তুষার চিতার খোঁজে
হিমালয়ের এক রহস্যময় প্রাণী হলো তুষার চিতা। পাহাড়ি গ্রামগুলোর আতঙ্ক। কখন যে নিঃশব্দে নেমে আসবে তা কেউ জানে না। সহজে দেখা যায় না এদের। ন’হাজার থেকে বার হাজার ফুট উপরে তাকে এই তুষার চিতা। হালকা ধূসর রঙ। তার উপর রয়েছে ছোট ছোট কালচে দানার নকশা। তীব্র শীতে সবকিছু জমাট বেঁধে যায়, তখন এই প্রাণীরা কখনও কখনও নিচে নেমে আসে। অনেকে বলে হিমচিতা। ভুটিয়ারা বলে আমচিতা। নেপালের অধিবাসীরা ওদের ডাকে সাবু বলে।
তুষার চিতার হিমশীতল দুটো চোখ । যা দেখলে যে কোনো সাহসী লোকের বুকও কেঁপে ওঠে।
এই দুর্লভ প্রাণীটির ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের রয়েছে অনেক কৌতূহল । বিভিন্ন দেশের চিড়িয়াখানাগুলো চায় একে সংগ্রহ করতে । প্রচুর মূল্য দিতে আগ্রহী । কিন্তু তুষার চিতাকে যে ধরাই যায় না। একদম যেন নাগালের বাইরে । সহজে দেখাই যায় না। হিমালয়ের উঁচু উঁচু পাহাড় পর্বত ঘেরা মনে জঙ্গলে থাকে এরা । নেপালের লাংগু গিরিখাতেও থাকে।
এই দুর্লভ প্রাণীটির খোজে বেশ কয়েকটি অভিযান চালানো হয়েছে হিমালয়ের দুর্গম এলাকায়। দুষ্প্রাপ্য প্রাণীদের সন্ধান করা অনেকের কাছে তীব্র এক নেশা। তারা পথের কোনো সমস্যার কথা মানতে চায় না। পথের প্রতি পদে কত ভয়ঙ্কর বিপদই যে থাকে। যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর থাবা নেমে আসতে পারে। তবু তারা ছুটে যাবেন। নতুন কিছু পাওয়ার উত্তেজনায় যেন আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন তারা।
তাই ভয়ঙ্কর দুর্গম লাদাকে কালো গলার সারসদের খোজে হয় অভিযান। বৃদ্ধ বয়সেও পাখিগুলো সালিম আলী নীলগিরি পাহাড়ে লাল পাখার কোকিল খুঁজতেন। হিমালয়ের পাহাড়ি তুষার চিতা এক দুর্লভ জন্তু। ক্রমশ বিরল হয়ে আসছে। অনেক প্রাণীই এখন বিরল তালিকায় ঠাই পেয়েছে। ডুয়ার্সের গভীর জঙ্গলে থাকে সোনালি বেড়াল। দেখতে খুব সুন্দর। ঝকঝক করে। এদের নাকের নিচে দুধারে শাদা দাগ। উঁচু পাহাড়ে থাকে। পাখি শিকার করে। কখনও ভেড়ার পালে হামলা চালায়। এখন আর সোনালি বেড়ালকে সহজে দেখাই যায় না।
লাদাকে আর গিলগিটের পাহাড়ি এলাকায় দেখা যায় লিংকস। এরা বেড়াল গোষ্ঠীর সদস্য। দুর্লভ জম্ভ তুষার চিতা সম্পর্কে সবচাইতে বেশি তথ্য দিয়েছেন রডনি জ্যাকসন। তাঁর অসম সাহস আর বুদ্ধিমত্তার জন্যে পাওয়া গেছে তুষার চিতার অনেকগুলো দুষ্প্রাপ্য ছবি।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অভিযান করেছিলেন জ্যাকসন। যে কোনো মুহূর্তে হিমচিতার থাবার আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতে পারেন তিনি। নয়তো গড়িয়ে যাবেন অতল খাদে। কিন্তু কোনো কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি তাকে।
তুষার চিতার খোঁজে অভিযানে গেলেন দুঃসাহসী রডনি জ্যাকসন। তাঁর উদ্দেশ্য এই রহস্যময় প্রাণীটি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। কোনো মতে একটি তুষার চিতাকে দেখতে পেলে হয়। ঘুমপাড়ানি ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করবেন।
অনেক দুর্গম এলাকায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল জ্যাকসনের। ঘরের নিরাপদ পরিবেশ তাঁর কাছে মোটেই ভালো লাগে না। তাঁকে শুধু হাতছানি দেয় দূর পাহাড়ের বন। কোথায় গহীন অরণ্যে ঘুরছে দুপ্রাপ্য প্রাণীগুলো। কিশোরকাল থেকেই জ্যাকসন সাহসী। বন্ধুদের জুটিয়ে প্রায়ই বনে জঙ্গলে যেত। পাখি দেখার ক্লাব করেছিল। হিমালয়ের অভিযানে যাওয়ার নেশা তার তখন থেকেই।
তুষার চিতা নিয়ে প্রচুর রহস্য। এই প্রাণীটির কোনো তথ্যই জোগাড় করা যাচ্ছে না। জীববিজ্ঞানীরা জানতে চান। কিন্তু প্রধান সমস্যা হলো যে, প্রাণীটিকে দেখাই যাচ্ছে না। পাহাড়ি এলাকায় যেসব গরিব লোক কাঠ সংগ্রহের জন্যে নিরুপায় হয়ে গহীন অরণ্যে প্রবেশ করত তাদের কেউ কেউ আচমকা দেখেছে এই দুর্লভ জম্ভটিকে। আমেরিকার বিখ্যাত ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফি পত্রিকা এ ধরনের বিরল প্রাণীদের ছবি ছাপতে আগ্রহী। এ জন্যে তাদের চিত্রগ্রাহকদের অনেক ঝুঁকি নিতে হয়। পত্রিকার কুশলী ফটোগ্রাফার জর্জ বিমাল এলেন নেপালের বনে। অনেক কষ্টে তিনি একটি তুষার চিতার ছবি তুললেন। ১৯৭১ সালের নভেম্বর সংখ্যায় সে ছবি ছাপা হলো। ওটাই ছিল তুষার চিতার প্রথম প্রকাশিত ছবি।
সেই ছবি দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করল । মানুষের কাছে এতদিন অপরিচিত ছিল প্রাণীটি। যেন রহস্যের মিহি কুয়াশায় ঢাকা। ছাপা হলো ছবি। তুষার চিতার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। পত্রিকায় ছাপা ছবি হওয়ার পর স্নো লেপার্ডের প্রতি মানুষের কোতুহল আরও বেড়ে গেল। অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করল অনুসন্ধান চালালোর।
নেপালের লাংগু গিরিখাত অত্যন্ত দুর্গম। পৃথিবীতে যে কটি দুর্গম অঞ্চল রয়েছে তার মধ্যে লাংগু অন্যতম। বিপদসঙ্কুল পাহাড় পর্বতে ঘেরা। কিছুদিন আগে পর্যন্ত সে জায়গাটির খবর জানা ছিল না ।১৯৬৪ সালে প্রথম একজন দুঃসাহসী ব্রিটিশ অভিযাত্রী জন টাইসন এলাকাটির মানচিত্র তৈরি করেন।
রডনি জ্যাকসন প্রথম লাংগুর ভূগোল সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। যোগাযোগ করলেন নেপাল সরকারের সঙ্গে। তারা জ্যাকসনের এই প্রকল্পটিকে অনুমোদন করল। নেপালের জাতীয় উদ্যান ও বন্যজন্তুর সংরক্ষণ বিভাগ এতে আর্থিক সহায়তা করল। পৃথিবীর অন্যান্য সংস্থা থেকেও জ্যাকসনের এই প্রকল্পের সহযোগিতা আসা শুরু হলো। জ্যাকসন অভিযানের প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম জোগাড় করলেন।
অভিযাত্রী দলটি প্রথমে বিমানে করে রওনা দিল। কাঠমাণ্ডু থেকে দুশো মাইল উত্তর-পূর্বে ছোট্ট পাহাড়ি শহর জুমলায় নামল। সেখান থেকে নির্ধারিত বেস ক্যাম্প ত্রিশ মাইল দূরে। এই পথটি আবার ভয়নাক দুর্গম। মালপত্র বহন করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। আবহাওয়া ছিল যথেষ্ট প্রতিকূল ।
বেস ক্যাম্প তৈরি হলো একটি পাহাড়ি নদীর তীরে। কাছে ছোট গ্রাম ডোলপু।নদীতে নেই সাঁকো। গাছের গুড়ির সাহায্যে তারা খরগ্রোস নদীটি পার হলো। বনে কোনো নির্দিষ্ট রাস্তা নেই। বন্য জন্তুরা যে সব পথ ব্যবহার করে তারা সেই পথ দিয়ে সাবধানে এগুতে লাগল। জ্যাকসন ধরেই নিয়েছিল এক রোঞ্চকর অভিযানে যাচ্ছে তারা। প্রতি পদে যেখানে উত্তেজনা।
সেখানে ঘন গাছগাছালি ঠাসবুনোট। ছায়া ছায়া অন্ধকার। ভেজা মাটি। কনকনে বাতাসের ঝাপটা। দলটি গিয়ে চলেছে হিম চিতার সন্ধানে। সঙ্গে অভিযাত্রী ছিল গ্যারি আলবোর্ন। একদিন জ্বালানি কাঠের জন্যে গিয়েছে ঘাসবনে। বাতাসে সরসর করে দুলছে ঘাসবন। কাঠে কয়েকটি নীল রঙের ভেড়া চরছিল। হঠাৎ গ্যারি বিস্মিত হয়ে দেখতে পেল সেই দুর্লভ জম্ভটিকে। একটি তুষার চিতা ছুটে আসছে। চাপা গর্জন করে একটি ভেড়ার উপর লাফ দিল। ভেড়াটি ছুটে পালিয়ে যায়। চিতাটি দেখতে পায় গ্যারিকে। গ্যারি তখন যেন কেমন সম্মোহিত। তুষারচিতাটি পাঁচ মিনিট তুষার সবুজ চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। চিতাটি সম্ভবত এর আগে কোনো মানুষ দেখেনি। তারপর চিতাটি কান দুটো খাড়া করে ঝুঁকে নিজেকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলল। কিছুক্ষণ পর ছুটে পালাল চিতাটি।
গ্যারি বিমূঢ় ভাব ততক্ষণে কেটে গেছে। ছুটতে ছুটতে আসে শিবিরে। রুদ্ধশ্বাসে বলে চিতা দেখার কথা। জ্যাকসন উৎফুল্ল হন। ঠিক জায়গায় তাহলে এসেছে তারা। পরদিন জ্যাকসন আর তার দল বনের ভেতরে খানিকটা এগুতেই দেখতে পেল একটি তুষার চিতাকে। সঙ্গে সঙ্গে নিপুণভাবে জাল ঝুড়ে বন্দি করল। শেরপা সাথি লোপসাং জালের একদিকে ধরে রেখেছে। জ্যাকসন ছুটে যান। জালবন্দি তুষার চিতা ক্রোধে গরগর করছে। জ্যাকসনের হাতে চার হাত লম্বা স্টিক। তুষার চিতার শরীরে ক্ষিপ্র হাতে ইনজেকশনের সুঁচ বিধিয়ে দিল। ওষুধের প্রভাবে চিতাটি অচেতন হলো। এ রকম ঘুমন্ত অবস্থায় প্রাণীটি থাকবে প্রায় পনের মিনিট। তারপর ওষুধের প্রভাব যাবে কেটে।
জ্যাকসন আর তার দলের সদস্যরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল তুষার চিতাটির দিকে। সোনালি রোদে ঝলমল করছে। শরীর থেকে সৌন্দর্য যেন ছিটকে আসছে।
‘অপূর্ব! মৃদৃ কণ্ঠে বললেন জ্যাকসন। তারপর ব্যাগ থেকে একটি রেডিও কলার বের করে চিতাটির গলায় বেঁধে দিলেন। এই ছোট বেতার যন্ত্রটি চিতার গতিবিধির খবর আগাম জানিয়ে দেবে পরবর্তী সময়।
এরপর জ্যাকসন বিভিন্ন কোণ থেকে চিতাটির অনেকগুলো ছবি তুললেন। খয়েরি শরীর। কালো চোখ। লম্বা লেজ। কিছুক্ষণ পর চিতাটির ঘুম ভাঙল। গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায়। জ্যাকসন আর তার সঙ্গীরা তখন ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে যায়। প্রাণীটি এক সময় জঙ্গলে মিলিয়ে গেল।
ক্যাম্পে এসে জ্যাকসন টেলিমিটার রিসিভার সচল করলেন। তুষার চিতাটির চলাফেরার সমস্ত খবর পেতে থাকলেন। চিতার আশেপাশের সব রকম শব্দ রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে জ্যাকসন শুনতে পেলেন। পৃথিবীর প্রথম রেডিও কলারযুক্ত তুষার চিতার জীবনের নানা খবর পাওয়া শুরু হলো। জ্যাকসনের স্বপ্ন সার্থক হলো। বেতার যন্ত্র নিয়মিতভাবে তুষার চিতাটির গতিবিধির সঠিক সন্ধান দিতে লাগল। সেই নির্দেশ অনুসরণ করে জ্যাকসন দূরবিন দিয়ে তুষার চিতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করতে লাগলেন। প্রাণীটির স্বভাব হলো একাকি চলাফেরা করা।
জ্যাকসনের তোলা তুষার চিতার বিভিন্ন আকর্ষণীয় ছবি ছাপা হয়েছে। দুর্লভ এই রাজকীয় প্রাণীর কল্পগল্প প্রচলিত ছিল এই প্রাণীটিকে নিয়ে। শেরপা কুলিরা যাদের কথা বলতে আতঙ্ক মেশানো কণ্ঠে। অনেকে ভাবত দুর্গম পাহাড় চুড়োতে বাস এই অপদেবতা।
জ্যাকসন সেই অভিযানে আর চারটি তুষার চিতার সন্ধান পেলেন। লাংগু অঞ্চলটি খুবই দুর্গম। অনেক দূর পর্যন্ত কোনো লোকালয় নেই। তারা ১৪.৪৭৫ ফুট উঁচুতে একটি শিবির স্থাপন করেছিল। নাম দিয়েছিল ত্রিশূল কেভ।
একটি চিতাকে ইনজেকশন দেয়ার সময় আহত হয়েছিল জ্যাকসন। চিতার থাবার আগাতে তার হাতের এক জায়গার মাংশ উড়ে যায়। চিকিৎসার জন্যে তাঁকে আটদিন হেঁটে জুমলায় পৌছাতে হয়।
দুঃসাহসী রড়নি জ্যাকসনের এই রোঞ্চকর অভিযানের জন্যে মানুষ জানতে পেল তুষার চিতার খবর।
শেরপা কুলিরা আরেকটি প্রাণীর খোঁজ দিল জ্যাকসনকে। শিকারী চিতার মতো ক্ষিপ্ত । উড়ন্ত পাখির ঝাঁকে লাফিয়ে আসে। প্রাণীটির নাম সিয়াগোশ। এটি ফারসি শব্দ। এর অর্থ কালো কান। সোহরাব রুস্তম বইতে এর কথা আছে।
প্রাচীন নথিপত্রে এই প্রাণীটি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছিলেন জ্যাকসন। এক ব্রিটিশ অভিযাত্রী গিলগিট আর লাদাকের উচ্চ ভূমিতে এদের দেখেছিলেন। কাশ্মিরের লোকেরা এদের বলে পাটিসালাম। প্রাচীনকালে রাজারা এদের পোষ মানিয়ে শিকার ধরত। সিয়াগোশ এর বৈশিষ্ট্য ছিল তার সাবলীলতা। অদ্ভুত ক্ষিপ্রগতিতে এরা শিকার করতে পারত। ছুটে যেত বিদ্যুতের মতো যে সব পাখিরা উড়ছে তাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ত। দ্রুতগতিতে পা চালিয়ে শিকার করত। প্রাচীন নতিতে আছে একঝাক পায়রা দানা খুঁটে খাচ্ছিল। তাদের মাঝে ছাড়া হলো এক পোষা সিয়াগোশকে। সে নিমেষে মাঝে পা চালিয়ে নয়, দশটি পায়রাকে মেরে ফেলল।
‘ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফী’ পত্রিকার কর্তৃপক্ষ পৃথিবীর বহু দুর্গম স্থানে অভিযানকারী দল পাঠিয়েছেন। বিরল কোনো প্রাণী বা রহস্যময় কোন জায়গার তথ্য সংগ্রহের জন্যে। তারা ঠিক করলেন হিমালয়ের তুষার চিতার ছবি ছাপা হওয়ার প্রচুর চিঠি এলো। অনেকেই কৌতূহল প্রকাশ করেছে। তারা এই লাজুক এবং বিরল প্রাণীটি সম্পর্কে আরো বিশদ জানতে আগ্রহী।
পত্রিকা থেকে পাঠানো হলো জর্জ শ্যালের সঙ্গে আরও কয়েকজন অভিযাত্রী। জর্জ তার রোমাঞ্চকর কাহিনী লিখলেন। নাম দিলেন নীরবতার প্রান্তর।
‘ডিসেম্বর তুষারসাত দিনে শ্রীনগর থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। লোকালয় পার হয়ে জিপ পৌছে গেল হিমালয়ের অরণ্য অঞ্চলে। আমরা যেখানে এসে পৌছেছি তার আশেপাশেই আছে পৃথিবীর বিরল প্রাণী তুষার চিতার আস্তানা। এরা রাতের অন্ধকারে শিকার করে। হরিণ, খরগোশ, বুনো ভেড়া আর ছাগল এদের প্রিয় খাদ্য। এরা সাধারণত চিতার মতোই বড়ো। একা একা থাকতে ভালোবাসে। কখনও কখনও জোটবেঁধে ঘুরে বেড়ায়। বরফের উপর বাঁকা নখের সাহায্যে চিহ্ন দিয়ে নিজেদের জায়গা আগলে রাখে । এদের পায়ে আছে অদ্ভুত গন্ধ যা ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের চূড়ায়, গাছের ডালে।
পরের দিন অবিরাম অনুসন্ধানের পর হঠাৎ এক পড়ন্ত শেষ বিকেলে শুভ্র হিমালয়ের পটভূমিতে তার ক্যাম্পে ফিরছিলাম। প্রথম জানুয়ারির হাড় কাঁপানো শীতে রক্ত বুঝি জমাট বরফ। আরও একটি দিন বৃথাই অতিবাহিত হলো। হতাশায়, ক্ষোভে ভেঙে পড়েছি ভীষণ। এত উদ্যম ব্যর্থ হবে? আমি কি আমার ইঙ্গিত তুষার চিতার সন্ধান পাব না?
ভাবতে ভাবতে ফিরছিলাম। হঠাৎ সজাগ কানে সচকিত নখের আওয়াজ। চমক ভাঙতেই দেখি পাথরের চাঁইয়ের আড়ালে খন দিয়ে বরফের বুকে দাগ টানছে বিশ্ববিধাতার আশ্চর্য এই সন্তান। নিস্পন্দ চোখে তাকিয়ে থাকি তার দিকে। কয়েক মুহূর্ত কি এক তন্দ্রাচ্ছন্নতার মধ্যে যেন কেটে যায়। এতই অভিভূত হয়ে পড়েছি যে ক্যামেরার বোতাম টিপতে ভুলে গেছি। যখন চমক ভাঙল তখন দেখি চারপাশে ধুধু প্রাণহীন বরফের সীমাহীন বিস্তার। ক্ষণিকের অবসানে কোথায় হারিয়ে গেছে পরমাকাঙ্ক্ষিত তুষার চিতা। এরপর কেটে গেল আরও সাতটি দিন। পাগলের মতো খোজ করলাম। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পা রাখলাম দুর্গম অরণ্যের বুকে। কিন্তু কোন তুষার চিতার দেখা পেলাম না। হঠাৎ পনেরোই জানুয়ারির সকালে স্থানীয় এক পাহাড়ি রাজকুমারের দূত ছুটে এলো আমার কাছে। তুষার চিতা দেখা মিলছে। রক্তে বেজে উঠল মত্ত মাদল। সব কাজ ফেলে দৌড়ে গেলাম রাজকুমারের কাছে।
কোথায় তুষার চিতা?
আমার অশ্রুসজল চোখের সামনে পড়ে আছে রক্তাক্ত গায়ের চামড়া। কি নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে প্রাণীটিকে! বিস্ফারিত চোখের মণিতে লেখা আছে জীবনের একান্ত আকুতি।
হাসতে হাসতে রাজকুমার বলে আপনার আসে বড্ড দেরি হয়ে গেল। জম্ভটা আমার বুনো ছাগলগুলোকে মারছিল। তাই গতকাল রাতে ওর ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলাম।
হায় ঈশ্বর! এরা জানে না অহঙ্কারের বন্দুক থেকে দশ্বের ট্রিগার টেপা সীসার বুলেট কেমন ভাবে ছিনিয়ে নিচ্ছে অমূল্য প্রাণীর জীবন।
এই ঘটনার পর বিষন্নতায় ভরে যায় মন। আগের সেই উৎসাহ অনেক কমে গেল। স্থির করলাম, গবেষণার কাজ অসমাপ্ত রেখে ফিরে যাব। প্রকৃতির বিচিত্র শাস্তিতে পৃথিবীর বুক থেকে যদি শেষতম তুষার চিতাটি হারিয়ে যায়, তার জন্যে আমি কি করতে পারি?
অবশেষে একদিন, প্রথমবার রাতেরবেলায় তার সঙ্গে আমার শেষবারের মতো দেখা হলো। এবারের মিলন ছিল কয়েক মুহূর্তের । তারই মধ্যে অপসুয়মান চিতার চোখ দুটি আমি দেখেছিলাম। সেখানে তখনও ঝরছে বেঁচে থাকার আশ্চর্য অভিলাষ । কে জানে এটাই হয়তো পৃথিবীর শেষ চিতা!