কাগজের একটা বিশেষ সংখ্যা বেরুবে। ফারুক তাই কদিন হলো আপিসে অত্যন্ত ব্যস্ত। দুপুরেই চলে যায়, আসে অনেক রাতে। সারা দুপুরটা তাই একেলাই কাটে তাহমিনার। তবু একেলা নয়। অনভিজ্ঞ নতুন মা–র হাজারো ব্যস্ততায় সময় তার গড়িয়ে যায় কখন। মাত্র চার মাস বয়স হয়েছে বাবুর ছেলেকে তারা আদর করে ডাকে বাবু—-তবু তারি দস্যিপনায় তাহমিনা অস্থির। দেখতে হয়েছে ঠিক তার মত। তেমনি গৌর, তেমনি নাকের গড়ন। সব কিছু তাহমিনার মতই। মাঝে মাঝে অপলক চোখে বাবুর দিকে তাকিয়ে এই সাদৃশ্য দেখে তাহমিনা।
আজ দুপুরে বাবু জেগে রয়নি তাকে বিরক্ত করবার জন্যে। কাঁদে নি। মাই খেতে খেতে যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন দোলনায় শুইয়ে দিয়েছে তাকে। তারপর সেই ফাঁকে সেরে নিয়েছে নিজের নাওয়া খাওয়া। দুপুরে যাবার সময় ফারুক আয়নার সামনে শেষবার চিরুনি চালাতে চালাতে চাপা হাসি গলায় ডেকেছে, বাবুর মা, ও বাবুর মা।
বারান্দায় কী একটা কাজ করছিল তাহমিনা। হঠাৎ করে এমন একটা ডাক শুনে তার বুকের ভেতরে রক্ত ছাৎ করে উঠেছে। বলেছে, যাঃ।
আহা, শোনোই না ইদিকে।
ডাকটা নতুন আর কেমন মিষ্টি লেগেছিল তার কাছে। আর একবার শুনতে তার সাধ হলো। এসে বলল, কী বলছ শুনি?
আরো কাছে এসো।
কাছে আসতেই ফারুক একেবারে আড়কোলা করে তুলে বুকের সাথে চেপে ধরেছে।
দিন দুপুরে একি! ছাড়ো, ছাড়ো বলছি।
ফারুকের এই খামকা ব্যবহারে তাহমিনা সত্যি সত্যি একটু বিরক্ত হয়েছিল। কিন্তু সে ছাড়ে নি তবুও। চেপে ধরে গালের ওপর একে দিয়েছে অনেকক্ষণ ধরে চুম্বনচিহ্ন
নাওয়া খাওয়া শেষ করে ঘরে এসে আয়নার সামনে সে দাঁড়িয়ে দেখল, এখনো সেখানে ফিকে লাল আভা। ছি, ছি, ফারুকটা কী। এমন করে নাকি কেউ? বারান্দায় এসে সারা মুখ রগড়ে ধুয়ে ফেলল আবার। এরচে সারামুখ লাল দেখাক, তাও ভালো। তারপর বুলোলো একটু পাউডার প্রলেপ সেটা ঢাকবার জন্যে। তারপর বাবুর দোলনার পাশে বেতের একটা চেয়ার টেনে বসলো ছোট্ট একটা সেলাই হাতে করে। বাইরে স্নান হলুদ রোদে মন্থর প্লাবিত পথ। দুএকটা বাড়ির ছাদে বাতাসে কাঁপছে শাড়ি। আর কেমন নিস্তব্ধতা। ঠিক স্তব্ধ নয়, তবুও শব্দ নেই যেন কোনোখানে। টেবিল কাকে তিনটের ঘর পেরিয়ে গেল ঘণ্টাব কাঁটা। তাহমিনা এব বার অলস চোখ তুলে সময় দেখলো।
ঝি এসে বলল, আপামণি।
কিরে?
কে একজন ভদ্রলোক বাইরে নিচেয় দাঁড়িয়ে।
কে ভদ্রলোক? কাকে চায়?
জাকি নয়ত? লাবলু নয়ত? কে এলো এখন! ফারুকের কাছে তো কেউ আসে না বড় একটা। আর এমন উদ্বিগ্ন হলো কেন সে খামোকা? ঝি উত্তর করলো, আপনার কথাই বললেন।
আমার কথা? নাম বললেন?
না।
হয়ত নাম শুনে আসবার জন্যে ঝি দরোজার দিকে পা বাড়ালো, এমন সময় সিঁড়ি দিয়ে কার উঠে আসবার শব্দ শোনা গেল। তাহমিনা উঠে বারান্দায় এসে দেখলো আবিদকে! আবিদ একটা ধাপের ওপর পা রেখে দেখল তাহমিনাকে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল তারা। তাহমিনা অস্ফুট স্বরে বলল, তুমি!
আবিদ কিছু একটা বলতে গিয়ে পারল না। একবার মাথা কুঁকালো শুধু অস্পষ্ট ভঙ্গিতে।
তাহমিনার মনে হয়েছিল প্রথমে, এই যে মানুষটা তার চোখের সমুখে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে সে কোনদিনও চিনতো না। দীর্ঘ সেই মানুষটার দেহ কী এক ক্লান্তির ভারে নুয়ে এসেছে যেন ঈষৎ। পরনে ছাই ছাই স্যুট—-তাতে আরো ম্লান আরো বিষণ্ণ দেখাচ্ছে তাকে। আর কী অসম্ভব স্থবির তার উপস্থিতি। বাঁ হাতে শিরা ফুটে উঠেছে দৃঢ়তায় নয়, দৌৰ্ব্বল্যে। হয়ত তাই। একটা রেখার মত, একটা অবাস্তব অথচ অনস্বীকার্য উপস্থিতির মত, পৃথিবীর। আতঙ্কের মত ওই মানুষটার আশ্চর্য উপস্থিতি।
তাহমিনা তেমনি অস্ফুটস্বরে, কেন না এর চেয়ে উঁচু পর্দা তার এখন এলো না, উচ্চারণ করল, এসো।
কিন্তু শোনা গেল না বুঝি তার সেই স্বর। কেননা আবিদ এতটুকু নড়ল না তার অবস্থান বিন্দু থেকে। পরে তাহমিনা এক পা পেছুলো, মুখ করলো তার কামরার দিকে। আর তখন আবিদ উঠে এলো একেকটা সিঁড়ি অনেক সন্তর্পণে মাড়িয়ে, রেলিংয়ে বাম করতাল ছুঁইয়ে চুঁইয়ে। নিঃশব্দে দুজনে গিয়ে ভেতরে বসলো। চৌকাঠে পা রেখেই আবিদের চোখ পড়েছিল দোলনার ওপরে। সে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল এক মুহূর্তের জন্যে। প্রথমে কিছুটা বিস্ময়, তারপর একটা চাপা হিংস্রতা যেন তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। এক ধরনের তীব্র হিংসায়। নীল ধ্বক ধ্বক করল তার চোখ।
আর তাহমিনা হয়ত সে সময়ে আর্ত চিৎকার করে উঠতো। কিন্তু ওঠেনি। সে চাইল বাবুকে তার দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখতে। ভীষণ একটা ভয় ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে তার ভিতরে ছড়িয়ে পড়ল। ভাবল, আবিদ কি করবে এর পর? এদ্দিন বাদে কেন সে এলো ঢাকায়? যদি কিছু একটা অনর্থ বাধিয়ে ফেলে আজ, এখুনি! তাহলে কী সে করবে? দেড় বছর ধরে যে সাহস ছিল তার চোখে এখন এক মুহূর্তে তা ভীরু হয়ে গেল। আবিদ যদি কোনদিন তার মুখোমুখি হয়, সে ভেবেছিল, কিছুই সে হতে দেবে না। হার মানবে না। অথচ আজ সামনাসামনি দাঁড়িয়ে শুধু অসহায় লাগল তার নিজেকে। একটু আগেই সে আবিদের চোখে দেখেছে হিংসার নীল আভা; সে কথা ভেবে পর মুহূর্তেই কঠিন হয়ে এলো তাহমিনা। ঋজু শান্ত ভঙ্গিতে আবিদকে একটা চেয়ার দেখিয়ে দিল একটু দূরে।
আবিদের সহসা ভীষণ তীব্র একটা সাধ হলো বাবুকে দেখবার। তার মনে হলো দোলনার ওপর শুধু ঘুমিয়ে থাকা এক শিশু নয়, তার চেয়ে আরো কিছু বেশি এবং অন্য কিছু সে দেখতে পাবে। তাহমিনার গর্তে যে সন্তানের জন্ম, তার মুখের আদল কেমন, তা সে দেখতে চায়। কিন্তু তাহমিনার সেই ঋজু ভঙ্গি তাকে বিহ্বল করে দিল। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সে বসলো চেয়ারে। তারপর শরীর এলিয়ে দিল অলস ভঙ্গিতে।
সমস্ত কামরায় এখন তীব্র নিস্তব্ধতা। কেউই শুরু করল না প্রথমে কোনো কথা। কিন্তু দুজনেই যেন বুঝতে পারল এ ভারী অশোভন হচ্ছে। তাই দুজনেই চাইল একটা কিছু বলতে। অনেকক্ষণ পরে, প্রথমেই তাহমিনা, কবে এসেছ?
কামরার দূর প্রান্তে দাঁড়িয়ে তাহমিনা। তার স্বর যেন তীরের মত বিদীর্ণ করল সহসা এই স্তব্ধতাকে। আবিদ চোখ তুলে উত্তর করল, কাল। যেন যথেষ্ট বলা হল না, এই ভেবে সে আবার বলল, কাল ভোরে। হোটেলে উঠেছি।
ও।
তাহমিনা উচ্চারণ করল না, একবার চোখ তুলেই নামিয়ে নিল। তারপর সেও বসল একটা চেয়ারে আস্তে আস্তে পিঠ ধরে। আবিদেব বসে থাকা ভঙ্গি দেখে সহসা তার মনে হলো যেন লাফ দেবার পূর্ব মুহূর্তে একটা বাধ ওঁৎ পেতে বসে আছে। যে কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে অন্ধের মত। তাহমিনা বলল, কেন তুমি এলে?
আবিদ এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। একটু পরে ধীরে ধীরে বলল, এমন করে চলে এলে কেন তাহমিনা? আমাকে বললে না, কাউকে বললে না। ফারুকের কথা আমি জানতামও না। আমি হাসপাতালে, শেষবার দেখাও করলে না।
আবিদের প্রত্যেকটা বাক্যের ভেতরে বেশ কিছুটা করে যতি। অনেক বড় কোন কথার যেন মাঝখান থেকে তুলে তুলে সে বলে গেল। তবু তাহমিনা বুঝতে পারল স্পষ্ট, কী সে বলতে চাইছে।
সে শান্ত গলায় বলল, আমার এ ছাড়া কোনো পথ ছিল না।
আবিদ একটুকাল তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর, কিন্তু আমার সাথে তোমার বিয়ে হয়েছিল। আমি তোমার স্বামী। কথাটা বলে নিজেই যেন চমকে উঠল সে। নতুন কথার মত শোনাল তার নিজেরই সংলাপ। আর এন তাহমিনার দিকে ভালো করে তাকিয়ে সে অনুভব করল, তাহমিনা তার কত দূরে সরে গেছে। তাকে সে আর স্পর্শও করতে পারবে না। এমনি দূর।
তাহমিনার কানে এই আমি তোমার স্বামী বাজলো একটা তীব্র ধাতব সংঘাতের মত। সে চুপ করে রইলো। আবিদ হঠাৎ আঙ্গুল তুলে শুধালো, খোকা?
হ্যাঁ।
কী নাম?
বাবু।
ও কোথায়?
আপিসে।
তাহমিনা অপেক্ষা করছিল, হয়ত আবিদ এখুনি দোলনার কাছে এগিয়ে যাবে। তার মনে হলো হয়ত একতাল মোমের মত দুহাতে তুলে পিষে ফেলবে বাবুকে। একটা তীক্ষ্ণ শংকা তাকে বিদ্ধ করল। কিন্তু আবিদ উঠলো না, দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল দ্রুত। তাহমিনা আশ্চর্য রকমে ব্যথিত হলো। সে যদি তা করত, তাহলে কি সত্যি সত্যি সে খুশি হতো? হঠাৎ আবিদ স্বর পালটে নরম গলায় বলল, তাহমিনা, একটা কথা তোমায় বলব?
বলো।
কেন তার কণ্ঠ এমন কোমল হলো? না না। নিজেকে মনে মনে অভিশাপ দিল তাহমিনা।
অবিশ্যি জানিনে বলবার মত দাবি আমার এখনো আছে কিনা, তাই প্রথমেই জিগ্যেস করে নিলুম।
আবিদ কী কথা বলতে চায় যে যার জন্যে এত ভূমিকার প্রয়োজন? প্রথমে যে দুর্বলতা তাকে ভর করেছিল, এখন আর তা নেই। মনে মনে কঠিন হলো সে। বিন্দুমাত্র সহানুভূতি জাগল তার মনে। অথবা জাগলেও তা এত ক্ষীণ যে সে বুঝতে পারল না। তার চোখে ফুটে উঠল চাপা উপেক্ষার বিদ্যুৎ।
এমন করে আর কদ্দিন তাহমিনা? নিজের বৌ চলে গেলে লোকে কত কথা বলে, সেটা ভাবলে না? এমন করে তুমিই বা কী করে থাকবে? সমাজের স্বীকৃতি ছাড়া? আমি তোমাকে কোনদিন কি ভালোবাসিনি? তোমাকে আমি আজো ভালোবাসি। দেড় বছর ধরে শুধু ভেবেছি, শেষ অবধি দেখেছি তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। তুমি চল।
আর ফিরবার পথ নেই আমার।
নেই?
না। আর সমাজের কথা বলছ? ইচ্ছে হলে আইনে যেমন করে হয় ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার ব্যবস্থা করলেই খুশি হব।
সেতো দেড় বছর আগেই হয়ে গেছে। আইন আর এদ্দিনে আমি তুলবো না। তাছাড়া মনের একটা নিজস্ব আইন আছে। তাকে সম্মান করতে জানি।
তাহমিনার মনে হলো একটা সম্পূর্ণ নতুন মানুষের সঙ্গে সে কথা বলছে যেন। এমনকি কথা বলবার ভঙ্গি কত বদলে গেছে আবিদের। সে উৎকর্ণ হয়ে শুনলো তার সংলাপ। আর কী আশ্চর্য, এমন কী তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, এই বাচন ভঙ্গির পরিবর্তন তার মনে এক শিশু কৌতূহলের জন্ম দিল। সে ভালো করে তা বুঝতে পারল না, যেন এই কৌতূহলের একটা নিজস্ব সত্তা আছে, আপনা আপনি একটি সুন্দরের মত তা গড়ে উঠল।
তাহমিনা প্রশ্ন করল, তাহলে কেন তুমি এলে?
তোমাকে নিয়ে যেতে।
আমি এখন মা, আর তা হয় না। যদি আমাকে কোনদিন ভালোবেসে থাকো তাহলে বাবুর জন্যে তুমি পাকাপাকি বিচ্ছেদের ব্যবস্থা কোরো। তুমি এসেছ, না হলে হয়ত নিজেই লিখতুম তোমাকে।
লিখতে? আমাকে?
হ্যাঁ। বাবুর ভবিষ্যৎ আমি ভাববো না?
আবিদ কোনো কথা বলল না। সে জানল, তাহমিনার সন্তান আজ তার শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাহমিনা কোন দিন এমন করে বলতে পারে তা সে ভাবতেও পারেনি। দুরাশা ছিল, হয়ত মুখোমুখি দাঁড়ালে সে আর না করতে পারবে না, ফিরে আসবে। সে কথা আফিয়াও বলেছিল, দেখো তুমি নিজে গেলে, ও কিছুতেই না এসে পারবে না। হাজার হোক তুমি ওর স্বামী তো।
উত্তরে সে বলেছিল, কিন্তু যদি সে না আসে, তাহলে আমি ছোট হয়ে যাব যে ভাবী। এখন তবু প্রায় ভুলে গেছি, আর কিছুদিন পরে হয়ত মনেই থাকবে না, সেই ভালো। মাঝখান থেকে চোখে দেখে ক্ষতটাকে বাড়াতে চাইনে ভাবী।
আফিয়া মনোযোগ দিয়ে শুনে তারপর বলেছে, এ তোমার মিছে ভাবনা। ও আসবেই, না এসে পারে না।
না, না।
আফিয়া এবার অভিমান করে স্নেহের রাগে গলা ভিজিয়ে বলেছে, আমি তোমার সংসার কদ্দিন দেখব? আমি মরে গেলে?
মরবার বয়স আপনার হয়নি।
তবুও তো। তোমার নিজের লোক থাকতে তুমি এমন করে কষ্ট করবে কেন?
আবিদ উত্তর করেছে, কষ্ট আমার কিছু নেই, বেশ আছি। আর আপনি যেতে চাইলে আমি ছাড়ব কেন?
না, না, তুমি ঢাকায় যাও। তুমি ওর সাথে দেখা করো।
আবিদও কিছুদিন হলো কথাটা ভাবছিল। নতুন করে অনুভব করেছিল তাহমিনার অনুপস্থিতি আর বুকের শূন্যতা। তীব্রতর হয়ে উঠেছিল তাকে কাছে পাবার বাসনা। প্রতিটি মুহূর্ত, তাহমিনা নেই এই কথা গুমরে মরেছে তার ভিতরে। নিজেকে মনে হয়েছে আরো অসহায়। প্রথম সেই আঘাতের পর জোর করে কিছু দিন তাকে ভুলে ছিল, কিন্তু শেষ অবধি তা পারে নি। আফিয়া যতক্ষণ কাছে কাছে থাকে, ততক্ষণ কিছুই মনে হয় না তার। কিন্তু সে একটু দূরে সরে গেলেই তার একাকীত্ব সে অনুভব করতে পারত ভয়াবহভাবে। সে জানে তাহমিনা কেন চলে গেছে, কি সে পায়নি; তবু অভিমান হতো সে কেন চলে গেল বলে। সে কি থাকতে পারত না? তার নিষ্ফল নির্বীজ জীবনে যে সামান্য শেষ ভালোবাসাটুকু ছিল সম্বল, তাকে সে উপড়ে দিয়ে গেল কেন? শুধু তাকে, সে ভালোবাসতে পারত না? সমস্ত অভিযোগ সব অভিমান দলা পাকিয়ে বুকের ভেতরে ভারী হয়ে কণ্ঠনালী রুদ্ধ করে দিতে চাইত।
সবাই যখন শুয়ে পড়ে, তখন শোবার ঘরে আবিদের ঘুম আসে না কিছুতেই। বিরাট খাটের শূন্যতার ওপর এপাশ ওপাশ করে শুধু ও। আনমনে, কিংবা দুরাশায় চোখ বুজে পাশে হাত বুলোয়, হয়ত তাহমিনার দেহগর্শ ঠেকবে এই ভেবে। কখনো কখনো শয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। খালি পায়ে পায়চারি করে কার্পেটের ওপরে। নিরর্থক তাকিয়ে থাকে ছোট করে রাখা বেডল্যাম্পের দিকে। তারপর জানালার কাছে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে চোখ মেলে দেয়। সহসা মুখ ফিরিয়ে বলে তুমি কেন গেলে তাহমিনা?
যেন তাহমিনা এ কামরাতেই আছে শুনতে পাবে।
দিনে দিনে তাহমিনার অভাব তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল তার কাছে। সে বুঝেছিল, তাহমিনাকে ছাড়া তার বেঁচে থাকা নিরর্থক। তার ভালোবাসা তার কাম্য। সে তাহমিনাকে ফিরিয়ে আনবেই।
ঢাকায় এসে জাকিদের বাসায় ওঠেনি। হোটেলে গেছে। মালেকাবাণুর সাথে দেখাও করে নি। দুপুরে গেছে জাকির আপিসে। বাইরে সেই মরিস দাঁড়িয়ে আবিদের মনে পড়েছিল বিয়ের পর সে আর তাহমিনা এই কারে করেই গিছল নারায়ণগঞ্জে। স্টিমারঘাট অবধি। এগিয়ে দিতে এসেছিল সবাই। পাশে ছিল লিলি। জাকি ড্রাইভ করছিল। আর লাবলু তার পাশে। কামাল সাহেব আর মালেকাবাণু বাড়িতেই ছিলেন। আর মনে পড়ল স্টিমারের ডেকে বসে অন্ধকার আকাশে দুজনের তারা দেখার কথা। একটা তারার ভুল নাম বলেছিল সে। তাহমিনা শুধরে দিয়েছে, ওটা কাল-পুরুষ।
জাকি ওকে যেন ঠিক আশা করতে পারেনি। দেড় বছর হয়ে গেল যে আসেনি, চিঠি দিয়েছে খুব কম, সে যে এমন করে হঠাৎ এসে পড়বে তা সে ভাবতে পারেনি। প্রথম দেখার উচ্চসটা জাকির কমে এলে পর আবিদ নিজেই জিগ্যেস করেছে তাহমিনার কথা। উত্তরে ও বলেছে, যা হয়ে গেছে তারপর থেকে ওকে আমি নিজের বোন বলে আর স্বীকার করতে পারিনি। আমরা মনে করি, তাহমিনা মরে গেছে।
আবিদ চুপ করে শুধু পেপারওয়েট আঙুলে ঘুরিয়েছে টেবিলের রেকিসন জমিনে। তারপর জাকি একটু থেমে বলেছে বেশ কিছুদিন আগে একটা খবর পেয়েছিলুম ওর নাকি ওর নাকি ছেলে হবে। কাউকে বলিনি বাসায়। শুনলে মা আরো দুঃখ পেতেন।
ও অবাক হয়ে প্রতিধ্বনি করেছে, ছেলে!
তারপর নিজেই মাথা নেড়েছে না অবাক হবার কী আছে।
সেই জাকির কাছ থেকেই নিয়েছে সে ঠিকানা। তাহমিনা সন্তানবতী, এদ্দিনে হয়ত সে মা। কেমন নতুন নতুন ঠেকল কথাটা। তাহমিনা যখন মা, তখন তাকে দেখাবে কেমন?
দেখতে সেই দেড় বছর আগের মতই। শুধুমাত্র পরিবেশটা ভিন্ন। কিন্তু ভেতরে যে কতখানি বদলে গেছে, সম্পূর্ণ সে আলাদা হয়ে গেছে, তা বুঝতে পারল যখন তাহমিনা উচ্চারণ করল —-বাবুর ভবিষ্যৎ আমি ভাবব না? এখন তার আর তাহমিনার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে ফারুক নয় বাবু। আবিদ উচ্চারণ করল, আমার কথা তুমি ভাববে না? একটু থেমে, আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছি তাহমিনা। তুমি কি কিছুতেই যেতে পার না?
এ প্রশ্নের কি জবাব দেবে তাহমিনা? এ কথার কোনো উত্তর দেয়া যায় না। তাহমিনা তাই চুপ করে বসে রইল। তার চোখ আনত হলো কোলের ওপর। আবিদ আসবার সময় ভেবেছিল যেমন করেই হোক তাহমিনাকে সে ফিরিয়ে আনবেই। কিন্তু এসে অবধি সেই দৃঢ়তা সে তার স্বরে, তার ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলতে পারল না। শুধু একটি অবোধ্য আকুতি হয়ে রইল তার সমস্ত কথা। এখন সে শুধু তার দিকে তাকিয়ে রইল।