১৭. কাবুলে দুই নম্বরের দ্রষ্টব্য তার বাজার

কাবুলে দুই নম্বরের দ্রষ্টব্য তার বাজার। অমৃতসর, আগ্রা, কাশীর পুরোনো বাজার যারা দেখেছেন, এ বাজারের গঠন তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে না। সরু রাস্তা, দুদিকে বুক-উঁচু ছোট ঘোট খোপ। পানের দোকানের দুই বা তিন-ডবল সাইজ। দোকানের সামনের দিকটা খোলা বাক্সের ঢাকনার মত এগিয়ে এসে রাস্তার খানিকটা দখল করেছে। কোনো কোনো দোকানের বাক্সের ডালার মত কজা লাগানো, রাত্রে তুলে দিয়ে দোকানে নিচের আধখানা বন্ধ করা যায় অনেকটা ইংরিজীতে যাকে বলে পুটিঙ আপ দি শাটার।

বুকের নিচ থেকে রাস্তা অবধি কিংবা তারো কিছু নিচে দোকানেরই একতলা গুদাম-ঘর, অথবা মুচির দোকান। কাবুলের যে কোনো বাজারে শতকরা ত্রিশটি দোকান মুচির। পেশাওয়ারের পাঠানরা যদি হপ্তায় একদিন জুতোতে লোহা পোঁতায়, তবে কাবুলে তিন দিন। বেশীরভাগ লোকেরই কাজ-কর্ম নেই কোনো একটা দোকানে লাফ দিয়ে উঠে বসে দোকানীর সঙ্গে আড্ডা জমায়, ততক্ষণ নিচের অথবা সামনের দোকানের একতলায় মুচি পয়জারে গোটা কয়েক লোহা ঠুকে দেয়।

আপনি হয়ত ভাবছেন যে, দোকানে বসলে কিছু একটা কিনতে হয়। আদপেই না। জিনিসপত্র বেচার জন্য কাবুলী দোকানদার মোটেই ব্যস্ত নয়। কুইক টার্নওভার নামক পাগলা রেসের রেওয়াজ প্রাচ্যদেশীয় কোনো দোকানে নেই। এমন কি কলকাতা  থেকেও এই গদাইলস্করী চাল সম্পূর্ণ লোপ পায়নি। চিৎপুরে শালওয়ালা, বড়বাজারের আতরওয়ালা এখনো এই আরামদায়ক ঐতিহ্যটি বজায় রেখেছে।

সুখদুঃখের নানা কথা হবে কিন্তু পলিটিক্স ছাড়া। তাও হবে, তবে তার জন্য দোস্তি ভালো করে জমিয়ে নিতে হয়। কাবুলের বাজার ভয়ঙ্কর ধূর্ত তিনদিন যেতে না যেতেই তামাম বাজার জেনে যাবে আপনি ব্রিটিশ লিগেশনে ঘন ঘন গতায়াত করেন কি না— ভারতবাসীর পক্ষে রাশিয়ান দূতাবাস অথবা আফগান ফরেন আপিসের গোয়েন্দা হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। যখন দোকানী জানতে পারে যে, আপনি হাই-পলিটিক্স নিয়ে বিপজ্জনক জায়গায় খেলাধুলো করেন না, তখন আপনাকে বাজার গপ বলতে তার আর বাধবে না। আর সে অপূর্ব গ-বলশেভিক তুর্কীস্থানের স্ত্রীস্বাধীনতা থেকে আরম্ভ করে, পেশাওয়ারের জানকীবাঈকে ছাড়িয়ে দিল্লীর বড়লাটের বিবিসায়েবের বিনে পয়সায় হীরা-পান্না কেনা পর্যন্ত। সে সব গল্পের কতটা গাঁজা কতটা নীট ঠাহর হবে কিছুদিন পরে, যদি নাক-কান খোলা রাখেন। তখন বাদ দরকার টাকায় বারো আনা, চোদ্দ আনা ঠিক ঠিক ধরতে পারবেন।

যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে, তাদের পক্ষে এই বাজার গ অতীব অপরিহার্য। মোগল ইতিহাসে পড়েছি, দিল্লীকে ব্যবসাবাণিজ্যের কেন্দ্র করে এককালে সমস্ত ভারতবর্ষ এমন কি ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে তুর্কীস্থান ইরান পর্যন্ত ভারতীয় হুণ্ডির তাঁবেতে ছিল। গুণীদের মুখে শুনেছি বাঙলার রাজা জগৎশেঠের হুণ্ডি দেখলে বুখারার খান পর্যন্ত চোখ বন্ধ করে কাঁচা টাকা ঢেলে দিতেন। কিন্তু এই বিস্তীর্ণ ব্যবসা চালু রাখার জন্য ভারতীয় বণিকদের আপন আপন ডাক পাঠাবার বন্দোবস্ত ছিল। তার বিশেষ প্রয়োজনও ছিল। হয়ত দিল্লীর শাহানশাহ আহমদাবাদের সুবেদারের (গভর্নর) উপর বীতরাগ হয়ে তাকে ডিসমিসের ফরমান জারী করলেন সে ফরমান আহমদাবাদ পৌঁছতে অন্তত দিন সাতেক লাগার কথা। ওদিকে সুবেদার হয়ত দুহাজার ঘোড় কেনার জন্য আহমদাবাদী বেনেদের কাছ থেকে টাকা ধার করেছেন— ফরমান পৌঁছলে সুবেদার পত্রপাঠ দিল্লী রওনা দেবেন। সে টাকাটা বের করতে বেনেদের তখন ভয়ঙ্কর বেগ পেতে হত— সুবেদার বাদশাহকে খুশী করে নূতন সুবা, নিদেনপক্ষে নূতন জায়গীর না পেলে সে টাকাটা একেবারেই মারা যেত।

তাই যে সন্ধ্যায় বাদশা ফরমানে মোহর বসালেন, সেই সন্ধ্যায়ই বেনেদের দিল্লীর হৌস থেকে আপন ডাকের ঘোড়সওয়ার ছুটত আহমদাবাদে। সেখানকার বিচক্ষণ বেনে বাদশাহী ফরমান পৌঁছবার পূর্বেই সুবেদারের হিসেবে ঢেরা কেটে দিত— পাওনা টাকা যতটা পারত উশুল করত— নূতন ওভারড্রা কিছুতেই দিত

ও দরকার হলে দেবার দায় এড়াবার জন্য হঠাৎ পালিতাণায় তীর্থভ্রমণে চলে যেত। তিনদিন পর ফরমান পৌঁছলে পর সুবেদারের চোখ খুলত। তখন বুঝতে পারতেন বেনে হঠাৎ ধর্মানুরাগী হয়ে পালিতাণার কোন্ তীর্থ করতে চলে গিয়েছিল।

আফগানিস্থানে এখনো সেই অবস্থা। বাদশা কাবুলে বসে কখন হিরাত অথবা বখশান মুবার কোন্ কর্ণধারের কর্ণ কর্তন করলেন, তার খবর না জেনে বড় ব্যবসা করার উপায় নেই। তাই বাজার গপের ধারা কখন কোনদিকে চলে, তার দিকে কড়া নজর রাখতে হয়, আর তীক্ষ্ণবুদ্ধির ফিলটার যদি আপনার থাকে, তবে সেই ঘোলাটে গপ থেকে খাঁটি-তত্ত্ব বের করে আর দশজনের চেয়ে বেশী মুনাফা করতে পারবেন।

আফগানিস্থানের ব্যাঙ্কিং এখনো বেশীরভাগ ভারতীয় হিন্দুদের হাতে। ভারতীয় বলা হয়ত ভুল, কারণ এদের প্রায় সকলেই আফগানিস্থানের প্রজা। এদের জীবন যাত্রার প্রণালী, সামাজিক সংগঠন, পালাপরব সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত কেউ কোনো গবেষণা করেননি।

আশ্চর্য বোধ হয়। মরা বোরোবোহর নিয়ে প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ পড়ে, একই ফোটোগ্রাফের বিশখানা হাজা-ভোতা প্রিন্ট দেখে দেখে সহ্যের সীমা পেরিয়ে যায়, কিন্তু এই জ্যান্ত ভারতীয় উপনিবেশ সম্বন্ধে বৃহত্তর ভারতের পাণ্ডাদের কোনো অনুসন্ধিৎসা কোনো আত্মীয়তাবোধ নেই।

মৃত বোয়োবোদুর গোত্রভুক্ত, জীবন্ত ভারতীয় উপনিবেশ অপাংক্তেয়, ব্রাত্য। ভারতবর্ষের সধবারা তাজা মাছ না খেয়ে শুটকি মাছের কাটা দাঁতে লাগিয়ে একাদশীর দিনে সিথির সিদুর অক্ষয় রাখেন।

কাবুলের বাজার পেশাওয়ারের চেয়ে অনেক গরীব, কিন্তু অনেক বেশী রঙীন। কম করে অন্তত পঁচিশটা জাতের লোক আপন আপন বেশভূষা চালচলন বজায় রেখে কাবুলের বাজারে বেচাকেনা করে। হাজারা, উজবেগ (বাঙলা উজবুক), কাফিরিস্থানী, কিজিলবাশ (ভারতচন্দ্রে কিজিলবাসের উল্লেখ আছে, আর টীকাকার তার অর্থ করেছেন একরকম পর্দা!) মঙ্গোল, কুর্দ এদের পাগড়ি, টুপি, পুস্তিনের জোব্বা, রাইডিং বুট দেখে কাবুলের দোকানদার এক মুহূর্তে এদের দেশ, ব্যবসা, মুনাফার হার, কঞ্জুশ না দরাজ-হাত চট করে বলে দিতে পারে।

এই সব পার্থক্য স্বীকার করে নিয়ে তারা নির্বিকার চিত্তে রাস্তা দিয়ে চলে। আমরা মাড়োয়ারী কিংবা পাঞ্জাবীর সঙ্গে লেনদেন করার সময় কিছুতেই ভুলতে পারি না যে, তারা বাঙালী নয় দুপয়সা লাভ করার পর কোনো পক্ষই অন্য পক্ষকে নেমন্তন্ন করে বাড়িতে নিয়ে খাওয়ানো তো দূরের কথা, হোটেলে ডেকে নেওয়ার রেওয়াজ পর্যন্ত নেই। এখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ অঙ্গাঙ্গি বিজড়িত।

স্বপ্নসম লোকযাত্রা। খাস কাবুলের বাসিন্দারা চিৎকার করে একে অন্যকে আল্লারসুলের ডরভয় দেখিয়ে সওদা করছে, বিদেশীরা খচ্চর গাধা ঘোড়ার পিঠে বসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ফার্সীতে দরকসর করছে, বুখারার বড় কারবারি ধীরে গম্ভীরে দোকানে ঢুকে এমনভাবে আসন নিচ্ছেন যে, মনে হয় বাকী দিনটা ঐখানেই বেচাকেনা, চা-তামাকপান আর আহারাদি করে রাত্রে সরাইয়ে ফিরবেন তার পিছনে চাকর হুকো-কল্কি সঙ্গে নিয়ে ঢুকছে। তারও পিছনে খচ্চর-বোঝাই বিদেশী কার্পেট। আপনি উঠি উঠি করছিলেন, দোকানদার কিছুতেই ছাড়বে না। হয়ত মোটা রকমের ব্যবসা হবে, খুদা মেহেরবান, ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর রসুলেরও আশীর্বাদ রয়েছে, আপনারও যখন ভয়ঙ্কর তাড়া নেই, তখন দাওয়াতটা খেয়ে গেলেই পারেন।

রাস্তায় অনেক অকেজো ছেলে-ছোকরা ঘোরাঘুরি করছে–তাদেরই একটাকে ডেকে বলবে, ও বাচ্চা, চাওয়ালাকে বলত আরেকপ্রস্থ চা দিয়ে যেতে।

তারপর সেই সব কার্পেটের বস্তা খোলা হবে। কত রঙ, কত চিত্রবিচিত্র নক্সা, কী মোলায়েম স্পর্শসুখ। কার্পেট-শাস্ত্র অগাধ শাস্ত্র–তার কূল-কিনারাও নেই। কাবুলের বাজারে অন্তত ত্রিশ জাতের কার্পেট বিক্রি হয়, তাদের আবার নিজের জাতের ভিতরে বহু গোত্র, বহু বর্ণ। জন্মভূমি, রঙ, নক্সা, মিলিয়ে সরেস নিরেস মালের বাছবিচার হয়। বিশেষ রঙের নক্সা বিশেষ উৎকৃষ্ট পশম দিয়ে তৈরী হয়–সে মালের সস্তা জিনিস হয় না। এককালে বেনারসী শাড়িতে এই ঐতিহ্য ছিল— আড়িবেল শাড়ির বিশেষ নক্সা বিশেষ উৎকৃষ্ট রেশমেই হত–সে নক্সায় নিরেস মাল দিয়ে ঠকাবার চেষ্টা ছিল না।

আজকের দিনে কাবুলের বাজারে কেনবার মত তিনটে ভালো জিনিস আছে— কার্পেট, পুস্তিন আর সিল্ক। ছোটখাটো জিনিসের ভিতর ধাতুর সামোভার আর জড়োয়া পয়জার। বাদবাকি বিলাতী আর জাপানী কলের তৈরী সস্তা মাল, ভারতবর্ষ হয়ে আফগানিস্থানে ঢুকেছে।

কাবুলের বাজার ক্রমেই গরীব হয়ে আসছে। তার প্রধান কারণ ইরান ও রুশের নবজাগরণ। আমুদরিয়ার ওপারের মালে বাঁধ দিয়ে রাশানরা তার স্রোত মস্কোর দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে, ইরানীরা তাদের মাল সোজাসুজি ইংরেজ অথবা রাশানকে বিক্রি করে। কাবুলের পয়সা কমে গিয়েছে বলে সে ভারতের মাল আর সে পরিমাণে কিনতে পারে না আমাদের রেশম মলমল মসলিন শিল্পেরও কিছু মরমর, বেশীরভাগ ইংরেজ সাত হাত মাটির নিচে কবর দিয়ে শ্রদ্ধশান্তি করে চুকিয়ে দিয়েছে।

বাবুর বাদশা কাবুলের বাজার দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। বহু জাতের ভিড়ে কান পেতে যে-সব ভাষা শুনেছিলেন, তার একটা ফিরিস্তিও তার আত্মজীবনীতে দিয়েছেন;

আরবী, ফার্সী, তুর্কী, মোগলী, হিন্দী, আফগানী, পশাঈ, প্রাচী, গেবেরী, বেরেকী ও লাগমানী।।

প্রাচী হল পূর্ব-ভারতবর্ষের ভাষা, অযোধ্যা অঞ্চলের পূরবীয়া–বাঙলা ভাষা তারই আওতায় পড়ে।

সে সব দিন গেছে; তামাম কাবুলে এখন যুক্তপ্রদেশের তিনজন লোকও আছে কিনা সন্দেহ।

তবু প্রাণ আছে, আনন্দ আছে। বাজারের শেষ প্রান্তে প্রকাণ্ড সরাই। সেখানে সন্ধ্যার নমাজের পর সমস্ত মধ্যপ্রাচ্য কাজকর্মে ইস্তফা দিয়ে বেঁচে থাকার মূল চৈতন্যবোধকে পঞ্চেন্দ্রিয়ের রসগ্রহণ দিয়ে চাঙ্গা করে তোলে। মঙ্গোলরা পিঠে বন্দুক ঝুলিয়ে, ভারী রাইডিং বুট পরে, বাবরী চুলে ঢেউ খেলিয়ে গোল হয়ে সরাই-চত্বরে নাচতে আরম্ভ করে। বুটের ধমক, তালে তালে হাততালি আর সঙ্গে সঙ্গে কাবুল শহরের চতুর্দিকের পাহাড় প্রতিধ্বনিত করে তীব্র কণ্ঠে আমুদরিয়া-পারের মঙ্গোল সঙ্গীত। থেকে থেকে নাচের তালের সঙ্গে ঝাঁকুনি দিয়ে মাথা নিচু করে দেয়, আর কানের দুপাশের বাবরী চুল সমস্ত মুখ ঢেকে ফেলে। লাফ দিয়ে তিন হাত উপরে উঠে শূন্যে দুপা দিয়ে ঘন ঘন ঢেরা কাটে, আর দুহাত মেলে দিয়ে বুক চেতিয়ে মাথা পিছনের দিকে ঠেলে বাবরী চুল দিয়ে সবুজ জামা ঢেকে দেয়। কখনো কোমর দুভাজ করে নিচু হয়ে বিলম্বিত তালে আস্তে আস্তে হাততালি, কখনো দুহাত শূন্যে উৎক্ষিপ্ত করে ঘূর্ণি হাওয়ার চর্কিবাজি। সমস্তক্ষণ চর ঘুরেই যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে।

আবার এই সমস্ত হট্টগোল উপেক্ষা করে দেখবেন, সরাইয়ের এক কোণে কোনো ইরানী কানের কাছে সেতার রেখে মোলায়েম বাজনার সঙ্গে হাফিজের গজল গাইছে। আর পাঁচজন চোখ বন্ধ করে বুদ হয়ে দূর ইরানের গুল বুলবুল আর নিঠুরা নিদয়া প্রিয়ার ছবি মনে মনে একে নিচ্ছে।

আরেক কোণে পীর-দরবেশ চায়ের মজলিসের মাঝখানে দেশবিদেশের ভ্রমণকাহিনী, মেশেদ-কারবালা, মক্কা-মদিনার তীর্থের গল্প বলে যাচ্ছেন। কান পেতে সবাই শুনছে, বুড়োরা ভাবছে কবে তাদের উপর আল্লার করুণা হবে, মৌল কবে তাদের মদিনায় ডেকে নিয়ে যাবেন, প্রাণ তো ওষ্ঠাগত,–

লবোঁ পর হৈ দম আয় মুহম্মদ সমহালো,
মেরে মৌলা মুঝে মদিনে বোলা লো!

ঠোঁটের উপর দম এসে গেছে বাঁচাও মুহম্মদ,
হে প্রভু আমায় ডাকো মদিনায়, ধরেছি তোমার পদ।

 

পুস্তিন ব্যবসায়ীর কুঠরিতে কবির মজলিস। অজাতশ্মশ্রু সুনীল গুম্ফ, কাজল-চোখ, তরুণ কবি মোমবাতির সামনে হাঁটু মুড়ে বসে তুলোট কাগজে লেখা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন। তার এক পদ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তামাম মজলিস একগলায় পদের পুনরাবৃত্তি করছে–মাঝে মাঝে উৎসাহিত হয়ে মরহাবা, আফরীন, শাবাশ বলে উচ্চকণ্ঠে কবির তারিফ করছে।

চার সর্দারজীতে মিলে একটা পুরানো গ্রামোফোনে নখের মতো পালিশ তিনখানা রেকর্ড ঘুরিয়ে বাজাচ্ছে—

হরদি বোতলাঁ
ভরদি বোতলাঁ
পাঞ্জাবী বোতলাঁ
লাল বোতলাঁ

হায়, কাবুলে বোতল বারণ। কে জানত, শ্রবণেও অর্ধপান!

আর আসল মজলিস বসেছে কুহিস্থানের তাজিকদের আড্ডায়। হেঁড়ে গলায় আকাশ-বাতাস কাঁপয়ে, দেয়াল-পাথর ফাটিয়ে কোরাস  গান,

আয় ফতু, জানে মা–
ফতুজান,
ফতুজান,
বর তু শওম কুরবা—আ—আ—ন।

কুরবানের আ দীর্ঘ অথবা হ্রস্ব, অবস্থা ভেদে সম মেলাবার জন্য। উচ্চাঙ্গের কাব্যসৃষ্টি নয়, তবু দরদ আছে,

ওগো ফতুজান,
তুঁহারি লাগিয়া দিল-জান দিয়া
হব আমি কুরবান!

উত্তরে ফতুজান যেন অবিশ্বাসের সুরে বলছেন,

–চেরা রফতী
হীচ ন্ গুফতী
দূর হিন্দুস্থান?

অর্থাৎ

কেন গেলে
আমায় ফেলে
দূর হিন্দুস্থান?

সহস্রপাদ বৈষ্ণব পদাবলীতে যখন এ-প্রশ্নের উত্তর নেই, তখন তাজিক ছোকরার লোক-সঙ্গীতে তার উত্তরের আশা করেন কোন্ অভিনব মম্মট? মথুরার সিংহাসন জয় হিন্দুস্থানে রাইফেল ক্রয়, দুটোই বদখদ বেতালা উত্তর। হাজারো যুক্তি দিয়ে গীতা বানিয়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন, কিন্তু মথুরাজয়ের যুক্তির হাল যমুনায় পানি পাবে না বলেই তিনি সেটা ব্রজসুন্দরী শ্রীরাধার দরবারে পেশ করেননি।

বলহীকের বল্লভও তাই নীরব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *