সপ্তদশ অধ্যায় – দক্ষযজ্ঞ-ধ্বংস
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–ইত্যবসরে শিব, শোভন মানসসরোবরে সন্ধ্যা সমাপন করিয়া নিজ আশ্রমের দিকে আসিতে লাগিলেন! ১
বৃষধ্বজ আসতে আসতেই বিজয়ার নিদারুণ তীব্ৰ আৰ্তনাদ শ্রবণ করিয়া ভয়-চকিত হইলেন। ২
অনন্তর, শিব, মন এবং পবনের ন্যায় শীঘ্রগামী বলবান বৃষারোহণে সত্বর নিজ আশ্রমে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ৩
তখন মহাদেব প্রিয়তমা দেবী দাক্ষায়ণীর নিকট আগমনান্তর তাহাকে মৃত দেখিয়াও প্রেমবশত মৃতবোধ না হওয়াতে তাহাকে পরিত্যাগ করিলেন না। ৪
অনন্তর বৃষধ্বজ, সতীর বদনমণ্ডল নিরীক্ষণপূর্বক মুখ মুছাইতে মুছাইতে সতীকে বার বার জিজ্ঞাসা করিলেন,–”দাক্ষায়ণি! ঘুমাইতেছ কেন?” ৫
তখন শিবের কথা শুনিয়া সতীর ভগিনী-তনয়া বিজয়া দাক্ষায়ণীর মৃত্যু বিবরণ বলিতে লাগিলেন। ৬।
বিজয়া বলিলেন,–শম্ভো! দক্ষ, যজ্ঞ করিবার জন্য সবান্ধব সুরাসুর, সিদ্ধ সাধ্য বিদ্যাধর, যক্ষ ও রাক্ষস প্রভৃতি সমুদয় দেবযোনি এবং ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও ইন্দ্রাদি দিক্পাল সকলকেই আহ্বান করেন। ৭-৮
দক্ষ, সে যজ্ঞে যাহাকে আহ্বান করেন নাই এমন প্রাণী ত্রিভুবন খুজিলেও পাওয়া যায় না। ৯
সতী, পিতার এইরূপ যজ্ঞ আরব্ধ হইয়াছে, আমার মুখে শুনিয়া তিনি তাঁহার নিজের এবং আপনার আহ্বান না হওয়ার কারণ চিন্তা করিতে লাগিলেন। ১০
হে ভূতনাথ! সতীকে তাদৃশ চিন্তিত দেখিয়া আমি যেমন শুনিয়াছিলাম তদনুসারে আপনাদিগের যজ্ঞে নিমন্ত্রণ না হইবার কারণ কীৰ্ত্তন করিলাম। ১১
আমার পিতা শুনিতে পান,–”শিব কপালী, সতী তাহার পত্নী, অতএব তাহার সংসর্গে দূষিতা; সুতরাং জামাতা শিব বা কন্যা সতী আমার যজ্ঞে আসিবে না।” দক্ষ নিজ গৃহে বীরিণীকে সুমিষ্টভাবে ইহা বুঝাইতেছিলেন, ইহাই নিমন্ত্রণ না হওয়ার কারণ। ১২-১৩
আমার এই কথা শ্রবণে সতী আমাকে কিছু না বলিয়া শোকাকুল-ভাবে বিবর্ণবদনে ভূতলে বসিয়া পড়িলেন। ১৪
হে মহেশ্বর! তাঁহার শ্যামবর্ণ বদনমণ্ডল তৎক্ষণাৎ ক্রোধে ভ্রূকুটীভীষণ ও ধূমকেতুর উদয়ে গগনতলের ন্যায় কঠোরভাবাপন্ন হইল। ১৫
অনন্তর, মুহূর্তকাল কি যেন ভাবিয়া মহাকুম্ভকে নিজ ব্ৰহ্মরন্ধ্র ভেদ করত প্রাণত্যাগ করিলেন। ১৬
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–রোষ-পূর্ণ মহারুদ্রের, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা ও মুখকুহর হইতে অগ্নিকণোদগারী প্রলয়-সূৰ্য-সন্নিভ ভৈরবনাদী বহুতর ভয়াবহ জ্বলন্ত উল্কা নির্গত হইতে লাগিল। ১৭
অনন্তর, মহাতপা দক্ষ, যথায় যজ্ঞ করিতেছিলেন,–রুদ্রদেব, তথায় গমন করিয়া যজ্ঞস্থানের বহির্ভাগে দণ্ডায়মান হইলেন। ১৮
কপর্দী মহাকোপে, বহুমূল্য-পাত্র-শোভিত যজ্বাদি-পরিবৃত সেই যজ্ঞ দর্শন করিলেন। ১৯
দেখিলেন, আজ্য-হোম-প্রদীপ্ত হুতাশন চতুর্দিকে প্রজ্বলিত, অস্ত্রধ্বজ সহ দিক্পালগণ সকলেই যথাস্থানে অবস্থিত, বিধাতা এবং বিষ্ণু যজ্ঞস্থলের মধ্যস্থানে,-রোষাবিষ্ট ধূর্জটি ইহা দেখিয়া দ্বিগুণ ক্রুদ্ধ হইলেন। ২০-২১
ইন্দ্র, ভগ, সূৰ্য, ভাৰ্যাগণপরিবৃত চন্দ্র এবং মহর্ষি গৌতম, ইহাদিগকে পূর্বভাগে অবস্থিত দেখিলেন। ২২
অগ্নি, মরুগণ, সাধ্যগণ, গরুড়, সনৎকুমার, আত্রেয় এবং ভার্গব, ইহাদিগকে অগ্নিকোণে অবস্থিত দেখিলেন। ২৩
যম, চিত্রগুপ্ত, বিশ্বদেব, অগ্নিষ্বাত্তাদি ও কব্যবাহাদি সমস্ত পিতৃগণ, চতুর্বিধ ভূতসমূহ, মঙ্গলগ্রহ, সিদ্ধ, প্রেত, মহর্ষি, অগস্ত্য এবং গালব–ইহাদিগকে দক্ষিণ দিকে অবস্থিত দেখিলেন। ২৪-২৫
নৈর্ঋতরাজ, রাক্ষস, পিশাচ, ভূত, মাংসাশী পশু-পক্ষি, ক্ষুদ্ৰজন্তু, কিন্নর, মহর্ষি মৌদগল এবং রাহু, ইহাদিগকে নৈর্ঋত কোণে অবস্থিত দেখিলেন। সানুচর, বরুণ, কামদেব, বসন্ত, শনিগ্রহ, গুহ্যক, মহাসর্প, গ্রাহ, নক্র, মৎস্য, কচ্ছপ, সপ্তসমুদ্র, নদ-নদী, তীর্থ, মানসাদি সমুদয় হ্রদ, গঙ্গা, জম্বুনদী এবং কাম, মধু, বসন্ত, অনুচরের সহিত বরুণ, শনৈশ্চর ও সমস্ত পৰ্বত-ইহাদিগকে পশ্চিমদিকে অবস্থিত দেখিলেন। ২৬-২৯
সানুচর বায়ু, প্রাণাদি পঞ্চ বায়ু, কল্পবৃক্ষ, হিমালয় এবং মহর্ষি কশ্যপ ইহা দিগকে বায়ুকোণে অবস্থিত দেখিলেন। ৩০
নলকুবরসহ যক্ষরাজ কুবের, স্থূলকৰ্ণাদি সুপণ্ডিত যক্ষ, সুমেরু প্রভৃতি পৰ্বত, কমলবৃন্দ, বহুতর ফল, চতুঃষষ্টিকলা, পদ্মাদিনিধি, বিবিধ রত্ন, সুবর্ণ, মনুষ্য, ধ্রুব যজ্ঞ, সোম, বিষ্ণু, অগ্নি, বায়ু, প্রত্যুষ এবং প্রভাত–ইহাদিগকে উত্তরদিকে অবস্থিত দেখিলেন। ৩১-৩৩
বৃষধ্বজ ব্যতীত সকল রুদ্র, বীজ, মন্ত্র, বিবিধ ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র, বিবিধ অন্ন, ব্রীহি এবং তিল–এতৎসমুদায়কে ঈশানকোণে অবস্থিত দেখিলেন। ঈশান কোণে পূর্বদিকের মধ্যস্থলে কঠোর ব্রতচারী ব্ৰহ্মর্ষি দেখিলেন। ৩৪-৩৫
মহর্ষি, চারিবেদ ও ছয় বেদাঙ্গ দেখিলেন। শিব নৈর্ঋত কোণ ও পশ্চিম দিকের মধ্যস্থলে শ্বেতপৰ্বত, সহস্রনাগ-পরিবৃত অনন্ত, কুষ্মাণ্ড, ডাকিনীগণ বেষ্টিত সপ্তভোগী কেতু, সৌদামিনী-বিজড়িত নানাবর্ণ জলদাবলী এবং করিণী সহিত ঐরাবত প্রভৃতি দিগগজবৃন্দ রহিয়াছে দেখিলেন। ৩৬-৩৮
মহারুদ্র দূর হইতে সেই মহাসমৃদ্ধিসমুজ্জ্বল যজ্ঞ স্থান অবলোকন করিয়া সত্বর বীরভদ্রকে তথায় প্রেরণ করিলেন। ৩৯
অনন্তর, বীরভদ্র, বহু-গণ-পরিবৃত হইয়া মহাত্মা দক্ষের যজ্ঞ-ধ্বংস করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। ৪০
বীরভদ্র যজ্ঞ ধ্বংস করিতেছেন দেখিয়া সৰ্ব্বদেবগণ-পরিবৃত বিষ্ণু তাহাকে নিবারণ করিলেন। ৪১
বীরভদ্র নিবারিত হইতেছেন দেখিয়া মহেশ্বর, রোষ-রক্ত-নয়নে স্বয়ং যজ্ঞ স্থানে প্রবিষ্ট হইলেন এবং যজ্ঞধ্বংস করিতে লাগিলেন। ৪২।
তাঁহাকে যজ্ঞস্থলে প্রবেশ করিতে দেখিয়া প্রথমেই ভগ * (সূৰ্য্যবিশেষ) ত্বরা সহকারে বাহুযুগল বিস্তৃত করিয়া রুদ্রদেবের সম্মুখীন হইলেন। ৪৩ [* ভৃগু (মুনিবিশেষ) পুস্তকান্তরের পাঠ]
তখন বৃষধ্বজও তাঁহাকে আসিতে দেখিয়া অত্যন্ত ক্রোধে অঙ্গুলীর অগ্রভাগ প্রহারে তাহার নয়নযুগল বিনষ্ট করিয়া দিলেন। ৪৪।
অনন্তর, দিবাকর (আর একজন সূৰ্য) * ভগসূৰ্য্যকে নেত্রহীন দেখিয়া স্পর্ধা-সহকারে সত্বর বিরূপাক্ষ রুদ্রদেবের সম্মুখীন হইলেন। ৪৫ [* সূৰ্য্য দ্বাদশটী]
অনন্তর, মহাদেব নিজ হস্তদ্বারা সেই সূর্যের হস্তধারণপূর্বক দূর করিয়া দিয়া অতিরোষভরে যজ্ঞাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। ৪৬
তৎপরে মাৰ্ত্তণ্ড বিশাল ভুজযুগল বিস্তার করিয়া হাস্য করত আগমনপূর্বক বলিলেন,–এস আমি তোমার সহিত যুদ্ধ করিব; বলিয়াই তাহার সম্মুখীন হইলেন। ৪৭
মার্তণ্ড হাস্য করিতেছিলেন–সময় বুঝিয়া বৃষধ্বজ অতিশয় কোপাবেগে চপেটাঘাত দ্বারা তাহার মুখ হইতে দন্তপংক্তি নিপাতিত করিলেন। ৪৮
যে যে দেবতা ও ঋষি তথায় ছিলেন, মার্তণ্ডকে দন্তহীন এবং ভগসূর্যকে নেত্রহীন দেখিয়া তাহারা সকলেই পলায়নপর হইলেন। ৪৯
মহাদেব অত্যন্ত ক্রোধে সমুদায় দেবাদিকে তাড়াইয়া দিয়া মৃগরূপে পলায়ন-পর যজ্ঞের অনুসরণ করিতে লাগিলেন। ৫০
যজ্ঞ, আকাশ পথে ব্ৰহ্মলোকে প্রবিষ্ট হইলেন; ক্রুদ্ধ বৃষধ্বজও তথায় প্রবেশ করিলেন। ৫১
রুদ্র-ভীত যজ্ঞ, ব্ৰহ্মলোক হইতে অবতরণপূর্বক নিজ মায়াবলে সতী শরীরে প্রবিষ্ট হইলেন। ৫২
তখন যজ্ঞানুগামী রুদ্র, মৃত সতীর সমীপে গিয়া তাহার মৃত-শরীর দেখিতে পাইলেন। ৫৩
তখন, মহাদেব, দক্ষ-দুহিতা সতীকে মৃত দেখিয়া যজ্ঞের কথা ভুলিয়া গেলেন; শবদেহের পার্শ্বে বসিয়া সতীর জন্য অত্যন্ত শোক করিতে লাগিলেন। ৫৪।
শূলপাণি, সতীদেবীর বহুবিধ গুণাবলী চিন্তা করিয়া তাহার দশন-পংক্তি শোভিত কমলসন্নিভ মুখমণ্ডল, অরুণাঞ্চল-বসন ও ভ্রূযুগল দর্শন করিয়া অত্যন্ত শোকে ব্যাকুলভাবে রোদন করিতে লাগিলেন। ৫৫।
সপ্তদশ অধ্যায় সমাপ্ত। ১৭