হাবিবুর রহমান তৌহিদাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসেছেন। ডাক্তারের নাম সালাহউদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন শ্রীনরোভে। চেম্বারের সামনে বিরাট সাইনবোর্ড।
ডা. সালাহউদ্দিন চৌধুরী
সহযোগী অধ্যাপক (সাইকো)
মনোরোগ ও মাদকাসক্তি চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ
সাইকিয়াট্রিস্ট ও সাইকোথেরাপিস্ট
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
শেরে বাংলা নগর, ঢাকা
রোগী দেখিবার সময়
বিকাল পাঁচটা থেকে রাত নয়টা
শুক্রবার বন্ধ
তৌহিদা জড়সড় হয়ে বসে আছে। তার পরনে হালকা সবুজ রঙের শাড়ি। কলাবউদের মতো সে বিরাট ঘোমটা দিয়েছে। ঘোমটার ভেতর দিয়ে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে কপালের খানিকটা চোখে পড়ছে। সে একেবারেই নড়াচড়া করছে না। তৌহিদার পাশে হাবিবুর রহমান বসেছেন। তার কপাল ঘামছে। তিনি কেন জানি ভয়ে অস্থির হয়ে আছেন। ডাক্তারের এই ঝামেলা শেষ হলে বাঁচেন এমন অবস্থা। ডাক্তার এবং উকিলের কাছে কিছু লুকানো যায় না। তাদেরকে সব সত্যি কথা বলতে হয়। হাবিবুর রহমান বুঝতে পারছেন না সব সত্যি কথা তিনি বলতে পারবেন কি-না। ডাক্তার সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে। মানুষটা কঠিন প্রকৃতির। রোগীদের সঙ্গে ধমক দিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন। ভদ্রলোক সারাক্ষণই বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে রেখেছেন।
ডাক্তার তৌহিদার দিকে সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন, নাম কী?
তৌহিদা সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট স্বরে বলল, বলব না।
কেন বলবেন না?
নাম বলতে ভালো লাগে না।
কী করতে ভালো লাগে?
পান খেতে ভালো লাগে।
এই বলেই সে হাবিবুর রহমানের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ভাইজান, জর্দা দিয়ে পান খাব।
হাবিবুর রহমান বিনীত ভঙ্গিতে ডাক্তারকে বললেন, স্যার, এর পান খাবার অভ্যাস ছিল না। অসুখের পর থেকে পান খায়। আর স্যার এর নাম তৌহিদা। তৌহিদা খানম।
তৌহিদা বলল, মতিন ভাই শুধু ডাকেন তৌ।
ডাক্তার বললেন, মতিন ভাই কে?
হাবিবুর রহমান বললেন, আমার শ্যালক।
ডাক্তার বললেন, আপনার বাসায় তার যাতায়ত আছে?
জি আছে। তবে কম। মাসে দুই মাসে একবার।
ডাক্তার তৌহিদার দিকে তাকিয়ে বললেন, মতিন সাহেবকে কি আপনার ভালো লাগে?
তৌহিদা বলল, আমি পান খাব। জর্দা দিয়ে পান খাব। আপনার এখানে পান নাই?
ডাক্তার হাবিবুর রহমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি একটা কাজ করুন। জর্দা দেয়া পান কিনে আনুন। পান কিনে এনে ওয়েটিংরুমে অপেক্ষা করবেন। আমি না ডাকা পর্যন্ত আসবেন না। আমি ততক্ষণ রোগীর সঙ্গে কথা বলব।
হাবিবুর রহমান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উঠলেন। তিনি ভয়ে ভয়ে ছিলেন কখন ডাক্তার জিজ্ঞেস করে বসে রোগী কি বিবাহিত? কার সঙ্গে বিবাহ হয়েছে? বিবাহ কবে হয়েছে? যখন শুনবে হাবিবুর রহমানের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছে তখন হুট করে জিজ্ঞেস করবে আপনার সঙ্গে কি আপনার স্ত্রীর যৌন মিলন হয়েছে? মানসিক রোগের ডাক্তারদের মুখে কোনো পর্দা থাকে না। অশ্লীল কথা তারা হুটহাট করে জিজ্ঞেস করে।
হাবিবুর রহমান চারটা জর্দা দেয়া পান কিনলেন। নিজে একটা মুখে দিলেন। বাকি তিনটা পকেটে রাখলেন। চারটা সিগারেট কিনে একটা ধরালেন। তিনি আগে সিগারেট খেতেন না। সিগারেট খেলে টেনশন কমে এই ভেবে সিগারেট ধরিয়েছিলেন। তার টেনশন কিছুমাত্র কমে নি। মাঝখান থেকে সিগারেটের অভ্যাস হয়ে গেছে।
তৌহিদার মতো ভয়াবহ রোগী ঘরে থাকলে টেনশন কীভাবে কমে? তাকে দেখাশোনা করার তৃতীয় ব্যক্তি নেই। সালেহা পুরোপুরি শয্যাশায়ী। একটা ছুটা কাজের মেয়ে আছে, সকালে এসে হাঁড়ি বাসন মেজে ঘর ঝাট দিয়ে চলে যায়। তাকে চোখে চোখে রাখতে হয়। কারণ এই মেয়ের অভ্যাস যাবার সময় শাড়ির কোচড়ে করে চাল ডাল নিয়ে যাওয়া।
গত সাতদিন থেকে হাবিবুর রহমানের ঘরে রান্নাবান্না হচ্ছে না। তৌহিদার এই অবস্থা, কে রাঁধবে? হাবিবুর রহমানের ব্যবসা-বাণিজ্য মাথায় উঠেছে। বেশির ভাগ সময় তাকে বাসায় থাকতে হয়। যখন বাইরে যান তখন তৌহিদাকে তার ঘরে তালাবন্ধ করে যান। তৌহিদা তাতে কোনো আপত্তি করে না। সে আগে যেমন শান্ত মেয়ে ছিল এখনো তাই আছে। যত শান্তই হোক মাথা খারাপ মানুষের কোনো ঠিক নেই। কোনো একদিন দেখা যাবে কাপড়চোপড় ছাড়া রাস্তায় বের হয়ে পড়েছে। রাস্তার মানুষজন মজা পাচ্ছে। ভ্যাকভ্যাক করে হাসছে।
হাবিবুর রহমান দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরালেন। পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোন বের করে মতিনের নাম্বার বের করে আবার চেষ্টা করলেন। রিং হলো না। গত পাঁচদিন ধরে তিনি মতিনের খোঁজ বের করার চেষ্টা করছেন। লাভ হচ্ছে না। একদিন তার বেঙ্গল মেসে গিয়ে দরজার নিচ দিয়ে চিরকুট ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছেন–
বিরাট বিপদে আছি
সাক্ষাতে কথা হবে।
বাসায় এসো। জরুরি।
তারপরেও মতিন আসে নি। বিপদের সময় আত্মীয়স্বজন না এলে কখন আসবে? জন্মদিনের অনুষ্ঠানে!
মতিনের সন্ধান পাওয়া গেলে তাকে কিছুদিনের জন্যে স্থায়ীভাবে বাসায় এনে রাখা যেত। তার সঙ্গে পরামর্শ করা যেত। পরামর্শ করার জন্যে নিজের লোক লাগে। যার তার সঙ্গে পরামর্শ করা যায় না! পরামর্শ করার বিষয় অনেক আছে। হাবিবুর রহমান অনেক ঝামেলা করে লৌহজং-এর কবিরাজ হৃষিকেশ ভট্টাচার্য (ভৈষজ্য ধন্বন্তরী, সাহিত্য শ্রী) সাহেবের কাছ থেকে পাগলের তেল আনিয়েছেন। তেলের নাম উন্মাদ ভঞ্জন কনক তৈল। এই তেল তৌহিদার মাথায় দেয়া যাবে কি-না তা নিয়ে পরামর্শ। তেল মাথায় দেবার আগে মাথার সব চুল ফেলে দিতে হবে। এটা করা কি ঠিক হবে? তিনি সালেহার সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন। সালেহা বলেছেন, অসম্ভব। সালেহার পরামর্শ গ্রাহ্য না। কারণ মহাবিপদে নারীর পরামর্শ নিতে নাই। শাস্ত্রের কথা। কনক তেলের জন্যে যাওয়া আসা বাদেই তাকে এক হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। এক ফাইল পাঁচশ টাকা। তিনি দুই ফাইল কিনেছেন। কবিরাজ সাহেব বলেছেন এক ফাইল। ওষুধেই কাজ হবে। তারপরেও তিনি দুই ফাইল কিনেছেন। যে কবিরাজ নিজ থেকেই এক ফাইল ওষুধ নিতে বলে তার মধ্যে সততা আছে। অসৎ কবিরাজ হলে তিন ফাইল গছিয়ে দেবার চেষ্টা করত।
হাবিবুর রহমান সিএনজি ট্যাক্সি ক্যাবে করে তৌহিদাকে নিয়ে ফিরছেন। তৌহিদা পান চিবোচ্ছে। সে মুখ থেকে ঘোমটা খানিকটা সরিয়েছে। তাকে উৎফুল্ল এবং আনন্দিত মনে হচ্ছে।
ডাক্তার সাহেব ওষুধপত্র কিছু দেন নি। তৌহিদাকে ক্লিনিকে ভর্তি করতে বলেছেন। ক্লিনিক মিরপুরে, নাম নিরাময়। ডাক্তার সাহেব নিজেই ক্লিনিক চালান। ক্লিনিকে দুই ধরনের কেবিন আছে। নরমাল কেবিন এবং ডিলাক্স কেবিন। নরমাল কেবিনের ভাড়া প্রতিদিন পাঁচশ টাকা। ডিলাক্স কেবিন এক হাজার টাকা। ডিলাক্স কেবিনে এসি আছে, রঙিন টিভি আছে।
তৌহিদাকে কেবিনে ভর্তি করাবেন কি-না এটা নিয়েও মতিনের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার। সে গেছে কোথায়?
মতিন কোথাও যায় নি। ঢাকাতেই আছে। দিন দশেক হলো সে বাস করছে। নিশুর সঙ্গে। বাড়িওয়ালার সেজো ছেলে নিশুকে খুবই বিরক্ত করছে। রাত বিরাতে এসে দরজা ধাক্কাচ্ছে। ছেলেটা নেশাখোর। গাঁজা ফেনসিডিল নিয়ে আছে। তার বন্ধু-বান্ধবরাও তার মতোই। বন্ধু-বান্ধবরাও যন্ত্রণা করছে। পুলিশে খবর দেয়া হয়েছিল। পুলিশ এসেওছিল। বাড়িওয়ালা পুলিশকে বলেছেন–নিশু মেয়েটা খারাপ। নানান ধরনের ছেলে তার কাছে আসে। রাতে থাকে। ভদ্রপাড়ায় থেকে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আমার ছেলে খারাপ এটা জানি। খারাপ যায় খারাপের কাছে। এখন বুঝেছেন ঘটনা?
পুলিশ হয়তো ঘটনা বুঝেছে। তারা কিছুই করে নি।
ঢাকা শহরে একা একটি অল্পবয়েসি মেয়ের ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকা প্রায়। অসম্ভব ব্যাপার। নিশু মেয়েদের কোনো হোস্টেলে চলে যেতে চাচ্ছে। তেমন কিছু পাচ্ছে না।
পল্লবীতে নিশুর আপন মামা থাকেন। নিশু তার কাছেও গিয়েছিল। তিনি বলেছেন, তিন বেডের এক বাড়িতে থাকি, আমাদেরই থাকার জায়গা নাই। তুই কই থাকবি?
নিশু বলেছে, আমি ড্রয়িংরুমে শুয়ে থাকব।
নিশুর মামা বলেছেন, ড্রয়িংরুমে আমার অফিসের পিয়ন ঘুমায়, তুই তার সঙ্গে ঘুমাবি?
নিশু বলেছে, হ্যাঁ।
নিশুর মামা বিরক্ত হয়ে বলেছেন, তোর বাবা যেমন পাগল ছিল তুইও পাগল। তোর যা করা উচিত তা হলো বিয়ে করে ফেলা।
নিশু বলল, আমি রাজি আছি, আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও। আমি আজই বিয়ে করব। গুণ্ডাপাণ্ডাদের যন্ত্রণা আর নিতে পারছি না।
নিশু ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছেছে। এখন তার প্রধান কাজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লেডিস হোস্টেলে সিট খোজা। সে ডাবলিং ট্রিপলিং সবকিছুতেই রাজি আছে। মেঝেতে শুয়ে থাকতেও তার আপত্তি নেই। সে মতিনকে আলটিমেটাম দিয়েছে। মতিন যদি সন্ধ্যার মধ্যে তার জন্যে থাকার ব্যবস্থা না করতে পারে তাহলে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে। বাড়িওয়ালার ছেলে রাতে এলে নিশু বটি দিয়ে তাকে খুন করবে।
আলটিমেটাম নিয়ে মতিন কিছু ভাবছে সেরকম মনে হচ্ছে না। সে ভোরের স্বদেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের সামনে লাজুক লাজুক মুখ করে বসে আছে। আজহার উল্লাহ সাহেব রাগে ছটফট করছেন। মতিন তাঁর রাগ কমার জন্যে অপেক্ষা করছে।
আজহার উল্লাহ সাহেবের রাগের কারণ বর্তমান কালের এক তরুণ কবির পাঠানো কবিতা। কবিতার নাম জনৈক রমণীর পায়ুপথ। তিনি কবিতা হাতে নিয়ে চিড়বিড় করছেন এই নামে কবিতা হতে পারে? মতিন, তুমি বলো, এই নামে কবিতা হতে পারে?
মতিন বলল, ইউরোপ আমেরিকার কিছু কবি এ ধরনের অ্যাক্সপেরিমেন্টাল কবিতা লিখছেন।
আজহার উল্লাহ বললেন, অ্যাক্সপেরিমেন্ট! এর নাম অ্যাক্সপেরিমেন্ট? পায়ুপথ নিয়ে অ্যাক্সপেরিমেন্ট?
মতিন বলল, ঠিক এধরনের একটি কবিতা ইংরেজিতে আছে–Anus of a young lady. কবিতার মধ্যে রুচি ও অরুচির মিশ্রণ। Lady হচ্ছে রুচির প্রতীক, Anus অরুচির প্রতীক।
চুপ কর।
জি আচ্ছা স্যার চুপ করলাম।
চা খাবে?
চা খাব না, কফি খাব।
আজহার উল্লাহ সিগারেট ধরালেন। তার রাগ সামান্য কমল। তিনি মতিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার গল্পগুলি ভালো হয়েছে।
মতিন বলল, আমার গল্প না স্যার। নদ্দিউ নতিম সাহেবের গল্প।
আজহার উল্লাহ বললেন, আমার সঙ্গে ফাজলামি করবে না। আমি তোমার ইয়ার দোস্ত না, তোমার দুলাভাইও না। তুমি গল্পগুলি ভালো লিখেছ, তবে লাভ নাই।
লাভ নাই কেন স্যার?
লাভ নাই, কারণ বাঙালি মুসলমান লেখক জন্মে জাত সাপ হয়ে, মারা যায় হেলে সাপ হিসাবে।
মতিন বলল, নদ্দিউ নতিম সাহেব মুসলমান এটা ঠিক আছে; তবে উনি বাঙালি না, উজবেক।
আমার কাছ থেকে থাপ্পড় খেতে চাও? থাপ্পড় দিয়ে চাপার লুজ দাঁত ফেলে দেব।
মতিন হেসে ফেলল।
আজহার উল্লাহ বললেন, কোনো নতুন লেখা এনেছ?
মতিন বলল, নদ্দিউ নতিম সাহেবের একটা অ্যাক্সপেরিমেন্টাল কবিতার অনুবাদ এনেছি। চায়নিজরা যেমন উপর থেকে নিচে লেখে তিনি এইভাবে কিছু কবিতা লিখেছেন। পক্ষীবিষয়ক রচনা।
মতিন টেবিলের উপর লেখা রাখল! আজহার উল্লাহ সাহেব লেখা হাতে নিলেন–
এ কি না পা
ক ং ও খি
টি বা * কে
পা শ্যা পা মা
খি মা রে না
* * * য়
ছি কা ব না।
ল ঠ লা *
হ ঠো ক জা
য় ক ঠি নি
* রা ন *
কা হ বে না
ক তে শ *
কি পা ক কে
ং রে ঠি ন?
বা * ন।
চ আ কা
ড়ু বা ঠি
ই র ন্য
আজহার উল্লাহ বেশ কিছুক্ষণ মতিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি আর আমার এখানে আসবে না। বিদায় হও।
কফি খেয়ে যাই স্যার?
আজহার উল্লাহ বললেন, না।
মতিন উঠে দাঁড়াল।
ভোরের স্বদেশ পত্রিকা অফিস থেকে বের হয়ে মতিন ঘড়ি দেখল, এগারোটা পঁচিশ। তার মনে হলো, বিজ্ঞান এখনো যথেষ্ট অগ্রসর হয় নি। এখনো মানুষকে ঘড়ি দেখতে হয়। সার্টের হাতা গুটিয়ে রিস্টওয়াচ চোখের সামনে ধরতে হয়। রাতে আরো সমস্যা, বাতি জ্বালাতে হয়। বিজ্ঞান এত কিছু করেছে কিন্তু মানুষকে ঘড়ি দেখার ঝামেলা থেকে মুক্ত করতে পারছে না কেন? মানুষের শরীরের ভেতর বিজ্ঞানীরা একটা ঘড়ি ঢুকিয়ে দেবেন। সেই ঘড়ি মানুষকে সময় দিতে থাকবে। ঘড়ি বন্ধ হবে মৃত্যুর সময়।
আকাশ নীল। কড়া রোদ উঠেছে। এই রোদের নাম ছাতা-রোদ। ছাতা ছাড়া এই রোদে যাওয়া যায় না। বিজ্ঞানীরা মানুষকে এখনো ছাতামুক্ত করতে পারে নি। তাদের আরেক ব্যর্থতা।
বিজ্ঞানীদের উপর মেজাজ খারাপ করে মতিন হাঁটছে। সে কল্পনা করে নিচ্ছে এখন সন্ধ্যার শুরু। গাছের ছায়া হয়েছে দীর্ঘ। বাতাসে শীতের আমেজ। দুএকটা বাড়িতে সন্ধ্যার আলো জ্বলছে–
A stranger came to the door at eve,
And he spoke the bridegroom fair.
He bore a green-white stick in his hand,
And, for all burden, care.
কবিতাটা কার লেখা? মতিন নাম মনে করতে পারছে না। কবিতা মুখস্থ অথচ কবির নাম মনে আসছে না। এই ধরনের সমস্যা মতিনের ঘনঘন হচ্ছে। কবির নাম মাথার ভেতর আছে। নামে R অক্ষরটা আছে। শুধুমাত্র R অক্ষর জ্বলজ্বল করছে, আর কিছু না। দারুণ অস্বস্তিকর অবস্থা। নিশুকে টেলিফোন করলেই অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচা যায়। সে সঙ্গে সঙ্গেই কবির নাম বলবে। নিশুকে টেলিফোন করা যাচ্ছে না, কারণ মতিনের মোবাইল কাজ করছে না। এখন কী করা যায়? কোথাও শান্তিমতো কয়েক কাপ কফি খেলে হতো। কফিতে মস্তিষ্ক উজ্জীবক পদার্থ আছে। সেই পদার্থ শরীরে বেশ খানিকটা ঢুকিয়ে দিলে হয়তো R-এর সঙ্গের অন্য দুই-একটা অক্ষর ভেসে উঠবে।
মতিন একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিল। কফি খাওয়ার জন্যে সে মতিঝিল থেকে যাচ্ছে গুলশানে। সালেহ ইমরান সাহেবের অ্যাসিসটেন্ট আহমেদ ফারুকের। অফিসে। এই বিষয়টাও রহস্যময়। মতিঝিলের অনেক দোকানেই কফি পাওয়া যায়। কফির জন্যে গুলশানে যেতে হয় না। কিন্তু সে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে? তার মস্তিষ্ক কি প্রোগ্রাম সেট করে রেখেছে? কফির তৃষ্ণা একটা অজুহাত ছাড়া কিছু না!
এসির কল্যাণে গাড়ির ভেতর আরামদায়ক শীতলতা। গাড়ির ড্রাইভার বলল, গান দিব স্যার? মতিন বলল, না। তার মাথায় কবিতার পরের চারটা লাইন–
He asked with the eyes more than the lips
For a shelter for the night,
And he turned and looked at the road afar
without a window light.
মতিন চোখ বন্ধ করে আছে। R অক্ষরের সঙ্গে আরেকটা অক্ষর এসেছে B. এখন মনে হয় অন্য অক্ষরগুলিও আসতে শুরু করবে। এই তো আরেকটা এসেছে O. এই তিন অক্ষর নিয়ে খেলতে খেলতে অন্য অক্ষরগুলি নিশ্চয়ই চলে আসবে। খেলা শুরু হোক–
BOR, ORB, ROB, BRO, OBR, RBO…
আরো কিছু কি হয়? কমল বলতে পারত। এই ছেলে এইসব খেলায় ওস্তাদ। ঘোনা ঘুতনি নিয়ে কী বিশাল খেলা ফেঁদেছিল!
আহমেদ ফারুক অবাক হয়ে বললেন, আপনি?
মতিন বলল, কফি খেতে এসেছি। আপনার এখানে কি কফি আছে?
কফি অবশ্যই আছে। আপনি কফি খেতে আমার কাছে এসেছেন–এটা বিশ্বাসযোগ্য না।
মতিন বলল, আমার কাছেও বিশ্বাসযোগ্য না।
আমার অফিসের ঠিকানা কোথায় পেলেন?
জোগাড় করে রেখেছিলাম।
কোত্থেকে জোগাড় করেছেন?
যে হাসপাতালে কমলের চিকিৎসা হয়েছিল, তাদের কাছ থেকে জোগাড় করেছি।
কবে জোগাড় করেছেন? আজ?
আজ না।
কবে?
মতিন বলল, কবে ঠিকানা জোগাড় করেছি এটা জানা কি জরুরি?
আহমেদ ফারুক বললেন, জরুরি না। কৌতূহল।
মতিন বলল, যেদিন কমলের চিঠিটা পড়লাম, চিঠিতে তার সিক্রেট জানলাম, সেদিন।
আহমেদ ফারুক বললেন, তার মানে আপনি কমলের সিক্রেট নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন?
মতিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনার কথা শুনে এখন আমারও সেরকমই মনে হচ্ছে। কফি দিতে বলুন।
কফিতে চুমুক দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মতিনের মাথায় আরেকটা অক্ষর চলে এলো–T, এখন এই চারটি অক্ষরকে নানানভাবে সাজানো যায় ROBT, BORT…
আহমেদ ফারুক বললেন, শুরু করুন।
মতিন বলল, কী শুরু করব?
যে কথা বলতে এসেছেন সেই কথা।
মতিন চার অক্ষরের খেলা বাদ দিয়ে আহমেদ ফারুকের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার ঘাড়ে কি কোনো জন্মদাগ আছে?
তার মানে?
আছে কি-না সেটা বলুন।
কমলের সিক্রেটের সঙ্গে আমার ঘাড়ে জন্মদাগ আছে কি-না তার সম্পর্ক কী?
মতিন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, কমল একটা বইয়ে পড়েছে কিংবা ইন্টারনেট থেকে পেয়েছে, পিতার শরীরের জন্মদাগ সন্তানের শরীরে আসে। আমার ধারণা সে তার নিজের ঘাড়ের এই দাগ নিয়ে চিন্তিত ছিল বলেই পড়াশোনাটা করেছে। তারপর সে তার বাবার ঘাড় পরীক্ষা করেছে। জন্মদাগ পায় নি। সে জন্মদাগটি দেখেছে অন্য একজনের ঘাড়ে।
আহমেদ ফারুক ঠাণ্ডা গলায় বললেন, কমল কি আপনাকে জানিয়েছে সেই অন্য একজনটা কে?
জানিয়েছে। জানিয়েছে বলেই আমি আপনার কাছে এসেছি। আমি কি আরেক কাপ কফি খেতে পারি?
না। আপনি এক্ষণ বিদায় হবেন।
মতিন উঠে দাঁড়াল। সে এই মুহূর্তে খুবই আনন্দিত। কবির পুরো নাম তার মাথায় চলে এসেছে। নিশুর সাহায্য লাগে নি। কবির নাম–Robert Frost. কবিতার নাম Love and a question.
ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই নিশুর মেজাজ খারাপ ছিল। সে বারান্দায় টাওয়েল শুকাতে দিতে এসে দেখে, রাস্তার পাশের চায়ের দোকানের সামনে বাড়িওয়ালার ছেলে দুই বন্ধুকে নিয়ে বসে আছে। নিশুকে দেখে বাড়িওয়ালার ছেলে উঠে দাঁড়াল এবং চেঁচিয়ে বলল, ঐ মাগি! তার দুই বন্ধুর হেসে গড়িয়ে পড়ার মতো অবস্থা হলো।
নিশু ঘরে ঢুকে গেল। তাকে এই যন্ত্রণা আর সহ্য করতে হবে না। মতিনকে বলা আছে, সে সন্ধ্যার মধ্যে একটা কিছু ব্যবস্থা করবেই। যদি কিছুই করতে না পারে সে কোনো একটা হোটেলে গিয়ে উঠবে। নিশুর ইউনিভার্সিটিতে যাবার দরকার ছিল। সে গেল না। ইউনিভার্সিটিতে যেতে হলে তিন বদের সামনে দিয়ে। যেতে হবে। তারা কুৎসিত কিছু কথা বলবে। রাস্তার লোকজনও সেই কথা শুনবে। কেউ কোনো প্রতিবাদ করবে না। বরং মজা পাবে। সোসাইটি বদলাচ্ছে। খারাপের দিকে বদলাচ্ছে। বর্তমান সোসাইটির মানুষ অন্যের দুর্দশীয় মজা পায়। সাহসী মানুষরা কি সব হারিয়ে যাচ্ছে?
সকাল এগারোটায় নিশু মন প্রচণ্ড ভালো হয়ে গেল। কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশন থেকে চিঠি এসেছে কুরিয়ারে। চিঠির বক্তব্য, নিশুর হাউজিং-এর ব্যবস্থা হয়েছে। সে ইচ্ছা করলে এখনই চলে আসতে পারে। নিশু যার আন্ডারে কাজ করবে সেই প্রফেসর John OHara Cosgrave-ও সুন্দর একটি চিঠি দিয়েছেন–
নিশু,
প্রথম সেমিস্টার তুমি মিস করেছ। ভালোই করেছ। আমি পুরো তিনমাস ছিলাম হাসপাতালে। তুমি নিশ্চয়ই জানো না আমি ব্যাধিগ্রস্থ মানুষ। আমার রোগের ধরন এমন যে, কিছুদিন পর পর আমাকে দীর্ঘদিনের জন্য হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। তবে আমার এই ব্যাধি উপকারী। আমি আমার প্রধান কাজগুলি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে করেছি।
আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। তুমি আমাকে বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশের উপর যে প্রবন্ধটি লিখে পাঠিয়েছ তা পড়ে খুশি হয়েছি। আমি তোমার কাছ থেকে এই কবি সম্পর্কে আরো জানতে আগ্রহী। ভালো থেকো।
ইতি–
ও হারা
অনেকদিন পর নিশুর সাজতে ইচ্ছা করল। মতিনকে চমকে দেবার ব্যবস্থা। সে সাজগোজ করে বসে থাকবে। মতিন দুপুরে খেতে আসবে। সে তাকে নিয়ে বাইরে কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যালে কোনো পার্লার থেকে চুল ঠিক করে আগে কি হয়! নিশু তার জীবনে কখনো পার্লারে যায় নি। তার মাথার চুল কোকড়ানো। পার্লারের মেয়েরা সেই চুল সোজা করে দেবে। চোখে কাজল দিয়ে দেবে।
নিশু বারান্দায় এসে উঁকি দিল। বদ তিনটাকে দেখা যাচ্ছে না। চায়ের দোকানের সামনের বেঞ্চটা ফাকা। নিশু ঘর তালা দিয়ে বের হলো। সে একটা শাড়িও কিনবে। সাজগোজের পর নতুন শাড়ি পরতে ইচ্ছা করে।
নিশু বাড়ি ফিরল একটার দিকে। মুগ্ধ হয়ে সে আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে থাকল। মনে মনে কয়েকবার বলল, নিশু মেয়েটা এত সুন্দর! এতদিন এই সৌন্দর্য চোখে পড়ল না কেন?
The wonder is I didnt see at once
I never noticed it from here before.
দরজায় টোকা পড়ছে। মতিন এসে পড়েছে। এখন নিশুর সামান্য লজ্জা লাগছে। মতিন কি ভাববে না তার জন্যেই এত সাজগোজ? ভাবলে ভাবুক। নিশু দরজা খুলল।
নিশুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে হুড়মুড় করে বাড়িওয়ালার ছেলে তার দুই বন্ধু নিয়ে ঢুকে পড়ল। বাড়িওয়ালার ছেলের হাতে ক্ষুর। সে হিসহিস করে বলল, শব্দ করলে মরছস। এক পোচ দিব, গলা শেষ।
নিশু একদৃষ্টিতে ক্ষুরের দিকে তাকিয়ে আছে। পত্রিকায় এই জাতীয় ঘটনা সে অনেক পড়েছে। আজ তার জীবনে ঘটতে যাচ্ছে। বাড়িওয়ালার ছেলের বন্ধুরা দরজা-জানালা বন্ধ করে ফেলেছে। ঘর এখন অন্ধকার। এই অন্ধকার কিছুক্ষণের মধ্যেই সয়ে যাবে। নিশু তাদের তিনজনের ঘামে ভেজা মুখ দেখতে পাবে। এরা কি মদ খেয়ে এসেছে? কী বিকট গন্ধই না আসছে!
ঐ মাগি! শাড়ি তুই নিজে খুলবি? না আমরা টান দিয়া খুলব?
নিশু শব্দ করতে পারছে না, নড়তে পারছে না। কে কী বলছে তাও তার কানে ঢুকছে না। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে ক্ষুরের ফলার দিকে। নিশুর জগৎ ছোট হয়ে আসছে। চারদিক থেকে জমাট অন্ধকার তাকে ঘিরে ধরছে। একবার তার শুধু মনে হলো, মধ্যদুপুরে এত অন্ধকার কেন?