১৭. কতেক আনন্দময় অথবা ভিন্নরকম সম্ভাবনা প্রসঙ্গে

কতেক আনন্দময় অথবা ভিন্নরকম সম্ভাবনা প্রসঙ্গে

ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কাল্পনিক এবং বৈজ্ঞানিক এ দু’ভাবেই লিখা যায়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সম্ভাব্য যা তা আবিষ্কারের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কাল্পনিক পদ্ধতিতে লেখকের মনে যা ভালো মনে হয় তুলে ধরেন। জোতির্বিদ্যার মতো একটি সুবিকশিত বিজ্ঞান কেউ কাল্পনিক পদ্ধতিতে গ্রহণ করবেন না। সূর্য অথবা চন্দ্রগ্রহণ ঘটলে কারো মনে আনন্দের সঞ্চার হবে এ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করেন না। সামাজিক ব্যাপারে যারা সমাজের গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে সাধারণ নিয়মনিষ্ঠ পদ্ধতিতে ভভিষ্যদ্বাণী করেন, তারা যতো বিজ্ঞাননিষ্ঠ বলে ভাণ করেন, আদতে তাদের মতামত অতোটা বিজ্ঞাননির্ভর নয়। ভবিষ্যতের মানব সমাজে কি ঘটতে যাচ্ছে, সে সম্বন্ধে কোন মতামত যে কোন প্রচেষ্টার মধ্যে প্রচুর অনুমান কল্পনা স্থান পায়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে কি ধরণের পরিবর্তন ঘটবে সে সম্বন্ধে আমরা আগাম কিছু বলতে পারি না। সম্ভবতঃ মানুষ বুধ অথবা মঙ্গল গ্রহে পাড়ি জমাতে পারে। সম্ভবতঃ আমাদের সকল খাদ্য শস্য উৎপাদিত না হয়ে রাসায়নিক গবেষণাগারে তৈরি হবে, দৃষ্টান্ত হিসেবে এগুলোকে তুলে ধরা যায়। এরকম সম্ভাবনার কোনো অন্ত নেই। আমি সে সবের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ না করে যে সকল মনোভাব বর্তমানে সস্পষ্ট হয়ে উঠেছে সে সম্বন্ধে আলোকপাত করতে চাই এবং সে সঙ্গে এটাও ভাবতে চাই আমাদের সভ্যতার গতি চলতে থাকবে, যদিও তাতে বিশেষ কোন নিশ্চয়তা নেই। যুদ্ধের ফলে আমাদের সভ্যতা ধ্বংস হতে পারে অথবা পরবর্তী রোমান সাম্রাজ্যের মতো তা বিলুপ্ত হতে পারে। কিন্তু আপদ বিপদ এড়িয়ে টিকে থাকতে পারলে তা কতেক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হতে পারে সে সকল বৈশিষ্ট্য কী রকম হতে পারে আমি তা উদঘাটন করার চেষ্টা করছি।

যান্ত্রিক প্রবর্তনা এবং বিশেষতঃ তার প্রতিক্রিয়ার ফলে আরেকটা পরিবর্তন ঘটেছে। আগের তুলনায় সমাজ অধিকতর সুসংহত রূপ ধারণ করেছে। মুদ্রাযন্ত্র, রেলপথ, টেলিগ্রাম এবং বর্তমানে বেতার যোগাযোগ, আধুনিক রাষ্ট্র অথবা আন্ত র্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের যান্ত্রিক সুবিধা প্রদান করেছে। একজন ভারতীয় অথবা একজন চীনা কৃষকের জীবনে সরকারি কাজের কোন স্থান নেই। কিন্তু ইংল্যাণ্ডের জেলাসমূহের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সরকারি কাজে ব্যাপক আগ্রহ পোষণ করে থাকে। সাম্প্রতিককালেই এ মনোবৃত্তির প্রসার হয়েছে। জেন অষ্টেনের লেখায় যে কেউ দেখতে পাবেন দেশের সঙ্গতিসম্পন্ন শিক্ষিত সম্প্রদায়ও নেপোলিয়নের যুদ্ধের কোন সংবাদ রাখতেন না। আধুনিককালের প্রধান প্রধান পরিবর্তন যে সামাজিক সংস্থার দ্রুত সংগঠনের কারণে হয়েছে আমি তাই তুলে ধরছি।

এর সঙ্গে বিজ্ঞানের আরেকটি ফলাফল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তাহলো বৃহত্তর পৃথিবীর ঐক্য। ষোড়শ শতাব্দীর আগে বলতে গেলে ইউরোপের সঙ্গে দূরপ্রাচ্য বা আমেরিকার কোনও সম্বন্ধ ছিল না। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর পরে সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ হতে ঘনিষ্টতর হতে থাকে। একই সময়ে রোমের অগাস্টাস এবং চীনের হ্যান সম্রাট নিজেদেরকে সমগ্র সভ্য দুনিয়ার একমাত্র প্রভু বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু আজকের যুগে এরকম আয়েসি কল্পনা করা অসম্ভব। পৃথিবীর প্রত্যেক অংশের সঙ্গে প্রত্যেক অংশের বাস্তব সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। তা শত্রুতার অথবা বন্ধুতার সম্বন্ধ যাই হোক না কোন উভয় ক্ষেত্রেই তা গুরুত্বপূর্ণ। শত বছর ধরে বিচ্ছিন্ন আরণ্যক থাকার পরে দালাইলামা একদিন দেখতে পেলেন যে রাশিয়া এবং বৃটিশ একত্রে তার সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের লুব্ধ মনোযোগে সংকুচিত হয়ে তিনি পিকিংয়ে চলে গেলেন। আমেরিকা থেকে সেখানেই তার পোষাক আশাক নিয়মিত আসতে থাকে।

এ দু বক্তব্য থেকে আমরা সুসংবদ্ধ সামাজিক সংগঠন এবং বৃহত্তর পৃথিবীর ঐক্যের সিদ্ধান্তে আসতে পারি। যদি আমাদের সভ্যতাকে উন্নতি লাভ করতে হয়, তাহলে কেন্দ্রে এমন একটা কর্তৃপক্ষ থাকতে হবে যা সমস্ত পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে। যদি বিরোধের কারণ বেড়ে না যায় তাহলে মানুষের যুদ্ধস্পৃহাও বেশি বলবৎ থাকবে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষটি সাধারণভাবে সরকারের মত হবে না এবং আমার মনে হয় তা হওয়াই বাঞ্চনীয়। তা আবার টাকার কারণে জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ লাগে বলে যারা বিশ্বাস করতে চান, তেমনি পুঁজিপতিদেরও একটি সংস্থা হবে না। আমেরিকার মত শক্তিশালী একটি রাষ্ট্র এককভাবে, অথবা আমেরিকা এবং গ্রেটবৃটেন যৌথভাবে সে কেন্দ্র গঠন করবে না। এরকম কোনা অবস্থায় পৌঁছে যাবার আগে পৃথিবী রাশিয়া এবং আমেরিকার মধ্যে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। আমেরিকা পশ্চিম ইউরোপ এবং নিয়ন্ত্রিত ডোমিনিয়নগুলো আর রাশিয়া সমগ্র এশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করবে, এ দুটো শিবিরই প্রতিরক্ষা কাজে শক্তিশালী এবং আক্রমণের বেলায় দুর্বল প্রমাণিত হবে। এভাবে তারা এক শতাদ্বী অথবা আরো বেশি কিছুকাল টিকে থাকতে পারে। সে যাহোক স্বাভাবিকভাবেই একবিংশ শতাব্দীতে কোন এক সময়ে যুদ্ধের ফলে সবকিছু তছনছ অথবা সমস্ত পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করার এত একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা সংগঠিত হবে। আমি ধরে নিচ্ছি যে সভ্য জগত অথবা আমেরিকার পরিপূর্ণ বোধ থাকবে যাতে করে সম্ভাব্য বর্বর যুগের প্রলয়কে ঠেকিয়ে রাখতে পারে। তাই যদি হয়, তাহলে কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে কী ক্ষমতা থাকা উচিত?

প্রথম এবং প্রধানত যুদ্ধ এবং শান্তির প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেয়ার মত সক্ষম তাকে অবশ্যই হতে হবে। অথবা এমন হতে হবে যুদ্ধের সময়ে এর সমর্থনধন্য পক্ষই দ্রুত জয়লাভ করতে পারবে। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বলের ওপর নির্ভর করে এ লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে। এর জন্য কোন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন পড়ে না। বৈজ্ঞানিক যুদ্ধ ব্যয়বহুল যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। সে জন্য পৃথিবীর প্রভাবশালী পুঁজিপতিরা এক সঙ্গে মিলিত হয়ে ঋণ দিয়ে অথবা ঋণ বন্ধ করে দিয়ে যে কোন সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য করতে পারে। ভার্সাই সন্ধির পরে যেমন জার্মানিকে চাপ দিয়ে নিরস্ত্র করে রাখবে। এভাবে তারা পৃথিবীর সমস্ত সৈন্যবাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসবে। তাদের অন্যান্য করণীয় কাজের সঙ্গে এ মৌলিক দাবীটিও তাদের গ্রহণ করতে হবে।

সন্ধির স্বপক্ষে আলাপ আলোচনা চালানো এবং বিরোধ নিস্পত্তি করা ছাড়া আরো তিনটি বিষয় কেন্দ্রীয় সংস্থার অধীনে থাকবে। তাহলো (১) প্রত্যেক জাতীয় রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণ করা (2) রাষ্ট্রের সীমানার বাইরে জনসাধারণের চলাফেরা কিভাবে হওয়া উচিত (৩) এবং বিভিন্ন দাবীদারদের মধ্যে কাঁচামালের রেশন বন্টন করা। এর প্রত্যেকটা কিন্তু কয়েকটা শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

আঞ্চলিক আনুগত্যের ব্যাপারটি এখনও এমন উদ্ভটভাবে পালন করা হয় একারণে যে প্রাচীনকালের একজন সার্বভৌম রাজার প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্য কালক্রমে আঞ্চলিক আনুগত্যে এসে রূপ নিয়েছে। কোন রাষ্ট্রের নাগরিক যখন তিনি যে জেলায় বাস করেন, সে জেলা অন্য রাষ্ট্রেরা অংশ বলে মতামত প্রদান করেন, তখন তাকে দেশদ্রোহী ভাবা হয় এবং কঠোর শাস্তিদান করা হয়। তারপরে তার মতামত অন্যান্য মতামতের এত রাজনৈতিক বিতণ্ডার কারণ হয়ে থাকে। ক্রয়ডেনের (Croyden) কোন লোক যখন বলেন যে ক্রয়ডেন লণ্ডনের অংশ হওয়া উচিত, তখন আমরা তার বিরুদ্ধে কোন বিরোধ অনুভব করিনা। কলম্বিয়া স্টেটের কোন গ্রামের নাগরিক যখন মনে করেন যে তার গ্রাম ভেনেজুয়েলার অন্তর্ভুক্ত হওয়াউচিত তখন তিনি তার সরকারের চোখে শাস্তির যোগ্য এক বিরাট দৈত্য বলে পরিগণিত হবেন। কেন্দ্রীয় সংস্থা জাতীয় সরকারকে এ রকমের কুসংস্কারপূর্ণ কিছু করার থেকে বিরত করবেন এবং আঞ্চলিক বিরোধের নিস্পত্তি যুক্তিগতভাবে, স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে পরামর্শ করে, তাদের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিষয় পর্যালোচনা করবেন।

বছর বছর জনসাধারণের একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়ার ফলে জটিল কঠিন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। সুতরাং মানুষের পক্ষে যেখানে কম মজুরি দেয়া হয়, সেখান থেকে বেশি মজুরি যেখানে পাওয়া যায় সেখানে চলে আসা খুবই স্বাভাবিক। এক রাষ্ট্রের মধ্যে এখন একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়ার অধিকারকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, কিন্তু বৃটিশ সাম্রাজ্যের মতো অনেকগুলো জাতি সম্মিলিত কনফেডারেশনে তা আজো স্বীকৃত হয়নি। এশিয়া থেকে আমেরিকা এবং স্বয়ংশাসিত ডোমিনিয়নের কোথাও গিয়ে বাস করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং ইউরোপিয়ানদের পক্ষেও আমেরিকায় গিয়ে বাস করার ব্যাপারে অনেক বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এর পক্ষে বিপক্ষে দু’দিকেই প্রবল যুক্তি রয়েছে। তারা এশিয়দের মধ্যে সামরিক মতবাদের জন্ম দিতে চায়। কালক্রমে তা সাদা জাতদের চ্যালেঞ্জ করার এত শক্তিশালী হয়ে উঠবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ সাদা জাতিদের মধ্যে গত মহাযুদ্ধের কথা বলা যেতে পারে।

যদি ব্যাপকভাবে যুদ্ধ বন্ধ করা হয় তাহলে ঔষধ এবং স্বাস্থ্যতত্ত্বের সাহায্যে জনস্বাস্থ্যের প্রভূত উন্নতি সাধন করা যাবে। শান্তি এবং কল্যাণের প্রতিষ্ঠার জন্য সভ্যজাতিগুলোর মত অনুন্নত জাতিগুলোর পক্ষেও জনসংখ্যার বৃদ্ধি রোধ করা অবশ্যই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। বাস্তবে যারা জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করে তারা হয়ত অঙ্ক জানেন না। অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে মানব সমাজে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগকে কায়েম রাখতে চান। একজন মানুষ ধরে নিতে পারে যে কেন্দ্রীয় সংস্থা অনুন্নত জাতি এবং শ্রেণীর মধ্যে জনসংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেবে। কিন্তু বর্তমানে সরকার যেভাবে একমাত্র বুদ্ধিমানের মধ্যে ক্ষুদ্র পরিবার গঠনের জন্য উৎসাহিত করেন,তা সেরকম হবে না শেষমেষ, কাঁচামালের রেশন প্রবর্তন করার বিষয়টি বোধ হয় সর্বাধিক গুরুত্বসম্পন্ন। যুদ্ধের সঙ্গে কাঁচামালের খুবই ঘনিষ্ট সম্বন্ধ বর্তমান। তেল, কয়লা এবং লোহা যুদ্ধপূর্ব বিরোধের সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কাঁচামাল যে ন্যায়ত বন্টন করা হবে তা আমি বলছিনা, আমি বলছি সেগুলো এমন ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে যাতে নিয়ন্ত্রণকারীর হাতে অপ্রতিরোধ্য শক্তি থাকে। আমি বিশ্বাস করি পৃথিবী একটি অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ইউনিটে রূপ দেয়ার কাজ, সুবিচার সাফল্যজনকবাবে প্রতিষ্ঠা করার আগে সম্পাদন করা যাবে। আমি একজন আন্তর্জাতিক সমাজবাদী কিন্তু সমাজতন্ত্রবাদের চাইতে শীগগীর আন্ত র্জাতিকতাবাদের বাস্তবায়ন ঘটবে বলে আমি প্রত্যাশা করি।

ধরে নিলাম পরবর্তী একশ পঞ্চাশ বছর সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় সংস্থা সমস্ত যুদ্ধকে খুব তাড়াতাড়ি দমন করা সম্ভব ছোটখাট যুদ্ধে পরিণত করার মত শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত হয়ে উঠবে। তারপরে অর্থনৈতিক উন্নতি কিভাবে সংগঠিত হতে পারে জনসাধারণের কল্যাণ কি বৃদ্ধি পাবে? তারপরে কি প্রতিযোগিতা টিকে থাকবে? অথবা উৎপাদন ব্যবস্থা কি একচেটিয়া হয়ে যাবে? পরেরটা যদি হয়, তাহলে তা ব্যক্তি মালিকানাধীন, না রাষ্ট্র মালিকানাধীন একচেটিয়া উৎপাদন ব্যবস্থার রূপ পরিগ্রহ করবে? বর্তমানের চাইতে কম অবিচার শ্রমের উৎপাদন বন্টন কাজে তখন কি হবে?

এখানে দুটো বিপরীত প্রশ্নের উৎপত্তি হবে। প্রথমে হলো অর্থনৈতিক সংস্থা সম্বন্ধীয় আর দ্বিতীয়টা বন্টনের নীতি সম্পর্কিত। দ্বিতীয়টা নির্ভর করে রাজনৈতিক শক্তির ওপর। প্রত্যেক জাতি প্রত্যেক শ্রেণী সম্পদের অংশ সাধ্যমত করায়ত্ব করে থাকে। সাধারণত সশস্ত্র সৈন্যের রক্ষণাবেক্ষনের জন্য যে পরিমাণ সম্পদ প্রয়োজন সে প্রয়োজন অর্থের মালিকানা গ্রহণ করে থাকে। তা আপাতত বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক সংস্থার আঙ্গিক নিয়েই প্রথমে আলোচনা করা যাক।

ইতিহাসে অর্থনৈতিক সংস্থার কাঠামোতে কতক বেদনাদায়ক সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। যখনই অর্থনৈতিক সংস্থা সাধারণ লোকের স্বার্থে বৃহত্তর আকারে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল, তখনই তা (স্বল্পসংখ্যক অপাংক্তেয় প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে) সবলের ক্ষমতাধীনে আনয়ন করা হয়েছে। যেখানে একতার একমাত্র সম্ভাব্য পন্থা ছিল স্বেচ্ছাকৃত ফেডারেশন গঠন করা, সেখানেই একতার প্রতিষ্ঠা হয়নি। ম্যাসিডোনিয়ার বিরোধিতার মুখে প্রাচীন গ্রিসে ফরাসি এবং স্পেনের প্রতিকূলতায় ষোড়শ শতাব্দীর ইটালিতে একতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বর্তমানে আমেরিকা এশিয়ার বিরোধিতার মুখে ইউরোপেও কোন ঐক্য প্রতিষ্ঠা হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং আমি মনে করি শক্তি দিয়ে অথবা শক্তির ভয় দেখিয়ে কেন্দ্রীয় সংস্থার সৃষ্টি করতে হবে। লীগ অব নেশন্সের মত স্বেচ্ছামূলক প্রতিষ্ঠান হবে না, কেননা এরকম প্রতিষ্ঠান বৃহত্তর শক্তিবর্গকে কখনো যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করতে বাধ্য করতে পারবে না। আমি আরো মনে করি, প্রাথমিকভাবে, কেন্দ্রীয় সংস্থাটি হবে অর্থনৈতিক এবং পরবর্তী স্তরে কাঁচামাল এবং ঋণ নিয়ন্ত্রণের উপর সমানভাবে নির্ভরশীল থাকবে। কতকগুলো রাষ্ট্রের সমর্থন এবং সাহায্য পুষ্ট কিছু পুঁজিপতি বেসরকারিভাবে এর প্রারম্ভিক সূচনা করতে পারেন বলে আমি মনে করি।

অর্থনৈতিক ভিত্তির দিক দিয়ে তা একচেটিয়া হবে। যেমন দৃষ্টান্তস্বরূপ পৃথিবীর যাবতীয় তেল সরবরাহ ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হলো। তার ফলে কেন্দ্রের সঙ্গে বিবাদকারী উড়োজাহাজ এবং তেলচালিত যুদ্ধযান অকেজো হয়ে পড়বে, যদি না তারা কোন তেলের খনি দখল না করতে পারে। একইভাবে সুস্পষ্ট পদ্ধতিতে অন্যান্য জিনিসের ওপর একই পদ্ধতি প্রবর্তন করা যায় ও বর্তমানেও পৃথিবীর প্রায় সমুদয় মাংস সরবরাহ শিকাগোর বৃহৎ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে, আবার প্রতিষ্ঠানগুলোও কিছু অংশে জে. পি ম্যান এণ্ড কোম্পানির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। কাঁচামালকে উৎপাদিত পণ্যে পরিণত করার আগে অনেক ঘোর প্যাঁচ অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়, যে কোন অবস্থাতেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তেলের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের স্বাভাবিক স্তর হলো একেবারে প্রথমেই নিয়ন্ত্রণ করে ফেলা। অন্যথা, পোতাশ্রয়, জাহাজ এবং রেলপথ যেখানে একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় সেখানেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যাই কিছু কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করুক না কেনো, তার শক্তি যে কোন পক্ষের চাইতে বেশি। একস্তরে একচেটিয়া ব্যবস্থা উৎপাদনের কারণ মঞ্জুর করা হলে প্রাথমিক থেকে পরবর্তী স্তরগুলোতেও একচেটিয়া ব্যবস্থা কায়েম রাখার একটা সক্রিয় মনোভাব থাকবে। সংস্থার শক্তি বৃদ্ধির ফলে যে মনোভাব দেখা দিয়েছে তার ফলেই একচেটিয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উৎপত্তি হয়েছে রাজনৈতিকভাবে বৃহত্তর শক্তি এবং রাষ্ট্রের আয়তনের মধ্যে যার প্রকাশ ঘটেছে। সুতরাং আমরা বিশ্বাসের সঙ্গে গত অর্ধশতাব্দী যাবৎ যে প্রতিযোগিতা চলে আসছে তার ক্রম পরিসমাপ্তি কামনা করতে পারি। অবশ্য এটাও অনুমেয় যে ট্রেড ইউনিয়ন মজুরদের বেতন নিয়ে যে প্রতিযোগিতা ধীরে ধীরে তার অবসান ঘটাতে পারে। এ মতানুসারে, পুঁজিপতিরা যখন সংগঠিত হবেন তার বিপরীতে মজুরেরাও সংগঠিত হতে পারে, আইন করে বন্ধ করে দিলে দীর্ঘদিন এ মনোবৃত্তি টিকে থাকবে না।

শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করা হলে আরাম আয়েশ অনেক বৃদ্ধি পাবে, যদিনা বাড়তি জনসংখ্যা তা নিঃশেষ না করে ফেলে, তখন পৃথিবী সমাজতন্ত্রী অথবা ধনতন্ত্রী যে রূপই গ্রহণ করুক না কোনো সকল শ্রেণীর অর্থনৈতিক উন্নতি হবে তা আমরা আশা করতে পারি। কিন্তু তার পরে আসে আমাদের প্রশ্ন,বিলি বন্টন ব্যবস্থা।

এটা কল্পনা করাও খুব কষ্টকর নয় যে একটি শক্তিশালী জাতির কতকগুলো পুঁজিপতি (অথবা চুক্তিপত্রের মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে কতিপয় জাতি) যখন মিলিত হবে তখন এটা স্পষ্ট যে তারা নিজেরাই অত্যধিক সম্পদের মালিক হবে এবং সে শক্তিশালী জাতির মজুরদের মাইনে প্রগতিশীলভাবে বৃদ্ধি করে দেশের জনসাধারণের মধ্যে সন্তুষ্টি ফিরিয়ে আনবে। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে এবং আগে ইংল্যাণ্ডে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। একটি জাতির সামগ্রিক সম্পদ তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পাওয়াতে পুঁজিপতিদের পক্ষে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ করে সাফল্যজনকভাবে প্রোপাগাণ্ডা চালানো খুব সহজ হয়ে পড়েছে এবং যে কোন কম সৌভাগ্যবান দেশকে সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণের আওতার মধ্যে অবদমন করে রাখা হয় এ পদ্ধতিতে।

সম্ভবত এরকম পদ্ধতি গণতন্ত্রের মধ্যে থেকেই বিকাশ লাভ করে। সমাজতন্ত্র হলো শুধু একটি সমাজের মানুষদের অর্থনৈতিক গণতন্ত্র যাতে অনেকগুলো শিল্পকে একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ইংল্যাণ্ডের বিকাশকে এর সমান্তরাল বলে ধরে নিতে পারে। রাজাই ইংল্যাণ্ডের একত্রীকরণ করেছিলেন এবং সে পদ্ধতি সম্রাট ৭ম হেনরি গোলাপের যুদ্ধের নৈরাজ্যবাদের পর নিজেই সমাপ্ত করেছিলেন! একত্রীভূত করার জন্য রাজকীয় শক্তির প্রয়োজন ছিল, কিন্তু যখনই একত্রীভূত হয়ে গেল তখন থেকেই গণতন্ত্রের দিকে আন্দোলন শুরু হলো। সপ্তদশ শতাব্দীর সঙ্কটকালের পর দেখা গেলো যে গণতন্ত্র জনসাধারণের শাসন শৃঙ্খলার পরিপন্থী নয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা এখন গোলাপের যুদ্ধ থেকে ৭ম হেনরির সময়ের যুগ সন্ধিকালের মধ্যে আছি। যখন একবার অর্থনৈতিক একতা তা যতই সামন্ততান্ত্রিক হোকনা কেননা স্থাপিত হবে তারপর থেকেই অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের শক্তি প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে, সুতরাং অর্থনৈতিক নৈরাজ্যবাদের আশঙ্কায় ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। সংখ্যালঘুরা যদি প্রচুর পরিমাণে জনমতের সমর্থন আদায় করতে পারে কেবল তাদেরই হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হবে। স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী এবং সিভিল সার্ভিসের লোকেরা অবশ্য অবশ্যই তাদের হুকুম মেনে চলবে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির এমন উন্নতি হবে যে একসময় আসবে যখন অর্থনৈতিক ক্ষমতা যাদের হাতে আছে তারা সুবিধাদান করাকে বুদ্ধিমানের কাজ মনে করবে এবং তাদেরকে কম সৌভাগ্যবান রাষ্ট্র এবং শ্রেণীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিশতে হবে, সামগ্রিক গণতান্ত্রিক অবস্থার সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এ পদ্ধতি চালু থাকবে।

যেহেতু আমরা একটি কেন্দ্রীয় সংস্থার কথা বলছি যা সমগ্র পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং সে সংস্থার গণতন্ত্র হবে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র, শুধু শ্বেত জাতিরা এর মধ্যে থাকবে না, আফ্রিকা, এশিয়ার জনগণও এতে অংশ গ্রহণ করবে। এশিয়া যে হারে উন্নতি করে যাচ্ছে তাতে মনে হয় সরকার গঠনের সময়ে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করার এত ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। আফ্রিকাকে নিয়ে অনেকগুলো সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। এমনকি আফ্রিকাতেও ফরাসিরা (এ ব্যাপারে আমাদের চাইতে অগ্রণী যারা) উল্লেখযোগ্য সুফল পাচ্ছে এবং আগামি একশ বছরের মধ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে সে সম্বন্ধে কেউ কোন ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না। সুতরাং উপসংহারে আমি এই বলতে চাই যে সমগ্র জাতির প্রতি সমগ্ৰশ্রেণীর প্রতি অর্থনৈতিক সুবিচার করতে পারার এত বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা কেন্দ্রীয় একটি সংস্থা ব্যতিরেকে কখনো সম্ভবপর হবে না। কেন্দ্রীয় সংস্থা যদি গঠিত হয় রাজনৈতিক শক্তি তা অবশ্যই গ্রহণ করবে।

সে, যাহোক এছাড়া অন্যান্য সম্ভাবনাও রয়ে গেছে কিন্তু সেগুলো শ্রেণীতে শ্রেণীতে বিরোধও জাগিয়ে রাখতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় স্টেটগুলো, যেখানে নিগ্রো এবং শ্বেতকায়রা পাশাপাশি বসবাস করে সেখানে শ্বেতকায়দের জন্যে গণতন্ত্র এবং নিগ্রোদের জন্য অর্ধদাস ব্যবস্থামূলক সমাজের পত্তন করা হয়েছে। ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলোতে নিগ্রোদের আমদানীর ব্যাপারে শ্রমিকদলের আপত্তিই হলো এই ব্যবস্থার উন্নতির পথে প্রধান প্রতিবন্ধক। সে যাহোক, এটাও একটা সম্ভাবনা জ্ঞানে মনে রাখা যেতে পারে। সে সম্বন্ধে পরে আমার আরো বেশি কিছু বলার রয়েছে।

আগামী দুশ বছরের মধ্যে পরিবারের কি উন্নতি হতে পারে? তা আমরা বলতে পারিনা, কিন্তু আমরা কতিপয় প্রভাব দেখতে পাচ্ছি কাজ করে যাচ্ছে, সেগুলো যদি না দমে যায় তাহলে কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের আকারে ফুটে উঠবে তা বলা যায়। প্রথমেই আমি যা বলতে চাই তা না বলে আমি কি প্রত্যাশা করি সে সম্বন্ধে আলোকপাত করতে চাই। এ আলোকপাতের কাজটা বলতে গেলে সম্পূর্ণভাবে আলাদা পর্যায়ের। অতীতে আমি যেমন আশা করেছিলাম পৃথিবীর সেভাবে উন্নতি হয়নি এবং ভবিষ্যতেও আমি যেভাবে প্রত্যাশা করব সেভাবে উন্নতি হবে না।

আধুনিক সভ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন কতকগুলো উপাদান রয়েছে যা পরিবারের বাধনকে দুর্বল করে ফেলেছে। শিশুদের প্রতি মানবিক অনুভূতি সহকারে শিশুকে যাচাই করাই হলো তার মধ্যে প্রধান। মানুষ উত্তরোত্তর অনুভব করছে যে সাহায্যকৃত না হলে তাদের পিতামাতার দুর্ভাগ্য অথবা পাপের জন্য শিশুদের কষ্ট ভোগ করা কিছুতেই উচিত নয়। বাইবেলে সবসময় সব অনাথ শিশুদের সম্বন্ধে দুঃখ করা হয়েছে এবং নিঃসন্দেহে তাদের অবস্থাও ছিল দুঃখজনক। সাম্প্রতিক কালে শিশুরা অন্যন্য যুগের শিশুদের চাইতে কম কষ্ট ভোগ করে। রাষ্ট্র এবং দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অবহেলিত শিশুদের পর্যাপ্ত স্নেহ সুযোগ দান করার বর্ধিত অনুরাগ বর্তমানে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলশ্রুতি স্বরূপ শিশুরা পিতামাতা এবং অন্যান্য অভিভাবকদের দ্বারা অতিরিক্তভাবে অবহেলিত হচ্ছে। জনগণের অর্থে অবহেলিত শিশুদের সেবা যত্নদান এবং প্রতিপালন করার পরিমাণ ধীরে ধীরে এমন ব্যাপক হয়ে দাঁড়াবে যে রাষ্ট্রের কাছে শিশুর দায়িত্ব অর্পণ করার সুযোগ পাওয়ার প্রবল আকাঙ্খবোধ করবে। আজকের দিনের স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থা যেমন, যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা, বিশেষ স্তরের নীচে, শেষমেষ তারাই এ পদ্ধতির বাস্তবায়ন করবে।

এধরণের পরিবর্তনের ফলে খুবই সুদূর প্রসারী প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার হবে। পিতামাতার কর্তব্য বলতে যখন কিছুই থাকবে না, তখন বিবাহ ব্যবস্থারও প্রচলন থাকবে না এবং ক্রমশ যে সকল শ্রেণী রাষ্ট্রের দায়িত্বে সন্তান অর্পণ করতে পারবে তাদের মধ্যে বিবাহ ব্যবস্থা লোপ পেয়ে যাবে। সভ্য জগতে এ ব্যবস্থামতে খুব অল্প সন্তানই জন্ম গ্রহণ এবং প্রত্যেক জননীকে নির্দিষ্ট সংখ্যক নাগরিকের জন্মদানের জন্য একটা নির্দিষ্ট ভাতা দান করবে। এ ব্যবস্থার সম্ভাবনা খুব স্বল্প নয়, বিংশ শতাব্দীর অবসানের আগেই ইংল্যাণ্ডে এ ব্যবস্থা চালু হতে পারে।

এগুলো যদি ধনতন্ত্রবাদী আন্তর্জাতিক নৈরাজ্যবাদীদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার সময়ে ঘটে তা হলে খুবই বিষময় ফল ফলতে পারে। তা বলতে গেলে, সর্বহারা যাদের পিতামাতা সন্তান কিছুই থাকবে না তারা এবং সঙ্গতি সম্পন্ন, যারা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে তাদের মধ্যে দু’টি অংশে বিভক্ত হয়ে যাবে। সর্বহারারা রাষ্ট্র কর্তৃক শিক্ষিত হয়ে তুর্কির’ ‘জানিসারীদের মতো, আবেগ প্রবণ সামরিক আনুগত্য পুষ্ট হয়ে গড়ে উঠবে। মেয়েদের এ শিক্ষা দেয়া হবে যে বেশি সন্তান ধারন করা তাদের কর্তব্য। সন্তান ধারণের জন্য রাষ্ট্রের বরাদ্দ টাকা জননীকে দেয়া ঠিক রেখে এবং অন্যদেশ লুণ্ঠণ এবং হত্যা করার সৈন্যের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হবে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু বলার মত বা শিক্ষা দেয়ার মত পিতামাতা যখন থাকবে না, তখন শিশুদের মনে বিদেশীদের প্রতি লোলুপতার অন্ত থাকবে না। ঐ মনোভাব তাদের মনে প্রবিষ্ট করিয়ে দেয়া হবে, যাতে করে বড় হলে প্রভুদের কথানুসারে অন্ধভাবে রাষ্ট্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত করে তাকে শাস্তিদান করবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে দেশপ্রেম এবং মানবপ্রেম দুই ভাবধারা শিশুদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করিয়ে ধাপে ধাপে দু’শ্রেণীতে বিভক্ত একটি সমাজ ব্যবস্থা সৃষ্টি করা খুবই সম্ভব। ওপরের স্তরে বিবাহ এবং পারিবারিক বাধ্যবাধকতা থাকবে এবং নীচের স্তরে শুধু রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য বোধ থাকবে। সামরিক কারণে সরকার অর্থের বিনিময়ে উচ্চহারে জন্ম সর্বহারাদের মধ্যে পাবে। স্বাস্থ্যবিজ্ঞান এবং ঔষদের কারণে মৃত্যুর হার হবে খুবই স্বল্প। সুতরাং জনসংখ্যাকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে অনসন ছাড়া রাখার জন্যে জাতিসমূহকে যুদ্ধে নামতে হবে। একমাত্র যুদ্ধ করেই অনসনের হাত থেকে আত্মরক্ষা করা যায়। পরিস্থিতি এরকম হলে মধ্যযুগের হুন এবং মোঙ্গলদের আক্রমণের মত আমরাও একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রত্যাশা করতে পারি। এক জাতি বা কতিপয় জাতির ত্বরিত বিজয়ের মধ্যেই আমাদের একমাত্র আশা নিহিত।

রাষ্ট্র কর্তৃক শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে এর যা ফল হবে তা হবে ওপরে যা বলা হয়েছে সোজাসুজি তার বিপরীত, যদিনা বিশ্বভিত্তিক একটা সংস্থা গঠিত হয় সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সংস্থা শিশুদেরকে বস্তুগত দেশপ্রেম শিক্ষা দিতে অনুমতি দেবে না এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক সামর্থ্যের বাইরে জনসংখ্যা বাড়াতে সুযোগ দেয়া হবে না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে প্রতিপালিত শিশুদের ওপর থেকে যদি সামরিক প্রয়োজনীয়তার চাপ সরিয়ে নেয়া হয়, আজকের গড়পড়তা শিশুর চাইতে শারীরিক এবং সামরিক দিকে সুস্থ হয়ে গড়ে উঠবে। সুতরাং পৃথিবীর দ্রুত প্রগতি সাধিত হবে।

যদি, একটি মাত্র কেন্দ্রীয় সংস্থা থাকে এবং বাকি রাষ্ট্র ধনতন্ত্রী অর্থনৈতিক পদ্ধতি থেকে সমাজতন্ত্রী পদ্ধতিতে অবতরণ করে, তাহলেও কিন্তু উল্টো ফল ফলবে। প্রথমোক্ত দুটোর যে কোনো একটাতেও শ্রেণী বিভাগ থাকবে যা আমরা একটু আগেই বলেছি। উচ্চ শ্রেণী পরিবারের মধ্যে অবস্থান করবে এবং নিম্নশ্রেণী রাষ্ট্রকেই পরিবারের বদলে গ্রহণ করবে। তার পরেও নিম্নশ্রেণীকে দুর্বল করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা উচ্চশ্রেণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করতে পারে। এর ফলে সাংস্কৃতিক একটা নিম্নমান প্রতিষ্ঠিত হবে, সে জন্যে সম্ভবত ধনীরা সাদা মানুষের চেয়ে কৃষ্ণকায় অথবা হলুদ বর্ণের সর্বহারা বংশবৃদ্ধিকে উৎসাহ দান করবে। শ্বেতকায় জাতিগুলো ধীরে ধীরে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিজাত সম্পদায়ে বিভক্ত হয়ে নিগ্রোদের আক্রমণে একসময়ে সম্পূর্ণভাবে লোপ পেয়ে যেতে পারে।

অনেক সাদা জাতির হাতে এখনো রাজনৈতিক গণতন্ত্র আছে বলে এগুলোকে উদভ্রান্ত চিন্তা মনে হতে পারে। সে যাহোক, আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, প্রত্যেক গণতান্ত্রিক দেশে স্কুলের শিক্ষার ততটুকু পর্যন্ত সুযোগ দেয়া হয়, যতটুকু শিক্ষা ধনীদের উপকারে আসে। কমিউনিস্ট হওয়ার অপরাধে স্কুল শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়, কিন্তু গোঁড়া হওয়ার অপরাধকে অপরাধ বলে ধরা হয় না। এটা যে অদূর ভবিষ্যতে পরিবর্তিত হবে আমি এমন কোন সম্ভাবনা দেখছি না। আমার চিন্তা হলো এই কারণে যে আমাদের সভ্যতা যদি ধনীদের স্বার্থে অনেকদিক ব্যবহৃত হয় তাহলে তা ধ্বংস প্রাপ্ত হবে। কিন্তু আমি একজন সমাজতন্ত্রী, সে কারণে আমাদের সভ্যতা ধ্বংস হোক সেটা আমি চাই না।

আগের বক্তব্য যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে সৌভাগ্যবান কয়েকজন সংখ্যালঘু ছাড়া অন্যান্যের বেলায় পরিবার বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সুতরাং সৌভাগ্যবান সংখ্যালঘু বলে কোন সম্প্রদায় না থাকলে পরিবার সম্পূর্ণভাবে লোপ পেয়ে যাবে। জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখলে এটাকে অনিবার্য মনে হয়। পরিবার হচ্ছে এমন একটা প্রতিষ্ঠান অসহায় শিশুকে রক্ষা করাই হলো যার প্রধান কাজ। পিঁপড়ে এবং মৌমাছিদের বেলায় সমগ্র সমাজই সে দায়িত্ব বহন করে, তাদের কোন পরিবার নেই। সুতরাং মানুষের মধ্যেও যখন মা বাবার আশ্রয় ছাড়া, শৈশবকাল নিরাপদে কাটে তাহলে ক্রমান্বয়ে পারিবারিক জীবন লোপ পেয়ে যাবে। এই লোপ পাওয়ার ফলে মানুষেরর জীবনের আবেগের মধ্যে একটা পরিবর্তনের সূচনা হবে। পূর্ববর্তী যুগের সাহিত্য এবং শিল্পকলার সঙ্গে মানুষ সমস্ত প্রকারের আবেগের বন্ধন ছিন্ন করে ফেলবে। তার ফলে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে প্রভেদ কমে যাবে, যেহেতু সন্তানের বৈশিষ্ট্যগুলো সঞ্জীবিত করার এত কোন পিতামাতা থাকবে না। যৌন সম্পর্ক এবং ভালোবাসার আকর্ষণ এবং রোমাঞ্চ কমে যাবে, সম্ভবত সব প্রেমের কবিতা উদ্ভট বলে বিবেচিত হবে। মানব চরিত্রের রোমান্টিক উপাদনগুলো অন্যন্য পন্থা যেমন শিল্পকলা, বিজ্ঞান এবং রাজনীতির মধ্যেই উৎসারিত হবে। (ডিজরেলির কাছে রাজনীতি ছিল রোমান্টিক অভিযান) সে অনুসারে আবেগের যে ভাটা পড়বে তা অমি চিন্তা করতে পারি না। কিন্তু নিরাপত্তা সূচক প্রত্যেক কাজের মধ্যে ওরকম এক আধটু আবেগের ক্ষয় হয়ে থাকে। পালের জাহাজের মত স্টিমার এবং পর্বতের মানুষের মত ট্যাক্স উসুলকারী কখনো রোমান্টিক নয়। মনে হয়, শেষ পর্যন্ত। নিরাপত্তা ক্লান্তিকর হয়ে পড়বে এবং মানুষ বিতৃষ্ণার ফলে ধ্বংসশীল হয়ে উঠবে। কিন্তু এ সকল সম্ভাবনা হিসেব করে নিরূপণ করা সম্ভব।

আমাদের যুগের সংস্কৃতির প্রবাহ সম্ভবত শিল্পকলা থেকে আলাদা হয়ে বিজ্ঞানমূখী হয়ে পড়েছে তা অবশ্য বিজ্ঞানের সুপ্রচুর বাস্তব ব্যবহার্যতার কারণেই হয়েছে। রেনেসাঁর যুগের একটা বলবান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের যুগে চলে এসেছে। সামাজিক সম্মানই ছিল এর নির্ভরস্থল! একজন ভদ্রলোকের সামান্য পরিমাণ ল্যাটিন জানলেই চলে, বাষ্পীয় ইঞ্জিন কিভাবে তৈরি হয় জানার দরকার নেই। এই ঐতিহ্যের স্থায়ীত্বের পেছনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভদ্রলোকদেরকে সাধারণমানুষের তুলনায় কম কাজের মানুষ করে গড়ে তোলা। আমার ধারণা অত্যল্পকাল পরে যে লোক বিজ্ঞানের কিছুই জানবে না তাকে শিক্ষিত মানুষ বলে গণ্য করা হবে না।

এসব তো হলো সুফল, কিন্তু বিজ্ঞান আমাদের সাংস্কৃতিকে বিভিন্ন দিকে মোড় ফিরিয়ে দিয়ে তার বদৌলতে আপন বিজয় কেড়ে নিচ্ছে তাই হলো সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপার। শিল্পকলা ধীরে ধীরে অলসের কাজ এবং কতিপয় ধনী পৃষ্ঠপোষকের চিত্তবিনোদনের সেবাদাসী হয়ে উঠেছে। আগে যেমন ধর্মীয় এবং সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ডে এর প্রয়োজন ছিল, এর প্রয়োজন সাধারণ মানুষের কাছে এখন আর তেমন অনুভূত হয় না। সেন্টপল নির্মাণে যে টাকা ব্যয় করা হয়েছে, সে টাকা যদি আমাদের নৌবাহিনীতে খরচ করা হতো তাহলে আমরা ওলন্দাজদের পরাজিত করতে পারতাম। তবে দ্বিতীয় চার্লসের সময় সেন্টপলের প্রয়োজনীয়তাই অধিক বিবেচিত হয়েছিল। আগে নন্দনতাত্বিক প্রশংসার মাধ্যমে মানুষের আবেগসঞ্জাত প্রয়োজনের পরিতৃপ্তি বিধান করা হতো, কিন্তু বর্তমানে অধিকভাবে তা তুচ্ছাতিতুচ্ছ যান্ত্রিক পদ্ধতিতেই প্রকাশিত হচ্ছে। গান এবং গানের সঙ্গে নৃত্য, সৌন্দর্যতত্বের নিয়মানুসারে একমাত্র রাশিয়ান ব্যালে নৃত্য ছাড়া এসবের কোনও শৈল্পিক মূল্য নেই। এগুলোকে কম আধুনিক সভ্যতা হতে আমদানি করা হয়েছে। শিল্পের অনিবার্য মৃত্যু দেখে আমার ভয় হয় যা আমাদের পিতামহের তুলনায় আমাদের অতিসাবধান সমূহবাদী জীবনের জন্য অতি আয়োজন। আমার ধারণা, আজ থেকে একশ বছর পরে একজন সুশিক্ষিত ব্যক্তি ভালো অঙ্ক জানবেন, জীববিজ্ঞানে তার জ্ঞান থাকবে এবং যন্ত্র কেমনে তৈরি হয় সে সম্বন্ধে অনেক বেশি জানবেন। অল্প কয়জন ছাড়া আর সকলের ক্ষেত্রে শিক্ষাকে গতিশীল করে তোলা হবে। তার মানে, মানুষ অনুভব অথবা চিন্তার জন্য নয়, শুধু কাজ করার জন্য শিখবে। তারা সব রকমের কাজ আশ্চর্য নিপূণতার সঙ্গে করতে পারবে, কিন্তু কাজটা করা উচিত কিনা যুক্তি দিয়ে তা চিন্তা করতে পারবে না। সম্ভবত চিন্তাবিদ এবং অনুভবকারী নামে দুটো সরকার স্বীকৃত শ্রেণীর উদ্ভব হবে। রয়েল একাডেমি বিবর্তিত হয়ে অনুভবকারী শ্রেণীর রূপ পরিগ্রহ করবে। চিন্তাবিদদের চিন্তার ফসলগুলো সরকারের সম্পত্তি, একমাত্র যুদ্ধ পরিষদে নৌবিভাগ, হাওয়াই তত্ত্ববিভাগের মন্ত্রীদের কাছেই তা ব্যক্ত করা হবে। কোন সময়ে শত্রুর দেশে রোগ ছড়াবার প্রয়োজন যদি পড়ে, তাহলে স্বাস্থ্যবিভাগকে এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে। অনুভাবকেরা সিদ্ধান্ত করবেন স্কুলে থিয়েটারে এবং গির্জায় কি ধরণের অনুভূতিকে ছড়ানো হবে, যদিও সে আকাঙ্খিত আবেগটি কি আবিষ্কারের ভার থাকবে সরকারী চিন্তাবিদদের উপর। স্কুলের ছেলেরা না গ্রহণ করতে পারে ভেবে সম্ভবত সরকারি অনুভাবকেরা চিন্তাকে সরকারের গোপনীয় করে রাখা হবে। সে যাহোক বয়স্কদের সেন্সর বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত ছবি দেখা এবং বক্তৃতা প্রচার করতে দেয়া হয়।

অনুমান করা যায়, ব্রডকাষ্টিংয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দৈনিক সংবাদপত্র মার খাবে। সংখ্যালঘুদের মতামত প্রকাশের জন্য কিছুসংখ্যক সাপ্তাহিক পত্রিকা হয়ত টিকে থাকতে পারে। কিন্তু পড়ার স্বভাব কমে গিয়ে, গ্রামোফোন শোনা বা অন্য কোন আবিষ্কার তার স্থলাভিষিক্ত হবে। একইভাবে ব্যবহার করে লেখার অভ্যাসকে সাধারণ জীবন থেকে বাদ দেয়া হবে।

যুদ্ধ বাদ দিয়ে পণ্যদ্রব্য যদি বৈজ্ঞানিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাহলে দৈনিক চার ঘন্টার শ্রম মানুষকে পরিপূর্ণ সুখ স্বাস্থ্যের মধ্যে রাখতে সক্ষম হবে। যে পরিমাণ কাজ করে কোন রকমে বেঁচে থাকবে তা তাদের মধ্যে একটা ভোলা প্রশ্ন বলে বিবেচিত হবে। সম্ভবত কেউ এটা কেউ ওটা পছন্দ করতে পারে। বিশ্রামের সময় নৃত্যে অংশ গ্রহণ, ফুটবল খেলা দেখে, সিনেমাতে গিয়ে মানুষ অধিকাংশ সময় ব্যয় করবে তাতে সন্দেহ নেই। সন্তানসন্ততি নিয়ে তাদের কাছে উৎকণ্ঠার কারণ নেই, রাষ্ট্র তাদের ভার নিয়েছে। বেশি রোগ ব্যারাম থাকবে না। মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে বার্ধক্যকেও নতুন শক্তিতে সঞ্জীবিত করা যাবে। তখন তা ভোগবাদীদের স্বর্গে পরিণত হবে, যেখানে সকলের কাছে জীবন অসহনীয় হয়ে দাঁড়াবে।

এই যে দ্বিমূখী সমস্যা-তা কি এড়িয়ে যাওয়া যায়? অধিকতর বিষণ্ণ দিকটি জীবনের মধ্যে যা কিছু সর্বোৎকৃষ্ট তার জন্য প্রয়োজন কি? আমি তা মনে করি না। যদি মানুষের অবস্থার কোন পরিবর্তন না হয় তাহলে অজ্ঞ লোকেরা এখনও যা ভাবে, সত্যিকার ভাবে তা থাকলে অবস্থা নৈরাজ্যজনক রূপ নেবে। কিন্তু আমরা এখন মনোবিজ্ঞানী এবং শরীর বিজ্ঞানীদের দৌলতে জানতে পেরেছি যে মানব চরিত্রে যা আছে তার দশভাগের একভাগ হচ্ছে প্রকৃতির কাছ থেকে পাওয়া এবং দশ ভাগের নয় ভাগ হচ্ছে উৎকর্ষ সাধন করার জিনিস। যাকে মানব প্রকৃতি বলা হয় শৈশবের শিক্ষার মধ্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে তা একেবারে পরিবর্তন করে দেয়া যায় এবং পরিবর্তনগুলো হবে বিপদের আশঙ্কামুক্ত জীবনে পরিপূর্ণ সিরিয়াসনেস বলতে যা বোঝায় তা বজায় রাখা। এ উদ্দেশ্যের জন্য দুটো জিনিসের প্রয়োজন, কোমলমতি শিশুদের মধ্যে গঠনমূলক প্রবৃত্তির উন্নতি সাধন করা এবং যৌবন পর্যন্ত সেগুলো টিকিয়ে রাখার মত সুযোগ দান করা।

সে যাহোক আমরা সিরিয়াসনেস বলতে বুঝি প্রতিরক্ষা এবং আক্রমণের কাজেই তা অধিকাংশভাবে নিয়োজিত। আমরা নিজেদের দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে এবং আমাদের শিশুদের লাঞ্ছনার পাত্র হওয়ার বিরুদ্ধে এবং আমাদের দেশকে বিদেশী শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা করে থাকি। যাদের আমাদের দেশের শত্রু মনে করি তাদের আমরা মৌখিকভাবে এবং হাতে কলমে আক্রমণ করে থাকি। কিন্তু আবেগের অন্যন্য উৎসও রয়েছে সেগুলোও অত্যন্ত গতিশীল রূপ নিতে পারে। সৌন্দর্য সৃষ্টি অথবা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের আবেগ এত বেশি হতে পারে, যে তা ভালোবাসার আবেগকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। ভালোবাসা যদি ধরে রাখার মত এবং নির্যাতন করার মত হয়, সৃজনশীল হতেও সক্ষম হবে। সৎশিক্ষা দেয়া হলে অধিকাংশ মানুষ গঠনমূলক কাজের মধ্যে আনন্দকে খুঁজে পাবে। কিন্তু শিক্ষা আসল শিক্ষা হওয়াই চাই।

তারপরে আমাদের দ্বিতীয় বিবেচনায় আসতে হয়। শুধু উচ্চতর কর্তৃপক্ষের হুকুম মেনে উপকারীর কাজ-সম্পাদন না করে তার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত গঠনমূলক একটা পরিবেশ অবশ্যই থাকতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক ও মৌলিক সৃষ্টির পথে অন্যান্য কোন বাধা থাকবে না। মানুষে মানুষে গঠনমূলক সম্বন্ধের মধ্যে এবং যে পথে মানুষের উন্নতি হতে পারে তার প্রতিকূল কোন প্রতিবন্ধক অবশ্যই থাকবে না। যদি সমগ্র অবস্থা তাই হয়ে থাকে এবং শিক্ষা ব্যবস্থা যথার্থ হয়ে থাকে, সিরিয়াস এবং উত্তেজনাপূর্ণ জীবন যাপন করার প্রচুর অবকাশ যারা অনুভব করে তারা অবশ্যই পাবেন। সেক্ষেত্রে এবং একমাত্র সে ক্ষেত্রেই যদি জীবনের শ্রেষ্ঠ দোষগুলোকে পরিহার করে সমাজ গঠন করা হয় তাহলে টিকে থাকবে, কেননা অধিকাংশ উৎসাহী সদস্যের কাছে তা সন্তোষজনক হবে।

আমি অবশ্যই স্বীকার করব যে, যে ভিত্তির উপর আমাদের সভ্যতা স্থাপিত তা বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল। সেখানে অধিকসংখ্যক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে এবং যেখানে অধিক সংখ্যক সংগঠন থাকবে সেখানে যতটুকু ক্ষতির আশঙ্কা করা যায় সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। কিন্তু তা একটি ক্ষতি করবে, যা হলো ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার সুযোগ সুবিধাকে নষ্ট করে ফেলবে। বিশাল শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির মধ্যে একটা শক্তিহীনতার ভাব সৃষ্টি করবে, যার ফলে চেষ্টা শক্তি ধ্বংস হয়ে যাবে। যদি শাসকেরা তার বাস্তবায়ন করে তাহলে অনেকগুলো বিপদকে এড়িয়ে যাওয়া যায় কিন্তু তার স্বরূপ হলো এমন যে বাস্তবায়ন করা অধিকাংশ শাসকের মধ্যে কিছুটা নৈরজ্যবাদ ঢুকিয়ে দেয়া উচিত যাতে করে নিষ্ক্রিয়তার কারণে ধ্বংস না হয় অথবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির এত অতো বেশিও হবে না যার পরিমাণ। এটা এমন একটা জটিল সমস্যা যে থিয়োরিগতভাবে কখনো তা সমাধান করা তো যায়-ই না, কঠিন বাস্তবের মধ্যেও তার সমাধান পাওয়া যাবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *