1 of 2

১৭. ট্যাকসি দাঁড় করিয়ে

ট্যাকসি দাঁড় করিয়ে যা ছিল সম্পদ তা তুলে দিয়েছিল আনন্দ। আপাতত সব থাকবে জয়িতাদের বাড়িতে। কল্যাণ চলে যাবে টুকিটাকি জিনিসপত্র আনতে। সুদীপ নিজের একটা ব্যক্তিগত কাজ সেরে ফিরে আসবে জয়িতার ফ্ল্যাটে আটটা থেকে সাড়ে আটটায়। একটা গাড়ি দরকার। এবং এই দায়িত্বটা নিয়েছে সুদীপ। হেঁকে বলেছিল, কলকাতা শহরে এত গাড়ি আর আমি একটা পাব না!

নিজের বাড়ি সম্পর্কে জয়িতা হঠাৎ যেন বেশিমাত্রায় স্থির হয়ে গেছে। ও যা ইচ্ছে করতে পারে ওখানে, কেউ কিছু বলবে না—এই ধরনের আত্মবিশ্বাস জন্মে গেছে ওর। একথা ঠিক, সুদীপের সঙ্গে অবনী তালুকদারের যে সম্পর্ক ওর সঙ্গে রামানন্দ রায়ের তা নয়। বড়লোক মানেই সামান্য হৃদয়বোধ থাকবে না একথা পাগলরাই ভাবতে পারে। বরং উঠতি বড়লোকদের মনে এক ধরনের দুর্বলতা সব সময় তিরতির করে কাঁপে। জয়িতা সেই সুযোগটা ব্যবহার করতে চাইছে। করুক।

 

চুপচাপ বিছানায় শুয়েছিল আনন্দ। এখন তার রুমমেট সুরজিৎ নেই। একমাত্র রাতের অন্ধকার বাড়লে ওর সঙ্গে দেখা হয়। কোথায় যায় কি করে তা বলতে চায় না। আনন্দও জিজ্ঞাসা করেনি। একই ঘরে পাশাপাশি বাস করেও দুজনের মধ্যে কোন মোগাযোগ হল না। এই ঘরে হয়তো আজই শেষবার শেষদিন। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ পড়ে রইল সে। ঘুম আসছে না। যে কাজ করবে বলে তারা নেমেছে সেটা ঠিক পথ নয়; কেউ কেউ বলবেন। প্যারাডাইসে যে মানুষগুলো মরল তাদের সবাই শয়তান নন। হয়তো দুএকজন নিরীহ মানুষ শুধু লোভের তাড়নায় ফুর্তি করতে গিয়ে বলি হল। কিন্তু প্যারাডাইসের মালিক? সেই শোষক লোকটার বেঁচে থাকার কোন অধিকার ছিল না। এই হত্যা কখনই ব্যক্তিহত্যা নয়। একটা চক্রকে ধ্বংস করা মানে ব্যক্তিআক্রোশ নয়। প্যারাডাইসকে যদি চলতে দেওয়া হত তাহলে প্রাথমিকভাবে দেশ কিংবা মানুষের খুব বড় ক্ষতি কিছু হত বলে মনে না হতে পারে, কিন্তু এখন সেইসব লোভী মানুষেরা ভয় পাবে, তার গ্রামের গরীব মানুষগুলো আর অন্ধকারে থেকে সেই নকল আলোকে ঈর্ষা করবে না। আইন কোনকালেই ওখানে হাত বাড়াত না। কারণ আইনকে ঠেকিয়ে রাখার মত সবকটা মুখোশ পরা ছিল। তাদের চারজনের পেছনে যেহেতু কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থন নেই, কোন বড় সংগঠন কাজ করছে না তাই তারা যা করবে তাই গুপ্তঘাতকের কাজ হবে? না, সে একথা মনে করে না। কারণ যে সুদীপ জীবনে কাউকে আঘাত করেনি সে ওই হত্যাকাণ্ডের পর একটুও গ্লানি বোধ করছে না, তারা সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছে। গুপ্তঘাতক এই তৃপ্তি কখনও পায় না। সুরথদার কথা মনে পড়ছিল। বেশ কিছুদিন আগে সে সুবথদার সঙ্গে তার কল্পিত পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছিল। সুরথদা বলেছিলেন, তোমাকে এমনভাবে ব্রেইনওয়াশড করল কে? এ তো স্যাডিস্ট টেরোরিজম ছাড়া কিছু নয়।

স্যাডিস্ট টেরোরিস্ট? নিজেকে তাই ভাবতে গিয়ে হেসে ফেলল আনন্দ। সুরথদারা কতগুলো নির্দিষ্ট থিয়োরিতে বিশ্বাস করেন। এই এই পথে এগোলে দেশে বিপ্লব হবে, এই সব করলে সঠিক রাজনীতির পথে চলা হবে, ব্যতিক্রম মানেই বিভ্রান্তি। যেন বই-এ লেখা অক্ষরগুলো যা তারা মগজে রেখেছেন তার বাইরে গেলেই রাজনীতির বাঁধানো সড়ক থেকে সরে যাওয়া। কোন বিকার তাকে আচ্ছন্ন করেনি। সুরথদারা যাই বলুক না কেন, ভারতবর্ষের মানুষকে কখনই কোন রাজনৈতিক দল বিপ্লবের পথে নিয়ে যেতে পারবে না। সে নিজে কিংবা তার বন্ধুরাও ব্যক্তিগত খুনে বিশ্বাসী নয়। বিত্তবান মানুষ মানেই শেয়াল-হায়না তা পাগল ছাড়া কেউ ভাবে না। কিন্তু একটা প্যারাডাইস দাহন হাজারটা মানুষকে চিন্তিত করবে এবং যে মানুষটি এই দেশে বিষাক্ত-উত্তেজনা আমদানী করছিল তাকে হত্যা করা মানে নিরীহ মানুষকে খতম করা নয়।

দরজা ভেজানো ছিল। সামান্য নক সেখানে এবং তারপরেই সুরজিৎ ঢুকল। এই সময়ে আনন্দকে শুয়ে থাকতে দেখে সে বেশ অবাক হল। জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার, শরীর খারাপ নাকি? দারোয়ান বলল তোমাকে নাকি এক ভদ্রমহিলা দুবার খুঁজে গেছেন।

ভদ্রমহিলা? আমাকে?

সুরজিৎ তার খাটের ওপর দুটো চকচকে মলাটের ইংরেজি বই আর একটা বাংলা উপন্যাস ছুঁড়ে দিয়ে বলল, উত্তেজিত হওয়ার কোন কারণ নেই। দারোয়ানকে মহিলার বয়স জিজ্ঞাসা করার পর আর কৌতূহলী হবার কোন কারণ পাইনি।

আনন্দ উঠে বসল। সে যখন হোস্টেলে ঢুকেছিল তখন দারোয়ানকে দ্যাখেনি। সুরজিৎকে জিজ্ঞাসা করল, ভদ্রমহিলা কিছু বলে গেছেন?

উঁহু। দারোয়ান বলল উনি বলে গেছেন আবার আসবেন। সুরজিৎ সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে বসল, আমার বোধ হয় ইন্ডিয়ার পাট চুকল।

ইন্ডিয়া! আনন্দ একটু হোঁচট খেল। কোন বাঙালির মুখে ইন্ডিয়া শব্দটা অস্বস্তি আনে।

হ্যাঁ, আমার কাকা যিনি শিকাগোয় থাকেন এবার আমাকে নিয়ে যাবেনই। এতদিন খাবার আপত্তি ছিল, আমি তো এই দেশ ছাড়ার জন্যে পা বাড়িয়েই ছিলাম, এখন সব সেটল্‌ড।

আনন্দ চুপ করে থাকল। সুরজিং যখনই কথা বলে তখনই কোন বৃহৎ ব্যাপার ছাড়া ভাবতে পারে। জ্ঞান হবার পর থেকেই, সম্ভবত দার্জিলিং-এর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকেই ও দেশটাকে ইন্ডিয়া ভাবতে শুরু করেছে। এবং কবে স্বপ্নের দেশে পৌঁছাবে এই আশায় বসে আছে। আনন্দ ঠাট্টা করে জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ বাংলা বই আনলে যে!

আমার এক বান্ধবী উপন্যাসটা গছিয়ে দিল। তুমি তো জান আমি থ্রিলার ছাড়া কিছু পড়তে পারি। বাংলা যা লেখা হয় তা শালা দুপাতা পড়া যায় না। হয় প্যানপেনে সাংসারিক গল্প, জোলো প্রেমকাহিনী কিংবা যত ইডিয়টিক ভাবনা। এই উপন্যাসটা নাকি পলিটিক্স নিয়ে লেখা। বিক্রি বাড়াবার কোন ধান্দা বোধ হয়। দেখি পড়ে।

আনন্দ হাত বাড়িয়ে উপন্যাসটা নিল। ইদানীং বইটার নাম খুব শোনা যাচ্ছে। লেখকও নতুন। কিন্তু একটি উপন্যাসে ভদ্রলোক জনপ্রিয় হয়ে গেছেন। কয়েক পাতা ওলটাল সে। তারপরেই সে চমকে উঠল। এই উপন্যাসের নায়ক বাঙালি যুবক, থাকে মধ্যপ্রাচ্যে। আরাফতের গেরিলাবাহিনীর একজন সদস্য। উপন্যাসটা খাটে রেখে দেওয়ামাত্র দারোয়ান দরজায় এসে দাঁড়াল, ওহো, আপনি আছেন! আপনাকে একজন মহিলা ডাকতে এসেছে। এর আগে দুবার এসেছিল।

আনন্দ চট করে পাঞ্জাবিটা চাপিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এল।

গেটের সামনেই ভিজিটার্সদের বসবার ঘর। আনন্দ সেখানে পৌঁছে দেখল কেউ নেই। দারোয়ান মাত্র ছমাস এখানে কাজ করছে, সে একটু বিভ্রান্ত হয়ে বলল, উনি তো এখানেই ছিলেন।

আনন্দ গেটের দিকে এগিয়ে যেতেই মাকে দেখতে পেল। হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে মা দাঁড়িয়ে আছেন। ও তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল কি ব্যাপার?

মাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। গ্রামে যাওয়ার পর থেকেই চেহারা ভেঙেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছিল খুব শুকনো। আনন্দর চেহারাটা দেখলেন তিনি। তারপর খুব শান্ত গলায় বললেন, তোর সঙ্গে আমার কিছু দরকারি কথা আছে।

একটু অস্বস্তি, সেটাকে কাটিয়ে আনন্দ বলল, ভিজিটার্স রুমে বসবে চল।

না, এখানে নয়। তোর কাছে কেউ আসেনি?

না। বোধ হয় তুমি এর আগে দুবার এসেছিলে!

বাইরে কোথাও বসা যায় না?

আনন্দ ফাঁপরে পড়ল। নিশ্চিন্তে কথা বলার জায়গা হল কফি হাউস। কিন্তু মাকে নিয়ে সেখানে বসা যাবে না। ওই চিৎকার সহ্য হবে না ওর। সে বলল, চল, বসন্ত কেবিনে গিয়ে বসি।

মা চুপচাপ ওকে অনুসরণ করলেন। আনন্দর খুব ইচ্ছে করছিল ব্যাপারটা জানতে। নিশ্চয়ই কোন গুরুতর ঘটনা ঘটেছে। এই হোস্টেলে অনেকদিন আগে মা একবার এসেছিলেন। প্রয়োজন হলে চিঠিতে জানান। তাছাড়া আজ মানুষটাকে একদম অন্যরকম দেখাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্নটা করার সাহস পেল না সে। যুনিভার্সিটির সামনে দিয়ে ওরা এগিয়ে এসে রেস্টুরেন্টের দোতলায় উঠে এল।

এখন এখানে প্রেমিক-প্রেমিকাদের ভিড়। দরজার সামনাসামনি একটা টেবিল খালি পেয়ে গেল ওরা। প্রকাশ্যে হয়তো ওরা বসতে চায়নি। একটু স্থির হয়ে আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কি খাবে তুমি?

মা মাথা নাড়লেন, কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। চা ব। তারপর একটু থেমে প্রশ্ন করলেন, তুই দুপুরে ভাত খেয়েছিস?

আনন্দ দ্রুত ঘাড় নাড়ল, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে সারাদিন কিছু খাওনি!

তাতে কিছু এসে যায় না। বেয়ারা এসে দাঁড়িয়েছিল। আনন্দ তাকে দুটো চা আর টোস্ট আনতে বলল।

ঠিক সেই সময় কোণার টেবিল থেকে একটি মেয়ে উঠে এল, আনন্দ, সুদীপের খবর কী বল তো?

চট করে নামটা মনে করতে পারল না আনন্দ। কিন্তু একে কলেজে দেখেছে। ভাল আছে।

ও কলেজে আসছে না কেন? আমি ওর বাড়িতে ফোন করেছিলাম, সেখানেও নাকি থাকে না। তোমার সঙ্গে দেখা হয়? মেয়েটি একবার আনন্দ আর একবার মায়ের দিকে তাকাল।

আনন্দ মাথা নাড়ল, দেখা হয়। ও বোধ হয় আর কলেজ করবে না।

সে কি? কেন?

সেটা ওর বলা উচিত।

তোমরা চারজনেই কলেজ থেকে ড়ুব মারলে কেন?

এটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।

তাই? সুদীপকে বলো দীপা কারো অবহেলা সহ্য করে না। মেয়েটি যেভাবে উঠে এসেছিল সেইভাবে ফিরে গেল কোণায়।

কিছুক্ষণ চুপচাপ রইল আনন্দ। মেয়েটি এমন ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল যেন নিজেকেই সুদীপ বলে মনে হচ্ছে এখন।

এই সময় মা জিজ্ঞাসা করলেন, তোরা কেমন আছিস?

আনন্দ মুখ তুলল, ভাল।

তুই কতদিন ওই হোস্টেলে থাকবি?

জানি না। তবে সামনের মাস থেকে তোমাকে টাকা পাঠাতে হবে না।

তোর আর ওই হোস্টেলে থাকা উচিত নয়।

কেন? কিছু হয়েছে?

হ্যাঁ, পুলিশ এসেছিল আজ সকালে। লোকাল থানা থেকে নয়, কলকাতা থেকে গিয়েছিল। গ্রামের সমস্ত মানুষকে জেরা করেছে। মুদির দোকানে বিপ্রদাসবাবুর সঙ্গে তোর দেখা হয়েছিল?

আনন্দর মনে পড়ল। তারা যখন গ্রামে ঢুকছিল তখন মুদির দোকানটার সামনে দিয়ে অন্ধকারে যাওয়ার সময় বিপ্রদাসবাবু প্রশ্ন করেছিলেন, কে? সে পরিচয় দিয়েছিল। কলকাতা থেকে বন্ধুরা সঙ্গে এসেছে এটাও জানিয়েছিল। সে উদ্বিগ্ন হয়ে উত্তর দিল, হ্যাঁ, কিন্তু উনি কাউকে দ্যাখেননি?

সেই কথা উনি পুলিশকে বলেছেন। সেন বাড়ির ছেলে আনন্দ কলকাতা থেকে বন্ধুদের নিয়ে রাত্রে গ্রামে এসেছিল, খবরটা পেয়ে পুলিশ বাড়িতে আসে।

এই সময় চা আর টোস্ট দিয়ে গেল বেয়ারাটা। সেদিকে না তাকিয়ে আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, তারপর?

মা বললেন, আমি দেখলাম অস্বীকার করে কোন লাভ হবে না। তাই বলেছি তুই দুই বন্ধুকে নিয়ে এসেছিলি বেড়াতে। রাতটা কাটিয়ে বকখালি যাবি বলে গিয়েছিস।

ওরা বিশ্বাস করেছে?

সেটা বুঝতে দেয়নি। তোর সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করল। কোথায় থাকিস, কি পড়িস, রাজনীতি করিস কিনা এই সব। যাওয়ার সময় জিজ্ঞাসা করেছিল, তোর কোন বান্ধবীকে আমি চিনি কিনা।

তুমি জয়িতার কথা বলনি?

না। গ্রামের সবাই জানে তিনজন ছেলে আর একজন মেয়ে ডাকাতিটা করেছে। জয়িতা সেদিন গিয়েছিল বললে আর কিছুই বলার বাকি থাকত না।

ডাকাতি?

সাধারণ মানুষের তাই ধারণা।

আনন্দ ভেতরে ভেতরে খুব অস্থির হয়ে উঠল। এতক্ষণ কি নিশ্চিন্ত হয়ে সে হোস্টেলে শুয়েছিল! আজ সকালে যদি ওরা সার্চ করত তাহলে কালকের কাগজে পুলিশের কৃতিত্বের কথা হেডলাইন হত। কি কুক্ষণে বিপ্রদাসবাবুর নজরে পড়েছিল ওরা! আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কাজের মেয়েটাকে পুলিশ জেরা করেনি? ও তো জয়িতাকে দেখেছিল!

মা জবাব দিলেন, ওর বাবার অসুখ বলে সকালে তাকে দেখতে গিয়েছিল। পুলিশ ওকে পায়নি। কিন্তু গ্রামের কেউ একজন সুদীপ আর কল্যাণকে অন্ধকারে বড় রাস্তার দিকে যেতে দেখেছিল। ওদের কেউ চিনতে পারেনি, কিন্তু পুলিশ আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল তোরা রাত্রে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলি কিনা। ওরা সন্দেহ করছে।

তুমি কি উত্তর দিয়েছ? আনন্দ জিজ্ঞাসা করল।

কি উত্তর আমার পক্ষে দেওয়া স্বাভাবিক? মা চোখ তুলে তাকাতে আনন্দ আর কিছু বলল না। চুপচাপ চা আর টোস্ট খাচ্ছিল ওরা। তারপর মা বললেন, তোরা এবার কি করবি ঠিক করেছিস?

আমরা আর থেমে থাকব না।

আনন্দ, আমি তোকে না বলব না কিছুতেই, কিন্তু বলব বোকামি করিস না।

বোকামি কাকে বলে তাই নিয়ে তর্ক হবে মা।

আমি সেই তর্কে যেতে চাই না। তোরা চারজন অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে যা করতে চাইছিস তার পেছনে কোন দলের সমর্থন নেই। অর্গানাইজড় হয়েও যেখানে একটা দেশের শক্তির সঙ্গে সব সময় লড়াই করা যায় না সেখানে তোদের অবস্থা কি হবে বুঝতে পারছিস না?

আমি জানি। তোমার সঙ্গে এই নিয়ে অনেক কথা বলেছি মা। আজ যদি ভারতবর্ষের এক নম্বর বুর্জোয়াকে কেউ খুন করে বলে দেশের শত্রুকে খতম করলাম তাহলে হয়তো আইন তাকে ফাঁসি দেবে কিন্তু দুই তিন চার নম্বর বুর্জোয়ারা সামান্য হলেও থমকে যাবে। এবং সাধারণ মানুষ–।

আনন্দকে থামিয়ে দিলেন মা। ওঁর ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল, তোর সঙ্গে তর্ক করতে চাই না। এই জীবনে আমি আমার জন্যে কিছুই চাইনি। তোর বাবা হঠাৎ চলে গেলেন, তোকেও আমি ধরে রাখছি না। শুধু বলব যা করবি ভেবে করিস। মা একটু নিঃশ্বাস নিলেন। এখানে খানিকক্ষণ বসে, চা খেয়ে তাকে একটু শান্ত দেখাচ্ছিল। তারপর বললেন, পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্যে তোরা যদি কারও বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় চাস তাহলে কেউ তা দেবে, যখন শুনবে তোরা মানুষ খুন করে এসেছিস? অতি কুখ্যাত খুনী যখন নিজে খুন হয়ে যায় তখন মানুষ তার প্রতি সহানুভূতি দেখায়। মৃতরা চিরকালই নিরীহ।

আনন্দ বলল, না মা, আমরা ভুল করছি না। আমরা কেউ বেঁচে থাকব না জানি। কিন্তু ধরো, আজ রাত্রে আমরা বড়বাজারের একটা জাল ওষুধ কারখানা ধ্বংস করব ঠিক করেছি, তুমি বলবে খবরটা পুলিশকে দিলে তারা ওটা বন্ধ করে দিত। হয়তো দিত। কেউ অ্যারেস্টেড হত কেউ হত না। তিন মাস কেস লড়ে তারা ঠিক বেরিয়ে আসত। এ দেশের আইন সব সময় চারপাশে ফাঁক রেখে দেয়। তারপর সেই লোকগুলো আবার আর একটা জায়গায় ওই ব্যবসা শুরু করত। আমাদের হোস্টেলের ছেলেটার মত হাজার হাজার প্রাণ চলে যাওয়ার বদলে ওদের শেষ করাটা আমি পবিত্র কাজ বলে মনে করি। তুমি আমার জন্যে চিন্তা করো না। আমাকে কিভাবে তৈরি করবে কখনও বলনি তুমি, কিন্তু আমরা আমাদের মত করে আগামীকালের জন্যে আজকের দিনটাকে উৎসর্গ করতে চাই।

বেয়ারা এসে প্লেটে মৌরি আর বিল দিয়ে গেল। মা বললেন, তুই এখনই ওই হোস্টেল ছেড়ে দে। তোর ধরা পড়া মানে তোর বন্ধুদের বিপদ। কিছু করার আগেই নিজে শেষ হয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না। তোর বাবার মারা যাওয়ার পর থেকেই আমি তোর কাছে কিছু চাইব না বলে ঠিক করেছিলাম, আজও সেটা পাল্টাবার কোন কারণ নেই। যা ভাল মনে করছিস তাই কর, সেটা যদি তোকে শান্তি দেয় দেবে।

তুমি আমাকে বাধা দিচ্ছ না কেন? আচমকা আনন্দ প্রশ্নটা করে বসল।

মা হাসলেন, কি লাভ? তুই যদি একটা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা অধ্যাপক হতিস তাহলে তো এই দেশে আর একটি সুবিধেবাদী মানুষের সংখ্যা বাড়ত, এই তো?

আনন্দ অবাক হয়ে গেল। মা ঠিক এইভাবে কথা বলবেন সে কখনও ভাবেনি। তার মনে হল পুলিশ যদি জানতে পারে তাহলে ওরা মাকেও ছাড়বে না।

তোকে যে কথাটা বলার জন্যে এসেছি সেটা এবার বলি। মা সোজা হয়ে বসেছিলেন, এবার সামান্য এগিয়ে এলেন। আনন্দ বুঝতে পারল না, পুলিশ তাকে যে কোন মুহূর্তে ধরতে পারে এ ছাড়া আর কি জরুরী কথা থাকতে পারে।

একটু ইতস্তত করলেন মা, তারপর খুব শান্ত গলায় বললেন, তুই এক সময় আমাকে প্রায়ই প্রশ্ন করতিস কেন তোর বাবা ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করতে গেলেন? কি দুঃখ ছিল ওঁর?

আনন্দ হঠাৎ থমকে গেল। এই মুহূর্তে মা যে ওই প্রসঙ্গ তুলবেন তা কল্পনাতেও ছিল না। সে বলল, আজ হঠাৎ ওসব কথা তুলছ কেন?

আজ বলা দরকার। তোর সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে জানি না। তোরও জানা উচিত। তোর বাবা আত্মহত্যা করার আগে জামশেদপুরের হোটেল থেকে আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে চেয়েছিল। লাইন পায়নি। তারপর সে একটা চিঠি লেখে। লিখে নিচে নেমে নিজের হাতে পোস্ট করে। ওই চিঠিটা আমি পাই কলকাতা ফিরে গিয়ে। চিঠিটার কথা কেউ জানে না। আমিও তোকে বলিনি। শুনেছি আত্মহত্যা করার সময় নাকি মানুষের এক ধরনের অ্যাবনর্মালিটি গ্রো করে। চিঠিটা পোস্ট করে যে আত্মহত্যা করেছে তার একটা লাইনেও কিন্তু অ্যাবনর্মালিটি নেই। মা ব্যাগ খুললেন। প্লাস্টিকের ব্যাগের ভেতরে আর একটা ছোট ব্যাগ। সেই ব্যাগের চেন খুলে তিনি একটা খাম বের করলেন। এখনও তার রঙ নতুনের মত, মা সেটা এগিয়ে দিলেন, এটা আমার কাছে রেখে দিয়েছিলাম এতকাল। আর রাখার দরকার নেই। তোর যা ইচ্ছে তাই করিস। এবার আমি চলি।

ব্যাগ হাতে নিয়ে মা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। খামটা হাতে নিয়ে আনন্দ বলতে পারল, চলে যাবে?

হেসে ফেললেন মা, বাঃ, আমি এই রেস্টুরেন্টে সারাজীবন থাকব নাকি?

ধক্ করে বুকের মধ্যে লাগল আনন্দর। ওর সমস্ত শরীরে একটা কাঁপুনি শুরু হল। সেটা লক্ষ্য করে মা বললেন, পাগলামি করিস না। আমাকে গ্রামে ফিরতেই হবে। মেয়েদের পরীক্ষা নিচ্ছি। দুজন পড়তে আসবে। বেশি রাত হলে অসুবিধে হবে।

দাম মিটিয়ে দিল আনন্দ। পাশাপাশি চুপচাপ নিচে নেমে মা জিজ্ঞাসা করলেন, এইখানে ধর্মতলার বাস দাঁড়ায় না?

নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল আনন্দ। জিজ্ঞাসা করলেন, তোর টাকাপয়সার নিশ্চয়ই দরকার, তাই না?

আনন্দ মাথা নাড়ল, না, টাকাপয়সা আছে।

বাস এসে পড়েছিল। হাত দেখিয়ে সেটাকে থামিয়ে মা বললেন, সাবধানে থাকিস। কোন দরকার হলে জানাস। তারপর ধীরে ধীরে উঠে গেলেন বাসের দরজায়।

অনেক কষ্টে চোখের জল সামলাল আনন্দ। এখন রোদ নেই। ছায়া ঘন হয়নি। বুকের ভেতরটা তোলপাড় করছে। ধীরে ধীরে সে হেঁটে যাচ্ছিল য়ুনিভার্সিটির উল্টো ফুট দিয়ে। আজ ওখানে মাইকে বক্তৃতা হচ্ছে না, জমায়েতও নেই। খামটার দিকে তাকাল সে। ঘরে এখন সুরজিৎ রয়েছে। ও ডানদিকে বাঁক নিল। কলেজ স্কোয়ারের মধ্যে ঢুকে জায়গা খুঁজতে লাগল। সবকটা চেয়ার হয় ভাভা, নয় কারও দখলে। শেষ পর্যন্ত একা ঘাসের ওপর বসে পড়ল আনন্দ। কাছাকাছি কেউ নেই কিন্তু চারপাশে বেশ উৎসবের আঁচ লেগেছে যেন। এই যে মানুষগুলো, এরা অন্তত এই মুহূর্তে দুঃখী নয়। কোন রাজনীতি এদের মাথায় ঢুকবে না। আত্মসুখী মানুষগুলোর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সে খামের ওপর রাখল। মায়ের নাম-ঠিকানা স্পষ্ট হাতে লেখা। মায়ের নামটায় দুবার কালি বুলিয়ে মোটা করা হয়েছে। ওপরে দুটো ডাকঘরের ছাপ। এতদিনেও তত বেশ বোঝা যাচ্ছে। জামশেদপুরের ছাপটা পড়েছিল বাবার মৃত্যুর পরের দিন। খামের কাগজটা নরম হয়ে এসেছে। বোঝা যায় খুব যত্ন করে রাখা। হয়তো এই কবছরে একদম হাত পড়েনি। সন্তর্পণে ভেতরের কাগজ দুটো বের করল সে। বাবার প্যাডের কাগজ। ওপরে তারিখ, আত্মহত্যা যে রাতে করেন সেই রাত্রের এগারোটা তিরিশ মিনিট। বাবার হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিল। কালো কালিতে লেখা চিঠি এখনও ঝকঝক করছে। বাবা মাকে অনু বলে ডাকতেন। এই চিঠিতে কোন সম্বোধন নেই। অনু লিখে বাবা শব্দটার চারপাশে কালির বৃত্ত এঁকেছেন। কেন? চিঠিটা পড়া শুরু করল আনন্দ। একজন মৃত মানুষের লেখা এত বছর পর পড়ার সময় অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল ওর।

অনু। একটু আগে তোমাকে টেলিফোনে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অপারেটর বলল কলকাতার লাইন এখন খারাপ। আমার বরাতটাই এই রকম, নইলে এই মুহূর্তে তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারব না কেন? এই মুহূর্তটুকু আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান। অতএব বাধ্য হয়ে এই চিঠি।

কাব্য করে বলতে পারতাম এই চিঠি যখন তোমার হাতে পৌঁছাবে তখন আমি আর পৃথিবীতে থাকব না। যদিও ব্যাপারটা সত্যি। ইতিমধ্যে তুমি নিশ্চয়ই খবরটা পেয়ে যাবে। কারণ তোমার ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর এবং একটা ডিক্লারেশন আমার টেবিলে রেখে যাচ্ছি যাতে হোটেল কর্তৃপক্ষ পুলিশকে দিতে পারেন। এ দেশের পুলিশদের তো এইটুকু সাহায্য করা দরকার।

অনু, আমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছি। কারণ এছাড়া আমার কোন উপায় নেই। বেঁচে থাকাটা তাদের কাছেই মূল্যবান যাদের আগামীকালের জন্যে আশা করতে ভাল লাগে। আমাকে ঘিরে এখন নানান সমস্যা। এবং কোনটাই আমি সমাধান করতে পারব না। তাছাড়া আমার বেঁচে থাকাটা অনেক ব্যাপারে জটিলতা সৃষ্টি করছে। সবার ওপরে, বেঁচে থাকলে আগামীকাল আমি সুস্থ থাকতে পারব না। আমাকে সুস্থ থাকতে দেওয়া হবে না। শুধু সেই বেঁচে থাকাটা তোমাদের ওপর চাপ আনবে, তোমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে।

না, আজ কোন কথা তোমার কাছে সুকাব না। অনু, এতগুলো বছর আমরা একসঙ্গে বাস করেছি, বেড়িয়েছি, আনন্দ করেছি, একই বিছানায় রাত কাটিয়েছি কিন্তু তোমার কাছে সব কথা খুলে বলিনি। আমার জীবনের একটা দিক তোমাকে জানাতে চাইনি। প্রথমে ভেবেছিলাম জানলে তুমি আগত্তি করবে, পরে মনে হয়েছিল, এতদিন জানাইনি বলে তুমি অপমানিত হবে। তুমি যদি খুব সাধারণ মনের মেয়ে হতে তাহলে এসব ভাবতাম না। তোমাদের মত গভীর মনের মেয়েদের নিয়েই যত মুশকিল। অত কাছে এসেও কিসের যেন ফারাক তৈরি করে রাখ।

তুমি জানতে না, আমি নকশালপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাস করতাম। আমি ভোট দিতে যেতাম না, কারণ হিসেবে তুমি ভাবতে আলস্য। আমি যে চাকরি করি তাতে দুহাতে ঘুষ নেওয়া যায়, অনেক উপরে স্বচ্ছন্দে বাস করা যায়। আমার গাড়ি ছিল, ভাল ফ্ল্যাট ছিল, সুন্দরী স্ত্রী ছিল। অতএব বিশ্বাসটা যদি বিশ্বাসেই সীমাবদ্ধ রাখতে পারতাম তাহলে আরও অনেক বুদ্ধিজীবী নকশালপন্থীর মত দেশলাইবাক্সের জীবনযাপন করতে পারতাম। এই করে কেউ কেউ তো তলার কুড়োচ্ছে আবার গাছেরও খাচ্ছে। আমি পারিনি। সেই আন্দোলনের সময় থেকে যতটা সম্ভব আড়াল রেখে আমি একটার পর একটা কাজ করে গেছি। ঘুষ না নেওয়ায় এখনও সত্তর হাজার টাকার ঋণ আমার কাধে, যা আসলে পার্টির প্রয়োজনে দিতে হয়েছিল। তুমি কিছু জানতে না, শুধু জানতে অফিসের কাজে আমাকে প্রায়ই টুরে যেতে হয়।

না, নকশালপন্থী রাজনীতি নিয়ে আমি কিছু বলতে বসিনি। বীরভূমের সিউড়িতে পুলিশ অফিসার রবীন্দ্রনাথ দত্তকে খুন করা নিয়ে খুব হইচই হয়েছিল, একথা কি তোমার মনে আছে? পার্টির জরুরী মিটিং ছিল। রবীন্দ্রনাথবাবু কলকাতা থেকে ছদ্মবেশে গিয়েছিলেন ওখানে। যে রাত্রে মিটিং সে রাত্রে রবীন্দ্রনাথবাবু জাল গুটিয়ে এনেছিলেন। দশ মিনিট দেরি হলে সবাই ধরা পড়ত। ভদ্রলোক সন্দেহ করেননি আমি একই উদ্দেশ্যে গিয়েছি। উনি জেনেছিলেন আমি বড় কোম্পানির কাজে ওই শহরে গিয়েছি। থানায় যাওয়ার আগে আমি ওঁকে খুন করেছিলাম। সাফল্যের সম্ভাবনায় ডগমগ লোকটাকে সরিয়ে দিয়ে আমার কমরেডদের বাঁচিয়েছিলাম আমি। পরদিন সবাই এটাকে উগ্রপন্থীদের কাজ বলে মনে করেছিল। আমার ওপর কোন সন্দেহ পড়েনি কারো। কলকাতায় ফিরে গিয়ে কয়েক রাত ঘুমুতে পারিনি আমি। কিন্তু ধীরে ধীরে সবই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। পার্টি ভাঙল, আন্দোলন মুখথুবড়ে পড়ল, কিন্তু আমার ওপর আর একটা চাপ শুরু হল। চাপটা আমার প্রাক্তন দলের একজনের কাছ থেকে। সে এখন ফেরার। সে জানে আমি খুন করেছি। আর সেই কারণে আমার ওপর নিয়ত চাপ। প্রত্যেক মাসে টাকা দিয়ে যেতে হয়েছে। ব্যাপারটা এখানেই থেমে থাকলে কিছু বলার ছিল না। এইবার সুপ্রভার কথা বলছি। সুপ্রভা এই ফেরারী মানুষটার স্ত্রী। একসঙ্গে দলে ছিলাম আমরা—সেই সময় ওদের প্রণয়, বিবাহ। সুপ্রভা অত্যন্ত সিরিয়াস টাইপের মেয়ে। কলকাতার একটা কলেজে পড়ায়, পাইকপাড়ার হাউসিং স্টেটে থাকে। টালা পার্ক থেকে দত্তপুকুরের দিকে যেতেই প্রথমে বাঁ দিকের হাউসিং স্টেট। স্বামীর আচরণ, পার্টিবিরোধী কাজকর্মের জন্যে সে পৃথক হয়েছিল। ডিভোর্স হয়নি ওদের। সুপ্রভার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল। শুধু এটুকু হলে ক্ষতি ছিল না। অনু তুমি কষ্ট পাবে, কিন্তু এখন আমার না বলে উপায় নেই। হ্যাঁ, ধীরে ধীরে আমি সুপ্রভার সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। এক্ষেত্রে আমার কিছু করার ছিল না। সুপ্রভার সঙ্গে জড়ানোর ব্যাপারে আমার কোন আফসোস নেই। সে কখনও আমাকে বিরক্ত করেনি। কখনও চায়নি আমাদের বিব্রত করতে। কিন্তু চেয়েছিল আমি যেন গোপন-রাজনীতি না ছাড়ি। এখনও সে সক্রিয়—যারা এখনও স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে ও তাদের দলে। কিন্তু একাত্তরের পরে পার্টির ভাগাভাগি থেকে শুরু করে এত রকমের ছবি আমি দেখেছি যে আর আমার পক্ষে নতুন ভাবনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব ছিল না। এই জীবনে কিছু হবে না। ভারতবর্ষ ভারতবর্ষের মতই থাকবে। আর এখানেই শুরু হল সুপ্রভার সঙ্গে সংঘাত। আর সেটাকেও কাজে লাগাল ওর ফেরারী স্বামী।

আজ একটু আগে সে আমার কাছে কতকগুলো দাবী করেছিল। সেগুলো মেটালে সারাজীবন তোমাদের কাছে হোট হয়ে থাকতাম। সে চাইছে তোমাদের ত্যাগ করে সুপ্রভাকে বিয়ে করতে হবে আমাকে। নিজেকে মৃত ঘোষণা করতে চায় সে। এই বিকৃত আবদারের পেছনে কি কারণ আমি বুঝতে পারছি না। এতে সুপ্রভার সায় আছে কিনা তাও জানি না। দ্বিতীয় দাবী ছিল টাকা। সেটা দেবার সাধ্য এখন আমার নেই। ফলে সে আজ বিহার পুলিশকে আমার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পৌঁছে দিয়েছে। বিহার পুলিশ কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তাদের একজন আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন হোটেল ছেড়ে যেন না যাই। রবীন্দ্রনাথ দত্তকে খুন গ্রার ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য এখন ওদের হাতে। আমি মামলা করতে পারি কিন্তু কি লাভ তাতে? আর এই মুহূর্তে আমি ফেরারী হতে পারি। তাতে কতটা গৌরব বাড়বে? ওরা আমায় ছেড়ে দেবে না, তোমাদের ওপর চাপ আসবে, তাছাড়া একজন খুনী হিসেবে তোমাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারব না।

অদ্ভুত ব্যাপার, এখন নিজেকে খুনী মনে হচ্ছে। অথচ সেই সময়, কমরেডদের বাঁচানোর সময় কখনই সেকথা মনে হয়নি। ওই আন্দোলন ব্যর্থ না হলে হয়তো মনে হত না। এখন আন্দোলনের বিভিন্ন ফাঁকফোকর এত বড় হয়েছে, পরিকল্পনাহীনতায় মুখথুবড়ে পড়া একটি উদ্যমের অনেক ত্রুটি চোখের সামনে। তখনই মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ দত্ত মশাই একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন, তার চাকরিটা তিনি মন দিয়ে করতে চেয়েছিলেন। একটি কর্তব্যপরায়ণ মানুষকে বুর্জোয়া, শ্রেণীশত্রু ইত্যাদি বলা যায় কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে।

আগামীকাল কিংবা আজ রাত্রেই পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করবে ওই মানুষটিকে হত্যা করার অভিযোগে। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবার মত অনেক তথ্য তখন সামনে দগদগ করবে। তারপর আর বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না অনু।

এবার তোমাকে দুটো কথা বলি। সুপ্রভার ব্যাপারটার জন্যে আমায় ক্ষমা করো, যদি সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে মেয়েটার কোন দোষ ছিল না, আজও নেই। আজ এই মুহূর্তে একটা সত্যি কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। অনু তোমাকে আমি ভালবাসি, যেহেতু তুমি আমার কাছে কাছেই ছিলে, ইচ্ছে হলে দেখতে পেতাম, চাইলে বা না চাইলেও কাছে পেতাম, তাই তোমাকে আলাদা করে কিছু ভাবিনি। নিজের ছায়াকে তো মানুষ গুরুত্ব দেয় না। দিনদুপুরে ছায়াহীন মানুষের কষ্ট কি তা এখন বুঝতে পারছি। এখন তোমাকে দেখতে, তোমার সঙ্গে কথা বলতে বড় ইচ্ছে করছে। আবার বলি, সবকিছু করেও আমার শেষ ভালবাসা তোমার জন্যই রইল। আমার ব্যাঙ্ক-আকাউন্টের কিছু টাকা তোমার নামে ট্রান্সফার করেছি আর অফিস থেকে প্রাপ্য টাকার নমিনি তুমি। জানি না তাতে তুমি হাত দেবে কিনা।

শুধু একটা অনুরোধ করব, আনন্দকে ওর নিজের মত বড় হতে দাও। তোমার কোন ইচ্ছে ওর ওপর চাপিও না। ও যা করতে চায় করতে দিও। ও যদি বড় হয়ে ভারতবর্ষের তথাকথিত সুখী নাগরিক হয় তাহলে কিছু বলার দরকার নেই, যদি তা না হয়, যদি ওর মধ্যে ঝড়ের উদ্দামতা দ্যাখো তাহলে সময় এবং সুযোগমত আমার এইসব কথা ওকে খুলে বলল। যদি চাও, এই চিঠি ওকে দ্যাখাতে পারো।

তোমাকে এই চিঠি লেখার এক ফাঁকে ট্যাবলেটগুলো খেয়েছিলাম। শরীর ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। এই সময় যদি তোমাকে দেখতে পেতাম! ক্ষমা চাই, শুধু তোমার কাছে। তোমারই (তুমি চাও বা না-চাও) সুব্রত।

মিনিট দশেক চুপচাপ বসে রইল আনন্দ। এখনও চোখের পাতায় সেই ঘুম স্পষ্ট। অথচ ধীরে ধীরে মুখের রেখাগুলো পালটে যাচ্ছে। বড় হয়ে কোন মেয়ের কাছে জল চাইবে না।

কেন? আনন্দ জল দাও বললেই সেই মেয়েগুলো চণ্ডালিকা হয়ে যাবে।

ছোট্ট শিশুর সঙ্গে কি সরল গলায় রসিকতা করেছিল যে মানুষটি তার ব্যক্তিজীবনের আর একটা ছবি এই রকম। আনন্দর খুব ইচ্ছে করছিল সেই ফেরারী লোকটি এখন কোথায় আছে জানতে! আর এই সুপ্রভা নামের মহিলাটি?

মা কোনদিন ওদের কথা বলেনি। সুপ্রভার সঙ্গে যোগযোগ হয়েছিল কিনা তাও সে জানে না, কিন্তু বাবা নকশাল রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন, ভারতবর্ষে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন এই তথ্য আজ এই মুহূর্তে মা তাকে জানিয়ে গেলেন কেন?

আনন্দ কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে বেরিয়ে এল কলেজ স্কোয়ার থেকে। সে যখন রাস্তা পার হতে যাচ্ছে ঠিক তখনই সুরজিৎ তাকে চিৎকার করে ডাকল। সুরজিৎ সেজেগুঁজে তার আড্ডায় যাচ্ছিল। ওকে দেখে দ্রুত কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার বল তো?

কিসের কি ব্যাপার? আনন্দ চোখ তুলে তাকাল।

তোমার খোঁজে পুলিশ এসেছে হোস্টেলে। লালবাজার থেকে।

কখন?

একটু আগে। আমাকে জিজ্ঞাসা করল। আমি বললাম বেরিয়ে গেছে। ওরা সুপারের সঙ্গে কথা বলে হোস্টেলেই অপেক্ষা করছে।

আনন্দ ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, ধন্যবাদ সুরজিৎ।

তুমি কি কোন ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত?

না। দৃঢ় গলায় বলল আনন্দ, আমি ক্রাইমগুলো ভাঙতে চাই। ঠিক আছে, চলি।

সুরজিৎ বাধা দিল, আনন্দ, আমি কি তোমাকে সাহায্য করতে পারি?

আনন্দ অবাক হল, তুমি! তুমি কি সাহায্য করবে?

আমার ক্ষমতার মধ্যে যা পারি।

তুমি তো জান না আমি কি করেছি!

জানি না, কিন্তু তুমি কোন অন্যায় করেছ এটা বিশ্বাস করি না।

ধন্যবাদ। ঠিক এই মুহূর্তে কোন সাহায্য আমি চাই না। তবে পরে হোস্টেলের বাইরে কোথায় তোমাকে পাওয়া যাবে বলতে পার?

হ্যাঁ। সুরজিৎ হ্যারিংটন স্ট্রিটের একটা ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিল, আমি রোজ বিকেলে ওখানে থাকি। তোমার কথা আমি বলে রাখব।

বেশ। আমার প্যান্ট শার্ট হোস্টেলে আছে। যদি পারো সেগুলো ওখানে নিয়ে যেও। আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি সুরজিৎ।

ঠিক আছে। কিন্তু তুমি আর এখানে দাঁড়িও না। পুলিশ এখানেও থাকতে পারে। তোমার উচিত এখনই কোন ভাল ল-ইয়ারের সঙ্গে দেখা করা।

একটা ডাবল ডেকার আসছিল শ্যামবাজার থেকে। সেদিকে তাকিয়ে আনন্দ বলল, আইনের বই এদেশে যারা লিখেছে তারা আমাদের জন্য কোন লাইন রাখেনি। চলি। প্রায় দৌড়ে বাসটায় উঠে পড়ল আনন্দ। এটাকে কি ভাগ্য বলে, নইলে সুরজিৎ হঠাৎ এই সময় এখানে আসবে কেন? সে যদি সোজা হোস্টেলে ফিরত কিংবা মা যদি না আসতেন, তাহলে? আনন্দ নিজেকে বলল, বড় কেয়ারলেস হয়ে থাকছে সে!

এই সময় পাশের ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু বলছেন ভাই?

আনন্দ মাথা নাড়ল। এবং তখনই তার খেয়াল হল বাঁ হাতে খামটাকে সে ধরে আছে। সযত্নে পকেটে ওটাকে রেখে দিয়ে দুহাতে বাসের রড ধরল আনন্দ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *