১৭. দবির মিয়া বিছানায় শোওয়ামাত্র

দবির মিয়া বিছানায় শোওয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়তে পারে। আজ রাতে নিয়মের ব্যতিক্রম হল। বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে রাত দুটা বাজল-ঘুম এল না। তার পাশে অনুফা ঘুমাচ্ছে মড়ার মত। মরেই গেছে কিনা, কে জানে। শ্বাস ফেলার শব্দ পর্যন্ত নেই। দবির মিয়া চাপা স্বরে বলল, এ্যাই, এ্যাই। কোনো সাড়া নেই। মেয়েরা বড় হয়েছে। এখন আর মাঝরাতে স্ত্রীকে ঘুম থেকে ডেকে ডেকে তোলা যায় না। মেয়েরা শুনে কি-না-কি ভেবে বসবে। দবির মিয়া অনুফাকে বড়ো কয়েকটি ঝাঁকুনি দিল। অনুফা বিড়বিড় করে পাশ ফিরল। তার ঘুম ভাঙল না। দবির মিয়া বিছানা ছাড়ল রাত দুটার দিকে। শুয়ে থাকার কোন মানে হয় না। যে-কোন কারণেই হোক ঘুম চটে গেছে। সে কাতালায় পরপর দুটি সিগারেট শেষ করল। বাইরেউলপাথাল হাওয়া। খালি গায়ে থাকার জন্যে শীতশীত করছে। এরকম হওয়ায় বারান্দায় বিছানা পেতে জহুর ঘুমায় কী করে কে জানে? দিনকাল ভালো না। এরকম খোলামেলা ভাবে বারান্দায় ঘুমান ঠিক না। জহুরের শত্রুর তো অভাব নেই। কিন্তু জহুর যেটা মনে করবে, সেটাই করবে। অন্যের কথা শুনলে কি আর আজ এই অবস্থা হয়? দবির মিয়া আরেকটি সিগারেট ধরাল।

জহুরের ব্যাপারে কিছু একটা করা দরকার, কিন্তু করবেটা কী? একটা লঞ্চের যোগাড় দেখার কথা ছিল, সেটা সম্ভব না। একা-একা লঞ্চ কেনা তার পক্ষে সম্ভব না। সফদর শেখের সঙ্গে কথা হয়েছিল, সে টাকা দিতে রাজি, কিন্তু জহুরকে রাখতে রাজি না।

বুঝেন তো দবির ভাই, নানান লোকে নানান কথা বলবে।

কী কথা বলবে?

সফদর শেখ তা আর পরিষ্কার করে বলে না, দাড়ি চুলকায়।

জহুর একটা নির্দোষ লোক, সেইটা জানেন আপনি সফদর সাব?

আরে ছিঃ ছিঃ, তা জানব না কেন? আমি কত আফসোস করলাম। এখন করি।

দবির মিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, আফসোসে কোন ফয়দা হয় না।

ফয়দা হয় না ঠিকই, তবু আফসোস থাকাটা ভালো। লোকজনের তত আফসোস পর্যন্ত নাই। এই যে ছেলেটা আসল, কেউ কি বাড়িতে এসে ভালো-মন্দ কিছু বলেছে? না, বলে নাই। মানুষের কিছুই মনে থাকে না। চৌধুরী সাহেব তো ভালো মতেই আছেন। কয়েক দিন আগে ডিগ্রী কলেজের জন্যে অনেকখানি জমি দিলেন। নিজের পয়সার গার্লস স্কুলের একটা হোস্টল তৈরি করে দিলেন। বিরাট হলস্থুল। ময়মনসিংহের ডিসি সাহেব আসলেন। কত বড়ো বড়ো কথা; কৰ্মযোগী, নীরব সাধক, নিবেদিতপ্রাণ–দূর শালা।

দবির মিয়া কলতলা থেকে উঠে এসে বারান্দায় বসল। জহরকে কিছু একটাতে লাগিয়ে দেওয়া দরকার। বিয়ে-শাদি দেওয়া দরকার। বিয়ে দেওয়াটাও তো মুশকিল। কে মেয়ে দেবে? দেশে মেয়ের অভাব নেই। কিন্তু খুন করে ছ-সাত বছর জেল খেটে যে-ছেলে এসেছে, তার জন্য মেয়ে নেই। চৌধুরী সাহেব অবশ্যি একটি মেয়ের কথা বলেন। সম্পর্কে তাঁর ভাতিজী। মেয়েটিকে দেখেছে দবির মিয়া। শ্যামলা রঙ, বেশ লম্বা। দেখতে-শুনতে ভালোই। কিন্তু জহরকে বলারই তার সাহস হয় না। পুরনো কথা সব ভুলে গিয়ে নতুন করে সব কিছু শুরু করাই ভালো। বরফের মেশিনে ম্যানেজারীর চাকরিটা নিয়ে নিলে মন্দ কি?

বাহাদুর জেগে উঠেছে। বিকট চিৎকার শুরু করেছে অভ্যাস মতো। দবির মিয়া নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে প্রচণ্ড একটা চড় কল। কান্না থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। অনুফা বলল, কেন বাচ্চা দুইটারে মার?

দবির মিয়া উত্তর দিল না।

বাচ্চা দুইটা তোমারে যমের মতো ডরায়।

দবির মিয়া তারও উত্তর দিল না। আবার বাইরে গিয়ে বসল। তৃতীয় সিগারেট ধরিয়ে দবির মিয়া কাশতে লাগল। নাহু, আবার বিয়ে করাটা ভুল হয়েছে। মস্ত বোকামি। অনুফার আগের পক্ষের ছেলে দুটি তার বাপের কাছে থাকবে, এরকম কথা ছিল। কিন্তু সাত দিন পার না হতেই বাবলু আর বাহাদুর এসে হাজির। তারা কাউকে কিছু না বলে আট মাইল রাস্তা হেঁটে চলে এসেছে। তাদের দ জনকে পাওয়া গেল নীলগঞ্জের বাজারে। কোথায় কার বাড়ি যাবে কিছু বলতে পারে না। শুধু জানেনীলগঞ্জে তাদের মা থাকে। দুটি যমজ ছেলে নিমাইয়ের মিষ্টির দোকানে বসে কাঁদছে শুনে দবির মিয়া কৌতূহলী হয়ে দেখতে গেছে। তারপর মুখ গম্ভীর করে বাড়ি নিয়ে এসেছে। বাচ্ছা দুটি খালি হাতে আসে নি, প্যান্টের পকেট ভর্তি। করে তাদের মায়ের জন্যে কাঁচামিঠা আম নিয়ে এসেছে।

ছেলে দুটি বিন্দু। মহা বিচ্ছু। তাদের নানা খবর পেয়ে এসে নিয়ে গিয়েছিল। তিন দিন পরই রাত নটায় দু মূর্তি এসে হাজির। দবির মিয়া তক্ষুণি ফেরত পাঠাবার জন্যে ব্যবস্থা করল। বাদ সাধন টুনী।

না বাবা, থাকুক।

থাকুক মানে?

মায়ের সাথে থাকুক।

দবির মিয়ার বিরক্তির সীমা রইল না।

থাকার জায়গাটা কোথায়?

জায়গা না থাকলেও থাকবে। মাকে ছাড়া থাকতে পারে!

ধামড়া ধামড়া ছেলে, মাকে ছাড়া থাকতে পারে না–একটা কথা হল!

দবির মিয়া মহা বিরক্ত হল। কী যন্ত্রণায় বিরক্তির সঙ্গে-সঙ্গে টুনীর সাহস দেখেও সে অবাক হল। বাপের মুখে-মুখে কথা বলে, বেয়াদপির একটা সীমা থাকা দরকার।

দবির মিয়া ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। খুট করে শব্দ হল একটা। দবির মিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, বাবলু বের হয়ে আসছে।

কী চাস তুই?

পেশাব করব।

শোয়ার আগে সারতে পারি না? বাঁদর কোথাকার। এক চড় দিয়ে দাঁত সবগুলো ফেলে দেব।

বাবলু বারান্দার এক কোণে প্যান্ট খুলে বসে রইল। দবির মিয়া আড়চোখে দেখল বাবলু ভীত চোখে বারবার দবির মিয়ার দিকে তাকাচ্ছে।

বারান্দায় বসে পেশাব করতে নিষেধ করি নাই?

বাবলু পাংশু মুখে উঠে দাঁড়াল।

পেশাব শেষ হয়েছে?

না।

শেষ কর।

বাবলু আবার বসল। দবির মিয়া বলল, স্কুলে যাস তো রোজা

যাই।

পড়াশোনা করিস তো ঠিকমতো?

হুঁ।

হুঁ আবার কি? বল জ্বি।

জ্বি।

পড়াশোনাটা ঠিকমতত করা দরকার।

বাবলু ঘরের দিকে যাচ্ছিল। দবির মিয়া হঠাৎ কী মনে করে মৃদু স্বরে বলল, এই বাবলু, বস দেখি এখানে।

বাবলু অবাক হয়ে পাশে এসে বসল।

কিচ্ছা শুনবি নাকি একটা? পিঠাপুলি রাক্ষসের কিচ্ছা?

স্তম্ভিত বাবলু কোনো উত্তর দিল না।

তুই আমারে ডরাস নি?

হুঁ।

হুঁ কিরে ব্যাটা? বল জ্বি।

জ্বি।

ডরাইস না। ডরের কিছু নাই। কিচ্ছা শুনবি?

হুঁ।

আবার হুঁ।

জ্বি। দবির মিয়া পিঠাপুলি রাক্ষসের কিচ্ছা শুরু করে।

অনুফা ঘুম ভেঙে অবাক হয়ে দেখল, দবির মিয়া মৃদু স্বরে বাবলুকে কী যেন বলছে। গল্প নাকি? তার চার বছরের বিবাহিত জীবনে এমন অদ্ভুত ঘটনা সে দেখে নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *