বৃষ্টি খুব এক পশলা হইয়া গিয়াছে —পথঘাট পেঁচ পেঁচ সেঁত সেঁত করিতেছে —আকাশ নীল মেঘে ভরা —মধ্যে মধ্যে হড় মড় হড় মড় শব্দ হইতেছে, বেঙগুলা আশে-পাশে যাঁওকো যাঁওকো করিয়া ডাকিতেছে। দোকানী পসারীরা ঝাপ খুলিয়া তামাক খাইতেছে —বাদলার জন্যে লোকের গমনাগমন প্রায় বন্ধ —কেবল গাড়োয়ান চিৎকার করিয়া গাইতে গাইতে যাইতেছে ও দাসো কাঁদে ভার লইয়া “হ্যাংগো বিসখা সে যিবে মাথুরা” গানে মত্ত হইয়া চলিয়াছে। বৈদ্যবাটীর বাজারের পশ্চিমে কয়েক ঘর নাপিত বাস করিত। তাহাদিগের মধ্যে একজন বৃষ্টি জন্যে আপন দাওয়াতে বসিয়া আছে। এক একবার আকাশের দিকে দেখিতেছে ও এক একবার গুন গুন করিতেছে, তাহার স্ত্রী কোলের ছেলেটিকে আনিয়া বলিল —ঘর-কন্নার কর্ম কিছু থা পাইনে —হেদে ! ছেলেটাকে একবার কাঁকে কর —এদিকে বাসন মাজা হয়নি, ওদিকে ঘর নিকোনো হয়নি, তার পর রাঁদা বাড়া আছে —আমি একলা মেয়েমানুষ এসব কি করে করব আর কোন্ দিগে যাব ? —আমার কি চাট্টে হাত চাট্টে পা? নাপিত অমনি ক্ষুর ভাড় বগল দাবায় করিয়া উঠিয়া বলিল —এখন ছেলে কোলে করবার সময় নয় —কাল বাবুরামবাবুর বিয়ে, আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে। নাপ্তিনী চমকিয়া উঠিয়া বলিল —ও মা আমি কোজ্জাব ? বুড়ো ঢোস্কা আবার বে করবে। আহা ! ওমন গিন্নী —এমন সতী লক্ষ্মী —তার গলায় আবার একটা সতীন গেঁতে দেবে —মরণ আর কি ! ও মা পুরুষ জাত সব করতে পারে ! নাপিত আশাবায়ুতে মুগ্ধ হইয়াছে —ও সব কথা না শুনিয়া একটা টোকা মাথায় দিয়া সাঁ সাঁ করিয়া চলিয়া গেল।
সে দিবসটি ঘোর বাদলে গেল। পর দিবস প্রভাতে সূর্য প্রকাশ হইল —যেমন অন্ধকার ঘরে অগ্নি ঢাকা থাকিয়া হঠাৎ প্রকাশ হইলে আগুনের তেজ অধিক বোধ হয় তেমনি দিনকরের কিরণ প্রখর হইতে লাগিল —গাছপালা সকলই যেন পুনর্জীবন পাইল ও মাঠে-বাগানে পশু-পক্ষীর ধ্বনি প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল। বৈদ্যবাটীর ঘাটে মেলা নৌকা ছিল। বাবুরামবাবু, ঠকচাচা, বক্রেশ্বর, বাঞ্ছারাম ও পাকসিক লোকজন লইয়া নৌকায় উঠিয়াছেন এমতো সময়ে বেণীবাবু ও বেচারামবাবু আসিয়া উপস্থিত। ঠকচাচা তাহাদিগকে দেখেও দেখেন না —কেবল চিৎকার করিতেছেন —লা খোল দেও। মাঝিরা তকরার করিতেছে —আরে কর্তা অখন বাটা মরি নি গো —মোরা কি লগি ঠেলে, গুণ টেনে যাতি পারবো ? বাবুরামবাবু উক্ত দুইজন আত্মীয়কে পাইয়া বলিলেন —তোমরা এলে হল ভালো, এসো সকলেই যাওয়া যাউক।
বেচারাম। বাবুরাম ! এ বুড়ো বয়সে বে করতে তোমাকে কে পরামর্শ দিল?
বাবুরাম। বেচারাম দাদা। আমি এমন বুড়ো কি ? তোমার চেয়ে আমি অনেক ছোট, তবে যদি বলো আমার চুল পেকেছে ও দাঁত পড়েছে —তা অনেকের অল্প বয়সেও হইয়া থাকে। সেটা বড় ধর্তব্য নয়। আমাকে এদিক্ ওদিক সব দিগেই দেখিতে হয়। দেখো একটা ছেলে বয়ে গিয়েছে আর একটা পাগল হয়েছে —একটি মেয়ে গত আর একটি প্রায় বিধবা। যদি এ পক্ষে দুই-একটি সন্তান হয় তো বংশটি রক্ষে হবে। আর বড়ো অনুরোধে পড়িয়াছি —আমি বে না করলে কনের বাপের জাত যায় —তাহাদিগের আর ঘর নাই।
বক্রেশ্বর। তা বটে তো —কর্তা কি সকল না বিবেচনা করে এ কর্মে প্রবর্ত হইয়াছেন। উঁহার চেয়ে বুদ্ধি ধরে কে ?
বাঞ্ছারাম। আমরা কুলীন মানুষ —আমাদিগের প্রাণ দিয়ে কুল রক্ষা করিতে হয়, আর যে স্থলে অর্থের অনুরোধ সে স্থলে তো কোনো কথাই নাই।
বেচারাম। তোমার কুলের মুখেও ছাই —আর তোমার অর্থের মুখেও ছাই —জন কতক লোক মিলে একটা ঘরকে উচ্ছন্ন দিলে, দূঁর দূঁর ! কেমন বেণী ভায়া কি বলো ?
বেণী। আমি কি বলব ? আমাদিগের কেবল অরণ্যে রোদন করা। ফলে এ বিষয়টিতে বড়ো দুঃখ হইতেছে। এক স্ত্রী সত্ত্বে অন্য স্ত্রীকে বিবাহ করা ঘোর পাপ। যে ব্যক্তি আপন ধর্ম বজায় রাখিতে চাহে সে এ কর্ম কখনই করিতে পারে না। যদ্যপি ইহার উল্টো কোনো শাস্ত্র থাকে সে শাস্ত্রমতে চলা কখনই কর্তব্য নহে। সে শাস্ত্র যে যথার্থ শাস্ত্র নহে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই, যদ্যপি এমন শাস্ত্রমতে চলা যায় তবে বিবাহের বন্ধন অতিশয় দুর্বল হইয়া পড়ে। স্ত্রীর মন পুরুষের প্রতি তাদৃশ থাকে না ও পুরুষের মন স্ত্রীর প্রতিও চল-বিচল হয়। এরূপ উৎপাত ঘটিলে সংসার সুধারা মতে চলিতে পারে না, এজন্য শাস্ত্রে বিধি থকলেও সে বিধি অগ্রাহ্য। সে যাহা হউক —বাবুরামবাবুর এমন স্ত্রী সত্ত্বে পুনরায় বিবাহ করা বড়ো কুকর্ম —আমি এ কথার বাষ্পও জানি না —এখন শুনিলাম।
ঠকচাচা। কেতাবীবাবু সব বাতেতেই ঠোকর মারেন। মালুম হয় এনার দুসরা কোই কাম-কাজ নাই। মোর ওমর বহুত হল —নূর বি পেকে গেল —মুই ছোকরাদের সাত হর ঘড়ি তকরার কি করব ? কেতাবীবাবু কি জানেন এ শাদীতে কেতনা রোপেয়া ঘর ঢুকবে ?
বেচারাম। আরে আবাগের বেটা ভূত ! কেবল টাকাই চিনেছিস্ আর কি অন্য কোনো কথা নাই? তুই বড়ো পাপিষ্ঠ —তোকে আর কি বলবো —দূঁর দূঁর ! বেণী ভায়া চলো আমরা যাই।
ঠকচাচা। বাতচিত পিচু হবে —মোরা আর সবুর করতে পারিনে। হাবলি যেতে হয় তো তোমরা জল্দি যাও।
বেচারাম বেণীবাবুর হাত ধরিয়া উঠিয়া বলিলেন —এমন বিবাহে আমরা প্রাণ থাকিতেও যাব না কিন্তু যদি ধর্ম থাকে তবে তুই যেন আস্তো ফিরে আসিস্নে। তোর মন্ত্রণায় সর্বনাশ হবে —বাবুরামের স্কন্ধে ভালো ভোগ করছিস্ —আর তোকে কি বলব ? দূঁর দূঁর !!!