অধ্যায় ১৭. ধর্ম যখন ব্যক্তিগত হয়ে উঠেছিল
মানব-ইতিহাসে ধর্ম বহু উদ্দেশ্যপূরণে সহযোগিতা করেছে। আধুনিক বিজ্ঞান সৃষ্টিরহস্য ব্যাখ্যা করার আগে, ধর্মীয় স্বপ্নদ্রষ্টারা তাদের ব্যাখ্যাগুলো প্রস্তাব করেছিলেন, তার কয়েকটি আমরা ইতিমধ্যে খানিকটা আলোচনা করেছি। কিন্তু কীভাবে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল সেটি ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা ছাড়াও, ধর্ম ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে কেন’ এটি যেভাবে আছে সেভাবে সংগঠিত হয়েছে। যদি প্রশ্ন করা হয়, মানুষ কেন এই গ্রহের প্রাধান্য বিস্তারকারী প্রজাতি এবং এটি নিয়ে যা খুশি তারা তাই করেছে, বাইবেল তাদের বলেছে, এর কারণ হচ্ছে ঈশ্বরই এই সবকিছু ঠিক এভাবেই সাজিয়েছেন। ঈশ্বরই আমাদের এই পৃথিবীর দায়িত্বে স্থাপন করেছেন এবং এটি জয় আর নিয়ন্ত্রণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে কেন চামড়ার রঙের নানা মাত্রার ওপর ভিত্তি করে মানবতাকে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভাজিত করা হয়েছে, হিন্দুশাস্ত্র উত্তর দিয়েছে, এই মহাবিশ্বের নেপথ্যে বিরাজমান বুদ্ধিমত্তা একটি উদ্দেশ্যে সবকিছুই এভাবে সাজিয়েছেন। এটি হচ্ছে কার্মা।
এই উত্তরগুলো পরিস্থিতি আসলে কেমন শুধুমাত্র সেটি বলছে না, এছাড়াও আমাদের এইসব কিছু মেনে নিতেও নির্দেশ দিয়েছে। পৃথিবী যেভাবে সংগঠিত, সেটি যথার্থ দাবি করে সেখানে এটি স্বর্গীয় অনুমোদনের সিলমোহরও বসিয়ে দিয়েছে : এভাবেই স্বয়ং ঈশ্বরই সব পরিকল্পনা করেছেন। আর সে-কারণেই এই জীবনে তাদের ভাগ্যকে মেনে নিতে মানুষকে প্ররোচিত করতে ধর্ম খুবই দক্ষ, সেই ভাগ্যটি যতই দুর্বিষহ হোক না কেন, বিশেষ করে যখন এটি তাদের এই জন্মের পরবর্তী জন্মে, অথবা পরবর্তী জন্মেরও পরবর্তী জন্মে, আরো উত্তম কোনো জীবন পাবার আশা দেয়।
এবং এছাড়াও সমাজের আরোপিত নিয়মনীতিগুলো যেন মানুষ মেনে নেয়, সেটি নিশ্চিত করতেও ধর্ম দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। আপনি যদি চান সবাই পরস্পরের সাথে সৌহাদ্যপূর্ণ সংহতির সাথে বসবাস করবেন, তাহলে তাদের একগুচ্ছ রীতিনীতি আর আচার থাকতে হবে, যা তারা সবাই মেনে চলবেন– একটি নৈতিকতা’। মিথ্যা কথা না বলা, চুরি না করা, হত্যা না করা। এইসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার মাধ্যমে যে-কোনো বুদ্ধিমান সমাজ নিজেকে রক্ষা করে।
আর ধর্মের ভূমিকা হচ্ছে এই আইনগুলোকে আরো দৃঢ়তর করে তোলা, আর। সমর্থন করা, এমন কিছু দাবি করে যে, এই আইনগুলো মানব-সৃষ্ট নয়, এগুলো। স্বয়ং ঈশ্বরের নির্দেশ। লোকালয় থেকে দূরে মরুভূমিতে ইজরায়েলাইটরা কিন্তু সেই টেন কমান্ডমেন্ট (দশটি নির্দেশ) তাদের স্বপ্নে আবিষ্কার করেননি। এটি তাদের ওপর আরোপ করেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বর। সুতরাং ইতিহাসে ধর্মের আরেকটি বড় ভূমিকা ছিল : নৈতিকতার অভিভাবক।
এখন অবশ্যই আমাদের একটি পরিবর্তনের দিকে নজর দিতে হবে, যখন। ধর্ম আরো ব্যক্তিগত একটি দিকে মোড় নিতে শুরু করেছিল। গোষ্ঠীগত একটি কর্মকাণ্ড আর মানবসমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি উপায় ছাড়াও, ধর্ম ব্যক্তি’ পর্যায়ে পরিত্রাণের (সালভেশন) প্রতিশ্রুতি দিতে শুরু করেছিল। সালভেশন’ (পাপ ও পাপের পরিণাম থেকে পরিত্রাণ) শব্দটির উৎস ল্যাটিন, যার অর্থ স্বাস্থ্য, একটি স্মারক যে মানুষ প্রায়শই অসুস্থতা আর দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হতো। এই জীবনে তারা সুখ কিংবা ভালো অনুভব করতেন না, এমনকি নিজেদের নিজেদের সাথেও তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধও করতেন না। আর পরবর্তী জীবনে তাদের জন্যে কী অপেক্ষা করছে সেটি নিয়েই তারা দুশ্চিন্তা করতেন। যখন ধর্ম আরো বেশি ব্যক্তিগত দিকে মোড় নিয়েছিল, এটি তাদের অস্থির জীবনে এমন প্রশান্তি নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল যে, বিশ্বাসীরা এই অভিজ্ঞতাটি মরে যাওয়া এবং আবার জন্ম নেওয়া, অন্ধ হওয়া এবং আবার দেখতে পাওয়া, পক্ষাঘাগ্রস্ত হয়ে পঙ্গু হওয়া এবং আবার হাঁটতে পারার মতো অলৌকিক কোনো অভিজ্ঞতার সাথে। তুলনা করে বর্ণনা করতে শুরু করেছিলেন। ধারণা করা হয় বিচিত্র ধর্মগুলোর পারস্পরিক সম্মিলন মূলত এই পরিবর্তনগুলোর সূচনা করেছিল।
আর এটিকে যতই অসম্ভাব্য মনে করা হোক না কেন, মূলত রোমসাম্রাজ্যের সৈন্যরাই এই পরিবর্তনের দিকে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি দিয়েছিলেন। কমন এরা শুরু হবার ত্রিশ বছর আগেই, রোমের সংস্কৃতি পারস্য আর গ্রিক সংস্কৃতির প্রভাবে অভিভূত হয়েছিল। রাজনৈতিকভাবে রোমানরা বিজয়ীপক্ষ ছিল, কিন্তু তারা যে দেশগুলো দখল করেছিল সেখানকার সংস্কৃতি তারা এত বেশিমাত্রায় আত্তীকৃত করেছিলেন যে, পরিশেষে কখনো কখনো বলা কঠিন হয়ে পড়ে, এখানে আসলে বিজয়ী কারা। গ্রিক আর পারস্যের প্রজাদের কাছে শোনা পুরাণকাহিনি তাদের এতই পছন্দ হয়েছিল, তাদের জীবনে তারা সেগুলোকে এমনভাবে গ্রহণ করেছিলেন যে, সেটি ধর্মের ভবিষ্যতের ওপর গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রভাব ফেলেছিল।
ঠিক যেভাবে চীনারা বৌদ্ধবাদকে, তারা যেভাবে সবকিছু করেন এবং তাদের জীবনের সাথে সংগতিপূর্ণ করে নিয়েছিলেন, সেভাবে রোমানরা গ্রিক পুরাণকে আত্তীকৃত করে নিয়েছিল তাদের সংস্কৃতিতে। রোমানরা খুব প্রয়োগবুদ্ধিসম্পন্ন একটি জাতি ছিলেন, কর্মপাগল মানুষ। সুতরাং তারা এইসব প্রাচীন পুরাণগুলোকে। নিয়ে এটিকে রূপান্তরিত করেছিল, যা আমরা এখন বলব, রোল প্লে’ বা সেই ভূমিকায় অভিনয় করা। এই গল্পগুলোর চরিত্র অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমে তাদের নিজেদের জীবন বদলে গিয়েছিল। এটি প্রাচীন কোনো পুরাণকে বিশ্বাস করার উদাহরণ ছিল না, যা তারা গ্রিকধর্ম থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। বরং আবেগীয় আর মনোজাগতিক একটি অভিজ্ঞতায় সেগুলো রূপান্তরিত করাই তাদের জন্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
কিন্তু গ্রিকদের একটি ধর্ম ‘ছিল’ এমন কিছু ভাবলে আসলে ভুল হবে, যেমন, ইহুদিদের ছিল জুডাইজম বা পারস্যের অধিবাসীদের ছিল জরাথুস্ট্রবাদ।
তাদের ধর্মটি জাপানিদের শিন্টোর সাথে যেমন সম্পর্ক ছিল সেরকমই ছিল, রোমানদের সাথে যতটা সদৃশ্যতা ছিল তারচেয়েও বেশি। অবশ্যই তারা বহুঈশ্বরবাদী ছিলেন, কিন্তু তাদের দেবতারা ভূখণ্ডের অংশও ছিল, যেমন, তাদের পর্বত, সাগর আর সূর্য, যা তাদের উপর উজ্জ্বল আলো ছড়াত। আর দেবতারা তাদের কাজ করতেন অনেকটাই আবহাওয়া যেমনটা কাজ করে। এবং আবহাওয়ার মতোই দেবতারা শান্ত আর অনুকূল যেমন হতে পারতেন, আবার বিপজ্জনক ঝুঁকিপূর্ণও হতে পারতেন। আর ঠিক এভাবেই সবকিছু ছিল। একজন প্রধান দেবতা ছিলেন, যার নাম জিউস, আকাশের দেবতা, যার দুইজন ভাই ছিলেন, সাগরের দেবতা পসাইডন আর পাতাল নরকের দেবতা হেডিস, যেখানে মৃতদের বাস। এছাড়াও বহুসংখ্যক অন্য দেবতারাও ছিলেন, তাদের কেউ কেউ প্রকৃতির নিয়মিত নানা কর্মকাণ্ডের ছন্দের সাথে যুক্ত ছিলেন। পুরাণের এই বিশাল ভাণ্ডার থেকে একটি গল্প, স্বর্গীয় একটি অভিযানের কাহিনি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হয়েছিল রোমান সাম্রাজ্যে, যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল।
এই গল্পটি শুরু হয়েছিল প্রকৃতি-সংক্রান্ত একটি পুরাণ দিয়ে, কিন্তু যখন রোমানরা এটি সংগ্রহ করেছিল, তারা এটিকে একটি ধর্মে রূপান্তরিত করেছিল, যাকে আমরা রহস্যময় ধর্ম’ বলতে পারি, একগুচ্ছ গোপন আচার আর অনুশীলন, যা এর অনুসারীদের হৃদয়ে গভীর আবেগপূর্ণ একটি অভিজ্ঞতার উদ্রেক করতে সক্ষম হয়েছিল। হেডিসের গ্রিক পুরাণে, যিনি পাতালপুরীর দেবতা ছিলেন, মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন একজন স্ত্রীর জন্যে, যিনি কিনা তার সাথে তার বিষণ্ণ পাতালপুরীতে বাস করবেন। সুতরাং তিনি পার্সিফোনকে অপহরণ করেছিলেন, পার্সিফোন ছিলেন ডেমেটারের মেয়ে, যিনি ছিলেন ফল, শস্য আর বৃক্ষের দেবী। মেয়েকে হারিয়ে তিনি এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন, সব দায়িত্ব অবহেলা করে তিনি। গভীর একটি শোকে প্রবেশ করেছিলেন। পরিণতিতে খাদ্যশস্যের ফলন হয়নি, গাছ থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল ফল, দুর্ভিক্ষ আর মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে জিউস নিজেই হস্তক্ষেপ করেন এবং দুই পক্ষ যা চেয়েছিলেন তার অর্ধেকটা নিশ্চিত করে তিনি তাদের একটি সমঝোতায় নিয়ে আসেন। পার্সিফোন পৃথিবীর উপরে অর্ধবর্ষ কাটাবেন, আর বাকি অর্ধেক বছর। পাতালপুরীতে সে তার বিরক্তিকর স্বামীর সাথে কাটাবেন। যখন গ্রীষ্ম শেষ হবে, পাতালপুরীতে তার জন্য নির্দিষ্ট সময় কাটাতে তিনি হেডিসের কাছে যাবেন, তার মা ডেমেটার তখন আবার তার অনুপস্থিতির জন্যে শোক করবেন। শীত নামবে তখন, কোনোকিছুই জন্মাবে না। পাতা পড়ে যাবে গাছ থেকে, শস্যক্ষেত খালি থাকবে। কিন্তু বসন্তে পার্সিফোন আবার পৃথিবীর উপরে উঠে আসবেন, তার প্রত্যাবর্তনে মা ডেমেটার আনন্দিত হবেন, আর আবার সবকিছু তাদের জীবন ফিরে পাবে।
প্রকৃতিতে দৃশ্যমান পরিবর্তনগুলো ব্যাখ্যা করতে কীভাবে একটি পুরাণ সৃষ্টি করে নেওয়া যেতে পারে এটি তার সুন্দর একটি উদাহরণ, সেটি একই সাথে মানবজীবনের উত্থান আর পতনের বিষয়টি প্রকাশ করতেও ব্যবহার করা যেতে পারে। মানব অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলা, আর পুনরায় সেটি ফিরে পাওয়া, ব্যর্থতা আর সফলতা, মৃত্যু আর পুনর্জন্মের একটি ছন্দ আছে। একটি মরে-যাওয়া আর নতুন করে জেগেওঠা দেবতার ধারণাটি মানুষের আত্মার গভীরে একটি প্রয়োজনীয়তার সাথে সংগতিপূর্ণ হয়েছিল। এই কাহিনিটির আর এর অর্থ অনুসন্ধান করার জন্য আচারগুলো রোমসাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি রহস্যময় ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছিল। রহস্য বা মিস্ট্র’ শব্দটি এসেছে একটি গ্রিকশব্দ থকে, যার অর্থ নীরব থাকা অথবা নিজের মুখ বন্ধ করে রাখা, কারণ এই ধর্মের সদস্যরা তাদের পালিত আচার আর উৎসব নিয়ে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করতেন।
কমন এরা শুরু হবার প্রায় ১৪০০ বছর আগে এই কাল্ট বা গোপন ধর্মীয় গোষ্ঠীটির উদ্ভব হয়েছিল এথেন্সের কাছে এলেউসিসে, একটি ছুটির উৎসবকে কেন্দ্র করে, যেদিন পৃথিবীর মানুষকে ফল উপহার দেবার জন্যে দেবী ডেমেটারকে উপাসনা করা হতো। কিন্তু রোমসাম্রাজ্যে এর আচারে আবৃত রূপটি পরিচিত ছিল এলেউসিনিয়ান কাল্ট নামে, ব্যক্তিক পর্যায়ের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার ওপর এর মতাদর্শের মূল তাগাদাটি ছিল, যারা দেবতার মৃত্যু আর তার পুনরায় জেগে ওঠার রহস্যটিকে গভীরভাবে অনুভব করতেন। এই কাল্টে যে-ব্যক্তিকে সদস্য করে নেওয়া হতো, তার একটি কমিউনিয়ন বা সংযোগ করতে হতো দেবীর সাথে এবং তাকে তার মৃত্যুর সেই শীতকাল এবং বসন্তে পুনর্জাগরণ অনুভব করতে হতো, আর এটি অর্জন করা হতো ধর্মীয় আচারের মাধ্যমে, যা প্রথমে কোনো অন্ধকার এলাকায় নেমে যাওয়া, তারপর আবার নতুন দিনের আলো বা নতুন জীবনে ফিরে আসার অভিজ্ঞতাটি অনুকরণ করত। মূলত আবেগের ওপরে এই আচারের আবেদন ছিল। এটি এমন কিছু না যে তারা সেটি ‘শিখেছিল’, এটি ছিল এমন কিছু যা তারা অনুভব করতেন। আর এই কমিউনিয়নের অভিজ্ঞতাটি তাদের মধ্যে একটি পরিবর্তনের সূচনা করত। মনে রাখতে হবে : এই সবকিছুই মানুষের মনের ভিতরে ঘটত। আর আমরা জানি মন খুবই অদ্ভুত একটি জায়গা। এখানে স্বর্গ আর নরক, উচ্চতা আর গভীরতা, অন্ধকার আর আলো থাকে। এলেউসিনিয়ানদের যাজকরা মানব-মন বিষয়ে খুবই দক্ষ ছিলেন। তারা জানতেন কীভাবে তাদের অনুসারীদের নানা নাটকীয়তার মধ্যে দিয়ে পরিত্রাণের সূর্যালোকিত প্রান্তরে নিয়ে আসতে হয়।
ডেমেটার আর পার্সিফোনের মতো শুধুমাত্র গ্রিকদেবতারাই রোমসাম্রাজ্যে। রহস্যময় ধর্মগুলোয় তাদের নতুন জীবন খুঁজে পাননি, পারস্য থেকে একজন প্রাচীন জরথুস্ত্রীয় দেবতা, মিথরাস আরেকটি রোমান ধর্মীয় কাল্টের কেন্দ্রীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছিলেন। গুহায় জন্ম নেওয়া মিথরাস ছিলেন একজন সূর্যদেবতা, যিনি একটি পবিত্র ষাঁড়কে হত্যা করেছিলেন, যার রক্তে পৃথিবী আর এর সব প্রাণীদের জন্ম হয়েছিল। রোমের সৈন্যরা পূর্বে তাদের সামরিক অভিযানের সময় মিথরাসের গল্প শুনেছিলেন। তাদের এর রক্ত আর তরবারির মূলধারণাটি ভালো লেগেছিল। তারা সেই সাহসকে প্রশংসার সাথে দেখেছিলেন, যে-সাহসে ভর করে মিথরাস একাই পবিত্র ষাঁড়কে হত্যা করেছিলেন। এবং তাদের সেই ধারণাটিও পছন্দ হয়েছিল যে, হত্যা এবং রক্তপাত ঘটিয়ে অন্যদের জন্য নতুন আর উত্তম জীবনের উদ্ভব ঘটানো সম্ভব। সুতরাং তারা অনেকেই এই পুরাণটিকে আত্তীকৃত করেছিলেন তাদের নিজেদের লক্ষ্যপূরণে, এবং এটি তাদের প্রিয় একটি রহস্যময় ধর্মীয় গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল।
এলেউসিনিয়ান গোষ্ঠীর চেয়ে মিথরাইজম আরো বেশি রক্তাক্ত ছিল, কিন্তু এদের মূল ধারণা খুব একটা ভিন্ন ছিল না। এটিও নতুন জীবন অভিমুখে দরজা হিসাবে মৃত্যুর উদ্যাপন করত। এর আচারগুলো হতো গোপনে, কোনো গুহায়, এবং শক্তিশালী আবেগীয় অভিজ্ঞতা এর অংশ ছিল। এটিও ‘শেখার বিষয় না, ‘অনুভব’ করতে হতো। এমনি গুহা ভীতিকর একটি জায়গা, সুতরাং এরকম কোনো একটি জায়গায় জমায়েত হবার বিষয়টি এই কাল্টের অনুসারীদের মনে একটি অস্বস্তিকর প্রভাব ফেলত। একজন রোমান-সৈন্য প্রতিদিনই মৃত্যুর মুখোমুখি হতো, সুতরাং কোনো একটি ধর্ম বিসর্জনের উদ্দেশ্য মৃত্যু এবং এর থেকে প্রবাহিত হওয়া নতুন জীবনটিকে, যা নাটকীয়তার মোড়কে উপস্থাপন করত, সেটি নিশ্চয়ই তার ভক্তি আদায় করে নিতে পারত। মিথরাইজম শুধুমাত্র পুরুষদের ধর্ম ছিল। আর এটাই রোমান সেনাবাহিনীর মতো পৌরুষ প্রদর্শনীর একটি সমাজে এই ধর্মটির বিশেষ আবেদনময়তার আরেকটি অংশ ছিল। গোপন আচার আর ব্যক্তিগত ভাষাসহ এই গোপন গোষ্ঠীগুলো এর সদস্যদের নিজেদের বিশেষ কিছু ভাবতে প্ররোচিত করত, যা আর সবার থেকে ভিন্ন এবং অবশ্যই সেরা। আর শুধুমাত্র একটি বিশেষ সমাজের সদস্য হবার বিষয়টি কিছু বিশেষ ধরনের মানুষদের মনে আবেদন রেখেছিল। এইসব আবেদন সৃষ্টির মূল কৌশলগুলো মিথরাইজমের দখলে ছিল।
রোমসাম্রাজ্যে এইসব রহস্যময় ধর্মগোষ্ঠীগুলোর আবির্ভাব ধর্মীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক পরিবর্তনের মুহূর্ত ছিল। এর আগে, ধর্ম মূলত ছিল সামাজিক পরিচয়ের সাথে যুক্ত একটি সামষ্টিক কর্মকাণ্ড। কারণ ইহুদিদের জন্যে ধর্ম ছিল, যে-ধর্মে তাদের জন্ম হয়েছে, এবং তার নির্বাচিত জাতি হিসাবে ঈশ্বর যাদের এই ধর্ম অনুসরণ করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাদের নৈতিক দৃঢ়তা, ইহুদি জাতির বাইরে অন্য সমব্যথীদের আকৃষ্ট করত, কিন্তু অন্য ধর্মের সদস্যরা তাদের জন্মের সেই দুর্ঘটনাকে পরিবর্তন করতে পারেন না। হিন্দুধর্ম এমন কিছু যে-ধর্মে আপনার জন্ম হতে হবে, সেই জাতপ্রথা অবধি, যা আজীবন আপনার সাথে যুক্ত হয়ে থাকবে। সেই সময় অবধি এর ব্যতিক্রম ছিল শুধুমাত্র একটি : বৌদ্ধধর্ম। এটি গোষ্ঠীর নিয়তিকে চ্যালেঞ্জ করেছিল এবং একক সদস্যদের পরিত্রাণের জন্যে তাদের কাছে একটি সংস্করণ প্রস্তাব করেছিল। এবং সেই সময় নাগাদ পুরো এশিয়াজুড়ে একটি বিশ্বজনীন ধর্ম হবার পথে ছিল, যে-কোনো জায়গায়, যে কোনো সময়ে, যে-ধর্মটি সবার জন্যে উন্মুক্ত।
একটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, যে-ধর্মগুলো ব্যক্তিগত স্তরে এর অনুসারীদের সহায়তা করে, সেই ধর্মগুলোর দ্রুত বৃদ্ধি এবং বিশ্বজনীন হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ, পৃথিবী পূর্ণ এমন বহু মানুষ দিয়ে, যারা পরিত্রাণ খুঁজছেন। আর রহস্যময় এই ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো দেখিয়েছে মানবসমাজে এই প্রবণতা কাজ করছে। বহু ব্যক্তিই সেখানে স্বেচ্ছায় যোগ দেন। আর এটি ‘গোষ্ঠীগত পরিচয় হিসাবে ধর্মধারণাটিতে একটি পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল এবং ব্যক্তিগত ধর্মান্তরিতকরণের ধারণাটি এটিকে প্রতিস্থাপিত করেছিল। আর তাদের অনুসারীদের পরিত্রাণ পাবার আবেগীয় অভিজ্ঞতা দিতে যে-উপায়গুলো এই গোষ্ঠীগুলো ব্যবহার করত, তা বিশেষ একটি ছক সরবরাহ করেছিল, তখনও জন্ম হয়নি এমন বহু ধর্মই, যা পরবর্তীতে অনুকরণ করেছিল। একটি দেবতার ধারণা, যিনি কিনা মৃত্যুবরণ করেছেন এবং তারপর আবার বেঁচে উঠেছেন, সেটি মানবপ্রকৃতির কোথাও-না কোথাও আবেদন রাখে, বিশেষ করে যদি এটি তাদের নিজেদের সমাধি থেকে বের হয়ে আসার একটি উপায় প্রস্তাব করে।
এইসব নতুন ধারণা আর প্রবণতাগুলো ধর্মের ইতিহাসে তাদের সবচেয়ে শীর্ষ অভিব্যক্তিটিকে স্পর্শ করতে আরো কয়েক শতাব্দী সময় লেগেছিল। কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল আর প্রাধান্যবিস্তারকারী ধর্মটির আবির্ভাবের জন্য দৃশ্যপটটি ততদিনে প্রস্তুত হয়েছিল। যখন খ্রিস্টধর্ম এর সবচেয়ে সফলতম পর্বে ছিল, এটি নিজেকে চিহ্নিত করেছিল ক্যাথলিক’ নামে। ‘ক্যাথলিক’ শব্দটি এসেছে গ্রিকভাষা থেকে, এর মানে বিশ্বজনীন’। এবং এর ভিত্তিমূলক বিশ্বাস ছিল একজন ঈশ্বরের মৃত্যু আর আবার তার পুনর্জাগরিত হওয়া। পরের কিছু অধ্যায়ে আমরা সেই বিষয়গুলো অনুসন্ধান করব, কীভাবে এই ধর্মটি, যা খুব ক্ষুদ্র একটি ইহুদি উপগোষ্ঠী হিসাবে এর যাত্রা শুরু করেছিল, সেটি আসলেই পৃথিবীর প্রথম সত্যিকারের বিশ্বজনীন ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছিল– ক্যাথলিক চার্চ-আর কীভাবে এটি এর নিজের জন্যে এই খেতাবটি অর্জন করেছিল।