1 of 2

১৭. এক একটা দিন এমন চমৎকার

এক একটা দিন এমন চমৎকার ভাবে আসে, সকালবেলা থেকে সবকিছুই মনে হয় অন্য রকম। মেঘ নিচু হয়ে নেমে এসেছে, পৃথিবীময় সেই ছায়া, বৃষ্টি নামেনি। মেঘের ছায়ায় সমস্ত বস্তুর চেহারা বদলে যায়। মনে হয়, পৃথিবীতে কোনও ভারী জিনিস নেই, সবকিছুই হালকা হালকা। ফুরফুর করছে হাওয়া, গায়ে সিল্কের কাপড়ের ছোঁয়া লাগলে যে রকম লাগে, ঠিক সেই রকম।

ইস্কুল ছুটি, সকালবেলা আমরা সুজি দিয়ে লুচি খেলাম। সূর্যদার পাস করার উপলক্ষে বাবা নবীন ময়রার রসগোল্লা এনেছেন। আমরা সবাই খুব আনন্দ করছি, কিন্তু সূর্যদা সেই একই রকম গোমড়ামুখো। কাল রাত্রে টেলিগ্রাম এসেছে সূর্যদা এ ওয়ান পেয়ে পাস করেছে। পাসের খবর শুনলে অন্য সব ছেলেরা কত লাফালাফি করে, অথচ সূর্যদা এমন ভাব করছে যেন এতে তার কিছু যায় আসে না!

বড়দি ফিসফিস করে সূর্যদাকে বলল, বড়বাবুকে প্রণাম করেছ? পাসের খবর পেলে গুরুজনদের প্রণাম করতে হয়। সূর্যদা এমন ভাবে বড়দির দিকে তাকাল, যেন এ রকম একটা অদ্ভুত কথা সে জীবনে শোনেনি।

ঠিক হয়েছে ম্যাটিনি শো-তে একটি বাইস্কোপ দেখা হবে। বলাই বাহুল্য, তাতে আমাকে নেওয়া হবে না, কারণ বাংলা বই ছোটদের দেখতে নেই। যাকগে, তার জন্য আমার কোনও দুঃখ নেই। আমি তো এক পয়সা দিয়ে যখন তখন বাইস্কোপ দেখতে পারি–আমাদের মোড়ের মাথায় আসে পেতলের একটা গোল বাক্স, ফুটোয় চোখ রাখলেই দেখা যায়।

কী যেন একটা যোগ আছে, মা গঙ্গাস্নান করতে যাবেন। আমাকে অবশ্য নিয়ে যেতে হবে না–আমার দুই দিদি যাবে মায়ের সঙ্গে। আমার আর এক জ্যাঠতুতো বোন পান্তুর জ্বর হয়েছে। আমার খেলার সঙ্গী নেই। আমার খুব ইচ্ছে করছিল বিষ্ণুদের বাড়িতে যেতে, কিন্তু আমায় কে নিয়ে যাবে? চাকর দেশে গেছে।

আমি আর দু’মাস বাদেই নয় পেরিয়ে দশে পা দেব, আমি একলা যেতে পারি। কিন্তু মা আমাকে কিছুতেই একলা ছাড়বেন না। অথচ রাস্তা আমার চেনা–এই তো আমাদের বাড়ি থেকে খানিকটা গেলেই কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট, তারপর বাঁ দিকে বেঁকলেই একটুখানি গিয়েই হেদো। হেদোর পাশ দিয়ে গিয়ে বিডন স্ট্রিট পেরিয়ে কাশি ঘোষের থামওয়ালা বাড়ি। সেখানে অনেকগুলো ঘোড়ার গাড়ি থাকে। সেটা পেরিয়ে গেলে, যদি এ-দিকের ফুটপাত দিয়ে যাই তা হলে ও-দিকের ফুটপাতে পড়বে দুটো থিয়েটার, রংমহল আর শ্রীরঙ্গম, তারপর একটা বিরাট উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি, তারপর রূপবাণী বাইস্কোপ। এই বাইস্কোপ বাড়িটার নাম নাকি দিয়েছিলেন রবি ঠাকুর। সবাই বলে রূপবাণী, কিন্তু বাবা একদিন আমাকে বলেছিলেন, এর উচ্চারণ করতে হয় রূপোবাণী। এদিকে আমি কালীদের বাড়ির পাশ দিয়ে আর একটুখানি গেলেই গ্রে স্ট্রিট, উলটো দিকে স্টার থিয়েটার। গ্রে স্ট্রিটের বাঁ দিকে বেঁকলেই বিষ্ণুদের বাড়ি এসে যাবে।

সূর্যদাকে গিয়ে বললাম, তুমি বিষ্ণুদের বাড়ি যাবে? চলো না!

ওবাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারে সূর্যদার আজকাল খুব একটা আগ্রহ নেই। তার কারণ, ও-বাড়িতে সূর্যদার সমবয়সি ঠিক কেউ নেই। অন্য ছেলেমেয়েরা সূর্যদার চেয়ে অন্তত চার-পাঁচ বছরের ছোট। আবার সুপ্রকাশদা চার-পাঁচ বছরের বড়। সূর্যদার কোনও বন্ধু। নেই। তা ছাড়া ওর যা স্বভাব, পাড়ার কোনও ছেলের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হল না।

সূর্যদা একটা মোটা বই পড়ছিল, মুখ না-তুলেই বলল, উঁহুঃ!

আমি সূর্যদার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললাম, তা হলে ক্যারম খেলবে?

আবার–উঁহু!

সূর্যদা, আমাকে একটা গল্প বলো!

আশ্চর্যের ব্যাপার, সূর্যদা তবু রেগে উঠল না। বই মুড়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর বলল, আমি এখন বেরোব, চল, তোকে ওবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি।

সূর্যদার ধুতি-পরা দেখলে আমার হাসি পায়। রীতিমতন কসরতের ব্যাপার। আগে কক্ষনও ধুতিটুতি পরেনি সূর্যদা, আচার ব্যবহারে ও ছিল পুরো সাহেব, হঠাৎ দু-তিন মাস ধরে খুব ধুতি পরার ঝোঁক হয়েছে। নিজেই কিনে এনেছে একজোড়া খদ্দরের সাদা পাঞ্জাবি।

রাস্তায় তখন অজস্র এলোমেলো হাওয়া, সূর্যদা ধুতি সামলাতে নাজেহাল। কোমরের কাছে গিঁট দিয়ে তারপর বেল্ট বাঁধা, সুতরাং খুলে যাবার ভয় নেই, কিন্তু কাছা ফুলে উঠছে বেলুনের মতন। একটা ফটোগ্রাফের মতন সেই দৃশ্যটা এত বছর পরেও আমার চোখে ভাসে। সূর্যদার মাথা-ভরতি লালচে রঙের চুল এলোমেলো, সাহেবদের মতন ফরসা রং, থুতনিতে অল্প দাড়ি ও সদ্য-ওঠা সরু গোঁফের রেখা, ব্যায়াম করা সুন্দর স্বাস্থ্য, পাঞ্জাবির হাতা গোটানো, নিচু হয়ে দু হাত দিয়ে ধুতি সামলাচ্ছে। মনে হয়, কোনও ছদ্মবেশী রাজকুমার। আমি রূপকথা পড়তে গেলেই রাজকুমারের মুখ সূর্যদার মতন কল্পনা করতাম।

আমি পরেছিলাম কালো রঙের হাফপ্যান্ট আর চেন-লাগানো তোয়ালের মতন কাপড়ের গেঞ্জি। ওই প্রকার গেঞ্জির ফ্যাশান তখন খুব চালু। পায়ে নটি বয় শু। হঠাৎ লম্বা হতে শুরু করেছিলাম বলে হাঁটুর তলা থেকে আমার পা দুটো বেখাপ্পা মনে হত।

দু’জন কাবুলিওয়ালা একজন রোগাপটকা লোকের জামা চেপে ধরে বাজখাই গলায় খুব ধমকাচ্ছে। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে আমরা সেই দৃশ্য দেখলাম। রোগা লোকটিকে এই অবস্থায় প্রায়ই দেখা যায় কাবুলিদের কাছ থেকে টাকা ধার করে রেস খেলে।

রাস্তায় বেরোলে যে কত রকম কী দেখা যায়। চেনা দোকান, চেনা রিকশাওয়ালা, চেনা ভিখিরি, এদেরও দেখতে ভালো লাগে। একটি বাচ্চা ভিখিরি রোজ ‘ম্যায় বনকে চিঁড়িয়া বনকে বনবন’ গানটা গায়। কানাকেষ্টর গান, ‘লোকে বলে কালা কালো নয় সে যে আমার চোখের আলো’–এটাও সে জানে, তবে বড় সুর ভুল করে। হেদোর কাছে ভালুকনাচ দেখানো হচ্ছে–এটা আমরা পয়সা না দিয়েও দেখতে পারি। একটু ভিড়ের পেছন দিকে দাঁড়ালে আর পয়সা না দিলেও চলে। আমার কাছে তো একটাও পয়সা থাকে না–আর সূর্যদা কখন কী দিতে হয় তাই-ই জানে না। একবার ইচ্ছে হল সূর্যদাকে বলি আমাকে একটা সিগারেট লজেন্স কিনে দিতে, কিন্তু লজ্জা হল।

ভাল্লুকটা বেশি বড় নয়, অথচ বেশ গাঁট্টাগোট্টা। মনে হয় যেন বামন ভালুক। আমার সেই কথা শুনে সূর্যদা বিজ্ঞের মতন জানাল, মাউন্টেন রিজিয়ানের ভাল্লুক। পাহাড়ি ভালুক বেশি বড় হয় না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম,–কোন পাহাড়? হিমালয়?

সূর্যদা বলল,–হতে পারে!

আচ্ছা সূর্যদা, হিমালয় তো অনেক দূর। সেখান থেকে ভাল্লুকটাকে এতদূর নিয়ে এল কী করে? হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে?

কেন, ট্রেনে?

হিমালয় পাহাড়ে কি রেলগাড়ি যায়?

খানিকটা হাঁটিয়ে, খানিকটা ট্রেনে।

রেলগাড়িতে কি ভাল্লুকদের উঠতে দেয়? অন্য লোকেরা ভয় পায় না?

এই ব্যাপারটা সম্পর্কে সূর্যদার জ্ঞান খুব পরিষ্কার নয়। আমতা আমতা করে বলল, ফ্রেটার ট্রেনে বোধহয়, কিংবা হাঁটিয়েও নিয়ে আসতে পারে–

কিছুক্ষণ আমরা এই বিষয়ে গভীর ভাবে আলোচনা করতে করতেই যাই। সেই দূর হিমালয়ের জঙ্গল থেকে একটা লোক একটা ভাল্লুকের গলায় দড়ি বেঁধে হটিয়ে হটিয়ে কলকাতা পর্যন্ত নিয়ে আসছে। এই কল্পনা বেশ রোমাঞ্চিত করে।

হঠাৎ সূর্যদার হাত টেনে ধরে আমি বললাম, বাঁ দিকে তাকাও, শিগগির বাঁ দিকে তাকাও!

উলটো দিকে থেকে একটা মড়া আসছিল। খাঁটিয়া কাঁধে নিয়ে চারটে লোক মহা উৎসাহে বলো হরি, হরি বোল–বলে চ্যাঁচাচ্ছে!

সূর্যদা অবাক হয়ে বলল, কেন, বাঁ দিকে তাকাব কেন?

ডান দিক থেকে মড়া গেলে সে-দিকে তাকাতে নেই। অকল্যাণ হয়।

হ্যাঁ রে বাদল, তুই এসব কোথা থেকে শিখেছিস রে?

মা বলেছে!

এসব হচ্ছে সুপারস্টিশন! কু..কু…কু…

কুসংস্কার!

হ্যাঁ। একটা ইট, কাঠ, লোহাও যা, একটা ডেডবডিও তাই! ডান দিক বাঁ দিক তাকানোতে কিছু আসে যায় না!

তা হলে মা বলল কেন!

মায়েদের বোঝাতে হয়। ওঁরা তো লেখাপড়া শেখেননি—

হ্যাঁ, আমার মা লেখাপড়া শিখেছে। মা গল্পের বই পড়ে!

বাজে তর্ক করিস না তো! যা বলব তাই শুনবি!

তুমি বুঝি সব জানো?

সূর্যদা আমার দিকে ফিরে বলল, আমি সব জানি। সব। বুঝলি!

সেই যোলো বছরের সদ্য যুবকের মুখে অহংকার ঝলসে উঠল। এই পৃথিবী-বিস্তৃত জ্ঞানের প্রতি যেন একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে চায়। কিন্তু সূর্যদা বাংলা বানান জানে না, আমার থেকেও কম জানে–একথাটা আমার মুখে এসে গেলেও বললাম না।

অভয় গুহ রোডের মোড়ে একটা দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একজন লোক চিৎকার করে ডাকছে, বৈকুণ্ঠবাবু, বৈকুণ্ঠবাবু! কেউ সাড়া দিচ্ছে না, লোকটি ডেকেই যাচ্ছে। বহুক্ষণ কানে সেই ডাকটা লেগে রইল। কেন জানি না, আমার হঠাৎ মনে হল, বৈকুণ্ঠবাবু মারা গেছেন–একটু আগে যে মড়াটিকে নিয়ে গেল, তারই নাম বৈকুণ্ঠবাবু। আমার মাঝে মাঝে এ রকম অদ্ভূত কথা মনে হয়।

বিষ্ণুদের বাড়িতে তখন আতর কেনা হচ্ছে। ঠাকুরদালানে বসেছে আতরওয়ালা, তার কাপড়ের বোঁচকার মধ্যে প্রায় একশোটা নানা রঙের শিশি। এক একটা শিশির মুখ খুলে একটু করে তুলো ভিজিয়ে এগিয়ে দিচ্ছে–গন্ধ শুকে যাচাই করছে বাড়ির মেয়েরা। বিষ্ণু, দীপ্তি, রেণু, ছকু, কানাইদের পেয়ে গেলাম।

সূর্যদা আমাকে পৌঁছে দিয়েই চলে যাবে। দু-তিন মাস আগে সূর্যদা কলকাতার কোনও রাস্তাই চিনত না–এখন সে একা একা কোথায় কোথায় যায় কারোকে বলে না। সূর্যদাকে দেখলে এবাড়ির ছেলেমেয়েরা খুব খুশি হয়, দীপ্তি তো একেবারে যেন গলে পড়ে! ওরা সূর্যদার হাত ধরে টানাটানি করতে লাগল, কিন্তু সূর্যদা আর দাঁড়াল না, চলে গেল। আমরা কিছুক্ষণ আতরওয়ালার কাছে উঁকিঝুঁকি মারলাম, তারপর বিষ্ণু আর আমি চলে গেলাম ওপরে।

দার্জিলিং থেকে বিষ্ণু কত রকম পাথর এনেছে। এক একটা পাথর দেখলে মনে হয়, কী অসম্ভব দামি! কত রকম রং! অথচ বিষ্ণু বলল, একটাও কেনেনি। সব ও নিজে কুড়িয়েছে। বিষ্ণুরা দার্জিলিং থেকে কালিম্পং, গ্যাংটক পর্যন্ত ঘুরে এসেছে। আমাকে বিষ্ণু বলল, তুই গেলি না তো! গেলে দেখতিস, কী মজাই যে হত!

আমি লুকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। যে-জায়গায় এমন সুন্দর সুন্দর পাথর পাওয়া যায়–সে তো স্বপ্নের দেশ! বাবা আমাকে যেতে দেননি। ঠিক আছে, বড় হয়ে আমি একশোবার যাব, হাজারবার যাব–তখন তো আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না।

বিষ্ণু জানলা-দরজা বন্ধ করে ঘর অন্ধকার করে দিল! তারপর দুটো বড় সাদা পাথর আমার হাতে দিয়ে বলল, ঠুকে দেখ! জোরে ঠুকবি!

ঠুকতেই ঝিলিক দিয়ে আগুনের ফুলকি দেখা গেল!

আমি উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, চকমকি?

চকমকি পাথরের কথা গল্পের বইতে পড়েছি শুধু। পাথরদুটোকে মনে হল, কোনও রূপকথার জিনিস আমার হাতে।

বিষ্ণু বলল, হ্যাঁ। এ রকম কত পাথর আছে ওখানে! তোর জন্যও আনব ভেবেছিলাম, ভুলে গেলাম!

এই সময় রেণু দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। ছুট্টে কাছে এসে বলল, আমি একবার, আমি একবার আগুন জ্বালব।

আমি পাথরদুটো রেণুকে দিতে যাচ্ছিলাম, বিষ্ণু বলল, না না, রেণু পারবে না! ওর হাত পুড়ে যাবে!

রেণু ঠোঁট উলটে বলল, ইস মোটেই হাত পোড়ে না! আমি এর আগে জ্বালিয়েছি তো!

বিষ্ণু রেগে গিয়ে বলল, তুই আমাকে না বলে আমার জিনিসে হাত দিয়েছিস? কেন হাত দিয়েছিস?

কাকিমা বলেছে!

মা তোকে আমার জিনিসে হাত দিতে বলেছে?

হ্যাঁ, বলেছেই তো!

মাকে ডাকি?

রেণু আবার এক ছুটে দরজার কাছে গিয়ে বলল, হাত দিয়েছি, বেশ করেছি! আবার দেব, কী হবে?

বিষ্ণু তাড়া করতেই রেণু পালিয়ে গেল। রেণুটা বড্ড দুষ্টু আর দুরন্ত। সবাই জানে। বিষ্ণু নিজের জিনিসপত্রের দারুণ যত্ন নেয়। তবু রেণু তাতে হাত দেবেই!

বিষ্ণু কৃপণ বা স্বার্থপর নয়, তার জিনিসপত্র সে অন্যদেরও ব্যবহার করতে দিতে পারে, কিন্তু নিজের তত্ত্বাবধানে। হঠাৎ ঘাঁটাঘাঁটি করা সে পছন্দ করে না।

বিষ্ণু বলল, দার্জিলিংয়ে আর একটা জিনিস কিনেছি, দেখবি? চামড়ার বাক্স খুলে বিষ্ণু সাবধানে একটা দূরবিন বার করল। নিজের জামা দিয়ে খুব স্নেহের সঙ্গে সেটাকে মুছেটুছে বলল, খুব পাওয়ারফুল! এক সাহেবের ছিল। এটা দিয়ে অনেক দূরের জিনিস দেখা যায়–আবার যদি উলটো করে ধরে দেখিস, তা হলে কাছের জিনিসও অনেক দূরের মনে হবে।

জিনিসটায় হাত দিয়ে আমার কেমন যেন শিরশিরে অনুভূতি হল। কলম্বাস দূরবিন। চোখে লাগিয়ে দেখলেন…গ্যালিলিও..ক্যাপ্টেন কুক..বইতে পড়া এসব যে সত্যি সত্যি কখনও নিজের হাতে নিয়ে দেখব।

ঘর অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বিষ্ণু বলল, চল, ছাদে চল!

ছাদে আমার আর বিষ্ণুর একটা চমৎকার আড্ডা দেবার জায়গা আছে। বিষ্ণুদের বাড়ির পেছনে খানিকটা পোডড়া জমি, সেখানে তিনটে নারকোল গাছ তিন বন্ধুর মতন কঁধ ধরাধরি করে বেড়ে উঠেছে, বিষ্ণুদের ছাদও ছাড়িয়ে গেছে। ছাদের এক কোণে তারা চমৎকার ছায়া দেয়। সেই কোণটাতে মাঝে মাঝে ঘোর দুপুরেও আমি আর বিষ্ণু এসে বসি, বই পড়ি, দেশ-বিদেশের গল্প করি, কিংবা খাতা-পেনসিল নিয়ে কাটাকুটি খেলি। এক এক দিন ওখানে আমরা ঘুমিয়েও পড়েছি।

আজ রোদ নেই, আকাশে মেঘ। দূরবিন চোখে লাগিয়েও মেঘের মধ্যে আর কিছু দেখা যায় না। বহু দূরের দূরের বাড়ির ছাদ বেশ স্পষ্ট দেখা যায় অবশ্য, তবু আমি একটু নিরাশ হলাম। আমার আকাশ দেখার ইচ্ছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, মেঘ না থাকলে কি এতে স্বর্গ পর্যন্ত দেখা যায়?

বিষ্ণু আমার চেয়ে অভিজ্ঞ। সে হেসে বলল, ধ্যেত বোকা, স্বর্গ কি চোখে দেখা যায় নাকি? জ্যান্ত অবস্থায় কেউ স্বর্গ দেখতে পায় না–তা হলে তো সবাই দেখে নিত! তা হলে আর যুধিষ্ঠিরকে অত কষ্ট করতে হত না!

তখন তো দূরবিন ছিল না?

হ্যাঁ ছিল! পুষ্পক রথ ছিল, আর দূরবিন ছিল না? তা কখনও হয়?

তা হলে এটা দিয়ে চাঁদের পাহাড়ের চরকা বুড়িকে দেখা যাবে?

বিষ্ণু আমতা আমতা করে বলল, তা যেতেও পারে। তবে, সূর্য চাঁদ এসব দেখতে গেলেও আরও পাওয়ারফুল জিনিস লাগে। তাকে বলে টেলিসকোপ। বাবাকে বলব আমাকে একটা টেলিসকোপ কিনে দিতে!

আমি উৎসাহিত হয়ে বললাম, জানিস, আমি ভূগোলের বইতে পড়েছি, এখনও অনেক গ্রহ কিংবা ধূমকেতু আবিষ্কার করা হয়নি। যদি সে রকম একটা হঠাৎ দেখতে পাই?

বিষ্ণু বলল, বাবা টেলিসকোপ কিনে দিলে আমরা রোজ সন্ধেবেলা তাতে চোখ লাগিয়ে বসে থাকব! যদি সে রকম একটা গ্রহ আবিষ্কার করে ফেলি, তা হলে ভূগোলের বইতে তোর আর আমার নাম একসঙ্গে থাকবে। সেই গ্রহটার কী নাম দেব বল তো?

চট করে কোনও নাম আমার মনে এল না। বললাম, তুই বল তো!

যেন আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, এই ভাবে বিষ্ণু বলল, নাম দেব হৈমন্তী। হৈমন্তী কাকিমার নামে। হৈমন্তী কাকিমা তো হারিয়ে গেছে!

এ-নামে আমারও কোনও আপত্তি নেই। তৎক্ষণাৎ রাজি।

কী ভালো লাগছিল ছাদে দূরবিন চোখে লাগিয়ে বসে থাকতে। নারকোল গাছের চিরুনির মতন পাতাগুলো দুলছে, দুটো চিল মেতে উঠেছে ক্রমশ আরও উঁচুতে ওঠার প্রতিযোগিতায়। একটু একটু মেঘ সরে যাচ্ছে, আমি আকাশের দিকে চেয়ে আছি। হঠাৎ হয়তো চোখে পড়ে যাবে, ভাবা যায় না এমন এক দৃশ্য। মাঝখানটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠিক মতন ফোকাস করতে হয়, বিষ্ণু দেখিয়ে দিচ্ছিল।

এই সময় দুপদাপ করে রেণু আবার ছাদে এল। কাছে এসে বলল, দেখি, দেখি, আমাকে একটু দেখতে দাও!

আমরা কেউ রেণুর কথা গ্রাহ্য করলাম না। রেণু নাকি নাকি আবদারের সুর করে বলল, একবারটি দেখতে দাও না বাবা!

তারপর রেণু আর কোনও সুযোগের অপেক্ষায় না থেকে পাস করে আমার হাত থেকে কেড়ে নিল দূরবিনটা। চলে গেল ছাদের অন্য দিকে।

বিষ্ণু একেবারে আঁতকে উঠল। ব্যস্ত হয়ে বলল, এই, এই ভেঙে যাবে! শিগগির এদিকে আয়!

রেণু তখন সেটা চোখে লাগিয়ে গভীর মূনোযোগিনী। বলল, ভাঙবে না, বলছি ভাঙব না, আমি আগেও এটাতে দেখেছি!

বিষ্ণু এবার রেগে গেল খুব। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, রেণু ভালো হবে না বলছি, শিগগির দিয়ে যা! এক্ষুনি!

দাঁড়াও না বাবা! দেখা হয়নি!

রেণু, ভালো হবে না বলছি।

তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে রেণু সত্যিই সেটা ফেলে দিল হাত থেকে। ধড়াস করে উঠল। আমার বুক। ভাঙেনি অবশ্য, কিন্তু তাতেই বিষ্ণুকে মনে হল যেন ও শারীরিক ভাবে আঘাত পেয়েছে! ও আর ধৈর্য রাখতে পারল না। ছুটে গিয়ে ঠাস ঠাস করে চড় মারল রেণুকে।

রেণু একটুক্ষণ ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে রইল–তারপর ই-ই-ই শব্দ করে বিষ্ণুর ওপর আঁপিয়ে পড়ে ওকে আঁচড়ে কামড়ে দিতে গেল। বিষ্ণুও ওকে মারতে লাগল এলোপাথাড়ি, বড্ড বেশি। একসময় রেণু ডুকরে কেঁদে উঠল।

আমি ওদের কাছে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, বেশ রাগ হয়েছিল রেণুর ওপর। এখন রেণুর কান্না দেখে মায়া হল। রেণু বড্ড অসুখে ভোগে, দুর্বল শরীর–দুষ্টুমি করলেও ওকে বড় জোর মেরেছে বিষ্ণু। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, কঁদিস না রে! তোর বেশি লেগেছে! কেন ওটা নিতে গেলি! আচ্ছা, আমি বিষ্ণুকে বকে দিচ্ছি! এই বিষ্ণু, তুই কী রে, এত জোরে কেউ মারে?

বিষ্ণুর তখনও রাগ কমেনি। ধমকে উঠে বলল, ওকে আরও মারা উচিত। ও আমার সব জিনিসে হাত দেয়!

রেণু জিভ দেখিয়ে বলল, ই-ই। মারো তো দেখি!

বিষ্ণু সত্যি সত্যি রেণুকে আবার মারতে গেল। আমি ওর হাত মুচড়ে ধরে বললাম, কী হচ্ছে কী?

রেণুটা অদ্ভুত মেয়ে। হঠাৎ কান্না থামিয়ে আমার হাতটা ঠেলে দিয়ে ঝংকার দিয়ে বলল, আমার দাদা আমাকে মেরেছে, তাতে তোমার কী? বেশ করবে মারবে! তুমি কেন আমার দাদাকে বকবে?

আমিও অবাক, বিষ্ণুও অবাক। বিষ্ণু হো হো করে হেসে উঠে বলল, দেখলি তো!

রেণু তার পরও আমাকে বলল, তুমি আমার দাদাকে খবরদার বকবে না!

বিষ্ণু বলল, এই রেণু, তুই নিজে দুষ্টুমি করেছিস, আবার চোখ রাঙাচ্ছিস!

বেশ করব, আমার যা খুশি করব!

দিন দিন বড্ড অসভ্য হয়ে যাচ্ছিস! জ্যাঠাইমাকে বলে দেব! বাদল তোকে কত গল্পের বই পড়ে শুনিয়েছে।

ও-সব গল্প আমি আগেই জানি!

তুই ক্ষমা চা বাদলের কাছে। দোষ করলে ক্ষমা চাইতে হয়। বল আমি আর এ রকম করব না।

আমি বলব না। আমাকে আরও মারবে? মারো! পরবর্তী জীবনে এইসব ঘটনার উল্লেখ করে কত বার রেণুকে রাগিয়েছি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *