ছাপাখানা ও নবজাগৃতি
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের আট বছর পরে বাঙলার ইতিহাসে এমন এক যুগপ্রবর্তনকারী ঘটনা ঘটে, গুরুত্বে যার মত ঘটনা বাঙলাদেশে পূর্বে ঘটেনি, পরেও না। ঘটনাটার জের প্রথম উন্মুক্ত করে দিয়েছিল, বাঙলার জনসমাজের সামনে জ্ঞানরাজ্যের ভাণ্ডার যার ফলে উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙলায় সংঘটিত হয়েছিল এক নবজাগরণ।
ঘটনাটা হচ্ছে একখানা বইয়ের প্রকাশ। বইখানা হচ্ছে ইংরেজি ভাষায় রচিত ও হুগলীতে মুদ্রিত ন্যাথানিয়াল ব্রাশী হ্যালহেড কৃত বাংলা ভাষার একখানা ব্যাকরণ। বইখানার গুরূত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই বইখানাতেই প্ৰথম বিচ্ছিন্ন নড়নশীল (movable types) বাংলা হরফের চেহারা দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। এই হরফ তৈরী করেছিলেন চার্লস উইলকিনস নামে কোম্পানির এক সিভিলিয়ান। তিনি পঞ্চানন কর্মকার নামে এদেশের একজন দক্ষ ও প্ৰতিভাশালী শিল্পীকে হরফ তৈরীর প্রণালীটা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বাংলা হরফের সাট বিবর্তনের ইতিহাসে পঞ্চাননের ও তার পরিজনদের প্রয়াস ও দান অনন্যসাধারণ।
হ্যালহেডের ‘গ্রামার’ ছাপা হবার পর ১৭৮৪ খ্রীস্টাব্দে জোনাথান ডানকান ‘মপসল দেওয়ানী আদালত সকলের ও সদর দেওয়ানী আদালতের বিচার ও ইনসাফ চলন হইবার কারণ ধারা ও নিয়ম’ নামক একখানা বাংলা অনুবাদ গ্ৰন্থ প্ৰকাশ করেন। পরের বছর (১৭৮৫ খ্রীস্টাব্দে) বইখানি ‘দেওয়ানী আদালতের বিচার পরিচালনার নিয়মাবলী’ নামে বড় আকারে প্রকাশিত হয়। তখন বইখানি দ্বিভাষিক রূপ নেয়। বইখানির বামদিকের পৃষ্ঠায় ইংরেজি পাঠ ও ডানদিকের পৃষ্ঠায় তার বাংলা অনুবাদ ছাপা হয়। ১৭৮৭ খ্রীস্টাব্দেও তিনখানা আইনের বই বাংলায় প্ৰকাশিত হয়। বইগুলি যথাক্রমে ‘কালেকটরদের আচরণ বিধি’, ‘মপস্বল দেওয়ানী আদালত সকলের ও সদর দেওয়ানী আদালতের বিচার ও ন্যায়ের কার্যের নিমিত্ত সন ১৭৮৭ ইং জুন ২৭ যে ধারা ও নিয়ম সাব্যস্ত হইল তাহা সকলের জ্ঞাত কারণ তৰ্জমা হুইয়া নামতে লিখা যাইতেছে’, ও ‘ফৌজদারী আদালতের গোর্দ্দধারী কারণ জেলাদার সাহেবদিগের নামে যে হুকুমনামা সন ১৭৮৭ ইংরেজি তারিখ ২৭ জুন ষ্ট্ৰীযুক্ত প্রবলপ্রতাপ গভর্নরজেনারেল বাহাদুর আজ্ঞা করিয়াছেন তার তর্জমা।’
১৭৯১ ও ১৭৯২ খ্ৰীস্টাব্দে নীল বেঞ্জামিন এডমণ্ডস্টোন সাহেব ছাপালেন বই আকারে ‘ফৌজদারী আদালতের নিয়মাবলী’ ও ‘ম্যাজিষ্ট্রেট-কাৰ্যবিধি’ নামে আরও দুটি আইনের তর্জমা। এগুলিই হচ্ছে বাংলা গদ্যের প্রথম মুদ্রিত পুস্তক। আগে বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচিত হত পদ্যে। এই প্ৰথম মুদ্রিত গদ্যসাহিত্যের প্রবর্তন হল। যার ফলে সৃষ্ট হয়েছিল বই ও সংবাদপত্র, যা পরবর্তী শতাব্দীতে সহমরণ নিবর্তন, বিধবা বিবাহ প্রভৃতি সামাজিক সংস্কারমূলক আন্দোলনের কাজে সাহায্য করেছিল।
ছাপা বই সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছিল শিক্ষার প্রসারে। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে কলকাতা শহর মুদ্রণের পীঠস্থান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মুদ্রাযন্ত্র স্থাপনের পূর্বে লোকের বিদ্যাবুদ্ধি যা কিছু হাতে লেখা পুঁথির মধ্যে ও বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যে নিবদ্ধ ছিল। এরূপ ক্ষেত্রে বিদ্যার প্রসার যে এক অতি সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকত, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সমাজের ওপর ছাপাখানার প্রভাব পড়েছিল এখানেই। ছাপাখানা মুদ্রিত বইয়ের সাহায্যে জ্ঞান ও বিদ্যাশিক্ষাকে সার্বজনীন বা democratized করে তুলেছিল। শিক্ষাবিস্তারের ফলে লোক যখন ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করল, তখন তারা পাশ্চাত্যদেশের চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হল। এই পরিচিতিই তাদের সমাজ, সাহিত্য ও রাজনীতির ক্ষেত্রে নূতন নূতন দিগন্তের দিকে ঠেলে নিয়ে গেল। এই নূতন নূতন দিগন্তের ওপরই উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগৃতি প্ৰতিষ্ঠিত হল। মানুষের মন নূতন আলোকের সন্ধান পেল। মানুষ যুক্তিনিষ্ঠ হল। সেই যুক্তিনিষ্ঠতাই সমাজ সংস্কারকদের অনুপ্ৰাণিত করুল সামাজিক অপপ্ৰথা সমূহ দূর করতে। সেজন্যই সনাতনীদের ছাপাখানার ওপর এক প্ৰচণ্ড রাগ হয়েছিল। কিন্তু ছাপাখানা থেকে যখন হুড়াহুড় করে বই ও সংবাদপত্র বেরুতে লাগল ও দেশের জনসাধারণ তা কিনে পড়তে লাগল, তখন তার স্রোতে ছাপা-বই বিদ্রোহী সনাতনীরাই ভেসে গেল। বস্তুতঃ ছাপা বই না থাকলে, এদেশে শিক্ষার প্রসার সুগম হত না, ও নবজাগৃতিরও আগমন ঘটত না।
এ সম্পর্কে আমাদের আরও স্মরণ করতে হবে যে উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগৃতির ধারা প্ৰধান হোতা ছিলেন যেমন বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, রামমোহন রায়, রাধাকান্ত দেব। প্ৰভৃতি অষ্টাদশ শতাব্দীরই লোক ছিলেন, যদিও নবজাগরণের উদ্বোধনে তাঁদের কর্মপ্ৰচেষ্টা উনবিংশ শতাব্দীতেই আত্মপ্ৰকাশ করেছিল। বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ই ছিলেন এদেশে ইংরেজি শিক্ষার পথিকৃৎ। ইংরেজ মহলে তাঁর ছিল অসাধারণ প্রভাব। তিনিই ইংরেজদের কাছে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন, এবং ১৮১৭ খ্রীস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর ওই কলেজের প্রথম সম্পাদক হন। রামমোহন রায় ছিলেন নবজাগৃতির জনক। তিনিই দেশের লোকের মনে প্ৰথম যুক্তিনিষ্ঠ চিন্তাধারার সঞ্চার করেন। শিক্ষার প্রসারে সহায়ক ছিল স্কুল বুক সোসাইটি। এর পত্তনের সময় থেকেই রাধাকান্ত দেব ছিলেন এর ভারতীয় সম্পাদক। বাংলা ভাষার মাধ্যমে কৃষি ও শিল্প বিষয়ক বিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি সরকারের গোচরীভূত করেন। সংস্কৃত ভাষায় তার অসাধারণ জ্ঞান ছিল৷ ‘শব্দকল্পদ্রুম’’ নামক মহাকোষ তাঁর জীবনের শ্ৰেষ্ঠ কীর্তি।