাতাম। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে উনি ছিলেন না তবে উনি একজন ধৈর্যশীল, সৎ এবং খাঁটি রাজনীতিক ছিলেন। আমার মতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য জে. পি-ই ছিলেন যোগ্যতম ব্যক্তি।”
অল্পবয়েসে বসু গান্ধীজির আদর্শের কদর করতেন। পরে অবশ্য, বসু বললেন, “যদিও আমাদের আদর্শের অবস্থান দুই বিপরীত মেরুতে, তাহলেও আমি মনে করি গান্ধীজি তাঁর বিভিন্ন গণ-আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে জাগাতে পেরেছিলেন। তবে ওঁর একটা ব্যাপার ছিল, উনি হঠাৎ করে আন্দোলনটা বন্ধ করে দিতেন। আমরা কখনও এটা করি না, এটা আমাদের নীতিবিরুদ্ধ। তাছাড়া গান্ধীজি শিল্পোন্নয়নে কখনও জোর দেন নি, যেটা খুবই জরুরী ছিল।” বসুর মতে নেহরুর উত্তরসূরি লালবাহাদুর শাস্ত্রী ছিলেন ‘খুব সৎ আর সাদাসিধে মানুষ”। “আমি ষাটের দশকের প্রথম দিকে কলকাতায় রাজভবনে শাস্ত্রীজির সঙ্গে দেখা করি। উনি আমাদের পার্টির বিরুদ্ধে কিছু কথা বলেছিলেন, তিনি আসলে আমাদের আদর্শটা ভুল বুঝেছিলেন, ভেবেছিলেন আমরা হিংসাত্মক কার্যকলাপে বিশ্বাসী। যখন আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম উনি আমাদের পার্টি প্রোগ্রাম পড়েছেন কিনা, উনি স্বীকার করেছিলেন উনি তা পড়েন নি। আমি জেলে খবর পাই উনি তাসখন্দে মারা গেছেন।” পাকিস্তানের সঙ্গে তাসখন্দ চুক্তি সই করার কয়েকঘন্টা পরেই তাসখন্দে ১৯৬৬ সালের ১০ই জানুয়ারি শাস্ত্রী মারা যান।
বসু বললেন, “স্বীকার করতে বাধা নেই আমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যাপারে বরাবরই প্রধানমন্ত্রীদের সহযোগিতা পেয়েছি, সে রাজনৈতিক ধ্যানধারণা তাঁদের যাই হোক না কেন। যেমন দন্ডকারণ্যে উদ্বাস্তু সমস্যা মেটাবার ব্যাপারে মোররাজী দেশাই আমায় যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। যখন ওঁর সরকারে বিপর্যয় দেখা দেয় আমি তখন ওয়ারস-এ। আমি সেই সরকারকে সমর্থন করতে প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু আমার পার্টি অবশ্য ততক্ষণে অন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।” মোরারজি সরকারের পতনের পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন চরণ সিং, কংগ্রেসের সমর্থনে। ২৮শে জুলাই, ১৯৭৯-তে প্রধানমন্ত্রী হলেন আর ইস্তফা দিয়েছিলেন ২০শে আগষ্ট, কংগ্রেস সমর্থন প্রত্যাহার করার পর। রইলেন তদারকি সরকারের মাথা হয়ে, পাঁচ মাসে একদিনও সংসদের মুখোমুখি হলেন না। চরণ সিং কেমন ছিলেন? বসু বলেন উনি “খুব অনমনীয় ধরনের লোক ছিলেন, তবে মানুষটি খাঁটি ছিলেন।”
যখন বফর্স কামান কেনার কেলেংকারির পর বিশ্বনাথপ্রতাপ সিং কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন তখন বসুর পার্টি বাইরে থেকে আলাদা প্ল্যাটফর্ম থেকে জনতা সরকারকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নিল। “ভি. পি. সিং” বসু বললেন, “একজন অসম্ভব সৎ লোক, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবার উপযুক্ত লোক। উনি বি. জে. পি-র রথযাত্রা থামাবার জন্য আমাকে বি. জে. পি-র প্রেসিডেন্ট এল. কে. অ্যাডভানির সঙ্গে কথা বলতে অনুরোধ করেছিলেন। তবে জাতপাতের ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়েছিল। আমরা অর্থনৈতিক দিকটা বিবেচনা করার কথা বলেছিলাম। সুপ্রিম কোর্টের রায়ও একই কথা বলেছে। কিন্তু বি. জে. পি-র প্রতি ওঁর অনমনীয় মনোভাবের আমি প্রশংসা করি।”
এখনকার রাজনীতিকদের সম্বন্ধে মন্তব্য বসু করেন বেশ সচেতন ও সতর্কভাবে। বললেন, “মণ্ডল কমিশনের ঝামেলাটা চন্দ্রশেখর অনেকটাই সামলিয়ে নিয়েছিল। চন্দ্রশেখরের বরাবরই ইচ্ছে ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়। মন্ত্রী দীনেশ সিং-এর বাড়িতে ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়, আমার সবচেয়ে যেটা ভাল লেগেছিল, সেটা হল ইন্দিরার বিরুদ্ধে ওঁর যুদ্ধ করার সাহস। আমার মনে আছে, যখনই আমার সঙ্গে ওঁর দেখা হত, উনি আমাকে বলতেন, আপনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হোন না, হচ্ছেন না কেন?’—এই সব…। ‘আমি হতে চাইনা, এটা আমার পার্টির নীতিবিরুদ্ধ’- আমি ওঁকে জবাব দিই। যখন জনতা সরকার ভেঙে গেল, আবার আমাকে উনি বললেন, ‘আপনি যদি এখন প্রধানমন্ত্রী না হন তো, আমি প্রধানমন্ত্রী হতে চাই’— ‘বেশতো, হোন না, হয়ে যান’, আমি উৎসাহ দিয়ে বলি।”
অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে বসুর সম্পর্ক সৌহার্দ্যের, যদিও রাজনীতিতে তাঁরা বৈরী। বাজপেয়ী ১৯৯৬ সালের মে মাসে পনের দিনের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। বসু বলেন, “অটলবিহারী জনতা সরকারের একজন সুদক্ষ বিদেশমন্ত্রী ছিলেন। আমার সঙ্গে নানা জায়গায় ডিনারে দেখা হয়েছে ওঁর সঙ্গে। আমার মনে হয় বি. জে. পি-তে উনি ‘মাইনরিটি’। আর পার্টি ছাড়ারও কোনও ইচ্ছা তাঁর নেই। একবার বাজপেয়ী আমার সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি নাকি ভুল পার্টিতে রয়েছি’– এই একই কথা আমিও ওঁর সম্বন্ধে বলতে পারি।”
যখন বসু তাঁর পার্টিগত অবস্থানের কারণে প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, তখন যুক্তফ্রন্টের ১৩টি দলের মধ্যে এইচ. ডি. দেবেগৌড়াই নির্বাচিত হলেন প্রধানমন্ত্রী। “যদিও ওঁর কোয়ালিশন সরকার চালানোর কোনও অভিজ্ঞতাই নেই, তবুও উনি ভালই কাজকর্ম করছেন। আমরা চাই তাঁর সরকার স্থায়ী হোক”—মন্তব্য করেন বসু।
“আসলে যেটা খুব দরকার”, বসু বলেন, “সেটা হল সার্বিক দৃষ্টি আর দেশের প্রতি ‘ডেডিকেশন’, সত্যিকারের প্রচেষ্টা আর সাহস থাকলে জনগণ তার কদর করবেই।” এই সব গুণের সমন্বয়ই বসু দেখেছিলেন তাঁর প্রিয়নেতা হো. চি. মিন- এর মধ্যে, যখন উনি একবার কলকাতায় এসেছিলেন। “আমি কখনও এমন সাদাসিধে, শৃঙ্খলাপরায়ণ, অসম সাহসী মানুষ দেখিনি। উনি একজন আদর্শ কমিউনিস্ট নেতা। আর একজন প্রশংসনীয় নেতা হলেন নেলসন ম্যাণ্ডেলা, উনি কলকাতায় এসেছিলেন ১৯৯১ সালে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে যেভাবে উনি সংগ্রাম করেছেন, সেটা থেকে অনেক কিছু আমাদের শেখার আছে।”
গত ষাট বছর ধরে বসু কমিউনিজমের লক্ষ্য সামনে রেখে রাজনীতি করছেন। “খুব কঠিন কাজ”, বসু স্বীকার করেন, “আমাদের বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন হতে হবে, পরিস্থিতি, অবস্থা সব বুঝে এগোতে হবে। আমার সব সময় চৌ. এন. লাই-এর একটা কথা মনে পড়ে। ১৯৫৫ সালে আমার সঙ্গে ওঁর দেখা হয়েছিল। “আপনাদের এই পরিশ্রমী সমাজব্যবস্থার অকুণ্ঠ প্রশংসা করতে হয়” আমি বলেছিলাম। উত্তরে উনি আমাকে বলেছিলেন ‘যদি আপনি হাজার বছর পরেও আবার এখানে আসেন, তখনও আপনি দেখবেন সমালোচনার জন্য কত নেতিবাচক দিক রয়েছে। দেখুন, উন্নতির অবকাশ সর্বদাই থেকে যায়’। সেই থেকে কথাটা আমার মনে গেঁথে আছে।”