1 of 3

১৭. তরল মন্তব্য

॥ ১৭ ॥

রঙ্গময়ীর আকস্মিক ওই তরল মন্তব্যে এত লজ্জা পেলেন হেমকান্ত যে, রাতে তাঁর ভাল ঘুম হলনা। শশিভূষণ এখন হাসপাতালে পুলিশের হেফাজতে, সেই চিন্তাও তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

জীবনটাকে তিনি যতদূর সম্ভব নির্ঝঞ্ঝাট এবং সরল রাখতে চেষ্টা করেছিলেন। তার জন্যই সংসারের সঙ্গে বেশী মাখামাখি করেননি, পুত্রকন্যাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হননি, বিষয়ের প্রতি আসক্ত হননি। তিনি চেয়েছিলেন এমন একটা জীবন যাতে জটিলতা নেই, আবর্ত নেই, অতিশয় শোক বা অত্যধিক আনন্দ নেই। কিন্তু তা পেলেন কই! জীবনের অনেকগুলি কপাট তিনি সভয়ে বন্ধ রেখেছিলেন। সেইসব কপাটের আড়ালে কী আছে তা জানার ইচ্ছাকে পর্যন্ত তিনি সভয়ে এড়িয়ে চলেছেন।

সেইরকম এক বন্ধ কপাট ছিল রঙ্গময়ী। আজ ওপাশ থেকে রঙ্গময়ী সেই কপাটে মৃদুমন্দ করাঘাত করতে শুরু করেছে। যদি অবারিত করে দেন দ্বার তবে হয়তো ভেসে যাবেন।

কাতর এক যন্ত্রণার শব্দ করে হেমকান্ত নিশুত রাতে পাশ ফিরলেন। এই শীতেও লেপের তলাকার উষ্ণতা তাঁর কাছে অসহ্য লাগছিল। উঠে আস্তে আস্তে এসে দাঁড়ালেন উত্তরের জানালার ধারে। জানালা খুলে দিলেন।

আজ কুয়াশা নেই। সামান্য জ্যোৎস্না আছে। গারো পাহাড়ের হিম বাতাস ব্রহ্মপুত্রের জল ছুঁয়ে আরো খরশান হয়ে আসছে। বালাপোশ ভেদ করে হাজারটা তীরের মতো বিদ্ধ করে যাচ্ছে শরীর। কিন্তু হৃদয় যখন উত্তপ্ত তখন বাইরের শীতলতা তেমন অনুভব করা যায় না।

ব্রহ্মপুত্রে সাদা বালির চর জেগে আছে। ওপারে জলা জমিতে মাঝে মাঝে ভূতের লণ্ঠনের মতো জ্বলে জ্বলে উঠছে নীলচে সবুজ শিখা। শূন্যে দোল খেয়ে হঠাৎ নিবে যাচ্ছে আবার। আলেয়া। রাত্রির কোন প্রহর ঘোষণা করছে শেয়ালের পাল? চাঁদের মুখে ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে বাদুড়।

এই নিসর্গকে হেমকান্ত বুঝতে পারেন। তাঁর শরীরের সীমায় আবদ্ধ অস্তিত্ব এই রহস্যময় গভীর রাত্রির আলো আঁধারিতে নিজের দুকূল ছাপিয়ে যেন চারদিকে প্রবাহিত। নিজের মানুষী পরিচয়, নাম, গোত্র সব বিলুপ্ত হয়ে যেতে থাকে। যদি সমাজ, সংসার, রাষ্ট্র এসব না থাকত তাহলে এই পৃথিবীতে হেমকান্তর মতো মানুষ বড় সুন্দর জীবন যাপন করতে পারত।

ঘড়িতে রাত তিনটে বাজবার সংকেত শুনে সামান্য নড়লেন হেমকান্ত। আজ আর ঘুম আসবে না। জীবনের বন্ধ দুয়ারগুলিতে আজ বারবার কে কড়া নাড়ছে! কড়া নাড়ছে রঙ্গময়ী, শশিভূষণ, সচ্চিদানন্দ।

খুলে দেবেন দরজা?

হেমকান্ত নিঃশব্দে নীচে নেমে এলেন। ভোর চারটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে রোজ তার ঘুম। ভাঙে। প্রাতঃকৃত্য শুরু করেন। আজ একটু আগেই শুরু হল তাঁর দিন।

কুয়োয় বালতি ফেললেন। হাত বেয়ে খড়খড়ে শুকনো দড়ি নেমে যাচ্ছিল নীচে। জল তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। বহু নীচে গোল চক্রাকার জলের স্থির আয়না। জ্যোৎস্নায় আলোকিত আকাশের একটুখানি প্রতিবিম্ব তার বুকে। স্থূল বালতির স্পর্শে শতখান হয়ে ভেঙে গেল জলের বৃত্তাকার কাচ।

বালতিটা টেনে তুলতে ইচ্ছে হল না হেমকান্তর। দড়িটা ধরে রইলেন আলগা হাতে। তাঁর মনে হচ্ছিল, ঠিক পিছনেই অপরূপ এক সাতরঙা ময়ূর পেখম মেলে চালচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। পিছন ফিরলেই মুখোমুখী দেখা হয়ে যাবে। হয়তো সেই মৃত্যুর দূত।

মুঠিটা হঠাৎ আলগা করে দিলেন হেমকান্ত। দড়িটা ছপাৎ করে গভীর কুয়োর মধ্যে পড়ে গেল। পার্থিব যা কিছু আকর্ষণ ছেড়ে হেমকান্ত তার মৃত্যুর মুখোমুখি হলেন।

কী চাও?

তোমাকে। শুধু তোমাকেই। ময়ূর বলল।

আমি প্রস্তুত নই।

মৃত্যু তো কারো প্রস্তুতির ধার ধারে না। খেলার মাঝখানে খেলার ঘুঁটি তুলে নিয়ে যায়। প্রস্তুত নও সে তোমার দোষ।

মৃত্যুর কি কোনো রচনা নেই? সে কি চোর?

না। তা কেন? সে তো আসবেই, জানা কথা। বেঁচে থাকা মানেই তো প্রতিটি মুহূর্ত তার পদধ্বনির জন্য অপেক্ষা করা।

আমি অন্যরকম জানতাম।

সে কিরকম?

আমার মনে হয়, জীবনেরই পরিণতি মৃত্যু। আগে পরিপূর্ণ জীবন। উৎস থেকে শুরু করে নানা ঘাত প্রতিঘাত ভেদ করে বয়ে যাওয়া। কত বাঁক, কত খাদ, কত উঁচুনিচু, গ্রাম ও শহর ছুঁয়ে নদী যেমন যায়। তারপর মোহনায় যখন গতি শ্লথ, বিস্তার অগাধ তখন মহাসমুদ্রের সঙ্গে দেখা।

মৃত্যু উপমা মানে না, নিয়ম মানে না।

কোনো নিয়মই নয়?

তার নিয়ম আলাদা। তোমাদের সঙ্গে মিলবে না।

কেন এরকম? মৃত্যু কি স্বেচ্ছাচারী শাসক?

তার স্বরূপ জীবন থেকে জানা অসম্ভব।

সে কি এক স্থির ও ব্যাপ্ত অন্ধকার?

না। তাও নয়।

সে কি ভিন্নতর এক অস্তিত্ব?

তুমি আছো, এটা যদি সত্যি হয় তবে তুমি যে ছিলে এবং তুমি যে থাকবে তাও সত্য। কেউই তো আনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব গ্রহণ করতে পারে না।

সে কেমন অস্তিত্ব?

সে এক গভীর আকাঙক্ষা, আকুল পিপাসার ঘনবদ্ধ একটি বিন্দু।

কিসের আকাঙক্ষা? পিপাসাই বা কিসের?

তুমি কি জানো না?

আমার আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা নেই। আমার জীবন স্তিমিত, আমার আশা আকাঙক্ষাও স্তিমিত।

তাহলে কিসের জন্য বেঁচে থাকতে চাও?

তা তো জানি না। স্বল্প পরিসরে আবদ্ধ আমার জীবন। কিন্তু তবু আমার বেঁচে থাকতে ভাল লাগে।

অন্ধকারে মিশে স্থির দাঁড়িয়ে আছেন হেমকান্ত। মুখ, পা, শরীরের অনাবৃত অংশগুলিতে ছেঁকে ধরেছে মশা। তবু হেমকান্তের শরীরের চেতনা নেই। তাঁর নিজস্ব চেতনা যেন চরাচরের অদ্ভুত এই জ্যোৎস্নামাখা ব্যাপ্তির মধ্যে হারিয়ে গেল।

ভোরের কিছু আগে লোকজনের সাড়া পাওয়া গেল। হেমকান্ত সম্বিতে এলেন।

শ্যামকান্ত শরীরচর্চা করতেন। তাঁর কিছু কাঠ ও লোহার মুগুর নীচের একটা ঘরে আজও জড়ো করা আছে। প্রাতঃকৃত্য সেরে হেমকান্ত আজ গিয়ে সেই ঘরে ঢুকলেন। ফুটবল ছেড়েছেন অনেকদিন। তারপর আর শরীর নিয়ে মাথা ঘামাননি। আজ মনে হল, মানসিক এই বিহ্বল ও বিবশভাবটা শরীরের আলস্যের দরুনও হতে পারে। সম্ভবত শরীরটাকে চাঙ্গা করা গেলে মনও চাঙ্গা হবে।

ঘরের দরজা সাবধানে এঁটে তিনি মাঝারি একটা মুগুর তুলে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরালেন। কিন্তু অল্পেই হাঁফিয়ে উঠতে হল। একটু বিশ্রাম আবার কিছুক্ষণ ঘোরালেন। মন্দ লাগছিল না। বুড়ো বয়সের একটা খেলা।

যখন বেরিয়ে এলেন তখন মুখ লাল, গা ঘামে ভেজা। তবে মনটা একটু চনমনে লাগছিল। যেন বয়সটা এক দুই দশক পিছু হেঁটেছে। নির্দিষ্ট রুটিনের বাইরে তিনি বড় একটা চলেন না। অনিয়মের কপাটগুলো বন্ধ রাখেন। আজ নিয়ম ভাঙার একরকম আনন্দ পাচ্ছিলেন।

কৃষ্ণকান্ত তার ঘরের বারান্দায় মাদুর পেতে রোদে পিঠ দিয়ে পড়তে বসেছে। হেমকান্ত তার কাছে গিয়ে হাজির হলেন। মুখে একটু উদ্বেগ। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি একটু আধটু শরীরচর্চা করো তো?

কৃষ্ণকান্তর মুখখানা আজ ভার এবং বিষন্ন। মুখ তুলে বাবাকে একটু বিস্ময়ভরে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি ফুটবল খেলি।

ও। আচ্ছা, খুব ভাল।

আমি ভাল ঘোড়ায় চড়তে পারি।

বেশ। আর কী? সাঁতার কাটতে শিখেছো?

হ্যাঁ।

নীচের ঘরে কয়েকটা মুগুর আছে। ভাঁজতে পারো। মুগুর ভাঁজা ভাল।

মুগুর কি ঘোরাতে হয়?

হ্যাঁ। ওপর নীচ ডাইনে বাঁয়ে। দরকার হলে বোলো, আমি দেখিয়ে দেবখন।

বলে হেমকান্ত চলে আসছিলেন।

পিছন থেকে কৃষ্ণকান্ত ডাকল, বাবা।

হেমকান্ত ফিরে চেয়ে বললেন, কী বলছ?

শশীদা কি ফিরে আসবে?

শশী! হেমকান্ত একটু বিপন্ন হয়ে বললেন, আসবে না কেন?

সবাই বলছে শশীদার ফাঁসি হবে।

হেমকান্ত নিস্তেজ গলায় বলেন, বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে, হতে পারে।

যদি হয়?

আগে তো তোক।

শশীদার তো অসুখ। অসুখ না সারলেও কি ফাঁসি দেবে?

ফাঁসির কথা উঠছে কেন এখন? সে কোনো অন্যায় করেছে বলে তো আমরা জানি না।

শশীদা এক সাহেবকে মেরেছে। বরিশালে।

তুমি জানলে কী করে?

মনু পিসির মুখ থেকে শুনেছি।

মনু জানে না।

শশীদা জ্বরের ঘোরে নিজেও বলছিল।

তাই নাকি? জ্বরের ঘোরে মানুষ ভুলই বকে।

যদি শশীদা দোষী হয়েই থাকে তাহলে?

তাহলে ফাঁসি হতেও পারে।

যদি গায়ে জ্বর থাকে তবে?

জ্বর সারিয়ে নেবে।

কমপাউনডারকাকাও আমাকে তাই বলছিল। গায়ে জ্বর থাকলে ফাঁসি দেবে না। জ্বর সারিয়ে নেবে।

হেমকান্ত একটু হাসলেন।

কৃষ্ণকান্ত হঠাৎ বলল, কেন এরকম নিয়ম বাবা? ফাঁসিই যখন দেবে তখন জ্বর সারানোর কী দরকার?

কথাটা হেমকান্ত একটু ভেবে দেখলেন। বড় মানুষরা এমন অনেক হাস্যকর ও অযৌক্তিক আচরণ করে যা ছোটোদের চোখেও অসঙ্গত ঠেকে। সত্যিই তো, ফাঁসিই যদি দিবি তো জ্বর সারানোর কী দরকার?

হেমকান্ত প্রশ্ন করলেন, তোমার কি শশীর জন্য মন কেমন করছে?

এই প্রশ্নে কৃষ্ণকান্তর চোখ ছলছলে হয়ে এল। বলল, হ্যাঁ বাবা খুব মন কেমন করছে। শশীদার তো দোষ নেই।

খুন করা নিশ্চয়ই অপরাধ।

শশীদা তো ইংরেজ মেরেছে। তাতে তো দোষ হয় না।

ইংরেজ মারলে দোষ হয় না একথা তোমাকে কে বলল?

সবাই বলে ওটা বীরত্বের কাজ।

হেমকান্ত মাথা নেড়ে বিষণ্ণ গলায় বললেন, সবাই বলে না। সবাই কি অযৌক্তিক কথা বলতে পারে? ইংরেজরাও মানুষ, মানুষ মারা বীরত্বের কাজ হতে যাবে কেন?

ওরা যে আমাদের পরাধীন করে রেখেছে!

সেটা শুধু ওদের দোষ তো নয়। দোষ আমাদেরও আছে। ওরা আমাদের সেই দোষটুকুর সুযোগ নিয়েছে মাত্র। ইংরেজ যদি আমাদের পরাধীন না করত তাহলেও আমাদের রেহাই ছিল। না। ফরাসী বা পর্তুগীজরা এসে আমাদের দেশ দখল করত। তুমি এসব কথা জানো না?

একটু একটু জানি।

পরের মুখে কখনো ঝাল খেও না। নিজের বিচারবুদ্ধি কাজে লাগানোর চেষ্টা কোরো। যে অবস্থায় ভারতবর্ষকে ইংরেজরা দখল করেছিল সেই অবস্থায় ইংরেজের অধীনতাই ছিল আমাদের মন্দের ভাল।

কৃষ্ণকান্ত তদগতভাবে তার বাবার দিকে চেয়ে থাকে। কোনো কথা বলে না।

হেমকান্ত জানতেন না, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রটি তাঁকে কত উচ্চ আসনে বসিয়ে রেখেছে। বাবা যা বলেন তাই কৃষ্ণকান্তর কাছে দেববাক্য। বাবা বলেন অবশ্য খুব কম। আর কম বলেন বলেই বোধ হয় সেগুলির ওজন অনেক বেশী মনে হয় কৃষ্ণকান্তর।

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, একজন দুজন ইংরেজকে মেরে লাভ কী? ওরা সাত সমুদ্র পেরিয়ে অনেক বিপদের ঝুঁকি নিয়েই এদেশে এসেছিল। সারা পৃথিবীটা জয় করতেও তো কম সাহস লাগে না। তুমি কি ভাবো ওরা দুচারটে বোমা বন্দুককে ভয় পায়, না দুচারজন মরলেই ঘাবড়ে যায়! ওরা অত ভীরু জাত নয়।

তাহলে কি শশীদার ফাঁসি হওয়াই উচিত?

তা বলিনি। শশী কী অপরাধ করেছে তা আমরা এখনো জানি না। ওসব কথা থাক। তোমার মনটা বোধ হয় আজ ভাল নেই।

না। আমার মনটা আজ বড্ড কেমন করছে।

তাহলে চললা, ব্রহ্মপুত্রে একটু নৌকো করে বেড়িয়ে আসি।

এ কথায় কৃষ্ণকান্তর মুখ উজ্জ্বল হল, অবিশ্বাসের গলায় বলল, আপনার সঙ্গে বাবা?

হেমকান্ত বুঝতে পারছিলেন না, ছেলের কাছে তাঁর কোনো দুর্বলতা ধরা পড়ে গেল কিনা। পুত্রস্নেহের কোনো প্রকাশ ঘটুক এটা তিনি চাননা। বড়ই অস্বস্তিকর ব্যাপার হবে সেটা। তাই একটু লজ্জার সঙ্গে বললেন, আমারও মনটা ভাল নেই। শশিভূষণের জন্য আমি তো কিছু করতে পারলাম না। কিন্তু অতিথিকে রক্ষা করা গৃহস্থের কর্তব্য। চলো, একটু ঘুরেই আসি।

নদীর ঘাটে কয়েকটা নৌকো সর্বদাই থাকে। হেমকান্তের নিজস্ব একটা ছোটো বজরাও আছে। কিন্তু হেমকান্ত আজ নিজস্ব নৌকো নিলেন না। ছোটো একটা ডিঙি ভাড়া করলেন। মাঝির কা থেকে বৈঠা নিজের হাতে নিলেন। ছেলেকে বললেন, হালটা তুমিই ধরো।

কৃষ্ণকান্তর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে গেল আনন্দে। শীতের কবোষ্ণ রোদ, ব্রহ্মপুত্রের গৈরিক বিস্তার, রূপোলী জলের ওপর বাতাসের হিলিবিলি এবং প্রিয় পুত্রটির নিস্পাপ মুখে উত্তেজিত আনন্দের প্রভা হেমকান্তের বড় ভাল লাগল। রাত্রির অনিদ্রার কথা ভুলে গেলেন। শরীরটা যেন যৌবনের গান গাইছে। তিনি সবল হাতে বৈঠা বাইতে লাগলেন। অনভিজ্ঞ কৃষ্ণকান্তর হাল ধরার দোষে মাঝে মাঝে নৌকো দিগভ্রষ্ট হচ্ছিল। একবার একপাক ঘুরেও গেল। মাঝি হালের জন্য হাত বাড়াতেই হেমকান্ত ধমক দিলেন, তুই বসে থাক। ও ঠিক পারবে।

হেমকান্তর এরকম প্রগলভ আচরণ বহুকাল কেউ দেখেনি।

তিনি নৌকোটা ভেড়ালেন নদীর মাঝখানকার চরে। সে এক অপার্থিব সৌন্দর্যের জঠর যেন বা। মাথার ওপর ঘন নীল চাঁদোয়া। দুদিকেই ব্রহ্মপুত্রের গম্ভীর স্রোত বয়ে যাচ্ছে। নদীর পরপারে বসতিহীন অবাধ প্রকৃতি। চরে কলুই শাকের বীজ ছড়িয়েছিল কে। হাঁটু সমান দুব্বোঘাসের মতো অতি সবুজ ও নরম ক্ষেত কী সুন্দর!

হেমকান্ত সামান্য জল ভেঙে কৃষ্ণকান্তকে নিয়ে চরে উঠে এলেন। কিছুক্ষণ বোবা হয়ে চেয়ে দেখলেন চারদিকে। তারপর ছেলের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ভাল লাগছে না?

খুব ভাল লাগছে।

তিনি সস্নেহে কৃষ্ণকান্তের মাথার চুলে একটু হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর ক্ষেতের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চরের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত চলে গেলেন। জল ও মাটির প্রগাঢ় গন্ধ রোদে আরো ঝাঁঝালো হয়ে উঠেছে এখন। এই গাছপালা, ওই আকাশ, আর চারদিকের এই যে অগাধ প্রসার এর মধ্যে কোথায় হারিয়ে যায় সমাজ ও সংসার, রাজনীতি বা রাষ্ট্র।

কৃষ্ণ

বলুন বাবা।

এসো একটু বসি।

দুজনে পাশাপাশি মাটির ওপর বসার পর হেমকান্ত প্রশ্ন করলেন, বড়দার কাছে কলকাতায় যেতে তোমার ইচ্ছে করে না?

না।

একটুও না?

একটুও না।

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তবু তোমার বড়দা তোমাকে নিয়ে যেতে চায়। যাবে?

আপনি যা বলবেন।

হেমকান্ত একটু চুপ করে থেকে বলেন, হয়তো ভালর জন্যই বলছে। তুমি একটু ভেবে দেখো।

আমার কলকাতায় যেতে ইচ্ছে করে না।

কেন?

আমার এ জায়গাই ভাল।

কারও জন্য কষ্ট হবে?

আপনাকে আর ছোড়দিকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। খুব কষ্ট হবে।

হেমকান্তের বুক্টা চলকে উঠল এক অনভিপ্রেত আনন্দে। যেন মায়ার একটি কলস ভরে গেল, উপচে গেল। তাঁকে ছেড়ে যেতে কৃষ্ণকান্তর তাহলে কষ্ট হবে? তাহলে তিনি যদি মরে যান তবে কৃষ্ণকান্ত বুঝি খুব কাঁদবে, হাহাকার করবে!

হেমকান্ত মৃদুস্বরে বললেন, আমি তো তোমার জন্য কিছুই করিনি। তুমি মা-হারা ছেলে, তোমার জন্য বোধ হয় আমার আরো কিছু করা উচিত ছিল। নজরই দিতে পারলাম না তোমার দিকে।

কৃষ্ণকান্ত চুপ করে রইল।

হেমকান্তর খুব ইচ্ছে করছিল ছেলের চোখ দুটির দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকতে। কিন্তু সংকোচবশে পারলেন না। নিজের দুর্বলতা কখনো ছেলেপুলেদের কাছে প্রকাশ করতে নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *