১৭. কর্মহীন লোক

কর্মহীন লোক

কর্মহীন লোক নানান কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। মতিনউদিনের বেলায় এই কথাটি সর্বাংশে সত্য। তিনি নানা কাজে প্রায়ই ব্যতিব্যস্ত থাকেন। তাকে দেখে মনে হতে পারে–এমন কাজের একজন মানুষ নিজের সংসার কোন চালাতে পারছেন না। তার অনেক কর্মকাণ্ডের একটি হচ্ছে রাজনৈতিক বিষয়ে নিয়ে প্ৰবন্ধ রচনা। তিনি তার প্ৰবন্ধগুলো দেশের সবকটি দৈনিকে নিয়মিত পাঠান। এখন পর্যন্ত তার কোনো প্ৰবন্ধ প্রকাশিত হয় নি। তবে সম্পাদকের কাছে লেখা দুটি চিঠি ছাপা হয়েছে। একটি দৈনিক বাংলায় এবং একটি সংবাদে। তিনি পত্রিকার কাটিং ফাইল বের করে রেখেছেন।

আজো তিনি খুব ব্যস্ত। একটি দীর্ঘ প্ৰবন্ধ শুরু করেছেন। এটি রাজনৈতিক প্ৰবন্ধ নয়। তবে শিক্ষামূলক প্রবন্ধ, প্রবন্ধের নাম–‘নারী জাগরণের প্রয়োজনীয়তা ও অপ্ৰয়োজনীয়তা’।

শিরোনামটি তার খাতার ওপর লেখা। প্ৰবন্ধ শেষ হবার পর ঠিক করবেন কোন শিরোনামটা শেষ পর্যন্ত যাবে। বাকি তিনটি শিরোনাম হলো–
১. আমার চক্ষে নারী।
২. বেগম রোকেয়া থেকে মাদার তেরেসা।
৩. হে নারী।

এখন রাত বাজছে সাড় আটটা। টিভিতে বাংলা খবর শেষ হয়ে গেছে। নৃত্যের তালে তালে’ নামের নাচের একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে। মতিনউদ্দিন টিভির সামনেই বসে আছেন। তবে টিভি দেখছেন না বা শুনছেনও না। টিভির সাউন্ড অফ করে দেয়া আছে।

টিভির বাংলা সংবাদ মতিনউদ্দিন সাহেব সব সময় শোনেন। কর্মহীন লোকরা দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকেবহাল থাকতে ভালোবাসে এবং এটাকে তার প্ৰধান দায়িত্বের একটি বলে মনে করে। মতিনউদ্দিন সাহেব শুধু যে টিভির সংবাদ শোনেন তা না, বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকাও শোনেন। আগে রেডিও পিকিঙের এক্সটারনাল সার্ভিস শুনতেন। ইদানীং শোনেন না, কারণ তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে খবর দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

বেছে বেছে আজকের দিনটাতেই মতিনউদ্দিন টিভির খবর শুনলেন না। নারী বিষয়ক প্ৰবন্ধে অতিরিক্ত মনোযোগ দেবার কারণে এই ঘটনাটা ঘটল। আজ টিভি শুনলে তিনি বড় রকমের বিস্ময়ে অভিভূত হতেন। কারণ আজ এস.এস.সি.র রেজাল্ট হয়েছে। টিভিতে তার মেজো কন্যা নাদিয়া মেহজাবিন-এর নাম বলা হয়েছে। আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় থেকে নাদিয়া মেহজাবিন আটটি লেটার নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগে ছেলে ও মেয়ে সবার মধ্যে প্রথম হয়েছে।

রাত দশটায় সুরাইয়া স্বামীর ঘরে ঢুকলেন। মতিনউদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, এখন ভাত খাব না। তোমরা খেয়ে নাও। আমি যখন লেখালেখির কোনো কাজে ব্যস্ত থাকি তখন আমাকে খাওয়াদাওয়ার মতো তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে বিরক্ত করবে না। এই কথাটা কতবার বলতে হবে?

সুরাইয়া বললেন, আজ এস.এস.সি’র রেজাল্ট হয়েছে। আটটার বাংলা সংবাদে বলেছে।

মতিনউদ্দিন স্ত্রীর কথার সঙ্গে সঙ্গে ফোঁপানির শব্দ শুনলেন। তাকিয়ে দেখলেন দরজা ধরে নাদিয়া দাঁড়িয়ে আছে। সে ফোঁপাচ্ছে এবং তার চোখ দিয়ে সমানে পানি পড়ছে। মেয়েদের চরিত্রের এই দুর্বলতায় তিনি খুবই বিরক্ত হলেন। মাত্র টিভিতে রেজাল্ট ডিক্লেয়ার করেছে। পাস-ফেল জানতে জানতে আরো দুদিন–এর মধ্যেই নাকের জলে চোখের জলে একাকার। তার রাগ উঠে গেল। তিনি প্রবন্ধের স্বার্থে রাগ সামলাবার চেষ্টা করলেন। মাথায় রাগ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী জটিল প্ৰবন্ধ লেখা যায় না। মতিনউদ্দিন গাখীর গলায় বললেন–গাধা মেয়ে কাঁদছ কেন?

সুরাইয়া নিজেও কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন–তোমার মেয়ে ফার্স্ট হয়েছে। আটটা লেটার পেয়েছে।

কী বললে?

ওদের ক্লাসের হেডমিস্ট্রেস এসেছেন। মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। স্কুল থেকে দুজন টিচারও এসেছেন।

নাদিয়া ফার্স্ট হয়েছে? কী বলছি। এইসব! সে ফার্স্ট হবে কী জন্যে?

সুরাইয়া এইবার সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলে বললেন–আমার বিশ্বাস হয় না। তুমি নিজে একটু নাদিয়ার হেডমিস্ট্রেসের সঙ্গে কথা বল। আমার মাথা যেন কেমন করছে।

উনাদের চা-টা দাও। আমি যাচ্ছি। ফলস নিউজ হতে পারে। হয়তো নাদিয়ার নামে নাম একটা মেয়ে ফার্স্ট হয়েছে বেকুব হেডমিসট্রেস মনে করেছে তোমার মেয়ে।

টিভিতে ওদের স্কুলেরও নাম বলেছে।

বাংলাদেশ টিভির নিউজের কোনো মূল্য আছে? মূল্য থাকলে আমরা ব্যাটারি পুড়িয়ে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা শুনি? পাঞ্জাবিটাতে ইন্ত্রি দিয়ে দুটা ডলা দিয়ে দাও-আমি দেখছি ব্যাপার কী? অল্পতে অস্থির হয়ে না। অস্থির হবার মতো কিছু নাই। বোঝাই যাচ্ছে ফলিস নিউজ।

রাত এগারটার ভেতর মতিনউদ্দিন জেনে গেলেন ঘটনা সত্যি। মিষ্টি নিয়ে নাদিয়ার বড়ফুফু চলে এসেছেন। নাদিয়ার স্কুলের কিছু বান্ধবী এসেছে। আশপাশের বাসার কিছু মহিলা এসেছেন। সবকটা পত্রিকা অফিস থেকে লোক এসেছে। বাবা-মা দুপাশে মেয়ে মাঝখানে এইভাবে ছবি তোলা হবে। মতিনউদ্দিন রাজি হলেন না। তিনি বিনীত গলায় বললেন, ভাই আমি আমার মেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে কিছুই জানি না। ওদের দিকে কোনোদিন লক্ষ করি নি। আজ যদি মেয়েকে সাথে নিয়ে ছবি তুলে পত্রিকায় ছাপাতে দেই সেটা খুবই অন্যায় হবে। মেয়ে তার মাকে নিয়ে ছবি তুলুক। সেটাই হবে ঠিক এবং শোভন। মতিন সাহেব কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হলেন। মেয়ের জন্যে কোনো একটা উপহার। কিনতে ইচ্ছে করছে। এত রাতে দোকানপাট সব বন্ধ থাকার কথা। তারপরেও চেষ্টা করে দেখা। কিছু কিছু দোকান অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। একটা ভালো হাতঘড়ি কি পাওয়া যাবে? মেয়েটা ঘড়ি ছাড়া পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষা শেষ পর্যায়ে তিনি ব্যাপারটা লক্ষ করছিলেন। পরীক্ষার জন্যে ঘড়িটা প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু এই মেয়ে মুখফুটে তা বলে নি। ভালো একটা ঘড়ির কত দােম পড়বে কে জানে। তার কাছে এত টাকা নেই। টাকা। যা ছিল সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। ছ সাত শ’র বেশি হবে না। এই টাকায় ভালো ঘড়ি হবে না। একটা কলম কিনে দেয়া যায়। কলামটা নিশ্চয়ই সে খুব যত্ন করে রাখবে। তার ছেলেমেয়েরা যখন বড় হবে তখন তাদের সে কলমটাি দেখিয়ে বলবে–আমার বাবা আমাকে দিয়েছিলেন। যেদিন আমার এস.এস.সি’র রেজাল্ট হলো সেই রাতে বাবা কিনে নিয়ে এসেছেন।

শাড়ি কাপড়ের একটা দোকান খোলা পাওয়া গেল। মতিনউদ্দিন মেয়ের জন্যে একটা শাড়ি কিনে ফেললেন। সাড়ে ছয় শ টাকা দাম। হাফসিল্ক। শাড়ির রঙ গাঢ় কমলা। রঙটা মতিনউদ্দিনের খুব পছন্দ হলো। তিনি ইতস্তত করে দোকানিকে বললেন, আমার মেয়ে শ্যামলা এই শাড়িটাতে তাকে মানাবে তো?

দোকানি শাড়ি প্যাক করতে করতে বলল, একটা পেত্নীকে যদি এই শাড়ি পড়িয়ে দেন তাকে লাগবে রাজকুমারীর মতো।

আরো দশটা দোকান দেখেশুনে কিনতে পারতাম। কিন্তু জিনিসটা আজই দরকার। আমার মেয়ের জন্য উপহার। ওর এস.এস.সি’র রেজাল্ট হয়েছে। ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে। বিজ্ঞান গ্রুপ। লেটার পেয়েছে আটটা। কাল সব পত্রিকায় তার ছবি দেখবেন। নাম হলো নাদিয়া মেহজাবিন। মেহজাবিন শব্দের অর্থ হলো চাঁদকপালী। আরবিতে মে হচ্ছে চন্দ্র। জাবিন হলো কপাল। আসলেই আমার মেয়েটা চাঁদকপালী।

দোকানদার সত্যিকার অর্থেই বিস্মিত হলো।

আপনার মেয়ে?

জ্বি ভাইসাহেব, আমার মেজো কন্যা। নাদিয়া মেহজাবিন।

দোকানদার ড্রয়ার খুলে এক শ টাকা ফেরত দিল। শাড়ির দাম পড়ল সাড়ে পাঁচ শ।

মতিনউদ্দিন দোকানদারের ভদ্রতায় মোহিত হলেন। তার চোখে পানি এসে গেল।

ঘরে অনেকরকম খাবার ছিল। নাদিয়ার ফুফু, হোটেল থেকে রোস্ট, পোলাও আনিয়েছেন। মতিনউদ্দিন কিছুই খেতে পারলেন না।–যাই খান ঘাসের মতো লাগে। তার খুবই ইচ্ছা ছিল মেয়ের সঙ্গে খানিক গল্পগুজব করেন। তাও করতে পারলেন না। মেয়ে তার সামনেই আসে না। নিজ থেকে মেয়েকে ডেকে গল্প করা তার স্বভাববিরুদ্ধ।

রাতে যথাসময়ে শুতে গেলেন। সুরমা বললেন, তিনি আজ নাদিয়ার সঙ্গে ঘুমোবেন। এটা তার মনঃকষ্টের কারণ হলো। তিনি ভেবেছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে শুয়ে শুয়ে মেয়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলবেন—তা হলো না। না হলে কী আর করা।

মেয়ের শাড়ি কি পছন্দ হয়েছে?

হয়েছে বোধহয় কিছু তো বলল না।

নতুন শাড়ি পরে সালাম করল না। শুধু পরীক্ষায় ফার্স্ট-সেকেন্ড হলে হবে না। আদব কায়দা তো শিখতে হবে। ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়া কঠিন কিছু না–আদব কায়দায় দূরস্ত হওয়া কঠিন।

শাড়ি পরতে বলেছিলাম, তার নাকি লজ্জা লাগবে। পরে আসতে বলব?

না থাক। যন্ত্রণা ভালো লাগছে না। ঘুম পাচ্ছে।

মতিনউদ্দিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। তিনি নিশ্চিত আজ রাতে তার এক ফোঁটা ঘুম হবে না। বুকও কেমন যেন ধড়ফড় করছে। হাট অ্যাটার্ক ট্যাটাক হবে না। তো। হার্ট অ্যাটাক হয়ে মরে থাকলেও কেউ কিছু টের পাবে না। এটা হচ্ছে কপাল। সংসার থেকেও সন্ন্যাসী। মতিনউদ্দিন তার প্রবন্ধ নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলেন। মাথায় কিছু আসছে না। চিন্তা ভাবনা সব এলোমেলো হয়ে গেছে। নজরুলের সেই কবিতাটা যেন কী? বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। কবিতাটা ঠিক না। বেশিরভাগই নারী করে–পুরুষ করে সামান্যই। তাকে দিয়েই এর প্রমাণ। তিনি কিছুই করতে পারেন নি। মতিনউদিনের পানির পিপাসা পেয়ে গেল। তিনি বাতি জ্বালালেন-ঘরে আজ পানি রাখা হয় নি। ভুলে গেছে। পানির জন্যে যেতে হবে রান্নাঘরে। তিনি দরজা খুলে রান্নাঘরের দিকে রওয়ানা হলেন। নাদিয়ার ঘরে বাতি জ্বলছে। মা-মেয়ের হাসি শোনা যাচ্ছে। এই হাসিতে তিনি যুক্ত হতে পারছেন না। আশ্চর্য। আচ্ছা তিতলীকে কি খবরটা দেয়া হয়েছে? তার শ্বশুরবাড়িতে কেউ কি একটা টেলিফোন করে নি। করে নি নিশ্চয়ই–করলে ওরা চলে আসত। খবর না দেয়ার মধ্যেও আনন্দ আছে। তিতলীর শ্বশুরবাড়ির লোকজন ভোরবেলা খবরের কাগজ পড়ে সংবাদ জানবে। এর আনন্দও তো কম না। মতিনউদ্দিন পরপর দু গ্লাস পানি খেলেন তার পিপাসা মিটাল না। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে যতই পানি খাচ্ছেন–পিপাসা ততই বাড়ছে। তিনি আরেক গ্লাস পানি হাতে বারান্দায় এসে বসলেন। ঘুম যখন হবেই নাবারান্দায় বসে থাকা যাক। আবারো নাদিয়ার হাসি শোনা যাচ্ছে। মা-মেয়ে কী নিয়ে এত হাসােহাসি করছে? দরজায় টোকা দিয়ে তাদের কি বলবেন–এই তোমরা বাইরে চলে আস। সবাই মিলে একসঙ্গে গল্প করি। না থাক। তারা আসবে, মুখ গন্তীর করে বসে থাকবে এরচে’ মা-মেয়ে গল্প করুক। সুরাইয়ার জন্যে একটা শাড়ি কিনে আনলে হতো। কাগজে লিখে দিতেন–মাতা শ্রেষ্ঠাকে সামান্য উপহার। ইতি মতিনউদ্দিন। না সেটাও ঠিক হতো না। বাড়াবাড়ি হতো। তারচে’ বরং মনে মনে নারী জাগরণ বিষয়ক প্ৰবন্ধটার খসড়া করে ফেলা যাক। শুরুটা ইন্টারেস্টিং হওয়া দরকার। পড়তে গিয়ে পাঠক ভাববে গল্প পড়ছে। গল্পের লোভ দেখিয়ে তাকে জটিল প্ৰবন্ধে ঢুকিয়ে দেয়া হবে–শুরুটা এ রকম করলে কেমন হয়–
ঘুঘু ডাকা ছায়া ঢাকা ছোট্ট সুন্দর সবুজ গ্রাম। গ্রামের নাম পায়রাবন্দ। সেই গ্রামের একটি শিশু তার নাম রোকেয়া…

নাদিয়ার ঘর থেকে আবার হাসির শব্দ আসছে। মতিনউদ্দিন উঁচু গলায় বললেন, তোমরা একটু আস্তে হাসাহাসি কর, মানুষকে ঘুমোতে দেবে না।

হাসির শব্দ থেমে গেল। মতিন সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেল। হাসাহসির করছিল করত। তিনি কেন ধমক দিলেন। সারাজীবন তিনি কি শুধু ভুলই করে যাবেন! তার চোখে পানি এসে গেল। কেউ সেই পানি দেখল না।

 

শওকতের অভ্যাস হচ্ছে ভোরবেলা দুটা খবরের কাগজ নিয়ে চা খেতে বাসা। নাশতাটা জরুরি না, খবরের কাগজ পড়াটা জরুরি। তিতলী সেই সময় তার সামনেই থাকে। তবে সে নাশতা খায় না। সঙ্গ দেবার জন্যে যে বসে তাও না। নিজ থেকে একটি কথাও বলে না। শওকত কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয়। সেই জবাবও অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। মানুষের অভ্যস্ত ক্ষমতা অসাধারণ। শওকত মনে হচ্ছে এই ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে।

আজ শওকত খবরের কাগজ তিতলীর দিকে বাড়িয়ে দিল–বিস্মিত গলায় বলল, নাদিয়ার ছবি ছাপা হয়েছে।

তিতলী কিছু বলল না, সে তার চায়ের কাপে চা ঢালছে। তাকে কোনো প্রশ্ন করা হয় নি, কাজেই জবাব দেবার কিছু নেই।

শওকত বলল, কী ব্যাপার, তুমি এই খবর পেয়েছ?

পয়েছি।

কখন পেয়েছ?

কাল রাতে।

রাতে মানে ক’টার সময়?

এগারটার সময়। নাদিয়া টেলিফোন করেছিল।

আমি তো তখন বাড়িতেই ছিলাম। আমাকে কিছু বল নি কেন?

বলার কী আছে?

এত বড় একটা খবর তুমি আমাকে জানাবে না?

এখন তো জানলেই।

তার মানে কি এই দাঁড়াচ্ছে–তুমি নিজ থেকে আমাকে কিছু বলবে না?

তিতলী জবাব দিল না, চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগল। শওকত বিরক্ত মুখে বলল, তুমি যা করছি তা যে ছেলেমানুষ তা কি বুঝতে পারছি?

তিতলী এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। শওকত ঠাণ্ডা গলায় বলল, তুমি যা করছ তা হচ্ছে হাস্যকর ছেলেমানুষ। যখন ছেলেমানুষিটা শুরু করেছিলে আমি তোমাকে বাধা দেই নি। আমার ধারণা ছিল বাধা দিলে এটা আরো বাড়বে। আমি ভেবেছি সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন দেখছি হচ্ছে না।

এখন কী করবে?

শোন তিতলী! আমার ধৈর্য অপরিসীম। আমি তোমাকে আরো সময় দেব। দু’বছর, তিন বছর, চার বছর…কোনো অসুবিধা নেই। আমি দেখতে চাই এক সময় তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ।

যদি কোনোদিনই ভুল বুঝতে না পারি?

তুমি তো বোকা মেয়ে না। বুদ্ধিমতী মেয়ে–আমি নিশ্চিত তুমি ভুল বুঝতে পারবে। তখন আমরা জীবন শুরু করব। সে জীবন অবশ্যই আনন্দময় হবে।

আনন্দময় হলেই তো ভালো।

ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার কি এর মধ্যে দেখা হয়েছে?

না।

টেলিফোনে কথা হয়েছে?

না।

শোন তিতলী আমি চাচ্ছি ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার দেখা হোক, কথা হোক।

কেন চাচ্ছ?

আমার ধারণা ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার যদি দু-একবার দেখা হয়–তুমি তোমার ভুল দ্রুত বুঝতে পারবে। এক কাজ করা যাক-আমি ভদ্রলোককে বাসায় একদিন খেতে বলি।

কোনো প্ৰয়োজন নেই।

তোমার অস্বস্তি বোধ করার কিছু নেই। আমি তার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করবো।

তিতলী চুপ করে আছে। তার দৃষ্টি চায়ের কাপের দিকে।

শওকত দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তিতলী ঠিক তার সামনে বসা। নতুন বউরা শ্বশুরবাড়িতে এসে শুরুর কিছু দিন ঘোমটা দিয়ে থাকে। তার মাথায়ও ঘোমটা। লালপাড়ের কালো শাড়িতে তাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। দেবী প্রতিমার মতো মেয়েটি চোখমুখ শক্ত করে বসে আছে। শওকত নিশ্চিত জানে এই শক্তমুখ একদিন কোমল হবে। সেই একদিনটা কবে এটাই সে জানে না।

তিতলী!

জ্বি।

আমি আশপাশে থাকলে তোমার কি অসহ্য লাগে?

না।

আমি আশপাশে থাকলে তোমার মুখ শক্ত হয়ে থাকে। এই জন্যেই জিজ্ঞেস করছি। নাদিয়াকে কনগ্রাচুলেট করতে যাবে না?

যাব।

আমি সঙ্গে গেলে কোনো অসুবিধা আছে?

অসুবিধা নেই–তবে আমি একাই যেতে চাই।

ব্যাপারটা খুব অশোভন হবে না? তুমি আমার সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করছ, সেটা ལ་ལས་ཀ་༢ বাড়ির কেউ জানে না। সবাই জানে আমরা খুব সুখে আছি। আনন্দে

সেটা জানাই তো ভালো।

তাদের জন্যে ভালো তো বটেই। তাদের সেই ভালোতে যেন খুঁত না থাকে সেই চেষ্টা তো আমাদের করা উচিত। তোমার পক্ষ থেকে কিছু অভিনয় দরকার। কাজেই হাসিমুখে আমার সঙ্গে চল।

আচ্ছা।

আরেকটা কথা। তুমি তো জানই আমি পি.এইচডি করতে বাইরে যাচ্ছি। তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে?

সেটা তোমার ইচ্ছা।

অর্থাৎ তোমার নিজের কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই।

না।

সেই ক্ষেত্রে আমার মনে হয় তোমার না যাওয়াই ভালো। এখানে থাকতে পার বা ইচ্ছে করলে তোমার মা-বাবার সঙ্গে থাকতে পার।

আমি এখানেই থাকব।

বেশ তো থাকবে। যদি এর মধ্যে তোমার ইচ্ছা করে আমার কাছে যেতে-চিঠি দিলেই আমি টিকিট পাঠাব। তুমি চলে আসবে।

আচ্ছা।

তোমার সব কথাই তো এ পর্যন্ত শুনে আসছি–এখন তুমি কি আমার একটা কথা শুনবে? কথাটা হচ্ছে–চল আমার সঙ্গে দুজন মিলে কোনো সুন্দর জায়গা থেকে ঘুরে আসি। যেমন ধর নেপাল। সুন্দর দৃশ্যের পাশে থাকলে মন সুন্দর হয়। পুরনো অসুন্দর ধুয়ে মুছে যায়। যাবে?

তুমি বললে যাব।

ভেরি গুড।

তোমার নাশতা খাওয়া তো হয়েছে। আমি কি এখন উঠতে পারি?

শওকত ক্লান্ত গলায় বলল, পার। তার মেজাজ খুবই খারাপ হয়েছে। সে অনেক চেষ্টা করেও মেজাজ ঠিক রাখতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে সমস্যাটা সামলাতে পারছে। না। ভবিষ্যতেও পারবে কি না বুঝতে পারছে না।

হাসান নামের ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে তার কি দেখা করা উচিত? তার সমস্যা মেটানোর জন্য ভদ্রলোকের সাহায্য প্রার্থনা করাটা কি ঠিক হবে? ভদ্রলোক কি সাহায্য করবেন? মনে হয় করবেন। যে-কোনো বিবেকবান মানুষেরই সাহায্য করা উচিত।

তিতলীকে না জানিয়ে ভদ্রলোককে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এলে হয়। সহজ স্বাভাবিকভাবে সবাই মিলে কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করা হবে। ক্ষতি কী?

তিতলী! তিতলী!

তিতলী এসে দাঁড়াল। কিছু বলল না। শওকত বলল, আচ্ছা যাও। এমনি ডেকেছিলাম। ও আচ্ছা শোন, নাদিয়ার ইন্টারভ্যুটা পড়েছ?

না।

পড় নি কেন? নাকি প্ৰতিজ্ঞা করেছ। আমার কেনা খবরের কাগজও পড়বে না?

আমি কোনো প্ৰতিজ্ঞা করি নি।

পড়ে দেখ। ভালো লাগবে। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে তোমার প্রিয় মানুষ কে?

সে তোমার নাম বলেছে।

ও আচ্ছা।

তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে তিতলী!

থ্যাংক য়্যু।

তুমি কি আমার ছোট্ট একটা অনুরোধ রাখবে? খুব ছোট্ট অনুরোধ?

কী অনুরোধ?

হাসলে তোমাকে কেমন দেখায় আমি জানি না। একটু হাস আমি দেখি। এত বড় খুশির একটা খবর পেয়েছ। এমনিতেই তো হাসা উচিত।

উচিত কাজ কি মানুষ সব সময় করতে পার?

না, উচিত কাজ মানুষ সব সময় করতে পারে না। মানুষ বরং অনুচিত কাজটাই সব সময় করে। আমাকে বিয়ে করাটা ছিল খুবই অনুচিত কাজ সেই কাজটা তুমি করেছি। বিয়ের পর পুরনো সমস্যা ভুলে গিয়ে স্বাভাবিক হওয়াটা ছিল উচিত কাজতুমি করছি উল্টোটা। দাঁড়িয়ে আছ কেন? বাস কথা বলি।

তিতলী বসল।

শওকত ক্লান্ত গলায় বলল, তুমি আমাকে একটা সত্যি কথা বল তো। তুমি কি আমার কাছ থেকে মুক্তি চাও? চুপ করে থেকে না, বল হ্যাঁ বা না।

মুক্তি চাইলে পাব?

তিতলী তাকিয়ে আছে। তার চোখে পলক পড়ছে না। শওকত চুপ করে রইল। তিতলীর প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। সম্ভবত জবাব তার জানা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *