১৭. ইবনুন নাফিস (১২০৮-১২৮৮ খ্রি:)
জ্ঞান, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, শিল্প, সাহিত্য ও বিশ্ব সভ্যতায় মুসলমানদের যে শ্রেষ্ঠ অবদান রয়েছে তা আমরা অনেকেই জানি না। পাশ্চাত্য সভ্যতার ধারক ও বাহক এবং তাদের অনুসারীগণ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মুসলিম মনীষীদের নামকে মুসলমানদের স্মৃতিপট থেকে চিরতরে মুছে ফেলার জন্যে ইসলামের ইতিহাস এবং মুসলিম বিজ্ঞানীদের নামকে বিকৃতভাবে লিপিবদ্ধ করেছে। ফলে সঠিক ইতিহাস না জানার কারণে অনেকে অকপটে এ কথা বলতেও দ্বিধা করেন না যে, সভ্যতার উন্নয়নে মুসলমানদের তেমন কোন অবদান নেই। বরং চিকিৎসা বিজ্ঞানেও মুসলমানগণ অমুসলিদের নিকট ঋণী। কিন্তু এ উক্তি সঠিক নয়; বরং মিথ্যারও নীচে। এমন এক যুগ ছিল যখন মুসলিম জাতির মধ্যে আল্লাহ পাকের করুণায় ধন্য মানুষের জন্ম হয়েছিল। তারা জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রায় সকল ধারা বা শাখা প্রশাখা আবিষ্কার করে গিয়েছেন। তাঁদের মৌলিক আবিষ্কারের উপরই বর্তমান জ্ঞান বিজ্ঞানের অধিষ্ঠান।
মানবদেহ রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থা কে আবিষ্কার করেছিলেন? শ্বাসনালীর আভ্যন্তরীণ অবস্থা কি? মানবদেহে বায়ু ও রক্ত প্রবাহের মধ্যে ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার ব্যাপারটা কি? ফুসফুসের নির্মাণ কৌশল কে সভ্যতাকে সর্ব প্রথম অবগত করিয়েছিলেন? রক্ত চলাচল সম্বন্ধে তঙ্কালীন প্রচলিত গ্যালেনের মতবাদকে ভুল প্রমাণীত করে চিকিত্সা বিজ্ঞানে ১৩’শ শতাব্দীর বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন কে? এসব জিজ্ঞাসার জবাবে যে মুসলিম মনীষীর নাম উচ্চারিত হতে তিনি হলেন আলাউদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবনে আবুল হাজম ইবনুন নাফিস আল কোরায়েশী আল মিসরী। তিনি ইবনুন নাফিস নামেই সর্বাধিক পরিচিত।
তিনি ৬০৭ হিজরী মোতাবেক ১২০৮ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মস্থান দামেস্ক, মিসর না সিরিয়া এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে তাঁর নামের শেষে ‘মিসরী’ সংযুক্ত থাকায় তিনি মিসরেই জন্মগ্রহণ করেছেন বলে অনেকে মনে করেন। ইবনুন নাফিস তাঁর প্রথম জীবন অতিবাহিত করেন দামেস্কে এবং মহাজজিব উদ্দীন আদ দাখওয়ারের নিকট তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে এত ঝুপত্তি লাভ করেন যে, তৎকালীন সময়ে তার সমকক্ষ আর কেউ ছিল না।
তথ্য অনুসন্ধান ও আবিষ্কারের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। খলিল আসোকিদি তাঁর ‘ওয়াদি বিল ওয়াকায়াত’ গন্থে লিখেছেন, “ইবনুন নাফিস ছিলেন অতি বিশিষ্ট দক্ষ ইমাম এবং অতি উচ্চ শিক্ষিত বিজ্ঞ হাকিম।” মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাঁর অবদান সর্বাধিক। চিকিৎসা বিজ্ঞান ও আইন শাস্ত্রে অগাধ পান্ডিত্য লাভের পর তিনি কায়রো গমন করেন এবং সেখানে মাসরুবিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিকাহ (আইন) শাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত হন।
ইবনুন নাফিস মানবদেহে রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি, ফুসফুসের সঠিক গঠন পদ্ধতি, শ্বাসনালী, হৃৎপিন্ড, শরীর শিরা উপশিরায় বায়ু ও রক্তের প্রবাহ ইত্যাদি সম্পর্কে বিশ্বের জ্ঞান ভান্ডারকে অবহিত করেন। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান জগতে তিনি যে কারণে অমর হয়ে আছেন তা হলো মানবদেহে রক্ত চলাচল সম্পর্কে গ্যালেনের মতবাদের ভুল ধরিয়ে ছিলেন তিনি এবং এ সম্বন্ধে নিজের মতবাদ সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন। ইবনুন নাফিস তাঁর ইবনে সিনার কানুনের এনাটমি অংশের ভাষ্য শরহে তসরিহে ইবনে সিনা গ্রন্থে এ মতবাদ প্রকাশ করেন। তিনি ৫ জায়গায় হৃৎপিন্ড (Heart) এবং ফুসফুসের (Lungs) ভিতর দিয়ে রক্ত চলাচল সম্বন্ধে ইবনে সিনার মত উদ্ধৃত করেছেন এবং ইবনে সিনার এ মতবাদ যে গ্যালেনের মতবাদেরই পুনরাবৃত্তি তাও দেখিয়ে দিয়ে এ মতবাদের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, শিরার রক্ত এর দৃশ্য বা অদৃশ্য ছিদ্র দিয়ে ডান দিক থেকে বাম দিকের হৃদপ্রকোষ্টে চলাচল করে না; বরং শিরার রক্ত সব সময়েই ধমনী শিরার ভিতর দিয়ে ফুসফুসে যেয়ে পৌঁছায়; সেখানে বাতাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে শিরার ধমনীর মধ্য দিয়ে বাম দিকের হৃৎপ্রকোষ্ঠে যায় এবং সেখানে এ জীবনতেজ গঠন করে।
তিনি ফুসফুস এবং হৃৎপিন্ডের এনাটমি নিয়ে আলোচনা করেন। ইবনে সিনা এ্যারিস্টটলের মতবাদের সাথে একমত হয়ে হৃৎপিন্ডে ৩টি হৃৎপ্রকোষ্ঠ রয়েছে বলে যে মত প্রকাশ করেছেন তিনি তার তীব্র প্রতিবাদ করেন। এ্যারিস্টটল মনে করতেন যে, দেহের পরিমাপ অনুসারেই হৃপ্রকোষ্ট সংখ্যার কম বেশী হয়। তিনি এই মতকে ভুল বলে প্রমাণ করেন। তাঁর মতে হৃৎপিন্ডে মাত্র দুটো হৃৎপ্রকোষ্ট আছে। একটা থাকে রক্তে পরিপূর্ণ এবং এটা থাকে ডান দিকে আর অন্যটিতে থাকে জীবনতেজ, এটা রয়েঝে বাম দিকে। এ দুয়ের মধ্যে চলাচলের কোন পথই নেই। যদি তা থাকত তাহলে রক্ত জীবনতেজের জায়গায় বয়ে গিয়ে সেটাকে নষ্ট করে ফেলতে। হৃৎপিন্ডের এনাটমি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ইবনুন নাফিস যুক্তি দেখান যে, ডান দিকের হৃপ্রকোষ্ঠে কোন কার্যকরী চলন নেই এবং হৃৎপিন্ডকে মাংসপেশীই বলা হউক বা অন্য কিছুই বলা হউক তাতে কিছু আসে যায় না। বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ মতবাদটি সম্পূর্ণ বিজ্ঞান সম্মত বলে গৃহীত হলেও ইবনুন নাফিসকে বিজ্ঞান জগতে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।
ইবনুন নাফিস কেবল মাত্র একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানীই ছিলেন না; বরং তিনি সাহিত্য, আইন, ধর্ম ও লজিক শাস্ত্রেও অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি বহু বৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ২০ খন্ডে ইবনে সিনার বিখ্যাত গ্রন্থ কানুন ‘ এর ভাষ্য প্রণয়ন করেন। এতে তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের বিভিন্ন কঠিন সমস্যার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিভিন্ন রোগের ঔষধ সম্পর্কে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘কিতাবুশ শামিল ফিল সিনায়াত তিব্বিয়া’। গ্রন্থটি প্রায় ৩০০ খন্ডে সমাপ্ত হবার কথা ছিল কিন্তু তার অকাল মৃত্যুতে তা সম্ভব হয়নি। এ গ্রন্থটির হস্তলিপি দামেস্কে রয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে তিনি হিপোক্রেটস, গ্যালেন, হুনায়েন ইবনে ইসহাক এবং ইবনে সিনার গ্রন্থের ভাষ্য প্রণয়ন করেন।
তিনি হাদীসশাস্ত্রের উপরও কয়েকখানা ভাষ্য লেখেন। এছাড়া তিনি আরো বহু গ্রন্থ রচনা করেন যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে–আল মুখতার মিনাল আগজিয়া (মানবদেহে খাদ্যের প্রভাব সম্পর্কে), রিসালাতু ফি মানাফিয়েল আদাল ইনসানিয়াত (মানবদেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কার্য সম্বন্ধে)’, আল কিতাবুল মুহাজ ফিল কুহল (চক্ষু রোগ সম্বন্ধে), শারহে মাসায়েলে ফিত তিব্ব’, ‘তারিকুল ফাসাহ, মুখতাসারুল মানতেক’ প্রভৃতি।
তিনি ৬৮৭ হিজরী মোতাবেক ১২৮৮ খ্রীঃ কায়রোতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে সুস্থ করে তোলার প্রায় সকল চিকিৎসাই ব্যর্থ হয়ে যায়। অবশেষে মৃত্যু শয্যায় তার মিসর ও কায়রোর চিকিৎসক বন্ধুরা তাঁর রোগের প্রতিষেধক হিসেবে তাকে মদ পান করতে অনুরোধ করেন। মদ পান করলেই তাঁর রোগ সেরে যাবে বলে তারা পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি এক ফোঁটা মদ পান করতেও রাজি হলেন না। তিনি বন্ধুদেরকে উত্তর দিলেন, “আমি আল্লাহ পাকের দরবারে চলে যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমি চিরদিন এ নশ্বর পৃথিবীতে থাকতে আসিনি। আল্লাহ আমাকে যতটুকু ক্ষমতা দিয়েছেন আমি চেষ্টা করেছি মানুষের কল্যাণে কিছু করে যেতে। বিদায়ের এ লগ্নে শরীরে মদ নিয়ে আল্লাহ পাকের দরবারে উপস্থিত হতে আমি চাই না।”
অতঃপর ৬৮৭ হিজরীর ২১শে জিলকদ মোতাবেক ১২৮৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই ডিসেম্বর রোজ শুক্রবার সকালে এ মহামনীষী ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তিনি তাঁর একমাত্র বাড়ীটি এবং তার সমস্ত বইপত্র মনসুরী হাসপাতালে দান করে যান।