জীবনের কথা ছাড়া আর কী-ই বা বলতে পারে সে। সে তো তত্ত্বজ্ঞানী নয়। নয় কোনও ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। নয় লেখক বা গবেষক। সে এমনকী কোনও বুদ্ধিমতী সুনায়রী নয় যে কথা বলে মুগ্ধ করে দেবে। সে জানে একমাত্র জীবন জীবনের অন্ধগলি যা সে মাড়িয়ে এসেছে এতকাল। অবহেলায়। অনিচ্ছায়। ঠিক যেমন বাচ্চারা আনমনে মাড়িয়ে যায় পথের আবর্জনা।
সে আর কী বলবে এই সব ছাড়া। সে কেবল জীবনের স্কুল ও নীরস চাহিদাকে জানে। সে জানে বাঁচতে হয়। কেন হয়, কেন বাঁচতে হয়, এ প্রশ্ন তার মনে কখনও আসেনি। এমনকী না বেঁচে যদি কেউ, যদি আত্মহত্যা করে, তবে তারা ভাবে বোকা। কী বোকা। বাঁচল না!কত কষ্ট করে পাওয়া এ জীবন, এই প্রাণ! বাঁচল না!
বাঁচা। এক পরমতম স্পৃহা। বাঁচা।
এই সরু গলি, পথে পড়ে থাকে আবর্জনা, এখানে মাকড়সার ডিমের মতো জন্মায় শিশু আর সঙ্গম, যৌনতা দেখতে দেখতে বাড়ে, পাকা বটফল খসানোর মতো গর্ভপাত হয় এখানে। এখানে ভাষা বায়সের কণ্ঠের মতো কর্কশ। গা ঘেঁষাঘেঁষি বাড়িগুলিতে শ্বাস নেবার বায়ু অকুলান পড়ে। নিরালোক, ক্ষুদ্র, দমচাপা ঘরে চড়াইও বাসা বাঁধে না। একটি সুন্দর শাড়ির জন্য মিথ্যাচার বা গিল্টি করা গয়নার জন্য কলহ করে, কিংবা বেনারসি শাড়ি কপালে সিঁদুর আয়নার কাছে দাড়িয়ে কেটে যায় যৎসামান্য অবসর। জীবন এখানে যোনিমুখ থেকে শুরু হয়, শেষ হয় পায়ুছিদ্রে।
তবু পৃথিবীকে সুন্দর লাগে সকলের। জীবনকে লাগে অপরূপ। আকর্ষণীয়। এ সুন্দর ভুবন মৃতের উপযোগী নয় বলে মনে করে তারা এবং গঙ্গাস্নান করে কালীমন্দিরে যায়।
সে-ও এইরকমই একজন। জীবনের মানে সে বোঝে এই বেঁচে থাকা। দাঁতে প্রাণ আঁকড়ে পড়ে থাকা। মরে তো গেল না বেঁচে তো গেল। এইটুকুই জয়! আহার, নিদ্রা, মৈথুন ও নিরাপত্তা-সভ্যতার ক্রমোন্নয়ন তার কাছে এই মাত্র বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। এছাড়া, সে আর কী বলবে। সে যখন বক্তৃতা করে, তখনও এইটুকুই বলে? কোনও গবেষক সাক্ষাৎকার নেয় যখন, তখনও বলে এইটুকুই। কোনও লেখকও তার এইটুকুই লেখে। কোনও পরিচালকও তার চলচ্চির্কে এটুকুর বেশি আঁকতে পারে না।
বারবার সে লিখিত হয়। বাধার মুদ্রিত হয়, বারবার প্রদর্শিত। কিন্তু সে যেমন ছিল তেমনই থাকে। আর থাকতে থাকতে তার মনে হয় সে এটুকুই। তার বেশি নয়। এর বেশি তার আর কিছুটি নেই।
আবার, একই কথা বলতে বসে তার একটি পৃথক ভাব হচ্ছে। যেমন আরও অনেক আছে তার, সেইটি যে ঠিক সে ধরতে পারছে না। শুধু এক অস্তির উপলব্ধি তাকে প্রাণিত করছে। পুরনো কথা নতুন প্রেরণায় বলতে থাকছে সে।
আট ভাইবোন। সাত দাদা আর সে। পাড়ার লোকে বলত সাতভাই চম্পা। মাও নাম রেখেছিল চম্পা। চম্পাকলি। খুব আদরের সেই কয়েকটা দিন। সেই তেরো বছর। অভাবের সংসার ছিল। কিন্তু সমস্ত অভাব পুষিয়ে দিত আদর।
সে যখন জন্মায়, তার বড়দাদার বয়স আঠারো। গম্ভীর বড়দাদাকে সে ভালবাসত, ভয়ও পেত খুব। সত্যি বলতে, একমাত্র বড়দাকেই মান্য করত সে। বাকি সময় সে পাখির মতো উড়ন্ত আর স্বাধীন।
বড়দার একটা রেডিও ছিল। ছোট্ট রেডিও। খুব প্রিয় সেই রেডিওতে কারওকে হাত লাগাতে দিত না। তাকেও না। আর ওই নিষেধ ছিল বলেই রেডিওটার প্রতি তার ছিল অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। সে চাইত অবশ্য মাঝেমাঝে। একটু দেখবে হাতে নিয়ে। বড়দা দিত তখন। একমাত্র তাকেই দিত। এমন করে দিত যেন সাতদিনের বাচ্চাকে অচেনা কারও হাতে তুলে দিচ্ছে অনিচ্ছুক মা। আর দিয়েই ফিরিয়ে নিত। কোথাও যাবার সময় রেডিওটা উঁচু আলমারির মাথায় তুলে রাখত।
একদিন বড়দা তুলে রাখতে ভুলে গেল আর সে হাতে পেয়ে গেল রেডিও। এবং তাড়াহুড়ো করে নাড়িয়ে কঁকিয়ে দেখতে গিয়ে হাত থেকে মেঝেয় ফেলে দিল। কথা বলছিল রেডিও। স্তব্ধ হয়ে গেল হঠাৎ,
দারুণ ভয় পেয়ে গেল সে। বড়দাদা এসে দেখতে পেলে রাগে অন্ধ হয়ে যাবে। মেরে ছাল তুলে নেবে তার। হাড় ফাটিয়ে দেবে। সে তখন কারওকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় এবং ঘুরতে ঘুরতে ইস্টিশানে এসে পড়ে। শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে সে রেলগাড়িতে চেপে বসে।
আগে কখনও রেলগাড়িতে চাপেনি সেগতি আর নতুনত্বের প্রাবল্যে অপূর্ব প্রসন্নতায় কুঁদ হয়ে ছিল সারাক্ষণ। ভয় করেনি। কষ্ট পায়নি বাড়ির জন্য। একের পর এক ইস্টিশান পেরুতে লাগল গাড়ি। কোথাও থামল। কোথাও থামল না। এইরকম করতে করতে যেখানে এসে একেবারেই থেমে গেল, সেই বিরাট বড় ইস্টিশানের নাম সে পরে জেনেছিল হাওড়া।
চমকে উঠল ছেলেটি। বাইরে দারুণ চিৎকার। দুটি পুরুষের ক্রুদ্ধ গলা। মেয়েদের সমবেত রব। একজন আরেক জনকে খানকিপুত্র বলে সম্বোধন করল। অন্যজন সঙ্গে সঙ্গে অপর জনের মাতা সম্পর্কে অশ্লীল উক্তি করল। গেল-গেল। ধরধর পড়-পড়। ছেলেটি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল দেখে হেসে ফেলল সে। আশ্বাস দিল, এখানে এরকম প্রায়ই হয়। রোজকার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই সব। পারিশ্রমিক নিয়ে মারামারি। লভ্যাংশ নিয়ে হাতাহাতি। এ ছাড়া আছে পরস্পরের প্রতি সন্দেহ আর অবিশ্বাস। খদ্দেরের সঙ্গেও লেগে যায় কখনও কখনও। অনেকে মাতাল হয়ে হইচই করে।
পুলিশ থাকে কিনা প্রশ্ন করে ছেলেটি। সে উঠে পড়ে। কিছু কাগজপত্র ছেলেটির হাতে দেয়। তথ্য। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি পড়তে দিয়েছে তাকে। এগুলোর ওপর চোখ বোলাতে বলে সে দরজার দিকে যায়। ছোটখাটো ঝামেলা সে-ও মিটিয়ে দিতে পারে। পুলিশ লাগে না। পুলিশ শুধু পাপের মূল্য নিতে আসে।
বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে সে বেরিয়ে যায়। ছেলেটি ইংরাজি ভাষা পড়তে পারবে নিশ্চয়ই। যদিও সে পড়েছে বাংলা তর্জমা।
মারামারি চলছে তখনও। দু’জনকেই সে চেনে। এ পাড়ারই সন্তান। এখন কাস্টমার ধরে আনে। একজন বার করেছে ছোট ছুরি। অন্যজনের সঙ্গে কিছু নেই। তবুও সে পিছু হঠছে না। সে দু’জনের মাঝখানে এসে পড়ে। দুজনকেই দু’হাতে ধরে সমিতির দিকে নিয়ে যায়। সমিতিতে, সারাক্ষণ তাদের দু’জন থাকে, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দুজন, অসুখ-বিসুখ থেকে মারামারি—সব রকমের ঝামেলা সামলায়। তবুও খুন হয়ে যায় মাঝে মাঝে। তবুও গোপন রোগে আত্মহত্যা করে বালুখ বুজে সহ করতে করতে মরে যায় কত মেয়ে।
সমিতির কাজ এখনও সম্পূর্ণ সফল নয়.সে জানে। এ পাড়ায় রাতদিনের তফাত নেই। কিন্তু সমিতি রাত্রিকারোটায় বন্ধ হয়ে যায়, খোলে আবার সকাল এগারোটায়। এর মাঝখানে অনেক কিছু ঘটে। তার রেশ থাকে দিনের পর দিন।
সমিতিকে চালু রাখতে গেলে মেয়েদের সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কিন্তু তারা এড়িয়ে যায়। ভয়ে এড়িয়ে যায়। বাড়িওয়ালিরা ভয় দেখায় তাদের। মৃত্যুভয়। শাস্তিভয়। গুণ্ডা লাগিয়ে জান নিয়ে নেবার ভয়ে, পুলিশের হাতে বন্দি থাকার ভয়ে কাটা হয়ে থাকে সব।
সমিতি থাকলে সবচেয়ে বেশি অসুবিধা পুলিশের। কারণ ঝঞ্জাট হলে মিটিয়ে নেবার ছলনায় তারা অর্থ নিষ্কাশন করতে পারে না। মেয়েরাও একটা নির্ভরযোগ্য জায়গা পেয়ে গেলে ন্যায়-অন্যায়ের বিষয়ে হয়ে উঠতে পারে অনেক বেশি সচেতন। তখন পুলিশের নৈমিত্তিক প্রাপ্তির ঘরে টান পড়ে।
অতএব, পুলিশ চায় না সমিতি থাক। পুলিশকে খুশি করতে গিয়ে বাড়িওয়ালিরা চায় না সমিতি থাক। মেয়েরা সচেতন হলে মুশকিল তাদেরও বাড়ছে বৈ কমছে না। আর মেয়েরা কোনটা ভাল সঠিক বুঝতে না পেরে গতানুগতিক প্রক্রিয়াকেই আঁকড়ে থাকে।
সে দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে সমিতির দিকে যাচ্ছে দেখে কয়েকজন সঙ্গ নিল। কিন্তু সমিতির ঘরে পৌঁছে সে আর দাঁড়াল না। ঘরে ক্লায়েন্ট আছে বলে বেরিয়ে এল তাড়াতাড়ি।
ছেলেটির মুখ মনে পড়ল তার। করুণ। উদাস। আর সুন্দর। ভারী সুন্দর। কিন্তু ওই অদ্ভুত জায়গায় ছেলেটি গিয়েছিল কেন বুঝতে পারছে না সে। পারতপক্ষে তারা ওই পথ দিয়ে সন্ধ্যাবেলা যায় না। অনেকে দুপুরেও ভয় পেয়েছে এখানে। তার নিজের খুব ভয়-ডর নেই। রাস্তা সংক্ষেপ করতে সাহস করে ওই পথ ধরেছিল। কিন্তু আজ পেছনে পায়ের শব্দ পেয়ে সে ভয় পেয়েছিল এমন যে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।
দরজা খুলে ঘরে আসে সে। দেখে ছেলেটি কাগজগুলোর ওপর উপুড় হয়ে আছে। এত মন দিয়ে পড়ছে যে তার আগমন টের পায়নি। আগেকার মতো গুছিয়ে বসে সে। বোতল থেকে জল খায়।
“আজকের যুব সম্প্রদায়ের নাম দেওয়া যেতে পারে এডস প্রজন্ম। এই রোগে এরই মধ্যে মারা গিয়েছে লক্ষাধিক মানুষ। গত কুড়ি বছরে এইচ আই ভি দ্বারা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় সত্তর লক্ষ। অধিকাংশের সংক্রমণ ঘটেছে পনেরো থেকে চব্বিশ বছর বয়সের মধ্যে।”
ছেলেটি মুখ তোলে। সে আবার কথা শুরু করে। ছেলেটি শুনতে আগ্রহী কিনা পুনর্বার জানতে চায় না। সে হাওড়া ইস্টিশানের কথা বলে। রেলগাড়ি থেকে নেমে সে হতভম্ব হয়ে যায়। অত লোক, অত গাড়ি, অত হাঁক-ডাক কোলাহল সব মিলে ভয় পেয়ে যায় সে। অসম্ভব একা এবং অসহায় লাগে তার। কী করবে বুঝতে না পেরে একজন টিকেট পরীক্ষকের কাছে গ্রামের নাম বলে গাড়ির হদিশ জানতে চায়। সেদিন আর গাড়ি ছিল না। তিনি জানান গাড়ি পাওয়া যাবে পরের দিন সকালে। বলতে বলতে কিছু সন্দেহ হয় তার। তার সঙ্গে আর কেউ আছে কিনা জিজ্ঞেস করেন তিনি। কী যে হয়ে যায় তার, একা আছে বললে যদি কিছু হয়, সে মিথ্যে করে বলে দেয় সঙ্গে তার বাবা আছে। তখন, একজন মধ্যবয়সি লোক তার কাঁধে হাত রাখে।
“The eminent French Jurist Renee Bridet, said of prostituted children that “Even if they are alive, they are dying within. It is a sad commentary on the social values of modern society that we can permit more than one million children in prostitution on Asia alone to remain in a form of slavery which is akin to a living death, said Ron O’Grady of End Child Prostitution in Asian Tourism (ECPAT).”
সে তাকায়। লোকটি হাসে এমন যেন কোথাও কোনও সমস্যা নেই। জানতে চায় কী হয়েছে, নির্ভয়ে তাকে সব বলতে বলে। এবং সেও ভয়তরাসে বলে দেয় সব বলে দেয় সে একা। বলে দেয় কালকের আগে আর গাড়ি নেই ফিরে যাবার।
লোকটি তাকে অভয় দেয়। তাকে নিয়ে মামির বাড়ি যেতে থাকে। ভাল মামি, সুন্দর মামি, তার কাছে রেখে দেবে তাকে এক রাত। সে বিশ্বাস করে। পরম সারল্যে বিশ্বাস করে। এবং অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। একটিই তো রাত। সে লোকটির সঙ্গে এ রাস্তাও রাস্তা করে, দু’পাশের ঝলক দেখতে দেখতে একসময় সেখানে পৌঁছে যায়।
মামি সমাদরে গ্রহণ করে তাকে। আর অন্য মেয়েদের হাতে তাকে তুলে দেয়। গোলগাল মধ্যবয়সি মামি, গালেমেচেতার দাগ, তাকে মামি বলেই বিশ্বাস করে সে। আরও বেশি বিশ্বাস জাগে যখন তাকে স্নান করিয়ে, খাইয়ে, রাতে শোবার ব্যবস্থা করে দেবার আদেশ দেয়।
ঘরে নিয়ে গিয়ে মেয়েরা তার পোশাক খুলে তাকে নগ্ন করে দেয়, সে লজ্জায় সংকুচিত হয়ে গেলে বলে, সকলেই তো মেয়ে, তার লজ্জার কিছু নেই, সে স্নান করে নিলেই আবার তাকে পোশাক-আশাক ফিরিয়ে দেওয়া হবে। সে তখন ভয় পেতে থাকে একটু কিন্তু স্নান করে নেয়। আর স্নান হয়ে গেলে, জামা-কাপড় ফেরত চাইলে, সেই মেয়েরা তাকে টেনে-হিচড়ে নগ্ন অবস্থায় নিয়ে যেতে থাকে।
চিৎকার করেছিল সে তখন। তাকে ছেড়ে দেবার, জামাকাপড় ফিরিয়ে দেবার আকুতিও জানিয়েছিল। কেউ শোনেনি। কেউ তাকে দয়া করেনি। সে তখন একজনের বাহুতে কামড় বসিয়ে দেয় আর খায় একটি সপাট চড়।
সে তখন কাঁদতে থাকে। আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। মার কথা তার মনে পড়ে। বাবার কথা। দাদাদের কথা। কী আর শাস্তি দিত বড়দাদা! না হয় বকত একটু। মারত। কিন্তু এই সব তো হত না।
তখন সে নগ্নভাবে নীত হয় সেই মামির কাছে। মামি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার শরীর দেখে। সারা শরীর দেখে। স্তন অপুষ্ট বলে মন্তব্য করে। কিন্তু সে যে ভবিষ্যতে হয়ে উঠবে খুবই আকর্ষণীয় একটি ‘মাল’–তাও সে শুনতে পায়।
খুঁজেছিল সে তখন। সেই লোকটিকে খুঁজেছিল। হিংস্র দাঁত বার করেছিল মামি। বলেছিল, তাকে বিক্রি করে দিয়ে সেই লোকটি ঘরে ফিরে গেছে।
“এইচ আই ভি এডস বহু লোকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে অনাথ শিশুর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সারা পৃথিবী জুড়ে প্রায় পনেরো লক্ষ শিশু, এক থ্রেকে পনেরো যাদের বয়সসীমা, এডস রোগের প্রকোপে হারিয়েছে হয় মাকে, নয় বাবাকে, নয়তো দু’জনকেই। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্যান্য অসুখের কবলে সারা পৃথিবীতে মাত্র দুই শতাংশ শিশু অনাথ হয়। আর শুধু এডসের জন্য দেশেদেশান্তরে অনাথ শিশুর সংখ্যা শতকরা নয় থেকে পঁয়ত্রিশ। এদের মধ্যে অনেকেই এইচ আই ভি সংক্রামিত।”
সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে টের পায়, সে কড়া প্রহরায় আছে। রাত্রে সে বাড়ির কথা ভাবতে ভাবতে কেঁদে-কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকালে উঠেই আবার তার বাড়ির জন্য কান্না পায়। সে কাঁদতে থাকে আর দুটি মেয়ে সারাক্ষণ তাকে বোঝায়। ব্যাখ্যা করে। বোঝায় যে এখানে যা করতে হবে সেসব না করে তার উপায় নেই। মেয়েমানুষ একবার ঘরের বাইরে পা রাখলে আর এ পাড়ায় রাত্রিবাস করলে ঘর আর তাকে ফেরত নেয় না।
সে শোনে। শুনে যায় কেবল। কিছু বোঝে। কিছু বোঝে না। কাঁদে। কেঁদে চলে ক্রমাগত এই দুনিয়ার কাছে অর্থহীন, মূলাহীন কান্না।
পরদিন থেকে সর্বাংশে প্রস্তুতি শুরু হয়। যেহেতু ওই তেরো বছর। বয়সে তার দেহ সম্পূর্ণ মুকুলিত হয়নি, স্তন ছিল অপরিপূর্ণ, যোনিমুখ শক্ত ও ক্ষুদ্র সেহেতু তাকে নগ্ন শুইয়ে দেওয়া হয় বিছানায়। হাত-পা বেঁধে ফেলা হয় শক্ত করে। মুখে গুঁজে দেওয়া হয় কাপড়। নড়তে পারেনি সে, চিৎকার করে যন্ত্রণা প্রকাশ করতে পারেনি যখন প্রায় টানা পাঁচ-ছ’ ঘন্টা তাকে এভাবে শুইয়ে রাখা হয়েছিল এবং ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল বড় লম্বা মোমবাতি।
পাগল হয়ে যায়নি সে, মরে যায়নি যন্ত্রণায়। এমনকী অজ্ঞানও হয়ে যায়নি। সে যখন নগ্ন হয়ে শুয়ে ছিল আর মুখে কাপড়, তখন এক বৃদ্ধা ভাবলেশহীন মুখ নিয়ে তার পাশে বসে। না। তার মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দেয় না স্নেহভরে। বরং এক কটুগন্ধী তেল হাতে মেখে সে তার স্তন মুঠোয় ধরে টানে। বার বার টানে। টেনে যায় এবং দুলতে থাকে, ঠোঁট বেয়ে লালা গড়িয়ে পড়ে। থামে না, যতক্ষণ না সে নিজেই ক্লান্ত হয়ে যায়।
এবং এ রকমই চলতে থাকে দিনের পর দিন। পাঁচ দিন স্থায়ুতো। অথবা সাত দিন। এখন আর মনে নেই তেমন। শুধু মনে আছে, সে প্রাণপণে পালাতে চাইছিল। ওই নরক থেকে পালাতে চাইছিল। এক দুপুরে সে সুযোগ পেয়ে যায়।
“The very basis of the child sex industry–designating of a child as a commodity for sale and purchase–demeans and dehumanises the child. It also serves the sexual drive of sexully immature men who seek emotional release by exploiting a completely powerless slave child.
The sexual exploitation of children does not occur in a vaccum but involves a more widespread exploitation, sexual or otherwise. Poverty and ignorance are the underlying causes of this worldwide phenomenon.”
ইতস্তত ঘুরছিল সে রাস্তায়। সহায়সম্বলহীন। ভীত। সন্ত্রস্ত। এক পুলিশ তাকে দেখতে পায় এবং প্রশ্ন করে। কী বলেছিল তার মনে নেই। সেই আরক্ষাকর্মীটি তাকে থানায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে সে প্রেরিত হয় সরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রে।
পুনর্বাসন কেন্দ্র। সে হাসে। উঠে দাঁড়ায়। পায়চারি করে। চুপ করে ভাবে কিছুক্ষণ। ছেলেটি অপলক তাকিয়ে থাকে। প্রশ্ন করতে ভুলে যায়। সে এসে ছেলেটির মুখোমুখি বসে আবার। ফাল্গুনের হাওয়া ঘরের দুয়ারে মাথা কুটে ফিরে যায়। সে কথা বলে আবার। ঘোর লাগা গলায় কথা বলে।
পুনর্বাসন কেন্দ্র। সরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্র। হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের রক্ষাকল্পে নির্মিত। আর সেখানেই এক রাত্রে তার শরীর থেকে পোশাক খুলে নেয় তাদের দেখাশুনোয় নিয়োজিত রাধামাসি। জোর করে একটি ফাঁকা ঘরে তাকে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শেকল তুলে দেয়।
কিছুক্ষণ পর এক বিশালাকার মাতাল পুরুষ সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে ঘরে ঢোকে। দেখে ত্রাসে সে থর থর কাঁপতে থাকে। আর তারকাঁপন দেখে লোকটি হা-হা শব্দে হাসে। দুই হাত মেলে তাকে ধরার জন্য এগোয়। সে প্রাণভয়ে ছুটে পালাতে থাকে এ-কোণ থেকে ওই কোণ। বেশিক্ষণ পারে না। দু’হাতে কলবন্দি ইদুরের মতো তাকে টিপে ধরে লোকটা। এবং ধর্ষণ করে।
“ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের সমীক্ষায় পাওয়া গেছে, দারিদ্রলাঞ্ছিত মানুষ অনেক বেশি মাত্রায় এডসের শিকার। অনেক দেশেই জীবনধারণের অন্য কোনও উপায় খুঁজে না পেয়ে তরুণী ও যুবতী মেয়েরা দেহব্যবসা শুরু করে। নিরাপত্তার সুব্যবস্থা না থাকায় এইচ আই ভি দ্বারা আক্রান্ত হয়। টানজানিয়ার কথা ধরা যাক। ক্রমবর্ধমান দারিদ্র আক্রান্ত সমাজে মেয়েদের প্রথাগত উপায়ে বিয়ে হওয়া কঠিন। সুতরাং যুবতী মেয়েদের মধ্যে বুড়ো বর বাগানোর জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। যুবাপুরুষদের চেয়ে বুড়োতেই তাদের বেশি টান একমাত্র এ কারণে যে বুড়োরা অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত। দেখা গেছে বুড়োদের থেকে এইচ আই ভি সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক বেশি।”
যোনিপথ ছিঁড়ে-খুড়ে গিয়েছিল তার। সারা শরীর আঁচড়ে-কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। সাতদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি সে। জগৎ সংসারে যা কিছু পরিবর্তন এর মধ্যে ঘটেছিল তার মধ্যে এও ছিল যে সেই দানব-সদৃশ লোকটি পুলিশের পোশাক পরে আরক্ষাকর্মী হয়ে যায় এবং সে লোকটিকে নগ্ন ও মাতাল অবস্থার পর সরাসরি সুস্থ পুলিশ হিসেবে দেখে।
প্রতি রাতে একজন-দু’জন করে সেই পুনর্বাসন কেন্দ্রের সমস্ত পুরুষকর্মী তাকে ধর্ষণ করেছিল। ভয় দেখিয়েছিল যদি সে ওপরতলায় নালিশ করে দেয় তবে খুন করে ফেলবে। পেট ভরে খেতে দেয়নি। কেন্দ্র থেকে দেওয়া পোশাকও তারা আত্মসাৎ করেছিল। সে স্বীকার করে, আজও স্বীকার করে, সেই মামির বাড়িতে সে পেট-ভরা খাবার অন্তত পেয়েছিল।
একদিন, আরও দু’জন মেয়ের সঙ্গে পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে সে পলায়ন করে। আবার তারা একটি দালালের কবলে পড়ে এবং আবার সেই মামির পাড়ায় গিয়ে ঠেকে।
সেই থেকেই এখানে। সেই থেকেই চলছে দেহব্যবসা। বহু দিন পর বাবা-মাকে চিঠি লিখেছিল সে। তারা দেখতে এসেছিল তাকে। কিন্তু গ্রামে ফিরে যেতে বারণ করেছিল। তার এই পেশার কথা জানাজানি হলে গ্রামে থাকা মুশকিল হবে সকলের।
মেনে নিয়েছিল সে। মা-বাবা আসত মাঝে মাঝে। বেঁচে ছিল যত দিন। সে-ও টাকা পাঠাত নিয়মিত। দাদারা আসেনি কোনও দিন। ডাকেনি। সে-ও যায়নি। মা বাবা মরে যাবার পর গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে।
“Twelve out of 49 children of prostitutes were motherless. 40 said that they have or had illiterate mothers.
Young girls are raped, beaten and starved and thus pressurised into receiving customers.
From the ancient temples of Delphi to the modern Hindu temples of India, the regular sexual abuse of young girls as temple prostitutes has been a way of obtaining religious merit.”
কেউ কারওকে স্পর্শ করেনি। শুধু চোখে চোখ রেখে বসে আছে। ছেলেটির মুখ বেদনায় বিবর্ণ। তার মুখ করুণ হয়তোবা। সে অস্ফুটে কথা বলে। এ পাড়ায় শত শত মেয়ের এ রকম কাহিনি আছে। করুণতর কাহিনি। তারা যখন সম্মেলনে যোগ দেয়, বহু জায়গার বহু যৌনকর্মীর সঙ্গে সুখ-দুঃখ, অভিজ্ঞতা, সুবিধা-অসুবিধা আদান-প্রদান সম্ভব করে তখন জানতে পারে আরও করুণ, বীভৎস সব কাহিনি। সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে এ কাহিনির সূচনা। শুধু অধর্মেই নয়, ধর্মেও জড়িয়ে গেছে বেশ্যাবৃত্তি।
মুম্বইয়ের একটি মেয়ের অভিজ্ঞতা ভয়ঙ্কর। পর পর তিন দিন অকথ্য অত্যাচার করেও তাকে রাজি করানো যায়নি যখন, তার সুগঠিত দেহের জন্য চড়া মূল্য হাঁকা পুরুষেরা হতাশ হয়ে ফিরে যেতে লাগল যখন, তখন একটি ছোট ঘরে নগ্ন করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তাকে। সেই ঘৱে সে ছাড়া ছিল মাত্র আর একজন। একটি কালকেউটে সাপ।
টানা দুদিন সে অনড় হয়ে বসেছিল সেই ঘরে। দু’চোখের পাতা এক করেনি। একবিন্দু জল পর্যন্ত খায়নি। তৃতীয় দিন সেভেঙে পড়ে এবং শয়তানের হাতে নিজেকে সঁপে দেয়।
ছেলেটি উঠে দাঁড়ায়। জল চায় এক গ্লাস সে জলের বোতল এগিয়ে না দিয়ে কুঁজো থেকে ঠাণ্ডা জল ঢেলে এনে দেয়। খায় ছেলেটি। গ্লাস ফিরিয়ে দিয়ে তার কাছাকাছি এগিয়ে আসে। আলতো হাত রাখে তার গালে। দু’চোখ দিয়ে কী যেন খুঁজে বেড়ায়। বিড়বিড় করে। ব্যাগ টেনে নিয়ে রওনা দেয় দরজার দিকে।
সে ডাকে। এবং পিছু ডাকল বলে আরও একবার বসে যেতে অনুরোধ করে। ছেলেটি ব্যাগ কাঁধে নিয়েই বসে পড়ে তার কথামতো। সে তখন পঞ্চাশ টাকা এগিয়ে দেয়। ছেলেটি নিতে অস্বীকার করে উঠে দাঁড়ায় আবার। সে তখন হাত টেনে টাকা গুঁজে দেয়। কবে, কোন তেরো বছর বয়সে হারিয়ে ফেলা আবেগ এত দিন পর আবার তাকে ক্ষণিকের জন্য অধিকার করে। সে বলে বসে, দিদি হয়ে ভাইকে এটুকু তো দিতেই পারে সে।
ছেলেটি প্রতিবাদ করে না। টাকা পকেটে খুঁজে বেরিয়ে চলে যায়।
সে তখন খানিক দূরত্ব রেখে ছেলেটিকে অনুসরণ করে। রাত হয়েছে। জায়গা ভাল নয়। বড় রাস্তা পর্যন্ত সে সঙ্গে যাবে।
ছেলেটি থমকে দাঁড়ায় একবার। কী যেন দেখে। তারপর বড় বড় পদক্ষেপে চলে যেতে থাকে।