১৭. দুজনই দেব শিশু

দুজনই দেব শিশু।
দেখে মনে হচ্ছে তারা তাদের ছোট্ট ডানা দুটি ঘরের বাইরে রেখে খেলতে বসেছে। এই খেলাও অদ্ভুত খেলা। একজনের হাতে একটা কাঁচি, অন্যজন বিছানার চাদর ধরে আছে। কচ কিচ করে চাদর কাটা হচ্ছে। বাচ্চা দুজনের কারো মুখেই কোন বিকার নেই!

পুতুল অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখছে। বাচ্চা দুটিকে সে চেনে তবে এখনো ভাল পরিচয় হয়নি। আজ পরিচয় করার জন্যেই এসেছিল। এসে দেখে এই কাণ্ড। তার বাধা দেয়া উচিত। কিন্তু বাধা দেয়ার পর্যায় পার হয়ে গেছে। বাচ্চা দুটি বিছানার চাদর কেটেছে, বালিশ কেটেছে একটা লেপ কেটেছে। ঘরময় তুলা উড়ছে। ভয়াবহ অবস্থা।

পুতুল বলল, এইসব কি?

নিশা হালকা গলায় বলল, কিছু না।

তোমরা এইসব কেন করতাছ?

কাটাকুটি খেলছি।

বোনের এই কথা টগরের পছন্দ হল না। সে বলল, আমরা দরজি দরজি খেলছি।

দরজি দরজি খেলতাছ?

হুঁ।

বলেই টগর হাসল। অনেকদিন থেকেই এই খেলাটা তার খুব পছন্দ।

রাস্তার ওপাশে নতুন দরজির দোকান হয়েছে— ক্যালকাটা সুদৃটিং সেখানে খচখচ করে রাত দিন কাঁচি দিয়ে কাপড় কাটা হয়, টগর গভীর আগ্রহে দেখে। আজ অনেক দিন পর এই খেলার সুযোগ পাওয়া গেল। কাঁচি অনেক কষ্টে নিশা মিলির কাছ থেকে জোগাড় করেছে।

পুতুল বলল, তোমাদের আব্বা তোমাদের মারবে না?

টগর বলল, মারবে। তারপরেও এই রকম করতাছ?

হুঁ।

কেন?

নিশা ছোট্ট করে হেসে বলল, বেশি মারবে না। অল্প মারবে।

অল্প মারবে কেন?

আমাদের মা মারা গেছেতো। মা মারা গেলে বাচ্চাদের বেশি মারার নিয়ম থাকে না। কম মারতে হয়।

পুতুল বলল, অনেক খেলা হইছে এখন হাত থাইক্যা কেচিটা নামাও। না হইলে হাত কাটব।

টগর বলল, আপনি এখন যানতো। আপনি আমাদের বিরক্ত করবেন না। পুতুল নড়ল না। এমন মজার একটি দৃশ্যের আকর্ষণ এড়িয়ে সে যেতে পারছে। না। বাচ্চা দুটি টুকটুক করে কথা বলছে।

নিশা বলল, আপনি আমার জন্যে এক গ্লাস খাওয়ার পানি আনেন তো। এমন ভাবে বলল যেন কতদিনের পরিচিত। কত দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্টতা। পুতুল পানি আনতে গেল।

পানি এনে দুই দরজির কাউকেই পাওয়া গেল না। তারা অদৃশ্য। ডেকেও সারা পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ আনিস ঘরে এসেছে। তার সাড়া পাওয়ার পরই এই অবস্থা।

পুতুল আনিসকে দেখে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, স্নামালিকুম।

আনিস বলল, ওয়ালাইকুম সালাম। তুমি এমদাদ সাহেবের নাতনী তাই না? পুতুল তোমার নাম?

জি।

দেখেছ কি অবস্থা?

পুতুল কিছু না বলে মুখ নিচু করে হাসল। আনিস বলল, এদের যন্ত্রণায় অস্থির হয়েছি। এরা যা করছে তার নাম দুষ্টুমি না। এ হচ্ছে ইচ্ছা করে আমাকে কষ্ট দেয়া! তোমার পানির গ্রাসটা কি আমাকে দিতে পার?

পুতুল গ্লাস এগিয়ে দিল। আনিস এক চুমুকে পানি খেয়ে ফেলল। বিষণ্ণ গলায় বলল, এই ঘটনা কিন্তু আজ নতুন ঘটছে না। এটা পুরনো ঘটনা। আগেও কাটাকুটি খেলা একবার হয়েছে। তখন তারা প্ৰতিজ্ঞা করেছিল আর কোনদিন খেলবে না। বার বার তো এটা হতে দেয়া যায় না।

পুতুল বলল, বাদ দেন। এরা ছোট মানুষ।

তুমি ভুল বলছ পুতুল–ওরা ছোট হলেও আমার সঙ্গে যা শুরু করেছে তা বড় মানুষদের খেলা। এক ধরনের দাবা খেলা। তারা একরকম চাল দিচ্ছে। আমি এক রকম চাল দিচ্ছি। আমার সংসার টিকে থাকবে কি থাকবে না। এটা নির্ভর করছে এই খেলায় জয় পরাজয়ের উপর।

এই মানুষটার কথাগুলো পুতুলের বড় ভাল লাগছে। কি সহজ সরল ভঙ্গিতেই না পুতুলের সঙ্গে কথা বলছে। যেন পুতুল তার কত দীর্ঘদিনের চেনা মানুষ অথচ এর আগে একদিন মাত্র কথা হয়েছে। তাও–কি নাম? দেশ কোথায়? এ রকম কথা।

পুতুল।

জ্বি।

ওরা কোথায় পালিয়েছে তোমার কোন ধারণা আছে?

জ্বি না,

আচ্ছা ওদের খুঁজে বের করছি, তার আগে এসো আমরা দুজন এক কাপ করে চা খাই। না কি তুমি চা খাও না?

খাই।

তাহলে বরং চা বানাও। চা খাবার পর ঠিক করব টগর এবং নিশাকে কি শাস্তি দেয়া যায়।

কত সহজ কত আন্তরিকভাবেই না লোকটা কথা বলছে, শুনতে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে তারা সবাই একই ছাদের নিচে দীর্ঘদিন ধরে আছে, যে ছাদের উপর ঝড়ে পড়েছে কত বৃষ্টি কত জ্যোৎস্না।

চা বানানোর কেরোসিন কুকার ঘরের এক কোণেই আছে। কোরোসিন কুকার ধরাতে অসুবিধা হল না। চা বানাতে বানাতে ছোট ছোট সব কথা হতে লাগল। প্রতিটি প্রশ্নের জবাব আনিস খুব মমতার সঙ্গে দিল। যেমন পুতুল বলল, ভাইজান আফনে কি করেন?

আনিস হাসতে হাসতে বলল, আমি কিছুই করি না, আবার অনেক কিছুই করি।

সেইটা কেমুন?

আমি লিখি! একজন লেখককে দেখলে কখনো মনে হবে না। সে বিশেষ কিছু করছে। হাতে হেলাফেলা করে ধরা একটা কাগজ। একটা কলম বা পেন্সিল। একজন শ্রমিককে বিশাল এক খণ্ড পাথর উপড়ে তুলতে কত না পরিশ্রম করতে হয়। টপ টপ করে তার মাথা বেয়ে ঘাম পড়ে অথচ একজন লেখককে দেখবে কত অনায়াসে লিখছে— অপূর্ব সব লেখা। এইসব লেখা কি তুমি কখনো পড়েছ?

পুতুলের কথা শুনতেই ভাল লাগছে, জবাব দিতে ইচ্ছে করছে না। ওদিকের মানুষটি বোধ হয় তা বুঝতে পারছে। সে বলছে–দেখা পুতুল লেখালেখি কি অদ্ভুত জিনিস মাত্র চার লাইনের একটা কবিতা, মাত্র দুলাইনের দুটি বাক্যে ধরা দিতে পারে মহান কোন বোধ, জীবনের গভীর ক্ৰন্দন।

পুতুল চুপি চুপি বলল, একটা বলবেন?

হ্যাঁ বলব। আমি টগর ও নিশাকে প্রায়ই বলি। তুমি যদি আসি তুমিও শুনবে। আজ না আজ থাক। আজ আমার মনটা খারাপ। বাচ্চা দুটি বডড কষ্ট দিচ্ছে। কি চাচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি না। পুতুল।

জি।

তুমি কি আমাকে আরেক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াবে?

কত সামান্য কথা অথচ পুতুলের এত ভাল লাগল। তার ইচ্ছা করছে আনন্দে একটু কাব্দে। তার কেন এত আনন্দ হল? এই আনন্দের উৎসব কোথায়? এইত চোখ ভিজে উঠছে। কেন, চোখ ভিজে উঠল কেন?

 

টগর ও নিশা বিলুর পেছনে পেছনে রাত দশটায় শোবার ঘরে ঢুকল এবং কোনদিকে না তাকিয়ে বিছানায় উঠে পড়ল। মুহুর্তের মধ্যে তাদের চোখ বন্ধ। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। যেন ঘুমিয়ে কাদা। বিলু বলল, আনিস সাহেব দয়া করে এবারের মত বাচ্চাদের ক্ষমা করে দিন। ওরা যা করেছে তার জন্যে খুব লজ্জিত, দুঃখিত এবং অনুতপ্ত! ভয়ে এ ঘরে আসতে চাচ্ছিল না। আমি অভয় দিয়ে নিয়ে এসেছি।

আনিস বলল, থ্যাংকস।

ওরা আমাকে কথা দিয়েছে আর কোনদিন এরকম করবে না।

এই কথা, কথা পর্যন্তই! ওরা আবারো এ রকম করবে এবং আপনার মতো অন্য কাউকে ধরে নিয়ে আসবে যাতে ক্ষমা করা হয়। কাজেই এবার ক্ষমার প্রশ্নই উঠে না।

 

বিলু অবাক হয়ে বলল, আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি তারপরেও আপনি ক্ষমা করবেন না? তারপরেও এরকম কঠিন করে কথা বলছেন?

হ্যাঁ বলছি। কারণ আপনার আগে আপনার বাবা এদের একবার নিয়ে এসেছেন, আপনার মা নিয়ে এসেছেন, মিলি এনেছে। একবার কাদের প্রটেকসন দিয়ে এনেছে।

বিলু কঠিন স্বরে বলল, অর্থাৎ আপনি ওদের শাস্তি দেবেন?

হ্যাঁ।

কি শান্তি জানতে পারি?

ওরা জানে কি শাস্তি। ওদেরকে আমি বলে রেখেছি যে, আবার যদি তারা কাটাকুটি খেলা খেলে তাহলে ওদের ফেলে রেখে আমি চলে যাব।

আপনি ওদের ফেলে রেখে চলে যাবেন?

হ্যাঁ।

বেশ চলে যান। আপনার সংসার আপনি চালাবেন। যেভাবে চললে ভাল হয় সে ভাবে চালাবেন।

আনিস রাত ১১টা দশ মিনিটে ব্যাগ হাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। বিলু। সারাক্ষণই ভাবছিল এটা এক ধরনের ঠাট্টা হয়ত গোট পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসবে। দেখা গেল ব্যাপার মোটেই ঠাট্টা না। আনিস সত্যি সত্যি চলে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *