১৭. তন্ময় তখনো অঘোরে ঘুমোচ্ছিল

তন্ময় তখনো অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। আমিও কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইলাম। নানা কথা ভাবলাম। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। তন্ময় আমাকে এমন করে জড়িয়ে ছিল যে আমি পাশ ফিরতে পারলাম না। তবু মুখ ঘুরিয়ে ওকে দেখলাম। দেখতে ইচ্ছা করল। ভেবেছিলাম, ওকে দেখেই রাগ হবে, ঘৃণা হবে কিন্তু রাগও হল না, ঘৃণা করতেও পারলাম না। আমার মায়া হল। তারপর হঠাৎ মনে হল, আমার একটা সন্তান হলে বেশ ভালো হতো। মনে হল, যে হয়তো এইভাবেই আমাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকত; হয়তো আমি পাশ ফেরবার চেষ্টা করলে ঘুমের ঘোরে ও আমাকে আরো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরত। মনে হল আরো কত কী! তারপর একবার ক্ষণিকের জন্য মনে হল, তন্ময় যদি হঠাৎ শিশু হয়ে যায় অথবা ঠিক ওর মতো একটা শিশু যদি আমার সন্তান হত, তাহলে বেশ হতো।

মাথার দিকের জানালা দিয়ে হঠাৎ এক ঝলক রোদ্দুর আমার মুখের ওপর পড়তেই আমার স্বপ্ন দেখা শেষ হল। তন্ময়ের ঘুম না ভাঙিয়ে অতি কষ্টে উঠে পড়লাম। দেখি, ঘরের মেঝের কার্পেটের ওপর আমাদের দুজনের জামা কাপড় ব্যাগ-পার্স ইত্যাদি চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। একটু হাসলাম। ভাবলাম, কাল রাত্রে কী দুজনেই একসঙ্গে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম?

তন্ময়ের গায়ে একটা চাঁদর দিয়ে আমি বাথরুমে গেলাম। আধঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে এসে দেখি ও তখনো অঘোরে ঘুমুচ্ছে। বুঝলাম, কাল রাত্তিরে একটু বেশিই ড্রিঙ্ক করেছিল। তারপর অত রাত্তিরে ফিরে এসে আমাকে নিয়ে কতক্ষণ পাগলামি করেছে, তার ঠিক নেই। তাই ভাবলাম, ওকে ডাকব না।

আমি নিজের জন্য এক কাপ চা করেই রান্নাবান্নার উদ্যোগ শুরু করলাম। তারপর একটু হাত খালি হতেই ঘরদোর ঠিক করতে এলাম। তন্ময়ের জামা-কাপড় তুলতে গিয়েই দেখি পার্সের ভিতর থেকে কিছু কাগজপত্র বাইরে পড়ে রয়েছে। ওই কাগজপত্র তুলতে গিয়েই চমকে উঠলাম। তন্ময়ের ওপর রাগে-ঘেন্নায় আমার সারা মন প্রাণ বিদ্রোহ করে উঠল। একবার মনে হল, হাতের কাছে একটা চাবুক থাকলে আশা মিটিয়ে মারতাম। অথবা…

না, আমি ওর সামনে দাঁড়াতে পারলাম না। একবার মনে হল, ঘরের দরজা লক করে। বেরিয়ে পড়ি। আবার মনে হল, না, না, আমি কেন পালাব। এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতেই কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে পায়চারি করলাম। তারপর চুপ করে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম।

কতক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ পিছন থেকে এসে তনয় আমাকে জড়িয়ে ধরতেই আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, সারারাত উপভোগ করেও মন ভরেনি?

তন্ময় আমার কাঁধের ওপর মুখ রেখে বলল, সারারাত কেন, সারা জীবন ধরে তোমাকে উপভোগ করলেও আশা মিটবে না।

সত্যি বলছ?

ও আমার বুকের ওপর একটা হাত রেখে বলল, সত্যি বলছি।

বুকের মধ্যে জ্বলে গেলেও জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি আমাকে খুব আদর করবে?

তন্ময় একটু হেসে বলল, এ কথা আবার জানতে চাইছ? বলেই ও আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েই চুমু খেল ওষ্ঠে, মুখে, গলায়। বারবার, বহুবার।

তোমাকে দেখে তো মনে হয়নি তুমি কোনো দিন এভাবে চাইতে পারো।

আমি একটু মুচকি হেসে বললাম, মানুষকে দেখে কতটুকু জানা যায়?

ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করে তো নিশ্চয়ই জানা যায়।

জানি না।

জানি না বলছ কেন? আমি যেমন তোমাকে চিনেছি, জেনেছি, সেই রকম তুমিও তো আমাকে চিনেছ, জেনেছ।

আমি একটু হেসে বললাম, তোমরা বল, পুরুষস্য ভাগ্যম স্ত্রিয়াশ্চরিত্রম মানুষ তো দূরের কথা, দেবতারাও জানেন না কিন্তু আমি যদি পারতাম তাহলে এই শ্লোকটা পালটে দিতাম।

কেন? বলতাম শুধু মেয়ে না পুরুষের চরিত্রও সত্যি অবোধ্য।

হঠাৎ, এ কথা বলছ কেন?

না, এমনি মনে হল বলে বলছি।

সবাইকে না জানলেও আমাকে তো জেনেছ।

নিশ্চয়ই কিছু জেনেছি।

যা জেনেছ তাতে কী তুমি খুশি?

আবার আমি হাসি। বলি, যা জেনেছি, যা পেয়েছি, তাতে কোন মেয়ে খুশি হবে না?

একটু চুপ করে থাকার পর তন্ময় জিজ্ঞাসা করল, চা খেয়েছ?

সরি! এখুনি তোমাকে চা দিচ্ছি।

চা এনে দিতেই তন্ময় হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, আজকেও তোমাকে কালকের মতো পাবো তো?

ঠিক কালকের মতো কি আজ হতে পারে? কাল কালই ফুরিয়ে গেছে; ঠিক কালকের মতো দিন তো কখনই ফিরতে পারে না।

এ কথা বলছ কেন? কাল কী তোমার ভালো লাগেনি?

কাল যখন তোমার সঙ্গে সমান তালে ঘুরেছি-ফিরেছি হেসেছি খেলেছি তখন নিশ্চয়ই ভালো লেগেছিল কিন্তু…

আমি কথাটা শেষ করি না। হঠাৎ থেমে যাই। মুখ নীচু করে বসে থাকি। তন্ময় আমার মখখানা আলতো করে তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু বলেই থামলে কেন? এমনি।

আমি আবার মুখ নীচু করেই বসে রইলাম, কিন্তু ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় মনের মধ্যে যে আনন্দ-উত্তেজনা, যে স্বপ্ন দানা বেঁধে উঠছিল তা হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ায় সত্যি কান্না পাচ্ছিল। আমি জীবনে একজনকেই মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছি। তাকে হারাবার পর আর কাউকে ভালোবাসতে না চাইলেও তন্ময়কে নিশ্চয়ই ভালো লেগেছিল। এই ভালো লাগা টিকে থাকলে হয়তো অতীতের দুঃখ ভুলে নতুন করে ভালো ভাবে বাঁচার কথা ভাবতাম। ভাবতাম কেন, বোধহয় মনে মনে ভাবতে শুরু করেছিলাম। আমার ও কথা হয়তো শুনতে তোমার খারাপ লাগছে, কিন্তু ভাই, কোনো দুঃখই তো মানুষ চিরকাল মনে রাখে না। মনের বেলাভূমিতে নিত্য-নতুন পলিমাটি জমতে জমতে অতীতের দুঃখ কোথায় যেন হারিয়ে যায়।

মনে মনে এলোপাথাড়ি হাজার রকমের চিন্তা করছিলাম। তন্ময়ও বিশেষ কথাবার্তা বলল। বাথরুমে গেল। ফিরে এসেই বলল, কবিতা, দারুণ খিদে পেয়েছে। খেতে দেবে?

হ্যাঁ দিচ্ছি।

খাবার সময়ও বিশেষ কথাবার্তা হল না। ও একবার শুধু জিজ্ঞাসা করল, খেয়ে উঠেই বেরুবে?

আমি বললাম, না।

কেন?

টায়ার্ড। ঘুমোব।

খেয়ে উঠেই আমি শুয়ে পড়লাম। তন্ময়ও কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ল। আমি পাশ ফিরে শুয়েছিলাম। ও আমাকে জড়িয়ে ধরতেই বললাম, ঘুমোতে দাও।

কথাও বলবে না?

এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া এ রকম ভাবে জড়িয়ে থাকলে আমার ঘুমও আসবে না।

কাল রাত্রে ঘুমোলে কী করে?

কাল রাত্রে নিশ্চয়ই স্বাভাবিক ছিলাম না।

তন্ময় একটু হেসে বলল, যা-ই হোক কাল খুব এনজয় করেছি। সত্যি কবিতা, জীবনে এত আনন্দ কোনো দিন পাইনি।

আমার মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠলেও তন্ময় দেখতে পেল না। বললাম, সত্যি?

এই আনন্দ আর কোথায় পাবো?

এ প্রশ্নের জবাব কী আমার কাছে চাও?

তন্ময় হঠাৎ এক টানে আমাকে ওর দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, তোমার কি হয়েছে?

কিছু না।

কিন্তু ঘুম থেকে উঠেই দেখছি তুমি কেমন যেন গম্ভীর হয়ে রয়েছ।

আমি হেসে বললাম, ঘুমোতে দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।

বিকেলের দিকে ঘুম ভাঙতেই দেখি তন্ময় বিয়ার খাচ্ছে। আমাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখেই ও হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, আর ইউ রেডি ফর ইভনিং প্রোগ্রাম?

মুহূর্তের মধ্যে মনে নানা চিন্তা এলো, গেল। তারপর মনে মনে ভাবলাম, স্বাভাবিক অবস্থায় নিশ্চয়ই সব কথা বলতে পারব না। সুতরাং…

হাসতে হাসতে বললাম, টয়লেট থেকে এসেই তৈরি হয়ে নিচ্ছি।

আমার কথা তন্ময় শুনেই খুশিতে লাফ দিয়ে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। চুমু খেল।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, দশ মিনিট ধৈর্য ধর।

তারপর আমি একটু তৈরি হয়েই এক বোতল হুইস্কি বের করলাম।

তন্ময় অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হুইস্কি বের করছ কেন? বিয়ার খাবে না?

বিয়ার খেয়ে কী নেশা হয়? ওতে শুধু আমেজ আসে।

কিন্তু…

ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আমি হুইস্কির বোতল খুলোম। গেলাসে ঢালোম। তারপর দু-চারটে আইস-কিউব দিয়েই গেলাস তুলে ধরে বললাম, চিয়ার্স।

তন্ময় কি যেন ভাবছিল। হঠাৎ বিয়ারের জাগটা তুলে ধরে বলল, চিয়ার্স!

দু-তিন রাউন্ড হুইস্কি খাবার পরই আমি তন্ময়কে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে তোমার ভালো লাগে?

তন্ময় হো হো করে হাসতে হাসতে বলল, তোমাকে ভালো লাগবে না এমন পুরুষ মানুষ আছে?

আর কাউকে আমার মতো ভালো লাগে না তো?

তুমি পাগল হয়েছ?

আমি দু হাত দিয়ে তন্ময়ের মখখানা জড়িয়ে ধরে বললাম, না, না, আমি পাগল হইনি। তুমি বল আর কাউকে আমার মতো ভালো লাগে কিনা।

এমন করে ভালো লাগার মতো মেয়ে কী আর কেউ আছে?

আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। ঠাস করে ওর গালে একটা একটা চড় মেরে বললাম, শিখাকেও আমার মতো ভালো লাগে না?

আমার কথা শুনেই তন্ময় মুহূর্তের মধ্যে বোবা হয়ে গেল। পাথরের মতো স্থির হয়ে রইল। আমি জোর করে ওকে চেপে ধরে বললাম, আমাকে তোমার বিয়ে করতেই হবে। হিয়ার অ্যান্ড নাউ। বিয়ে না করলে আমি তোমাকে এখান থেকে যেতে দিচ্ছি না।

জানো রিপোর্টার, তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না। আরো অনেক কথা ওকে বলেছিলাম কিন্তু সব কথা আজ আর মনে পড়ছে না। শুধু মনে আছে বেশ কিছুক্ষণ বকাবকি করার পর ও বলেছিল, আমাকে বিয়ে করে তোমার লাভ নেই।

লাভ-লোকসানের কথা বাদ দাও। আমাকে তোমার বিয়ে করতেই হবে।

তন্ময় মুখ নীচু করে বলল, আমাকে বিয়ে করলে তো তুমি কোনদিনই সন্তানের মা হতে পারবে না।

আমি উন্মাদের মতো চিৎকার করে বললাম, তাই বুঝি কলকাতায় বিয়ে করা বৌ রেখে এসে লন্ডনে শিখাকে নিয়ে ফুর্তি করতে?…শিখাকে মাতাল করে তার নেকেড ছবি তুলেছ কেন? ওকে ব্ল্যাক মেলিং করবে?

তন্ময় চুপ।

আমাকে উলঙ্গ করে আমার ছবি তুলবে না? কাম অন! হ্যাভ মাই নেকেড ফটোগ্রাফ!

তন্ময় তখনো চুপ।

আমি এক লাথি মেরে হুইস্কির বোতলটা ফেলে দিয়ে বললাম, এনাফ ইজ এনাফ! নাউ গেট আউট মাই বয়। বেরিয়ে যাও; এখুনি বেরিয়ে যাও।

সত্যি বলছি ভাই, সেদিন তন্ময়কে তাড়িয়ে দেবার পর আর কোনোদিন ওর কথা আমি মনেও করিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *