১৭. ওসমান সাহেবের বসার ঘর

১৭

ওসমান সাহেবের বসার ঘর। রাত প্রায় এগারটা। একটি কম পাওয়ারের টেবিল-ল্যাম্প ছাড়া ঘরে কোনো আলো নেই। আবছা অন্ধকার। এই আবছা অন্ধকার ঘরে তিন জন মানুষ মুখোমুখি বসে ছিলেন। এক জন উঠে চলে গেলেন। ফরিদা। তিনি নিঃশব্দে কাঁদছিলেন। যে আলোচনা চলছিল, তা তাঁর সহ্য না হওয়ায় উঠে গেছেন। এখন বসে আছেন দু’ জন–মিসির আলি এবং ওসমান সাহেব। কথাবার্তা এখন বিশেষ হচ্ছে না। ওসমান সাহেবের যা বলার তা বলেছেন। এখন আর তাঁর কিছু বলার নেই। তিনি বসে আছেন মূর্তির মতো। দেখে মনে হচ্ছে, তাঁর মধ্যে জীবনের ক্ষীণতম স্পর্শও নেই। যেন এক জন মরা মানুষ।

মিসির আলি বললেন, ‘আপনি বলছেন, ফিরোজকে তালাবন্ধ করে রেখেছেন?’হ্যাঁ।’

‘কবে থেকে?’

‘আজ নিয়ে ছ’ দিন।’

‘এটা তো বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। কারণ এই ছ’ দিনে বেশ ক’বার সে বের হয়ে গেছে। পুরানা পল্টন এলাকায় তাকে দেখা গেছে। পত্রিকায় নিউজ হয়েছে।’

ওসমান সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘কী ভাবে কী হচ্ছে আমি জানি না। আমি যা করেছি, সেটা বললাম। তালা দেয়া আছে। আপনি নিজে গিয়ে দেখতে পারেন।’

‘সেই তালার চাবি কার কাছে? অর্থাৎ আমি জানতে চাচ্ছি, অন্য কেউ তালা খুলে দিতে পারে কি না।’

‘না, পারে না। কারণ চাবি আমার কাছে।’

‘অর্থাৎ আপনি বলতে চাচ্ছেন তালাবন্ধ করে রাখা সত্ত্বেও সে বের হয়ে পড়ছে?’

‘আমি কিছুই বলতে চাচ্ছি না। আপনার যা ইচ্ছা মনে করতে পারেন। মিসির আলি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘আমি কোনো আধিভৌতিক ব্যাপারে বিশ্বাস করি না। এক জনকে তালাবন্ধ করে রাখা হবে, কিন্তু তবু সে বের হয়ে যাবে–এটা আর যে-ই বিশ্বাস করুক, আমি করব না।

‘বিশ্বাস করতে আমি আপনাকে বলছি না। আপনি নিজে গিয়ে দেখুন। সেটা না করে আপনি একই কথা বারবার আমাকে বলছেন কেন?’

‘সেটা বলছি, কারণ আমি আগে সমস্ত ব্যাপারটা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা করতে চাই। ওসমান সাহেব, আমি–আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই, আমি এই ছেলেটিকে সুস্থ করে তুলতে চাই। আপনি আমাকে শত্রুপক্ষ মনে করছেন, এটা ঠিক না। আমার কোনো পক্ষ নেই। আমি এক জন চিকিৎসক।

মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন এবং সহজ স্বরে বললেন, ‘চলুন, ফিরোজের ঘরটা দেখে আসি।’

‘আপনি একাই যান, আমি যাব না।’

‘আপনি যাবেন না কেন?’

‘আমার সহ্য হয় না। আমি নিজেও পাগল হয়ে যাব।’

মিসির আলি একাই রওনা হলেন।

.

ফিরোজের ঘর নিঃশব্দ। সে এই গরমেও চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে মিসির আলি চমকে উঠলেন। মুখভর্তি খোঁচা-খোঁচা দাড়ি-গোঁফ। গালের হ উঁচু হয়ে আছে। সেই উজ্জ্বল গৌরবর্ণের কিছুই নেই, কেমন কালি মেরে গেছে। মিসির আলি লক্ষ করলেন, ফিরোজের হাতের নখ বড় বড় হয়েছে। নখের নিচে ময়লা জমে দেখাচ্ছে শকুনের নখের মতো। ঘুমের মধ্যেই ফিরোজ পাশ ফিরল। মিসির আলি লক্ষ করলেন, সে হাঁ করে ঘুমাচ্ছে এবং মুখ দিয়ে লালা পড়ে বিছানার একটা বেশ বড় অংশ চটচটে হয়ে আছে। কুৎসিত একটা দৃশ্য!

ঘরের একটিমাত্র দরজা, সেখানে সত্যি-সত্যি বিরাট একটা তালা ঝুলছে। দু’ দিকে দু’টি বিশাল জানালা। জানালায় লোহার গ্রিল। সেই গ্রিল ভেঙে বের হওয়া অসম্ভব। সুস্থ মানুষ দূরের কথা, এক জন পাগলও সেই চেষ্টা করবে না।

মিসির আলি বসার ঘরে ফিরে এলেন। ওসমান সাহেব বললেন, ‘ঘর যে বন্ধ, এটা আপনার বিশ্বাস হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, হয়েছে।’

‘এখন বলুন সে কীভাবে বের হয়?’

‘ফিরোজের ঘরের সঙ্গে একটা এ্যাটাড্ বাথরুম আছে। বাথরুমের ভেতরটা আমি দেখতে পাই নি। তবে আমার ধারণা, বাথরুমে বেশ বড় একটি ভেন্টিলেটার আছে, এবং ফিরোজ সেই ভেন্টিলেটার দিয়ে বের হয়।’

ওসমান সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। সিগারেট ধরালেন। মিসির আলি লক্ষ করলেন, সিগারেট ধরাতে গিয়ে তাঁর হাত কাঁপছে। মিসির আলি বললেন, ‘এক্ষুণি আপনি ভেন্টিলেটার বন্ধ করার ব্যবস্থা করুন। আজ রাতে যেন সে বের হতে না পারে।’

‘হ্যাঁ, করছি।’

‘আমি এখন চলে যাব। কিন্তু কাল ভোরে আবার আসব। আপনার দারোয়ানকে বলে দিন, যাতে সে আমাকে ঢুকতে দেয়।’

‘হ্যাঁ, আমি বলব। মিসির আলি সাহেব।’

‘বলুন।’

‘আমার ছেলে কি কোনোদিন সুস্থ হয়ে উঠবে?

‘নিশ্চয়ই হবে। হতেই হবে।’

‘এত রাতে আপনি বাড়ি গিয়ে কি করবেন? থেকে যান এখানে।

‘না, থাকতে পারব না। আমার সঙ্গে একটা ছোট মেয়ে থাকে, সে একা ভয় পাবে। আপনি দেরি না করে ভেন্টিলেটারটা বন্ধ করার ব্যবস্থা করুন।

‘করছি। এক্ষুণি করছি।’

ফরিদা ঘরে ঢুকলেন। তাঁকে খুব উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত মনে হল। তাঁর কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম, এবং তিনি কাঁপছেন। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। ফরিদা থেমে বললেন, ‘মিসির আলি সাহেব, ফিরোজ জেগেছে। আপনাকে ডাকছে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।’

.

‘কেমন আছ ফিরোজ?’

‘ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?’

মিসির আলি চমকে উঠলেন। ভারি গম্ভীর গলায় কথা বলছে ফিরোজ। চোখে-মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি। সে পায়ের ওপর পা তুলে চেয়ারে বসে আছে।

‘তুই তুই করে বলছি বলে রাগ করছিস না তো? তুই তো আবার প্রফেসর মানুষ!’

‘রাগ করছি না, তবে দুঃখিত হচ্ছি। সবাইকে সবার প্রাপ্য সম্মান দেয়া উচিত।’

‘তা উচিত। কিন্তু মুশকিল কি জানিস, সারা জীবন তুই ছাড়া কোনো সম্বোধন করি নি। আমাকে চিনতে পারছিস তো? তুই তো গিয়েছিলি আমাদের বাড়িতে।’

মিসির আলি চুপ করে রইলেন। যে কথা বলছে, সে ফিরোজ নয়। ফিরোজের দ্বিতীয় সত্তা। সেকেন্ড পার্সোনালিটি।

‘কি রে, চুপ করে আছিস কেন? ভয় পাচ্ছিস? হা হা হা।‘

‘না, ভয় পাচ্ছি না।’

‘খাঁচায় আটকে রেখেছিস, ভয় পাবি কেন? ছেড়ে দে, তারপর দেখি তোর কত সাহস!’

‘আমার সাহস কম।’

‘এই তো একটা সত্যি কথা বললি। হ্যাঁ, তোর সাহস কম–তবে তোর বুদ্ধি আছে। মাথা খুব পরিষ্কার। বোকা বন্ধুর চেয়ে বুদ্ধিমান শত্রু ভালো।‘

‘আমি কারো শত্রু নই।’

‘বাজে কথা বলিস না। তুই আমার শত্রু, মহা শত্ৰু!’

‘কেমন করে?’

‘তুই ফিরোজকে সারিয়ে তুলতে চাচ্ছিস। ওকে সারিয়ে তুললে আমি যাব কোথায়? ডাণ্ডাপেটা করব কীভাবে? তুইই বল।’

‘ডাণ্ডাপেটা করতেই হবে?’

‘করব না? বলিস কী তুই! আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে, আমি ছেড়ে দেব? পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলব।’

‘লাভ কী তাতে?’

‘লাভ-লোকসান জানি না। ছোট চৌধুরী লাভ-লোকসানের পরোয়া করে না। তোকে আমি একটা শিক্ষা দেব। এক বাড়ি মেরে টপ করে মাথাটা ফাটিয়ে দেব। গল-গল করে ঘিলু বের হয়ে আসবে। ছিটকে আসবে রক্ত। বড় মজার ব্যাপার হবে। তবে তুই দেখতে পাবি না। আফসোসের কথা!’

মিসির আলি তাকিয়ে দেখলেন, এ-বাড়ির প্রায় সবাই এসে জড়ো হয়েছে। চোখ বড় বড় করে শুনছে এই অস্বাভাবিক কথোপকথন। কাঁদছেন শুধু ফরিদা।

ফিরোজ হিসহিস করে উঠল, ‘কি, চুপ করে আছিস যে? কথা বলছিস না কেন? ভয় পেয়েছিস? ভয় পেয়ে শেষটায় মেয়েমানুষের আঁচল ধরলি? লজ্জা করে না?’

‘কার কথা বলছ?’

‘ওরে হারামির বাচ্চা, তুই জানিস না কার কথা বলছি? তোর পেয়ারের নীলু বেগম। যার ইয়ে দুটি—। এবং যার ইচ্ছে হচ্ছে—।’

কুৎসিত সব কথা। সে একনাগাড়ে বলে যেত লাগল। কদর্য অশ্লীলতা। যা ছাপার অক্ষরে লেখার কোনো উপায় নেই। ফিরোজ যে-সব কথা বলতে লাগল, তার ভগ্নাংশও অশ্লীলতম পর্ণো পত্রিকায় থাকে না। ফরিদা দ্রুত ঘরে চলে গেলেন। কাজের লোকগুলি মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। ওসমান সাহেব ধৈর্য হারিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘শাট আপ।’

ফিরোজ হাসিমুখে তাকাল ওসমান সাহেবের দিকে। যেন খুব মজার কথা বলছে, এমন ভঙ্গিতে বলতে লাগল, ‘আমাকে ইংরেজিতে গাল দিচ্ছে। বাহ্, বেশ মজা তো! কাকে তুই ইংরেজিতে গাল দিচ্ছিস? তোর নাড়ি-নক্ষত্র আমি জানি। সালেহা নামের কাজের মেয়েটির সঙ্গে তুই কী করেছিস, বলে দেব? খুব মজা পেয়ে গিয়েছিলি, তাই না? ক’দিন খুব সুখ করে নিলি। বলব কী করেছিলি? বলব? হা হা হা। কি, পালিয়ে যাচ্ছিস কেন? লজ্জা লাগছে? ফুর্তি করার সময় লজ্জা লাগে নি? একটা ঘটনা বরং বলেই ফেলি—।’

ওসমান সাহেব বললেন, ‘মিসির আলি সাহেব, আপনি চলে আসুন।’

‘আপনি বসার ঘরে গিয়ে বসুন। আমি আসছি।’

‘তুই যাচ্ছিস না কেন? কথাগুলো শুনতে মজা লাগছে? তোর ইয়ে—(কিছু কুৎসিত কথা।

মিসির আলি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ফিরোজ, চুপ কর।’

‘ঠিক আছে, চুপ করলাম। তুই আজ রাতে কোথায় থাকবি?’

‘বাসাতেই থাকব।’

‘তাহলে দেখা হবে।’

‘না, দেখা হবে না। বাথরুমের ভেন্টিলেটার বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’ ফিরোজের কয়েক সেকেণ্ড সময় লাগল ব্যাপারটা বুঝতে। তারপর লণ্ডভণ্ড কাণ্ড করল। চেয়ার ভাঙল, লাথির পর লাথি বসাতে লাগল পালঙ্কে। কাপ-বাটি ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। চোখে দেখা যায় না, এমন ব্যাপার। ভয়াবহ উন্মত্ততা! মনে হয় না এ কোনো দিন শান্ত হবে। মিসির আলি একটি সিগারেট ধরালেন। ফিরোজ চাপা গলায় গর্জন করছে। ক্রুদ্ধ পশুর গর্জন। সমস্ত আবহাওয়াই দূষিত হয়ে গেছে। নরকের একটি ক্ষুদ্র অংশ নেমে এসেছে এখানে।

মিসির আলি দাঁড়িয়ে-থাকা লোকদের বললেন, ‘তোমরা যাও। বারান্দার বাতি নিভিয়ে দাও। ও আপনা-আপনি শান্ত হবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *