১৭
জানালা দুরকম হয়। কোনও জানালায় দৃশ্য থাকে, কোনওটায় থাকে না। চয়নের জানালায় কোনও দৃশ্য নেই। তার একতলার ঘরখানা খুবই অন্ধকার। একটাই দরজা ভিতরদিকে, একটাই জানালা বাইরের দিকে। জানালার ওপাশে একটা সংকীর্ণ গলি, তার ওপাশে দেয়াল। নিরেট দেয়াল, নোনাধরা। জানালার পুরনো শিক আর জং ধরা এক্সপাণ্ডেড মেটাল লাগানো। দিনেই আলো জ্বালতে হয়। তবে এ ঘরের ইলেকট্রিক লাইন কেটে দিয়েছে চয়নের দাদা। বাড়ির পিছন দিককার সবচেয়ে খারাপ, ড্যাম্প ধরা, অন্ধকার ঘরখানায় থাকে চয়ন আর তার মা। চয়ন এ ঘরে পড়াশুনো করতে হলে জানালার ধারে বসে করে। এ ঘরেই স্টোভ জ্বেলে তার আর মায়ের রান্না হয়। এক চিলতে উঠোনে চৌবাচ্চা আছে। তাতে করোরেশনের জল আসে। জল ব্যবহারের ওপর কড়া বিধিনিষেধ আছে। সকাল আটটার মধ্যে তাদের স্নান করে নিতে হয়। ছাদে যাওয়া বারণ বলে ভেজা কাপড় শুকোতে হয় ঘরের মধ্যেই। সাবান কাচা সম্পূর্ণ নিষেধ।
জানালায় দৃশ্য থাক বা না-থাক, ঘরে থাকলে চয়নের বেশীর ভাগ সময়ই কাটে জানালার ধারে বসে। এ ঘরের যেটুকু আলো তা ওই জানালার সুবাদেই পাওয়া যায়। এই পিছনের গলিটা সর্বসাধারণের ব্যবহারযোগ্য নয়। আগে খাটা পায়খানার আমলে মেথর আসবার রাস্তা ছিল, আজকাল খিড়কির রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করে অন্য বাড়ির লোক। মাঝখানে গলিতে ময়লা ফেলা শুরু হয়েছিল, সেটা চয়ন চেঁচামেচি করে পাড়ার হস্তক্ষেপে বন্ধ করেছে। তবু কিছু কিছু অশ্লীল জিনিস গলিতে নিক্ষিপ্ত হয়। কাকেরা টানা-হ্যাঁচড়া করে।
মলিন আলোটুকু বই পড়তে বা লিখতে কাজে লাগে চয়নের। দুপুরে জানালার খাঁজে বসে কোলে বই বা খাতা নিয়ে সে ডুবে যায় নিজের কাজে বা চিন্তায়। ওই গলিপথেই একদিন দুপুরে উদয় হল আশিস বর্ধন।
কি মশাই চিনতে পারছেন?
চয়নের স্মৃতিশক্তি চমৎকার। কোনও নাম বা মুখ সহজে ভোলে না। সে একটু অবাক হয়ে বলে, চিনতে পারছি। আপনি আশিসবাবু, এল আই সিতে কাজ করেন। মেশিন ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু গলি দিয়ে এলেন কেন? এদিক দিয়ে তো এ বাড়িতে ঢোকার রাস্তা নেই।
সে জানি। তবে আপনার কথা থেকে আঁচ করেছিলাম যে, সদর দিয়ে ঢোকা একটু আনসেফ। ঢোকার দরকারও নেই। এখান থেকেই কথা বলে চলে যাই। বলে প্যান্টের পকেট থেকে একটা কাগজের পুরিয়া বের করে এক্সপান্ডেড মেটালের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিয়ে বলে, ধরুন। কালো তাগায় বেঁধে পরবেন।
কী এটা?
মাদুলি। হাবড়ার এক তান্ত্রিকের দেওয়া।
চয়ন মৃদু একটু হেসে বলে, তাবিজ-কবজ তো অনেক হয়ে গেল। কাজ হয়নি কিছু।
আশিসও হাসল, ওসবে আমারও বিশ্বাস নেই। তবে মানুষ তো সব রকম চেষ্টাই করবে। আমিও যে যা বলে করে যাই, বোনটার জন্য। মৃগী না সারলে বিয়ে দেওয়া যাবে না, আর বিয়ে না হলে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
আপনার বোনের কি মাদুলিতে কাজ হয়েছে?
মনে হয় হতেও পারে। গত পনেরো দিন তো অজ্ঞান হয়নি। দেখা যাক।
চয়ন কুণ্ঠিতভাবে বলে, আপনি এত কষ্ট করলেন! দাঁড়ান, আমি জামাটা পরে আসছি।
আশিস বর্ধন জানালার কাছে এসে ঘরের মধ্যে একটু উঁকি দিয়ে বলল, এইটাই বুঝি আপনার আর আপনার মার ঘর?
চয়ন মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ। বাদবাকি বাড়িটা আমাদের কাছে নিষিদ্ধ। সেইজন্য—
আরে ব্যস্ত হবেন না। এসব সিচুয়েশন আমার জানা আছে। মা বুঝি ঘুমোচ্ছেন! খুব রোগা তো!
সরু চৌকির ওপর পড়ে থাকা মায়ের দিকে একবার তাকায় চয়ন। বলে, হাড় ক’খানা অবশিষ্ট আছে। মায়ের অনেক রোগ, চিকিৎসা তো হয় না। পড়ে থাকে নির্জীব হয়ে। মাঝে মাঝে মনে হয়, মরে-টরে গেছে বুঝি।
রোগটা কী?
মার চোখে ছানি। প্রেশার খুব বেশী। হার্টও বোধ হয় ভাল নয়। বাত।
আপনাদের রান্না করে কে?
কিছুদিন আগেও মা পারত। আজকাল আমি করি। একটা কুকার ছিল বাবার আমলের। সেইটে কাজে লাগছে।
দাদা বউদির সঙ্গে সম্পর্কটা এখন কেমন?
সম্পর্ক নেই। দেখা হলেও কথাবার্তা হচ্ছে না।
বকাঝকা বা পরোক্ষ গালাগাল?
চয়ন মৃদু হেসে বলে, আগে হত। আজকাল সেদিক দিয়ে পিসফুল। আপনাকে তো এত কথা বলিনি, জানলেন কি করে?
বেশীর ভাগ অভাবের সংসারের ছবিটা একই রকম কিনা। আমি সেদিন আপনার বাড়ির ঠিকানা চাওয়ায় আপনি একটু দোনোমোনো করেছিলেন এবং অসময়ে আসতে বারণ করেছিলেন, তখনই আন্দাজ করে নিয়েছিলাম। কিছু মনে করলেন না তো!
বিবর্ণ একটু হেসে চয়ন বলে, না না, আপনি তো সিমপ্যাথাইজার।
একজ্যাক্টলি। কারণ আমার দাদা আমাকে আপনার চেয়েও একটু বেশী করেছিল। লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল।
চয়ন চেয়ে রইল লোকটার দিকে।
আশিস ম্লান হেসে বলল, অবশ্য দোষটা আমারই ছিল। দাদার জায়গায় আমি হলেও হয়তো তাই করতাম। যাকগে। তবে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়াতেই কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে যেতে পেরেছি। নইলে একদম বখে গাড্ডায় চলে যেতাম।
দাদার সঙ্গে আপনার আর সম্পর্ক আছে?
পরে রিকনসিলিয়েশন হয়েছিল, তবে সংসার তো আর এক হয়নি। শত্রুতাও নেই।
কিন্তু আপনি গলিতে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, আমার খুব অভদ্রতা হয়ে যাচ্ছে। দাঁড়ান, জামাটা গায়ে দিয়ে আসছি।
একবার বেরোলে ঢুকতে পারবেন তো! সদর বন্ধ বা খোলার ব্যবস্থা কি আপনার হাতে আছে?
চয়ন মলিন মুখে মাথা নেড়ে বলে, না। বউদি ওপরে ঘুমোচ্ছে। সদর খুলে বেরোলে দরজা টেনে দিলে লেগে যাবে। কিন্তু ফের ঢুকতে হলে ডোরবেল বাজাতে হবে। তবে অসময়ে ফিরলে আমি এই জানালায় এসে মাকে ডাকি। মা খুলে দেয়। তবে মার কষ্ট হয়।
তাহলে বেরোনোর দরকার নেই আপনার। আমি যাচ্ছি।
আরে না। আমার টিউশনিতে যাওয়ার সময় তো হয়ে এল।
তাহলে আসুন। আমি রাস্তায় অপেক্ষা করছি।
তার নতুন একজন বন্ধু হল কিনা তা বুঝতে পারছে না চয়ন। আগে ইস্কুল-কলেজে তার অনেক বন্ধু ছিল। আজকাল বিশেষ কেউ নেই। সে কোনওদিন চায়ের দোকানে বা পাড়ার ঠেক-এ আড্ডা দিতে যায়নি। তার শরীর দেয় না, তার সময়ও হয় না। প্রাণপাত বন্ধুত্ব তার সঙ্গে ছিলও না কারও। সে অনেকটাই একা, সঙ্গহীন। আশিস তার চেয়ে বেশ কয়েক বছরের বড়, তবু যদি বন্ধুত্ব হয় তাহলে খারাপ লাগবে না চয়নের। তার বোধ হয় এখন একজন বন্ধুই দরকার।
পোশাক বলতে প্যান্ট, জামা আর চপ্পল। পরতে দুমিনিট লাগে। বেরোনোর আগে একবার মাকে ডেকে বলে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু মা এত অকাতরে ঘুমোচ্ছ যে, ডাকতে ইচ্ছে হল না। এরকম ঘুমের মধ্যেই মা একদিন চলে যাবে বোধ হয়। সেদিন চয়ন আরও একটু একা হয়ে যাবে।
বাইরে মেঘলা আকাশ। ভ্যাপসা গরম।
আশিস বলল, আজ টিউশনি কোন দিকে? সাউথে কি?
আজ্ঞে হ্যাঁ। গোল পার্কের কাছে, সেদিন যেখানে যাচ্ছিলাম।
ছাত্র না ছাত্রী? ছাত্রীই যেন বলেছিলেন!
হ্যাঁ।
বড়লোক নাকি?
পয়সায় তেমন নয়। তবে ছাত্রীর বাবা বড় সায়েন্টিস্ট। নাম আছে।
কী নাম বলুন তো!
কৃষ্ণজীবন বিশ্বাস। কাগজে লেখেন-টেখেন। এনভিরনমেন্টের ওপর।
আশিস বর্ধন মাথা নেড়ে বলল, জানি। বিখ্যাত লোক। ইংরিজি কাগজে লেখা পড়েছি। কি রকম দেয় আপনাকে?
আড়াই।
কমই দিচ্ছে। বাসভাড়াটা বাদ দিন, কী থাকছে বলুন!
এর বেশী চাইতে ভয় করে। হয়তো টিউশনিই পাব না।
দুর মশাই! বরং উল্টো। যত দাম বাড়াবেন তত ডিমান্ড হবে। আমি তো এক গুজরাতির ছেলেকে পাঁচশো টাকাতেও পড়িয়েছি।
ও বাবা!
আজকাল আর ওই উঞ্ছবৃত্তি করি না। তবে আমার আর একটা সাইড বিজনেস আছে। শেয়ার বাজারের ব্রোকারি।
সেটা কী ব্যাপার?
সেটা খুব ভাল ব্যাপার। একটু মেধা আর ক্যালকুলেশনের দরকার হয়। কিছু টাকাও খাটাতে হয়। লেগে থাকলে অনেক পয়সা। করবেন?
চয়ন খুব লাজুক দৃষ্টিতে আশিস বর্ধনের দিকে একবার তাকায়। পৃথিবীর কত কিছুই সে পারে না। পারবেও না ইহজন্মে। সে স্মিত মুখে চুপ করে রইল।
আশিস বর্ধন তার মনের কথাটা যেন পড়ে নিল। বলল, পারবেন না তো! বাঙালির ছেলেরা ওসব রাস্তায় যেতে চায় না। তারা চায় সেফ প্রফেসন। যাকগে, মাদুলিটা পরবেন কিন্তু। একটু নিয়ম আছে। শনিবার সকালে একটু কাঁচা দুধে ধুয়ে নিয়ে কালো কার বেঁধে পরবেন। কাজ হলে হবে। না হলেও ক্ষতি নেই। তাই না?
এর দাম?
দুর মশাই! পাঁচ সিকে দক্ষিণা দিয়েছি। আপনাকে কিছু দিতে হবে না। তান্ত্রিকটার পয়সার লালচ নেই, সেইজন্যই ভরসা হল, কাজ হতেও পারে। চলুন, চা খাই কোথাও বসে।
সম্পর্ক জিনিসটা চয়ন কখনও রচনা করতে পারে না। আপনা থেকেই রচিত হয়ে যায়। বেশীরভাগ সময়েই সেটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক নয়। এই যে আশিস বর্ধন, এইমাত্র চয়ন বুঝতে পারছে, এর সঙ্গেও তার বন্ধুত্ব হবে না। লোকটি মেধাবী, করিৎকর্মা এবং শক্তিমান। এর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হবে কি করে? সম্পর্কটা উপকারী ও উপকৃতের। অনুগ্রহকারী ও অনুগৃহীতের, উপদেষ্টা ও উপদিষ্টের। এ লোকটা সেদিন তার কিছু উপকার করেছিল এবং আরও কিছু উপকার করতে চেয়েছিল। আজও বাড়ি বয়ে মাদুলি দিয়ে গেল। চয়নের কৃতজ্ঞতাবোধ বড়ই বেশী। কেউ তার জন্য সামান্য কিছু করলেও সে গলে যায়। এই মনোভাব নিয়ে কি বন্ধুত্ব হয়!
আশিসকে নিয়ে পাড়ার কালোর চায়ের দোকানে বসল চয়ন। এ দোকান তার ঠেক নয়। তবে অনেকদিন এ পাড়ায় থাকার সুবাদে চেনা। চা খুবই ভাল বানায় এরা। আশিসকে চা আর ওমলেট খাওয়াল চয়ন। খাওয়াল, কিন্তু দামটা দিতে পারল না। কারও সঙ্গে সে জোর জবরদস্তিতে পেরে ওঠে না। আশিস জোর করেই দামটা মেটাল। খুব হীনম্মন্যতা কষ্ট পেতে লাগল চয়ন।
আশিস বলল, আমি সাউথেই যাচ্ছি। চলুন নামিয়ে দিয়ে যাই। ট্যাক্সি নেবো।
চয়ন আবার আর একটা কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হয়ে পড়তে চাইল না। পৃথিবীর শক্তিমান লোকগুলোর ওপর ইদানীং তার খুব রাগ হয়।
চয়ন মৃদু হেসে বলে, এখনও ঢের দেরি। আমি একটু পরে যাবো।
চলুন, আগেই বেরোই। এই ফাঁকে আমার বাড়িতে ঘুরে আসবেন।
বাড়িতে! বলে চয়ন ভাবিত হয়। এত অল্প পরিচয়ে বাড়ি নিয়ে যেতে চায় কেউ?
আরে অত ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন! আমি দ্রুত বন্ধুত্বে বিশ্বাসী।
দ্রুত-বন্ধুত্ব!
এ যুগে যা করার তা চটপট সেরে ফেলতে হয়। আমাদের আয়ু কম, সময় কম, অবসর কম, বন্ধুত্ব করার জন্য বেশী ভ্যানতারার স্কোপ কোথায় বলুন! আমি তাই চটপট বন্ধুত্ব করে ফেলি। তাতে দু-চারটে সন্দেহজনক ক্যারেকটারও যে জোটে না তা নয়। তবে মোটের ওপর আমি ঠকিনি। আর আপনারও চিন্তার কিছু নেই। চলুন। সবসময়ে অত সংকুচিত হয়ে থাকবেন না। সবসময়ে যদি নিজের ডেফিসিয়েন্সিগুলোর কথাই ভাবতে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে, নিজের কাছেই নিজে বাতিল হয়ে বসে আছেন। তাহলে দুনিয়া আপনাকে পাত্তা দেবে কেন বলুন!
চয়ন লোকটার দিকে আর একবার চোরাচোখে তাকাল। লোকটি সদাশয়, সে আগের দিনই বুঝেছিল। কিন্তু এর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হবে দাতা ও গ্রহীতার। এ তার অনেক উপকার করবে এবং করতেই থাকবে। বন্ধুত্বের জন্য আর একটু সমানে সমানে হওয়া দরকার। তবু জীবনে যা আসে তাই নেওয়া ছাড়া কী আর করার আছে তার?
সে বলল, চলুন।
ট্যাক্সিতে চড়াটা চয়নের কাছে বেশ একটা অপব্যয় বলে মনে হয়। কলকাতায় এত বাস ট্রাম, তা সত্ত্বেও ট্যাক্সি চড়ে তারাই যাদের বিস্তর ফালতু পয়সা আছে! আশিস বর্ধনও মনে হচ্ছে, বিস্তর ফালতু পয়সার মালিক।
ধীরে ধীরে আশিস বর্ধনের ছবিটা পরিষ্কার হচ্ছে তার কাছে। আশিস বর্ধন চটপট বন্ধুত্বে বিশ্বাসী, চয়ন তা নয়। আসলে চয়ন তো বন্ধুত্ব গড়েই তুলতে পারে না আজকাল, হীনম্মন্যতা ভোগে বলে। কিন্তু মানুষকে সে খুব লক্ষ করে। তার দৈর্ঘ্য প্রস্থ ছাড়াও তার আর যেসব খামতি বা বাড়তি, খুঁটিনাটি সব কিছু। লোকে বুঝতেই পারে না, চয়নের চোখে গোয়েন্দার পর্যবেক্ষণ আছে।
ট্যাক্সিতে বসে আশিস বলল, চাকরি পেলে করবেন?
এখনই। হাতে আছে?
আরে না। বলে হাসল আশিস, চাকরি কি হাতে থাকে নাকি? তবে আমি শেয়ারের ব্রোকার তো, বিজনেসম্যানদের চিনি। আমারই খদ্দের সব। এদের কারও কম্পানিতে হয়ে যেতে পারে। তবে কিনা মাইনে খুব কম, খাটুনি বেদম। আসলে দেশে এত বেকার আর এই বাঙালি ছেলেগুলো চাকরি ছাড়া আর কিছু করতে চায় না বলে, এইসব লোকেরা সুযোগটা নেয়। তিনশো চারশো টাকায় বারো ঘণ্টা খাটিয়ে নিচ্ছে।
চয়ন মলিন মুখে বলে, জানি। আমি ওরকম পেরে উঠবো না।
চাকরির বাজার খারাপ। তবু আপনার বায়ো-ডাটাটা আজ লিখে দেবেন তো আমাকে।
চয়ন বলল, আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করছেন। আমি তো কিছুই প্রতিদান দিতে পারছি না।
আপনি মশাই, খুব খারাপ লোক।
তাই বুঝি?
খারাপ ছাড়া কী! এখনও দূরত্বটাই ঘোচাতে পারলেন না। এইসব ছোটোখাটো পরিচয়গুলোকে উপেক্ষা করবেন না। এভাবেই ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, ভাব ভালবাসা আসে, আর এ থেকেই জাতীয় সংহতি। বুঝলেন?
বলেই আশিস হেসে ফেলল।
চয়ন সহজে কারও সঙ্গে ঠাট্টা রসিকতা করে না। কিন্তু এই সহজ লোকটাকে সে বলে ফেলল, আপনিও খারাপ লোক। আমাকে চা ওমলেটের দাম দিতে দেননি।
হবে হবে, বিস্তর চা ওমলেট খাওয়া যাবে। খাওয়ার এই তো শুরু।
যাদবপুরের একটু ভিতরদিকে কলোনির মধ্যে আশিস বর্ধনের দোতলা বাড়ি। একটু জমি আছে সামনে আর পিছনে। মেলা গাছ। যেটুকু জমি পেয়েছে ঘন বুনটে গাছগাছালি লাগিয়েছে। ফলন্ত কুমড়ো, লঙ্কা, ঢ্যাঁড়স দেখতে পেল চয়ন। আরও আছে।
বাড়িতে ঢোকার আগে বর্ধন তাকে বাগানটা দেখাল, এই এরাই আমার প্রাণ। এইসব গাছপালা, জীবনে এই একটাই আমার হবি, নিজের লাগানো গাছের সবজি বা ফল খাওয়া, নিজের গাছের ফুল দিয়ে ঠাকুরপুজো করা। জমি থাকলে আরও কত কী করতাম! আসুন ভিতরে।
একজন এপিলেপটিকের সঙ্গে আর একজন এপিলেপটিকের পরিচয় কি অন্যরকম কিছু ঘটনা? কোনও টেলিপ্যাথি হয়? বা বিশেষ ধরনের সমবেদনা? কে জানে কী! তবে আশিসের হাঁকডাকে যখন জনা তিনেক মহিলা আর দুটো বাচ্চা এসে বৈঠকখানায় জড়ো হল তখন লজ্জায় নতমুখ চয়নও টের পেল, তাকে সবচেয়ে নিবিড় ভাবে লক্ষ করছে যে মেয়েটি, সে হল আশিসের ওই এপিলেপটিক বোন, রোগা দাঁত-উঁচু ফ্যাকাশে মেয়েটিকে দেখলেই বোঝা যায়, অসুস্থ। একবারের বেশী তাকায়নি চয়ন। তবু দেখে নিয়েছে, মেয়েটির মাথায় অনেক চুল, আর চোখ দুখানা ভারি টানা টানা।
এরা বেশ ভাল পরিবার। বেশী এটিকেট নেই। ঝুপঝাপ সবাই বসে পড়ল। হই হই করে কথা বলতে লাগল।
চয়নের কথা আসে না। স্মিত মুখে চুপচাপ বসে থাকতেই সে ভালবাসে। একজন এপিলেপটিক কি আর একজন এপিলেপটিককে দেখে ভরসা পায়? জীবনের ওপর বিশ্বাস ফিরে পায়? আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে? এপিলেপটিকরা কি পরস্পরকে আশ্বস্ত এবং আরোগ্য করে তুলতে পারে! তার কেন যেন সন্দেহ হচ্ছে, নিজের মৃগী রোগী বোনের জন্যই তাকে বাড়িতে এনেছে আশিস। হয়তো তাকে দেখিয়ে বোনের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা।
আশিসের বউ চা আর খাবার করতে গেল। আশিসের মা গেল নাতি আর নাতনি সামলাতে? আশিস গেল বাথরুমে। রইল শুধু মেয়েটি।
আমার নাম রাকা। আপনার কথা দাদা খুব বলে।
বলার মতো কী? আজ তো দ্বিতীয় দিনের পরিচয় মাত্র।
কী জানি কেন বলে! ওর আবার যাকে ভাল লাগে, তাকে এক মিনিটেই লাগে।
ওঁর সঙ্গে একদিনের মাত্র আলাপ, তাও আমার পক্ষে লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে। আমি রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম।
দাদা সব বলেছে। আমারও তো ওরকম হয়। ইস্কুলে কলেজে ক্লাস করতে করতে কতবার হয়েছে। একবার রাস্তায় আর একবার ট্রামেও হয়েছিল। দাদা কিন্তু তা বলে আমাকে বেরোতে বারণ করে না। বরং বলে, না বেরোলে কনফিডেন্স থাকবে না। ওর ভীষণ কনফিডেন্স জানেন তো!
জানলাম। উনি আমাকে আজ একটা মাদুলি দিয়ে আসতে গিয়েছিলেন।
মেয়েটি হাসল, তাও জানি। ও এমনিতে ভীষণ নাস্তিক, কিন্তু অসুখ-বিসুখের বেলায় কিছুই ছাড়ে না, সব বাজিয়ে দেখে। আপনি মাদুলিটা ধারণ করবেন কিন্তু। আমার মনে হচ্ছে একটু কাজ হয়েছে।
করব। তবে গত একমাস আমার অ্যাটাক হয়নি। একজন বড় হোমিওপ্যাথকে দেখাচ্ছি। বোধ হয় কাজ হচ্ছে তাতেও।
দুজনেই দুজনের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ নীরবে। তারপর দুজনেই একসঙ্গে হেসে ফেলল।
রাকা বলল, আসলে কিসে যে সত্যিকারের কাজ হবে কে জানে! ফ্রিকোয়েন্সিটা কমলেই যেন হাতে চাঁদ পাই। তাই না বলুন!
চয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তা তো ঠিকই। কিন্তু যখন দীর্ঘ দিন গ্যাপ যায় তখন ভীষণ টেনশনও শুরু হয়, এই বুঝি হবে! এই বুঝি হবে!
উঃ, আপনার সঙ্গে আমার দারুণ মিল! আমারও ঠিক এরকমই হয়।
বিকেলটা হাসিতে গল্পে বেশ কেটে গেল চয়নের। অনেকদিন বাদে কিছুটা সময় এমন ভাল কাটল তার। আশিস তাকে বাসরাস্তা অবধি এগিয়ে দিয়ে বলল, দেখলেন তো, এসে ঠকেননি! এ যুগে চটপট বন্ধুত্ব করে নেওয়া ভাল, নইলে ভ্যানতাড়ায় আয়ুক্ষয় হয়ে যায়। চলে আসবেন যখন তখন, অলওয়েজ ওয়েলকাম।
অটোমেটিক লিফটে মোহিনীদের সাততলার ফ্ল্যাটে উঠবার সময় মনে মনে একটা ভারি উচ্চকোটির ভাব হচ্ছিল তার। মনটাও যেন লিফটে করে অনেক ওপরে উঠে বসে আছে আজ। নামতে চাইছে না।
চার বা পাঁচ তলায় কেউ লিফ্ট্টা থামাল। চয়ন চোখ বুজে তার আনন্দিত অভ্যন্তরটাকে অনুভব করার চেষ্টা করছিল। লিফ্ট্টা থামতেই চোখ খুলল। কিন্তু তাকে আপাদমস্তক শিহরিত করে চোখে ঘনিয়ে আছে কুয়াশা। একটা ট্রেনের শব্দ এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা থরথর করে কাঁপছে।
না, আজ কিছুতেই অজ্ঞান হওয়া চলবে না তার। কিছুতেই না। যেমন করেই হোক তাকে আজ জেগে থাকতেই হবে। দরজাটা খুলতেই তাই সে কুয়াশায় আবছা চোখেই দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কেউ উঠছিল, তাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে এল সে করিডোরে। তারপর সিঁড়ি ধরে ছুটতে ছুটতে উঠতে লাগল সে, না আমার কিছু হয়নি! কিছু হয়নি! আমি ভাল আছি!…..ভাল আছি…..
একটা ল্যান্ডিং অবধি উঠতে পেরেছিল সে। তারপর দড়াম করে পড়ল। সিঁড়ি দিয়ে খানিক গড়িয়ে, তারপর টেরচা হয়ে রেলিং-এ লেগে স্থির হল তার শরীর। ওইভাবেই পড়ে রইল। প্রায় পনেরো মিনিট বাদে তাকে আবিষ্কার করলেন মিসেস মেহতা। তিনি খবর দেওয়াতে, মোহিনী আর রিয়া নেমে এল।