অনেক’দিন পর তিথি, নাসিমুদ্দিনের কাছে এসেছে। নাসিম দরজা খুলে অবাক, আরে তুমি?
তিথি নিচু গলায় বলল, কেমন আছেন নাসিম ভাই? শরীর এমন কাহিল লাগছে কেন?
ইনফ্লুয়েঞ্জার মত হয়েছিল। প্রতি বছর শীতের শুরুতে এরকম হয়। জ্বরজ্বারি। এবার খুব বেশি হয়েছে। এস ভেতরে এস।
তিথি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ভাবী বাসায় নেই?
না, বাপের বাড়ি গেছে। ছেলেপুলে হবে।
আবার?
নাসিম লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, তুমি অনেক’দিন আস না দেখে ভাবলাম তোমার সমস্যার সমাধান হয়েছে। বিয়ে-শাদী করে সংসার পেতেছ। এ রকম হয়। চিরকাল তো আর খারাপ যায় না।
কারোর কারোর আবার যায়।
তোমাকে দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। মেয়েদের এই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না।–আর আমিই কি-না এর দালালি করি।
কেন করেন?
অভাব, বুঝলে তিথি–অভাব। প্রথম যখন এই রকম দালালি করলাম তখন মনের অবস্থাটা কী হয়েছে শোন–তিনশ টাকা পেয়েছি। টাকাটা বাসায় নিয়ে আসলাম। রাত তখন এগারটা, ঝুম
বৃষ্টি। এই বৃষ্টির মধ্যে….
বৃষ্টির মধ্যে কী?
বাদ দাও। ঐ সব বলে কী হবে। আমি এই লাইন ছেড়ে দিব তিথি। মীরপুরে একটা দোকান নিচ্ছি টেইলারিং শপ।
দরজির কাজ আপনি জানেন?
না জানি না। কারিগর রাখব। নিজে শিখে নিব।
ভালই তো। কিন্তু আমাদের মত মেয়েদের কি অবস্থা হবে? আমরা তো সেই পথে পথেই ঘুরব। আপনার মত একজন ভাল মানুষ পাশে থাকলে মনে সাহস থাকে।
ভালমানুষ। আমি ভালমানুষ? এই কথা না বলে স্যান্ডেল খুলে তুমি আমার গায়ে একটা বাড়ি দিলে না কেন? তাহলেও তো কষ্ট কম পেতাম। চা খাবে?
না।
খাও একটু চা। তোমার উপলক্ষে আমিও এক ফোঁটা খাই।
রান্নাবান্না নিজেই করেন?
হ্যাঁ। চারটা ডালভাত খাবে আমার সাথে?
জি-না।
নাসিম রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসের চুলায় কেতলি বসিয়ে দিল। তিথি পেছনে পেছনে গেল। নাসিম বলল, তুমি কী কাজের সন্ধানে এসেছে?
একটা কাজ হাতে আছে। কোরিয়া থেকে তিনজনের একটা টিম এসেছে। জয়েন্ট ভেনচারে বাংলাদেশে ইন্ডাস্ট্রি খুলবে। ওদরে খুশি করবার জন্যে বাংলাদেশী পার্টনাররা উঠে পড়ে লেগেছে। ওদের তিনজনের জন্যে তারা তিনজন বান্ধবী চায়। এরা তাদের সাথে ঘুরবে। রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার এই সব জায়গায় যাবে, চার-পাঁচদিনের ব্যাপার। তুমি যাবে?
তিথি জবাব দিল না।
নাসিম বলল, টাকা-পয়সা ভালই পাবে। ওদের সঙ্গে ঘুরলে মনটাও হয়ত ভাল থাকবে।
তিথি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, মন ভাল থাকবে?
এমনি বললাম তিথি। কথার কথা। নাও-চা নাও।
তিথি নিঃশব্দে চায়ের কাঁপে চুমুক দিতে লাগল। নাসিম বলল, তুমি যদি যেতে চাও তাহলে ১১ তারিখের মধ্যে জানাবে। ওরা ১২ তারিখ রওনা হবে।
টাকা কেমন দেবে জানেন?
না। হাজার পাচেক তো পাবেই।
আজ তাহলে উঠি নাসিম ভাই?
এস তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি, যাবে কোথায়? বাসায় তো?
হ্যাঁ।
চল।
নাসিমুদিন তাকে উঠিয়ে দিল। জোর করে হাতে একশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিল। বাস ছেড়ে না-দেয়া পর্যন্ত বাস স্টপে দাঁড়িয়ে রইল।
জালালুদ্দিন সাহেব খুবই আদরের সঙ্গে বললেন, জনাব আপনার নাম এবং পরিচয়? ভদ্রলোক বললেন, আমার নাম দবির উদ্দিন। আগেও একবার এসেছিলাম। আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কিছুই মনে থাকে না ভাই সাহেব। চোখে না দেখরে মনে থাকবে কী ভাবে বলেন? দৃষ্টিশক্তি নেই। সামান্য চিকিৎসায় আরাম হয়। সেটাই কেউ করাচ্ছে না। বসুন ভাই।
আমি আপনার মেয়ের কাছে এসেছিলাম, তিথি।
তিথি বাসায় নেই। এসে পড়বে। একটু বসেন। সুখ-দুঃখের কথা বলি, আপনের দেশ কোথায়? দবির উদ্দিন তার দেশ কোথায় সেই প্রসঙ্গে গেলেন না। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন।
আপনার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট এনেছিলাম।
সত্যি? জি, এই নিন।
সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে আনন্দ ও বিস্ময়ে জালালুদ্দিন স্তব্ধ হয়ে গেলেন। পৃথিবীতে এখনো এত ভালমানুষ আছে?
ভাই সাহেব বড়ই খুশি হলাম। বসুন। একটু চায়ের কথা বলে আসি।৷ দিবে কী না বলতে পারছি না। আপনি বন্ধু মানুষ, আপনাকে বলতে বাধা নেই। এই সংসারে আমি কুকুর-বিড়ালের অধম। বিড়াল যদি একবার ম্যাও করে–তার সামনে একটা কাটা ফেলে দেয়। আমার বেলায় তাও না।
জালালুদ্দিন সাহেব চায়ের কোনো ব্যবস্থা করতে পারলেন না। মিনু চায়ের কথা শুনে এমন এক ধমক দিলেন যে জালালুদ্দিন সাহেবের মনে হল সংসারে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। এরচে রাস্তায় ভিক্ষা করা এবং রাতে কমলাপুর রেলস্টেশনে শুয়ে থাকা অনেক ভাল। শেষপর্যন্ত হয়ত তাই করতে হবে। এমন বিশিষ্ট একজন মেহমান। অথচ তাকে এক কাপ চা খাওয়ানো যাচ্ছে না। এরচে আফসোসের ব্যাপার। আর কী হতে পারে?
ভাই সাহেব নিজগুণে ক্ষমা করবেন। চা খাওয়াতে পারলাম না।
ঐ নিয়ে চিন্তা করবেন না। তিথি কখন আসবে বলে আপনার মনে হয়?
কিছুই বলতে পারছি না ভাই সাহেব। এই সংসারের কোনো নিয়ম-কানুন নাই। যার যখন ইচ্ছা আসে। যখন ইচ্ছা যায়। সরাইখানারও কিছু নিয়ম-কানুন থাকে। এই বাড়ির তাও নাই।
আমার খুবই জরুরি কাজ আছে আমাকে চলে যেতে হবে। আমি আপনার কাছে কী একটা প্যাকেট রেখে যাব–তিথিকে দেবার জন্যে।
রেখে যান।
আপনার মনে থাকবে তো? ভুলে যাবেন না তো আবার?
জি-না ভুলব না।
প্যাকেটের ভেতর একটা জরুরি চিঠি ও আছে।
আমি দিয়ে দেব। আপনি চিন্তা করবেন না। আসামাত্র দিয়ে দেব।
আজ তাহলে উঠি।
কোন মুখে আর আপনাকে বসতে বলি? এক কাপ চা পর্যন্ত দিতে পারলাম না। বড়ই শরমিন্দা হয়েছি ভাই সাহেব! নিজগুণে ক্ষমা করবেন।
দবির উদ্দিনের চিঠিটি দীর্ঘ এবং সুন্দর করে লেখা। চিঠি পড়লেই বোঝা যায়। ভদ্রলোক বেশ সময় নিয়ে লিখেছেন। ঠিকঠাক করেছেন। একটা রাফ কপি করবার পর আবার ফেয়ার কপি করা হয়েছে কারণ চিঠিতে কোনো রকম কাটাকুটি নেই।
তিথি খুব আগ্রহ নিয়ে চিঠিটা পড়ল। অনেক দিন পর কেউ তাকে চিঠি লিখল। তাও এমন গুছিয়ে লেখা চিঠি।
প্রিয় তিথি, একটা দুঃসংবাদ দিয়ে চিঠি শুরু করছি। আমার স্ত্রী ফরিদা মারা গেছে। এই মাসের ১৮ তারিখে। সৌভাগ্যক্রমে মৃত্যুর সময় আমি তার পাশে ছিলাম। সে আমাকে বলল, তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। মনে কোনো রাগ রেখো না। তার মৃত্যু খুব সহজ হয়নি। নিঃশ্বাসের কষ্ট শুরু হল। এই কষ্ট চোখে দেখা যায় না। এই প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যেও সে হাসি হাসি মুখ হয়ে বলল, কিছুক্ষণের মধ্যেই সব কষ্ট শেষ হবে ভাবতেই আনন্দ লাগছে।
ফরিদা তোমার জন্যে কিছু টাকা রেখে গেছে। আশা করি মৃত মানুষের প্রতি সম্মান দেখিয়ে টাকাটা তুমি গ্রহণ করবে। টাকার পরিমাণ তেমন কিছু না। তবে প্রতিটি টাকাই ফরিদার। সে কোন এক বিচিত্র কারণে তোমাকে পছন্দ করেছে। ফরিদার ঘৃণা এবং ভালবাসা দুইই খুব তীব্র।
ফরিদার মৃত্যুর পর বুঝলাম তাকে আমি কী পরিমাণ ভালবাসতাম। আজ আমার দুঃখ ও বেদনার কোনো সীমা নেই।
অজন্তা খুব কষ্ট পাচ্ছে। তবু এই কষ্টের মধ্যেও আমার কষ্টটা তার বুকে বাজছে। সে তার নিজের মতো করে আমাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করছে। এই দৃশ্যটিও মধুর।
তিথি এই মধুর দৃশ্যটি কী তুমি এসে দেখে যাবে? যদি এই দৃশ্য তোমার ভাল লাগে তাহলে তুমি এসে যোগ দাও আমাদের সঙ্গে। তোমার শুরুর জীবনটা কষ্টের ছিল, শেষেরটা মধুর হতে ক্ষতি কী? এস ধরে নেই যে, আমাদের কারোর কোনো অতীত ছিল না। যা আমাদের আছে তা হচ্ছে বর্তমান।
তিথি, এককালে আমি খুব গুছিয়ে চিঠি লিখতে পারতাম। আমি খুব চেষ্টা করছি এই চিঠিটিও গুছিয়ে লিখতে। পারছি না। তবে মনে মনে অপূর্ব একটি চিঠি তোমার কাছে এই মুহুর্তে লিখছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই চিঠি কোনো না কোনো ভাবে তোমার কাছে পৌঁছবে।
তিথির চোখ ভিজে উঠল। সে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে মনে মনে ভাবল, আশ্চর্য এখনো আমার চোখে পানি আসে।
তিথি।
তিথি দেখল হীরু দরজা ধরে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কোনো কারণে অসম্ভব ভয় পেয়েছে। তিথি শুকনো গলায় বলল, কী ব্যাপার?
একটু বাইরে আয়।
যা বলার এখানে বললেই হয়।
না, একটু বাইরে আয়।
তিথি উঠোনে এসে দাঁড়াল। হীরু নিচু গলায় বলল, সৰ্ব্বনাশ হয়েছে রে তিথি। ভেরি বিগ প্রবলেম।
প্রবলেমটা কী?
এ্যান চলে এসেছে।
এ্যানা চলে এসেছে মানে? এ্যানাটা কে?
বলেছিলাম না একটা মেয়ের কথা, আমার সঙ্গে ইয়ে আছে। আজ সকালেই তার গায়ে হলুদ হয়েছে। আর এখন এই সন্ধ্যাবেলা কী গ্রেট ঝামেলা, এক কাপড়ে চলে এসেছে।
চলে এসেছে মানে? তোর কাছে কী ব্যাপার?
আহ্ কী যন্ত্রণা আমাদের মধ্যে একটা Love চলছে না; এখন করি কী বল?
মেয়েটা কোথায়?
বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কী যে প্রবলেমে পড়লাম। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়াই তো ভাল। কী বলিস তিথি?
তিথি বিস্মিত হয়ে বাইরে এসে দেখল, কাঁঠাল গাছের অন্ধকারে হলুদ শাড়ি পরা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিথি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কে?
এ্যানা সহজ গলায় বলল, আপা আমি এ্যানা।
তুমি এইসব কী পাগলামি করছ? বাসায় যাও। চল আমি তোমাকে দিয়ে আসি।
বাসায় ফিরে যাবার জন্যে তো আসিনি আপা।
তুমি বিরাট বড় একটা ভুল করছি এ্যানা।
জানি আপা।
আমার তো মনে হয় না তুমি জানো। আমার ভাইকে আমি খুব ভাল করে চিনি। ওর জন্যে তুমি এত বড় ডিসিশান নিতে পার না।
হীরু শুকনো মুখে বলল, তিথি রাইট কথা বলছে। ভেরি রাইট এবং ওয়াইজ কথা।
এ্যানা বিরক্তমুখে বলল, তোমাকে কত বার বলেছি কথার মধ্যে মধ্যে বিশ্ৰী ভাবে ইংরেজি বলবে না।
এই প্রথম এ্যানা হীরুকে তুমি করে বলল। হীরুর বুক কেমন ধড়ফড় করতে লাগল। চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। এই মেয়েটার জন্যে কিছু করতে ইচ্ছা করছে। কী করা যায়? মেয়েটাকে খুশি করবার জন্যে সে অনেক কিছু করতে পারে। হাসিমুখে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। ডান হাতটা কেটে পানিতে ফেলে দিতে পারে।
তিথি বলল, এখনো সময় আছে এ্যানা। এখনো সময় আছে।
এ্যানা মিষ্টি করে হাসল। মেয়েটা দেখতে তত সুন্দর না। কিন্তু তার হাসিটি বড়ই স্নিগ্ধ। তিথি বলল, এখন যে কত রকম ঝামেলা হবে তুমি কল্পনাও করতে পারছি না। তোমার বাবা পুলিশে খবর দেবেন। পুলিশ আসবে, তোমাকে এবং হীরুকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাব। এ্যানা বলল,
এইসব কিছুই হবে না আপা। আমি বাসায় না বলে তো আসিনি। বলেই এসেছি। সবাই জানে ভূমিকাথায়। কেউ কোনো ঝামেলা করবে না। কারণ আমি তাদের এমন একটা কথা বলে এসেছি…
কথা শেষ না করেই এ্যানা হাসল। তিথি বলল, কী কথা বলে এসেছ?
এটা আপা বলা যাবে না।
এস ঘরে এস।
এ্যানা জালালুদ্দিন সাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম করল। জালালুদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, কে? এ্যানা বলল, বাবা আমার নাম এ্যানা। আমি আপনার একজন মেয়ে।
জালালুদ্দিন হকচকিয়ে গেলেন। কী ব্যাপার কিছু বুঝতে না পেরে বললেন, মা আপনার শরীর কেমন?
এ্যানা বলল, আমার শরীর ভাল।
মিনুকে সালাম করতে যেতেই মিনু বললেন, খবরদার তুমি আমার পায়ে হাত দিও না।
এ্যানা সহজ গলায় বলল, আমার সঙ্গে এমন কঠিন করে কথা বললে তো হবে না মা। আমি এই বাড়িতেই থাকব। আমাদের তো মিলেমিশে থাকতে হবে। হবে না?
রাত সাড়ে দশটায় কাজী এনে বিয়ে পড়ানো হল। এ্যানার বাবাকে খবর দেয়া হল। আশ্চর্যের ব্যাপার–তিনি বিয়েতে এলেন। হীরু যখন তাকে সালাম করল তখন হীরুকে একটা আংটি এবং দুশ টাকা দিলেন।
টাকাটা পাওয়ায় হীরুর খুব লাভ হল। তার হাতে একটা পয়সা ছিল না। কেন জানি তার মনে হল এ্যানা খুব পয়মন্ত মেয়ে। এইবার সংসারের হাল ফিরবে।