ধান কাটার দিন ভোর হওয়ার বেশ আগেই, আন্ধার থাকতে থাকতে আলের উপর কুলগাছতলায় দাঁড়িয়ে তার দুই বিঘা সাত শতাংশ জমি তমিজ দেখে নিচ্ছিলো দুই চোখ ভরে। এ বছর জমির এমন ভরা বুক তো সে আর দেখতে পারবে না। পাকা ধান মাথায় নিয়ে ধানগাছগুলো খানিকটা হেলে পড়েছে, আবার জায়গায় জায়গায় তমিজ ধানগাছ এলিয়ে দিয়েছে নিজেই, ধান যাতে সমানভাবে পাকে। কোলে ধান কাঁখে ধান নিয়ে একেকটি গাছ নিঃসাড়ে ঘুমায়। কুয়াশা ছুঁয়ে শিশিরের এক-একটি বিন্দু শীষের ওপর স্বপ্নের তরল ফোঁটার মতো পড়লে ধানগাছের ঘুম আরো গাঢ় হয়। ধানখেতের স্বপ্নের ঝাপটায় তমিজের গা কাঁপে, দেখতে দেখতে সে বসে পড়ে আলের ওপর।
ধানগাছের স্বপ্নের ধাক্কায় দুলতে দুলতে তমিজ হাতের কাস্তের ধার দেখে আলগোছে, কাস্তের কচি কচি দাঁতে তার হাতে সুড়সুড়ি লাগে, ভোতা আঙুলের মাথা বেয়ে তাই ছড়িয়ে পড়ে তার সারা শরীরে। দশরথ কর্মকারের পাশে বসে সে কাস্তে ধার করে নিয়ে এলো পরশুদিন। কাস্তে কোদালে ধার দশরথের মতো দিতে পারে-এ তল্লাটে তেমন আর কেউ নাই। মানুষটা কথা কয় কম, দিনরাত হাঁপর টানে, হাঁপর টানে আর ফাঁকে ফাঁকে এটা ওটা ধার দিয়ে দেয়। তবে প্যাচাল পাড়ে তার বেটাটা। বাপ কেমন চুপচাপ হপর চালাচ্ছে। আর দেখো এক নাগাড়ে কথা বলে চলে যুধিষ্ঠির।কী?-না, গোলায় ধান তোলার সময় মণ্ডল নাকি তার সঙ্গে খুব প্যাগনা করেছে। মণ্ডল খালি এটা চায়, ওটা চায়। এই খরচ দাও, ওই খরচ দাও। খরচ দিতে না পারো তো তোমার ভাগের ধান থেকে এ বাবদ এতো ধান দাও, ওই বাবদ অতো ধান দাও। যুধিষ্ঠির তমিজকে ভয় দেখায়, তোমার তো মেলা ধান হছে। হামি লিজেই দেখ্যা আসিছি। কতো ধান ঘরত তুলবার পারো দেখো!
আগেভাগে এসব অলক্ষুণে কথা বলার দরকারটা কী বাপু? তমিজের রাগই হচ্ছিলো। যুধিষ্ঠিরের ওপর, যার জমি তুমি বর্গা করো, যার জমিতে তোমার লক্ষ্মী তার নামে এমন গিবত করলে তোমার ধর্মে সইবে?-ধান মাপা আরম্ভ হলে মণ্ডল খালি প্যাগনা করবি।-এই দেখো, শীতের অন্ধকার ভোরে যুধিষ্ঠিরের বাড়ির হাঁপরের আঁচ লাগে, এই আঁচে ধানখেতের ওপরকার কুয়াশা উড়ে যাচ্ছে ধোয়া হয়ে, শিশিরবিন্দু শুকিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে জমির ভেতরে। আসমান সাফ হয়ে আসছে।
এই সময় বাপকে কাস্তে হাতে আসতে দেখে তমিজ উঠে দাড়ালো। না গো, বুড়া দেরি করে নি। বাপ বেটায় এখনি জমিতে নামা যায়।
কিন্তু দুজনে জমিতে নামার আগেই এসে হাজির হলো হুরমতুল্লা ও তার পেছনে আরো তিন জন কামলা। এরা সূব নিজগিরিরডাঙার পুবপাড়ার মানুষ।
নামো, নামো। হুরমতুল্লা এসেই তাগাদা দেয়, কামেত নামো গো। বেলা ডোবার আগেই ব্যামাক আঁটি হামার বাড়িত তোলা লাগবি।
কিন্তু কামলা নেওয়ার কথা তো তমিজের ছিলো না। মণ্ডলের সঙ্গে এমন কথা তো হয় নি। তবে এগুলো কী?–না,কামলা নিতে হবে। শরাফত মণ্ডলের হুকুম। এই জমির ধান কাটতে হবে এক দিনে। তমিজ একলা কাটলে এক সপ্তাহেও কুলাতে পারবে না।
হামার বাপ তো হামার সাথে আছে। তাই হাত লাগালে তোমার দুই কামলার কাম সারবার পারে, সেই খবর রাখো?
তমিজের কথায় হুরমতুল্লা আমল দেয় না। ধান বেশি পেকে গেছে। কয়েক দিন ধরে কাটলে এর মধ্যে অর্ধেক ধান ঝরে পড়বে মাটিতে, ঝরা ধানে বরকত নাই। শরাফত তাই কাল রাত্রে হুরমতুল্লাকে ডেকে কামলা জোগাড়ের ভার দিয়েছে।
সবাই মাঠে নেমে পড়লে তিন মুঠা কাটা হলে আঁটি বান্দো, হুশিয়ার হুয়া কাম। করো, কাচি ধরার কায়দা আছে বাপু, ইটা তোমার জাল মারা লয়। ধান যানি ঝর্যা না পড়ে, হুরমতুল্লার প্রভৃতি উপদেশে শরাফতের হুকুমই গমগম করে ওঠে। তবে বাপের কাস্তের অতি দ্রুতগতিতে তমিজ তার ভোরবেলার, এমন কি, আরো আগেকার তেজ ফিরে পায় এবং হাম্বিতম্বি শুরু করে নিজেই, দেখো! চোখ দিয়া চায়া দেখো। বুড়া। মানুষটার ছ্যাও দেখ্যা তোমরা শিখ্যা লেও।
বাপের কাজে অসাধারণ ক্ষিপ্রতা ও পটুত্বের কল্যাণে দুপুরবেলার মধ্যেই জমি জুড়ে তমিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে ধানের পরিমাণে, আকারে, পুষ্টিতে ও সৌন্দর্যে অভিভূত হওয়ার সুযোগ সে পায় এবং এই জমিতে নিজের মেহনত ও কৌশল নিয়ে নানা কিসিমের বাকি ছাড়ে। তমিজের বাপ কথা কয় না। ধানের ফলনে বেটার কৃতিত্বে সে খুশি কি-না তার কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু তার কাস্তের গতি ও তমিজের চোপার নিচে চাপা পড়ে হুরমতুল্লার দাপট।।
বাপের চুপ মেরে যাওয়া সুদে-আসলে তোলে হুরতুল্লার বেটি ফুলজান। বাঁকের দুই দিকে ভারে ভারে ধানের আঁটি এনে হুরতুল্লার উঠানে কামলারা সাজিয়ে রাখছিলো থাক থাক করে, ফুলজান তখন চলে আসে সামনে। কামলাগুলো না থাকলে সে হয়তো মাঠেই চলে যেতো।
দুই দিন ধরে সব ধান কাটা শেষ হলে কামলারা চলে যায়, এখন থেকে ধানের সমস্ত তদবির করতে হবে তমিজকে একা। বাপটা ঘরেই পড়ে থাকে, জমি থেকে ধান। কেটে দেওয়ার পর তার আর কোনো উৎসাহ নাই। তমিজ বললে হয়তো আসতো। তা তমিজ কিন্তু বাপকে কিছু বলে নি। ফুলজানের চোপার কিছু ঠিক নাই, কার সামনে কী বলে বসে কে জানে? তমিজ অবশ্য রোজ ভোরবেলা এই বাড়িতে ঢোকার সময় বুকে। বল জুগিয়ে নেয়, সে কি ফুলজানের খায় না পরে, না-কি তার বাপের জমিতে বর্গা চাষ করে যে তাকে ভয় করতে হবে? আবার তার বিমারি বেটাকে দেখে তমিজের মায়াও লাগে, আহা ছেলের জন্যে মায়ের কষ্টের আর শেষ নাই। তা বেটাকে নিয়ে টাউনে যাবার কথা সে তুলবে, আগে ধানটা মণ্ডলের গোলায় তোলা হোক। ফুলজানের বেটা নবিতনের কোলে বসে ঘোলাটে চোখে জ্বলজ্বল নজরে তমিজের ধান পেটানো দেখে। ফ্যাকাশে মুখে তার চোখজোড়া চকচক করে দেখে তমিজের ধান পেটানো হাত শিথিল হয়ে আসে : দুত্তোরি! ছোঁড়াটা মনে হয় ভালোই হয়ে গেলো! ওকে নিয়ে প্রশান্ত কম্পাউনডারের কাছে যাবার কথা ছিলো, তা বুঝি আর হলো না!
ধানের কোবান দেওয়ার কায়দা আছে, বুঝিছো? কিন্তু কাঠের তক্তায় ধানের আঁটি বাড়ি মারার কৌশলটি দেখিয়ে না দিয়েই ফুলজান বলে, খালি গায়ের জোর খাটালেই ব্যামাক কাম হয় না গো মাঝির বেটা। বুদ্ধি খাটান লাগে।।
তার কাজের খুঁত ধরতে ফুলজান সবসময় কাছে থাকে। তমিজের একেক দিন রাগ হয়, ইচ্ছা করে, মাগীর পাওনা পয়সা কয়টা ঝনাৎ করে ফেলে দেবে সামনে। বলবে, ভালো করা গুন্যা লেও। কিন্তু ফুলজান তো পয়সা চায় না। তমিজও ভাবে, ধান ঘরে ওঠার আগে এতো খরচ করা ভালো নয়। তবে নিজেকে ফুলজান যে এতো কামলি মেয়েমানুষ বলে মনে করে, এই দেখে দেখে তমিজ ভাবে, এখানে কুলসুমকে একবার এনে ফেললে হয়। কাম তো আর ফুলজান একলা জানে না। কয়টা বছর আগেও কুলসুম মণ্ডলবাড়িতে ধান ভানার কাজ কম করে নি। আর বিয়ের আগে কালাম মাঝির। বাড়িতে কতো হাঁড়ি ধান যে সেদ্ধ করতে তার কোনো হিসাব আছে? আর এমনিতে কুলসুমের পাশে এই মাগী কি আর দাঁড়াতে পারে নাকি? ফুলজানের যে জায়গাটায় মস্ত ঘ্যাগ ঝোলে একটা, কুলসুমের ওইখানটা দেখতে কী মসৃণ। কুলসুমের রঙ কালো হলে কী হয়, তার মুখের দিকে তাকালে তাকে বড়োলোকের বাড়ির মেয়েদের মতো দেখায়। তমিজের সত্য হলেও কুলসুম তাকে কখনো হিংসা করে নি। মাঝির বংশ নিয়ে তাকে খোটা দেয় বটে, কিন্তু সেটা কেবল তার বাপদাদা নিয়ে তুমি কথা শোনালেই। কুলসুম এখানে থাকলে ফুলজানের নাহক খোটা মারা, তাকে হেয় করাটা বন্ধ হবে। তার নিজের বর্গা করা জমির প্রথম ধান উঠছে। মণ্ডল বাগড়া না দিলে তো জমি থেকে ধান সে তুলতো সোজা বাড়িতেই। কুলসুম বাড়ির বাইরের উঠানটা নিকাবার আয়োজনও করেই রেখেছিলো। নিজের বাড়িতে না হোক, নিজের জমির ধান ঝাড়ার সময় তমিজ কুলসুমকে পাশে পাবে না, তা কী করে হয়?
ভোরবেলা কাৎলাহার পেরিয়ে নিজগিরিরডাঙার হুরমতুল্লার বাড়িতে গিয়ে দিনভর কাজ করবে কুলসুম,—এতে তমিজের বাপের তেমন সায় ছিলো না। কুলসুম বলেই ফেললো, ইগলা আলগা ফুটানিই তোমার সব্বোনাশ করলো! তবে ধান ঝাড়ার চেয়ে কুলসুম মরিয়া হয়ে উঠেছে ফুলজানের নামে এটা ওটা শুনতে শুনতে। কুলসুম রাগে জ্বলে! মা গো মা, মাগীমানুষ বলে এতো দজ্জাল হয়? এমন না হলে স্বামীটা কি তার এমনি এমনি ভাগে? এখন আবার লেগেছে পরের ছেলে তমিজের পেছনে। স্বামীকে বেশি কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কুলসুম ভোররাতে বেরিয়ে যায় তমিজের সঙ্গে।
তমিজের বাপ তখন মাচায় শুয়ে চোখ মেলে তাকিয়েছিলো বাইরের দিকে। তার বেটা আগে এবং পিছে বৌ চলতে চলতে ডোবার ওপারে গিয়ে হাঁটতে লাগলো পাশাপাশি। তমিজের বাপ পাশ ফিরে শুয়ে ফের ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু কুলসুমের রাগারাগি বলো, ঝগড়াঝাটি আর মুখ ঝামটা দেওয়া বলো, সবই তার বাড়ির ভেতর। হুরমতুল্লার ভিটায় পা দিয়েই সে একরকম চুপ হয়ে যায়। ফুলজানের দিকে আড়চোখে তাকায়, যেন জীবনে এই পয়লা দেখছে তাকে।
সেদিন তমিজ আর কুলসুমের পৌঁছুবার পরপরই শুরু হলো গোরু দিয়ে ধানের আঁটি মাড়াই। কাঠের তক্তায় পিটিয়ে ধান ঝরানো আঁটিগুলো উঠানের পাশে গাদা করে রাখা ছিলো। ফুলজান আর হুরমতুল্লা আগেই কয়েকটা আঁটি খুলে বিছিয়ে রেখেছিলো উঠানে। গলায় গলায় বাঁধা ও মুখে ঠুলি পরানো জোড়া গোরুর পেছনে পান্টি হাতে ঘুরতে লাগলো তমিজ। উঠানের অন্যদিকে ধানের স্থূপ থেকে কুলায় ধান নিতে নিতে। ফুলজান চাঁচায়, ও নবিতন, কাঁড়ালটা লিয়া মাঝির বেটার পিছে না! নবিতন বারান্দায় বসেছিলো কাঁথা সেলাই করতে। বেশ মন দিয়ে নকশা তুলছিলো, বোনের ডাকে সাড়া না দিয়ে নকশাই তুলে চললো। এই মেয়েটিকে তমিজ প্রায় সবসময়ই কথা সেলাই করতে দেখে, ধানের কাজে তার উৎসাহ নাই। ফুলজান আরেকবার চিৎকার করলে জোড়া গোরু ও তমিজের পিছে পিছে কড়াল হতে নামলো সে। কাঁড়ালের আঁকশি দিয়ে ছড়িয়ে দিতে লাগলো ভাঙা আঁটিগুলো। পেটাবার পর এই কয়েকদিনে। আঁটির ধানগুলো লাল হয়ে এসেছে, এই ধানের চালও লাল হবে, ভাতে স্বাদ নাই। তমিজ বেশ বুক চিতিয়ে এগোয়, তার কোবানো আঁটিতে ঘুলানা ধান থাকে না, তার কয়েকটা বাড়িতেই আঁটির ধান সব ঝরে পড়ে।
ঘুলানা ধান তো তোমার হলোই না গো। ব্যামাক ধানই বার কর্যা লিছো? নবিতন তাকে সাবাশি দিতে এই কথা বলতে না বলতে ফুলজান বলে ওঠে, হাভাতা মাঝির বেটা, ধান কি আঁটিত কিছুই থোয়া লাগে না?
আঁটি পেটানোর পটুত্বও তার ফুলজান স্বীকার করে না, এটাকে সে বিবেচনা করে হাভাতেপনা বলে। তমিজকে এভাবে হেয় করাটা কুলসুমের গায়ে একটু লাগে, একটু নিচু গলাতেই সে বলে, ঘুলানা ধানের চাউল হামরা খাই না বাপু!
কিসক? ভিক্ষা করা বেড়াছো, তখন মানষে ঘুলানা চাউল দিলে ফিক্যা মারিছো? ফুলজান কথাটা বলে কুলসুমকে, কিন্তু তাকে এই কথা বলার সুযোগ দেওয়ায় তমিজের রাগ হয় কুলসুমের ওপর। গোরুর পিঠে আলগোছে পান্টির বাড়ি মেরে সে বলে, ভিক্ষা হামরা করি নাই। ফকিরের বেটিক লিকা করা হামার বাপ ঘরজামাই হয়া যায় নাই। ঘুলানা চাউল হামাগোরে খাওয়া লাগে না।
তমিজের কথায় ফুলজান বোধহয় আরাম পেয়েছে, নইলে এর পিঠে তার কিছু না কিছু বলার কথা। কুলসুম তো এখন অনেক কথাই বলতে পারতো।-তমিজের বাপের সংসারে ঘুলানা চালের ভাত তাকে কম খেতে হয় নি। তমিজের কথায় দুঃখ পাওয়ার চেয়ে সে অসহায় বোধ করে বেশি। বিচলিত হয়ে ফুলজানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ধান ঝাড়ার কুলাটা সে ধরে দক্ষিণ দিকে। তাই দেখে ফুলজান হাসে খিলখিল করে, তার ঘ্যাগের ভেতর দিয়ে আসতে আসতে খিলখিল স্বরটি লুপ্ত হয় এবং শোনা যায় ঘর্ঘর শব্দ। শীতের বাতাস তো বইছে সবই উত্তর থেকে, সেই বাতাসে কুলার চিটাধান কি খড়কুটো উড়ে পড়ে নিচে, কুলায় রয়ে যায় ভালো ধানগুলো। ফুলজানের মুখোমুখি দাঁড়াবার ফলেই কুলসুম কুলা ধরে উল্টোদিকে। তা এতে ফুলজানের এত হাসির কী হলো? ফুলজানের এই তুচ্ছ-করা হাসির প্রতিবাদে, না কুলসুমের অযোগ্যতায় বিরক্ত হয়ে, ঠিক বোঝা মুশকিল তমিজ দুটো গোরুর পিঠেই পান্টির বাড়ি লাগায় কষে। এই বাড়ির জন্যে একেবারেই অপ্রস্তুত গোরু দুটো হঠাৎ একটু দৌড় দিলে তমিজ হুমড়ি খেতে খেতে সামলে নেয়। তার এই দশায় হেসে ফেলে নবিতন, তার হাসিতে নির্ভেজাল খিলখিল বোল। ফুলজান কিন্তু এবার হাসে না, জিভ দিয়ে চ চ্চ আওয়াজ করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হায়রে, চাষা হাওয়ার হাউস! মাঝি বলে হাউস করিছে চাষা হবি!
একটু আগে ফুলজানের ঘর্ঘরে হাসিতৈ কিন্তু কুলসুমের আনাড়িপনার জন্যে একটু প্রশ্রয়ও ছিলো। বিদ্রুপ কিংবা প্রশ্রয় কোনোটাতেই কুলসুম স্বস্তি পায় না। নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই সে কুলা ধরেছিলো উত্তরদিকে, উত্তরের হাওয়াকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনেও তার অস্বস্তি কাটে না।।
জোড়া গোরুর পিছে পিছে মলন দিতে দিতে তমিজ কিন্তু সবই দেখে। কুলসুমের কালো ও লম্বা আঙুলওয়ালা হাতের হালকা নাচন ধানের ওপরকার চিটাধান ও খড়কুটো উড়িয়ে ফেলে দিচ্ছে মাটিতে, সেখানে হলুদ ও হালকা কালচে হলুদ ছোটো স্থূপ তৈরী হচ্ছে তার স্তনের মতো। ফুলজানের কুলায় মোটা মোটা গাবদা গোবদা হাতের হালকা পিটুনিতে কিন্তু কাজ এগোয় অনেক তাড়াতাড়ি। কিন্তু ঘেগি মাগী আজ এমন ছটফট করে কেন? কিছুক্ষণ পরেই সে ছোটোবোনকে বলে, ধর তো নবিতন। কুলাটা তার হাতে তুলে দিয়ে সে হাতিয়ে নেয় তার কাঁড়াল এবং একটু জোর কদমে অনুসরণ করতে থাকে তমিজকে। ফলে তমিজকেও কদম বাড়াতে হয় এবং তার প্রভাব পড়ে গোরুজোড়ার ওপর। গোরুর টানে ও ফুলজানের ঠেলায় তমিজের বুক ও পিঠ শিরশির করে। গোরু সে ঠিকই সামলে নেয়, কিন্তু বুকটা টিপটিপ ও পিঠটা শিরশির করতেই থাকে।-বাঁশের কড়াল দিয়ে ফুলজান তার পিঠে একটা খোঁচা না মারে! কাঁড়ালের আঁকশিতে সে আবার তমিজের গলায় আটকে একটা হ্যাচকা টান না দেয়! আহা, ফুলজান একটা হালকা খোঁচা যদি দেয়! তমিজের পিঠের কি আর সেই কপাল হবে?
কিন্তু ফুলজান নিয়োজিত কেবল খড়ের আঁটিগুলো আলগা করে দেওয়ার কাজে। এখানেও সে কতো তাড়াতাড়ি কাম করে। কঁড়ালের আঁকশি বিঁধে দেয় আঁটির একেবারে নিচে, তারপর কড়ালের পেছনটায় এমন জোরে মোচড় দেয় যে আঁটি একেবারে আলগা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এর ওপর দিয়ে গোরু হেঁটে আরাম পায়, খড়ও মোলায়েম হয়। ওদিকে কুলা ঝেড়েই চলেছে কুলসুম; তার আঙুল নড়ে খুঁড়িয়ে, এতেক্ষণ ধরে ঝেড়েও তার চিটাধান ও খড়কুটোর পরিমাণ ফুলজানের স্তুপের চেয়ে কতো ছোটো।
ফুলজানের হাতের কাম কত পাকা! তার বাপের বৌটা যদি ওরকম হতো! এরকম একজন কেউ পাশে থাকলে তমিজ বিঘার পর বিঘা জমি চাষ করতে পারে একা। ধান ঝাড়ার এরকম কেউ থাকে তো তমিজের লাঙলের ফলা ঢুকে যাবে মাটির অনেকটা নিচে, সেখান থেকে এমনকি পানিও তুলে আনতে পারে সে। তখন জমিতে পানি সেচার জন্যে আর মণ্ডলের হাতে পায়ে ধরতে হয় না।
সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার আগে তমিজ আবছা আন্ধারে দেখে তার ধানের স্তুপ। আল্লায় দিলে কতো ধান তার হয়েছে। এই ধান কাল যাবে মণ্ডলবাড়ি। ভাগাভাগির পর তার নিজের ভাগ নিয়ে তমিজ কালই ওঠাবে তার উঠানে। এতো ধান কি কুলসুম সেদ্ধ করতে পারবে? কালাম মাঝির বাড়িতে সে ধান সেদ্ধ করেছে তখন তো তার বিয়েই হয়। নি, ছোটো ছিলো। কালাম মাঝি বৌঝিদের সাথে সাথে থাকতো, কুলসুম হাত লাগিয়েছে মাত্র। এখন এতো ধান সেদ্ধ করে শুকিয়ে ঘরে তোলা কি আর সাধ্যে কুলাবে? এখন কী আর করা যায়? ফুলজান কি তার বাড়ি উজিয়ে গিয়ে তার ধান সেদ্ধ করে শুকিয়ে দিয়ে আসবে নাকি?
কুলসুমের সামনে ফুলজানের কথা এভাবে ভাবতেও তমিজের এমন বাধো বাধো ঠেকে কেন? কুলসুমকে তার এতো পরোয়া করার দরকারটা কী? এর ভয়ে কি ফুলজানের বেটার ব্যারামের খবরটাও নিতে পারবে না? মরিয়া হয়ে একটু উঁচু গলাতেই ফুলজানকে জিগ্যেস করে, বেটা তোমার ক্যাংকা আছে গো? এই কয়টা দিন যাক, চলো একদিন টাউনেত যাই। দেরি করা ভালো লয়।
টাউনেত গেলে তোমার পাছ ধরা লাগবি কিসক? বেটাক লিয়া হামি হামার বাপের সাথে যাবার পারি না? ফুলজানের জবাবে তমিজ কষ্ট করে হাসতে চেষ্টা করে, লাভ হয় না। মাঝখান থেকে তার চোয়াল ও ঠোট ব্যথা করে।
তখন সন্ধ্যা, সন্ধ্যার কুয়াশা কালচে লাল হয় বারান্দায় রাখা কুপির আলোয়। তমিজের সঙ্গে কথা বলেতে বলতেই ফুলজানের ঘরের ভেতরে গিয়ে তার ছেলেকে নিয়ে আসে, কোলের ওপর রুগ্ন ছেলেটিকে সে নিয়ে এসেছে একটি নতুন র্যাপারে জড়িয়ে। কুপির আলো পড়েছে ফুলজানের বেটার গায়ের কাপড়টিতে। এই কালচে লাল আলোতেও কাপড়টা চিনতে তমিজের একটুও দেরি হয় না। সঙ্গে সঙ্গে সে তাকায় কুলসমের দিকে, কুলসুমও ওই কাপড়টাই দেখছে খুব খুটিয়ে খুটিয়ে। তমিজের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মুখ ফিরিয়ে নিলো।
সারাটা রাস্তা কুলসুম রেডক্রসের সেই ব্যাপারের কথা তুললো না। সেই চাঁদনি রাতে তমিজ ওই যে ফুলজানের গায়ে র্যাপার চড়িয়ে দিয়ে এসেছিলো, এরপর কুলসুম না হোক একশোবার ওটার কথা বলেছে। তমিজ একেকবার একেক জবাব দিয়েছে। আচ্ছা, সত্যি কথাটা বলতে তার অসুবিধাটা কী ছিলো? তমিজের গা চড়চড় করে : সে কি তার বাপের বৌয়ের খায় না পরে? তাকে তার এতো ভয় করার কী হলো? ফুলজানকে রাপার দিয়েছে, ঠিক করেছে। তাকে কি কুলসুমের মুখ চেয়ে চলতে হবে? তাকে সংসার করতে হবে না? দুই চার বিঘা জমি করতে হবে না? তার দিকে দেখে কে? বাপ তো তার হিসাবের বাইরে। রাত নাই, দিন নাই আবোরের লাকান খালি টোপ পাড়ে আর নিন্দ পাড়ে। নিন্দের মধ্যে কীসব খোয়াব দেখে আর এদিক ওদিক হাঁটে।-কুলসুম কি স্বামীকে কখনো এভাবে ঝিমাতে আর ঘুমাতে আর হাঁটতে না করেছে কখনো?
ঘুমের পাঁকের মধ্যে পড়েই তো বাপ তার খোয়াব দেখে আর কামকাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। স্বামীর এই খাসলত তো কুলসুমই বরং উস্কে উস্কে দেয়। আর কোনো মেয়েমানুষ কি স্বামী ঘুমের ভেতর কী বিড়বিড় করে তাই শুনতে তার মুখের কাছে কান পেতে থাকে? বাপের এই খাসলতেই সংসারটা তাদের ছারেখারে গেলো। এখন হিসাব করো তো, এই খাসলত সে পেলো কোথায়? চেরাগ আলি ফকিরের পোঁদে পোঁদে ঘুরেই তো তার এই দশা। খোয়াব দেখার কী ভয়ানক নেশা ফকির তার মধ্যে সেঁধিয়ে দিলো যে ঘর সংসার ভুলে মানুষটা তাতেই বুদ হয়ে থাকে এই বুড়া বয়সেও! যে মানুষ বড়ো হওয়া পর্যন্ত ঘুরঘুর করলো মণ্ডলদের বাড়িতে, যাদের এঁটোকাটা খেয়ে যার শরীর পুরুষ্টু হলো, সে-ই কিনা ওই বাড়ির নাম পর্যন্ত শুনতে পারে না। ফকির তাকে কী এলেম যে দিয়ে গেলো। শরাফত মণ্ডলের এতো কষ্ট করে, এতো তদবির করে, নায়েববাবুর পেছনে এতো খরচা করে ইজারা নেওয়া বিল, সেই বিলের ধারে ধারে আন্ধারে মান্দারে তমিজের বাপ যদি ঘুরে বেড়ায় তো মণ্ডল তাকে সন্দেহ করবে না কেন? চেরাগ আলি তার নাতনিটাকে গছিয়ে দিয়ে গেলো বাপের ঘাড়ে, কী মন্তর পড়ে দিয়ে গেছে কে জানে? না-কি ফকিরের মন্ত্রে কুলসুমই তাকে এমন করে রেখেছে? তা ছাড়া আবার কী? ঘরের দুষমন এই মেয়েমানুষটাকে তোয়াক্কা করলে কি তমিজের চলে?