আবার কতকাল পরে ফেরা।
সব কিছু কেমন অচেনা লাগে। কিছুই যেন আগের মতো নেই। নতুন নতুন রাস্তাঘাট নতুন নতুন বাড়িঘর। মোহনগঞ্জ স্টেশনে নেমে আমিন ডাক্তারের চোখ ভিজে উঠল। কত পুরনো জায়গা, অথচ কত অচেনা লাগছে।
মোহনগঞ্জ থেকে এখন লঞ্চ যায় নিমতলি, সুখানপুকুর, ঘাসপোতা। গয়নার নৌকা নাকি উঠেই গেছে। লঞ্চে চেপে হুসহস করে লোকজন চলাফেরা করে। আমিন ডাক্তার লঞ্চের ছাদে চাদর পেতে বসে থাকে চুপচাপ। এই লঞ্চে করেই হয়তো কেউ কেউ যাচ্ছে নিমতলি আর সোহাগীতে, অথচ কাউকেউ চিনতে পারছে না।
গ্রামের পর গ্রাম পার হচ্ছে। আমিন ডাক্তার তৃষিতের মতো তাকিয়ে থাকে। বর্ষার পানিতে নদী ভরে গিয়েছে। ছেলেরা ঝাঁঝাঁপি করছে নতুন পানিতে। ঐ একটি নাইওরিদের নৌকা গেল। বৌটি ঘোমটার ফাঁক দিয়ে অবাক হয়ে দেখছে। আমিন ডাক্তারের চোখ দিয়ে জল পড়ে। বয়স হয়ে মন অশক্ত হয়েছে, অল্পতেই চোখে ভিজে ওঠে।
পেন্নাম হই। আপনে আমিন ডাক্তার না?
আমিন ডাক্তার অভিভূত হয়ে পড়ল। কানা নিবারণের সেই শক্ত সমর্থ শরীর আর নেই। মাথার মরকৃষ্ণ কালো চুল আজ কাশ ফুলের মত সাদা।
ডাক্তার সাব আমারে চিনছেন?
আপনেরে চিনতাম না? আপনেরে না চিনে কে?
ভগবান আপনের মঙ্গল করুক। আপনে কিন্তু ভুল কইলেন। আমারে এখন কেউ চিনে না। গান গাই না আইজ সাত বর। গলা নষ্ট, হাঁসের মত শব্দ হয়।
আমিন ডাক্তার স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।
মতি মিয়া এখন খুব বড় গাতক। চিনছেন? সোহাগীর মতি মিয়া। নয়খান সোনার মেডেল আছে। রেডিওতে নিয়া গেছিল। মিনিস্টার সাব তার সাথে ছবি তুলছে।
আপনে এখন করেন কী?
কিছুই করি না ভাই। পুরান লোকদের সাথে দেখা হইলে তারা টেকাপয়সা দিয়া সাহায্য করে। খুব অচল হইলে মতি মিয়ার কাছে যাই। আমারে খুব খাতির। করে।
শইল কেমন আপনের?
বালা না। হাঁপানি হইছে। সারা জীবন শইলের উপরে অত্যাচার করছি। শইলের আর দোষ কি?
কানা নিবারণ হোগলাপোয় নেমে গেল। হাত ধরে নামিয়ে দিতে গেল আমিন ডাক্তার। টিকিট করা ছিল না। লঞ্চের একটা লোক কী একটা গাল দিয়ে কানা নিবারণের সার্ট চেপে ধরতেই আমিন ডাক্তার উঁচু গলায় বলল, কার সাথে বেয়াদবি কর? জান এই লোক কে? গাতক কানা নিবারণ। ইনার মত বড়ো গাতক এই পিথিমীতে হয় নাই। কয় টেকা ভাড়া হইছে? আমার কাছ থাইক্যা নেও, আর ইনার পাও ধইরা মাফ চাও।
নিমতলি পৌঁছতে পৌঁছতে বিকাল হেয় গেল। কত পরিচিত ঘরবাড়ি। ঐ তো দখিনমুখি বটগাছ। এর নিচেই হাট বসে প্রতি বুধবার। ঐ তো উত্তর বন্দ। এমন ঘন কালকা পানি অন্য কোনো হাওড়ে নেই। বড়ো মায়া লাগে।
নিমতলি থেকে একটা কোয়া নৌকা নিল আমিন ডাক্তার। সন্ধ্যায়-সন্ধ্যায় পৌঁছবে সোহাগী। শক্ত বাতাস দিচ্ছে, সন্ধ্যার আগেও পৌঁছতে পারে। নৌকার মাঝি নৌকা ছেড়েই জিজ্ঞেস করল, আপনে কেডা গো? চিনা-চিনা লাগে?
আমি আমিন।
আমারে চিনছেন?
না, তুমি কেডা?
আমি কালাচানের ছোড পুলা–বাদশা মিয়া। আপনের কাছে লেহাপড়া শিখছি।
পা ছুঁয়ে সালাম করল বাদশা মিয়া। অনেক খবর পাওয়া গেল তার কাছে। আজরফ একজন সম্পন্ন চাষী এখন। দুটি মেয়ে তার বড় মেয়ের নাম আতাবানু। ইস্কুলে যায়।
ইস্কুল হইছে নাকি?
হ চাচা, টিনের চালা।
আমিন ডাক্তার চমৎকৃত হয়।
চৌধুরীর খবর কি?
দুই চৌধুরীই মারা গেছে। পাঁচ-ছয় বচ্ছর হয়। বৌটা চৌধুরীবাড়িতেই আছে। মতি চাচার খবর কিছু হুনছেন?
কিছু কিছু হুনছি।
খুব বড় গাতক হইছে। প্ৰত্যেক বছর এক বার কইরা আসে এই দিকে। গানের রেকর্ড হইছে মতি চাচার, পাঁচ টেকা কইরা দাম।
চৌধুরীর অবস্থা কেমুন এখন?
খুব খারাপ। জ্ঞাতি মামলা-মোকদ্দমা কইরা সব শেষ কইরা দিছে। পুত্ৰসন্তান তো কেউ ছিল না চৌধুরীর।
আরেকটি আশ্চর্য হওয়ার মত খবর দিল বাদশা মিয়া। নিখল সাব ডাক্তার অনুফাকে নিয়ে বিলাত চলে গেছেন। যাবার আগে অনুফাকে নিয়ে গ্রামে এসেছিলেন। এক রাত ছিলেন আজরফের বাড়ি।
মাইয়াটা কী যে সুন্দর হইছে চাচা, আর কী আদব-লেহাজ।
তার বাপের কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে?
নাহ্।
গ্রামে ঢুকবার মুখেই মিনার দেওয়া সুন্দর মসজিদ চোখে পড়ল।
পাকা মসজিদ দিছে কে রে বাদশা?
সরকার সাবরা দিছে। মৌলভি আছে মসজিদের। জুম্মার দিন মানুষের জায়গা দেওন যায় না। সুখানপুকুর থাইক্যাও মাইনষে নামাজ পড়তে আইয়ে।
আমিন ডাক্তার মতি মিয়ার বাড়িতে না গিয়ে চৌধুরীবাড়ি উঠল। তাকে অবাক করে দিয়ে চৌধুরীবাড়ির বৌ তার পা ছুঁয়ে সালাম করল। আগের সেই কঠিন পর্দার এখন আর প্রয়োজন নেই।
ভালে আছ মা বেটি?
ভালো আছি ডাক্তার চাচা।
দীর্ঘ এগার বছর পর আবার চৌধুরীবাড়ি খেতে বসল আমিন ডাক্তার। কেউ তো তাকে সারা জীবনেও এত যত্ন করে খাওয়ায় নি। বারবার চোখ ভিজে ওঠে। পান হাতে নিয়ে বৌটি আগেকার মত মিঠি গলায় বলল, পেট ভরছে চাচা?
ভরছে মা। শুকুর আলহামদুল্লিাহ।
খাওয়াদাওয়ার শেষে বাইরের জ্যোতায় এসে বসে থাকে আমিন ডাক্তার। বৌটি এসে বসে দাওয়ায়, এক সময় মৃদু স্বরে বলে, আপনার কথা ঠিক হইছিল চাচা।
কোন কথা?
আপনে যে কইছিলেন, ওর মাথার দোষটা সারব। মরবার এক বচ্ছর আগে সত্যি সারছিল। খুব ভালো ছিল। আমারে নিয়া আষাঢ় মাসে আমার বাপের দেশে বেড়াইতে গেছিল।
বৌটি চোখ মুছে একটি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল, আমারে নিয়া ময়মনসিংহ গেছিল। একটা হোটেলে আছিলাম। বাইস্কোপ দেখলাম ডাক্তার চাচা। আইজ আর চৌধুরীর উপরে আমার কোনো রাগ নাই।
বৌটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
কত পরিবর্তনই না হয়েছে সোহাগীর। একটা দাতব্য ডাক্তারখানা হয়েছে। সেখানে সপ্তাহে এক দিন এক জন সরকারী ডাক্তার এসে বসেন। অল্প বয়েস। মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেই এসেছেন। খুব নাকি ভালো ডাক্তার। এক ফোঁটা দেমাগ নেই শরীরে। গত বৎসরের বাঘাই সিনির সময় ছেলেপুলেদের সঙ্গে মিলে খুব নাচানাচি করেছেন।
শরিফার চলচ্ছক্তি নেই। বিছানায় রাত-দিন শুয়ে থাকতে হয়। অসম্ভব। বুড়িয়ে গেছে। কথাবার্তাও অসংলগ্ন।
আমিন ডাক্তার যখন বলল, দোস্তাইন, শরীলডা বালা? শরীফা শুন্যদৃষ্টিতে তাকাল।
আমি আমিন, আমিন ডাক্তার।
শরিফা চিনতে পারল না। খানিকক্ষণ চুপ থেকে চাপা গলায় বলল, এরা আমারে ভাত দেয় না। আমারে না খাওয়াইয়া মারণের ইচ্ছা। আজরফ হারামজাদারে সালিসি ডাইক্যা জুতা পিটা করণ দরকার। আপনে আজরফ হারামজাদারে একটা ধমক দিয়া যান।
দোস্তাইন, আপনে আমারে চিনতে পারছেন না?
আজরফ হারামজাদা ইন্দুর মারা বিষ কিন্যা রাখছে। পানির সাথে মিশাইয়া খাওয়াইতে চায়।
আজরফ মনে হল আমিন ডাক্তারকে হঠাৎ উদয় হতে দেখে ঠিক সহজ হতে পারছে না। কোথায় উঠেছে, কোথায় খাচ্ছে, কিছুই জিজ্ঞেস করল না। নিজের বাড়িতে এসে উঠবার কথাও বলল না। থেমে থেমে বলল, সোহাগীতে থাকবেন। নি ডাক্তার চাচা?
আর যাইয়াম কই ক?
ডাক্তারী কইরা তো আর কামাইতে পারতেন না। সরকারী ডাক্তার আছে এখন। বালা ডাক্তার।
ওখন আর কাজ-কামের বয়স নাই আজরফ। শইলডা নষ্ট হইয়া গেছে।
নুরুদ্দিন লম্বা-চওড়া জোয়ান হয়েছে। বাপের মতো লম্বা চুল ঘাড় পর্যন্ত এসেছে। আমিন ডাক্তার বলল, তুইও গান গাস নাকি নুরা?
জ্বী-না চাচা।
জংলা ভিটার ঘাটে যাস?
না চাচাজী, অখন আর যাই না।
আমারে লইয়া এক দিন জংলা ভিটার ঘাটে যাইস।
ক্যান চাচা?
দেখনের ইচ্ছা হইছে।
এই দীর্ঘ সময়েও জংলা ভিটার ঘাটের কোন পরিবর্তন হয় নি। জায়গাটির বয়স বাড়ে নি। আমিন ডাক্তার অবাক হয়ে দেখল, সেই ডেফল গাছটি এখনো আছে। নুরুদ্দিন লগি দিয়ে খুন্দা ঠেলছিল। সে হালকা গলায় বলল, জংলা ভিটায় মাইট আছে চাচা।
কে কইছে?
আমার মনে অয়।
খুন্দা এগুচ্ছে খুব ধীর গতিতে। ডেফল গাছের কাছের বাঁকটি পেরুতেই আমিন ডাক্তার বলল, এইখানে তুই একটা মেয়েমানুষ দেখছিলি। পানির মইধ্যে ভাসতে ছিল। হাতের মধ্যে লাল চুড়ি। তোর মনে আছে?
নুরুদ্দিন থেমে থেমে বলল, আছে চাচা। স্বপ্ন দেখছিলাম কিংবা চউখের ধান্ধা।
নুরুদ্দিনের অস্বস্তি লাগে। ফ্যাকাশেভাবে হাসে।
তুই ঠিকই দেখছিলি। স্বল্প-টপু না। আমি এই জিনিসটা নিয়া অনেক চিন্তা করছি। জেলখানাতে চিন্তার খুব সুবিধা আছিল রে নুরা।
নুরুদ্দিন চুপ করে রইল। আমিন ডাক্তার একটা সিগারেট ধরিয়ে কাশতে লাগল। কাশি থামিয়ে শান্ত স্বরে বলল, একটা কথা মন দিয়া শুন। মেয়েটার হাতভর্তি আছিল লাল চুড়ি। হাতভর্তি চুড়ি কোন সময় থাকে জানস নুরা?
নাহ্।
যখন নতুন চুড়ি কিনে। যত দিন যায়, তত চুড়ি ভাঙ্গে, আর কমে। কিছু বুঝতাছস?
নাহ্।
সোহাগীতে সেই বৎসর চুড়িওয়ালী আছিল শ্রাবণ মাসে। সব মেয়েরা চুড়ি কিনছে, তোর মাও কিছিল।
নূরুদ্দিন ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনে কইতেছেন মেয়ে সোহাগীর?
হ্যাঁ।
কিন্তু সোহাগীর কোনো মেয়ে তো মরে নাই চাচাজী।
মরে নাই কথাটা ঠিক না নুরা। বানের সময় সরকারবাড়ির একটা বউ নিখোঁজ হইছিল। কত খোঁজাখুঁজি করল, তোর মনে নাই?
আছে।
আমিন ডাক্তার চাপা স্বরে বলল, বানটা হইছিল কিন্তু জংলা ভিটার ঘটনার। তিন দিন পরে।
নুরুদ্দিন লগি হাতে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বহু কাল আগে থইরকল গাছ থেকে অসংখ্য কাক কাকা-কে উড়ে গিয়েছিল। আজও হঠাৎ চারদিক থেকে কাক ডাকতে লাগল। নুরুদ্দিন হাত থেকে লগি ফেলে দিল। আমিন ডাক্তার শান্ত স্বরে বলল, ভয় পাইছস নুরা?
পাইছি।
ভয়ের কিছু নাই। চল ফিরত যাই।
ফিরবার পথে আমিন ডাক্তার একটি কথাও বলল না। দক্ষিণ কান্দায় নৌকা বেঁধে দুজনে উপরে উঠে এল। আমিন ডাক্তার মৃদু স্বরে বলল, একটা খুব বড় অন্যায় হইছে সরকারবাড়িত। একটা মেয়েরে খুন কইরা ফালাইয়া রাখছিল জংলা ভিটাত। বুঝতামস তুই নুরা?
চাচা বুঝতাছি।
আমি ওখন কি করবাম জানস?
নাহ।
সরকারবাড়ির সামনের ক্ষেতটাত গিয়া বসবাম। বলবাম, আপনেরা একটা বড়ো অন্যায় করছেন। তার বিচার চাই।
আমিন ডাক্তার হেসে উঠল।
এক অপরাহ্নে আমিন ডাক্তার তার ধূলিধূসরিত লাল কোট গায়ে দিয়ে সরকারবাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। মানুষটি ছোটখাট, কিন্তু পড়ন্ত সূর্যের আলোয় তার দীর্ঘ ছায়া পড়ল। সন্ধ্যা এগিয়ে আসছে বলেই হয়ত সরকারবাড়ির সামনের প্রাচীন জামগাছ থেকে অসংখ্য কাক কাকা করে ডাকতে লাগল।
——–
আঞ্চলিক শব্দের অর্থ
মাইট – স্বর্ণমুদ্ৰাপূৰ্ণ কলসি। সাধারণত মাটির নিচে পোঁতা থাকে এবং আলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন (?) হয়ে থাকে। এরা নিজেরাই চলাচল করতে পারে।
খুন্দা – ঘাস-কাটা হোট নৌকা।
দোস্তাইন – বন্ধুর স্ত্রীকে ডাকার জন্যে ব্যবহৃত সম্মানসূচক সম্বোধন।
বাঘাই সিন্নি – নবান্ন জাতীয় উৎসব।
বারাবান্দানী – যারা ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে।
লারবড়শি – বোয়াল মাছ মারবার জন্যে ব্যবহৃত বড়শি। জ্যান্ত ব্যাঙ বা টাকি মাছের টোপ দিয়ে এই সব বড়শি সারা রাত পেতে রাখা হয়।
মা-খলা – মাছ শুকানর জন্যে ব্যবহৃত উঁচু জায়গা।
ফিরাইল – শিলাবৃষ্টির হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্যে এক শ্রেণীর বিশেষ মত্ৰশক্তিসম্পন্ন (?) ফকির।
জিরাতী – ভিনদেশী চাষী, যারা চাষ শেষ হলে ধান নিয়ে নিজ দেশে চলে যায়।
কান্দা – বাঁধ জাতীয় উঁচু জায়গা (প্রাকৃতিক)।
বন্দ – ফসলের বিস্তীর্ণ মাঠ। ভাটি অঞ্চলের বনগুলি বর্ষায় হাওড়ে পরিণত হয়।
পাইল করা – মাছ মারা বন্ধ রাখা। সাধারণত জলমহালগুলি দু-তিন বৎসর পাইল করার পর মাছ মারা হয়।
কেরায়া নৌকা – ভাড়া করা নৌকা।
জার – জাড়, অর্থাৎ শীত।
শরকি – বল্লম।
জালা – বীজতলার ধান।